শোভন সোম
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের আমলে, ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষে শিল্প-বিদ্যালয়গুলো প্রতিষ্ঠিত হয়। মূল উদ্দেশ্য ছিল, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ভারতীয়দের ছবি নকল এবং ছাঁচ নির্মাণের কাজে এমনভাবে দক্ষ করে তোলা, যাতে ক্রমবর্ধমান বিভিন্ন ঔপনিবেশিক জরিপ এজেন্সিগুলোর দাবি তারা মেটাতে পারে। চলতি ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভরশীল এবং ক্ষমতার প্রতি বশংবদ একটি শ্রেণি গড়ে তোলার উদ্দেশ্যেই ব্রিটিশ ভারতের সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থার ছাঁচটি নির্মিত হয়েছিল।
ঔপনিবেশিক শিক্ষার এই কর্মোন্নতির পেছনে ছুটে বেড়ানোর যে মনোভাব – তার বিরম্নদ্ধে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আমাদের কবি। তাঁর দর্শনে মানুষ নিছক কার্যকর একক নয়, সে আসলে সামাজিক একক। স্বীয় বোধশক্তির ক্ষমতাতেই মানুষ প্রকৃতি এবং শিক্ষায়তন থেকে লব্ধ বিভিন্ন ধারণাকে সূত্রায়িত করতে সমর্থ। বুদ্ধি, জ্ঞান আহরণ এবং নান্দনিক আবেগের প্রসারণ-ক্ষমতা – চিহ্নিত এই বৈশিষ্ট্যগুলো মানুষের মনে সৃষ্টিশীল আগ্রহের উদ্দীপনা সঞ্চার করতে পারে। এই সৃষ্টিশীল আগ্রহই প্রাকৃতিক, সামাজিক এবং আত্মিক – এই তিন নৈর্ব্যক্তিক পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে ক্রিয়াশীল এক শক্তি। ১৯০১ সালে পূর্ব ভারতের শামিত্মনিকেতনে কবি যে বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন, পরবর্তী সময়ে ১৯১৯ সালে সেই বিদ্যালয় একটি উদারমনা বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য ছিল, কর্মমুখী বাজার-চলতি শিক্ষার বিপ্রতীপে সব মানবিক ক্ষমতার বিকাশমুখী শিক্ষা।
সেই প্রথম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই ‘বিশ্বভারতী’ বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৃতির কোলে সৃজনশীল ক্ষমতা বিকাশের উপযোগী একটি সহায়ক পরিবেশ ভারতীয় ছাত্রদের সামনে উপস্থাপিত করেছিল। একেবারে নিজস্ব আর্থিক ক্ষমতায় বলীয়ান এই বিশ্ববিদ্যালয় ভারতবর্ষে সেই প্রথমবার কলার অন্যান্য বিভাগের সঙ্গে শিল্পকলাকেও উচ্চতর জ্ঞানের একটি বিষয় হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল।
তাঁর খ্যাতনামা ভাইপো শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্ভাবনাময় ছাত্র, তরম্নণ চিত্রকর নন্দলাল বোসকে তিনিই ১৯১৯ সালে শামিত্মনিকেতনে নিয়ে আসেন। সেখানকার নানদনিক পরিবেশের বিকাশ এবং শিল্প বিভাগ, যার নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘কলাভবন’ অর্থাৎ শিল্পের আবাসগৃহ, সেই কলাভবন সংগঠনের দায়িত্ব দেন নন্দলাল বোসকে। আমাদের সময়কালের সবচেয়ে দায়িত্ববান শিল্প-শিক্ষকদের অন্যতম নন্দলালের শামিত্মনিকেতনে যে অবদান তার সঙ্গে জার্মানির বাউহাউসের (Bauhaus) ওয়াল্টার গ্রোপিয়াসের অবদান তুলনীয়।
কলাভবনের ভ্রূণাবস্থায় ১৯১৯ সালে নন্দলাল সেখানে যোগ দেন। তাঁর সময়কালে কলাভবন ভারতের সবচেয়ে প্রাণচঞ্চল একটি শিল্পকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। ঠিক সেইভাবে ১৯১৯ সালেই ওয়াল্টার গ্রোপিয়াসকে জার্মানির হেইমারে অবস্থিত Hochsische for Bildende Kunst এবং Grossher Zogliche Sachsische Kunstge-werbeschule – এই দুটি শিক্ষায়তনের পরিচালক করে দেওয়া হয়। এদের তিনি একত্রিত করেন এবং তার নাম হয় Staatliche Bauhaus অর্থাৎ নির্মাণ ভবন। ১৯২৬ সাল পর্যমত্ম স্থায়ী তাঁর কর্মকালটি ইউরোপের শিল্পকলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরম্নত্বপূর্ণ কয়েকটি বছর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। দুর্ভাগ্য এই যে, ১৯৩৩ সালে হিটলারের জারি করা এক অধ্যাদেশ-বলে এই নির্মাণ-ভবন চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
নন্দলাল এবং গ্রোপিয়াস – কয়েক হাজার মাইলের ব্যবধান তাঁদের মধ্যে। এতদসত্ত্বেও তাঁরা দুজনেই নিজ নিজ সময়কালের পরিবেশ-পরিস্থিতি সম্পর্কে স্পষ্টত সচেতন ছিলেন। দুজনেই মনে করতেন সমাজ-অর্থনীতির পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে শিল্প-শিক্ষার প্রথাগত কাঠামো একেবারে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। ঘটনাচক্রে দুজনেই তাঁদের এই নতুন ধারণার ভিত্তিতে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। নিজের দেশের ঐতিহ্যবাহী প্রথাগুলোকে তাঁরা নতুন করে আবিষ্কার করেছিলেন। রাষ্ট্রীয়
নিয়ম-কানুনের বিপ্রতীপে তাঁরা সংবেদনশীলতার এমন একটি নতুন সত্মর সৃষ্টি করেছিলেন, যাতে শিল্পকে আরো একবার সমাজে প্রাসঙ্গিক করে তোলা যায়। রেনেসাঁসের পর থেকেই ক্রমশ ললিতকলা এবং ফলিতকলার মধ্যে যে মিথ্যা বিভাজন সৃষ্টি করা হয়েছিল, দুজনেই তাকে বর্জন করেছিলেন। মনশ্চক্ষে, কল্পনায় তাঁরা সমাজের পক্ষে একামত্ম উপযোগী একজন শিল্পী-কারিগরকে দেখেছিলেন – তিনি একজন সম্পূর্ণ মানুষ – নিজের চারপাশের জগৎ এবং মানুষজনের নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেওয়ার ক্ষমতা তাঁর আছে। গভীরতর সত্মরে বাসত্মবকে প্রতিফলিত করার মাধ্যম হলো শিল্প – দুজনের শিল্প-দর্শন ছিল এমনই। ব্যাপারটা মনে হতে পারে অদ্ভুত সমাপতন, কেননা প্রয়োগের ক্ষেত্রে দুজনের মধ্যে অনেক পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও দুজনের চিমত্মাভাবনাই একইরকমভাবে তাঁদের কাজের মধ্যে উদ্ভাসিত হয়েছিল। অথচ আদতে তাঁরা ছিলেন যোজন মাইল ব্যবধানে। এমনকি পরস্পরের কাজ সম্পর্কে তাঁদের কোনো ধারণাই ছিল না। ভারত এবং জার্মানি এই দুদেশের ঐতিহাসিক চালচিত্র একেবারে বিপরীত হওয়া সত্ত্বেও নন্দলাল এবং গ্রোপিয়াস দুজনেই তাঁদের প্রগতিশীল
ধ্যান-ধারণাকে শিক্ষাদানের মূল্যবান অভাসে নিয়োজিত করেছিলেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বসত্ম হওয়ার পর তখন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে আবার জার্মানির উত্থান ঘটছে। তার অস্ত্র ব্যবসা
ফুলেফেঁপে উঠছে, আর্থিক বিকাশের রেখাচিত্র ঊর্ধ্বমুখী। এই জীবনবিরোধী বিকাশকে বর্জন করল বাউহাউসের শিক্ষায়তন,
মানব-সমাজের প্রকৃত বিকাশের পথনির্দেশক সম্পূর্ণ ভিন্ন
সমাজ-অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য নানা পদ্ধতি ও মাধ্যম ব্যবহার করতে লাগল। বাউহাউসের এই আদর্শায়িত ধারণা প্রকৃতপক্ষে ইংলন্ডে উদ্ভূত প্রগতিশীল চিমত্মন ও বিচার-শৃঙ্খলের সর্বোচ্চ সত্মর। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংলন্ডে, তৎকালে সংঘটিত শিল্প-বিপস্নবের ফলস্বরূপ জনমানসে যে চাহিদা সৃষ্টি হয়েছিল, তার সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি সেখানকার শিক্ষায়তনগুলো। সেই ব্যর্থতা ব্রিটিশ পার্লামেন্টেও অত্যমত্ম সমালোচিত হয়েছিল। ফলিত এবং ললিত – দুই কলার মধ্যে এই যে বিভাজন তার বিরম্নদ্ধে ধর্মযুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন জন রাস্কিন এবং উইলিয়াম মরিস। কিন্তু বাকি কাজ সম্পাদনের দায়িত্ব নিয়েছিল বাউহাউস শিক্ষায়তন। ইউরোপের নানা এলোমেলো পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলোকে একটি সুসংহত পরিকল্পনার মাধ্যমে সামাজিক সত্মরে নির্ণায়ক পরিবর্তন ঘটানোর কাজকেই বাউহাউস অধিকতর গুরম্নত্ব দিয়েছিল।
রাস্কিনের সামাজিক কাঠামোয় শিল্পায়নকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল। মরিস মনে করতেন, মধ্যযুগীয় কারিগরদের সময়কালই হলো পবিত্র গ্রন্থ, কুৎসিত বাসত্মবের ছোঁয়াচ তার গায়ে লাগেনি। আরেকজন ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবী রজার ফ্রাই ১৯২২ সালে এক ব্যর্থ স্বপ্ন দেখেছিলেন – পঞ্চদশ শতাব্দীর ফ্লোরেন্সে যেমন হতো, সে রকম আমরাও শিল্পী গড়ার কারখানা (Bottega) থেকে উত্তীর্ণ শিল্পীদের সমাজে পেতে পারি। এসব বুদ্ধিজীবীর দৃষ্টিতে যন্ত্রনির্ভর শিল্পই সমাজের পক্ষে অভিশাপ।
শিল্প-বিদ্যালয়গুলোর যেমন শিল্পীদের প্রতি দায়িত্ব আছে, তেমনি শিল্পীদেরও দায়িত্ব আছে সমাজের প্রতি – প্রকৃতপক্ষে এই দৃঢ় সিদ্ধামত্ম ব্যক্ত করেছিলেন জার্মানির ব্রম্ননো পল। এ কথার পুনরাবৃত্তি করেছিলেন গ্রোপিয়াস। কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়াই যে শিল্পসমাজ-কাঠামোর অন্দরে আগ্রাসন চালিয়েছে সে-কথা বাউহাউসের শিক্ষাসংক্রামত্ম প্রসত্মাবনায় স্বীকার করা হয়েছে। অতএব এখন সমাজের প্রয়োজন সংগঠিত বৃদ্ধি, স্বচ্ছ নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং যুক্তিবাদের বিকাশ। বাউহাউস ঐতিহাসিক বস্ত্তবাদকে গভীরভাবে অনুধাবন করেছিল। শিল্পনির্ভর সংস্কৃতির নিয়ন্ত্রণে জীবনের যে নতুন নকশা ফুটে উঠছে তার কাজে লাগুক শিল্প – এই আকাঙ্ক্ষা ছিল তার। বাউহাউসীয় ধারণায় দৃশ্যমান (visual) শিল্পকলার চূড়ামত্ম লক্ষ্য এক সুসম্পূর্ণ নির্মাণ।
সংস্থার পরিচালক হিসেবে গ্রোপিয়াস চেয়েছিলেন, ‘ভবিষ্যতের নতুন নির্মাণ-পরিকল্পনা এবং সৃষ্টির কাজে শিল্পী এবং কারিগর উভয়ে একটি যূথবদ্ধ গোষ্ঠী হিসেবে কাজ করবে… একদিন আরো লক্ষ লক্ষ হাতের ছোঁয়ায় সেগুলি আকাশচুম্বী হয়ে উঠবে।’ রম্নশ বিপস্নবের সাফল্যে অনুপ্রাণিত গ্রোপিয়াস বিশ্বাস করতেন, সমাজের পুনর্সৃজনের কাজে শিল্পীরা একটি গুরম্নত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। নিজের ভাবনাকে কল্পনা এবং পরিকল্পনায় মূর্ত করার ক্ষমতা আছে একজন শিল্পীর। এই ক্ষমতাবলেই গোষ্ঠীজীবনকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে কিছু বিশেষ সুযোগ একজন শিল্পীর থাকে। বাউহাউসে শিক্ষাদান – এ কাজকে মনে করা হতো শ্রমদান। সর্বজনীন উদ্যোগে অভ্যাস এবং নিরমত্মর অভ্যাসের লক্ষ্যে উপনীত হওয়া আর এর উদ্দীপনা ও কারণকে বুঝে নেওয়ার উপায় এই শ্রমদান। যে কয়েকটি প্রধান উপাদানে শিল্প-বিপস্নবকে বিশেষিত করা হয় তার অন্যতম হলো, নতুন উৎপাদন ব্যবস্থায় একজন স্রষ্টা যেহেতু সমগ্র উৎপাদন-প্রক্রিয়ার শুধু অংশবিশেষ দেখতে পায় কিংবা সে-বিষয়ে জানতে পারে তাই যে বস্ত্ত সে উৎপাদন করে শেষমেশ সেই উৎপাদিত বস্ত্তর সঙ্গে তার বিচ্ছেদ ঘটে যায়। তদুপরি সমগ্র বস্ত্তটির ভিন্ন ভিন্ন অংশ উৎপাদনকারী শ্রমিকদের সঙ্গে নকশাকারের কোনো যোগাযোগ থাকে না। নিজের শ্রমোৎপাদিত বস্ত্ত থেকে শ্রমিকের এই বিচ্ছিন্নতার সম্পূর্ণ বিরোধী ছিল বাউহাউস শিক্ষায়তন। সেখানে যে পর্যায়ক্রমে কাঁচামাল শেষ পর্যমত্ম উৎপন্ন বস্ত্তর চূড়ামত্ম রূপ পায় সেই উৎপাদন প্রক্রিয়াটি
জেনে-বুঝে নেওয়া শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক ছিল, যাতে শ্রমিক হিসেবে তারা সম্পূর্ণ পরিবর্তন-প্রক্রিয়া সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানলাভ করে এবং নিজেদের মানসিক ক্ষমতা সেসঙ্গে উৎপন্ন বস্ত্তটির আরো বিকাশের জন্য নতুন নতুন চিমত্মাভাবনা চলতি প্রক্রিয়ায় যুক্ত করতে পারে। এই শিক্ষায়তনে শিক্ষার্থীরা অঙ্কন, ভাস্কর্য, স্থাপত্যকলা, নকশা এবং হসত্মশিল্পের সমন্বয়ে একটি সুসংহত শিক্ষাক্রম অনুসরণে অধ্যয়ন করত।
সুতরাং বাউহাউস উদ্ভূত আধুনিক এবং কার্যকর শৈল্পিক নকশার এই ধ্যান-ধারণা উৎপাদিত বস্ত্তর সামগ্রিক আদর্শটি বদলে ফেলার কাজে কোমর বেঁধে নেমে পড়ল। নকশাকারের দলই এখন হয়ে উঠল যন্ত্র-কারিগর – সাধারণের রোজকার সামগ্রীর জন্য উন্নত, ব্যবহারের উপযোগী অথচ নান্দনিক মনোরম নকশা তৈরি হতে লাগল। নিছক একজন কারিগর না হয়ে শিক্ষার্থীরা
আদর্শ-মান, সরলীকরণ এবং যুক্তিগ্রাহ্যতার বিষয়ে গভীরভাবে অনুধাবন করে উৎপাদনের হাতিয়ার এবং উপাদানকে ঠিকমতো ব্যবহার করতে শিখল। শিল্পকলা আর হসত্মশিল্পের সঙ্গে বাউহাউস যন্ত্রশৈলীকে সমন্বিত করল এবং তদানীমত্মন সময়কালে সৃজনশীল চিমত্মনের প্রগতিশীল প্রবণতার ক্ষেত্রে এই শৈল্পিক সমন্বয় মুখ্য আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠল। গ্রোপিয়াস ছাড়াও পল ক্লি, ওয়াসিলি ক্যানডিনস্কি, জোহানেস ইটেন, লিওনেল ফেইনিগের, জর্জ ন্যাস, অস্কার শ্চেস্নমের, গেরহার্ড মার্কস, লাজলো মোহলি, নাগি, মার্শেল ব্রম্নয়ের, হার্বার্ট বেয়ার, জোসেফ অ্যালবার্স এবং আরো অনেক শিল্পী – বিংশ শতাব্দীর আধুনিক শিল্পে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রয়েছে তাঁরাও বাউহাউসের শিক্ষক-কর্মচারী ছিলেন। বিশিষ্ট এক মতবাদ – এরই সপক্ষে তাঁরা কাজ করেছিলেন। মহতী নিষ্ঠায় সমাজের মধ্যে শিল্পকে প্রাসঙ্গিক করে তোলার জন্য নানা সূত্রায়ন করা হয়েছিল, যাতে প্রয়োজনের সামগ্রীর নান্দনিকতার ধাঁচটিই পুরোপুরি বদলে যায়। বাউহাউসের বহুবিসত্মৃত নকশায় স্থান পেয়েছিল – কাগজের নকশা থেকে টাইপ শিল্প, স্থাপত্যবিদ্যা থেকে আসবাব, গাড়ির মডেল থেকে চিনামাটির বাসন-কোসন, বয়নশিল্প থেকে আলোক আচ্ছাদন – আধুনিক সময়কালের দৃশ্যায়িত ভাষায় সবকটি পুরোপুরি উতরে গেল।
ঔপনিবেশিক সরকারের দেওয়া লোভনীয় পদে যোগ না দিয়ে নন্দলাল বোস চলে এলেন শামিত্মনিকেতন, এমন একটা কাজের দায়িত্ব নিয়ে নিলেন যাতে না ছিল উন্নতির আশা, না ছিল অর্থের বিপুল হাতছানি। কিন্তু নন্দলাল মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন কোনো অবস্থাতেই ঔপনিবেশিক সরকারের দাসত্ব করবেন না।
স্বাধীন দেশ জার্মানি। তার প্রতিতুলনায় সামমত্মতান্ত্রিক এবং ঔপনিবেশিক শোষণের চারণভূমি ভারতবর্ষের চালচিত্র সম্পূর্ণ আলাদা তখন। এ দেশকে সংস্কৃতিহীন করে তোলার যে প্রক্রিয়া তার ফসল ফলতে শুরম্ন করেছে আর ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণে শিল্পকলা সম্পূর্ণ উপেক্ষিত।
অবশ্য হাতেগোনা কয়েকজন ব্যতিক্রমী মানুষও ছিলেন। তাঁদের একজন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আমাদের কবি। নিজেও তিনি প্রথাগত স্কুলের পাঠ নেননি। কবি বিশ্বাস করতেন যে, উপযোগিতা এবং আত্মপ্রকাশ – এই দুই সমামত্মরাল রেখায় ছুটে চলছে মানুষের শক্তি – চাইছে মিলতে, মিশে যেতে … সত্য অর্থে মানুষের একটা পৃথিবী নির্মাণে – সত্য ও সুন্দরের এই প্রাণময় জগৎই শিল্পের স্বাভাবিক ক্রিয়া। সামগ্রিক শিক্ষার বিসত্মৃত ধারণার ভিত্তিতেই শামিত্মনিকেতনে তাঁর ‘বিশ্বভারতী’তে শিল্পকলা এবং কারিগরি শিল্পের একত্রিত চর্চার বিষয়টি গুরম্নত্বসহকারে বিবেচনা করা হয়েছে। তাঁর এ উদ্যোগে নন্দলাল এসে যোগ দিলেন এবং তারপর থেকে ১৯৫১ সাল পর্যমত্ম শামিত্মনিকেতনের শিল্পসংক্রামত্ম ক্রিয়াকর্মের পরিচালন-ভার রইল তাঁরই হাতে।
এর আগে মাদ্রাজ সরকারি শিল্প বিদ্যালয় (১৮৮৪-১৮৯২) এবং কলকাতা সরকারি শিল্প বিদ্যালয় (১৮৯৬-১৯০৬) – এই সময়কালে দুটি বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ হিসেবে আর্নেস্ট বিনফিল্ড হ্যাভেল পাঠক্রমে ললিতকলার সঙ্গে কারিগরি শিল্পকে যুক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। এসব বিদ্যালয় বিভিন্ন সরকারি এবং অন্যান্য বেসরকারি এজেন্সিতে প্রয়োজনীয় নকলনবিশের চাহিদা মেটাত। তাই সেখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের চাকরি নিশ্চিত ছিল। সে কারণে ললিতকলা এবং কারিগরি শিল্পের এই আনুপাতিক স্থিতাবস্থা টলে যেতে পারে কিংবা চাকরির সুযোগ হাতছাড়া হতে পারে, এমন কোনো পরিবর্তন স্থানীয় জনমানস মোটেই চাইত না।
পশ্চিম ভারতে হাতেগোনা কয়েকটি বয়নশিল্পের কারখানা, পূর্ব ভারতের কয়েকটি পাটকল এবং দুটি ইস্পাত কারখানা ছাড়া এই বিশাল দেশে সরকারি বা বেসরকারি মালিকানাধীন কোনো ধরনের কোনো কারখানা ছিল না। কৃষিকাজে এবং সুতো কারখানায় তখনো মধ্যযুগীয় কর্মপদ্ধতি বহাল। সর্বত্র পুরনো উৎপাদন প্রক্রিয়া রমরমিয়ে চলছে। সামাজিক এবং আর্থিক কোনোরকম পরিকাঠামো ছাড়াই রাতারাতি এই দৃশ্যপট বদল অসম্ভব ছিল। বিশেষত ঔপনিবেশিক ব্যবস্থাপনার বাসত্মব প্রেক্ষাপটে তেমনটাই হওয়ার কথা। সময়ের দাবি মেটাতে এবং কাজের অমত্মর্নিহিত অর্থের পুনর্নবীকরণে স্থানীয় হসত্মশিল্পীরা সম্পূর্ণ ব্যর্থ। আমদানি করা মোটা দাগের নিরেস সামগ্রীর উপর্যুপরি আগ্রাসনে তাদের এতদিনকার বাজার ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছিল।
নন্দলাল বুঝেছিলেন, কারিগরদের জন্য নতুন বাজার তৈরির চেষ্টা না করে তাদের কাজকেই শুধু গুরম্নত্বপূর্ণ করে তুললে পুরনোকে ফিরিয়ে আনার এই রোমান্টিক আন্দোলনে জোয়ার আসবেই। নতুন করে কারিগরদের মনে করিয়ে দিতে হবে যে, নকশার মূল কার্যনীতি হলো উদ্দেশ্যের সঙ্গে মানানসই হয়ে ওঠা। নন্দলাল পাঠক্রমে কারিগরি শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করলেন। প্রাচীন ঐতিহ্য অনুসারী কারিগর এবং ম্যুরাল চিত্রকরদের শিক্ষক হিসেবে, গাইড হিসেবে, সহকর্মী হিসেবে কাজ করার আমন্ত্রণ জানালেন, যাতে তাঁরা শিক্ষার্থীদের সামনে নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারেন, শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলো বুঝতে পারেন। তাঁর মনে হয়েছিল, শিল্পীরা যাঁরা নকশা তৈরি করছেন আর কারিগররা যাঁরা কারখানায় সেই নকশার ভিত্তিতে কাজ করছেন, পরস্পরের উপকারের জন্যই তাঁদের একসঙ্গে কাজ করা প্রয়োজন।
কোনো বাঁধাধরা কর্মসূচি ছাড়াই, এমনকি কোনো নির্দিষ্ট পাঠক্রম ছাড়াই শিল্প বিভাগ একটা স্টুডিও হয়ে উঠতে লাগল। শুধু একটি অমত্মর্নিহিত সুরে বাঁধা ছিল সবকিছু : ১. শিল্পের মূল ভিত্তি হওয়া উচিত প্রকৃতির অধ্যয়ন, যার অর্থ পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা; ২. ঐতিহ্য বা পরম্পরা সম্পর্কিত জ্ঞানের অর্থ ঐতিহাসিক বিকাশ বিষয়ে সচেতন থাকা; ৩. সৃষ্টির মৌলিকত্ব আসলে সৃজনশীল ব্যক্তিত্বের অভিব্যক্তি।
অঙ্কন, ভাস্কর্য, কারিগরি শিল্প, নকশা তার অলংকরণ – সবই শিক্ষার এই সুসংহত ধাঁচের মধ্যে একসূত্রে গাঁথা। ফলে বাইরের কোনো বিশেষ চাপ ছাড়াই শিক্ষার্থীরা ক্রমশ নিজেদের পছন্দসই বিশেষ একটি শিল্পক্ষেত্র স্বাধীনভাবে খুঁজে নেওয়ার ঢালাও সুযোগ পেত।
প্রায় সমসত্ম ভারতীয় উৎসবই ধর্মীয় উৎসব। ফলে নানা ধর্মবিশ্বাসী মানুষজন নানা উৎসব পালন করেন। এই সাম্প্রদায়িক উৎসবের পরিবর্তে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নতুন অ-সাম্প্রদায়িক উৎসবমালার প্রবর্তন করলেন শামিত্মনিকেতনে – যেমন, বৃক্ষরোপণ (গাছ লাগানোর উৎসব), হলকর্ষণ (জমিতে লাঙল দেওয়ার উৎসব), বর্ষামঙ্গল (বর্ষার আগমনী), বসমত্ম উৎসব (বসমেত্মর আবাহন) – এরকম আরো সব উৎসব। প্রকৃতির সঙ্গে মানবজীবনকে যুক্ত করা এবং এই সম্পর্ককে আরো একবার নতুন করে বুঝে নেওয়া – এই ছিল এসব উৎসবের উদ্দেশ্য। আর এদের জন্য প্রয়োজন ছিল নতুন অলংকরণ – নতুন নতুন ভাবনায় তাদের বিকাশ ঘটতে লাগল। মেঝে অলংকরণের চিরাচরিত ধর্মীয় রীতির বদলে প্রকৃতি থেকে নানা বিষয়বস্ত্ত নেওয়া হলো। অলংকরণের জন্য কাজে লাগানো হলো নানা অপ্রচলিত উপাদান। চলতি অমার্জিত মঞ্চসজ্জা যেখানে শুধু ভিক্টোরীয় যুগের রম্নচির প্রতিফলন, সেসব বাতিল করে নন্দলাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরম্ন করলেন – খোলা মঞ্চ, আধ-ঢাকা কিনারাওলা মঞ্চ, কোনো ভবনের সদর দরজার বাইরে ছাদওয়ালা পরিসর অথবা সার সার গাছ লাগানো পরিসর – এদের কাজে লাগানো। এভাবে চলতি নিরেস রীতি-পদ্ধতির বাইরে অন্যভাবে ভাবনা-চিমত্মা করতে তিনি আমাদের বাধ্য করতেন। তাঁর মঞ্চসজ্জায় স্থাপত্যের প্রশসত্ম তলগুলো অত্যমত্ম গুরম্নত্বপূর্ণ হয়ে উঠত এবং বিবিধ রঙের উদ্ভাসে বিভিন্ন মাত্রায় তারা উপস্থাপিত হতো। রঙিন সূচিশিল্পের কারিকুরিতে সৃষ্ট টুকরো টুকরো কাপড় প্রস্থের একঘেয়ে বিসত্মারকে ছিন্নভিন্ন করে দিত। ভারতের আধুনিক মঞ্চসজ্জা অনেকাংশেই নন্দলালের কাছে নান্দনিক ক্ষেত্রে ঋণী। রসকষহীন প্রোসেনিয়ম মঞ্চ আর মাঝে মাঝেই নাট্যে ছেদ টানার কৌশলের বদলে নাট্য-পরিস্থিতি অনুসারে হাজির হতো নানা ইঙ্গিতময় গতিবান মঞ্চসজ্জা। বিশেষ বিশেষ নাট্যমুহূর্ত তাদের উপস্থিতিতে আরো সান্দ্র হয়ে উঠত।
লন্ডন ক্রিস্টাল রাজপ্রাসাদের সূত্র কাজে লাগিয়ে গৃহনির্মাণের চিরাচরিত উপাদানের পরিবর্তে গ্রোপিয়াস তাঁর Fagus works building-এ ব্যবহার করলেন কাচ আর ধাতু। আসবাবে কাঠ আর বেতের স্থলে এলো টিউব আর কাপড়। অন্যদিকে শামিত্মনিকেতনে কিন্তু কারিগররা যেসব উপাদানে কাজ করতে অভ্যসত্ম তাদের পরিবর্তে অন্য কোনো নতুন উপাদান তাদের দেওয়া হয়নি। বরং এর বিপরীতে সেসব বহুব্যবহৃত উপাদানের উপযোগিতা-মূল্য প্রসারিত করার জন্য নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।
গায়ক-ভিখারিরা ছেঁড়া ন্যাকড়াকানি দিয়ে বানিয়ে নিতেন তাঁদের ঝুলি। সেখান থেকেই নতুন এক ভাবনায় নন্দলাল অত্যমত্ম কাজের একজাতীয় ঝোলাব্যাগ তৈরি করলেন। সেই ব্যাগ এখন সারা ভারতে দারম্নণ জনপ্রিয়। এই ব্যাগের উৎপাদন প্রক্রিয়া যাতে আরো সূক্ষ্ম এবং চরম কার্যকর হয়ে উঠতে পারে সেজন্য তিনি পূর্ব ভারতের বাসিন্দা নাগাদের ঐতিহ্যময় তাঁতযন্ত্র কাজে লাগালেন। শুধু কয়েকটি কাঠির সাহায্যে এই যন্ত্র চালানো যায়। অতএব, এই ঝোলাব্যাগের মধ্যে দুটি ঐতিহ্য, দুটি পরম্পরা মিলেমিশে গেল। সেইসঙ্গে রইল উপরিতলের আধুনিক নকশা এবং এর উপযোগিতা-মূল্যও বিসত্মৃত হলো। বেত আর বাঁশ দিয়ে তৈরি ঐতিহ্যময় গ্রাম্য টুল, যার চলতি নাম ‘মোড়া’, তাকেও বেশ ছিমছাম কার্যকর অথচ শিল্পিত কাঠামো দেওয়া হলো। তার ওপর রাখা হলো বসবার তাকিয়া। নকশা করা চামড়ার ঢাকনি দেওয়া তাতে। চামড়ার আসনওয়ালা এই চিরাচরিত মোড়া দেখতে হলো বেশ নতুন আর এর কার্যকর মূল্যও গেল বেড়ে। দেখতে না দেখতে শহুরে ফ্যাশনদুরসত্ম রম্নচির নজর কেড়ে নিল এই মোড়া।
আরো কয়েকটি হসত্মশিল্প, যেমন – শিল্প-গুণান্বিত চামড়ার কাজ, বাটিক আর ফ্রেসকো-বুয়োনোর মতো কারিগরি কৌশল সব কটিই শেখানো শুরম্ন হলো; কিন্তু একটু অন্যরকমভাবে। ফ্রেসকোর চিরাচরিত কলাকৌশল, লোকশিল্প এবং অন্যান্য কারিগরি
শিল্প-আঙ্গিক – এদের নতুন করে বাঁচিয়ে তোলা হলো – কাজে লাগানো হলো নানাভাবে। রবীন্দ্রনাথের পুত্র রথীন্দ্রনাথ এবং পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী চামড়ার শিল্পিত কাজ আর বাটিকের নানা কলাকৌশল ফ্রান্স ও ইটালি থেকে শিখে এলেন। এরপর উদ্ভাবিত হলো নতুন নতুন কার্যকর উৎপন্ন এবং চামড়ার ওপর নানা নকশা। যেমন, বাটিকের শ্রমসাধ্য এবং যান্ত্রিক ইন্দোনেশীয় পদ্ধতি কিংবা Resist Dyeing পদ্ধতি – এদের বদলে একটা খোলামেলা সহজ পদ্ধতি – অনেকটা চিত্রাঙ্কনের মতো। ধাতব চামচ আর কাঠের বস্নক দিয়ে বাটিকের নকশা ছাপার বদলে শিল্পীর তুলিতে সরাসরি কাপড়ের ওপর অাঁকা হলো নকশা। বাটিকের কাজ দেখতে একেবারে অন্যরকম হয়ে গেল। এই যে নতুন পদ্ধতি তৈরি হলো তাকে সবাই সাদরে গ্রহণ করল। ভারতীয় শিল্পী-কারিগরদের মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা এবং ভোক্তাদের রম্নচি-পছন্দ এসবের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই বাটিক এবং চামড়ার কাজের উৎপাদন-কৌশলে বদল আনা হলো। শিল্প-গুণান্বিত চামড়া শিল্প এবং বাটিক এখন টিকে থাকা হসত্মশিল্পের মধ্যে দুটি প্রধান শিল্প। নানা কার্যকর নকশার সঙ্গে সঙ্গে উপরিতলের জন্যও তৈরি হলো নানা নকশা। সে সময় ভারতবর্ষের শিক্ষিত মহিলারা এমব্রয়ডারি করতে পাশ্চাত্যের নানা লতাপাতার নকশা নকল করত। শামিত্মনিকেতনে কিন্তু চিরাচরিত ভারতীয় এমব্রয়ডারি সেলাই শিল্পে নতুন করে প্রাণ সঞ্চারিত হলো। প্রকৃতির নিজস্বতায় উদ্দীপিত নতুন নতুন নকশায় সমৃদ্ধ হলো এই প্রাচীন শিল্প। নতুন ধরনের আসবাবে, লোক হসত্মশিল্পে ঘরের ভেতর-পরিসরকে সাজানোর নতুন শৈলী খুঁজে পাওয়া গেল। অবশ্য কার্যকর এবং নান্দনিক সাফল্যের ওপর বিশেষ গুরম্নত্ব দেওয়া হলো।
আদ্দিকালের পুরনো বৈশিষ্ট্যকে অাঁকড়ে ধরার অভ্যাস না ছাড়লে শিল্পের প্রকৃত বিকাশ অসম্ভব। নতুন কোনো কিছুকে গ্রহণ করার ক্ষমতা যেন আমাদের থাকে – শিল্প আমাদের কাছে শুধু এটুকুই চায়। নতুন ভাবনা এবং আকারের নব নব সৌন্দর্যের প্রতি সংবেদনশীল যে হৃদয়, একমাত্র সে-ই প্রমাণ করতে পারে যে, সত্যিকারের গ্রহণযোগ্য যে-কোনো কিছুকে গ্রহণ করার ক্ষমতায় বলীয়ান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বাস করতেন যে, মানব-সংস্কৃতিতে বর্ণভেদের কোনো কাঁটাতার নেই; পরস্পরের সঙ্গে মিলেমিশে যাবার ক্ষমতা, নতুন নতুন বৈচিত্র্য উৎপাদনের ক্ষমতা মানুষের আছে। যুগ যুগ ধরে এই মিলনের উৎসব চলছে – মানব মনসত্মত্ত্বে নিবিড় সংহতির যে সত্য এ হলো তার প্রমাণ। অন্যসব সংস্কৃতির কাছে অসংখ্য কর্জ নিয়েও আমাদের সংস্কৃতির অমত্মর্বস্ত্ততে এমন কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য থেকেই যাবে, যাদের কারণেই সেটি হয়ে উঠবে ভারতীয়। এই ভারতীয়ত্বই হলো তার গভীর অমত্মর্বৈশিষ্ট্য – একেবারে অমত্মসত্মল থেকে এটি উদ্ভাসিত। কৃত্রিম কোনো আরোপিত আঙ্গিক নয় এটি। তাই অবাঞ্ছিত অনুপ্রবেশে যেমন একে নিশ্চিত করা যায় না, তেমনি অস্বাভাবিক প্রচেষ্টায় একে আত্মসচেতনও করে তোলা অসম্ভব। পৃথিবীর সব প্রামেত্ম উৎসারিত ভাবনাকে ঠাঁই দিয়েছিল কবির শামিত্মনিকেতন। তাই এটি হয়ে উঠেছিল শিল্প বিকাশের এক উন্মুক্ত উদার কেন্দ্র। শিল্প ও কারিগরির বিকাশ সাধনে পর্যটক শিল্পীরা অসংখ্য অবদান রেখে গেছেন। শিক্ষার্থীরাও এখান থেকে গেছেন বিদেশে, শিখেছেন নতুন পদ্ধতি, চিনেছেন নতুন নতুন শিল্পমাধ্যমকে – তাঁদের শিক্ষায়, নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ক্রমান্বয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে এই শিক্ষায়তন।
প্রথমে, ১৯১২ সালে রবীন্দ্রনাথ শামিত্মনিকেতন বিদ্যালয়ের এক ছাত্র নারায়ণ কাশীনাথ দেভালকে দর্শন অধ্যয়নের জন্য পাঠিয়েছিলেন ইংলন্ডে। কিন্তু দর্শনের বদলে কবির অনুমতি নিয়েই তিনি শিখে এলেন ভাস্কর্য। ১৯১৬ সালে শামিত্মনিকেতনের আরেক ছাত্র মুকুল চন্দ্র দে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গেলেন জাপান – জাপানি অঙ্কন শিল্প এবং কাঠখোদাই (wood-cut) চিত্রাঙ্কনের কারিগরি কৌশল শেখার জন্যে। সেই বছরই রবীন্দ্রনাথ একজন জাপানি শিল্পীকে কলকাতায় তাঁর পৈতৃক ভবনে পাঠালেন, যাতে জাপানি এবং ভারতীয় শিল্পীরা একত্রে কাজ করতে পারেন আর পারস্পরিক অভিজ্ঞতা বিনিময়ে উভয়েই সমৃদ্ধ হন। এরপর আরো অনেক জাপানি শিল্পী একের পর এক এখানে এলেন। ফলে ভারতীয় শিল্পীরা তাঁদের শিল্পশৈলী বিবিধ অভিমুখে বিসত্মৃত করে অত্যমত্ম সৃজনশীলতায় এই প্রক্রিয়ায় সাড়া দিতে পারলেন। এই
দেওয়া-নেওয়ায় উজ্জীবিত গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর তুলি আর কালি দিয়ে চিত্রাঙ্কনের একটা গুরম্নত্বপূর্ণ শৈলীর জন্ম দিলেন। নন্দলাল বোস নিজেও জাপানি ছবিতে রঙের যে সুস্পষ্ট প্রকাশ এবং তুলির স্বতন্ত্র ভাষা তাদের আত্মস্থ করে নিলেন। এচিংয়ের (Etching) কাজ শেখার জন্য মুকুল চন্দ্রকে আবার পাঠানো হলো যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯২৪ সালে, পূর্ব এশিয়ার নিকট ও দূরের শিল্প সম্পর্কে সরাসরি জ্ঞান লাভের জন্য রবীন্দ্রনাথ নন্দলালকে চীন ও জাপান নিয়ে গেলেন। ওই বছরেই রবীন্দ্রনাথ শামিত্মনিকেতনের শিক্ষক সুরেন্দ্রনাথ করকে পাঠালেন ইংলন্ডে, যাতে তিনি আধুনিক লিথোগ্রাফি করণকৌশল শিখে আসেন। ধীরেন্দ্রনাথ দেববর্মণ, বরিষ্ঠ ছাত্র তিনি, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গেলেন ইন্দোনেশিয়ায় – পরে লন্ডনের ইন্ডিয়া হাউসে ম্যুরালের কাজ করার বরাত পেলেন ধীরেন্দ্রনাথ। ১৯৩০ সালে শ্রমসাধ্য এবং খুবই জটিল Ukiyo-E কারিগরি অর্থাৎ জাপানের রঙিন কাঠখোদাই চিত্রাঙ্কন শিখে আসার জন্য বিশ্বরূপ বোসকে সে দেশে পাঠানো হলো। আরেকজন বরিষ্ঠ ছাত্র বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় গেলেন চীন এবং জাপান। ধীরেন্দ্রনাথ, বিশ্বরূপ, বিনোদবিহারী প্রত্যেকেই পরে শামিত্মনিকেতনে শিক্ষকতা করেন। এঁরা ছাড়াও কলাবিভাগের উন্নতির কাজে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং প্রতিমা দেবীরও সক্রিয় অবদান ছিল। যেসব বিদেশি শিল্পী এই সামগ্রিক উদ্যোগে সাহায্য করেছিলেন তাঁরা হলেন স্টেলা ক্রামরিশ, আন্দ্রে কার্পেলেস, লিজা ভন পোট, মার্গারেট মিলওয়ার্ড, ফ্রাইম্যান। স্টেলা ক্রামরিশ অল্পবয়সী গবেষক, তখন সবে কুড়ি পেরিয়েছেন, তিনি পড়াতে এলেন ‘শিল্পের ইতিহাস’। অর্থাৎ ভারতবর্ষে প্রথমবার, সেই ১৯২২ সালে ‘শিল্পের ইতিহাস’ একটি পৃথক বিষয় হিসেবে পাঠক্রমে যুক্ত হলো।
নন্দলাল এবং তাঁর সহকর্মী সুরেন্দ্রনাথ কর আমাদের স্থাপত্যের একটি নতুন রূপ দিয়েছিলেন। ভারতীয় চিরায়ত স্থাপত্যরীতিকে বিশেস্নষণ করে, স্থানীয় নিসর্গদৃশ্যের সাযুজ্যে তার মধ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ সর্বসমক্ষেত্রের (projected modile) আলম্বন স্থানে স্থানে তাঁরা যুক্ত করলেন। এভাবে একইসঙ্গে তাঁরা গ্রোপিয়াসের ধাঁচে নিরেস জ্যামিতিক বিন্যাস যেখানে ৯০০তে পরম্পরছেদী (criss-cross at 900) তারজালের আলম্বন – সেই শৈলী সরাসরি বাতিল করে দিলেন। কম উৎপাদন ব্যয়, উপযোগিতা এবং সৌন্দর্য – এই তিন ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত নন্দলালের নকশা। Bas-relief-এর কাজে কিংবা আলকাতরা-লাগানো বহিরাংশের অলংকরণে তিনি স্থানীয় সহজে যা মেলে সেই কাদামাটি ব্যবহার করেছিলেন। কাকে বলে লোকশিল্প, কী তার কারিগরি তারই নমুনা সহকর্মীদের দেখাতে নিজেই শামিত্মনিকেতনের ঠিক মাঝখানে কাদামাটির সুন্দর একটি ভাস্কর্য গড়লেন তিনি। তাঁর এই দৃষ্টামত্ম নান্দনিক ক্ষমতার উন্নতিতে অত্যমত্ম সহায়ক এক শক্তি হয়ে উঠেছিল।
নন্দলাল সবকিছুর নকশা করতে পারতেন – মঞ্চ থেকে শুরম্ন করে ভারতীয় সংবিধানকে ভাস্বর করে তোলা – যে-কোনো কিছুর নকশা। এমনই এক গুরম্ন ছিলেন তিনি। নকশার প্রতি তাঁর যে ভালোবাসা সে আসলে পারম্পর্য, সংহতি, সামঞ্জস্য এবং গড়নের প্রতি তাঁর আমত্মরিক ভালোবাসার অভিব্যক্তি। ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে তিনি ছোট-বড় যে প্রজেক্টেই কাজ করেছেন সেখানেই অলংকরণ ছিল আবশ্যকীয়।
Bas-relief-এর কাজ থেকে সারা ভারত কংগ্রেস অধিবেশনের সাজসজ্জা – এই ছিল প্রজেক্টের বিসত্মার। শিল্পকে কোনো একটি বিশেষ অভিজাত ক্রিয়াকর্ম ভাবতেন না নন্দলাল। তিনি মনে করতেন জীবনের একটি আবশ্যিক উপাদান শিল্প। নিজে সৃষ্টি করে ছাত্রদের সেটা দেখিয়ে শেখাতেন। ছাত্রদের উৎসাহিত করতেন, তারা যেন অপ্রচলিত নানা উপাদান, হাতের কাছে যা কিছু সহজে পাওয়া যায় সেগুলোই তাদের নকশায় কাজে লাগায়। ডেস্কের মধ্যে যে নমুনা আছে সেগুলোতেই তাঁর ছাত্ররা আটকা পড়েনি। চারদিকে চোখ খোলা রেখে ঘুরে বেড়ানো, প্রকৃতির নানা ঘটনাবলি উপভোগ করার স্বাধীনতা তাদের ছিল। যে-কোনো সময় তিনি তাদের ডেকে পাঠাতেন, চাক্ষুষ অভিজ্ঞতাকে গ্রাফিক্সের ভাষায় রূপ দিতে বলতেন। শেখানোর এই পদ্ধতি এমনিতে খুবই সহজ মনে হতে পারে। কিন্তু এ হলো অত্যমত্ম ব্যাপক এক পদ্ধতি, একেবারে ব্যক্তিগত সত্মরে এটি কাজ করে। প্রকৃতপক্ষে চাক্ষুষ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে মননকে জারিত করার এক প্রশিক্ষণ। শিক্ষক হিসেবে ছাত্রদের ঠিক পথে পরিচালিত করতেন বটে, কিন্তু ছাত্রদের কাজের মধ্যে প্রায় নাক গলাতেনই না। শিল্প যাতে ছাত্রদের ব্যক্তিত্ব প্রকাশের মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে, সেই প্রয়াসই ছিল তাঁর। কলাভবনের অন্য শিক্ষকদেরও কাজ করতে হতো – নিয়মিত ছাত্রদের সামনে কাজের আদর্শ উপস্থাপিত করার জন্য শুধু নয়; বরং তাঁদের কাজের পদ্ধতি দেখতে দেখতে ছাত্ররাও যাতে কিছু শিখতে পারে প্রধানত সেজন্য। সাদামাটা, সহজ-সরল বস্ত্তর নান্দনিক মূল্যকে তারিফ করতে শেখা, অন্য সভ্যতার শিল্পকর্মকে আবিষ্কার করা, গড়নের সৌন্দর্য আর মানুষের নৈপুণ্য যেখানেই নজরে আসুক না কেন তাকে সম্মান করা – এসব কাজে ছাত্রদের উৎসাহিত করা হতো। জীবন এবং পরিবেশের প্রতি ভালোবাসা ছাত্রদের মনে সঞ্চারিত করতেন তিনি।
সমসত্ম শিল্পী, শিক্ষক তথা পরিচালকরা একটি সুসংহত পরিবেশ-পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করতেন – শিক্ষাদান, নির্দেশ দেওয়া আর একই সঙ্গে নিজেদের কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে শেখা, উদ্ভাবন, ভাবনার বিনিময়, শিল্পের বিকাশের জন্য সম্ভাব্য সমসত্ম উৎস সন্ধান করে ফেরা। মিশনারিসুলভ এই উদ্দীপনায় নন্দলাল এবং তাঁর সহকর্মীরা কাজ করেছিলেন – বিনিময়ে কী পাবেন সে চিমত্মা তাঁরা করেননি – নিজেদের সৃষ্টিশীলতার উৎসারকে এমনই মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তাঁরা চিহ্নিত করেছিলেন যে, পরবর্তীকালে গোটা দুনিয়ায় শিল্পের অনেক গুরম্নত্বপূর্ণ
অগ্রগতি এর কাছে মস্নান হয়ে গিয়েছিল। এখান থেকেই
আত্মপ্রকাশ করেছিলেন আমাদের সময়কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাস্কর রামকিঙ্কর। ভারতীয় ভাস্কর্যের মধ্যে তিনি এক নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন : এ ছাড়া আরো অনেক মহান চিত্রকর,
ভাস্কর, নকশাকার, সংগঠক এমনকি আমাদের সবচেয়ে
প্রতিভাবান চিত্রপরিচালক সত্যজিৎ রায় আর সেইসঙ্গে একঝাঁক শিল্প-ইতিহাসবিদ।
সহকর্মী এবং ছাত্রদের মনে নানা ভাবনা উসকে দেওয়া ব্যতিরেকে নন্দলাল নিজেও অনেক কাজ করতেন – ম্যুরালের নকশা, মঞ্চ পরিকল্পনা, স্থাপত্য পরিকল্পনা; সুরেন্দ্রনাথ কর দেখতেন স্থাপত্য, উৎসব এবং অলংকরণের পরিকল্পনা, গ্রাফিক্স আর বই বাঁধাই; ম্যুরাল, গ্রাফিক্স আর নকশার দায়িত্বে ছিলেন বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়; পরিবেশ ভাস্কর্য আর নাটক – সেখানে রামকিঙ্কর; ম্যুরাল চিত্রাঙ্কনে ভি এস মাসোজি; নকশা, হাতের কাজ, রূপসজ্জা সেইসঙ্গে নৃত্যশিল্পেও কিছু সহায়তা করার ভার গৌরী দেবীর ওপর; জাপান থেকে কাঠখোদাই চিত্রাঙ্কনের কারিগরি আনলেন বিশ্বরূপ বোস। রূপচাঁদ গুঁই, ওখানকার একজন ঐতিহ্য অনুসারী কারিগর, তিনি শেখাতেন বার্নিশের কাজ; স্থানীয় এক গ্রামবাসী, শোকলা, তিনি শেখাতেন বই বাঁধাই। গ্রাম্যকুটিরের নির্জন জীবনযাপন থেকে সুকুমারী দেবী সংগ্রহ করে আনলেন চিরায়ত এমব্রয়ডারি করা কাঁথাশিল্প, দীর্ঘ লোক পরম্পরায় মেঝের অলংকরণ – আলপনা এবং আরো অনেক শিল্প। আন্দ্রে কার্পেলেস কাঠখোদাই চিত্রাঙ্কনের নানা করণকৌশল শেখাতেন এবং এরই সঙ্গে হসত্মশিল্প বিভাগের উন্নতির কাজেও সাহায্য করতেন। অত্যমত্ম উদারমনা ছিলেন নন্দলাল – বিভিন্ন করণকৌশল কাজে লাগিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার ঢালাও অনুমতি দিয়েছিলেন তিনি ছাত্রদের। ভারতীয়, দূরপ্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য কৃৎকৌশল এবং শিল্পের ইতিহাস – একই সঙ্গে সবকিছু জানার এবং শেখার সুযোগ পেত ছাত্ররা। সেমিনার, বক্তৃতা, নানা প্রদর্শনী নিয়মিত হতো – সবই ছিল শিক্ষাদানের অঙ্গ। শিক্ষামূলক ভ্রমণও প্রকারামত্মরে শেখানোর এক পদ্ধতি।
শ্রীনিকেতন, গ্রামীণ বিকাশ কেন্দ্র, সেটি বিকাশের কাজেও রবীন্দ্রনাথকে সাহায্য করেছিলেন নন্দলাল। সেখানে তিনি বয়নের নকশা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন, নান্দনিক মনোমুগ্ধকর নকশা এবং কম শ্রমসাধ্য পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। ঝকমকে রঙিন চিনামাটির বাসন-কোসনের ক্ষেত্রে, বাজার-চলতি জাপানি এবং ব্রিটিশ নকশার বদলে নতুন নতুন নকশা দিয়েছিলেন তিনি।
তাঁরই পরিচালনায় এবং উদ্ভাবনী উদ্দীপনায় শামিত্মনিকেতন আমাদের উপহার দিয়েছে – আধুনিক পরিবেশ-ভাস্কর্য, উন্মুক্ত স্থানে ম্যুরাল, আধুনিক মঞ্চ-কৌশল, ঘরের ভেতর সজ্জায় এবং উৎসবের অলংকরণে নানা ভাবনা, নতুন ধরনের ঘর-সাজানোর সামগ্রী, নতুন ক্যালিকো ছাপাই, আধুনিক প্রচ্ছদ, পুসত্মক অলংকরণ ও ছাপাই বিন্যাস, নতুন ধরনের চিনামাটির বাসন-কোসন, নতুন আসবাবপত্র আর একগুচ্ছ নতুন নতুন উদ্ভাবন – এতে শুধু জনসাধারণের নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গি উন্নতই হলো না, এর সঙ্গে কারিগরদের কাজেও নতুন উদ্দীপনা সঞ্চার হলো। এই নান্দনিকতা ক্রমেই সমগ্র জনজীবনের মধ্যে মিশে গেল।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শেস্নড অধ্যাপক থাকাকালে জন রাস্কিন তাঁর ছাত্রদের রাসত্মা সারানোর কাজে নিয়ে যেতেন। আর সাধারণ মানুষের দুর্দশায় নন্দলালের সেবাকাজ এখন প্রবাদ হয়ে গেছে। তিনি জনসাধারণের পাশে দাঁড়ানোর সামাজিক দায়িত্বভার ছাত্রদের দিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, তাঁর ছাত্ররা সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে উঠুক – এমন একজন মানুষ যে তার সমসত্ম কাজকেই সমাজের পক্ষে প্রয়োজনীয় করে তুলতে চায় – শুধু একজন শিল্পী হিসেবে নয়, একজন মানুষ হিসেবে যে-কোনো পরিস্থিতির মুখোমুখি যেন সে দাঁড়াতে পারে।
যুদ্ধ-পরবর্তী জার্মানির পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অতীতের নিগড় ভেঙে গ্রোপিয়াসের বাউমাউস আত্মপ্রকাশ করেছিল। সেই অবস্থায় চলতি কাঁচা উপাদানের বদলে গ্রোপিয়াস অন্য উপাদান আনতে বাধ্য হয়েছিলেন। স্থাপত্যকলায় এবং প্রতিদিনকার ব্যবহার্য সামগ্রীতে নকশার কার্যকরী বদল ঘটাতে হয়েছিল তাঁকে। অন্যদিকে পরম্পরানির্ভর ভারতবর্ষে হাতে তৈরি জিনিসের ক্ষেত্রে দরকার ছিল নতুন অভিমুখ, নতুনতর মাত্রা এবং বিসত্মার। নন্দলালের দৃষ্টিভঙ্গিতে, প্রতিটি হসত্মশিল্পী একজন স্ব-নিযুক্ত শ্রমিক এবং তাদের প্রত্যেকের বাড়িই একেকটি কারখানা। ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে আমজনতার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল আত্মপ্রত্যয় এবং স্বনির্ভরতা। ঘটনাচক্রে শামিত্মনিকেতনের কলাবিভাগে ছাত্রীদেরও ভর্তি করা হতো এবং শিক্ষকতার কাজেও মহিলাদের নিয়োগ করা হতো। ভারতবর্ষের কোনো কলা-শিক্ষায়তনে এই প্রথমবার এমন ঘটনা ঘটল। নন্দলাল বিশ্বাস করতেন যে, যেসব নারীর ঝোঁক শিল্পকলায় তাঁরা সুগৃহিণী হবেন এবং আর্থিক নিরাপত্তাও অর্জন করতে পারবেন। নতুন অভিমুখ এবং আরো বেশি কাজের সুযোগ সৃষ্টির জন্য সেই প্রথম কোনো
কলা-শিক্ষায়তনের পাঠক্রমে সূচিশিল্প এবং হসত্মচালিত তাঁত অমত্মর্ভুক্ত হলো। শ্রীনিকেতনের হসত্মশিল্প বিভাগ গ্রাম্য হসত্মশিল্পীদের শামিত্মনিকেতনের স্টুডিওতে তৈরি নকশা, নানা কর্মপদ্ধতি এবং প্রয়োগ-শৈলী সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিত।
বাউমাউস এবং শামিত্মনিকেতন – দুটি জায়গাতেই শিক্ষার ত্রম্নটি-বিচ্যুতি দূর করার চেষ্টা করা হয়েছিল। সরাসরি কোনো বিষয়কে তারা চিহ্নিত করেনি, বিপরীতে জীবনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার মানুষের যে স্বাভাবিক তৎপরতা তাকেই পাঠক্রমের শীর্ষে স্থান দেওয়া হয়েছিল। এই দুটি শিক্ষায়তন ঘটনাক্রমে একই সময়ে কাজ শুরম্ন করেছিল; কিন্তু তাদের দার্শনিক অভিজ্ঞতা ছিল একেবারেই আলাদা। শিল্পনির্ভর সমাজে একজন শিল্পীর অবস্থানকে চিহ্নিত করে বাউমাউস শিল্প-নকশার বিকাশে মেশিন ব্যবহার শুরম্ন করেছিল। আর শামিত্মনিকেতনের বিবেচনায় ভারতীয় প্রেক্ষাপটে হাতের ভাষা অনেক বেশি গুরম্নত্বপূর্ণ। হাতে তৈরি জিনিসের কদর যে এখনো খুব বেশি তার অর্থ হলো হাতের স্পর্শে মানুষে-মানুষে ভাব-বিনিময়। ভারতের গ্রামই হলো আসলে সমগ্র দেশ তাই এখানে পৃষ্ঠপোষকতার অর্থ হলো গ্রামনির্ভর ভারতীয় অর্থনীতিকে নৈতিক এবং আর্থিকভাবে সাহায্য করা।
গ্রোপিয়াসের চোখের সামনে একটি গণতান্ত্রিক দেশের ছবি ছিল, লাখ লাখ শ্রমিকের হাতে যে দেশ গড়ে উঠবে। বাউমাউসের উৎপন্ন দ্রব্য শেষাবধি পুঁজিবাদকেই সাহায্য করেছে, যাতে অংশগ্রহণের যৌক্তিক পরিবেশনে আরো বেশি মুনাফা নিংড়ে নেওয়া যায়। বাউমাউস যেহেতু অভিজাত বুদ্ধিজীবীদেরই আকর্ষণ করেছিল, তাই নিচের তলাকে ওপরে উঠিয়ে আনার জন্য তার যে চেষ্টা সেটি ব্যর্থ হয়েছিল। কাজ শুরম্ন করার মাত্র সাত বছর পরই ১৯২৬ সালে ক্রমশ বেড়ে ওঠা অসুবিধা আর ব্যক্তিগত আক্রমণের মুখে গ্রোপিয়াসকে বাউমাউস ছেড়ে চলে যেতে হয়। ১৯৩০ সালের গ্রীষ্মকাল পর্যমত্ম বাউমাউস চালান মেয়ের। এরপর তাঁর জায়গায় আসেন মিয়েক ভ্যান দের রোহে। ১৯৩২ সালে হেইমার থেকে শিক্ষায়তনটি বার্লিনে আনা হয়। তার পরের বছর হিটলারের বিশেষ নির্দেশনামায় এটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। গ্রোপিয়াস যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর কাজ চালিয়ে যান। তাঁর সঙ্গে যোগ দেন ফেইনিঞ্জার এবং মোহলি-নাগি। মোহলি-নাগি বাউমাউসকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। শিকাগোতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন নতুন বাউমাউস। কিন্তু সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
অন্যদিকে নন্দলাল বোস সমাজের একেবারে নিচের তলার বঞ্চিত মানুষের কাছ থেকেই তাঁর সমসত্ম ভাবনা, সমসত্ম উদ্দীপনা আহরণ করেছিলেন। শামিত্মনিকেতনে তাঁর বত্রিশ বছরের শিক্ষক জীবন তিনি অতিবাহিত করেছিলেন। তারপরও পনেরো বছর, তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যমত্ম তিনিই ছিলেন প্রেরণার মূল উৎস। আজো তিনি ভারতীয় শিল্পীদের অনুপ্রাণিত করেন।
নন্দলাল এবং গ্রোপিয়াস দুজনেই শিল্প-শিক্ষায়তনে যে মূল পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন সেটা হলো কোনো একটি ক্ষেত্রে বিশেষ দক্ষতা প্রদর্শন না করে – শিল্প এবং হসত্মশিল্প, শিল্প এবং সমাজ – এদের মধ্যে গভীর আমত্মঃসম্পর্ক গড়ে তোলা।
সাধারণ রম্নচি বিকৃতির বিরম্নদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন নন্দলাল।
শিল্প-শিক্ষায়তনের প্রথাসিদ্ধ রীতিকে অনুসরণ করতে অস্বীকার করেছিলেন। গভীর অমত্মর্দৃষ্টিতে তিনি তাঁর সময়কে অতিক্রম করে দূর ভবিষ্যতের সমাজকে দেখতে পেয়েছিলেন।
কিউবার হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত ভাষণের (১৯৮৭) বঙ্গানুবাদ : কাবেরী বসু