র বি উ ল হু সা ই ন
বাংলাদেশ একটি গ্রামপ্রধান দেশ। বর্তমানে শতকরা আশি ভাগ মানুষ গ্রাম বা পল্লিতে বসবাস করে। এই যে বিপুল পরিমাণের জনগোষ্ঠী তারা প্রধানত গ্রামে চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করে। দেশের জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশ অর্থাৎ ১২ কোটি মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। এবং তারা এইভাবে আবহমান কাল থেকে গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে জীবনযাপন করে আসছে। মূলত নগরায়ণের মাধ্যমে আমরা আধুনিক স্থাপত্যের যে দেখা পাই তা গ্রামে সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত। তবে তার মূল চিন্তাভাবনা গ্রামীণ বা লোকজ ধারা থেকেই উৎসারিত। একসময় মানুষ পাহাড়ের গুহায়, বনজঙ্গলে, বিশাল গাছের নিচে, কোনো জলাশয় বা নদীর ধারে গাছগাছালির ছাউনি দিয়ে বসবাসের ঘর বানিয়ে আশ্রয়স্থল নির্বাচন করত। কালে কালে সেইসব এক প্রয়োজনের ধারাবাহিকতায় একচালা থেকে দোচালা তারপর চারচালা-আটচালার ঘরে রূপ নেয় এবং আশ্চর্যজনকভাবে সেই পরম্পরা এখন পর্যন্ত চলে আসছে। এইসব আবাসস্থল গ্রামে প্রাপ্ত বা সংগৃহীত বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী বা উপকরণ দিয়ে নির্মিত বা তৈরি। কাঠামো তৈরিতে বাঁশ বা কাঠ, দেয়াল কাঠ, মাটি বা বাঁশের, মেঝে কাঠ বা মাটির, চাল বা ছাদ খড়ের, পরে ঢেউটিনের আচ্ছাদনে নির্মিত হয়ে আসছে। এইসব বাড়িঘর নির্মাণের ক্ষেত্রে তারা স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বয়ম্ভূ এবং স্বনির্ভর। একে অপরের সাহায্যে সমবায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে বাড়িঘরগুলো নির্মিত হয় নিজস্ব চাহিদা, শৈলী এবং চিন্তাভাবনা দ্বারা। সাধারণ নির্মাণসামগ্রী দিয়ে গ্রামবাসীরা আবহমান কাল থেকে অসাধারণ গঠন-কাঠামো, রূপ এবং ব্যবহারিকতাসহ যে গ্রামীণ বা পল্লিস্থাপত্যের মূল ধারা নির্মাণ করে আসছে, সেগুলোই আমাদের স্থাপত্যের ঐতিহ্য বা সংস্কৃতির গোড়ার কথা। আজ যে আমরা পশ্চিমি আবহাওয়ায় লালিত, পালিত এবং চিন্তিত এক তথাকথিত আধুনিক নগর স্থাপত্যের আবহাওয়া-প্রতিবেশে লালিত, পালিত ও ঋদ্ধবান হচ্ছি সেটি কখনো ওই পল্লিস্থাপত্যের মূল নির্যাসকে পাশ কাটিয়ে নয়, বরং চেতনে-অবচেতনে তার প্রভাব অগ্রসরমাণ স্থাপত্যের ওপর পড়ছে। গ্রামের একটি উঠোন ঘিরে চারদিকে চারটি দোচালা বা চারচালা ঘর, তার এক পাশে রান্না বা হেঁসেলঘর আর একটু দূরে প্রক্ষালন, স্নান বা বাইরের ঘর, পাশে নদীর ঘাট, পুকুর পাড় কিংবা ইঁদারা কুয়ো বা টিপকলের স্থাপনা – এইসব একীভূত হয়ে উঠোন, বৈঠকখানা, খাবার ঘর, পরিবার ঘর তারপর চারদিকের চারটি ঘর, প্রক্ষালন ঘরসহ চারটি কক্ষে রূপান্তরিত হয়ে আমাদের নগরসভ্যতার অন্যতম উপাদান ফ্ল্যাট বা কক্ষাবাস স্থাপত্যে রূপ নিয়েছে। গ্রামের নির্মাণ উপকরণ ছিল এবং এখনো তাই বাঁশ, কাঠ, মাটি, খড় বা টিন সেগুলো শহরে এসে ইট, সিমেন্ট, লোহা, বালি, কাচ ইত্যাদিতে দেখা দিলো। গ্রামে ছিল মাটিসংলগ্ন একতলা ঘর, শহরে এসে তা হলো চার, পাঁচ, ছয় বা বহুতল বিশিষ্ট একটি সুরম্য অট্টালিকা। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আধুনিক বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি আর পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার ব্যবহার। গ্রামে সেইসব বাড়িঘর একরৈখিকভাবে অনেক জায়গা এবং খোলামেলা পরিবেশ নিয়ে পঁচিশ বা তিরিশ পরিবারের জন্য বিসত্মৃত হয়েছিল, সেগুলো অনায়াসে নগরের একটিমাত্র বহুতলবিশিষ্ট দালানে স্থানসংকুলান করা সম্ভব হলো। সন্নিবেশ বা স্থাপনা সেই পল্লি বা গ্রামীণ কাঠামোর মূলধারা থেকে আহৃত হয়ে নগরস্থাপত্যে উন্নীত হয়েছে। লোকজ বা গ্রামীণ বা পল্লিস্থাপত্য আমাদের নগরস্থাপত্যের মূলে বিরাজ করছে এই তথ্য থেকে তা প্রমাণিত হয়। যে-কোনো শিল্পমাধ্যমের বেলায় একথাটি প্রযোজ্য। লোকজ শিল্পধারা থেকেই আধুনিক শিল্প পরিপুষ্ট ও ঋদ্ধবান হয়ে থাকে। সাহিত্য, সংগীত, নাটক, চিত্রকলা, ভাস্কর্য বা স্থাপত্য – সব শিল্পমাধ্যমের গোড়ায় এই লোকজ ধারার বলিষ্ঠ পদচারণা এবং উপস্থিতি। আমাদের উপমহাদেশের ক্ষেত্রে এই শিল্পধারার উত্তরণ এবং ক্রমান্তর ও উত্তরোত্তর অগ্রসরতা খুবই প্রণিধানযোগ্য। সেই হিসেবে আমরা সৌভাগ্যবান যে আমাদের এই অঞ্চল বা দেশে লোকজ শিল্পধারা এত বলিষ্ঠ এবং জীবন্ত হয়ে আজো বিরাজমান ও সেটি আধুনিক শিল্পমাধ্যমের একটি অফুরন্ত উৎস হয়ে আছে। কালের নিয়মে পশ্চিমি আবহাওয়ার ছোঁয়া অবশ্যই বৈশ্বিক বা আধুনিক শিল্পের মাধ্যমে দেশীয় শিল্পের ওপর প্রভাব বিস্তার করবে কিন্তু তা কতখানি এবং কতদূর পর্যন্ত। শিল্পে আঞ্চলিক বা দৈশিক বা লোকজ ধারা যা কি না মূলধারা হিসেবে দেশে দেশে বিবেচিত সেটিকে সম্পূর্ণভাবে পাশ কাটিয়ে বা বিসর্জন দিয়ে শিল্পসৃষ্টি কতখানি যুক্তিযুক্ত এই প্রশ্ন বর্তমানে প্রবল। বিশেষ করে ঔপনিবেশিক শাসনামল পেরিয়ে যেসব দেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে দেখা দিয়েছে, সেইসব দেশে প্রশ্নটি সঠিক উত্তরায়ণের পথ খুঁজে ফিরছে এবং একবাক্যে স্থির হয়েছে যে, শিল্পে দৈশিক বা লোকজ বা স্বকীয় নিজস্ব পরিচয়ে পরিচিহ্নিত হওয়া প্রকৃত শিল্পসৃষ্টির অন্যতম শুধু নতুন নয়, তা চিরকালের মাপকাঠি, সেটিকে এড়িয়ে যাওয়ার অর্থই হচ্ছে প্রকৃত শিল্পমানের অবনতি, যা কখনো শিল্পমাধ্যমে বিবেচিত হতে পারে না। আমাদের সব শিল্পমাধ্যমের বেলায় কথাটি প্রযোজ্য। স্থাপত্যশিল্পের বেলায় কথাটি সঠিক তো বটেই। ব্যবহারিক উপযোগিতার ক্ষেত্রে গ্রামীণ স্থাপত্যের পরোক্ষ প্রভাব আধুনিক স্থাপত্যে সূক্ষ্মভাবে দেখা যায়, যেখানে আমাদের জীবনযাপনের পদ্ধতি ও প্রণালী মূল হিসেবে বিবেচিত। পরিবারের পর্দানশীলতা, বৈঠকখানা এবং অতিথিঘর মূল অন্দরমহল থেকে আড়াল করা, পরে প্রযোজনমতো কোনো পারিবারিক উৎসবে আবার সেই একই পরিসরকে একীভূত করে বিসত্মৃত করা – এইরূপ সুবিধা ভোগের নিশ্চিতকরণ একটি গ্রামীণ স্থাপত্যনির্ভর আবাসস্থল থেকে যা কিনা মূলধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, তা নগর বা আধুনিক স্থাপত্যনির্ভর আবাসগৃহের ক্ষেত্রেও অনুসরিত হয়। এছাড়া গঠনগত আকার বা রূপও খুব গুরুত্বপূর্ণ। দোচালা বা চারচালা ঘরের ঢালু খড়ের বা টিনের ছাদ নগর বা আধুনিক স্থাপত্যেও অন্যতম মূল রূপ-কাঠামো হিসেবে দেখা যায়। গ্রামের চারচালা বা আটচালার বাংলা ঘর থেকে ইংরেজরা তাদের ‘বাংলো’ নির্মাণ করেছিল। চারদিকে টানা বারান্দা, মাঝখানে ব্যবহার্য কক্ষসমূহ এবং ওপরে ঢালু ছাদ, যে কাঠামো মৌসুমি বা উষ্ণ আবহাওয়াযুক্ত দেশের জন্যে একটি উপযুক্ত ও সঠিক রীতি তা এখন পর্যন্ত অনুসরিত হয়ে আসছে। এইরূপে প্রমাণ করা যায় যে লোকজ মূলধারা থেকে উপাদান, গঠন, রূপারোপ, উপযোগিতা, সামঞ্জস্য ইত্যাদি নিয়ে আধুনিক বা নগর স্থাপত্য নির্মাণ করা যায় এবং তা একটি সঠিক পদক্ষেপ, আর এটিই হচ্ছে স্থাপত্যে দেশজ স্বরূপ অন্বেষণের ফসল ও সুফল। এই প্রক্রিয়া বহমান থাকা প্রয়োজন। স্থপতিদের অন্যতম দায়িত্ব এই শিল্পসৃষ্টি নতুন নতুন রূপে যাতে প্রকাশিত হতে পারে তার জন্যে মূলচিন্তাটা মনে নিয়ে স্থাপত্যশিল্প চর্চা করা। কিন্তু মজা হচ্ছে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রাপ্ত ডিগ্রিধারী স্থপতিরা প্রায় কখনো পল্লিস্থাপত্যধারা অনুযায়ী বাড়িঘর নির্মাণের সুযোগ পান না, যেহেতু গ্রামবাসীদের পক্ষে স্থপতিদের সেবা গ্রহণ করার কোনো পথ নেই। তাঁদের প্রয়োজন তাঁরাই মেটান এবং নিরসন করেন। আমাদের পল্লিস্থাপত্যের স্থাপনা ও গঠনারোপে খনার সেই অবিনশ্বর বচন আজো বহমান, যা ব্যবহারিক ও উপযোগিতার বিবেচনায় একটি স্থায়ী নির্দেশিত রীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এবং আবহমান কাল থেকে গ্রামবাসীরা তা অনুসরণ করে আসছেন। খনার শেস্নাক বা বচনটি নিম্নরূপ :
দখিন দুয়ারী ঘরের রাজা,
পূর্ব দুয়ারী তারই প্রজা,
পশ্চিম দুয়ারীর মুখে ছাই,
উত্তর দুয়ারীর খাজনা নাই।
আপামর গ্রামবাসী প্রাগুক্ত বচনটি বাড়ি তৈরি এবং তা স্থাপনার বিষয়ে বেদবাক্য হিসেবে বিবেচনা করে। দক্ষিণমুখী ঘরই হলো শ্রেষ্ঠ। যেহেতু আমাদের দেশে বাতাস দক্ষিণ দিক থেকে আসে। উষ্ণ আবহাওয়াযুক্ত অঞ্চলে মুক্ত প্রবাহিত বাতাসযুক্ত খোলামেলা আবাসগৃহ স্বাস্থ্যসম্মত এবং বসবাসের জন্যে আরামপ্রদ। সেইজন্যে দক্ষিণমুখী ঘরের কোনো তুলনা নেই। এরপরে আসে পূর্বমুখী ঘর। কেননা পূর্ব দিক থেকেও এদেশে বাতাস আসে। পশ্চিমে যেহেতু সবসময় প্রায় সূর্যের আলো বা রোদ পড়ে তাই তা প্রায়শ গরম বা উষ্ণ হয়ে থাকে, সেইজন্যে পশ্চিম দুয়ারী ঘর না করাই উত্তম এবং তাই এমন অবস্থার মুখে ছাই। উত্তর দুয়ারী ঘর মন্দের ভালো। শীতকালে যখন উত্তর দিক থেকে বাতাস আসে তখন তা হয়ে ওঠে বেশ ঠা-া এবং বসবাসের জন্যে কষ্টকর, তাই এই ধরনের স্থাপনায় ঘর বানালে তার খাজনা নেই। আবার এইসব সমস্যার বিপরীতে পশ্চিম দিক থেকে রোদের তাপে ঘর গরম হলে তার সমাধানও খনা তার প্রবচনে দিয়েছেন এইভাবে –
পুবে হাঁস।
পশ্চিমে বাঁশ।
যেহেতু পুব দিক থেকে বাতাস আসে সেইহেতু ঘরের এইদিকে এমন জলাশয় থাকতে পারে যেখানে হাঁস পানিতে সাঁতার কাটবে, হাঁস এখানে জলাশয়ের প্রতীক, তার ওপর দিয়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে পুবের বাতাস বয়ে নিয়ে আসবে ঠাণ্ডা আবহাওয়ার পরশ, যা গরমে বসবাসকারীদের পক্ষে হবে আরামদায়ক এক পরম পাওয়া।
এছাড়া পল্লিস্থাপত্যের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে, সেটি হচ্ছে, বসবাসগৃহ স্থাপনা ও নির্মাণের সঙ্গে নিসর্গ রচনার নিবিড় যোগাযোগ। চারদিকে গাছগাছালিবেষ্টিত মনোরম পরিবেশ এবং সেইসব গাছের প্রতিটি প্রয়োজনীয়। শহরেও সেই চিন্তা অনুসৃত হয়, তবে তা দৃশ্যশোভন ফুল ও অন্যান্য গাছ দ্বারা, এর বদলে গ্রামে থাকে রকমারি ফল, বাঁশ ও বহুবিধ ঔষধি ও দরকারি বৃক্ষসমূহ।
পশ্চিমের গরম রোদ এবং তার উষ্ণ আঁচ ঠেকাতে ঘরের সেইদিকে রোপণ করা হবে বাঁশের ঝাড় বা বাগান, যাতে ঘরটি রোদ থেকে পরিত্রাণ এবং ছায়া পায়। গ্রামে গ্রামে আজো এমনিভাবে খনার এই অবিস্মরণীয় স্থাপত্যবিষয়ক প্রবচন অনুসারে ঘর তৈরি ও স্থাপনা করা হয় এবং সেই ধারাবাহিকতা আজো চলছে। আশ্চর্যের বিষয়, খনার বচনটি শুধু যে গ্রামের জন্যেই একমাত্র অনুসরণযোগ্য তা নয়, আমরা শহরে দালান বা আবাসিক গৃহনির্মাণেও এই রীতি যথাসম্ভব মেনে চলি। শহরের কোনো জমিতে সুইমিং পুল বা সাঁতার কাটার জলাশয় স্থাপনের খনার বচন অনুযায়ী, যা দেশীয় আবহাওয়া আর জলবায়ু অনুযায়ী নির্দিষ্ট সেটি সাধারণত পূর্ব দিকেই স্থাপনা করা হয়। পুবের হাঁসের বদলে মানুষই সেখানে সাঁতার কাটে।
একটি দালানের দক্ষিণ এবং পূর্ব দিকে সাধারণত স্থপতিরা শোবারঘর স্থাপন করতে চেষ্টা করেন। মালিকের শোবারঘরটি সবচেয়ে ভালো জায়গা দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বসানোর চেষ্টা করেন একটি প্রশস্ত বারান্দাসহ। পশ্চিম দিকে সিঁড়ি, রান্নাঘর ইত্যাদি দেওয়া হয়ে থাকে, যেহেতু ওই দিকে রোদ পড়ে বেশি এবং তাই উষ্ণতা রোধ করা যায় সেইভাবে। এইভাবে খনার প্রবচন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমাদের লোকজ ও আধুনিক স্থাপত্যে প্রভাব ফেলে আসছে। তাই বলা যায় যে, আধুনিক বা নগর স্থাপত্যের মূলে আছে আমাদের ঐতিহ্যবাহী লোকজ স্থাপত্যের সরাসরি প্রভাব। স্থপতিদের তাই সেই ঐতিহ্য থেকে খুঁজে বের করতে হবে নতুন নতুন স্থাপত্যশিল্প সৃষ্টির মূলধারা, যার সাহায্যে রচনা করা যাবে আমাদের নিজস্ব দৈশিক স্থাপত্যের স্বরূপ এবং তা হবে প্রকৃতপক্ষে আধুনিক বাঙালি স্থাপত্যশিল্পের প্রধান পরিচয়।
বর্তমানের ক্রমবর্ধমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং ডিজিটাল-বৈদ্যুতিন যুগে আধুনিক বা সাম্প্রতিক স্থাপত্যের রূপ প্রায় সব দেশেই এক হয়ে দেখা দিচ্ছে। এর মূলে আছে নির্মাণসামগ্রী ও নির্মাণরীতির সাযুজ্য। আগে দেশজ বা অঞ্চলভিত্তিক সামগ্রী, যেমন আমাদের দেশের ইট ও টালি নির্মাণে এবং তা থেকে শিল্পকর্ম পোড়ামাটির ম্যুরাল বা টেরাকোটা দেয়াল চিত্রে দেখা যেত, যা এক গৌরবময় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সভ্যতার প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত। এটি পরিবর্তিত হয়ে সিমেন্ট, লোহার রড, কাচ, বিভিন্ন ধরনের টাইলস, কাঠের বদলে পারটেক্স, স্টেনলেস স্টিল, অ্যালুমিনিয়ামের বর্ণিল পাত, স্টিলের নির্মাণ কাঠামো – খুঁটি, বিম ইত্যাদি সব জায়গাতে একইরকম এবং শিল্পকর্মে মার্বেল বা লোহা বা সিমেন্টের দেয়াল চিত্র-ভাস্কর্যেও তেমনটি। সেভাবে ভিন্ন ভিন্ন আঞ্চলিক রূপ আর দেখা না গিয়ে এক বৈশ্বিক একীভূত রূপ পরিলক্ষেত হচ্ছে। বর্তমানে প্রশ্নটি খুবই প্রাসঙ্গিক, যেহেতু আমাদের কোনদিকে অগ্রসর হতে হবে তা জানা। এর উত্তরে বলা যায়, বর্তমানের পুঁজিবাদী জাতীয়তাবাদী, ডানপন্থা রাজনীতি ও সমাজের দেশে প্রদর্শনবাদের যে দৃশ্যমান জয়জয়কার, বিশেষ করে চীন, জাপান, তেলসমৃদ্ধ আরব ও মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে যা গড়ে উঠেছে এবং উঠছে আমেরিকা-ইউরোপীয় স্থপতি ও প্রকৌশল উপদেষ্টা সংস্থার সাহায্যে, তার সীমাহীন পরিবেশ ও প্রকৃতি-বিরুদ্ধ অসুস্থ প্রতিযোগিতা কখনো সমর্থন করা যায় না। এর বদলে বিশ্বরূপটিকে প্রবল, শক্তিশালী, অপরিহার্য বা একমাত্র একদর্শী না করে এর সঙ্গে দেশজ ও আঞ্চলিকতাকে মিশিয়ে যে মিশ্র বা যৌগিক রূপ পাওয়া যায় সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করা, দরকার হয়ে পড়েছে যেটাকে বলা যেতে পারে বিশ্বাঞ্চলিক যৌগিকতা। তবে প্রয়োজনে সব শিল্পেরই পরিবর্তন হয়, একথা অনস্বীকার্য। আমাদের মতো একদা প্রাচ্যদেশীয় ঔপনিবেশিক শক্তিশাসিত দেশগুলোতে শিল্পী-স্থপতিদের জন্য এটি খুব জটিল এক প্রশ্ন ও সমস্যা, যা পশ্চিমিদের নেই। কৃষিনির্ভর এই দেশ বাংলাদেশে যেমন দেখা যায় দুই কোটি ১৭ লাখ একর কৃষিজমি, যা প্রায় ৩৪ হাজার বর্গমাইল এলাকা জুড়ে অবস্থিত সেই জমির শস্য-ফসল-ফল-মূল ১৬ কোটি মানুষের ক্ষুধা নিবারণ করে এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন হয়ে সম্মানিত এবং মোট দেশের আয়তন ৫৬ হাজার বর্গমাইল থেকে তা বিয়োগে বাকি অংশ দাঁড়ায় ২২ হাজার বর্গমাইল এলাকা, যাতে বিদ্যমান নদ-নদী, খাল-বিল, পাহাড়-টিলা, বন-জঙ্গল ও শহর-উপশহর। দেশের সর্বমোট জনসংখ্যার ১৬ কোটি মানুষ এই ৩৪ হাজার বর্গমাইল কৃষিজমির ওপর নির্ভরশীল এবং তা ক্রমবর্ধমান নগরায়ণের জন্য দিন দিন সংকুচিত হয়ে পড়ছে ভয়াবহভাবে, তা কখনো হতে দেওয়া যায় না সংগত কারণে। তাই কৃষিজমির অপব্যবহার না করে তা অটুট রাখার জন্য অন্যান্য দেশের মতো বিশেষ করে রাশিয়া যেমন করছে তেমন করে কয়েকটি গ্রামের জনবসতি নিয়ে বহুতল বিশিষ্ট উলস্নম্ব বা ঊর্ধ্বমুখী গ্রাম, সমবায়ভিত্তিক জীবজন্তু ও পশুখামার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, কুটিরশিল্প, বিনোদন, রাজনীতিচর্চা, জনসভা ও খেলাধুলার বিকাশে ফাঁকা ময়দান, সবুজ পার্ক – এইসবের ব্যবস্থাসহ নতুন করে দিকনির্দেশনামূলক সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনাসহ প্রতিটি অঞ্চল নিয়ে এক বৃহৎ মাস্টারপস্ন্যান বা ভবিষ্যৎ প্রকল্প-ভাবনার নকশা করা খুব জরুরিভাবে এখনই প্রয়োজন। সেই সার্বিক ভৌত পরিকল্পনাই আগামীর স্থাপত্যশিল্প, বিশেষ করে বাংলাদেশের পল্লিস্থাপত্যকে যথাযথ ও সময়োচিতভাবে পরিচালিত করতে সমর্থ হবে।
নগর থেকে এতদিন যে নগরায়ণ শুরু হয়েছে সে কারণে কৃষিভূমি ক্রমাগত ও আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে, এর মধ্যে গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো নব্য ধনী ও শাসকশ্রেণির, ক্ষমতাবান গোষ্ঠী শত শত একর কৃষিজমি শিল্প-কারখানা স্থাপন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আবাসনের নামে দখল করে নিচ্ছে, যা শহর থেকে বাইরে গেলেই জমিতে প্রোথিত বহু সাইনবোর্ডে দেখা যায়। এটা কখনো মানা যায় না। এই ক্ষতিকর বদ অভ্যাস অবিলম্বে বন্ধ করা দরকার, তা না হলে কিছুদিন পর এদেশে কোনো কৃষিজমিই খুঁজে পাওয়া যাবে না।
এ কারণে নগরায়ণের বিপরীতে গ্রাম বা গ্রামোন্নয়নে মন দিয়ে তার বাস্তবায়ন করতে হবে। রাজধানী ঢাকার ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে দেশকে সাত-আটটি প্রদেশে ভাগ করে সেখানে বিচারিক, প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক কর্মকা- শুরু করতে হবে তাৎক্ষণিক, মধ্য ও সুদূরপ্রসারী প্রকল্প-পরিকল্পনা নিয়ে। ১৯৩০ সালে জার্মান ভূগোলবিদ ওয়াল্টার ক্রিস্টোফারের সেন্ট্রাল প্লেস বা কেন্দ্রীয় স্থল তত্ত্ব অনুযায়ী বড় ও ছোট শহর চারদিকের পণ্য চাহিদা ও সেবা জোগান দিতে গড়ে উঠেছে। সেই হিসেবে ইউটিউবের ওয়েল্ডওভার প্রোডাকশন এমন বলছে যে ভৌগোলিকভাবে রাজনীতি ও ইতিহাসের দিক ব্যতিরেকে আমাদের সাতটি নদীবেষ্টিত যথা শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গা, বংশী, বালু, তুরাগ, ধলেশ্বরী ও নারাই – বর্তমানে বায়ুদূষণ, দারিদ্র্য ও জলবায়ুর পরিবর্তনে এই ঢাকা শহর বিশ্বের বাস অযোগ্য নগরগুলোর একটি হলেও মানবসভ্যতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠার যাবতীয় গুণাবলিই এতে বিদ্যমান। তাই সেইদিকে কাজ করা আজ প্রয়োজন। সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার আশপাশে কুয়ালালামপুর-পুত্রাজায়ার মতো একটি প্রশাসনিক রাজধানী করা দরকার সময়ের ক্রমবর্ধমান প্রয়োজনে। ঢাকাকে আরো আকর্ষণীয় করার জন্য কমপক্ষে ১০০০ ফুট উচ্চতাসম্পন্ন ঘূর্ণায়মান রেস্তোরাঁসহ একটি পরিদর্শন স্তম্ভ ও একটি গোলাকার লন্ডন আইয়ের মতো উঁচু ঘূর্ণিত সাইকেল-চক্র ‘ঢাকার চাকা’ও নির্মাণ করা যেতে পারে। পুরো ঢাকা শহর দেখার জন্য।
এইসব স্বপ্ন নিশ্চয়ই একদিন বাস্তবায়িত হবে এই আশা করা যায়, যেহেতু স্থাপত্যশিল্প একটি রাজনৈতিক শিল্প। যারা ক্ষমতাসীন অথচ জনগণবান্ধব, তাদের দ্বারাই এসবের বাস্তবায়ন সম্ভব। এই প্রেক্ষিতে নগরায়ণের বদলে যদি গ্রামায়ণ শুরু হয় বা করা যায় তাহলে কৃষিভূমির বিস্তার বহু বৃদ্ধি পাবে। ১০ তলা বহুতলবিশিষ্ট বা তার চেয়ে বেশি উঁচু উলস্নম্ব আবাসগৃহ নিয়ে সারি সারি উঁচু গ্রাম অর্থাৎ উলস্নম্ব গ্রাম যেগুলো কৃষিজমি আর খাল-বিল-নদীর পাড়ে পাড়ে নির্মিত হবে। খাড়া ও উঁচু বহুতলবিশিষ্ট আবাসিক ভবনগুলোতে সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, মৎস্য ও জীবজন্তুর বর্জ্য দিয়ে গ্যাস ও জৈবসার সৃষ্টির সুব্যবস্থাসহ নিচের জমিতে সমবায়ভিত্তিক
হাঁস-মুরগি, সবজি, মাছ, গবাদি পশু পালন ও দুগ্ধ খামার, বিল ও পুকুরে মৎস্য খামার, ফুলের বাগান, ফলের চাষ, বন সৃষ্টি, জলাধার সৃষ্টি, নিয়মিত নদীভাঙনসহ সবুজ স্থাপত্য সৃষ্টিতে এমন স্বয়ংক্রিয়, টেকসই ও যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে গ্রামবাসীরা অন্যের দ্বারা
সাহায্য-সহযোগিতার বদলে নিজেরাই স্বাধীনভাবে নিজেদের পরিচালিত করতে সক্ষম হবে। এইভাবে বাংলাদেশের নদীবাহিত পলিমাটির সবুজ গ্রামবাংলা তখন গ্রামায়ণের উজ্জ্বল উদাহরণ সৃষ্টি করে সারাবিশ্বের মধ্যে একটি পৃথক পরিচয়ে পরিচিহ্নিত হবে, আমরা বাঙালিরা সেই আশা দৃঢ়ভাবে পোষণ করি এই একবিংশ শতাব্দীতে ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি রেখে।
ভারতবর্ষ তথা সারা পৃথিবীর শস্যভা-ার যে দেশকে একসময়ে মোগল শাসকেরা ‘যে-কোনো জাতির স্বর্গ-বাংলাদেশ’ বলে আখ্যায়িত করত তদ্রূপ সবুজ এই দেশ সঠিক লক্ষ্য ও পদক্ষেপে নগরায়ণ থেকে গ্রামায়ণে রূপ নিয়ে সোনার বাংলা হিসেবে বাস্তবায়িত হয়ে নতুন করে আত্মপ্রকাশ করবেই। n