শিবনাথ বিশ্বাস
বাংলার নকশিকাঁথা শিল্প ঐতিহ্যবাহী এবং অতুলনীয় লোকশিল্পের নিদর্শন। এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অধিকারী আমাদের এই দেশ। ঐতিহ্যের একটি বড় অংশ জুড়ে আছে এ অঞ্চলের লোকশিল্প। আমাদের কৃষিনির্ভর গ্রামীণ সমাজের দৈনন্দিন জীবন, ধর্মীয় ও সামাজিক আচারবিধির প্রয়োজনীয় উপাদান হিসেবে লোকশিল্পের ব্যবহার চলে আসছে প্রাচীনকাল থেকে। শখের হাঁড়ি, পটচিত্র, আলপনা, লক্ষ্মীর সরা, ধাতু ও মাটির তৈজসপত্র, বাঁশের তৈরি কুলা, শঙ্খের তৈরি চিরুনি, নকশিকাঁথা ইত্যাদি। লোকশিল্প আমাদের গ্রামীণজীবনকে যেমন নান্দনিক রূপ দিয়েছে, তেমনি আবার অনেক লোকশিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সামাজিক মূল্যবোধ, সংস্কার ও লোকঐতিহ্য।
সামাজিক প্রেক্ষাপটে পল্লী রমণীদের রচিত নকশিকাঁথাটির মূল বিষয়বস্ত্ত মূলত লোকসংস্কৃতির মধ্য দিয়ে প্রভাবিত হয়েছে। কাঁথাটি কোড়া কাপড়ে বিভিন্ন রঙের সুতা দিয়ে নকশা তোলা। শাড়ি কাপড়ের পাড় থেকে সুতা উঠিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই অপূর্ব নকশিকাঁথা। কাঁথাজুড়ে বিভিন্ন মোটিফ দেখা যাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে বউ পালকিতে চড়ে শ্বশুরবাড়ি যাবার দৃশ্য। তারই একপাশে বার্তাবহ পাখি মুখে একটি সাপ নিয়ে উড়ে যাচ্ছে, নিচে বক মাছ শিকার করছে, পাখির ওপরে ফুল, কোনো এক গাঁয়ের মেয়ে ফুলের বাগানে হাত উঁচিয়ে আছে পাখিটিকে ধরার জন্য। কিন্তু না, পাখি ধরা গেল না। পালকিটির অন্য প্রান্তে শহর থেকে গাঁয়ে আসা কোনো লোক একটি মেয়ের হাত ধরে দাঁড়ানো, গাছের মাথার ওপর পাখি ও একটি ময়ূর মাথা উঁচু করে আছে। নিচের সারিতে হাতির পিঠে বসে আছে একটি মেয়ে, তার সামনে বড় একটি ময়ূর মুখে সাপ নিয়ে খেলা করছে। গায়ের ছেলেমেয়ে হাত ধরাধরি করে দাঁড়ানো। মেয়েটির এক হাতে দড়ি, পায়ের নিচে একটি ফুল, পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের সাজু ও রূপার কথা মনে করিয়ে দেয়। ঘরের পাশে একটি হাঁড়ি ও একটি কুলা, গাছে দুটি পাতা, একটি পাতা বড়, গাছের পেছনে মাছ-ফুল, ওপরের সারির দিকে ঠিক মাঝখানে বরবধূ এই নকশিকাঁথাটির মূল আকর্ষণ। দুই পাশে মাছ ও কুলা, পাশে হাত উঁচু করে কোনো এক গাঁয়ের ‘বধূ কি জানি কও’ কথা বলছে। বড় একটি কাস্তে দেখা যায়, গৃহবধূর এক পাশে মাছ, কলকা ও একটি বেহালা, গাছের মাথার ওপরে পাখি প্রজাপতি। বরের পাশে বড় মাছ, চিরুনি পানপাতা। ঢুলি ঢোল বাজাচ্ছে, পায়ের কাছে প্রজাপতি, বিভিন্ন মোটিফ দিয়ে সাজানো বাগানে জীবনবৃক্ষ দেখা যাচ্ছে।
নকশিকাঁথাটির দুই পাশে দুটি বড় কলকা দেওয়া আছে। নিচে আড়াআড়িভাবে জ্যামিতিক নকশাবর্ডার, তার নিচে পেঁচানো গাছের মতো দেখা যায়। ফুলপাতা দিয়ে তোলা হয়েছে দুই পাশের বর্ডার। ওপরে নিচে অলংকৃত বর্ডারে বিভিন্ন ধরনের তাগা দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ভাঙা ভাঙা বর্ডার, একটি তাগার সঙ্গে আরেকটি তাগা জড়িত। সব তাগা একসঙ্গে তৈরি হয়ে অপরূপ সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে। এই নকশিকাঁথাটি সম্পূর্ণ বাংলার গ্রামীণজীবনের চিত্র যেমন তুলে ধরছে, তেমনি আমাদের সংস্কৃতির মূলধারাকে সূচিশিল্পে আলোকিত করেছে।
সংস্কৃতি কী, এ বিষয়ে নানা মুনি নানা মত প্রকাশ করেছেন। সংস্কৃতিকে ব্যাখ্যা করেছেন যাঁর যাঁর নির্দিষ্ট দৃষ্টিকোণ থেকে। কেউ বলেছেন, Culture is the man-made part of environment (Herscovils)। আবার সংস্কৃতিকে আরো বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন দুজন নৃবিজ্ঞানী ক্লাইড ক্লাকহোন ও উইলিয়াম কেলি। তাঁরা বলছেন, All those historically created designs for living explicit and implicit, rational, irratonal and non-rational which exit at any time as potential guides for the behaviour of men। কিন্তু ওপার বাংলার লেখক পবিত্র সরকার সংস্কৃতিকে ব্যাখ্যা করেছেন দুটি স্তরে। তিনি বলেছেন, ‘জীবনের অন্তর্গত সকল বিষয় –
কর্ম-চর্চা-সাধনা প্রভৃতিই হচ্ছে সংস্কৃতি। সেটা হতে পারে বস্ত্তগত কিংবা অবস্ত্তগত। বস্ত্তগত সংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে আমাদের খাদ্যদ্রব্য ও তার উপাদান, আমাদের পোশাক-আশাক, আমাদের আবাস ও গৃহস্থালির নানা উপকরণ।’ অর্থাৎ যা প্রত্যক্ষ, যাকে স্পর্শ করা যায়, যার আকার-আকৃতি আছে – সেগুলোই বস্ত্তগত সংস্কৃতির মধ্যে পড়ে। আর অবস্ত্তগত সংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে নাচ, গান, অভিনয় প্রভৃতি। এগুলোকে দেখা যায়, শোনা যায় এবং অনুভব করা যায়। বেশিরভাগ মানুষ মনে করে, নাচ, গান, নাট্যাভিনয় কিংবা যাত্রাই হলো সংস্কৃতি। কুমোর যখন মাটি দিয়ে বিভিন্ন জিনিস তৈরি করে তার মধ্যে সে অনেক রকম শিল্পকর্মের ছোঁয়া দেয় কিংবা সে যখন কাঠ, খড়, মাটি দিয়ে একটি প্রতিমার কাঠামো নির্মাণ করে তখন তা হয়ে থাকে শুধুই বস্ত্ত, কিন্তু তার ওপরে রঙের প্রলেপ দিয়ে সে যখন তাকে সম্পূর্ণ একটি প্রতিমা করে তোলে এবং পুরোহিত যখন তাতে প্রাণের প্রতিষ্ঠা করে বলে ধারণা করা হয় তখন আর সেটি বস্ত্ত থাকে না, বস্ত্তরও অধিক একটি নতুন শিল্পকর্ম হয়ে ওঠে, যা বস্ত্তগত সংস্কৃতিকে অতিক্রম করে অবস্ত্তগত সংস্কৃতিতে পরিণত হয়ে যায়।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, কয়েক প্রস্থ জীর্ণ বস্ত্র, পুরনো ধুতি-শাড়ি আর সেই কাপড়ের পাড় থেকে ছড়ানো কিছু রঙিন সুতা – অতিসামান্য এই উপকরণ দিয়ে পল্লী নারীরা এই কাঁথাটিতে যে অসামান্য শিল্পসৃষ্টি করেছেন তারই উদাহরণ বলা যেতে পারে। পবিত্র সরকার বস্ত্তগত বা অবস্ত্তগত সংস্কৃতির বাইরে আর যা কিছু আছে, তাকে বলেছেন প্রকৃতি। আমাদের চারপাশের গাছপালা, পশুপাখি, সব ধরনের প্রাণী এই প্রকৃতির অন্তর্গত। কবি অসীম সাহার নিজের বিবেচনায়, এই পৃথিবী কিংবা বিশ্বব্রহ্মান্ডের যা কিছুর অস্তিত্ব আছে তা-ই হলো সংস্কৃতি। আমরা স্পর্শ করতে পারি বা না পারি, আমাদের অনুভবে আসুক বা না আসুক, তাকে আমরা সংস্কৃতির বাইরে ঠেলে দিতে পারি না। যেমন মানুষেরা যে বৃক্ষরোপণ করে তার পরিচর্যা করে, সে বড় হয়ে ওঠে, তারপর ফল দেয়, ফুল ফোটায়, দৃষ্টিকে বিমোহিত করে। আবার অনেক বৃক্ষ আছে যেগুলো ফুল-ফল কিছুই দেয় না, তাদের মধ্যে আছে আবার অফলদায়ক বুনো গাছ, তা ছাড়া অনেক গাছ আছে যেগুলো আপন জালা, হয়তো একটি পাখি তার ঠোঁটে বীজ বহন করে নিয়ে এসে সেটিকে অনির্দিষ্ট কোনো স্থানে ফেলে রেখে যায়। তা থেকেই অঙ্কুরোদ্গম হয়, একটু একটু করে গাছ হিসেবে বেড়ে উঠতে থাকে, সেসব গাছে ফুল ফোটে, তারা ফলও দেয়, আবার কোনো কোনো বৃক্ষ এর কিছুই দেয় না। এদের আমরা বস্ত্তগত কিংবা অবস্ত্তগত সংস্কৃতির মধ্যে নাও ফেলতে পারি। আবার ইচ্ছে করলে একে সংস্কৃতির বৃহত্তর পরিমন্ডলে স্থানও দিতে পারি। সাদা চোখে দেখলে গাছপালা, পশুপাখি অর্থাৎ অসংখ্য রকমের প্রাণীও এই সংস্কৃতির আধার হয়ে উঠতে পারে। গাছ যখন নিঃশব্দে স্থির হয়ে থাকে, তখন তাকে দেখলে মনে হয়, এটা শুধুই বস্ত্ত, যখন সুদূর থেকে হাওয়া এসে তার বাঁধন খুলে দেয়, তখন সে তার ডালপালা নাচিয়ে তার নিজের ভাষাকে মানুষের কাছে জানান দেওয়ার জন্য উদ্বেল হয়ে ওঠে। প্রাণিজগৎ সম্পর্কে সেই একই কথা বলা যায়। [অসীম সাহা : সংস্কৃতি ও অপসংস্কৃতি, দৈনিক যুগান্তর, ২৪ জুলাই ২০০৯]
এই বাংলার কুমারী ভূমিতে অনাবিষ্কৃত বনজঙ্গলের মধ্যে এই অঞ্চলের মানুষকে পুঁজি করতে হয়েছিল কতগুলো ধ্বনি ও দেহভঙ্গি। মানুষেরা সেসব আদি স্বরে পশুপাখির গতিবিধি বুঝেছে।
কখনো পশুপাখির স্বর অনুকরণ করেছে তাদের বশে আনার জন্য। কখনো আত্মরক্ষার জন্য ধ্বনির মধ্যে অর্থ সঞ্চিত করেছে, কখনো আবার পশুপাখিকে এমন দীক্ষা দিয়েছে, যাতে সেই প্রাণী দিয়ে শিকার ধরা যায়। প্রাক-পৌরাণিক অভিজ্ঞতার প্রয়োগ এখনো চোখে পড়ে। মানুষ হাতকে সর্প বানিয়ে সাপ ধরছে, পুষেছে। এখনো ঘুঘুকে দীক্ষা দিয়ে ঘুঘু শিকার চলছে। একটি ঘুঘুকে খাঁচায় বন্দি করে গাছে ঝুলিয়ে রেখে ফাঁদ পেতে অন্য ঘুঘুকে ধরার চেষ্টা করছে। আর প্রথম হরবোলা প্রাণী কুকুরকে সঙ্গে নিয়ে চলছে। হাতি, ঘোড়া – কত প্রাণী তো মানুষের কথা শুনেছে। পরস্পর সখ্য হয়েছে, পশুপাখির সঙ্গে এখনো মানুষ কথা বলে। এর চেহারায় হয়তোবা এর চেয়ে বেশি কথা বলার সম্পর্কটা ছিল। মানুষ নিসর্গকে বন্ধু বলেছে, পশুকে নানা আকার, ইঙ্গিত ও ধ্বনি উচ্চারণ করে ডেকেছে – তার মধ্যেই এদেশের মানুষের আদি সৃজনসূত্র রয়ে গেছে বলে ধারণা করা হয়। ওই অর্থহীন ধ্বনি হরবোলা ডাক দিয়ে মানুষ পরিপার্শ্বের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছে আর এই ধ্বনি ও স্বরে গাঢ় হয়ে আছে মানুষের অস্তিত্বের আকুতি। [মইনুদ্দীন খালেদ : যুগান্তর]
মানুষের সঙ্গে যেমন মানুষের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, তেমনি রয়েছে মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, প্রেম-ভালোবাসা, আশা-আকাঙ্ক্ষা। মানুষকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে এই সমাজব্যবস্থা। একসময় বাঙালির যৌথ পরিবারের ঐতিহ্য ছিল, তারা সবাই মিলেমিশে একসময় একসঙ্গে বসবাস করতে ভালো বাসতেন। বর্তমানে মানুষের অভাব-অনটনের ও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে বা চাপে যৌথ পরিবার ভেঙে পড়ছে। দুর্বল হয়ে গেছে সামাজিক সংস্কৃতির ঐতিহ্য। হারিয়ে যেতে বসেছে মানুষের একত্রে মিলেমিশে থাকার আনন্দ। এখন আর দেখা যায় না গ্রামের সেই মেঠোপথ পাড়ি দিয়ে পালকিতে চড়ে বউকে শ্বশুরবাড়ি নিয়ে যাবার দৃশ্য।
এই নকশিকাঁথার ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ দেখা যায়, এখানে সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান, বিয়েশাদিতে গ্রামীণজীবনের মানবিক মূল্যবোধ ফুটে ওঠে। বিয়ের পর বউকে পালকিতে চড়ে শ্বশুরবাড়ি যাওয়া প্রাচীনকাল থেকেই প্রথা অনুযায়ী চলে আসছে। বিবাহ একটি সামাজিক অনুষ্ঠান, যদিও বিবাহ ব্যক্তিজীবনের পক্ষে একটি দারুণ সংকটের, তবু এই বিবাহ উপলক্ষে নানা আয়োজন হয়ে থাকে। বিভিন্ন সময় অর্থাৎ পাত্র-পাত্রী নির্বাচন, গায়েহলুদ দেওয়া, স্নান করানো, বরযাত্রা, কন্যাবিদায়, বধূবরণ ইত্যাদি দেখা যায়।
বিয়েশাদি ছিল নারী কি পুরুষ প্রত্যেকের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। সকলে বিপুল আনন্দ-উৎসবের সঙ্গে বিয়েতে যোগ দিত এবং খুব আমোদ-প্রমোদ, ধুমধাম ও সমারোহের ভেতর দিয়ে বিবাহ অনুষ্ঠিত হতো। অতি অল্প বয়সে বালক-বালিকাকে বিয়ে দেওয়া ছিল সমাজের রীতি। বাল্যবিবাহ হিন্দুদের মধ্যে খুব বেশি মাত্রায় প্রচলিত ছিল। বাল্য বয়সে তাদের ছেলেমেয়েদের, বিশেষ করে মেয়েদের যৌবনাবস্থায় পৌঁছবার পূর্বেই বিয়ে দেওয়া তাঁরা ধর্মীয় কর্তব্য বলে বিবেচনা করতেন। বেশি বয়সে মেয়েদের বিয়েশাদি সমাজে অসম্মানজনক ছিল এবং এরূপ ক্ষেত্রে বালিকার পিতামাতা সকলের নিকট নিন্দনীয় ছিলেন। বালিকাদের বেলায় যেমন তাদের স্বামী নির্বাচনে, বালকদের বেলায় তেমনি স্ত্রী গ্রহণে কোনো প্রকার নিজস্ব মতামত ছিল না। পিতামাতা ও অভিভাবকেরা তাদের (পুত্র-কন্যাদের) বিয়েতে তাদের মতের কোনো প্রয়োজন আছে বলে বিবেচনা করেননি। মুসলমানদের মধ্যে বরপক্ষ বিয়ের কনেকে পণ দিত। কনের পিতামাতা কখনো কখনো বর ও বরপক্ষকে উপহার প্রদান করতেন। হিন্দুদের মধ্যে বরকে মূল্যবান যৌতুক প্রদানের প্রথা প্রচলিত ছিল। এমনকি তাদের নিম্নশ্রেণির ভেতরেও কনের পিতা বরকে যৌতুক প্রদান করতে বাধ্য হতেন। বিয়ে উপলক্ষে কনের ও বরের বাড়িঘর সুরুচিপূর্ণভাবে সাজানো হতো এবং চমৎকারভাবে আলোকিত করা হতো। এমনকি প্রতিবেশীদের বাড়িঘর পর্যন্ত উৎসবের আকার ধারণ করত। বিয়ের অনুষ্ঠান বিশেষ করে কনের বাড়িতে হতো। একটা খোলা জায়গা অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্ত্তত থাকত। একটা মঞ্চ নির্মিত এবং ওপরে চাঁদোয়া টানিয়ে রাখত, যাতে রোদ-বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। কলাগাছ পুঁতে তোরণ নির্মাণ এবং একধরনের লাল নীল হলুদ পাতা (গ্রামাঞ্চলে কাঁটাবাহার পাতা বলে) দিয়ে সাজানো হতো। বিয়েতে গান-বাজনা এবং বাঁশি, ঢোল, কাঁসা নানা প্রকারের সংগীতে বর ও কনের বাড়ি মুখরিত হয়ে উঠত। আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশী নারী ও যুবতী মেয়েরা উজ্জ্বল পোশাক-পরিচ্ছদে ভূষিত হয়ে কনের বাড়িতে বরযাত্রী হয়ে আসত।
কাজী ও উকিলের মাধ্যমে বিয়েতে কনের সম্মতি জানার জন্য দুজন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হতো। অতঃপর তাদের বিয়ে সম্পন্ন হলে লোকটি তার স্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। গ্রামাঞ্চলে মোল্লা বিয়ে অনুষ্ঠান ধর্মসম্মতভাবে সম্পন্ন করেন এবং বিবাহিত দম্পতির জন্য দোয়া করেন। হিন্দুদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সমারোহ ও জাঁকজমকের সঙ্গে বিবাহ উৎসব অনুষ্ঠিত হতো। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকরা কনেকে বিবাহমন্ডপে বা বিবাহসভায় নিয়ে আসত। তাকে একটি কাঠের পিঁড়িতে বসিয়ে দুজনে পিঁড়ি ধরে সভায় আনা হতো। তার আগে বিবাহসভায় বরকে এনে পুরোহিত দিয়ে মন্ত্র পড়ানো হতো ছাদনা তলায়। এরপর বরকে দাঁড় করানো হয় মুখ ঢেকে। কনেকে নিয়ে সাত পাক ঘুরিয়ে পূর্বদিকে মুখ করে রেখে শুভদৃষ্টি করে মালা বদল হয়।
বিবাহবাসরে বরের বুদ্ধি পরীক্ষা করার জন্য কিংবা বরযাত্রীদের ঠকানোর জন্য যে-কোনো ধরনের ধাঁধা জিজ্ঞাসা করা হয়ে থাকে।
কন্যাপক্ষের প্রশ্ন :
মিষ্টি কিন্তু মিষ্টি নয়, দেখা যায় না দোকানময়
খেতে গেলে যায় না খাওয়া
ধরতে গেলে যায় না পাওয়া তবুও তাহা মিষ্টিময়
বলো তো তাহা কী হয়?
বরপক্ষের উত্তর :
কথার চেয়ে মিষ্টি কিছু নাই
মধুর ভাষায় কথা বলে রমণীরা তাই।
এমনই বিচিত্র আর রঙে ভরা বাংলার গার্হস্থ্য জীবন। এখানে দুঃখ আছে, সুখ আছে, স্নেহ, মায়া-মমতা ও ভালোবাসা আছে। আছে অপার বিস্ময়। তাই আমাদের গ্রামীণ সমাজজীবনের একটা বড় বন্ধন হলো এই পরিবার, আবার এই পরিবারকে কেন্দ্র করে আমাদের সুজলা-সুফলা গ্রামবাংলায় গড়ে উঠুক মধুর গৃহস্থালি জীবন।
নকশিকাঁথার পালকি নিয়ে কাঁথাশিল্পীরা গ্রামীণজীবনের চিত্র তুলে ধরছেন। গ্রামজীবনে একসময় রাস্তাঘাটের অবস্থা এমন ছিল যে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে হলে পালকি নিয়ে চলাফেরা করা হতো। সামনে দুজন এবং পেছনে দুজন মোট চারজন লোক কাঁধে করে পালকি বয়ে নিয়ে যেত। বর পালকিতে যেত না, সে হেঁটে যেত। আর একজনের হাতে লণ্ঠন থাকত, সে আগে যেত। পল্লীবাংলার এই দৃশ্য এখন আর চোখে পড়ে না। বধূকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাওয়া এবং বাপের বাড়ি আসার ব্যাপারে গ্রামজীবনে পালকি ছিল একসময় ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ বিষয়ে পালকি নিয়ে কবি ছড়া রচনা করেছেন।
পালকি নিয়ে ছড়া :
দোলায় আসি দোলায় যাই,
সোনার দর্পণে মুখ চাই।
বাপের বাড়ির দোলাখানি
শ্বশুরবাড়ি যায়
আসতে যেতে দুইজনে ঘৃত মধু খায় \
এছাড়া দীনদরিদ্র শাশুড়ি জামাইকে আপ্যায়নের জন্য নগণ্য আয়োজনের মধ্যে ছেঁড়া কাঁথা অথবা কোনো আসনকাঁথা খাবার সময় বসতে দিত। শোয়ার জন্য ছিল নকশিকাঁথা। এমনই ছিল বাঙালি ঘরোয়া জীবনের সঙ্গে নকশিকাঁথার ওতপ্রোত সম্পর্ক।
এই কাঁথার মধ্যে যে ঘরটি দেখা যাচ্ছে তা হলো বাংলার লোকস্থাপত্য। মাটির দেয়াল ও খড়ের ছাদ দিয়ে ছাওয়া ঘরটি নকশিকাঁথা ট্রিজ দিয়ে দেখানো হয়েছে। এই খড় ছাওয়া হয় বাঁশের কাঠামোর ওপর। এ ধরনের বাড়ির আরেকটি বিকল্প ব্যবস্থা হলো বাঁশের বেড়া ও বাঁশের ছাওয়া। তাছাড়া আছে খড়কুটো বা নাড়া দিয়ে তৈরি করার ব্যবস্থা। এটি বিশেষ করে এই বাংলায় দেখা যায় বেশি। মাটির বাড়ির দেয়ালে, বিশেষ করে সাঁওতাল বাড়িতে জীবনবৃক্ষ, আলপনা, পশুপাখি আঁকা থাকে। পাখির প্রতিকৃতিও চোখে পড়ে। কখনো কখনো তাতে রং দিয়ে অাঁকা হয়। লোকস্থাপত্য রবীন্দ্রনাথের চিন্তাধারাকে কতখানি প্রভাবিত করেছে তা তাঁর শান্তিনিকেতনের তৈরি করা শ্যামলী নামক মাটির ঘরটিই উজ্জ্বল প্রমাণ।
লোকচিত্রের ক্ষেত্রে আরেকটি উল্লেখযোগ্য উপাদান হলো শখের হাঁড়ি। গ্রামবাংলার মানুষ সুখবর বয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় হাঁড়িভর্তি মিষ্টি নিয়ে সংবাদ পৌঁছাতেন। যে কারণে সন্দেশ শব্দের আরেকটি অর্থ হলো সংবাদ।
নকশিকাঁথাটির ঘরের পাশে এবং গাছের নিচে রাখা যে হাঁড়িটি এখানে দেখা যাচ্ছে হয়তো বা কোনো একসময় এই হাঁড়িটির মধ্যে মিষ্টি ছিল, আবার নাও থাকতে পারে। নতুন হাঁড়ি চিত্রায়িত থাকে না, কোনো এক বাজার থেকে কিনে এনে সাধারণত শিল্পীরা হাঁড়িতে চিত্রায়িত করে ঘরের শিকায় ঝুলিয়ে রাখে। এই চিত্রিত হাঁড়ির সার্থক নমুনা পাওয়া যায় রাজশাহী অঞ্চলে। শিল্পীরা এই হাঁড়ি চিত্রায়িত করেন হাঁড়ির কানা থেকে পেট পর্যন্ত তলাজুড়ে। নিচের দিকে শুধু রেখার মাধ্যমে জ্যামিতিক নকশা করা হয়। কোনো রকম ধর্মীয় ছোঁয়া এখানে দেখা যায় না। তাছাড়া নতুন হাঁড়ি গ্রামবাংলার নারীরা তাদের দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করে থাকে। ঘরে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য রাখার জন্য হাঁড়ি অত্যন্ত জরুরি।
একটি মেয়েকে হাতির পিঠে উঠে বসা অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। মেয়েটির এক হাতে লাঠি। হাতির পিঠের ওপরে কাপড় পুরু করে দেওয়া আছে। বসার আরামের জন্য এটা দেওয়া হয়ে থাকে। একে গদি বলা হয়। কোনো কোনো সময় কাপড়ের গায়ে কাঁথার ব্যবহার লক্ষ করা যেত। বাঙালির সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে জমিদারদের খাজনা আদায়ের জন্য হাতির পিঠে চড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখা যেত। তাছাড়া এক স্থান থেকে অন্য কোনো স্থানে অথবা বহুদূরে চলে যাওয়া এবং ফিরে আসা মোগল যুগে প্রচলন ছিল। বাঙালির ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে যেমন পহেলা বৈশাখ, চৈত্রসংক্রান্তি, দোলপূর্ণিমা, মুসলমানদের ঈদ এবং যে-কোনো মেলা উৎসবে ছেলেমেয়েদের হাতির পিঠে চড়ে আনন্দ উপভোগ করতে দেখা যেত। বর্তমানে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে তেমন একটা দৃশ্য এখন আর চোখে পড়ে না।
বাংলাদেশে অসংখ্য নদনদীর কল্যাণে এবং ঋতুমাফিক বৃষ্টিপাত ও প্রাকৃতিক সেচব্যবস্থার ফলে বহু শতাব্দীব্যাপী বাংলার সমতলভূমি পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে উর্বর অঞ্চল ছিল। বাংলার মাটি এত বেশি উর্বর ছিল যে, একই মাটিতে বছরে তিনটি ফসল উৎপন্ন হতো। ফসল কাটার জন্য বাংলার কৃষকরা কাস্তে ব্যবহার করত। এই নকশিকাঁথাটির মধ্যে কাস্তে মোটিফ লক্ষ করা যায়। অগ্রহায়ণ ও পৌষ মাসে ধান পাকার পর কাটার পর্ব শুরু হয়ে যায় এবং এই সময় কৃষকরা কাস্তে দিয়ে ধান কাটতে আরম্ভ করে দেয়। তাই কৃষিজীবনে কাস্তের একটা প্রয়োজনীয় ভূমিকা আছে। বাংলার কৃষকরাই গ্রামীণজীবনের ভরসা, মাথার ঘাম পায়ে ফেলেও হতদরিদ্র কৃষক অনেক সময় ঘরে ফসল তুলতে পারে না। তাই বলা যেতে পারে ধান কাটার জন্য কাস্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এই নকশিকাঁথার মধ্যে ঘর ও পালকির পাশে দুটি কুলা দেখা যাচ্ছে। কুলা হলো মাঙ্গলিক ও সম্পদের প্রতীক। ধান ছাঁটার পর ধান ঝাড়া শুরু হয়ে যায়। কৃষক পরিবারের গৃহবধূরা ধান ঝাড়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শুধু ধান ঝাড়াই নয়, আমাদের গৃহজীবনের প্রতিদিনের সংসারে অনেক জিনিসের প্রয়োজন হয়। এগুলো লোক-প্রয়োজনের তাগিদেই সংসারে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত পরিবারের অতি তুচ্ছ নানা উপকরণের মধ্যে আমাদের বাংলার কুলা অতি পরিচিত। বিয়েতে কুলা সাজানো এবং তাতে আলপনা অাঁকা ছিল বাঙালির সামাজিক ও সংস্কৃতির অঙ্গ।
সুপ্রাচীনকাল থেকেই বাংলায় বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার চলে আসছে। চর্যাপদ থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের সাহিত্যেও বাদ্যযন্ত্রের কথা শোনা যায়। লোকসাহিত্যের একটা বিরাট অংশ বিভিন্ন ধরনের লোকসংগীত। লোকসংগীত গাইবার জন্য বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে ঢোল অন্যতম।
বাঙালি ঢোল-করতাল নিয়ে ধর্মসংগীত গায়। এ ধরনের বাদ্যযন্ত্র লোকবাদ্য নামে বাংলার লোকসংস্কৃতির উপাদান হয়ে গিয়েছে। লোকমনের কৌতূহল বা জিজ্ঞাসা এসব বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারের মধ্য দিয়েই মানুষের মানসিক চেতনাবোধ জাগ্রত বা পরিতৃপ্ত করেনি, এর মধ্য থেকে বাঙালির লোকমানসের যে সামাজিক অভিজ্ঞতা, বাস্তববোধ, জানবার আগ্রহ তাকে বিচিত্র ভাষায় ও ভঙ্গিতে ধাঁধার মধ্য দিয়ে পল্লীকবিরা বর্ণনা করেছেন। এছাড়া ঢোল একটি অতি পরিচিত নাম। এর আওয়াজ ঢাকের মতো অত জোরে না হলেও কিছু কম নয়। ঢোলের গায়েও যে হাত দেয় সঙ্গে সঙ্গে শব্দ বেরিয়ে আসে। ঢোল নিয়ে ধাঁধা হলো –
দুই মুখে কথা কয় থাপ্পড় যদি খায়,
নয় মাসের পেট নিয়ে মরার কথা কয়।
জ্যান্ত লোকের কাঁধে উঠে যদি পিতা দিলা,
শ্লেকের জবাব না দিলে তোমার মাথা হবে ধলা। -ঢাকা
এ ধরনের বাদ্যযন্ত্রের রূপ ও গঠনগত বৈশিষ্ট্য এবং তার আওয়াজ অতি চমৎকারভাবে লক্ষ করা যায়। এছাড়া আছে বেহালা। জারি, সারি ও ভাটিয়ালির দেশ বাংলাদেশ। এদেশে কত কবি, কত গীতিকার জন্মগ্রহণ করেছেন। বেহালা বাজিয়ে কত গায়ক-গায়িকা তাঁদের সুরেলা আওয়াজে পল্লীবাংলার মেহনতি মানুষের মন জয় করে নিয়েছেন। তাঁদের সুর ও ছন্দ মন কেড়ে নিয়েছে কত অজানা-অচেনা মানুষের হৃদয়। বেহালা দেখতে যেমন সুন্দর, তার সুর আরো বেশি সুন্দর। সেই বেহালার কথা বিভিন্নভাবে ধাঁধায় ফুটে উঠেছে। তাই বেহালা কীভাবে বাজালে তার সুমধুর স্বর কীভাবে বের হয় তা নিয়ে লোককবি বেহালাকে নিয়ে রচনা করেছেন চমৎকার ধাঁধা : যেমন
মুরাত থাকে সুবোল বলে
নয়রে পক্ষীর ছা
হাতে লইলে পিঠ বরাবর
ভূঁইয়ে ন দেয় পা। -চট্টগ্রাম
লোকশিল্প সম্বন্ধে বলা হয়, এটি সাধারণ লোকদের জন্য সাধারণ লোকদের সৃষ্টি। গ্রামের নকশিকাঁথা শিল্পীরা হতদরিদ্র। তারা নকশিকাঁথা তৈরি করে। এটা গ্রামবাংলার নিজস্ব সূচিশিল্প। গ্রামের অতি সাধারণ নারীরা এর রূপকার। পল্লীকবি তাঁর লেখায় লিখেছেন, পল্লীশিল্পের কথা ভাবতে প্রথমেই নকশিকাঁথা শিল্পের কথা মনে পড়ে যায়।
এই নকশিকাঁথার মধ্যে একটি বড় মাছ এবং একটি ছোট মাছ দেখা যাচ্ছে। মাছ মোটিফ হলো উর্বরতা বা সৌভাগ্যের প্রতীক। কাঁথায় এ ধরনের মোটিফ ব্যবহার করা হয় মঙ্গলজনক প্রতীক হিসেবে। বিবাহযোগ্য মেয়েদের জন্য যে কাঁথা সেলাই করা হয় তাতে মাছের প্রতীক চিত্রিত করা হয়। মাছ জীবন সংরক্ষণ এবং জীবনের উৎস হিসেবে ব্যবহৃত, অর্থাৎ জীবনের প্রতীক। বাংলার কাঁথায় মাছের মোটিফ দেওয়া হয় বিবাহিত কন্যার উর্বরতার প্রতীক হিসেবে। খাদ্যের তালিকায় মাছ একটা বিশেষ স্থান দখল করে আছে। খাদ্যরসিক বাঙালি শুধু খেয়েই তৃপ্ত নয়, কোন বস্ত্তর সঙ্গে কোন বস্ত্ত বা উপকরণের সম্মিলন ঘটলে রান্নাটি মুখরোচক হয়ে ওঠে তা বাঙালিরা জানে।
গুটি থেকে বাইরে বেরিয়ে আসার পর প্রজাপতির যে সৌন্দর্য প্রকাশিত হয় তা অতুলনীয়। আমাদের চারপাশে রয়েছে অজস্র ধরনের প্রজাপতি। তার গঠন, রং বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। প্রজাপতি মোটিফ হলো শুভমিলনের প্রতীকস্বরূপ। এই মোটিফের মধ্যে মানুষের কামনা, বাসনা প্রতিফলিত হয়ে থাকে। কলকা অতি পরিচিত ও জনপ্রিয় মোটিফ। নকশিকাঁথায় এর ব্যবহার অত্যন্ত বেশি। কাঁথার চারকোনায় কলকা দেওয়া হলে তা কাঁথার সৌন্দর্যকে অনেক বেশি বাড়িয়ে তোলে। এই মোটিফটি ইরান থেকে এসেছে। এটিকে ইরানি প্রভাবজাত বলা যায়। মোগল আমল বা সুলতানি আমলের সময় থেকে এ কলকা ব্যবহৃত হয়ে আসছে। শুধু নকশিকাঁথাই নয়, শালেও এর ব্যবহার লক্ষ করা যায়। কলকা বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। চীনা প্রতীক ‘yin’ এবং ‘yang’-নরনারীর প্রতীক, যা কি না কলকার সঙ্গে সাদৃশ্যজাত।
সুই-সুতার মাধ্যমে আপন মনের ইচ্ছায় পরিবেশের চারপাশের ফুল, পাতা, পাখি, দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপত্র কাঁথায় প্রতিফলিত হয়ে থাকে। তার মধ্যে পাখি হলো অন্যতম। ঈশ্বরের বার্তাবাহক এবং প্রাণিজগতের প্রতিনিধি হলো পাখি। এরা মৃত প্রাণীর আত্মাকে মননোত্তর জগতে বহন করে। এখানে সূচিশিল্পে এই মোটিফ দেখা যায়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়ও মৃত প্রাণীর আত্মা পাখির আকার ধারণ করে বলে বিশ্বাস। তাই সুমাত্রায় লামপুং মেয়েদের ধর্মীয় সাংঙে পাখির মাথাওয়ালা মানুষের নকশা দেখা যায়। খ্রিষ্ট ধর্মে স্বর্গের ডানাওয়ালা দেবদূত পাখিরই নামান্তর, এটিও সূচিকার্যে স্থান করে নিয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের পাখি নিয়ে অনেক লোককবি ধাঁধা রচনা করেছেন। পাখিদের মধ্যে বিভিন্ন প্রকারের স্বভাব ও বাসস্থানের বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। সেই বিচিত্র স্বভাব, চেহারা ও বাসস্থানের সুন্দর পরিচয় কাঁথাশিল্পীরা তাঁদের ট্রিজের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেন। এখানে একটি বকপাখি দেখা যাচ্ছে। বকের লম্বা গলাটির কথা অপূর্বভাবে লোককবি বর্ণনা করেছেন –
ডালে বসে কোলে মেলা,/আহার করতে গলা মেলা।- কুষ্টিয়া
আবার ময়ূরের সৌন্দর্য নিয়েও পল্লীকবিরা ধাঁধা রচনা করেছেন সুন্দরভাবে।
দেখিতে সুন্দর হয়, গভীর জঙ্গলে রয়/স্ত্রী-পুরুষেতে কভু সঙ্গম না হয়।
তথাপি তাদের বংশ দেখি বৃদ্ধি হয়/কি হেন জীব আছে বলো হে ধরায়? -মেদিনীপুর
পালকি এবং একটি মানুষের মাঝে ব্যাঙ দেখা যায়। প্রকৃতির রাজ্যে সুন্দরের পাশেই আছে অসুন্দরের স্থান, তেমনি আছে সুশ্রীর পাশে বিশ্রীর অবস্থান। তাই পল্লীকবি যেমন সুন্দর ময়ূরের দিকে তাকিয়েছেন তেমনি কুৎসিত ব্যাঙের চেহারার প্রতিও তাঁর দৃষ্টি পড়েছে। ব্যাঙ শুধু দেখতেই কুৎসিত নয়, তার চিৎকারও বড় বিশ্রী।
এখানে বড় মাছের পাশে পানপাতা দেখা যায়। পান-সুপারি বিয়েশাদি বা যে-কোনো অনুষ্ঠান-পূজায় মঙ্গলজনক বলে পরিচিত। এই পান-সুপারির জন্মকথা নিয়ে খাসিয়া উপজাতিদের মধ্যে এক চমৎকার লোককাহিনি প্রচলিত আছে। পানগাছে ফুল-ফল কিছুই হয় না, পাতাতেই ভরা থাকে এবং বারো মাসই জন্মায়। যখন পানটি সম্পূর্ণরূপে ফলে যায় তখন রসবতী হয় অর্থাৎ পানের রসে সবাই আস্বাদ পায়। পান দেখতে তাসের ইসকাপনের টেক্কার মতো।
বিভিন্ন ধরনের গাছের পরেই আসে ফুলের কথা। ফুলের মনোমুগ্ধকর স্বর্গীয় শোভা সকলেরই মন কেড়ে নেয়। ফুলের সুগন্ধও মনকে আকৃষ্ট করে। প্রাকৃতিক নিয়মে ঋতুর পরিবর্তন ঘটে। এক এক ঋতুতে বঙ্গপ্রকৃতি নতুন নতুন ফুলের সাজি নিয়ে উপস্থিত হয়, আর সেই সাজিতে থাকে বৈচিত্র্যময় বাহার। বাংলার এ বিভিন্ন ধরনের ফুল নিয়ে কেবলমাত্র কবিরাই কবিতা রচনা করেননি, ধাঁধা রচয়িতার মনও কেড়ে নিয়েছে বাংলার সৌন্দর্যময়ী নানান ফুল। তাই গ্রাম্য কবির মনোরাজ্যে দেখি নানা ফুলের সমারোহ। কদম ফুলের সৌন্দর্য নিয়ে পল্লীকবি বলেছেন –
দেখলে মনে চায়, ভাঙলে নাহি খায়।
আবার পদ্মফুল নিয়েও লোককবি জলের ঢেউয়ের মধ্যে পদ্মফুলকে ঠাকুরদাদার বউ বলে উল্লেখ করেছেন :
এই পারে ঢেউ হেই পারে ঢেউ/মধ্যিখানে বইয়া রইছে ঠাকুরদাদার বউ। – নেত্রকোনা
কাঁথাটির নিচে একটি ছেলে ও একটি মেয়েকে হাত ধরাধরি করে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখা যায়। মেয়েটির এক হাতে দড়ি, মনে হয় খেলা করছে। গ্রামের মেয়ে, বয়স কত হবে বলা যায় না। বারো কি তেরো। হয়তো কমও হতে পারে। বাড়ন্ত বয়স। পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের অমর কাব্য নকশিকাঁথার মাঠের কথা চিত্রে মনে করিয়ে দেয়। কবি জসীমউদ্দীনের অমর কাহিনি নকশিকাঁথার মাঠের কাব্যে কেন্দ্রীয় চরিত্রে রূপা, সাজু ও নকশিকাঁথা। সাজুর প্রেমে ও অশ্রুজল-বেদনায় গড়া নকশিকাঁথাটি যেন কাহিনির শেষে হয়ে উঠেছে মূল চরিত্র।
পল্লীবালা সাজু ও রূপার দাম্পত্য প্রণয়কাহিনি এই কাব্যের উপজীব্য। যে-প্রেম অমর মৃত্যুতেও তার লয় নেই, ক্ষয় নেই। পল্লীবধূ সাজু তার স্বামীর পাশে বসে প্রতিদিন যে কাঁথাটি চিত্রিত করতে শুরু করেছিল, তা ছিল তাদের জীবনের হাসি-খেলা, প্রণয়ের-আনন্দের রঙিন স্বপ্ন-সুতোয় গাঁথা। কিন্তু রূপার গ্রাম থেকে চলে যাবার পর সেই কাহিনিই কাঁথার চিত্রপট বদলে গেল। বিরহিনী সাজুর অশ্রুজলে ও বেদনায় কাঁথার সুর হলো বেদনাবিধুর। সেই করুণ রাগিণী শেষ করল সাজু তার মৃত্যুশয্যায়-
একটু আমাকে ধরো দেখি মাগো, সুচ-সুতা দাও হাতে,
শেষ ছবিখানা এঁকে দেখি যদি কোনো সুখ হয় তাতে।
পরিশেষে মৃত্যুপথযাত্রী সাজুর অনুরোধ-
এই কাঁথাখানি বিছাইয়া দিও আমার করব পরে,
ভোরের শিশির কাঁদিয়া কাঁদিয়া এরি বুকে যাবে ঝরে।
নকশিকাঁথার মাঠে বাংলার মানুষের সহজিয়া চিরন্তন আর একান্ত অনুভূতি তথা সকরুণ বিয়োগব্যথার যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তা অতুলনীয় নিঃসন্দেহে। এ কাব্যগাঁথায় রয়েছে বাংলার নারীর হাতে চিত্রিত অতুলনীয় লোকশিল্প।
কাঁথার পাড়ে জ্যামিতিক নকশা দিয়ে তৈরি অপূর্ব নকশিকাঁথাটির বর্ডারে বিভিন্ন ধরনের ফোঁড় দিয়ে সাজানো। কাঁথা সেলাই করতে কয়েকটি বিশেষ ধরনের ফোঁড় ব্যবহার করতে হয় – যেমন রান ফোঁড়, ডবল রান ফোঁড়, তেরছি ফোঁড়, বাখরা বা বাখেরা ফোঁড়, বাঁশপাতা ফোঁড়, বেকি ফোঁড়, লিক ফোঁড়, বরফি ফোঁড়, চাটাই বা পাটি ফোঁড়, বোতাম ঘর তোলা ফোঁড়, কুচি বা পেটে ফোঁড়, ভরাট ফোঁড়, ক্রস ফোঁড়, গাঁট ফোঁড়, প্যাঁচ ফোঁড়, ডাল ফোঁড়, চেন, কষিদা, হেবিংবোন ফোঁড় ইত্যাদি। এই ফোঁড়গুলো কাঁথার বৈচিত্র্য সৃষ্টি করে। প্রতিটি ফোঁড়ে দেখা যায় শিল্পীর শিল্পনৈপুণ্যের অপূর্ব কুশলতা।
লম্বালম্বিভাবে রয়েছে মাকুপাড়, টাকুপাড়, কলমিলতাপাড়, গঙ্গা-যমুনা পাড়। এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন ধরনের তাগার সমাহার, চোখ তাগা, চেন তাগা, মাছ তাগা, স্টার তাগা, পাটি তাগা, নলক তাগা, ধানের শিষ তাগা, বিদেশি চোখ তাগা বা বাজু তাগা ইত্যাদি। এই কাঁথার পাড়ের মধ্যে তাগা ও বর্ডারগুলো একটার সঙ্গে অন্যটা জোড়া দিয়ে সাজানো হয়েছে। এলোমেলোভাবে সাজানোর ফলে নকশিকাঁথাটির সৌন্দর্য অনেকাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে। অপর দিকের পাড়ের মধ্যে রয়েছে ফুলপাতা দিয়ে তৈরি করা বর্ডার। পাশে লতানো পাড় দিয়ে ছন্দোবদ্ধ স্টিজে রঙের বিন্যাসে অপূর্ব সুন্দর শিল্পরূপ গড়েছেন। রং ও রেখার মধ্যে মিশিয়েছেন লীলায়িত এবং রেখায় এনেছেন বৈচিত্র্য।
যুগ যুগ ধরে বাংলার ঘরে ঘরে নারীর হৃদয়ের কোমলতায় লালিত নকশিকাঁথার এই অনুপম শিল্পজগতের সঙ্গে মানুষের পারিবারিক ও সামাজিক পরিচিতি ছিল শত শত বছরের। তারাই ছিলেন একমাত্র নকশিকাঁথার রূপকার ও কারিগর। অধিকাংশ সময় কাঁথার নকশা মোটেও না এঁকে সরাসরি সুই-সুতা চালিয়ে একের পর এক একটি কাঁথা তৈরি করা হতো। বিভিন্ন রঙের সুতা দিয়ে মনের মাধুরী মিশিয়ে কাঁথাগুলো এফোঁড়-ওফোঁড় দিয়ে অনুপম রসের আবহ তৈরি করতেন। কিন্তু আমরা জানি কী অতুলনীয় শিল্পাবেগে রচিত হয় এক একটি নকশিকাঁথা। শুধু বাণিজ্যিক কারণেই যে শিল্পের প্রসার হয় তা নয়, বাংলার নারীরাই দেখিয়ে দিলো নিজেই সে এর রসস্রষ্টা, নিজেই ধারণ করেছে এর শিল্পরস, নিজেই প্রসারিত করেছে এর শিল্পযাত্রা। নারীমনের প্রেম, বিরহ ও স্নেহ-মমতার চিত্রও প্রকাশ পায় বেশ সুন্দরভাবে।
তথ্যসূত্র :
বাংলার নকশিকাঁথা : ড. শীলা বসাক
বাংলার ধাঁধার বিষয়বৈচিত্র্য ও সামাজিক পরিচয় : ড. শীলা বসাক
বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস : ড. এম এ রহিম