রামেন্দু মজুমদার
আইটিআই বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী আয়োজিত দ্বিতীয় ঢাকা আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসবের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল কলাক্ষেত্র মণিপুরের নাটক দ্রৌপদী। কারণ এরা এর আগে রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর মঞ্চস্থ করে ঢাকার দর্শকদের তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। তাই দ্রৌপদীর জন্যে দর্শকদের ছিল সাগ্রহ অপেক্ষা।
দ্রৌপদী নাটক শেষ হবার পর নাটক থেকে বাস্তবে ফিরতে কিছুটা সময় লাগে আমাদের। সাম্প্রতিককালে পৃথিবীর কোথাও কোনো নাটক দেখে এতটা মুগ্ধ হইনি। নিরাভরণ মঞ্চে যে এমন জাদু সৃষ্টি করা যায় – তা নাটকটি না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। নাটক শেষে দলটিকে ফুল দিতে মঞ্চে উঠে ফেরদৌসী মজুমদার দ্রৌপদীর চরিত্র রূপদানকারী অসামান্য অভিনেত্রী সাবিত্রীকে জড়িয়ে ধরে আবেগে কেঁদে ফেললেন, বললেন, তাঁর জায়গায় আমি নিজেকে কল্পনা করছি।
নাটকটি মহাশ্বেতা দেবীর গল্পের ওপর ভিত্তি করে রচিত। সাঁওতাল অধ্যুষিত এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে আইন-শৃঙখলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আদিবাসী সম্প্রদায় কীভাবে নির্যাতিত হয়, তার একটি করুণ চিত্র ফুটে ওঠে নাটকটিতে। অভিনেতাদের শরীরী অভিনয় এত নিয়ন্ত্রিত ও শিল্পসমৃদ্ধ যে বন্দুকের বদলে যখন হাত ব্যবহার করেন বা পর্দা নাড়িয়ে ধর্ষণের ইঙ্গিত দেন, তখন দর্শকদের বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না। বরং মনে হয় এভাবেই উপস্থাপনা করা উচিত। দ্রৌপদী চরিত্রে অভিনয় করেন দুজন। মঞ্চে যেভাবে অভিনয়শিল্পী বদল হন, সেটাও নির্দেশকের সৃষ্টিশীল চিন্তার ফসল। স্বল্পালোকিত মঞ্চের এক পাশ থেকে লাল কাপড়ে আবৃত একজন এসে জড়িয়ে ধরল তরুণী দ্রৌপদীকে, একটু পরেই ফিরে গেলেন সেই লাল কাপড়ে আবৃত শিল্পী। মঞ্চে হঠাৎ আমরা আবিষ্কার করলাম বৃদ্ধ দ্রৌপদীকে। বুঝতে পারলাম, লাল কাপড় জড়িয়ে আসা-যাওয়ার মধ্যে শিল্পী পরিবর্তন ঘটেছে। বৃদ্ধ দ্রৌপদীর ভূমিকায় সাবিত্রী হেইসনামের অভিনয় দীর্ঘদিন ঢাকার দর্শকের স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। পুলিশ সদস্যরা একের পর এক যখন তাঁর ওপর নির্যাতন চালায়, তখন সম্ভ্রম হারানো নারী প্রতিবাদ করে একের পর এক তাঁর শরীরের সব বসন ফেলে দিয়ে। নগ্ন শরীর দেখে বিব্রত হচ্ছে পুলিশ, আর আরো জেদি হয়ে উঠছেন সাবিত্রী। শেষ পর্যন্ত এক মুহূর্তের জন্যে পুরো নগ্ন হলেন, তাঁর চূড়ান্ত প্রতিবাদটি করলেন। এই নগ্নতার মধ্যে কিন্তু বিন্দুমাত্রও অশ্লীলতা ছিল না। এখানেই নান্দনিকতা আর অশ্লীলতার পার্থক্য।
এ প্রতিবাদ কি কেবল সাঁওতাল-অধ্যুষিত অঞ্চলে? বা মণিপুরে? নাকি যেখানেই নারীর ওপর অত্যাচার হয় সেখানকার? তাই নাটকটি আমাদের সমাজের জন্যেও হয়ে ওঠে প্রাসঙ্গিক।
মণিপুরের দুই নির্দেশক হেইসনাম কানহাইলাল ও রতন থিয়ামের খ্যাতি বিশবজোড়া। রতন থিয়ামের প্রযোজনায় অনেক জমকালো উপস্থাপনা থাকে; কিন্তু কানহাইলালের প্রযোজনায় হৃদয়বৃত্তির ওপর বেশি গুরুতব আরোপ করা হয়। সেটা দ্রৌপদীতেও স্পষ্ট। অভিনয়ের ঢং, শরীরী ছন্দ ও নেপথ্যের লাইভ মিউজিক, বিশেষ করে ড্রাম বাদন নাটকটিকে উত্তেজনায় ভরিয়ে রাখে সবসময়। মণিপুরি ভাষার সংলাপ আমরা বুঝতে পারিনি, কিন্তু বক্তব্য হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পেরেছি।
মণিপুরের রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে দ্রৌপদীর মতো প্রযোজনা করতে অনেক সাহসের প্রয়োজন হয়। কানহাইলাল,সাবিত্রী ও কলাক্ষেত্রকে আমাদের টুপিখোলা অভিবাদন।
দ্রৌপদীর ঘোর কাটতে অনেক সময় লাগবে।