logo

দ্যুতিময় উদ্ভাস এবং মৃত্যু

ভি ভা ন  সু ন্দ র ম্ – অনুবাদ : কা বে রী  ব সু

আত্মমগ্না কয়েকজন তরুণী। সকলের দৃষ্টি দর্পণে। কেন্দ্রে এক ইউরোপীয় নারী – মারি আঁতোইনেত। পরনে জমকালো প্রাচ্য-পোশাক। শরীরে গর্ভসঞ্চারের লক্ষণ পরিস্ফুট। গর্ভস্থ শিশুটি – পরে তার নাম হবে অমৃতা। মারির ডানপাশে এখন অমৃতা – সাবালিকা। না, একজন নয়, দুজন অমৃতা – একজন ভারতীয়, অন্যজন হাঙ্গেরীয় – দুজনেই স্পষ্ট দৃশ্যমান দর্পণে। ডিজিটাল ক্লোনিংয়ের কারিকুরিতে আত্মপরিচয়ের অনন্যতা আর রংবাহারি সাজে নির্বিকার শরীরী উপস্থিতি বাঁধা পড়ল বিপরীত ছন্দে। অমৃতার বাবা-মার ভিন-জাতীয়তার মিশ্রিত সূচক তাঁর সাজসজ্জায়। স্থিরচিত্রের সেই একই বিন্যাসে দর্পণের ঘেরাটোপে ওমরাও সিং এবং মারি আঁতোইনেতের দ্বিতীয়া কন্যা – নিজের মুখোমুখি। উনি আমার মা – ইন্দিরা। আয়নার প্রতিফলনে আমিও হাজির – বসে আছি দাদামশায়ের কোলে। স্থিরচিত্রের এই ‘মেলানো-মেশানো’র পরিকল্পনায় বলতে গেলে তিনি আমাকে কেবলই উসকে দিচ্ছেন। আমার পরিকল্পনার মূল চিত্রগ্রাহক তিনি। তাঁর তোলা এই ছবিগুলোর অর্ধশতাব্দী পরে ডিজিটাল জাদুযন্তর নিয়ে আসরে নেমেছি আমি। একজন চিত্রশিল্পীর ক্যামেরায় বন্দি স্থিরচিত্রের দুনিয়ায় একটা ভোয়াগল্যান্ডার (Voigtlander) ক্যামেরা হাতে সময় খুঁড়ে চলেছে এক অর্বাচীন ছোকরা। অবশ্য উসকানি দেবার মতোই সম্পর্ক আমাদের। আগে তো তারই সংকেত দিলাম। নিজের পারিবারিক স্থিরচিত্রের ভাঁড়ার কাজে লাগিয়ে ‘ভবিষ্যতে’র কোনো এক শিল্প-সৃজন – এ কাজটাই করতে চাইছে – একজন শিল্পী : এ কি বংশগতির ধারাবাহিক কৌশল! কী তার চরিত্র? সময়ের উলটপুরাণে বিশুদ্ধ আত্মপ্রেমের এ কেমন পুনরাবৃত্তি?
কিন্তু একটি কাল্পনিক চলচ্চিত্র – ‘অমৃতা’ – ডিজিটাল মন্তাজ যেখানে স্বাধীন রূপকার – তীব্র ঘাতপ্রতিঘাতে চরিত্র বদলে হয়ে ওঠে আখ্যানের কথক – সেই ছায়াছবির স্থিরচিত্রগুলি – তাদের নিছক বিন্যাসেই তো সাজানো যেত এই ছবির মিছিল। চিত্রকর অমৃতা শেরগিলের জীবন নিয়ে একটি কাহিনিচিত্র নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন কুমার শাহনী। উনি চেয়েছিলেন, চিত্রনাট্য রচনায় আমিও যোগ দিই। আমরা উজিয়ে গেলাম বুদাপেস্ট – অমৃতার জন্মস্থান : তারপর তাঁর যৌবনকাল আর চিত্রাঙ্কনের শিক্ষানবিশির শহর প্যারিস। এরপর এলাম সিমলা আর সারায়াতে – তাঁর পৈতৃক বাড়ি আর কাজের জায়গায়। সবশেষে লাহোর – সেখানে তাঁর গর্ভে সন্তান আসে এবং তিনি মারা যান। সমস্ত ঘটনা এবং তথ্যের মোড়ক একটু একটু করে খুললে গড়ে ওঠে একটা গল্পের নকশা – একটা আখ্যান – ঠিক বিপরীত সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে গড়ে ওঠা একটা বুর্জোয়া পরিবারের গল্প – তীব্র নৈকট্য আর জ্বলন্ত আকাক্সক্ষার একটি কাহিনি।
ফটো-স্বপ্ন-প্রেম-নাটক শুরু হয় ‘অন্য’ অনেকের সাক্ষাৎকার পর্বে – ‘অন্য’রা মানে তাঁর যারা ভালোবাসার মানুষ। ওমরাও সিং কবিতা লিখতেন, ছবিও তুলতেন। আর এসব কাজকর্মে চোখ ধাঁধিয়ে দিলেন এক হাঙ্গেরীয় রমণীর। ১৯১০ সালে লাহোরে তাঁর সঙ্গে এই নারীর দেখা হয়েছিল। প্রায় এক দশক আগে তিনি নিজের একটা ছবি তুলেছিলেন – নগ্ন বুকের ছাতি, দীর্ঘ চুলের রাশ নেমেছে – সদ্য øানশেষে গর্বিত আত্মঘোষণা। সাহস করে আরো একটু এগোলাম – ওনাকে বসিয়ে দিলাম প্রাচ্য কায়দায় সাজানো বসার ঘরে – পাশে তাঁর তরুণী বধূর এলিয়ে পড়া অবসন্ন শরীর – তাঁদের দুরন্ত দাম্পত্যপ্রেমের সাংকেতিক প্রকাশ।
সব কটি ছবির মূলে – প্রাণকেন্দ্রে এক ধরনের প্ররোচনার ইঙ্গিত – অন্তত দেখে আমার তেমনই মনে হয়েছে। ওমরাও সিংয়ের তোলা তাঁর এবং সেইসঙ্গে তাঁর কন্যা অমৃতার ছবিগুলো – প্রতিটির মধ্যে প্রচ্ছন্ন চিত্রগ্রাহকের প্রচণ্ড আবেগ। তাঁর এই প্রবল আসক্তি মাখানো মুহূর্তগুলোতে আবার প্রাণ প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা হলো। ইচ্ছাপূরণ করল এই ডিজিটাল যন্তরটি। আত্মপ্রতিষ্ঠ অহমের সম্পূর্ণ পুনঃসৃজিত এই নাট্য যেন একেবারে বাস্তব, বর্তমানে ঘটমান। প্যারিসে তাঁদের যে ফ্ল্যাট, তার অপরূপ বসার ঘরটির দারুণ সব ফটোগ্রাফে দেখা যায় চমৎকার সাজানো একটা মঞ্চ – সেখানে উপস্থিত সেই সময়ের অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী। ওমরাও সিংয়ের পরনে শুধুমাত্র লেংটি আর অমৃতা পরেছেন পার্টিতে যাবার পোশাক, সঙ্গে আর একজনের উজ্জ্বল উপস্থিতি – বরিস তাসলিটঝস্কি, অমৃতার সহপাঠী এবং প্রেমিক। দেয়ালে অমৃতার আঁকা ছবি – সেই ছবি দেখার উপলক্ষেই সকলকে একসঙ্গে এখানে আনা। ডিজিটাল ফটোমন্তাজের কারিকুরিতে গোপন রইল এই বানিয়ে তোলা সম্মিলন – প্রচ্ছন্ন হলো প্রকট – তীব্র যৌন আকাক্সক্ষার উৎসার আর তারই গভীর তলে নিষ্ঠুর পরিহাস।
ওমরাও সিংয়ের তোলা সমস্ত আত্মপ্রতিকৃতি তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অভিমুখ : নিজের বলিষ্ঠ শরীরের একান্ত অনুভব, বৌদ্ধিক প্রসন্নতা, বিষণœ মুহূর্ত, নিঃসঙ্গ প্রান্তিক অবস্থান। তাঁর ক্যামেরায় বন্দি তাঁর মেয়ে অমৃতার প্রতিটি ছবি – সেখানে প্রতিফলিত মেয়েটির আশা-উদ্দীপনা। ক্রমশ শিল্পী হয়ে উঠছে সে অথচ তারই সঙ্গে জড়িয়ে আছে নিজেকে দেখানোর তীব্র কামনা। তাঁর বাবার ক্যামেরার ফ্রেমে আশ্চর্য প্রসন্নতায় বাঁধা পড়েছে এই দ্বিচারী গমন। আসরে নেমেছে এবার অধুনার এক ‘পরিচালক’। ক্যামেরার সামনে নানান মুহূর্তে স্বনির্ধারিত তাঁর বিশেষ ভূমিকা – লীলায়িত বিভঙ্গ, বিশেষভাবে সাজানো দৃশ্যপট – এদেরই আমি কুশলী দক্ষতায় সাজালাম। ‘তরুণীরা’ (১৯৩২) ছবির মডেলদের সঙ্গে অমৃতা – এই দৃশ্য পরিকল্পনায় যেন অমৃতারই হাতের ছোঁয়া – বেশ কায়দা করেই দৃশ্যটি বানানো। বাস্তবিক শিল্পী আর তাঁর মডেল – এদের পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়ে বিবিধ ব্যাখ্যার মিশ্রিত অভিব্যক্তি – এ আমার সংযোজন।
ছবি আঁকার সময় বা ছবি শেষ হবার ঠিক পরেই সেই বিশেষ ছবিটির সামনে শিল্পীরা নানান ভঙ্গিতে ক্যামেরার মুখোমুখি হন – খুবই পরিচিত ‘পোজ’ এসব। কিন্তু অমৃতাকে দিয়ে আমি পরোক্ষে এই শিল্পীর চরিত্রে ‘অভিনয়’ করিয়ে নিলাম – একটু অন্যভাবে – নানান অভিমুখে। কম্পিউটারের অ্যাডোব ফটোশপের শরণাপন্ন হলাম। অমৃতার আঁকা ছবিগুলোর সামনে তাঁর পুরনো আলোকচিত্র নানাভাবে রেখে নতুন কয়েকটা ছবি তুললাম। প্রযুক্তির কেরামতিতে শিল্পী বেমালুম চলে এলো তাঁরই আঁকা ছবির ভেতরে – পশ্চাৎপটে। শিল্পী নিজে এবং তাঁর মডেলরা যেমন সত্যি রক্তমাংসের – তেমনি সত্যি হয়ে উঠল ছবিতে আঁকা মানুষগুলো। অন্যদিকে চলচ্চিত্রের স্বপ্নদৃশ্যের মতো চিত্রগ্রাহকের ‘মডেল’ অমৃতা এবং তাঁর আঁকা শরীরী বিভঙ্গ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল।
এই নাটকের যে অংশটুকু শেরগিল পরিবারে ঘটে সেখানেই অন্তর্দৃশ্যপটের দাপট। ‘অমৃতার পুনঃসৃজন’ নাটকের দ্বিতীয় পর্বটি ২০০২ সালে সাজানো। সেখানে পারিবারিক কাহিনিতে নতুন দিকবদল – আর একটি নতুন চরিত্র, সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে হাজির। দেশটি হাঙ্গেরি – সেখানে অমৃতার মামার বাড়ি। মায়ের সম্পর্কে তুতো-ভাই ভিক্টর এগানকে বিয়ে করলেন অমৃতা। তাঁর বাপের বাড়ির নিদারুণ নিদাঘতাপ থেকে বেরিয়ে পা রাখলেন একেবারে অন্যরকম এক দুনিয়ায়।
এই নতুন পর্বে ভিক্টর এবং নববিবাহিত দম্পতির আত্মীয়স্বজনের তোলা ছবিগুলো কাজে লাগালাম আমি। বেশিরভাগই আচমকা তোলা। ওমরাও সিংয়ের সাজানো-গোছানো ফটোগ্রাফ প্রদর্শনীর তুলনায় এগুলো নেহাতই নিয়মকানুনের ধার-না-মানা, এলোমেলো। একেবারে খোলা আকাশের নিচে আমার এবারের ফটোগ্রাফিক মন্তাজ। একাধারে নৈকট্য এবং দূরত্ব – নবদম্পতির চোখের চাউনিতে মিলনের শরীরী আকাক্সক্ষা আর অনতিক্রম্য ব্যবধানের যুগলবন্দি। ইউরোপীয় সংস্কৃতির উদারনৈতিক চরিত্রের কারণে সর্বসমক্ষে অর্ধনগ্নতা অনুমোদিত। দেহজ কামনার এই নাটকটি চিত্রায়ণে অমৃতার তিনটি ছবি আমি বেছে নিয়েছিলাম। প্রথমটি অমৃতার কামনাজর্জর নারীদেহ – শায়িত – আধো ঘুমে আধো জাগরণে – ওপর থেকে কোনো এক পুরুষ (ভিক্টর) দুচোখ ভরে তাঁকে দেখছে। অমৃতার পেছনে দূরে একটা হাওয়াকল – যেন অতিকায় এক উত্থিত লিঙ্গ। দ্বিতীয়টিতে শুয়ে আছেন দিবাস্বপ্নে মগ্ন অমৃতা – দেখছেন এক সুসজ্জিতা নারীকে (সে নারীও অমৃতা)। সেই নারীর অবসন্ন শরীর একটি নৌকার গায়ে প্রায় এলিয়ে পড়েছে। রমণীর যৌনতার ঘনসংবদ্ধ রূপ এই ছবিতে। তৃতীয় ছবিতে এমনভাবে উপুড় হয়ে আছে অমৃতার শরীর যেন উড়ছে – অবাধে – উড়ছে তাঁর ওড়না দামাল হাওয়ায় – আকাশে উড়ে চলেছেন এক অপ্সরা। সুস্থিত অবস্থানের বিপরীতে বহিরঙ্গনের এই ছবিগুলোতে ভরা যৌবনের উদগ্র কামনায় অভিসারী যাত্রাপথের তীব্র সংঘাতে পুরোপুরি ইউরোপীয় ঘরানায় অমৃতা উপস্থিত। তাঁর দ্বিতীয়বার ভারতে ফিরে আসার লগ্ন আসন্ন। এই ভবিষ্যৎ পর্বে দ্রুত পরিণত হবে অমৃতার নিঃসঙ্গ মনন। গভীর নৈতিকতায় আচ্ছন্ন অমৃতা ক্রমান্বয়ী পরিশীলনে হয়ে উঠবেন একজন অন্তর্দর্শী চিত্রকর।

সত্তরোর্ধ্ব বয়সের একটি আত্মপ্রতিকৃতিতে ওমরাও সিং বিশাল একটি জানলার মুখোমুখি। সেই জানলার চারগণ্ডিতে বন্দি কালো রাত্রি। তারই প্রেক্ষাপটে উদ্ভাসিত একটি দূরবীক্ষণ যন্ত্র আর তাঁর তর্জনীর অগ্রভাগ (রঁলা বার্থ বলেছিলেন, তার চোখ নয় এই তর্জনীই আসলে চিত্রগ্রাহকের ‘অঙ্গ’) আমার ফটোমন্তাজে অমৃতা একাধারে দর্শক এবং ছবির অংশবিশেষ। জ্যোৎøায় ধোয়া তাঁর মুখ, গভীর চোখের একাগ্র দৃষ্টি যেন আকাশের শূন্যতা জরিপ করছে। অনেকগুলো পরস্পরছেদী অভিমুখ এখানে উপস্থিত : জৈব অক্ষিপট, জড়বস্তু, যৌনতা আর অধিবিদ্যা। নিয়তির অমোঘ পরিণতি বিষয়ে সম্যক অবহিত একজন পিতা এবং একজন কন্যা – সম্পূর্ণ বিপরীত দুটি জীবনযাত্রা যেন অন্ধকারে এক অভিসারী বিন্দুতে পরস্পরকে স্পর্শ করেছে।
বিষণœতার পরত ছাড়াও অমৃতার কাজে আবেগময় তরলতা আর প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলার লক্ষণ স্পষ্ট – চিত্রাঙ্কনের আধুনিক ভাষায় দ্বান্দ্বিক বৈপরীত্য। কিউবিজম-পরবর্তী অবয়ববাদ তত্ত্বের সঙ্গে সমসাময়িক চিত্রাঙ্কনরীতির মেলবন্ধন তাঁর ছবিতে। আলোয় ঝলমল এই ফটোগ্রাফটি : অমৃতার স্টুডিও। এর নকশা উনি নিজেই করেছেন। আসবাবে অলংকৃত শিল্পের ছোঁয়া আর একটি কার্পেট – ঠিক মধ্যবিন্দুতে একটা কাচের পাত্র – ‘মহাজাগতিক’ বিস্ময়ের সমস্ত প্রতিফলন ধরা পড়েছে তার শূন্যতায়। এই স্বর্গীয় বস্তুটির ঠিক পেছনে একটা টুলে অমৃতাকে বসতে বললাম। ‘অমৃতার পুনর্চিত্রায়ণ’ পর্বের বিষয় এটাই – দ্যুতিময় উদ্ভাস আর মৃত্যু।
পাঞ্জাবের একজন গোষ্ঠীপতির জ্যেষ্ঠ পুত্র ওমরাও সিংয়ের জন্ম ১৮৭০ সালে। সমস্ত জীবন তিনি জ্ঞানের অন্বেষণে কাটিয়েছেন। সংস্কৃত আর ফারসি – দুই ভাষাতেই পণ্ডিত এই মানুষটি ধর্মতত্ত্বের নানান দার্শনিক জিজ্ঞাসার উত্তর সন্ধানে মগ্ন ছিলেন। টলস্টয়ের সামাজিক মূল্যবোধ আর পাণ্ডিত্যময় ভাষা তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। টলস্টয়ের সঙ্গে নিবিড় আত্মীয়তা অনুভব করতেন তিনি। এমনকি এই রুশ লেখকের পোশাকের ধরনে নিজের পোশাকের নকশাও করেছিলেন। কংগ্রেস পার্টি এবং গান্ধী ও জওহরলাল নেহরু – রাজনৈতিকভাবে তিনি এঁদের সহমর্মী ছিলেন। জোতির্বিজ্ঞান এবং যোগবিদ্যা থেকে শুরু করে হস্তলিপিবিদ্যা, ছুতোরের কাজ আর ফটোগ্রাফি – তাঁর আগ্রহের বিষয় ছিল বিচিত্র, বহুমুখী। ১৮৯২ থেকে শুরু হলো নিজের ক্যামেরায় নিজেকে বন্দি করা। ষাট বছর ধরে আশিটিরও বেশি আত্মপ্রতিকৃতি – সত্যিই অসাধারণ। সমস্ত ছবিতেই সেই বিশিষ্ট মানুষটির স্বীকৃতি স্পষ্ট। তাঁর তোলা ছবির বেশিরভাগেই শেরগিল পরিবার – অবশ্য মারি আঁতোইনেতকে বিয়ে করার পরে – এহ বাহ্য!
তাঁর প্রথমা স্ত্রী মারা যাবার কয়েক বছর পরে ১৯১০ সালে একজন হাঙ্গেরীয় অপেরা গায়িকার সঙ্গে লাহোরে তাঁর দেখা হলো। মহারাজা রঞ্জিত সিংহের নাতনি রাজকুমারী বম্বার সহযাত্রিনী হিসেবে লন্ডন থেকে এই গায়িকা এসেছেন। তাঁর নাম মারি আঁতোইনেত গ্রেটসম্যান। ১৯১২ সালের ফেব্র“য়ারি মাসে লাহোরে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন ওমরাও সিং এবং মারি আঁতোইনেত। এরপর দম্পতি গেলেন বুদাপেস্ট। কেননা মারির তীব্র ইচ্ছা তাঁর প্রথম সন্তান যেন সেখানেই প্রথম পৃথিবীর আলো দেখে। ৩০ জানুয়ারি ১৯১৩ অমৃতার জন্ম হলো। আর তাঁদের দ্বিতীয়া কন্যা ইন্দিরা জন্মগ্রহণ করল ১৯১৪ সালের ২৮ মার্চ। তখন শুরু হয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। দেশে ফিরতে পারলেন না তাঁরা। বুদাপেস্টেই রয়ে গেলেন আট বছর। বাচ্চারা কথা বলতে শিখল, পড়তে শিখল মূলত হাঙ্গেরির ভাষায়। ১৯২০ সালে দেশে ফিরে সিমলায় সংসার পাতলেন তাঁরা। আবার গেলেন বিদেশে – ১৯২৯ সালে। চিত্রাঙ্কনে অমৃতার সহজাত দক্ষতাকে সঠিক প্রথামাফিক চর্চায় আরো উন্নত করতে এবার গেলেন প্যারিস। ইকোলে দ্যে ব আর্তে ভর্তি হলেন অমৃতা। প্যারিসে সাংবৎসরিক চিত্রাবলির (জীবিত চিত্রকরদের) বিরাট প্রদর্শনী – ‘গ্রঁ সাঁলো’ – অমৃতার আঁকা ‘তরুণীরা’ সেখানে স্বর্ণপদক পেল। তাঁর অসাধারণ দক্ষতার প্রথম স্বীকৃতি। তখন তাঁর বয়স মাত্র কুড়ি। ইন্দিরা ভর্তি হলেন সর্বসাধারণের সংগীত বিদ্যালয়ে – পিয়ানো বাজানো শিখতে লাগলেন। ওমরাও সিং তাঁর বৌদ্ধিক জীবন যথারীতি নিজস্ব মেজাজেই কাটাতে লাগলেন। মাঝেমধ্যেই তাঁর ডাক পড়ত সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ে। বক্তৃতা দিতে হবে – বিষয় – ভারতীয় দর্শন। স্যাঁ এলিসের ঠিক পরের রাস্তা র্যু বাসানো। সেখানে তাঁদের বিলাসবহুল ফ্ল্যাট। এমন এক প্রাণোচ্ছল পরিবেশ গড়ে তুলেছিলেন মারি আঁতোইনেত যে তাঁর টানে সমাজতাত্ত্বিক, লেখক আর সংগীতজ্ঞের দল প্রায়শই ভিড় জমাতেন।
ঠিক এই সময়কালে ওমরাও সিং তাঁর নিজের সবচেয়ে বিশদ নিবিষ্টমনা ছবিগুলো ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন। খুবই ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ছবি এগুলো। ঔপনিবেশিক মূল্যবোধে আচ্ছন্ন এক ভারতীয় প্রজা ক্রমশ বদলে হয়ে উঠল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী এক বুর্জোয়া পরিবার। ফটোগ্রাফির নতুন রীতি-পদ্ধতি যে তাঁর অগোচর ছিল না তারই প্রমাণ মেলে এক ডজন স্বতঃবর্ণালি (Autochrome) ছবিতে (কাচের ওপর কালার নেগেটিভ – লুমিয়ের ভায়েদের উদ্ভাবন)। এর সামান্য কয়েকটা রয়েছে ভারতে। ১৯৩০ সালে নিজের স্টেরোস্কোপিক ক্যামেরার সাহায্যে বেশ কয়েকটি ত্রিমাত্রিক (3-D) ছবিও তুলেছিলেন ওমরাও সিং। আধুনিক ভারতীয় ফটোগ্রাফির অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে আমি ওমরাও সিংয়ের নাম উল্লেখ করতে চাই।
ভারতে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত অমৃতার নিজের। ১৯৩৪ সালের ডিসেম্বর মাসে বাবা-মার সঙ্গে দেশে ফিরলেন তিনি। সিমলায় নিজের স্টুডিও তৈরি করলেন। অচিরেই আধুনিক ভারতীয় শিল্প নির্মাণের অন্যতম এক অংশীদার হিসেবে নিজেকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করলেন। জাতীয়তাবাদী প্রস্তাবনায় উদ্দীপ্ত অমৃতা শুরু করলেন তাঁর তীর্থযাত্রা ‘ভারত-আবিষ্কার’। অজন্তা তাঁকে বিহ্বল করে দিলো। প্রতিটি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তুলির টান খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন তিনি। শিল্প ঐতিহাসিক কার্ল খান্ডালাভালার সঙ্গে ভারতীয় শিল্প বিষয়ে নানান আলাপচারিতায় সমৃদ্ধ হলেন। এই সময়কালে পাঁচটি শহরে তাঁর ছবির প্রদর্শনী হলো। দিল্লির প্রদর্শনী শেষ হবার পর ১৯৩৭ সালে জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে দেখা করলেন। পরের বছর ১৯৩৮ সালে স্থির করলেন হাঙ্গেরি যাবেন – সেখানে বিয়ে করবেন তুতো-ভাই ভিক্টর এগানকে। ভিক্টর তখন ডাক্তার হবার শিক্ষানবিশি করছেন।
নবদম্পতি ভারতে ফিরলেন ১৯৩৯ সালে। সারায়ায় (গোরখপুরের কাছে) মাদ্রিথিয়া পারিবারিক জমিদারিতে সংসার পাতলেন তাঁরা। নারীবিষয়ক তাত্ত্বিক ভাবনায় বিশেষিত তাঁর কয়েকটি বিশিষ্ট কাজ এখানেই করা। ১৯৪১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দম্পতি চলে এলেন লাহোরে। সেখানে ডাক্তার হিসেবে ভিক্টরের পসার জমবে এই আশা। সে বছরের ডিসেম্বরে নিজের ছবির এক বিশাল প্রদর্শনীর পরিকল্পনা করে ফেললেন অমৃতা। প্রদর্শনীর ঠিক কয়েকদিন আগে অমৃতার সামান্য একটু অসুস্থতা ডাক্তার স্বামীর চিকিৎসায় মারাত্মক হয়ে উঠল। পরিণতি মর্মান্তিক – ৫ ডিসেম্বর ১৯৪১ শেষ নিঃশ্বাস ফেললেন অমৃতা। ভিক্টর আর অমৃতার কোনো সন্তান ছিল না।
মারি আঁতোইনেত কন্যার মৃত্যুতে একেবারে ভেঙে পড়লেন। দু’দুবার আত্মহত্যার চেষ্টা করলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত ওমরাও সিংয়ের বন্দুক দিয়ে নিজের হাতে নিজেকে শেষ করে দিলেন মারি। সিমলায় নিজের পড়ার ঘরে মারা গেলেন তিনি – ১৯৪৮ সালের ৩১ জুলাই সন্ধ্যে সাতটায়। ১৯৩৭ সালেই ইন্দিরা বিয়ে করেছিলেন কে কে সুন্দরম্কে। ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের একজন সদস্য হিসেবে সুন্দরম্ তখন সিমলায় কর্মরত। ভিভানের জন্ম ১৯৪৩ সালে আর তার বোন নবীনা – সে জন্মায় ১৯৪৫ সালে। ওমরাও সিং ছোট মেয়ে ইন্দিরার সঙ্গেই আমৃত্যু ছিলেন – প্রথমে সিমলায়, পরে দিল্লিতে। ১৯৫৪ সালে ৮৪ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। ইন্দিরা মারা যান কৌশালিতে ১৯৭৫ সালে আর কে কে সুন্দরম্ দিল্লিতে ১৯৯৩ সালে শেষ নিঃশ্বাস ফেলেন।

Leave a Reply