দী প্তি দ ত্ত
চল্লিশের দশকে তথাকথিত প্রাচ্যকলা বা অবনীন্দ্রনাথের শিল্পশৈলীর একমুখী প্রভাববলয়ের বিপরীতে নিজস্ব বাস্তবতার স্বীকৃতি দিতে যে-কজন শিল্পী আত্মপ্রকাশ করেন তাঁদের মধ্যে জয়নুল আবেদিন ছিলেন অন্যতম। জাতীয়তাবাদী চেতনা বিনির্মাণের লক্ষ্যে ইতিহাস ও ধর্মের পুনরুজ্জীবনকে আশ্রয় করে যে-শিল্পচর্চা তখন চলছিল, তা নব আঙ্গিক নির্মাণের চেয়ে বিষয়াশ্রিত ছিল অনেক বেশি। বিষয়ে ছিল বর্তমানের অস্বীকৃতি। জীবনের সঙ্গে শিল্পের সম্পর্ক তৈরি তথা তরুণ শিল্পীদের নিজস্ব বাস্তবতার চেতনার রূপায়ণের স্বার্থেই নব-বাস্তববাদের ধারায় তাঁরা তুলি ধরেন। এই উপমহাদেশে প্রতিবাদী নতুন শিল্পভাষার জন্ম হয় এর মধ্য দিয়ে। কিন্তু তাতে বিষয়বস্ত্তর আধুনিকায়ন ঘটলেও শৈলীর দিক থেকে দেশজ ধারাকে একেবারে বর্জন করে বিশ্ব-প্রতিনিধিত্বশীল শিল্পের পরিত্যক্ত অঙ্গনকেই কেবল গ্রহণ করা হয়। গ্রহণের চেয়ে অনুকরণ-মোহ নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে। ফলে দেশজ শিল্পশৈলীর সঙ্গে পাশ্চাত্য শৈলীর সংশ্লেষের চেয়ে গ্রহণ-বর্জনের একমুখী প্রবণতাই প্রধান হয়ে ওঠে।
এ উপমহাদেশের শিল্পীরা যখন শাসকশ্রেণির শিল্পের দ্বিমাত্রিক তলে ত্রিমাত্রিকতার বিভ্রমে আচ্ছন্ন তখন ইউরোপে দাপটে আত্মপ্রকাশ করছে বিমূর্ত অভিব্যক্তিবাদ, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বিস্ফোরিত হয়। মনস্তাত্ত্বিক সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্যও নব্য ঔপনিবেশিক এই সময়ে প্রচারমাধ্যমের কল্যাণে সম্প্রসারিত হয়। ফলে বিংশ শতকের প্রথম পর্ব থেকেই যেখানে ইউরোপীয় শিল্পে আভাঁ-গার্দগুলো সূচিত হয়েছে গ্রহণ-বর্জনের মুক্তধারায় বা যথাযথ সিনথেসিসের মধ্য দিয়ে, সেখানে এই উপমহাদেশের শিল্পকলা মুক্তবাজারের একমুখী শিকারে পরিণত হয়েছে। এই চরিত্র-সূত্রের ধারাবাহিকতায় স্বাধীন বাংলাদেশের শিল্পকলার আত্মপ্রকাশ ও বিস্তার শিল্পী জয়নুল আবেদিনের হাত ধরে। সাতচল্লিশের মধ্য দিয়ে খন্ডিত বাঙালি সত্তার তৈরি হয় ভিন্ন ভিন্ন জাতীয়তাবাদী পরিচয়। ফলে আত্মপরিচয়ের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য নির্মাণের তাগিদ আমাদের শিল্পভাষাকে আরো বেশি পশ্চিমমুখী করে তোলে দেশের ভেতরে আত্মানুসন্ধানের চেয়ে। আর এই চেতনার তলে পরোক্ষ জোগানদাতা হয় সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রচরিত্র। ফলে এদেশে আধুনিক শিল্পের ভাষা নির্মাণে বাঙালি চেতনার সঙ্গে ধর্মবোধের সংশ্লেষ ঘটে নানামুখী দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়েই। এই দ্বন্দ্ব কোনো একটি শৈলী নির্মাণের চেয়ে বলা যায় অধিক ভূমিকা রেখেছে বিশ্বশিল্প থেকে শৈলী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে।
সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের চিত্রশিল্পে সবচেয়ে প্রভাবশালী শৈলী হিসেবে কয়েক যুগ ধরে আধিপত্য বজায় রেখেছে বিমূর্ত ধারার শিল্পপ্রবণতা। এদেশে এই শৈলী রূপভাবনা বা অভিব্যক্তিবাদের প্রকাশ হিসেবে আসেনি। ধীরে ধীরে এই শৈলী গড়ে উঠেছে এবং ভিত্তি দৃঢ় হয়েছে অ্যাকাডেমিক রীতির অগ্রহণযোগ্যতা এবং আন্তর্জাতিক শিল্পে বিমূর্ত আঙ্গিকের আধিপত্য দেখে এর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষার মধ্য দিয়ে। ফলে চিত্রপটে সম্মিলন ঘটেছে বাস্তববাদী ধারার সরলীকরণ ও সুন্দর চিত্রতল নির্মাণের প্রচেষ্টার। এর মধ্যেই গড়ে উঠছে একটি শিল্পের নিজস্ব আত্মপরিচয়, যা গ্যালারি কায়ায় প্রদর্শিত শিল্পকর্মের বিষয়বস্ত্ততে বা রং-ভাবনায় খুঁজে পাওয়া যাবে।
গ্যালারি কায়ায় আমিনুল ইসলাম, মুর্তজা বশীর, কাইয়ুম চৌধুরী, রফিকুন নবী, তরুণ ঘোষের মতো প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের পাশাপাশি তরুণ ছাপচিত্র শিল্পী আনিসুজ্জামান বা সম্ভাবনাময় চিত্রশিল্পী বিশ্বজিৎ গোস্বামীর শিল্পকর্মসহ মোট ত্রিশজন শিল্পীর শিল্পকর্মের প্রদর্শনী চলছে। প্রদর্শনীতে দর্শক গ্যালারির প্রথম কক্ষেই একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হবেন শিল্পী শম্ভু আচার্যের শিল্পকর্মটি দেখে। এখানে নতুন কোনো সম্বোধন বা ঘোষণা ব্যতিরেকেই আধুনিক প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত আর সব শিল্পীর সঙ্গে একদল ভুক্ত হয়েছেন শিল্পী শম্ভু আচার্য। কোনো তত্ত্বে নয় বা কোনো আধুনিক শিল্পীর নতুন শৈলী উদ্ভাবনের কৌশল হিসেবে নয়, এখানে গ্যালারি কায়া সহজাতভাবে কারু ও চারু বিভাজনকে একাকার করে দিয়েছে। যদিও শিল্পীর ছবিতে বিষয় হিসেবে বংশানুক্রমিকতার সূত্র ধরে রাবণের হাতে সীতার অপহরণ দৃশ্যই এসেছে।
তার পাশেই রয়েছে শিল্পী মনসুর-উল-করিমের শিল্পকর্ম। মনসুর আধুনিক শিল্পী হলেও পরম্পরা ধর্ম অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। তবে তা বংশানুক্রমিকতার নয়, তা হলো পাশ্চাত্য শিল্পশৈলীর প্রভাব। এ-প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত কাজটি দেখে শিল্পী আরশাইল গোর্কির কথাই বেশি মনে হয়।
শিল্পী আমিনুল ইসলাম তাঁর চিত্রকর্মকে কতকগুলো উল্লম্ব সারিতে ভাগ করেছেন। দুটো সারির মাঝে দেশজ রঙে একইভাবে চারটি ফিগারকে স্থাপন করেছেন। চারটি ফিগারের একটি শুধু রেখায় সম্পন্ন করেছেন। টেক্সচার ব্যবহার করে কতকগুলো সারি তৈরির ফলে তাঁর ছবিতে যে ফাঁকগুলো তৈরি হয়েছে সেই ফাঁকগুলোতে যেমন Presence in Absence ধারণা যুক্ত হয়েছে, তেমনি তিনটি রঙিন ফিগারের বিপরীতে শুধু রেখায় সৃষ্ট ফিগারেও এই ধারণার দেখা মেলে। এবং একই সঙ্গে কম্পোজিশনে ভারসাম্য তৈরি হয়। তাঁর ছবিতে ফিগারগুলোকে কয়েকটি রঙিন উল্লম্ব রেখার সমষ্টিও বলা যেতে পারে। শিল্পীর এই কাজের পেছনে জর্জ স্যুরাতের প্রভাব কাজ করে থাকতে পারে।
কাইয়ুম চৌধুরীর একাধিক কাজ থাকলেও একটি কাজে ভিন্নধর্মী হওয়ার চেষ্টা করেছেন নিজস্ব শৈলী বজায় রেখেই। উজ্জ্বল রঙের প্রাধান্য কমিয়ে এনেছেন মিনিমালিস্ট রীতিতে। যদিও শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর এই কাজটিতেও নকশাধর্মী মটিফের পুনরাবৃত্তি এড়াতে পারেননি, যা কাজটির সামগ্রিকতায় অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হয়।
মুর্তজা বশীরের কাজটিতে আমাদের চেনা আধুনিক নারীর দেখা মেলে অবনীন্দ্রনাথের ‘অভিসারিকা’র রাত্রির সমতলীয় অন্ধকারের বিপরীতে। অবয়বটি রাবীন্দ্রিক চিত্রকলার আধুনিকার মতো চিত্রতলে রচিত আর শাড়ির পাড়ের রেখায় রবির doodle-এর ছন্দই কথা বলে ওঠে। শিল্পী তাঁর এই কাজটিতে দেশীয় রং ব্যবহার করেছেন।
শিল্পী কালিদাস কর্মকারের কাজে ফরমাল অ্যাপ্রোচ নির্মাণে সচেতনতা লক্ষ করা যায়। একটি সুন্দর মুখশ্রীর সঙ্গে একটি পাখি বা পায়রার কম্পোজিশন যদিও সাধারণ বিষয় আমাদের চিত্রকলায়। আবার কারো কারো চিত্রশৈলীই গড়ে উঠেছে পুরুষের একরৈখিক এই সৌন্দর্যবোধের আধিপত্যের দ্বারা। সেখানে কালিদাস তুলি চালনায় ও রূপ নির্মাণে এদেশের সৌন্দর্যবোধের অনুগামী নয়। তাঁর ছবিতে একটি অবয়ব ও হাঁসের ফর্ম থাকলেও তাতে বিষয়ের প্রাধান্য নয় বরং তিনি ছবি নির্মাণের উপাদানগুলোকে ব্যবহার করেছেন সচেতনভাবে। এখানে পশ্চাৎপট ও মধ্যপটে রচিত অবয়ব এক হয়ে গেছে। ভিঞ্চির মোনালিসার মতো করে এখানে দুটি তল আলাদা করা যাবে না। সম্মুখপটে পায়রার বদলে গ্রামীণ চরিত্রের সহগামী একটি হাঁস এঁকে দুটি ভিন্ন তল তৈরি করেছেন। ফলে ছবিতে স্পেস ধারণা যেমন তৈরি হয়েছে, অন্যদিকে অবয়বে ব্যবহৃত তরল রেখার সঙ্গেও ফর্মটির সামঞ্জস্য রক্ষা হয়েছে। যদিও চিত্রতলে ফর্মের এই বিন্যাসের ক্ষেত্রে শিল্পীকে যেমন পল ক্লির অনুগামী মনে হয় তেমনি রঙের ব্যবহার ও তুলি সঞ্চালনের ধরন ফ্রাঙ্ক অরব্যাকের কথাই মনে করিয়ে দেয়।
চিত্রকর্মের পাশাপাশি গ্যালারিতে কিছু ছাপচিত্রের কাজও রয়েছে। তার মধ্যে নিয়মিত ছাপচিত্রশিল্পী আনিসুজ্জামান, নগরবাসী বর্মণের কাজ যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে শিল্পী মনিরুল ইসলাম, রফিকুন নবী বা আশরাফুল হাসানের শিল্পকর্মও। এক্ষেত্রেও একটি নতুন বিষয় গ্যালারি কায়া উপস্থাপন করেছে। সাধারণত চিত্রকর্মের মতোই আমাদের গ্যালারিগুলো ছাপচিত্র প্রদর্শন ও বিক্রি করে থাকে। কিন্তু এ-মাধ্যমে একটি কাজের অনেকগুলো কপি থাকে বলে তার দাম সেই কপির সংখ্যা, ভবিষ্যৎ সম্ভাব্যতা ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে। গ্যালারি কায়া প্রতিটি ছাপছবির সঙ্গে লেভেল ব্যবহার করে এর এডিশন সংখ্যা দিয়ে দিয়েছে, যা ভবিষ্যৎ শিল্প সংগ্রাহক ও শিল্পীদের স্বার্থের অনুগামী ও স্বচ্ছতা তৈরির একটি দিকনির্দেশনা।
এখানে শিল্পী আনিসুজ্জামানের কাজকে সত্যিকার অর্থেই শিল্পীর স্বকীয় একটি শৈলী বলা যায়। নব্য নাগরিক পরিকাঠামো নির্মাণের বাস্তবিক দৃশ্যকেই তিনি একটি ফরমাল রূপ দিয়েছেন। অন্যদিকে তরুণ চিত্রশিল্পী বিশ্বজিৎ গোস্বামীর কাজেও মিনিমালিস্ট ধারায় একটা নিজস্ব নির্মাণপ্রবণতা লক্ষ করা যায়, যা পুরো গ্যালারিতে একটি ভিন্ন আবহ তৈরি করে; যাকে ধ্যানমগ্ন বা meditative art বলা যেতে পারে। মার্ক রথকোর contemplative ধারণাও এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে।
আধুনিক শিল্পে নতুন নতুন মাধ্যম ও ধারণার প্রায় অধিকাংশ লক্ষণই আমাদের শিল্পে দৃশ্যমান হলেও এখনো স্পষ্ট নয়। তবে যে বৈশিষ্ট্যগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তার উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে চলমান জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীর কথা বলা যায়। একে বর্তমান বাংলাদেশের সমসাময়িক শিল্পপ্রবণতার একটি স্মারক হিসেবে দেখা যেতে পারে। এই পরিপ্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে গ্যালারি কায়ায় প্রদর্শিত শিল্পকর্মগুলোকে একটি সুনির্দিষ্ট চিত্ররীতির প্রতি পক্ষপাতিত্বের নিদর্শন হিসেবে দেখার সুযোগই বেশি। পঞ্চাশ-পরবর্তী জয়নুলে যে নিরীক্ষাধর্মী বিমূর্ত রীতির সূচনা তার ধারা এখনো প্রবহমান না বলে বলা যায় এটি বাংলাদেশের শিল্পবাজারে স্বীকৃত ও বিক্রয়যোগ্য একটি মূল ধারা। ফলে নতুন গ্যালারিগুলো, এমনকি প্রতিষ্ঠিত গ্যালারিগুলোও অর্থনৈতিক দিক বিবেচনার ক্ষেত্রে বিমূর্ত শিল্পরীতিকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে। তাই ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের কাজের প্রতি ঔৎসুক্য লক্ষ করার মতো। কাজের মানের চেয়ে স্বাক্ষর বাছাইয়ের সচেতনতাও এতে ধরা পড়ে। শিল্পী মনিরুল ইসলাম ও রফিকুন নবীর মতো শিল্পীদের কাছ থেকে কোনো রকমে নামমাত্র শিল্পকর্ম আদায় করে নিয়ে স্বাক্ষর-মূল্য বিবেচনায় গ্যালারি সেগুলো ব্যবহার করলে তাতে শুধু প্রদর্শনীর মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না, প্রতিষ্ঠিত শিল্পীর শৈল্পিক মানকেও একটু অসচেতনতার কারণে নিচে নামিয়ে আনা হয়, যা এই প্রদর্শনীর দুটি ছাপচিত্রের ক্ষেত্রে ঘটেছে বলে মনে হয়। এর পেছনের কারণ হিসেবে আধুনিক শিল্পরাজ্যের চরিত্র সম্পর্কে আমেরিকান শিল্প-সমালোচক ডেভিড হিকির (David Hickey) মতামতকেই (‘too obsessed with money and celebrity’) স্মরণ করা যথাযথ বলে মনে হয়।