logo

দেবযানী চলিহা : এক মান্য নৃত্যশিল্পীর আলেখ্য

আ বু ল  আ হ সা ন  চৌ ধু রী

নাচের ভুবনে – বিশেষ করে মণিপুরি নাচের ক্ষেত্রে, দেবযানী চলিহা সম্ভ্রম-জাগানো একটি নাম। নাচের প্রসঙ্গে প্রায় বিরাশি বছরের এই প্রবীণ শিল্পীর নাম শুধু দেশে নয়, কিছু পরিমাণে বিদেশেও শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত। নৃত্যকলা দেবযানীর চর্চা ও মনোযোগের কেন্দ্রে থাকলেও এই বহুমাত্রিক শিল্পসাধক নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন শিল্পকলার ও সারস্বতসাধনার নানা দিকে – সংগীত, সাহিত্য, অধ্যাপনা, সাময়িকপত্র-সম্পাদনা, সামাজিক কর্ম, সাংস্কৃতিক-সংগঠন নির্মাণ, নৃত্যশিক্ষায়।

দেবযানী জন্মেছিলেন অসমের সেই সময়ের যোড়হাট জেলার শিবসাগরে, ১৯৩৪-এর ১০ মে। অবশ্য এখন সেই শিবসাগর আলাদা জেলার মর্যাদা পেয়েছে। জন্মের আগেই, মাতৃগর্ভে যখন ছিলেন, আশীর্বাদ পেয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধির। অসমের শিবসাগরের চলিহা কাকতি-পরিবার বিত্ত, বিদ্যা ও কৌলীন্যে বিশিষ্ট ছিল। উত্তর ভারতের কনৌজ থেকে তাঁরা এখানে এসেছিলেন। অসমের চা-বাগিচা তৈরিতে চলিহা-পরিবারের ছিল অগ্রণী ভূমিকা। এই পরিবারের সদস্যরা শ্রম-মেধা-প্রজ্ঞার গুণে কেউ ব্যারিস্টার, কেউ চা-কর, শিল্পপতি, অসম পাবলিক সার্ভিস কমিশনের প্রথম চেয়ারম্যান, কেউ বা অসমের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। পরিবারের মেয়েরাও পিছিয়ে ছিলেন না। অসমের প্রথম যুগের মহিলা চিকিৎসক এই পরিবারেরই কন্যা। চলিহা-পরিবারের মেয়েদের উদ্যোগে ১৯২৭-এ ঘরজেউতি নামে অসমের নারী-সম্পাদিত প্রথম পত্রিকা বের হয়। গ্রামোফোন রেকর্ডে  গান-দেওয়া ও তার সংগীত-পরিচালনাও যেমন করেছেনচলিহা-পরিবারের মেয়েরা, তেমনই চলিস্নশের দশকে ফিল্মে অভিনয়ের কৃতিত্বও তাঁদেরই প্রাপ্য। পারিবারিক ঐতিহ্যের এই উজ্জ্বল প্রেক্ষাপটেই দেবযানীর আবির্ভাব।

দেবযানীর ছেলেবেলা কেটেছে শিবসাগরের যৌথ-পরিবারে আর করঙ্গানি চা-বাগানে মা-বাবার সঙ্গে। তারপর কলকাতায় আসা, সেখান থেকে শামিত্মনিকেতনে। প্রাতিষ্ঠানিক পাঠের শুরম্ন এই শামিত্মনিকেতনেই – পাঠভবনের ছাত্রী ছিলেন তিনি। অনেক মধুর স্মৃতির বাঁধন ছিঁড়ে দুবছর পর আবার কলকাতায়। এখানেই প্রবেশিকা ও উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে প্রেসিডেন্সিতে বিএ ক্লাসে ভর্তি হওয়া। কিন্তু হঠাৎই এখানকার নোঙর তুলে পাড়ি জমাতে হলো বাবার কর্মস্থল শিলংয়ে। বাবা তখন দায়িত্ব নিয়েছেন অসম পাবলিক সার্ভিস কমিশনের প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে। দর্শনের স্নাতক হয়ে আবার সেখান থেকে ফিরে দেবযানীর এমএ পড়তে আসা ওই প্রেসিডেন্সিতেই, – বিষয় ওই দর্শনই। পাশ করার পর প্রথমেই সুযোগ আসে শিক্ষকতার – অনেকদূরে মণিপুরের ইম্ফলের ধনমঞ্জরি কলেজে। তারপর একে একে কলকাতার শ্রীশিক্ষায়তন কলেজ, আসানসোলের বিধানচন্দ্র কলেজ – কিন্তু কোথাও দুবছরের বেশি সময় থাকা হয়নি নানা কারণে। এরপর যুক্ত হন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্বভারতীর সঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে এখনো  নৃত্য-বিষয়ের পরীক্ষা-সংক্রামত্ম কাজে নিয়মিত ডাক আসে এই দুই প্রতিষ্ঠান থেকে।

শিক্ষকতার বাইরে তাঁর কাজের আলাদা ধরনও রয়েছে। একসময়ে অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর অসমিয়া মুখপত্র আকাশীর সহসম্পাদক ছিলেন। সম্পাদনা করেছেন অসমিয়া শিশুতোষ পত্রিকা ভাইটি ভনীটি। বই লিখেছেন, অনুবাদ করেছেন অসমিয়া ভাষায় – যথাক্রমে জন্তু-জানোয়ার ও এমিল লুড্উইগের এব্রাহাম লিঙ্কন। মাইস্নাম গুরম্ন অমুবি সিংয়ের একটি তথ্যনিষ্ঠ জীবনী লিখেছেন ইংরেজিতে – যাঁর কাছে তিনি শিখেছিলেন খাঁটি মণিপুরি নাচ।

এই লাজ-নম্র স্বভাবের অসম-কন্যা প্রেম করে বিয়ে করেন বাঙালি বসু-পরিবারে। এঁদের আদিবাস ছিল বাংলাদেশের বিক্রমপুরে। প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী অতুল বসু ছিলেন এই পরিবারেরই সমত্মান। যাই হোক, স্বামীর রেলের চাকরির সুবাদে দেবযানীকে প্রায় সারা ভারত ঘুরে বেড়াতে হয়। এই কারণে প্রায় বছর সাতেক নাচের মূলধারার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অনেকটা ছিন্ন থাকে বললেই চলে, ওই সময়টাতে পালা-পার্বণে রেলের অনুষ্ঠান কিংবা স্থানীয় স্কুল-কলেজে নৃত্য-পরিবেশন ও পরিচালন – এইটুকুই শুধু ছিল নাচের সঙ্গে সংযোগ। ১৯৬৭-তে পাকাপাকি কলকাতায় ফিরে আসার পর আবার নতুন করে ছেঁড়া তার জোড়া লাগে।

সেই শিশুকাল থেকেই নাচের প্রতি তাঁর আগ্রহ-আকর্ষণ। শিবসাগরের বাড়িতে বিহুর নাচগান, করঙ্গানি চা-বাগানে নানা পালা-পার্বণে সাঁওতালিদের নাচ-গান দেখে শিশুমনে নাচের প্রতি একটা ঝোঁক তৈরি হয়। আর বাড়িতে অতিথি এলে মাঝেমধ্যেই মা বলতেন নাচ দেখাতে। এতদিন তো চলছিল দেখে-দেখে বা নিজের মন থেকে পাঁচমিশেলি ঢঙে নাচ-দেখানোর পালা। এবারে নাচের প্রাতিষ্ঠানিক হাতেখড়ি হলো শামিত্মনিকেতনে এসে। যে মণিপুরি নাচ দিয়ে শিক্ষানবিশি-পর্ব শুরম্ন, তাই-ই নাচের ক্ষেত্রে শেষ পর্যমত্ম জীবনের ধ্রম্নবতারা হয়ে ওঠে। শামিত্মনিকেতন থেকে কলকাতায় ফিরে এসে প্রথমে বাণী বিদ্যাবীথি ও পরে ব্রজবাসী সিংহের কাছে মণিপুরি নাচ শেখা শুরম্ন হয়। সময় গড়িয়ে যায় – স্কুল-কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে একটা বড়ো সুযোগ মেলে ১৯৫৫ সালে দিলিস্নতে ইন্টার ইউনিভার্সিটি ইয়ুথ ফেস্টিভালে মণিপুরি নাচের একক প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেওয়ার। সেই উৎসবে একটি মণিপুরি মেয়ে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে মণিপুরি নাচ পরিবেশন করে। এই নাচ দেখে দেবযানী বুঝতে পারেন, এতদিন মণিপুরি নাচের নামে তিনি যা শিখেছেন, সব ভুল – সব মেকি। তখন থেকেই আসল মণিপুরি নাচ শেখার একটা আকুলতা মনের মধ্যে জেগে ওঠে।

এর আগেই ১৯৫৪-৫৫ সালের দিকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে কলকাতায় গড়ে ওঠে আকাদেমি অফ ডান্স ড্রামা অ্যান্ড মিউজিক। সেখানে নৃত্য বিভাগের ডিন হিসেবে দায়িত্ব নেন নৃত্যাচার্য উদয়শঙ্কর। একই পাড়ায় গল্ফ ক্লাব রোডে মুখোমুখি বাড়িতে থাকার ফলে উদয়শঙ্কর চিনতেন দেবযানীকে। খুব উৎসাহ নিয়ে আকাদেমিতে ভর্তি হন দেবযানী। তাঁর আগ্রহ ও ঝোঁক দেখে আসল মণিপুরি নাচ মণিপুরে গিয়ে গুরম্ন ধরে শেখার পরামর্শ দেন উদয়শঙ্কর। সেই মোতাবেক দেবযানী মণিপুরে গিয়ে মাইস্নাম গুরম্ন অমুবি সিংয়ের কাছে মণিপুরি নাচ শিখতে শুরম্ন করেন। এই যোগ্য শিষ্যাকে গুরম্ন তাঁর বিদ্যা উজাড় করে দেন। পাকা প্রায় আড়াই বছর গুরম্নগৃহে থেকে দেবযানী সিদ্ধিলাভ করে ফিরে আসেন। নাচের ভুবনে নতুন যাত্রা শুরম্ন হয় দেবযানীর। ক্রমে হয়ে ওঠেন মণিপুরি নাচের এক মহান শিল্পী ও প্রাজ্ঞ প্রশিক্ষক। মণিপুরি নাচের আঙ্গিকে দেবযানী-পরিকল্পিত ও পরিবেশিত নৃত্যের মধ্যে ‘মহাশ্বেতা’, ‘উষা-অনিরম্নদ্ধ কথা’, ‘ব্রজলীলা’, ‘শ্রীকৃষ্ণ বন্দনা’, ‘গৌরাঙ্গ-নর্তন’, ‘দশাবতার’, নজরম্নলের গান নিয়ে রচিত ‘শ্রীকৃষ্ণ কথা’ দর্শকপ্রিয় হয়েছিল। সমঝদার দর্শক কিংবা নৃত্যগুণী যাঁরা, তাঁরা বরাবরই দেবযানীর নাচের অকুণ্ঠ তারিফ করেছেন। কাগজে কাগজে তাঁর নাচের সুখ্যাতি ও প্রশংসার কথা বেরিয়েছে। সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় (৭ জুন ১৯৮০) রবীন্দ্রসদনে তাঁর এক নাচের অনুষ্ঠান সম্পর্কে বলা হয় : ‘দেবযানী চলিহার মণিপুরি নাচ সম্পূর্ণভাবেই মাটি থেকে উঠে আসে। আধুনিকতার খাতিরে কোন শহুরে পালিশ লাগিয়ে তাকে কমার্শিয়াল করা হয় নি। […] অসমের দেবযানী চলিহার মণিপুরি নৃত্যের ভাবনার অনুষঙ্গ আসে বাংলার জয়দেবের কবিতা থেকে – সমাহিত মণিপুর এক হয়ে যায় […]।’ আর ‘The Statesman’ (10 June 1975) মমত্মব্য করে : ‘Devjani Chaliha gave a Manipuri dance recital at the Kala Mandir on Friday evening. Miss. Chaliha is undoubtedly among the most talented exponents, in Calcutta, of this art form […].’ বয়সকালে তো মঞ্চ দাপিয়ে বেড়িয়েছেন, আর এখন প্রায় পঁয়তালিস্নশ বছর ধরে মণিপুরি নাচ শেখাচ্ছেন ‘মৈতৈ জগোই’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করে। কলকাতার শ্রীশিক্ষায়তন কলেজের মঞ্চে দেবযানীর নাচ দেখে দাদা উদয়শঙ্কর একবার বলেছিলেন : ‘এই নাচটা দেখে বোঝা যায় যে এর পেছনে কতখানি মেহনত আছে, কতখানি চিমত্মা আছে। আমার আশীর্বাদ রইলো তুমি এই নৃত্যপরম্পরাকে আরও অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে।’ সময় সাক্ষ্য দেয় উদয়শঙ্করের এই শুভাশিস নিষ্ফল হয়নি। আর গুরম্ন অমুবি সিং প্রথম সাক্ষাতে দেবযানীর শিষ্য হওয়ার আরজি সম্পর্কে বলেছিলেন : ‘শিষ্য যেমন গুরম্নর খোঁজে আসে তেমনই গুরম্নও শিষ্য খোঁজে। আর সে শিষ্য কেমন হবে সেটা শিষ্যের উপর নির্ভর করে।’ দেবযানী পরিপূর্ণভাবে গুরম্নর প্রত্যাশা পূরণ করেছিলেন। তাই গুরম্নর মোক্ষম মমত্মব্য স্মরণে আসে : ‘মীনাক্ষীকে [দেবযানীর পোশাকি নাম] শেখালে অনেক শেখা যায়।’ এ যে কত বড় দুর্লভ স্বীকৃতি, তা বুঝতে কষ্ট হয় না আদৌ।

অমুবি সিং ও উদয়শঙ্কর – দেবযানীর এই দুই গুরম্নই তাঁর নৃত্যচর্চার প্রেরণা ও সহায়ক ছিলেন। অমুবি সিংয়ের সঙ্গে তাঁর যে পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, গুরম্নর অবর্তমানেও তা আজো অবিচ্ছিন্ন আছে। দেবযানী গুরম্নকে নিয়ে ইংরেজিতে যে বই (‘Maisnam Guru Amubi Singh’) লিখেছেন, তা এপ্রিল ২০১৫ প্রকাশ করেছে ইম্ফলের ‘জওহরলাল নেহরম্ন মণিপুর ডান্স আকাদেমি’ – এটি নয়াদিলিস্নর ‘সংগীত নাটক আকাদেমি’র একটি অঙ্গ-প্রতিষ্ঠান। দেবযানীর এই বইটি কেবল গুরম্ন অমুবি সিংয়ের জীবনী নয়, সেইসঙ্গে মণিপুরি নৃত্যের নানা প্রসঙ্গ, পরম্পরা ও অনুষঙ্গও এতে উঠে এসেছে। ফলে এটি মণিপুরি নৃত্যগুরম্ন ও মণিপুরি নৃত্য সম্পর্কে একটি আকর গ্রন্থ হয়ে উঠেছে।

দেবযানীর নৃত্যজীবনে উদয়শঙ্করের ভূমিকার কথাও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয়। দেবযানী যা হয়ে উঠেছেন তার পেছনে রয়েছে গুরম্ন অমুবি সিংয়ের অবদান – আর এই ‘হয়ে ওঠা’র দিকনির্দেশনা দিয়েছেন উদয়শঙ্কর। দেবযানীর প্রতি তাঁর স্নেহ-স্বীকৃতির দৃষ্টামত্ম মেলে যখন তিনি তাঁর শঙ্করস্কোপের ‘বিউটি কনটেস্ট’ নামে একটি আইটেমে দেবযানীকে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেন।

ভারতবর্ষের নানা জায়গায় দেবযানী যেমন নৃত্য-পরিবেশনার জন্য আমন্ত্রিত হয়েছেন, তেমনি দেশের বাইরে থেকেও তাঁর ডাক এসেছে। তিনি যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কায় নৃত্যানুষ্ঠান ও নৃত্যবিষয়ক লেকচার-ডেমোনেস্ট্রেশনে অংশ নিয়েছেন। পেয়েছেন অনেক স্বীকৃতি-সম্মাননা-পুরস্কার – এর মধ্যে বিশেষ উলেস্নখযোগ্য : পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সংগীত আকাদেমি অ্যাওয়ার্ড (২০০৪), ‘নৃত্যরত্ন’ উপাধি (মণিপুরি সাহিত্য পরিষদ, ২০০৫), মণিপুর স্টেট কলা আকাদেমি অ্যাওয়ার্ড (২০০৬), উদয়শঙ্কর অ্যাওয়ার্ড (ডিপার্টমেন্ট অফ কালচার, গভর্নমেন্ট অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল, ২০০৭), মাইস্নাম গুরম্ন অমুবি সিং সম্মান (মণিপুরি সাহিত্য পরিষদ, ২০১০), গুরম্ন তরম্নণকুমার সম্মান (মণিপুর, ২০১১), টেগোর আকাদেমি পুরস্কার (সংগীত নাটক আকাদেমি, ২০১২), ডায়মন্ড জুবিলি স্পেশাল অনার (জওহরলাল নেহরম্ন মণিপুর ডান্স আকাদেমি, ২০১৪) কনভোকেশন-স্পিকার (প্রাচীন কলাকেন্দ্র, ২০১৫), ইউনিভার্সিটি উইমেন্স অ্যাসোসিয়েশন সম্মাননা (২০১৫)। এই আংশিক খতিয়ান থেকেই ধারণা করা যায় এই শিল্পগুণী-বন্দনার স্বরূপ।

দেবযানী চলিহা জড়িত ছিলেন ও আছেন নানা সাংস্কৃতিক-সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। মণিপুরি নৃত্যশিক্ষার জন্য গড়ে তুলেছেন ‘মৈতৈ জগোই’ নামের প্রতিষ্ঠান। প্রশিক্ষক ও পরিচালক হিসেবে তিনি জড়িত আছেন এর সঙ্গে। গোবিন্দন কুট্টির মৃত্যুর পর দেবযানী ২০০৬ থেকে ওয়েস্ট বেঙ্গল ডান্স গ্রম্নপ ফেডারেশনের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন। পশ্চিমবঙ্গে এটিই নৃত্যশিল্পী, পরিচালক ও অনুরাগীদের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান। এই সংস্থার নানামুখী কার্যক্রমে এই বয়সেও দেবযানী সক্রিয় ভূমিকা পালন করে চলেছেন।

নাচের পাশাপাশি দেবযানীর গানের চর্চার কথাও খানিক বলা প্রয়োজন। নাচটাই তাঁর জীবনে ছিল মুখ্য, তাই গানের ব্যাপারটা অতখানি গুরম্নত্ব হয়তো পায়নি। রীতিমতো গুরম্ন ধরে গান শিখেছেন – বিশেষ করে উচ্চাঙ্গসংগীত ও রবীন্দ্রসংগীত। অবশ্য তুলনায় সামান্য হলেও এ-বিষয়ে অসমিয়া ও লোকগানের কথাও বলতে হয়। উচ্চাঙ্গসংগীতে তালিম নিয়েছেন ওসত্মাদ ফৈয়াজ খাঁ সাহেবের সাক্ষাৎ-শিষ্য ওসত্মাদ সুনীল বসুর কাছে। শিলংয়ে যখন ছিলেন তখনো শুদ্ধসংগীতের চর্চায় বিরতি পড়েনি। রবীন্দ্রনাথের গান শিখেছেন অরবিন্দ বিশ্বাস ও সুচিত্রা মিত্রের মতো প্রখ্যাত শিল্পীর কাছ থেকে। নাচের সঙ্গে গান গেয়েছেন, আবার গানে
সুর-যোজনাও করেছেন। গ্রামোফোন রেকর্ডেও গান দিয়েছেন দেবযানী। হিন্দুস্থান রেকর্ড থেকে তাঁর অসমিয়া শিশুতোষ ছড়ার গান এবং প্রথম অসমিয়া চলচ্চিত্র জয়মতী ছবির গানের (‘লরা বুঢ়া কাক কয়’) রিমেক ডিস্ক বেরিয়েছে। শিশুশিল্পী হিসেবে বেতারের সঙ্গে প্রথম সম্পর্ক। তারপরে বড় হয়ে বেতারে গান করেছেন একা এবং ভূপেন হাজারিকার সঙ্গে। বিশেষ স্নেহ-সান্নিধ্যও লাভ করেছেন এই বিখ্যাত অসমিয়া শিল্পীর। আবার চলচ্চিত্রের প্রবাদপুরম্নষ প্রমথেশ বরম্নয়ার অনুজা গোয়ালপাড়ার লোকগানের ভা-ারি নীহার বরম্নয়ার সঙ্গে তো ছিল একেবারে ঘরোয়া সম্পর্ক, লোকগানের হাতেখড়িও তাঁর কাছে। গানের চর্চা থেকে এ-বয়সেও দূরে সরে যাননি – এখন অবশ্য গান করেন নাচের প্রয়োজনে আর নিজের জন্য।

নাচ-গান-সমাজকর্ম-বন্ধুত্ব-আত্মীয়তা – নানা সূত্রে কত বিখ্যাত ব্যক্তির সঙ্গে যে দেবযানীর আলাপ-পরিচয়-সম্পর্ক রচিত হয়েছে তার তালিকা যথেষ্টই দীর্ঘ। ছেলেবেলার বন্ধু মীনাক্ষীর সূত্রে তাঁর পরিবার – বিশেষ করে প্রতিভা বসুর অপার স্নেহ ও সঙ্গলাভের সুযোগ হয়েছে। বাল্যকালের নিকট-পড়শি নবনীতা দেব সেনের সঙ্গে সম্পর্ক এখনো মধুর ও অবিচ্ছিন্ন। খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী অতুল বসুকে পেয়েছেন আত্মীয়রূপে – কিন্তু সেই পরিচয় ছাপিয়ে গড়ে উঠেছিল শিল্পীর সঙ্গে শিল্পীর এক মরমি সম্পর্ক। বিখ্যাত নাট্যকার ও নাট্য-নির্দেশক রতন থিয়ামের সঙ্গে সম্পর্ক তাঁর বাবা দেবযানীর গুরম্নভাই তরম্নণকুমারের সুবাদে। ঠিক তেমনই সহপাঠী-বন্ধু সম্বিত চট্টোপাধ্যায়ের অনুজ বলে প্রখ্যাত অভিনয়শিল্পী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা। এই চলচ্চিত্রজগতের সূত্র ধরেই আসে দেবযানীর একামত্ম স্নেহসিক্ত অকালপ্রয়াত প্রতিভাবান চিত্রপরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের কথা, তাঁর মা ইরা ঘোষ ছিলেন দেবযানীর কৈশোর-যৌবনের ‘বকুলফুল সই’য়ের মতো নিবিড় বন্ধু। সাহিত্যচর্চায় ‘মশগুল’ অন্নদাশঙ্কর রায় আর বিদেশিনী লীলা রায়ের ঘরোয়া বাঙালি রমণীর রূপ দেবযানীকে মুগ্ধ করে – এই দম্পতি স্বল্প-পরিচয়ের ব্যবধান ঘুচিয়ে নিরমত্মর তাঁকে আকর্ষণ করেছেন। ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের সদস্য হিসেবে একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ মেলে আশাপূর্ণা দেবীর সঙ্গে – কী আশ্চর্য সরল ও স্নিগ্ধ মমতাময়ী ছিলেন এই অসামান্য লেখক! বড়মাপের চেনা মানুষ স্মৃতির সুরভি ছড়িয়ে একে একে দেবযানীর মনের পর্দায় ধরা দেন : অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, কথাশিল্পী সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, ড. হিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়, শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাস, শিল্পী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, চলচ্চিত্র-নির্মাতা জ্যোতিপ্রসাদ আগরঅলা এবং আরো কেউ কেউ।

বিরাশিতেও দেবযানীর অবসর নেই আলস্যে শুয়ে-বসে সময় কাটানোর। ভোর থেকে রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগ-পর্যমত্ম
কাজে-ঠাসা জীবন। দেবযানীর ভোর হয় সাড়ে চারটে-পাঁচটায়, শুরম্ন হয় ব্যায়ামের পালা, বলতে গেলে এটা একেবারে সেই ছেলেবেলার অভ্যাস। তারপর দীর্ঘ দুই-আড়াই ঘণ্টা ধরে চলে চা-পর্ব – এই সময়ে কবিতা বা ডায়েরি লেখা থেকে শুরম্ন করে বাজারের ফর্দ-হিসেব তৈরি, খবরের কাগজ পড়া থেকে রেডিয়োতে গান শোনা, ফোন করা থেকে পড়াশোনা – সবকিছুই চলে। সকালে প্রায় দিনই নাচের ক্লাস থাকে। সেসব মিটিয়ে দেবযানী অফিসে যান। ছুটির দিন বাদে সাড়ে এগারোটা-চারটে অফিস করতে হয়। অফিস মানে আজিজবাগ টি-এস্টেটের প্রধান কার্যালয়, কলকাতার উদয়শঙ্কর সরণির নিজেদের বাড়ির দোতলায়। এই টি-এস্টেটটি দেবযানী, তাঁর সব দিদি ও বড় দাদার ভাগে পড়েছে। অফিসে অন্যান্য দায়িত্বের পাশাপাশি তাঁর মূল কাজ টি-টেস্টিং। অফিস থেকে ফিরেই আবার নাচের ক্লাস নিতে হয়। সাতটায় ছুটি হওয়ার পর দেবযানী ফুরফুরে মেজাজে বেড়াতে বের হন, বন্ধুদের বাড়ি যান, কখনো নেমমত্মন্ন রক্ষা করতে যেতে হয়, আবার কখনো কোনো সভা বা অনুষ্ঠান থাকে। দুই-একদিন ব্যতিক্রম হলেও মোটের ওপর রাত সাড়ে দশটার দিকে ঘুমোতে যান। এই হলো মোটামুটি দেবযানীর দিনযাপনের সূচি। একটা ছকে-বাঁধা নিয়মনিষ্ঠ জীবনচর্চার ছবি এর থেকে ফুটে ওঠে।

অসমিয়া-বাংলা-মণিপুরি – দেবযানী এই তিনটি সংস্কৃতিকে আত্মস্থ করেছেন। জন্মসূত্রে তিনি অসম-কন্যা, অসমিয়া তাঁর মাতৃভাষা, অসমিয়া-সংস্কৃতি মিশে আছে তাঁর রক্তে। কিন্তু শৈশব থেকে বাংলায় বসবাস, বাংলা ভাষায় লেখাপড়া, বাঙালি পরিবারে বিয়ে – এ সবকিছু তাঁকে ভাব-ভাষা-ভাবনা-আচার-আচরণ-সংস্কৃতিতে বাঙালি করে তুলেছে। আর মণিপুরি নাচের মাধ্যমে তিনি মণিপুরি সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে চলেছেন। অনেকগুলো ভাষা, যেমন – অসমিয়া, বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত, হিন্দি, মণিপুরি জানার ফলে তাঁর সংস্কৃতিচেতনা ভারতীয় ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আরো দৃঢ় হতে ও প্রসার লাভ করতে পেরেছে।

মানুষ হিসেবে দেবযানী কেমন, এ-প্রশ্নের জবাব তাঁর কাছের মানুষেরা – প্রিয়জনেরা এবং তাঁর সঙ্গ-সান্নিধ্য যাঁরা পেয়েছেন, তাঁরা ভালো দিতে পারবেন। অল্প সময়ের বীক্ষণে তাঁর যে-গুণ ও বৈশিষ্ট্যগুলো চিহ্নিত করা যায়, তা হলো এই রকম : মিতবাক, ধীরস্থির, মমতাময়ী, স্নেহশীল, সৌজন্যপরায়ণ, সহজ-সরল, পরোপকারী, দৃঢ়চেতা, মজলিশপ্রিয়, নিয়মনিষ্ঠ, সময়সচেতন। আর দেবযানী সম্পর্কে তাঁর বান্ধবী মীনাক্ষী বসুর (দত্ত) মূল্যায়ন এই রকম : ‘মীনাক্ষী কোমলস্বভাবা, মৃদুভাষিণী, সদাহাস্যময়ী কিন্তু উচ্ছল নয়’ (ভাইয়া, বিশ্বপ্রিয় বসু স্মরণগ্রন্থ, কলকাতা, তারিখবিহীন; পৃষ্ঠা-সংখ্যার উলেস্নখ নেই)। তাঁর নির্মল হাসি তাঁকে আরো প্রিয় ও আকর্ষণীয় করে তোলে। তাঁর সারল্য ও মার্জিত সাজ-পোশাক তাঁর আভিজাত্যকে এক নতুন ব্যঞ্জনায় ভূষিত করে। সময়বিশেষে তাঁর নীরবতা ও শীতল অনুভূতি কখনো কখনো তাঁকে ভুল বুঝতে সহায়তা করে। অবশ্য অতি-ঘনিষ্ঠ স্বজন ও বন্ধুজনের কাছে তাঁর অভিব্যক্তি ও বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ ভিন্নধরনের হতে পারে। দেবযানীর সর্বদীর্ঘ সময়ের বান্ধবী প্রতিভা-বুদ্ধদেব বসুর কন্যা মীনাক্ষী বসু এক স্মৃতিচর্চায় জানিয়েছেন, ‘নিজের বিয়ের খবর দিতে গিয়ে দেবযানী যে নাটকীয় আবহ রচনা করেছিলেন এবং সেইসঙ্গে কৌতুকও – তাতে করে তাঁর চরিত্রের একেবারে বিপরীত বৈশিষ্ট্য – উচ্ছ্বাস-উচ্ছলতা ও রঙ্গ-রসিকতার বড়ো আকর্ষণীয় রূপের পরিচয় মেলে’ (ভাইয়া, বিশ্বপ্রিয় বসু স্মরণগ্রন্থ, পূর্বোক্ত)। রহস্যের আবরণে ঢাকা ‘লাজুক মিষ্টি’ হাসি, প্রলম্বিত যৌবনের কোমল রূপের মানবী-পুত্তলিকা, স্নিগ্ধ আচরণে মুগ্ধতা-সঞ্চারিণী দেবযানী বা মীনাক্ষীর সম্মোহনী শক্তি সম্পর্কে তাঁর রঙ্গপ্রিয় স্বামী রসিকতা করে কখনো বলতেন : ‘আট থেকে আশি, যে কোনো বয়সের পুরম্নষ মীনাক্ষীকে দেখলে প্রেমে পড়ে যায়।’ মীনাক্ষীকে যাঁরা দেখেছেন তাঁরা একে অতিকথন বলে খারিজ করতে পারবেন বলে মনে হয় না। দেবযানীর বাল্যসখি, নবনীতা দেব সেন তাঁর সম্পর্কে যা বলেছেন তা এখানে তুলে ধরলে দেবযানীর ছবিটি আরো স্পষ্ট ও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে : ‘আমি মীনাক্ষীকে আশৈশব দেখছি। মীনাক্ষী একটি সর্বাঙ্গসুন্দর মানুষ। রূপসী, দীর্ঘাঙ্গী, মাথায় মেঘের মতো চুল, সর্বাঙ্গে আত্মবিশ্বাসের লাবণ্য আর শক্তি কোমলভাবে ফুটে আছে। খুব নম্র নিচু গলায় কথা বলেন, কিন্তু কথাগুলি আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। তাঁর উচ্চারণে, হাত-পায়ের নড়াচড়ায়, চাহনিতে, সবকিছুর মধ্যেই তারম্নণ্য এবং স্বাভাবিক আভিজাত্য ফুটে বেরোয়। বয়স তাঁকে একেবারেই স্পর্শ করতে পারেনি…।’

দেবযানী দর্শনবিদ্যার ছাত্রী। তাই বোধহয় জগৎ ও জীবন সম্পর্কে – শিল্পচর্চা ও শিল্পবোধ প্রসঙ্গে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি একটু ভিন্ন রকমের। সে কারণে উত্তরসূরি শিল্পসাধকদের উদ্দেশে বলেন : ‘আনন্দের জন্য, নিজেকে প্রকাশ করার জন্য, নিজেকে প্রকাশ করার মধ্যে যে আনন্দ আছে সে আনন্দ আবিষ্কারের জন্য তুমি শিল্পচর্চা করো। তুমি নাচো, তুমি গান করো। আর তাতে যেন কোনো ফাঁকি না থাকে। নিজেকে প্রচার করার জন্য যতটা না, নিজেকে প্রকাশ করার জন্য যেন সেই শিল্পচর্চা তোমায় অনুপ্রাণিত করে।’ দেবযানী জীবনকে একটা ‘অ্যাডভেনচার’ বলে মনে করেন, যার মধ্যে ‘ত্রম্নটি-বিচ্যুতি থাকবে’, ‘অসম্পূর্ণতা থাকবে’, ‘কিছু কৃতি থাকবে’ – এই ‘সবকিছু নিয়েই জীবন’। তাই তিনি অনায়াসে বলতে পারেন : ‘আমি যা পেয়েছি তার তুলনা নেই। আর যা পাইনি, তার জন্য আমার কোনো দুঃখ নেই।’ আর এই জীবনের পরের পর্বের কথায় তিনি সরাসরিই বলেন, এই স্মৃতিময় চেনা জগৎ থেকে বিদায় নেওয়ার জন্য তাঁর কোনো মৃত্যুভয়ের শঙ্কা কিংবা স্বজন-বিচ্ছেদের বেদনা-হাহাকার-শূন্যতার কোনো অনুভূতি তাঁর মনে জাগে না। বরং তাঁর উপলব্ধি এই রকম : ‘আমার মনে হয় এর পরে যেখানে যাব, সেখানে আরো সুন্দর জীবন, আরো সম্পূর্ণতা খুঁজে পাব।’

তাঁর কলকাতার উদয়শঙ্কর সরণির নিজস্ব আবাসে বসে দুইদিনে দীর্ঘ সাড়ে সাত ঘণ্টার আলাপচারিতার ভেতর দিয়ে বুঝেছি, শিল্পী ও শিল্পবোদ্ধা হিসেবে দেবযানী অনন্য, আর মানুষ হিসেবে সব মিলিয়ে অসাধারণ। এই আলাপের ফসল অমত্মরঙ্গ স্বরে বিবৃত তাঁর প্রকাশিতব্য আত্মভাষ্য অমত্মরঙ্গ দেবযানীতে তাঁর যাপিত জীবন ও শিল্পসাধনার এক গভীর-নিবিড় পরিচয় মিলবে নিঃসন্দেহে এ-কথা বলা যায়।

Leave a Reply