logo

দৃশ্যকলার সন্ধিক্ষণ সফিউদ্দীনের গুরুত্ব

আ বু ল  ম ন সু র

In memory of 71 Engraving 1988

In memory of 71 Engraving 1988

১৯৪৭-এর দেশবিভাগ তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি মুসলমানের জন্য সংস্কৃতির এক সংকট নির্মাণ করেছিল। বাঙালির দীর্ঘ, সমৃদ্ধ ও ধর্মীয়-সমন্বয়শীল সংস্কৃতির ওপর হঠাৎ করে এসে পড়ল একটি ধর্মবাদী পৃথক সংস্কৃতি নির্মাণের চাপ, যে-অভিজ্ঞতা বাঙালি মুসলমানের জন্য একেবারে আনকোরা। এ সংস্কৃতি নির্মাণের জন্য অচলিত বা স্বল্পপরিচিত আরবি-ফার্সি শব্দের প্রাবল্যের জোয়ার বইয়ে এক ধরনের উৎকেন্দ্রিক বাংলা লিখন, রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধকরণ বা আরবি হরফে বাংলা প্রচলনের মতো অবিমৃশ্যকারী সিদ্ধান্তকে চালানোর প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল। বাঙালি মুসলিম গভীরভাবে ধার্মিক হওয়া সত্ত্বেও এসব প্রয়াসকে প্রতিহত করেছে। পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষের জন্য ব্যাপারটি ছিল একেবারে ভিন্ন রকম, তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে পুবের ভারতের চেয়েও পশ্চিমের আরবি-ফার্সি-পশতুভাষী সংস্কৃতির যোগ ঐতিহাসিকভাবেই অধিক ছিল। একমাত্র বিভক্ত পাঞ্জাব প্রদেশেই ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে যোগসূত্রের ব্যাপারটি ছিল। তা ছাড়া তাদের সংস্কৃতির ধারাগুলিও ছিল তুলনামূলকভাবে অবিকশিত, ফলে পাকিস্তানের জন্য একটি ইসলামী সংস্কৃতির রূপ নির্মাণে শামিল হওয়া তাদের জন্য কঠিন ছিল না। বাঙালি মুসলিম ধর্ম ও সংস্কৃতিকে এক করে দেখেনি, ফলে ধর্মনিষ্ঠ হয়েও বাঙালির হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিমের সমন্বয়ে ও অবদানে নির্মিত হওয়া অত্যন্ত সমৃদ্ধ সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলার ধারা থেকে তাকে বিযুক্ত করবার পাকিস্তানি প্রচেষ্টা দমন-পীড়ন সত্ত্বেও সফল হতে পারেনি। অল্প কিছু ধর্মবাদী তৎপরতা ব্যতিরেকে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি সংস্কৃতির মূলধারা সমন্বয়বাদী ও ধর্মনিরপেক্ষ বৈশিষ্ট্যে বিকশিত হওয়ার প্রয়াস চালিয়ে গেছে।
দৃশ্যকলায়ও এ-সংকট তার নিজস্ব ধরনে দেখা দিয়েছিল। কলকাতায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুসলিম চিত্রশিল্পীদের জন্য সংকটটি দেশ-বিভাজনের আগেই নির্মিত হয়েছিল। পাঠ সমাপ্ত করার পর তাঁদের সামনে সমসাময়িক রীতি হিসেবে ছিল প্রধানত ‘বেঙ্গল স্কুল’-প্রভাবিত কাব্যিক ভাবালুতা বা রোমান্টিকতায় মোড়ানো বাস্তবানুগ চিত্রাঙ্কন, অথবা স্বাদেশিক চেতনার পরিপূরক হিন্দু ধর্মীয় বা পৌরাণিক উপাখ্যান কিংবা ইতিহাস বা সাহিত্যের কোনো মহীয়ান ও আবেগঘন বিষয়। প্রতিনিধিত্বশীল ভূদৃশ্য বা নৈমিত্তিক জীবনদৃশ্য অঙ্কনের রেওয়াজ খুব বেশি ছিল না। অবশ্য দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী, অতুল বসু, গোপাল ঘোষ, অবনী সেন, গোবর্দ্ধন আশ, মুরলীধর টালি, হরেন দাস এবং আরো কারো কারো কাজে প্রকৃতি ও শ্রমজীবী মানুষের বাস্তববাদী রূপায়ণ লক্ষ করা যায়। তবে এসব শিল্পীর কাজে প্রত্যক্ষতার ছোঁয়া থাকলেও তাঁদের আঁকা ভূদৃশ্য পুরোপুরি নৈমিত্তিক বাস্তবতা হয়ে উঠতে পারেনি, কদাচিৎ তা প্রকৃতির রূপবিভঙ্গের আবেগাক্রান্ত অতিশায়নকে অতিক্রম করতে পেরেছে। বরং জয়নুল আবেদিন এবং তাঁর পাশাপাশি সফিউদ্দীন আহমেদ ও আনোয়ারুল হকের চিত্রেই আমরা দৈনন্দিন জীবন ও ভূদৃশ্যের বাস্তববাদী রূপায়ণ লক্ষ করি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ইসলামী চিত্রশিল্পের একটি পাকিস্তানি ধারা তৈরি করার প্রয়োজন হলো, ঐতিহ্য হিসেবে পাওয়া গেল পারসিক ও ভারতীয় অনুচিত্র আর ইসলামী লিপিকলা বা ক্যালিগ্রাফি। এগুলির কোনোটির সঙ্গেই বাঙালি মুসলিম শিল্পীর তেমন কোনো যোগাযোগ ছিল না। ফলে একেবারে প্রথম প্রজন্মের শিল্পী জয়নুল ও তাঁর সঙ্গীরা দৃশ্যকলার এ ইসলামীকরণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন এবং বিকল্প হিসেবে পূর্ব বাংলার প্রকৃতি ও নৈমিত্তিক বাস্তবতার রূপায়ণে মনোযোগ দিয়েছেন। পঞ্চাশের দশক থেকে ঢাকায় প্রশিক্ষিত তাঁদের ছাত্ররা নতুন বিকল্প হিসেবে পশ্চিমের শিল্পরূপ থেকে প্রেরণা গ্রহণ করে শিল্পনির্মাণের মাধ্যমে প্রতিরোধের ধারাটিকে অব্যাহত রেখেছেন। এ দুয়ের মধ্যবর্তী জায়গাটিতে যেন একাকী দাঁড়িয়ে আছেন চিত্রী ও ছাপচিত্রকর সফিউদ্দীন আহমেদ।
চল্লিশের দশকের আমাদের প্রথম প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যে সফিউদ্দীন আহমেদই একমাত্র এখনো আমাদের মধ্যে রয়েছেন। সফিউদ্দীন ধারণ করে আছেন একটি স্মৃতিগন্ধময় যুগের বৈশিষ্ট্য, ঔপনিবেশিক সময়কালের ভালোমন্দের মিশ্রণে এক ভিন্ন মূল্যবোধের যুগ সেটি, বর্তমান কালের সমস্ত বাস্তবতার সঙ্গে যার পার্থক্য পাহাড়প্রমাণ এবং যার সঙ্গে আমাদের পরিচয় ক্রমশই ক্ষীণ হয়ে আসছে। শিল্পী সফিউদ্দীনও কি বিগত হয়ে যাওয়া এক যুগের শিল্প-প্রতিনিধি, সমকালে যাঁর কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই? সম্ভবত তা নয়। তাঁর চিত্রকর্ম, ছাপাই ছবি ও রেখাচিত্রের বিপুল সমারোহ অনুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণে চল্লিশের দশকের এ শিল্পী-কারিগরটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতাকে প্রতিভাত করে তুলবে। বাংলাদেশে আধুনিক শিল্পচর্চার ক্রম-বিবর্তনে সফিউদ্দীনের ভূমিকা ও তাৎপর্য আমাদের শিল্প-ইতিহাসে যথাযথভাবে নির্দেশিত হয়েছে বলে মনে হয় না।
তাঁর ব্যক্তিক স্বাতন্ত্র্যকেও তিনি দৃঢ়ভাবে রক্ষা করে চলেছেন। তাঁর সমসময়ের তিন শিল্পী – জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান এবং এস এম সুলতানের তুলনায় সফিউদ্দীনের পরিচিতি কম। এর অবশ্য কারণও রয়েছে। ছবির ধরন অন্যতম একটি কারণ হলেও অন্য কারণও রয়েছে বইকি। তাঁর জীবন ও ব্যক্তিত্ব অন্য তিনজনের মতো ‘ব্যতিক্রমী’ বা ‘বর্ণাঢ্য’ নয়। কথার জালে মানুষকে টানবার ক্ষমতাও তাঁর বিশেষ নেই। পরিমিতি ও সুমিতির প্রয়োগে নির্মিত আভিজাত্যের একটি দেয়াল টেনে চলতে তিনি পছন্দ করেন। অন্য তিনজনই এর থেকে ভিন্নতর, বিভিন্নভাবে। জয়নুল আবেদিন তাঁর অবয়ব বা বেশ দিয়ে তেমন আকর্ষণ করেন না, তিনি সব ধরনের মানুষকে কাছে টানতে পারেন তাঁর অসাধারণ সারল্য, কথার জাদু আর নামের মহিমা দিয়ে। বিশেষ করে দেশি উচ্চারণের টান-মাখানো কথার আন্তরিকতায় সাধারণ শ্রমজীবী থেকে সমাজের উচ্চতম শ্রেণীর মানুষটিকেও মোহমুগ্ধ করে রাখবার অনায়াস ক্ষমতা ছিল তাঁর অসাধারণ। কামরুল হাসান মোটেও সেরকমটি নন, চেহারা, বেশভূষা ও আচরণে তিনি তাঁর চারদিকে একটি টগবগে রংচঙে আকর্ষণের বলয় নির্মাণ করতে সচেতনভাবে সচেষ্ট। তাঁর আকর্ষণের মূল সূত্র এক ধরনের পৌরুষের ঝলকানি আর সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহে তাঁর সাহসী ও অগ্রণী ভূমিকা। সুলতান তাঁর পরিচ্ছদ, জীবনাচার আর অন্য সকল আচরণে এমনই নিয়মছাড়া যে, তিনি যে-কোনো মানুষের নির্নিমেষ কৌতূহল আকর্ষণে সমর্থ। তাঁকে পির-দরবেশ বা অলৌকিক ক্ষমতাধারী বলেও অনেকে বিশ্বাস করেছেন। কথার মোহবিস্তারে তিনিও পারঙ্গম। এসব বর্ণাঢ্য ও নিয়মভাঙা ব্যক্তিত্বের সামনে সফিউদ্দীন এক পরিমার্জিত সামাজিক-আচরণ-মেনে-চলা ভদ্রলোক মাত্র, খানিকটা রাশভারী ও খুঁতখুঁতে চরিত্রের কারণে আরো একটু অগম্য। ফলে আমজনতার আকর্ষণের বস্তু তিনি কখনো হয়ে ওঠেননি, হতে চানওনি।
যে-ধরনের ছবি সহজেই দর্শককে আকৃষ্ট করে সফিউদ্দীনের চিত্রকর্ম সে-ধরনের নয়। ফলে ছবির ধরনের বেলায়ও প্রায় একই বৈশিষ্ট্য তাঁকে একটু দূরবর্তী করে রাখে। জয়নুল আবেদিন এঁকেছেন বোধগম্য ভাষায় মানুষের আত্মশক্তির ছবি। ভীষণা প্রকৃতির দুর্বিনীত শক্তির বিরুদ্ধে অথবা ক্ষমতাধরের হীন চক্রান্তে বিপর্যস্ত হয়েও অজেয় মানবের লড়াইয়ের শক্তিমান ভাষ্য। মানুষ তাঁর ছবিতে নিজকে আবিষ্কার করে, চিনে নেয় নিজের জীবন-সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। ফলে তাঁর ছবি মানুষকে টানে এক অন্তর্নিহিত ক্ষমতায়। কামরুল হাসানের ছবিও সাধারণ দর্শককে টানে, তবে এখানে মানুষ দেখে তার হারিয়ে যাওয়া পল্লীজীবনের এক স্বপ্নিল ও স্মৃতিবিধুর দৃশ্যপট। লোকচিত্রের আদলে সহজ উপস্থাপনায় ও বর্ণিল চেহারার জৌলুসে তাঁর ছবি সব ধরনের দর্শককেই সহজে আকর্ষণ করতে পারে। তিনি যখন রাজনৈতিক বক্তব্য-সংবলিত ছবি আঁকেন বা ছবির মানব-অবয়বে কিছু অতিরঞ্জন বা ব্যত্যয় ঘটান তখনো উপস্থাপনার বর্ণাঢ্যতায় তা দর্শকের কাছে সহজেই উপভোগ্য হয়ে ওঠে। সুলতানের ছবিতে মানব-অবয়বের অতিরঞ্জন বা পেশির অস্বাভাবিক উপস্থাপন সত্ত্বেও চিরায়ত পল্লীজীবনের অতি চেনা দৃশ্যপট সাধারণ দর্শককে আকৃষ্ট করে। এখানেও মানুষ নিজের শক্তিময়তাকে নতুনভাবে আবিষ্কার করে। তবে জয়নুলের মতো প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধরত অবস্থায় নয়, সুলতানের ছবিতে দর্শক সে মানুষকে দেখে যে আদিম ও জান্তব, পায়ের নিচে বশীভূত করে অবাধ্য প্রকৃতিকে। এখানেও মানুষ নিজকে এক স্বতন্ত্র সত্তায় ও শক্তিতে আবিষ্কার করে।
সমসাময়িকদের মতো সফিউদ্দীনের ছবি বয়ানধর্মী ঘরানার নয়। জয়নুল-কামরুল-সুলতান তাঁদের নিজ নিজ স্বাতন্ত্র্য সত্ত্বেও পরবর্তীকালেও চল্লিশের দশকের সাদৃশ্যধর্মিতার মূল চারিত্র্যলক্ষণ থেকে পুরোপুরি পৃথক হতে পারেননি। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে চল্লিশের দশক থেকে ভারতবর্ষে এবং পঞ্চাশের দশক থেকে তৎকালীন পূর্ব  পাকিস্তানে পশ্চিমা শিল্প-আন্দোলনগুলির প্রভাবে দৃশ্যকলার আঙ্গিকে যে পালাবদলের সূচনা ঘটেছিল জয়নুল-কামরুল-সুলতানরা তার সঙ্গে নিজেদের মেলাননি বা সে বিবর্তনের সাথি হননি। সুলতান সে চেষ্টাই করেননি, তবে জয়নুল-কামরুলের মধ্যে চেষ্টা যে ছিল না তা নয়।
এ-কথার অর্থ জয়নুল আবেদিন বা কামরুল হাসানের চিত্রকর্মের কোনো অবমূল্যায়ন নয়, সময়ের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন শিল্পীর মানসপটটিকে বুঝবার চেষ্টা করা মাত্র। জয়নুল আবেদিন এক পর্যায়ে তাঁর চিত্রে আমাদের লোকশিল্পের অনুষঙ্গ যুক্ত করে চমৎকার কিছু কাজ করেছেন, কিন্তু সেটিকে তাৎপর্যময় কোনো পরিণতির দিকে নিয়ে যাবার মতো অভিনিবেশ দেননি। কামরুল হাসান বরং লোকশিল্পের আঙ্গিকের সঙ্গে কিউবিজমের কিছু বৈশিষ্ট্যের মিশ্রণ ঘটিয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন, তাঁর শেষদিকের কাজে ফ্যান্টাসির ব্যবহারেও সমকালের শিল্পরূপের ছাপ পরিদৃশ্যমান। তবু বলতে হয়, পরিবর্তনশীল শিল্পভাবনার মূলস্রোতের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ার জন্য যে বিপুল রূপান্তরের প্রয়োজন ছিল জয়নুল বা কামরুল, তাঁদের কালজয়ী কিছু শিল্পকর্ম সত্ত্বেও, সেটিতে শামিল হননি। অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর সূচনা থেকে চল্লিশের দশক পর্যন্ত এ উপমহাদেশের আধুনিক শিল্পরূপটি যে বিশেষ চারিত্র্যলক্ষণে প্রকাশিত হয়েছিল জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান ও এস এম সুলতান, তাঁদের উল্লেখযোগ্য বিশিষ্টতা সত্ত্বেও, সে শিল্পধারার প্রতিনিধি হিসেবেই রয়ে গেছেন। এখানে সফিউদ্দীন ব্যতিক্রম এবং তাঁর চল্লিশের দশকের সাথিদের থেকে পৃথক। এবং এখানেই সম্ভবত তাঁর গুরুত্বের সূত্রটিও নিহিত থাকতে পারে।
জয়নুল-কামরুলের মতো সাদৃশ্যধর্মী দৃশ্যপট সফিউদ্দীনও চল্লিশের দশক ও পঞ্চাশের প্রথমার্ধ জুড়ে এঁকেছেন, অন্যদের মতোই তাতে কিছুটা বেঙ্গল স্কুলের প্রভাব, কিছু লোকশিল্পের সরলীকরণ, কিছু ইমপ্রেশনিজমের অনুপ্রেরণা দেখা যাবে। ১৯৪৬-এর ‘সাঁওতাল রমণী’ বা ’৪৭-এর ‘মেলার পথে’ ছাপাই ছবিতে সাদৃশ্যরূপের প্রাধান্য সত্ত্বেও বেঙ্গল স্কুলের ছায়াপাত অনুভব করা যায়। একইভাবে ’৫২-এর ‘ধানঝাড়া’তে পাই ইমপ্রেশনিজমের সুস্পষ্ট ছাপ আর ’৫৬-এর ‘কাঠমিস্ত্রি’তে লোকশিল্পের সরলায়িত রেখানির্ভর সংস্থাপন। ১৯৫৮ সালে সফিউদ্দীন ছাপাই ছবিতে উচ্চতর প্রশিক্ষণ লাভের জন্য লন্ডনের সেন্ট্রাল স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটসে ভর্তি হন। বলা যেতে পারে যে, এখান থেকেই সফিউদ্দীন সংগ্রহ করলেন উত্তরণের রসদ, এখান থেকেই রচিত হতে শুরু করল সমসাময়িকদের সঙ্গে তাঁর পার্থক্যের লক্ষণসমূহ। উল্লেখ্য যে, জয়নুল আবেদিন অল্প কিছুদিন লন্ডনের স্লেড স্কুলে কাজ করলেও এটি ঠিক উচ্চতর প্রশিক্ষণ নয়। কামরুল ও সুলতান পশ্চিমে কোনো প্রশিক্ষণ নেননি। এখানে সফিউদ্দীন ব্যতিক্রম। তিনি পুরোপুরি ছাত্র হিসেবে বিশ্বখ্যাত ছাপচিত্রী হেহটারের শিষ্য মার্লিন ইভান্সের অধীনে সেন্ট্রাল স্কুল থেকে এচিং ও এনগ্রেভিংয়ে ডিপ্লোমা নিয়েছেন। এচিং-অ্যাকুয়াটিন্ট-এনগ্রেভিংয়ের কঠিন টেকনিক-নির্ভর শিল্পমাধ্যমে হেইটার নিয়ে এসেছিলেন স্বতঃস্ফূর্ত ছন্দোময় রেখার বিন্যাস, যা ইতোপূর্বে সম্ভব বলে বিবেচনা করা হয়নি। টেকনিক বা শৈলীর কুশলতা ও পরিশীলনের প্রতি আজীবন আগ্রহী সফিউদ্দীনকে ছাপাই ছবিতে রেখার এ বেগবান প্রকাশময়তা ভীষণভাবে আকর্ষণ করেছিল, যে-আকর্ষণ তাঁর বাকি জীবনের শিল্পকর্মে অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে বিরাজ করছে।
এ শিল্পীকে কোথাও আমরা বলেছি শিল্পী-কারিগর। শিল্পের যত মাধ্যম নিয়ে কাজ করেছেন তার প্রতিটির উপাদান ও নির্মাণশৈলী অনুপুঙ্খভাবে এবং পরিপূর্ণ দক্ষতার সঙ্গে আয়ত্ত না করে তিনি শিল্পনির্মাণে অগ্রসর হননি। তেলরং বা জলরং বলি বা ছাপাই ছবির নানান মাধ্যমের কথাই বলি, এসব বিষয়ে বাংলাদেশে সফিউদ্দীন আহমেদের চেয়ে কুশলী কেউ কখনো ছিলেন না, এখনো নেই। তাই শিল্পী-কারিগর অভিধা তাঁর শিল্পপ্রতিভার প্রতি শ্রদ্ধারূপেরই প্রকাশ, অন্য কিছু নয়। আসলে সফিউদ্দীন আগাগোড়াই একজন শুদ্ধতাবাদী বা পারফেকশনিস্ট, কী জীবনাচারে, কী বিশ্বাসে, কী শিল্পসৃষ্টিতে! সেই ১৯৪৬-এর তেলরঙে করা দুমকার প্রকৃতিদৃশ্যে যেমন তেমনি ’৪৬-৪৭-এর এনগ্রেভিং ছাপাই ছবিতে উপকরণ ও কৃৎকৌশলের ওপর শিল্পীর দখল ছবিগুলির অন্যতম আকর্ষণের দিক। পরবর্তীকালে সারাজীবনই সফিউদ্দীন কৃৎদক্ষতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্বের জায়গাতেই রেখেছেন। সেটি যে কতখানি নিষ্ঠার সঙ্গে চর্চা করেছেন তিনি তার প্রমাণ পাওয়া যাবে এমনকি বিভিন্ন মাধ্যমে করা তাঁর রেখাচিত্রেও। পেনসিল, কাঠকয়লা বা কালির মতো রেখাঙ্কনের নিছক প্রাথমিক উপাদানকেও যে তিনি কত যতœ ও সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করেন তা শিল্পকলার শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষণীয় উদাহরণ।
এটি লক্ষ করবার মতো যে, জীবনাচারে বা অন্যান্য বহু বিষয়ে সফিউদ্দীনকে মূলত চল্লিশের দশকে প্রচলিত ধারাপন্থী বলেই প্রতীয়মান হয়, শিল্প-উপকরণ ও কৃৎকৌশল ব্যবহারের ক্ষেত্রেও তিনি যথেষ্ট রক্ষণশীল। কিন্তু শিল্পভাবনার বিবর্তনে তাঁর সমসাময়িকদের তুলনায় তিনি অনেকখানি প্রাগ্রসর দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন, রীতিমতো বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়েছেন তাঁর শিল্প-আঙ্গিকে। চিত্রতলকে ত্রিমাত্রিক দৃষ্টিবিভ্রম রচনার ও দৃশ্যবর্ণনার ক্ষেত্র হিসেবে দেখবার দীর্ঘলালিত ঐতিহ্যকে বর্জন করে চল্লিশের দশকের শিল্পীদের মধ্যে একমাত্র তিনিই একে দেখতে চেয়েছেন দ্বিমাত্রিক তলে রেখা, আকৃতি ও বর্ণের সুসমঞ্জস বিন্যাস হিসেবে। চিত্রে বিষয়ের খবরদারি কমিয়ে আঙ্গিককে গুরুত্বপূর্ণরূপে বিবেচনার বিংশ-শতাব্দীয় শিল্পদর্শনকে এদেশের শিল্পধারায় রোপণ করবার কাজে পথিকৃৎদের অন্যতম সফিউদ্দীন আহমেদ, এ-কথাটি আমরা তেমন উচ্চকণ্ঠে কখনো বলিনি। পশ্চিমের শিল্পধারার সরাসরি সংস্পর্শে আসার আগেই সফিউদ্দীনের ১৯৫৪-তে করা ‘শূন্য ঝুড়ি’ ও ‘শরবতের দোকান-১’ তৈলচিত্রে এবং ১৯৫৭-র এচিং-অ্যাকুয়াটিন্ট ‘জড়জীবনে’ দেখি আকৃতির জ্যামিতিক সরলায়ন ও চিত্রপটকে দ্বিমাত্রিক ক্ষেত্র হিসেবে বিন্যাসের প্রয়াস। আমাদের দেশে চিত্রপটের বিমূর্ত-বিন্যাসের ধারাটির পথিকৃৎ হিসেবে যাঁদের বিবেচনা করা হয় – আমিনুল ইসলাম, মোহাম্মদ কিবরিয়া কিংবা হামিদুর রাহমান, এঁদের পাশে সফিউদ্দীন আহমেদ নামটিও খোদিত হলে বোধহয় অধিকতর শোভন হয়।
ছাত্রাবস্থার সাদৃশ্যধর্মিতার সীমা পেরিয়ে পঞ্চাশের দশকের সূচনা থেকেই সফিউদ্দীন যে অনুসন্ধান ও নিরীক্ষার পথে যাত্রা শুরু করেছিলেন যতদিন কর্মক্ষম ছিলেন ততদিন তাতে এতটুকু ক্ষান্তি ছিল না। বেঙ্গল স্কুল, লোকচিত্র, কিউবিজম, বিমূর্ততার নানান ঘাট ঘুরেও তাঁর খোঁজ চলতেই থাকে। চিত্রী ও ছাপচিত্রী সফিউদ্দীনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং অনুধাবনীয় দিক এটিই – সমাজে যাবতীয় মূল্যবোধের যখন আকাল নেমেছে তখন একজন শিল্পসাধকের সততা, অনুসন্ধিৎসা, নিষ্ঠা ও শ্রমের এক প্রোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে তিনি বিরাজ করেন আমাদের মাঝে। সফিউদ্দীন আহমেদ চল্লিশের দশকের দেশবিভাগ-পূর্বকালীন আখ্যানধর্মী
শিল্পধারার পুঁজি নিয়ে পরবর্তীকালের একেবারে বদলে যাওয়া শিল্পরূপের পরম্পরার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছেন। তাঁর সমসাময়িকদের থেকে এখানে তিনি ব্যতিক্রমী। সফিউদ্দীন চল্লিশের বয়ানধর্মী শিল্পধারা আর পঞ্চাশ থেকে সূচিত আঙ্গিকপ্রধান শিল্পধারার মধ্যে একমাত্র সেতুবন্ধ, আমাদের শিল্প-ইতিহাসে তাঁর এ গুরুত্বটি যথাযথ স্বীকৃতিতে প্রতিষ্ঠিত হওয়া প্রয়োজন।

Leave a Reply