logo

দুর্বিনীত এক নারীর চোখে পিকাসো

আ ন্দা লি ব  রা শ দী

[পিকাসো মানব না দানব – এ বিতর্কটিকে সামনে নিয়ে এসেছেন তাঁর ভালোবাসার এবং উপেক্ষার নারীরাই। পিকাসোর নারীদের অন্তত একজন ফ্রাঁসোয়াজ জিলো নিজেকে এই শিল্পীর কাছে শতভাগ সঁপে দেননি। জার্মান লোকগল্পের ব্লু বেয়ার্ডের কাছ থেকে বেরিয়ে এসেছেন। ফ্রাঁসোয়াজ জিলোর পিকাসোর সঙ্গে জীবন, জেনেট হাউলের সাক্ষাৎকার, আরিয়ানা হাফিংটনের পিকাসো : স্রষ্টা ও ধ্বংসকারী এবং আরো কিছু রচনা অনুসরণ করে ‘দুর্বিনীত রক্ষিতার চোখে পিকাসো’ লিখিত।

সঙ্গে যোগ করা হয়েছে ঈষৎ অপ্রাসঙ্গিক ভিন্ন পাদটীকা।]

পিকাসোর প্রণয়িনী ও উৎসাহদাত্রীদের মধ্যে এখনো একজন জীবিত আছেন – ফ্রাঁসোয়াজ জিলো। তাঁর জন্ম ২৬ নভেম্বর ১৯২১ সচ্ছল এক ফরাসি পরিবারে। বাবা ব্যবসায়ী ও কৃষিতত্ত্ববিদ আর মা জলরংশিল্পী। তিনি লিখতে শুরু করেন বাম হাতে কিন্তু বাবা তাঁকে লিখতে বাধ্য করেন ডান হাতে। তিনি দুহাতেই সমানে লিখে যেতে পারেন। পাঁচ বছর বয়সেই ঠিক করলেন চিত্রশিল্পী হবেন। কিন্তু বাবা চাইলেন মেয়েকে তাঁর মতো উচ্চশিক্ষিত করতে, তাঁকে হতে হবে বৈজ্ঞানিক কিংবা আইনজীবী। তিনি আইন অধ্যয়ন শুরু করলেন, কিন্তু সুযোগ পেলে ক্লাস ফেলে চলেন যান কোনো না কোনো মিউজিয়ামে। দিনভর বিখ্যাত সব শিল্পীর অাঁকা ছবি দেখেন, ফিরে এসে যতটা আইন পড়েন তার চেয়ে বেশি পড়েন সাহিত্য – এডগার অ্যালেন পো,  শার্ল বোদলেয়র। উনিশ বছর বয়সে শিল্পী হবার স্বপ্ন এগিয়ে নিতে আইন অধ্যয়ন চিরদিনের মতো ছেড়ে দেন।

১৯৪৩। প্যারিস তখন জার্মানির দখলে। পিকাসোর সঙ্গে দেখা। পিকাসো তখন একষট্টি আর এই ছবিপাগল তরুণী একুশ।

১৯৪৩-৫৩ প্রায় দশ বছর ফ্রাঁসোয়াজ জিলো পিকাসোর মিসট্রেস ও প্রেরণাদাত্রী ছিলেন; বৈধতার সংকট মেনে নিয়েই তিনি শিল্পীর এক কন্যা ও এক পুত্রের জননী হয়েছেন।

২০১১-তে নববই বছর বয়সে জেনেট হাউলের কাছে অনেক বছর পর তিনি মুখ খোলেন তাঁর নিউইয়র্কের অ্যাপার্টমেন্টে। স্মর্তব্য, তিনি নিজ মেধা ও শৈলীতে একজন উল্লেখযোগ্য চিত্রশিল্পী এবং পিকাসোকে নিয়ে লেখা বেস্ট সেলার একটি গ্রন্থের রচয়িতা।

ফ্রাঁসোয়াজ জিলো বলেছেন, আমিই একমাত্র নারী যে পিকাসোকে পরিত্যাগ করে এসেছি। আমিই একমাত্র নারী যে এই ঐশ্বরিক দানবের কাছে নিজেকে বলিদান করিনি, আমিই একমাত্র নারী যে তাঁর কাহিনি বলার জন্য এখনো বেঁচে আছি।

ভ্রূ উঁচিয়ে বললেন, অন্যদের কী হয়েছে দেখো –  ম্যারি-থেরেস ওয়াল্টার আর জ্যাকুলিন রোক আত্মহত্যা করেছে – প্রথমজন ফাঁসিতে ঝুলেছে, দ্বিতীয়জন নিজেকে গুলি করেছে। ওলগা খোকলোভা হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হয়েছে আর ডোরা মার তো বদ্ধ উন্মাদ। মনমোহিনী ফ্রাঁসোয়াজ জিলো যখন চবিবশ, তাঁকে নিয়ে পিকাসোর অাঁকা বহু ছবি তাঁকে অমরত্ব দিয়েছে।

‘পাবলো আমার সঙ্গে অনবদ্য এক মানুষ – তার সঙ্গ আতশবাজির সঙ্গে থাকার মতো। পাবলো বিস্ময়কর ধরনের সৃজনশীল, মেধাদীপ্ত এবং জাদুকরী ব্যক্তিত্বের মানুষ। তার মন যখন মোহিত করতে চায়, এমনকি পাথরও তার সুরে নাচতে চাইবে। কিন্তু পাবলো একই সঙ্গে অন্যের প্রতি নির্মম, মর্ষকামী ও নির্দয়, কখনো নিজের প্রতিও। পাবলো চাইত সবকিছুই তার ইচ্ছে অনুযায়ী হবে, নারীকে থাকতে হবে তার সেবায়। সে নারীর জন্য নয়। পাবলো ভাবত সে ঈশ্বর – কিন্তু সে তো ঈশ্বর নয় – এটা তাকে বিচলিত করত। পাবলো আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রেম, কিন্তু (তার মতো ঐশ্বরিক দানবের সঙ্গে থেকে) নিজেকে রক্ষা করার পদক্ষেপও তো নিতে হবে। আমি নিয়েছি। ধ্বংস হয়ে যাবার আগে আমি বেরিয়ে এসেছি। অন্যরা পারেনি। তারা প্রবল শক্তিশালী মিনোটার (গ্রিক উপকথার অর্ধেক মানব, অর্ধেক ষাঁড়) অাঁকড়ে থেকেছে এবং সেজন্য চরম মূল্য দিয়েছে।’

১৯৫৩ সালে ফ্রাঁসোয়াজ যখন দুই সন্তান – ক্লদ (১৯৪৭) এবং পালোমাকে (১৯৪৯) নিয়ে পিকাসোকে চিরদিনের মতো ছেড়ে যান, পিকাসো তাঁকে সতর্ক করে দিয়েছেন, ‘আমার মতো মানুষকে কেউ এভাবে ছেড়ে যায় না।’ তাঁর কথায় প্রচ্ছন্ন ছিল : এর পরিণতি ভালো হবে না।

শেষ পর্যন্ত ফ্রাঁসোয়াজ ও তাঁর সন্তানদেরও অনেক মূল্য দিতে হয়েছে।

১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হলো ফ্রাঁসোয়াজ জিলোর লাইফ উইথ পিকাসো। নিরন্তর সৃজনশীল শিল্পীকে তিনি যেমন এঁকেছেন, তেমনি সামনে নিয়ে এসেছেন তাঁর যৌনলালসা – স্ত্রী, মিসট্রেস/প্রেরণাদাত্রী/মডেলের সঙ্গে সম্পর্ক, তাদের নিজ প্রয়োজনে ব্যবহার এবং দরজার পাপোশ হিসেবে তাদের ছুড়ে ফেলার কাহিনি। তাঁর ভেতরের আগ্নেয়গিরির উষ্ণতা ও শক্তি, নিত্যকার নারীসঙ্গ, অাঁধার অলিগলির ওপর তিনি আলোকসম্পাত করেছেন।

ক্ষুব্ধ পিকাসো তাঁর এই সাবেক মিসট্রেসের সঙ্গে তো বটেই, দুই সন্তানের সঙ্গেও যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। ১৯৭৩-এ একানববই বছর বয়সে মৃত্যু পর্যন্ত পিকাসো তাঁর জীবনের ফ্রাঁসোয়াজ অধ্যায়টির দিকে আর ফিরে তাকাননি।

জেনেট হাউলে যখন ফ্রাঁসোয়াজ জিলোর সাক্ষাৎকার চান, বারবার প্রত্যাখ্যান করে একসময় বলে ওঠেন : ‘এতে আমার মূল্যবান সময়ের অপচয় ঘটবে। পিকাসো আমার অতীত জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কিন্তু আমি তো অতীত নিয়ে জীবনধারণ করি না। আমার নিজের শিল্পকর্ম রয়েছে, আমি প্রতিদিনই ছবি অাঁকি।… আমি যা লিখেছি বা বলেছি তা তো লেখা বা বলা হয়ে গেছে। এসব নিয়ে আবার কথা বলে আমি সময় নষ্ট করতে চাই না।’

জেনেট দেখলেন, তাঁর বাড়িভর্তি  বই ও ছবি। কিন্তু পিকাসো নেই। ‘আমার কাছে পিকাসোর একটি ছবিই ছিল Le
Femme-Fleur, কিন্তু কবছর আগে এটি বেচে দিয়েছি, আমার মনে হয়েছে এই ছবি আমার জন্য দুর্ভাগ্য ডেকে আনছে।… আমি পিকাসোর আর কোনো ছবি কখনো নিতে চাইনি। তাহলে পিকাসোর বলার সুযোগ হতো তুমিও তো আমার অন্য নারীদের মতোই; আমি কিছুই নিইনি। আমি স্বাধীন থাকতে চেয়েছি। তাছাড়া এটা তো আমার জানাই, পিকাসোর কাছ থেকে কিছু নিলে তাঁর কাছে ঋণী হয়ে যাব, আর সেজন্য আমাকেও মূল্য দিতে হবে। সে চেয়েছে তার আর সব নারীর মতো নিজেকে বিছিয়ে দিই, কিন্তু আমি কখনো তা করিনি। আমি পিকাসোর শিল্পীজীবনের ‘জিলো অধ্যায়’ হিসেবে পরিচিত হতে চাইনি ফার্নান্দে/ইভা/ওলগা/ম্যারি-থেরেস/ ডোরা মার অধ্যায়ের মতো। সম্ভোগ ও অঙ্কনের জন্য পিকাসো কেমন করে একজনের পর একজন নারীকে হত্যা করেছে তা আমার জানা।’

পিকাসোর শুভদৃষ্টি ও সানুগ্রহ ছোঁয়া থেকে যে কজন নারী বাদ পড়েছেন তিনি তাঁদের নির্মমভাবে এঁকেছেন : ওলগার দাঁত ক্ষুরের মতো, শরীর দুমড়ানো-মোচড়ানো আর ধাতব পদার্থ কাটার করাতের মতো যোনি – আর এ ছবির প্রেক্ষাপটে লাস্যময়ী ম্যারি-থেরেস, বয়স সতেরো; ম্যারি দখল করে নিয়েছে ওলগার স্থান।

ফ্রাঁসোয়াজ জিলো মনে করেন, এসব মহিলার জীবনের ট্র্যাজেডি হচ্ছে তারা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে চেয়েছে বিখ্যাত শিল্পী পিকাসোর হাতে অাঁকা ছবির বিষয়বস্ত্ত হয়ে। তারা তোষামোদের শিকার হয়েছে, ফাঁদে পড়েছে এবং পিকাসোর মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকতে চেয়েছে। কিন্তু আমি নিজেই তো পেইন্টার – আমি জানি এরকমভাবে বেঁচে থাকা মূর্খতা। শিল্পী হিসেবে আমরা সবাই জানি যদিও পিকাসো নারীর পোর্ট্রেট অাঁকছেন, এটা মূলত তাঁর নিজেরই পোর্ট্রেট। পিকাসোর সব ছবিই তাঁর জীবনের দৈনন্দিন ডায়েরি।

পিকাসো তাঁর নতুন প্রেমিকা ফ্রাঁসোয়াজ জিলোকে নিয়ে পুরনো বন্ধু মাতিসের কাছে গেলেন – মাতিসে তাকে পছন্দ করলেন এবং ঘোষণা দিলেন, ‘আমি ফ্রাঁসোয়ার পোর্ট্রেট করব। তার শরীর হবে পান্ডুর নীল, আর চুল হবে সবুজ পাতার রঙের।’ মাতিসের আগ্রহে পিকাসো ক্ষুব্ধ হলেন। বাড়ি ফিরে তিনি ফ্রাঁসোয়াজের ড্রইং করতে শুরু করলেন, বললেন, তিনিই প্রথম পেইন্টিং করবেন – আমার সেই ছবিই হয়ে উঠল Le Femme-Fleur – ফুলনারী, মুখমন্ডল পান্ডুর নীল আর চুল পাতা রঙের।

‘পিকাসোর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ছিল যুদ্ধকালীন রোমাঞ্চ – একটি চরম পরিস্থিতি আমাদের এমনভাবে মিলিয়ে দিলো, যা
শান্তিকালীন পরিস্থিতিতে কখনো হবার নয় – তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলছে, আমরা তখন জার্মানির দখলে নেওয়া প্যারিসে, সময়টা ভয়ংকর বিপদ ও ধ্বংসযজ্ঞের।’

‘আমার প্রজন্মের কাছে পিকাসো একজন নায়ক; পিকাসো গুয়ের্নিকা এঁকেছে। ফ্যাসিবাদ ও ফ্রাঙ্কোর রাজত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীক এই ছবি। আমেরিকায় পালিয়ে না গিয়ে তখন প্যারিসে থাকা তার জন্য অসম সাহসের কাজ। যে-কোনো দিন গ্রেপ্তার হতে পারত, অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার এটাই তার পথ।’

‘আমার পরিবারের অনেকেই প্রতিরোধ করতে গিয়ে নিহত হয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের বিক্ষোভ থেকে আমিও গ্রেপ্তার হয়েছিলাম। আমার অস্তিত্বও বিপন্ন হতে পারত।’

পিকাসো তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তুমি কেন সবসময় আমার কথার বিরোধিতা করো?’

তিনি বললেন, ‘কারণ তোমার আর আমার মধ্যে কথোপকথন হচ্ছে – এটা ডায়লগ, মনোলগ নয়। রাজার চারপাশের লোকজন যেমন তার কাছে কেবল হ্যাঁ বলে, সবাই সবসময় তোমার সামনেও তা-ই করে। সেজন্য আমি না বলি। যখন সবাই তোমার কথায় হ্যাঁ বলে তুমি নিশ্চয়ই নিজেকে ক্ষমতাধর মনে করো। কিন্তু তুমিও তো নিঃসঙ্গ। সেই পাবলোকে আমি দেখি অত্যন্ত নিঃসঙ্গ একটি আকৃতির মতো।’

নৈঃসঙ্গ্য ও নিজের ভেতরে নির্জনতার কথা শিল্পীও স্বীকার করেছেন, আরো বলেছেন, কেউ তাঁকে বুঝতে পারে না। একটি বিশেষ প্রাজ্ঞতা দিয়ে ফ্রাঁসোয়াজই তাঁর ভারসাম্য রক্ষা করে যেতে পারেন। ফ্রাঁসোয়াজও মনে করেন, তিনি সত্যিই তা পেরেছেন এবং পিকাসোকে আশ্বস্ত রেখেছেন।

পিকাসো ঘুম থেকে বিষণ্ণতা ও হতাশার মধ্যে জেগে উঠতেন সকাল দশটার দিকে। উঠেই বলতেন, জীবন দুর্বিষহ হয়ে গেছে, ঘুম থেকে জেগে ওঠার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না, কোনো কিছু অাঁকার চেষ্টা করার কোনো মানে নেই।

ফ্রাঁসোয়াজ তাঁকে আশ্বস্ত করতেন – ‘যতটা খারাপ বলছ, তেমন খারাপ কিছু তো ঘটেনি। আজ বিস্ময়কর কিছু অাঁকতে পারবে। বন্ধুরা এলে তাদের সঙ্গে বাদানুবাদ করে তাকে জিততে হতো, তার ব্যাটারি বিদ্যুতায়িত হতো, আবার সম্রাটের মতো হয়ে যেত, শেষে বেলা একটার দিকে প্রসন্ন মনে স্টুডিওতে ঢুকত।’

‘পিকাসো রাত দশটা পর্যন্ত একটানা কাজ করত; সবসময়ই নিঃশব্দে, কোনো সংগীত বাজাতে হতো না কিংবা কোনো সাহায্যকারী লাগত না। দশটায় থামত রাতের খাবারের জন্য। দিনে চল্লিশটি সিগারেট টানত; কিন্তু কখনো মদপান করেনি। কখনো আবার কাজ শুরু করত, বিছানায় ফিরত রাত দুটায়।  একই রুটিন পরদিনের জন্য।’

পিকাসোর স্ত্রী ও রক্ষিতাদের নিয়ে ফ্রাঁসোয়াজ বললেন, ব্যাপারটা ব্লু বেয়ার্ডের সাতজন স্ত্রীর মতো (ফরাসি লোককথার ব্লু বেয়ার্ড কুৎসিত নীল দাড়িওয়ালা এক ধনী ব্যক্তি, যিনি একের পর এক তাঁর সাত স্ত্রীকে খুন করেন – তাঁকে বিয়ে করতে কোনো তরুণী আর সম্মত হয় না) – সবাই দেয়ালে ঝুলে থাকবে, তার বেলাতেও একই ঘটনা ঘটত।

পিকাসোর প্রথম দীর্ঘকালীন রক্ষিতা চিত্রশিল্পী ও মডেল ফার্নান্দে অলিভিয়েকে (১৯০৪ থেকে ১৯১২ পর্যন্ত পিকাসোর সঙ্গী) কিংবা পিকাসোর পরবর্তী নারী ইভা গুয়েল, ১৯১৫ সালে যক্ষ্মায় যার মৃত্যু ঘটে তাদের কাউকে ফ্রাঁসোয়াজ চিনতেন না, কিন্তু অন্যদের তিনি জানতেন। তিনি মনে করেন নিজেকে কেন্দ্রে রেখে তার নারীদের ওপর বিকৃত অধিকার প্রতিষ্ঠা করে আবর্তন করাতে গিয়ে ‘পিকাসো তাদের সঙ্গে অবিরাম মিথ্যে কথা বলে গেছেন।’

পিকাসো যখন ৩৪, তরুণী গ্যাবি লেসপিনাসকে অধিকার করে নেন। তবে এই অধ্যায়টি খুবই অল্প আলোচিত।

১৯১৮ সালে শিল্পী রুশ ব্যালেরিনা ওলগা খোকলোভাকে বিয়ে করেন। ওলগার সামাজিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও মানসিক অস্থিরতা এবং একই সঙ্গে পিকাসোর উপেক্ষা ও বহুগামিতা সংসার ভেঙে দেয়। কিন্তু তখন স্পেনে তালাক আইনানুগ না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত তালাক সম্পাদিত হয়নি। ওলগা দক্ষিণ ফ্রান্সে এসে তালাকের মামলা করেন, কিন্তু পিকাসো সম্পদের যথাযথ বণ্টনে সম্মত না হওয়ায় প্রক্রিয়াটি ঝুলে যায়। ১৯৫৫-তে কার্যত মস্তিষ্ক বিকৃত ও ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে ওলগার মৃত্যু পর্যন্ত পিকাসোর সঙ্গে বিয়ে বহাল ছিল।

পিকাসো ও ওলগার পুত্র পাওলো, জন্ম ১৯২১, অতিরিক্ত অ্যালকোহল আসক্ত, ৫৪ বছর বয়সে লিভার সিরোসিসে মৃত্যুবরণ করে।

ফ্রাঁসোয়াজ বলেন, ‘আমি পাওলোকে ভালো করেই চিনতাম, আমরা দুজন সমবয়সী। চমৎকার এই যুবক বাবা ও মা দুজনের কারণেই কঠিন কষ্টকর জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছে। পিকাসো কখনো চায়নি এই ছেলে বড় হয়ে উঠুক, তাকে সবসময় ছোট করে রেখেছে, তাকে নিজের গাড়ির ড্রাইভার বানিয়েছে (পিকাসো গাড়ি চালাত না)। আমরা যখন দক্ষিণ ফ্রান্সে চলে যাই পাওলো গাড়ি চালিয়ে আমাদের ষাঁড়ের লড়াই দেখতে নিয়ে যেত। ষাঁড়ের লড়াই পিকাসোর খুব পছন্দের, তার ধারণা জীবন হচ্ছে ‘কোরিদা’ (ষাঁড়ের লড়াইয়ের স্প্যানিশ প্রতিশব্দ), মৃত্যু পর্যন্ত রক্তাক্ত যুদ্ধ। তাকে লড়াইয়ের রিংয়ের ভেতর ষাঁড়সহ যত চরিত্র আছে সবগুলোর সঙ্গেই শনাক্ত করা যায়।’

১৯২৭। পিকাসোর চোখ পড়ে সতেরো বছরের তরুণী ম্যারি-থেরেস ওয়াল্টারের ওপর।

পিকাসো তখন পঁয়তাল্লিশ। প্যারিসের গ্যালারিজ ল্যাফায়েত ডিপার্টমেন্ট স্টোরে ম্যারি পিটারপ্যান কলার জামা খুঁজছে (১৯০৫ সালে চালু, জামার দুপাশে বড় কলার)।

শিল্পী এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘তোমার চেহারাটা খুব মজার। আমি তোমার একটি পোর্ট্রেট করতে চাই। আমার মনে হয় তুমি আর আমি মিলে একটা বড় কিছু করতে যাচ্ছি। আমার নাম পিকাসো।’ কিন্তু তরুণী কখনো তাঁর নামই শোনেনি। শিল্পী তাকে পাশের একটি বইয়ের দোকানে নিয়ে গেলেন। তাঁর অাঁকা ছবি নিয়ে প্রকাশিত একটি মনোগ্রাফ দেখালেন। আর সময় লাগেনি। ম্যারি-থেরেস ওয়াল্টার অচিরেই তার প্রেমে পড়ল এবং মিসট্রেসে রূপান্তরিত হলো। শিল্পীর জীবনের অন্যতম প্রধান প্রেম – সম্ভবত প্রধানতম প্রেম এটিই।

ফ্রাঁসোয়াজ জিলো খোলামেলাভাবেই বলছেন, ‘আসলে দুজনের সম্পর্কটা ছিল মূলত শারীরিক। পিকাসোর অাঁকা তার ছবিগুলো যৌনতাধর্মী, গীতিময়, কোমল, পান্ডুর এবং সমুদ্রবরণ রঙে ছাওয়া। মেয়েটির জন্য আমার মায়া হয়, কারণ সে নিষ্পাপ – তেমন চাতুর্য নেই তার, অক্রিয়, মধুর এবং সুন্দর। সে পিকাসোকে অর্চনা করত, তার জীবনে আর কিছু ছিল না।১৯৩৫-এ তাদের একটি কন্যাসন্তান জন্মে, মায়া তার নাম।’

পিকাসোর লেখা একটি কবিতার উলটো পিঠে ম্যারি-থেরেস লিখেছেন : ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমার যা কিছু আছে তার সবই তোমাকে দিয়েছি।’

কিন্তু তার জন্য পিকাসোর অনুরাগ দ্রুত মিলিয়ে যেতে থাকে। ১৯৩৬-এ তিনি আবিষ্কার করেন পরাবাস্তববাদী ফটোগ্রাফার ডোরা মারকে। ক্রোয়েশিয়ান বাবা ও ফরাসি মায়ের সন্তান ডোরা বেড়ে উঠেছেন আর্জেন্টিনায়, চমৎকার স্প্যানিশ কথাবলা কলাকৌশল রপ্ত করেছেন, পিকাসো নিজে স্প্যানিশ, এতে আরো মোহিত হন। প্যারিসে লে দ্যু ম্যাগো কাফেতে আঙুলের ফাঁকে দ্রুতলয়ে ধারালো ছুরি চালানোর নৈপুণ্য দেখাতে গিয়ে আঙুল কেটে ফেলেন। প্রথম দেখার স্মৃতি ধরে রাখতে পিকাসো তাঁর হাতের রক্তাক্ত গ্লাভস নিজের কাছে রেখে দেন।

মনে করা হয় ডোরার বাম রাজনৈতিক কার্যক্রম পিকাসোকে ১৯৩৭ সালে গুয়ের্নিকা অাঁকতে অনুপ্রাণিত করেছে। ডোরার বন্য অসনাতন আচরণ পিকাসোকে আকৃষ্ট করেছে বলে ফ্রাঁসোয়াজ জিলো মনে করেন। ‘ডোরা ছাড়া আর কেউ খুব বুদ্ধিমতী ছিল না, তারা এসেছে পাতি-বুর্জোয়া প্রেক্ষাপট থেকে, তারা তেমন শিক্ষিতও ছিল না। ডোরা তাদের মধ্যে সবচেয়ে ধীমতি, তবু সে পিকাসোর চোখ দিয়ে দেখতে চায়নি; কিন্তু শেষ পর্যন্ত শিল্পীর সঙ্গে মর্ষকামী খেলায় মেতে ওঠে। তার মনস্তাত্ত্বিক সংকট শুরু হয়, ১৯৪৩ সালে পিকাসো তাঁকে পাগল ঘোষণা করেন। হামেশাই আবেগজনিত দ্বন্দ্ব ও সংকটে ভুগতে থাকা ডোরাকে নিয়ে পিকাসো বলেছেন, আমার জন্য সে-ই ক্রন্দসী রমণী – দ্য উইপিং ওমেন। বছরের পর বছর আমি তার নিপীড়িত যন্ত্রণাক্লিষ্ট ছবি এঁকেছি – তা কোনো ধরনের মর্ষকাম বা আনন্দজাত নয়, আমি বিষয়কে যেভাবে দেখেছি তাই আমাকে দিয়ে অাঁকিয়ে নিয়েছে।’

পিকাসো যখন  গুয়ের্নিকা অাঁকছেন ডোরা তাঁর ক্যামেরায় ছবি তুলে রাখছেন; শিল্পীর ক্রোধ এবং যুদ্ধের ভয়াবহতা সবই তাঁকে সইতে হয়েছে। উইপিং ওমেন তার সেই যন্ত্রণার সাক্ষ্যই দেয়।

ফ্রাঁসোয়াজ জিলো লিখেছেন, ১৯৪৩-এ পিকাসো তাঁকে আশ্বস্ত করেছেন ম্যারি-থেরেস এবং ডোরা মারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের ইতি ঘটেছে, যদিও দুসপ্তাহে দুবার মেয়ে মায়া এবং তার মাকে দেখতে যেতে হচ্ছে। সন্তান দেখতে যাওয়াকে কি জিলো স্বাভাবিক পিতার সফর হিসেবে দেখছেন?

‘সম্ভবত তা-ই। এটা তার জীবনের একটি অংশ। আমি একে হুমকি হিসেবে দেখছি না – পিকাসো যদি ম্যারি-থেরেসের সঙ্গে আরো একবার সহবাস করে তাতে অবস্থার কী এমন পরিবর্তন ঘটবে? এটা তো সে ১৯২৭ থেকেই করে আসছে আর এখন তো ১৯৫০-এর দশক চলছে। আমার সঙ্গে পাবলোর সম্পর্কটা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। ম্যারি-থেরেস কিংবা ডোরা মারকে নিয়ে ঈর্ষান্বিত ছিলাম না। দুজনেই পিকাসোর ছবিতে উঠে এসেছে এবং তাতে ভালোই হয়েছে।’

‘আমি জানতাম পিকাসো হচ্ছে বড় নদীর মতো, যার স্রোত কঙ্কাল ও ধ্বংসাবশেষ বহন করবে। তার প্রচুর যৌন তৃপ্তি দরকার ছিল, পিকাসো যেভাবে তৈরি তাতে এটাই মৌল তাড়না।’

পিকাসো কি বড়মাপের প্রেমিক ছিলেন?

‘হ্যাঁ, যদি পিকাসো তা হতে চাইত তবেই।’

যখন ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চলে তাদের বাস, পিকাসোই তাকেসন্তান নিতে উদ্বুদ্ধ করলেন, বললেন, এতে নিজেদের জোড়টি আরো আবদ্ধ হবে এবং তার নারীত্বের ষোলোকলা পূর্ণ হবে। ‘আমি চিন্তিত ছিলাম কারণ পিকাসো তখনো ওলগার সঙ্গে আইনসম্মতভাবে বিবাহিত। কিন্তু সে প্রতিশ্রুতি দিলো সবসময় আমাদের সন্তানদের ভালোবাসবে এবং দেখভাল করবে।’ দুজনের সন্তান ক্লদের জন্ম ১৯৪৭ সালে এবং পালোমা ১৯৪৯-এ।

জিলো মনে করেন, পিকাসোর অন্য নারীদের চেয়ে তিনিই এই শিল্পীকে সবচেয়ে ভালো পরিমাপ করতে পেরেছেন। ‘আমি জানতাম, যে শিল্পী গুয়ের্নিকা এঁকেছে সে কোনো ছোট্ট সুন্দর দেবদূত নয়। মাঝারি মেধার মানুষকে যে মানদন্ডে বিচার করা হয় সেই একই প্রমাণ মাপে, একই নৈতিক বিচারে অত্যন্ত সৃজনশীল একজন শিল্পীকে বিচার করা ঠিক হবে না।’

কোনো না কোনো অবয়বে পিকাসো সর্বোচ্চ ভালো ও সর্বনিম্ন মন্দের অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন – তা না থাকলে যেভাবে তিনি এঁকে চলেছেন, তা সম্ভব হতো না। তাঁর আচরণ আদিম মনে হতে পারে।

‘পাবলোর আগ্রহ শিশুর আগ্রহের মতো অপরিপক্ব – ভেতরে কী আছে দেখার জন্য একটা ঘড়ি হাতে নেয় এবং তারপর ভেঙে ফেলে।’

‘যখন যা মন চেয়েছে পাবলো পরিণতির কথা ভাবেনি, করে ফেলেছে।’ জিলো মনে করেন, পিকাসোর আচরণ অন্যায্য ও নির্মম হয়ে উঠেছে; সন্তানদের ওপর এর কী প্রভাব তা নিয়ে তাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকতে হয়েছে।

পারিবারিক সম্পর্ক রক্ষা করে চলা ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছিল। ‘যেখানে পিকাসো হচ্ছে ঈশ্বর এবং আমার সন্তানরা আর আমি সাধারণ মানুষ মাত্র।’

পিকাসো অহংকার করে জিলোকে বলেছেন, যারা তাকে ভালোবাসে তাদের ভুগিয়ে তিনি আনন্দ পান। ‘একবার আমি পাবলোকে জিজ্ঞেস করলাম, তার যে সেক্রেটারি তাকে রীতিমতো পূজা করে সেই সাবার্তেসের সঙ্গে এমন নোংরা আচরণ কেন করল?’

পিকাসো জবাব দিলেন, ‘আমি যাদের ভালোবাসি তাদের প্রতি নোংরা আচরণ করি, যাদের আমি পাত্তাই দিই না তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করি।’ এই হচ্ছে পিকাসো – ‘এভাবে আমাদের ভালোবাসার পরীক্ষা নেয়। র‌্যাশনাল বা যুক্তিপ্রবণ হওয়া ছাড়া আর যা যা হওয়া যায় সবই সে হয়েছে।’ সে সময়ে তাঁকে নিয়ে অাঁকা পিকাসোর ছবি নিয়ে ফ্রাঁসোয়াজ জিলো বলছেন, ‘পাবলো ঘোড়ায় সওয়ার মধ্যযুগের সম্ভ্রান্ত নাইটের একটি সিরিজ এঁকেছে। ছবিগুলো আমাকে নিয়ে। সে বলেছে, আমি কখনো নিরস্ত্র হই না।’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, আমি চাই না, আমি খুন হই।’ সে অনেকগুলো বড় চিংড়ি এঁকেছে। চিংড়ির বাইরে শক্ত আস্তর, নিজেকে রক্ষা করার জন্য। সেগুলোও আমি – আমারও চারদিকে সুরক্ষা আস্তর।

ক্রমেই আরো বেশি করে তার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল, পিকাসোকে ভালোবাসতে এবং বুঝতে তিনি তাঁর সম্পূর্ণ জীবন দিয়ে দিয়েছেন কিন্তু পিকাসো তাঁকে কখনো চিনতে পারেনি।

পিকাসো যখন তাঁর সঙ্গে প্রথম ভালোবাসাবাসি করছেন, তিনি তাঁর সঙ্গে এমন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিলেন, ‘এমনও মুহূর্ত ছিল, আমার মনে হয়েছে তার উপস্থিতি এড়িয়ে আমার পক্ষে শ্বাস-প্রশ্বাস চালিয়ে যাওয়া শারীরিকভাবেই অসম্ভব।’

তারপর তিনি মানবিক উষ্ণতার জন্য অপেক্ষা করেছেন এবং জেনেছেন তা কখনো পিকাসোর কাছ থেকে পাওয়া সম্ভব নয়।

‘ভালোবাসা নিয়ে পিকাসোর ধারণাটি মূলত শারীরিক এবং অধিকারের, কিছু দেবার নয়। আবার একই সঙ্গে তার বুদ্ধিদীপ্ত ভালো দিক হচ্ছে যখন কেউ তার সঙ্গে তার ভাবনার কথা শুনছে, তাকে রঙের কাজ করতে দেখছে সে এতই বিস্মিত হবে যে, ভাববে, বুঝি অলৌকিক কিছু দেখছে। এই অনুভূতি পিকাসো দিতে পারে – আর এটা যার বোঝার ক্ষমতা আছে সে-ই এই অনুভূতিতে ভাগ বসাতে পারে।’

আর কোনো নারীই পিকাসোকে ছেড়ে যায়নি। জিলো যখন ছয় বছরের ক্লদ ও চার বছরের পালোমাকে নিয়ে দাদির দিক থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্পদের অর্থে কেনা প্যারিসের একটি অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে ওঠেন, পিকাসো ক্রোধ ও অবিশ্বাস থেকে ফুঁসে উঠছিলেন।

জিলো বললেন, ‘আমার বাঁচার মতো টাকা-পয়সা ছিল, নিজের একটি ক্যারিয়ার ছিল; আমার আত্মীয়স্বজন ও আমার বৃত্তের বন্ধুরা আমার জীবন পুনর্গঠন করতে সাহায্য করেছে।’

ক্লদ ও পালোমা স্কুল ছুটির দিনগুলো পিকাসোর সঙ্গে কাটাত।

তিনি তখনো ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চলে বাস করতেন। একাত্তর বছর বয়স্ক বিমর্ষ শিল্পী শিগগিরই তাঁর সঙ্গে থাকতে আগ্রহী, সাতাশ বছর বয়স্ক মৃৎশিল্প-সহকারী জ্যাকুলিন রোককে কাছে টেনে নেন এবং ওলগার মৃত্যুর পর সংগোপনে বিয়ে করেন।

জিলো ঘৃণা ও অবজ্ঞা মিশিয়ে জ্যাকুলিনের কথা বলেন। ‘জ্যাকুলিন ফাঁপা, নির্বোধ, পাতি-বুর্জোয়া এক নারী, যার স্বাভাবিক বুদ্ধির ঘাটতি রয়েছে, আর পিকাসোর ব্যাপারে তার ভূমিকা দখলদারির। পাবলো তাতেই খুশি। কারণ এই নারী তো নির্বোধের মতো নিজেকে বিছিয়ে দিয়েছে – তাকে বলছে তার যা কিছু কাজ সবই অনবদ্য; কখনো সমালোচনা করেনি।’

তাচ্ছিল্যভরে জিলো বলছেন, ‘পিকাসো যখন জ্যাকুলিনকে পেল তার শিল্পীজীবনের শ্রেষ্ঠ সময়ের অবসান ঘটল। আগে সে যৌনতাশ্রয়ী চিত্রকল্প ব্যবহার করেছে কিন্তু জ্যাকুলিনকে পাওয়ার পর পর্নোগ্রাফিক হয়ে ওঠে – তার নতুন শিল্পকর্মে যেখানে সেখানে যোনি ও পায়ু অাঁকতে শুরু করে।’

ব্যাপারটা যেন তার জন্য খুব উপভোগ্য এমন স্বরেই ফ্রাঁসোয়াজ জিলো বলেছেন, ‘শুনেছি, ততদিনে পিকাসোর পৌরুষের সমস্যা দাঁড়িয়ে গেছে। আমার সঙ্গে বেশ শক্তিশালী পুরুষই ছিল। এখন বুড়ো হচ্ছে। এখন জ্যাকুলিনের কাছ থেকে সরে যেতে চাইলেও এটা তার জন্য জুতসই হবে না। এটা নিশ্চয়ই তার কাছে খুব বিরক্তিকর, তার মন তাকে জ্যাকুলিনের প্রতি যত না বিশ্বস্ত করেছে, তার চেয়ে বেশি বিশ্বস্ত করে তুলেছে তার শরীর। আহ, কী দুর্ভাগ্য!’

জিলো বলছেন, ‘জ্যাকুলিন আসার আগে পর্যন্ত পিকাসোর কাছে তাঁর আর সব নারী ও সন্তানদের কিছুটা জায়গা ছিল। আমি জানি অন্য নারীরা পিকাসোর কাছে প্রেমপত্র পাঠাত, পিকাসো জবাবও দিত। আমাদের সঙ্গে স্কুল ছুটির দিনগুলো কাটাতে আমি সবসময়ই মায়াকে আমন্ত্রণ জানাতাম; মায়া, পাওলো, ক্লদ ও পালোমাকে বন্ধুত্বের দিকে উৎসাহিত করতাম। কিন্তু জ্যাকুলিন পিকাসোকে চেয়েছে কেবল নিজের জন্য।’

১৯৬৪ সালে নতুন মোচড় লাগল – প্রকাশিত হলো ফ্রাঁসোয়াজ জিলোর লাইফ উইথ পিকাসো। বাজারে নামার সঙ্গে সঙ্গেই নন-ফিকশন বইয়ের বেস্ট সেলার্স লিস্টে। দশ লক্ষাধিক বিক্রি হলো। বইয়ের বিক্রি ও ফ্রাঁসোয়াজের পরিচিতি যত বাড়ছে ততই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন পিকাসো ও জ্যাকুলিন।

 

১৯৬৪-তে ক্লদ স্কুলছাত্র, বয়স ষোলো বছর। ক্লদ তাঁর দুর্ভাগ্যজনক অভিজ্ঞতার কথা বলছে :

‘তখন ইস্টারের ছুটি। পালোমা ও আমি ট্রেনে চেপে চলে যাই ফ্রান্সের দক্ষিণে – সেখানে আমার বাবা। সেখানে আমার মায়ের রেখে আসা একটি বাড়িতে উঠে বাবার বাড়িতে আগের মতো ফোন করি। গাড়ি যেন আমাদের নিতে আসে। কিন্তু কেউ আসেনি। আমরা কয়েকদিন অপেক্ষা করি, তবুও আমাদের নিতে কেউ এলো না।’

শেষ পর্যন্ত পিকাসো ও জ্যাকুলিনের সঙ্গে আমাদের একটি বৈঠক হয় – প্রায় সব কথা জ্যাকুলিন একাই বলে। আমাদের জানায় – আমার মায়ের বইয়ের কারণে পিকাসো নির্মম আঘাত পেয়েছেন। আর এর জন্য আমরাই দায়ী। কারণ আমি ও পালোমা মাকে এই বই লেখা থেকে নিরস্ত করিনি। দুজনেই বুঝিয়ে দিলো আমাদের সঙ্গে বাবার সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে।

আমি বাবার ওপর খুব ক্ষুব্ধ হলাম। আমার মনে হলো, বাবা খুবই বোকাটে ও দুর্বল বৃদ্ধের মতো আচরণ করছে। পালোমা একেবারে ভেঙে পড়ল এবং সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যাত বোধ করল। আমরা ফিরে এসে আবার ফোন করলাম, চিঠি লিখলাম; কিন্তু সবই যে অর্থহীন। বাবার বয়স তিরাশি বছর, মনে হলো বাবা সেখানে নির্বিকার সন্ন্যাসীর জীবনযাপন করছে। আমি প্রতিবছর সেখানে গিয়েছি, তাকে দেখতে চেয়েছি, তার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছি। আমি দেয়াল ডিঙিয়ে ভেতরে গিয়ে সিঁধেলের মতো ঢুকতে চেয়েছি, কিন্তু কখনো তাকে দেখিনি।

ফ্রাঁসোয়াজ জিলো বললেন, ‘পিকাসো আমার ফরাসি প্রকাশকের বিরুদ্ধে মামলা করল। মামলায় হেরে গেল। রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করল, তাতেও হেরে গেল। যেদিন আপিলের রায় বের হলো পিকাসো আমাকে ফোন করে বলল, ‘তুমি জিতে গেলে। বেশ! আমি তোমাকে অভিবাদন জানাই।’ এটাই তাঁর স্বভাব – বিজয়ীকে অভিনন্দন জানায়, তার প্রশংসা করে, কিন্তু হেরে গেলে আমি তার ঘৃণা ও নিন্দার শিকার হতাম।’

মেধাবীরা তাদের চারপাশে যারা আছে তাদের কাছ থেকে বড্ড বেশি আদায় করে নেয় – যন্ত্রণাটা রেখে যায় তাদের জন্য। পিকাসোর পাশে যারা ছিল এই ট্র্যাজেডির শিকার তারা সবাই।

পিকাসোর মৃত্যুর পর প্রভেন্সের উঁচু দেয়ালঘেরা শ্যাটোতে (প্রাচীন সামন্ত ভবন) তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয়, সমাহিত হন সেখানে।

ক্লদ স্মরণ করছে – ‘তখন তুষার ঝরছে। তারপর বৃষ্টি শুরু হলো। পালোমা ও আমি তিন দিন ধরে দুর্গের বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম, আমরা ভেতরে ঢোকার অনুমতি প্রার্থনা করে যাচ্ছি। কিন্তু জ্যাকুলিনের কড়া আদেশ, আমাদের যেন ভেতরে ঢুকতে দেওয়া না হয়।’

পিকাসোর দৌহিত্র পাওলো পিকাসোর (ওলগা ও পিকাসোর সন্তান) পুত্র পাবলিতো ভেতরে ঢুকতে চেয়েছিল, তাকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি, রাগে-অভিমানে বাড়ি ফিরে এক বোতল ব্লিচ গলাধঃকরণ করে। তিন মাস টানা যন্ত্রণার পর পাবলিতোর মৃত্যু হয়। কবছর পর পিকাসোকে ছাড়া বাঁচতে অসমর্থ দুই নারী জ্যাকুলিন ও ম্যারি-থেরেস আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

বরাবরই মৃত্যুভয়ে আতঙ্কিত পিকাসো কোনো উইল রেখে যাননি। এ নিয়ে তাঁর মৃত্যুর পর পারিবারিক দ্বন্দ্ব-সংকট আরো বেড়ে যায়। তখনকার ফরাসি আইনে বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক থেকে জন্ম নেওয়া সন্তান সম্পত্তিতে অধিকার দাবি করতে পারত না।

ফ্রাঁসোয়াজ জিলো আগেই নিজের দূরদর্শিতা কাজে লাগিয়ে তাঁর সন্তানদের জন্য আদালত থেকে ‘পিকাসো’ সারনেইম ব্যবহারের আদেশ নিয়ে রেখেছেন।

ক্লদ বলল, ‘বারো বছর বয়স পর্যন্ত আমি ছিলাম ক্লদ জিলো, তারপর থেকে ক্লদ পিকাসো।’

 

জ্যাকুলিনের মৃত্যু

 

ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরার যে শ্যাটোতে বিংশ শতকের শ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পীর মৃত্যু হয় সে বাড়িতেই তাঁর শেষ সঙ্গী জ্যাকুলিন রোক (পরে পিকাসো) আত্মহত্যা করেন। ১৫ অক্টোবর ১৯৮৬ তাঁর বাড়ির গৃহকর্মী সকাল নয়টায় তাঁকে তাঁর বেডরুমে মৃত অবস্থায় দেখতে পায়। একটি স্বয়ংক্রিয় পিস্তল পড়ে ছিল তাঁর নিথর দেহের পাশেই। পুলিশ বলে, নিজের মাথা টার্গেট করে ট্রিগার টেপা একটি গুলিই তাঁর প্রাণ হরণের জন্য যথেষ্ট ছিল। ৮ এপ্রিল ১৯৭৩ পিকাসোর মৃত্যু পর্যন্ত দুজন এ বাড়িতেই ছিলেন।

জ্যাকুলিন পিকাসোর দ্বিতীয় স্ত্রী। তাঁদের সম্পর্কটিও দ্বন্দ্বসংকুল ও ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল, সাময়িক বিচ্ছেদ ও সমঝোতা স্থাপন একাধিকবার ঘটেছে। তবে জ্যাকুলিন আমৃত্যু পিকাসোর অনুগত ছিলেন।

১৯৫৩ সালে আটাশ বছর বয়সী তালাকপ্রাপ্ত জ্যাকুলিন রোক পিকাসোর মডেল হিসেবে শিল্পীকে সঙ্গ দিতে থাকেন। পিকাসোর বয়স তখন বাহাত্তর বছর।

জ্যাকুলিন ভয়ংকর ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন, ঘনিষ্ঠজনদের বলেও গেছেন – এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে বরং আমার মরে যাওয়া ভালো।

পিকাসোর পাশেই তিনি সমাহিত হন। নিয়তির এই পরিহাসটুকু উপভোগ করেই যেন ফ্রাঁসোয়াজ জিলো বললেন, লাইফ উইথ পিকাসো লিখে তাঁর হাতে যে অর্থ এসেছে তা-ই কাজে লেগেছে পিকাসোর বৈধ উত্তরাধিকারী হতে ক্লদ ও পালোমার দায়ের করা মামলায়। ‘কয়েক বছর লেগে গেছে – আইন ধীরগতিতে বদলাচ্ছিল, কিন্তু এই মামলার এত প্রচারণা হলো যে আইন বদলে যেতে আর বেশি সময় লাগল না। ক্লদ, পালোমা ও মায়া আদালতের রায়ে বাবার সম্পত্তিতে বৈধ উত্তরাধিকার লাভ করল।’

যখন মামলা আদালতে গড়ায় পিকাসো তখনো জীবিত। ‘সে ভয়ংকর খেপে গেল। সন্তানদের ভালোবাসার ও যত্ন করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সে কথা রাখল না।’

রক্ষিতার সন্তান বলে ভিন্ন চোখে দেখার কোনো কারণ নেই, পিকাসোরই ঔরসজাত, তাঁর কারণেই ফ্রাঁসোয়াজের গর্ভে ক্লদ ও পালোমা এবং ডোরা মারের গর্ভে জন্ম নেওয়া মায়ার আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ফরাসি রক্ষণশীল সমাজের হাজার বছরের ট্যাবু ভেঙে গেল। বৈধ বিয়ের বাইরে যাদের জন্ম তাদের জীবনে উৎসব এনে দিলেন দুর্বিনীত পিকাসো রক্ষিতা ফ্রাঁসোয়াজ জিলো। ন্যায্যভাবেই হোক কি অন্যায়ভাবে, অবৈধ সন্তান যাতে পিকাসোর বিশাল-সাম্রাজ্যে ঢুকতে না পারে, লৌহকপাট বন্ধ করে জ্যাকুলিন রোক তা বরাবরই নিশ্চিত করেছেন। জন রিচার্ডসন জ্যাকুলিনকে ক্ষমায় ও ভালোবাসায় মিশিয়ে দেখেছেন। তিনি যখন পিকাসোকে গ্রহণ করলেন তাঁর বয়স সত্তর, আর তিনি সাতাশ। তাঁদের প্রণয়ের দুবছরের মধ্যে ফ্রাঁসোয়াজ জিলো সন্তানদের নিয়ে চিরদিনের জন্য দূরে চলে গেলেন।

জ্যাকুলিন পিকাসোকে ছাত্র, ভক্ত, ট্যুরিস্ট, ছবির ডিলার, পন্ডিত, অভিনেতা-অভিনেত্রী, তাঁকে দেখতে বেপরোয়া উন্মাদ – সবার হাত থেকে রক্ষা করেছেন। পিকাসোকে শেষ বছরগুলোতেও রং-তুলিতে তিনি সক্রিয় রেখেছেন। পিকাসোকে ঘিরে তাঁর যে নির্মম কাঁটাতারের বেষ্টনী তা-ই তাঁকে বাইরের জগতে ডাইনি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

রিচার্ড ডরমেন্ট লিখেছেন, পিকাসোকে তাঁর প্রথম মিসট্রেস ফার্নান্দে অলিভিয়ে ব্ল্যাকমেইল করেছেন। তিনি ফ্রাঁসোয়াজ জিলোর বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছেন। ফ্রাঁসোয়াজ পিকাসোর দানব মূর্তিটি পৃথিবীর সামনে তুলে ধরলেও জোর দিয়েই বলেছেন, ‘পাবলো ওয়াজ দ্য গ্রেটেস্ট লাভ অব মাই লাইফ’ – পাবলোই আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রেম… আমি ধ্বংস হয়ে যাবার আগেই তাঁকে ছেড়ে এসেছি।

পিকাসোই তাঁকে বলেছেন, ‘আমার কাছে নারী হয় ঈশ্বরী, না হয় দরজার পাপোশ।’

ফ্রাঁসোয়াজ জিলোর কাছে পিকাসোর অাঁকা একটি ছবিও  নেই, তিনি রাখতেও চাননি। কিন্তু পিকাসোকে নিয়ে লেখা ডজন ডজন বই আছে। তাঁর নিজের বিতর্কিত বইটি তো আছেই। তিনি বলছেন, ‘পিকাসো হচ্ছে জনগণের আরাধ্য দেবতা। আমি তাদের সামনে সমালোচক হিসেবে চিহ্নিত থাকতে চাই না। তাঁর সঙ্গে আমার যে সময় কেটেছে সে সময়ের একটি মুহূর্ত নিয়েও আমার কোনো খেদ নেই। তাঁর শিল্প অসাধারণ, কিন্তু মানুষটির দোষত্রুটি আছে… আমি পিকাসোর এমন কিছু বিষয় জানি যা অন্য কারো জানা নেই – আমি এমন কিছু বলতে পারতাম যা তাঁকে ক্রোধে উন্মত্ত করে তুলত।’

পিকাসোকে ক্ষুব্ধ করার মতো তিনি অনেক কিছু করেছেন। ‘পাবলো বলেছিল, যখন আমি তাঁকে ছেড়ে এলাম আমার জীবন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। পৃথিবীতে সে ছাড়া আমার পাশে আর কেউ দাঁড়াবে না। কিন্তু আমি দুবার বিয়ে করেছি।’

এবার তাঁর সমবয়সী ফরাসি চিত্রশিল্পী লুক সিমোকে। তাঁদের দাম্পত্যজীবন ১৯৫৫-৬২, সাত বছরের, তাদের কন্যা অরিয়েনা স্থপতি। তারপর পোলিও ভ্যাকসিন আবিষ্কারের অন্যতম অগ্রণী বিজ্ঞানী জোনাস স্যাকের সঙ্গে কেটেছে পুরো সিকি শতাব্দী। ১৯৯৫-তে তাঁর মৃত্যু হয়।

ফ্রাঁসোয়াজ জিলো গর্বভরেই বলেছেন, এর সবই তো বিরুদ্ধাচরণ। ‘এটা ধর্মদ্রোহ! কথা ছিল আমার জীবন তাঁর জন্য উৎসর্গ করব, কিন্তু তাহলে তো একেবারে লোককথার ব্লু বেয়ার্ডের গল্পই হয়ে যেত। আমি তা নষ্ট করে দিয়েছি।’

আরিয়ানা হাফিংটনের লেখা বিরূপ জীবনীগ্রন্থ পিকাসো : স্রষ্টা ও ধ্বংসকারীর ওপর ভিত্তি করে ভারতীয় বংশোদ্ভূত ইসমাইল মার্চেন্ট ছবি বানিয়েছেন। পিকাসোর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন অ্যান্থনি হপকিন্স।

জন রিচার্ডসন দেখিয়েছেন, নারীর প্রতি পিকাসো যতটা নির্মম ছিলেন, ভালোবেসেছেন, কোমল হাতে লালন করেছেন, প্রাণের আর্তি দিয়ে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছেন তার চেয়ে বেশি।

রিচার্ডসন মনে করেন, ‘নারীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের ধরন তাঁর শিল্পকর্মেই প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি যখন তাদের সঙ্গে কোমল ও নমনীয়, তাঁর ছবিতে পিকাসোর নারীরা সেভাবেই উঠে এসেছেন।… যখন অন্য একজন পুরনো নারীর স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন পিকাসো তখন যে নারীকে অাঁকছেন তাঁর চুলের অর্ধেক অংশ কালো অর্ধেক সোনালি – দুপাশে দুই রং – যাতে পুরনো নারী নিজেই দেখতে পান অন্য কেউ তাঁর স্থলাভিষিক্ত হতে যাচ্ছেন।’

পিকাসোর নারী অধিকাংশ সময়ই বিমূর্ত হয়ে ক্যানভাসে উঠে এসেছেন – ১৯১০-এর পর তাঁর মিসট্রেসরা মর্ত্যের শরীর ছেড়ে কখনো গিটার কিংবা অন্য কোনো বাদ্যযন্ত্র হয়ে অঙ্কিত হয়েছেন – যেন পিকাসোরই ক্রীড়নক।

 

পিকাসোর মৃত্যু

 

৮ এপ্রিল ১৯৭৩ ভোর তিনটা পর্যন্ত ৯১ বছর বয়সী পিকাসো ছবি এঁকেছেন। তারপর ঘুমিয়ে পড়েন। সকালে বিছানা থেকে নামতে কষ্ট হচ্ছিল। তিনি জ্যাকুলিনকে নাম ধরে ডাকেন। দশ মিনিট পর তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর কারণ বড়মাপের হার্ট অ্যাটাক।

নিজেকে দিয়ে অাঁকা সর্বশেষ সেলফ পোর্ট্রেট শেষ করেন ৩০ জুন ১৯৭২। সে পোর্ট্রেটের নাম : ‘সেলফ পোর্ট্রেট ফেইসিং ডেথ’ – মৃত্যুর মুখোমুখি আত্মপ্রতিকৃতি। কাগজের ওপর ক্রেয়নে অাঁকা এই পোর্ট্রেট পিকাসো তাঁর নিজের মুখের ওপর স্থাপন করে তাঁর বন্ধু পিয়েরে দাইকে দেখিয়েছেন। তাঁর মনে হয়েছে, এখানে ভীতির অভিব্যক্তি আসলে পিকাসোর একটি কৌশল। তিন মাস পর পিয়েরে আবার যখন পিকাসোর কাছে যান, দেখতে পেলেন ছবির রূঢ় দাগগুলো আরো গভীর হয়ে আছে, তিনি অপলক তাকিয়ে আছেন, তাঁর মনে হয়েছে পিকাসো সরাসরি নিজের মৃত্যুর দিকে তাকিয়ে আছেন।

 

নারীর ছবি ছবির নারী

 

ফার্নান্দে অলিভিয়ে : পিকাসো যখন তাঁর শিল্পীজীবনের নীল অধ্যায় অতিক্রম করছেন, লালের আভা উঁকি দিতে শুরু করেছে, এমনি সময় ৪ আগস্ট ১৯০৪ অপ্রত্যাশিত ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যে আরো অপ্রত্যাশিতভাবে আবির্ভূত হন পিকাসোর চেয়ে চার মাসের বড় বৃষ্টিভেজা ফার্নান্দে অলিভিয়ে। তিনি তখন অন্য শিল্পীদের মডেল হিসেবে কাজ করতেন। পিকাসো তাঁকে বেঁধে ফেললেন প্রণয়ের বন্ধনে। ১৯০৪ থেকে ১৯১২ – সাত বছরেরও বেশি সময় তিনি শিল্পীর সঙ্গে ছিলেন, মিসট্রেস হিসেবেই। সে সময় পিকাসো তাঁকে অন্য কারো মডেল হতে নিরস্ত করেছেন।

তাঁকে নিয়ে অাঁকা পিকাসোর ভাস্কর্য : নারীর মাথা (১৯০৯)

 

ইভা গুয়েল : ফার্নান্দে অলিভিয়ে ১৯১২ সালে পিকাসোকে ছেড়ে যান। সে সময় তাঁর জীবনে আসেন সাতাশ বছর বয়সী মার্সেল হামবার্ট কিংবা ইভা গুয়েল। পিকাসো তখন একত্রিশ। ১৯১৫ সালে যক্ষ্মা কিংবা ক্যান্সারে তাঁর মৃত্যু হয়। পিকাসো ব্যথিত হয়ে ভেঙে পড়েছিলেন। ইভাকে নিয়ে ‘আই লাভ ইভা’ নামে কয়েকটি ছবিও এঁকেছেন। ১৯১৩-তে অাঁকা ‘ওমেন ইন আর্মচেয়ার’ ইভাকে নিয়ে অাঁকা অন্যতম শ্রেষ্ঠ তেলচিত্র।

 

ওলগা খোকলোভা : ব্যালে নৃত্যশিল্পী ওলগার সঙ্গে পিকাসোর দেখা রোমে। শিল্পী তখন ব্যালে নৃত্যনাট্য ‘প্যারেডে’র ডিজাইন করছিলেন। প্যারিসের এক রুশ অর্থোডক্স চার্চে ১৯১৮-তে তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের সাক্ষী ছিলেন জ্যঁ ককতো। বিয়েটা সুখের হয়নি। দুজন ভিন্ন মেজাজের শিল্পীর দ্বন্দ্ব লেগেই ছিল।

তাঁকে নিয়ে অাঁকা পিকাসোর ছবির মধ্যে রয়েছে : হাতলওয়ালা চেয়ারে ওলগা (১৯১৩)

 

ম্যারি-থেরেস ওয়াল্টার : ওলগার সঙ্গে বিবাহিত থাকা অবস্থায় ১৯২৭ সালে ছেচল্লিশ বছর বয়সী পিকাসোর সঙ্গে সতেরো বছর বয়সী ম্যারির দেখা। ১৯২৭ থেকে ১৯৩৬ প্রায় দশ বছর পিকাসোর মিসট্রেস ও মিউজ। তাঁকে নিয়ে পিকাসোর হাতে উঠে এসেছে কিছু অসাধারণ স্নিগ্ধ ছবি। ‘স্বপ্ন’ ও ‘ঘুমন্ত’ এরকম দুটি ছবি।

 

ডোরা মার : যুগোস্লাভিয়ান ফটোগ্রাফার ডোরা মারকে পিকাসোর বাম রাজনীতির প্রতি আসক্তি ও প্রতিবাদী চিত্রের প্রেরণা বলে মনে করা হয়। ১৯৩৬ সালে পিকাসো চুয়ান্ন, ডোরা ঊনত্রিশ; ডোরা স্প্যানিশ গণযুদ্ধের ভয়াবহতা নিয়ে অাঁকা গুয়ের্নিকার হয়ে ওঠার বিভিন্ন পর্বের চিত্র ধারণ করেন। মিসট্রেস হিসেবে পিকাসোর সঙ্গে কাটিয়ে দেন ১৯৩৬ থেকে ১৯৪৪ পর্যন্ত আট বছর। শিল্পী তাঁকে নিয়ে অাঁকেন তাঁর ‘ক্রন্দসী’ সিরিজের বহু ছবি। বঞ্চিত ডোরার জীবনে পিকাসো অধ্যায় শেষ হলে নিজে ছবি অাঁকতে শুরু করেন, প্যারিসে প্রদর্শনীও করেছেন। নিঃসঙ্গ, জনবিচ্ছিন্ন ও দরিদ্র অবস্থায় তাঁর শেষ দিনগুলো কাটে।

ডোরাকে নিয়ে পিকাসোর সবচেয়ে আলোচিত ছবি ‘দ্য উইপিং ওমেন’- ক্রন্দসী নারী।

 

ফ্রাঁসোয়াজ জিলো : ১৯৪৩-এ পিকাসো বাষট্টি আর চিত্রকলার শিক্ষার্থী ফ্রাঁসোয়াজ জিলো মাত্র বাইশ; অবস্থাপন্ন পরিবারের ফ্রাঁসোয়াজকেও রক্ষিতার জীবনই যাপন করতে হয়েছে; ক্লদ ও পালোমা – এক পুত্র ও এক কন্যার জননী হয়েছেন। তিনি প্রতিবাদী ছিলেন এবং তাঁর ভাষায়, ‘অন্য নারীদের মতো নিজেকে পিকাসোর কাছে বিছিয়ে দেননি। তিনিই পিকাসোকে ত্যাগ করেছেন। তাঁকে নিয়ে অাঁকা ছবির মধ্যে রয়েছে : ওমেন ফ্লাওয়ার।

 

জেনভিয়েভ লোপার্ত : ১৯৪৪ সালে সতেরো বছর বয়সী এই তরুণী স্কুলের সংবাদপত্রের জন্য পিকাসোর সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলেন। ১৯৫১ সালে পিকাসোর বয়স সত্তর বছর – জেনভিয়েভ তাঁকে দেখতে তাঁর স্টুডিওতে আসেন। গ্রীষ্মে তাকে নিয়ে চলে যান সেইন্ট ত্রোপেজ। তাকে নিয়ে সেখানেই থাকতে চান। কিন্তু এই তরুণী যেতে অসম্মতি জানান। ১৯৫৩ সালে তাকে ছেড়ে যান। একই সময়ে ফ্রাঁসোয়াজও পিকাসোকে পরিত্যাগ করেন।

তাঁকে নিয়ে পিকাসোর ছবি : জেনভিয়েভের পোর্ট্রেট (১৯৫১)

 

জ্যাকুলিন রোক : মৃৎশিল্প প্রদর্শনী ও বেচাকেনার দোকানের সেলসগার্ল জ্যাকুলিনের সঙ্গে ১৯৫৩ সালে পিকাসোর প্রণয় পর্ব যখন শুরু হয়; তাঁর বয়স ঊনআশি বছর। তিনি জ্যাকুলিনকে বিয়ে করেন। পিকাসো তাঁকে নিয়েই সবচেয়ে বেশি ছবি এঁকেছেন। কেবল পোর্ট্রেটের সংখ্যা সত্তর ছাড়িয়ে। তিনি পিকাসোকে তাঁর মিসট্রেস ও তাঁদের গর্ভজাত সন্তানদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিলেন।

তাঁকে নিয়ে পিকাসোর একটি বিখ্যাত ছবি : জ্যাকুলিন উইথ ফলাওয়ার্স।

 

ভিন্ন পাদটীকা

 

পেইন্টিং নিয়ে পিকাসো কী বলছেন?

 

‘সবাই পেইন্টিং বুঝতে চান। তাঁরা পাখির গান কেন বুঝতে চান না? না বুঝেই কেন কেউ রাত, ফুল, চারপাশের সবকিছু ভালোবাসেন? কিন্তু পেইন্টিংয়ের বেলায় মানুষকে তা বুঝতে হবে।’ (ক্রিশ্চিয়ান জারভোস, পিকাসোর সঙ্গে কথোপকথন, ১৯৩৫)

জেরোম স্লেকার জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কেন এমনভাবে ছবি অাঁকেন, যা জনগণের পক্ষে বোঝা এত কঠিন?’

পিকাসো জবাব দিলেন, ‘আমি এভাবে ছবি অাঁকি, কারণ এগুলো আমার চিন্তার ফলাফল। এখানে পৌঁছতে আমি বছরের পর বছর কাজ করেছি। আর আমি যদি এখান থেকে এক পা পিছিয়ে যাই, তাহলে জনগণকে অপমান করা হবে – কারণ আমার ছবিই আমার ভাবনার ফলাফল। কেবল বোঝাতে পারার পরিতৃপ্তির জন্য আমি সাধারণ কোনো পদ্ধতির আশ্রয় নিতে পারি না।’ (১৯৪৫)

আরো অনেক পরে আদ্রে মালরো বলেছেন, ‘মানুষকে জাগিয়ে তুলতে হবে। কোনো কিছু শনাক্ত করার জন্য তাদের ব্যবহৃত পদ্ধতি গুঁড়িয়ে দিতে হবে। গ্রহণযোগ্য নয় এমন চিত্রকল্প নির্মাণ করতে হবে।’ (১৯৭৪)

ব্রাসাইর পিকাসোর সঙ্গে কথোপকথনে (১৯৭৪) শিল্পী বেশ কিছু প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন :

সবসময়ই শুদ্ধতার প্রত্যাশা করতে হবে। আমার বেলায় তা হচ্ছে দূর থেকে আরো দূরে চলে যাওয়া, এক ক্যানভাস থেকে অন্য ক্যানভাসে।

আশি বছর বয়সে পিকাসো বললেন, আমার পুরনো পেইন্টিং আমাকে আগ্রহান্বিত করে না। যে ছবি আমি এখনো অাঁকিনি আমার অনুসন্ধিৎসা সেদিকেই।

আরো আগেই বলেছেন, আমি একটি বিষয়কে যেভাবে দেখি সেভাবে অাঁকি না, যেভাবে ভাবি, সেভাবেই অাঁকি।

পেইন্টিং হচ্ছে অন্ধ মানুষের পেশা; যা দেখেন তা তিনি অাঁকেন না, যা অনুভব করেন, বিষয় সম্পর্কে তিনি নিজেকে যা বলেন তা-ই অাঁকেন।

ঈশ্বর হচ্ছেন আর একজন শিল্পী। তিনি জিরাফ, হাতি ও বিড়াল আবিষ্কার করেছেন। তাঁর নিজস্ব কোনো স্টাইল নেই। তখন তিনি অন্যকিছু আবিষ্কারের চেষ্টা করেন।

আমরা যখন মুখাবয়ব অাঁকি, ভেতরে কী আছে তা অাঁকি, পেছনে কী আছে তা-ও।

তুমি যা কিছু কল্পনা করতে পারো তার সবই বাস্তব।

কোনো কোনো শিল্পী সূর্যকে একটি হলদে বিন্দুতে পরিণত করেন, কোনো কোনো শিল্পী হলদে বিন্দুকে সূর্য করে তোলেন। আমি অনুপ্রেরণা খুঁজি বাস্তবতায়। বাস্তবতাই আমার কল্পনাকে শক্তিমন্ত করে, আমাকে দেয় নতুন জীবন।

পেইন্টিং আমার চেয়ে শক্তিশালী; পেইন্টিং যা চায় আমাকে দিয়ে তা-ই করায়।

ভালো শিল্পীরা নকল করেন, মহান শিল্পীরা চুরি করেন। আমার যখন লাল থাকে না, আমি নীল ব্যবহার করি।

বিমূর্ত শিল্প বলে কিছু নেই। তোমাকে অবশ্যই কিছু একটা নিয়ে শুরু করতে হবে। তারপর বাস্তবতার সব চিহ্ন তুলে দেবে।

আমরা সবাই জানি, শিল্প সত্য নয়। শিল্প একটি মিথ্যে, যা সত্যকে অনুধাবন করায় – অন্তত যে সত্যটি অনুধাবনের জন্য আমাদের দেওয়া হয়।

কিউবিজম অন্য কোনো স্কুল অব পেইন্টিং থেকে ভিন্ন কিছু নয়।

আমি ইংরেজি বই পড়তে পারি না, আমার কাছে ইংরেজি বই অর্থহীন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে ইংরেজি ভাষার অস্তিত্ব নেই। আমি যা বুঝি না, যার কিছুই জানি না, সেজন্য নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে দোষারোপ করব কেন?

শিল্প সৌন্দর্যের আইনকানুনের প্রয়োগ নয় – আইনকানুনের বাইরে হৃদয় ও মস্তিষ্ক যা ধারণ করতে পারে তা-ই। আমরা যখন একজন নারীকে ভালোবাসি তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মাপ মেলাতে শুরু করি না।

র‌্যাফায়েলের মতো করে অাঁকতে আমার চার বছর লাগল; কিন্তু শিশুর মতো অাঁকতে লেগে গেল সারাটা জীবন।

নিত্যকার যে ধুলোবালি আত্মার ওপর পড়ে, শিল্প তাই ধুয়ে দেয়।

ক্রান্তিকালের শিল্প বলে কিছু নেই।

আমাকে একটি জাদুঘর দাও, আমি পুরোটা ভরে দেব।

যদি কেবল একটি সত্য থাকত তাহলে একই থিম নিয়ে একশ ক্যানভাসে অাঁকা যেত না।

 

চিত্রদহন : হার্লেকুইন হেড

 

পিকাসো কেবল কুড়ি পেরোলেন। তখন দারিদ্র্য তাঁর নিত্যসঙ্গী। এর মধ্যে তাঁর এক বন্ধু আত্মহত্যা করেছেন। পিকাসোর তুলিতে তখন অাঁকা হচ্ছে দারিদ্র্যপীড়িত বিপন্ন মানুষ। রঙের ব্যবহারে অন্যসব রংকে ছাপিয়ে যাচ্ছে নীল। এটিই পিকাসোর চিত্রকর জীবনের ‘নীল অধ্যায়’ (১৯০১-০৪)।

খাবার কিংবা ছবি অাঁকার উপকরণ কেনার মতো পর্যাপ্ত টাকা তখন ছিল না। ভীষণ শীতে সে সময় ঘর উষ্ণ করার জন্য যখন মরিয়া হয়ে উঠতেন, কখনো পিকাসোকে তাঁর অাঁকা ছবি পুড়িয়ে ঘর উষ্ণ করতে হয়েছে।

ছবি চুরির ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এ পর্যন্ত গ্যালারি ও মিউজিয়াম থেকে সবচেয়ে বেশি চুরির শিকার হয়েছে পিকাসোর চিত্রকর্ম। দুবছর আগে পিকাসোর হার্লেকুইন হেড চুলোর আগুনে পুড়িয়ে ছাই করা হয়েছে, সঙ্গে পুড়েছে অগাস্ত মনে এবং মাতিসের ছবি। ১৯১২-র অক্টোবরে নেদারল্যান্ডসের রটারডাম গ্যালারি থেকে চুরি হয় পিকাসোর হার্লেকুইন হেড (১৯৭১), মনের ওয়াটারলু ব্রিজ (১৯০১), লন্ডন ও ব্যারিং ক্রস ব্রিজ (১৯০১), মাতিসের রিডিং গার্ল ইন হোয়াইট অ্যান্ড ইয়োলো (১৯১৯), পল গঁগার গার্ল ইন ফ্রন্ট অব ওপেন উইন্ডো, মেয়ার দ্য হোনর সেন্ট পোর্ট্রেট (১৮৯০), লুসিয়ান ফ্রয়েডের ওমেন উইথ আইস ক্লোজড – চক্ষু মুদে থাকা নারী (২০০১)।

ছবি চোরদের রিং লিডার রাজ দোগারু রোমানিয়ান। গ্রেফতারের পর তার মা ওলগা দোগারু আদালতকে জানিয়েছেন, তাঁর বাড়ি তল্লাশি হবে বুঝতে পেরে একটি পরিত্যক্ত কবরে লুকিয়ে রাখা ছবিগুলো তুলে এনে পুড়িয়ে ফেলেছেন।

ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা চিত্রভস্ম পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ চালাচ্ছেন।

দ্য ওমেন অব আলজিয়ার্স

 

Les Femmes d’Alger – দ্য ওমেন অব আলজিয়ার্স চিত্রকর্ম বেচাকেনার ইতিহাসে বিশ্বরেকর্ড করল। মে ২০১৫-তে ক্রিস্টির নিলামে ১৭৯.৪ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়ে গেল ১৯৫৫ সালে অাঁকা আলজেরিয়ার নারীগণ। ষাট বছর আগের মূল্য সূচকের সঙ্গে সমন্বয় করলে এখন মূল্য দাঁড়াবে অবিশ্বাস্য ১৭.৯ বিলিয়ন ডলার!

আলজেরিয়ার নারী ফক্স-চ্যানেলে প্রদর্শনের সময় তিন নারীর স্তন ঝাপসা করে দেবার জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছে ফক্স-নিউজ কর্তৃপক্ষকে – শিল্পী যা স্বাচ্ছন্দ্যে এঁকেছেন, সারা পৃথিবী তিন নারীর স্তন যেভাবে দেখেছে এবং গ্রহণ করে নিয়েছে, তা বিকৃত করার কী দরকার ছিল?

 

পিকাসোর চিঠি

জ্যঁ ককতোকে

১৯১৬/ফরাসি সাহিত্যিক জ্যঁ ককতো (১৮৮৯-১৯৬৩) অসুখে ভুগছেন। তাঁর বন্ধু পাবলো পিকাসো তাঁর রোগমুক্তি কামনা করে চিঠি লিখলেন। রঙের অাঁচড় লাগানো চিঠি, তাও যদি পিকাসোর তুলির অাঁচড় শরীর তো ভালো হবেই।

মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্টে স্থায়ী প্রদর্শনীতে রাখা চিঠির ভাষান্তর :

আমার প্রিয় ককতো,

তোমার শরীর খারাপ শুনে আমিও খুব ব্যথিত। আমি আশা করি শিগগির তুমি সুস্থ হয়ে উঠবে। আমি তোমাকে দেখতে পাব। আগামী বুধবার মঁপারনাসে-তে সুরকারের সম্মানে উৎসব, তোমাকে সেখানে দেখব আশা করি। আমাদের মঞ্চের গল্প নিয়ে আমার কিছু ভালো ধারণা আছে। তোমার সঙ্গে এ নিয়ে আলাপ করব।

 

শ্রেষ্ঠতম শুভেচ্ছা

পিকাসো

 

ম্যাক্স জ্যাকবকে

 

ম্যাক্স জ্যাকব (১৮৭৬-১৯৪৪) জার্মান কবি, ঔপন্যাসিক, চিত্রশিল্পী এবং পিকাসোর প্রথম জীবনের দুঃসময়ের দিনগুলোর বন্ধু। তাঁর শিল্পের আশ্রয় প্রতীকীবাদ ও পরাবাস্তববাদ।

পিকাসো ও ম্যাক্স জ্যাকবের দশটি চিঠি পাওয়া গেছে। ১৯০৩/একটি সচিত্র চিঠি বার্সেলোনা থেকে লেখা :

 

আমার প্রিয় ম্যাক্স,

আমি যদি এখানে (বার্সেলোনা) কাজ করতে পারি তাহলে থেকে যাব, কিন্তু কিছু করতে না পারলে প্যারিসে ফিরে যাব।

এই চিঠির ওপর অাঁকাঅাঁকির নমুনাই বলে দেয়, এটা পিকাসোর নীল অধ্যায়ের সৃষ্টি। চিঠির শেষে লিখেছেন, ‘তোমার ভাই পিকাসো’। অনেকেই মনে করেন ম্যাক্স সেসময় শিল্পীর শ্রেষ্ঠ বন্ধুই ছিলেন না, তিনি শিল্পীকে আবিষ্কারও করেছেন।

পিকাসো জ্যাকবকে যে কটা চিঠি লিখেছেন, দশটি কেবল উদ্ধার করা গেছে। এই চিঠিটির স্কেচে একজন নারী বসে থাকা একজন পুরুষকে সুখানুভূতি দিচ্ছে, একটি হাত বাড়ানো, লোকটির পাশে হাঁটু গেড়ে বসা এক শিশু, কিছু প্রাণী তাকিয়ে আছে, নারী ও পুরুষ ডুবে আছে গভীর কথোপকথনে।

গারট্রুড স্টেইনকে

 

অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ প্রিয় বন্ধু এই আমেরিকান নারী, শিল্পের অতুল সমঝদার এবং মননশীল লেখক গারট্রুড স্টেইন (১৮৭৪-১৯৪৬)। পিকাসো ও মাতিসের পেইন্টিংয়ের প্রথম দিককার ক্রেতা তিনি। এই শিল্পীকে নিয়ে একটি বইও লিখেছেন। নাম – পিকাসো, ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত। তিনি লিখছেন, ‘সে সময় আমি একাই পিকাসোকে বুঝে উঠতে পারছি – কারণ আমিও সাহিত্যে একই কথা বলার চেষ্টা করছি, আসলে আমি আমেরিকান আর ও স্পেনিয়ার্ড… কোনো বিষয় নিয়ে আমাদের ধারণা একই ধরনের।’ তাঁর কাছে পিকাসোর চিঠি :

তুমি দেখতে পাবে। প্রতিটি দিন আরো জটিল, তুমি কোথায় শান্ত থাকবে? আমি একটি ছোট মেয়েকে নিয়ে ঘর সাজানোর মাঝামাঝিতে রয়েছি। তাদের ঝুড়িতে ফুল, তার পাশে দুটো ডিম আর গম – এরকম একটা কিছু। তোমাকে ও তোমার বোনকে আমার শ্রেষ্ঠতম শুভেচ্ছা। তোমার বন্ধুর কাছ থেকে পিকাসো

Leave a Reply