logo

থিয়েটার আর্ট ইউনিটের আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব ২০১২ পুষ্পেপত্রে শোভিত অসাধারণ নাট্যাঞ্জলি নিবেদন

অ লে া ক  ব সু
শীত শুরু হতে না হতেই ঢাকার নাট্যাঙ্গনে ছড়িয়ে পড়েছে নাট্যোৎসবের উষ্ণতা। থিয়েটার আর্ট ইউনিটের বিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ‘রঙ্গ হর্ষে বিংশ বর্ষে’ শীর্ষক এক আড়ম্বরপূর্ণ আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব। ১৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমীর মূল মিলনায়তনে এ উৎসবের উদ্বোধন করেন মাননীয় তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শুরুতে থিয়েটার আর্ট ইউনিট সম্মাননা প্রদান করা হয় দেশের খ্যাতিমান নাট্যকার সৈয়দ শামসুল হক এবং পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট নাট্যনির্দেশক বিভাষ চক্রবর্তীকে। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন ভারতীয় দূতাবাসের মাননীয় রাষ্ট্রদূত পঙ্কজ শরন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অন্য অতিথিদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন আইটিআই সভাপতি রামেন্দু মজুমদার, নাট্যনির্দেশক আতাউর রহমান, নাট্যজন মামুনুর রশীদ, শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী, রোকেয়া রফিক বেবি এবং ভারতের কৃতী নির্দেশক বানসি কাউল।

ছয়টি বিদেশি নাটক : চূড়ান্ত চমক
দেখাল ভোপাল
থিয়েটার আর্ট ইউনিট আয়োজিত বিংশ বর্ষপূর্তির এ নাট্যোৎসব সত্যিকার অর্থে রঙ্গ হর্ষে পূর্ণ হয়ে উঠেছিল। সাম্প্রতিক সময়ে নাটকের ক্ষেত্রে এত বড় এবং সার্থক আয়োজন খুব কমই চোখে পড়েছে। আয়োজকরা এ উৎসবকে আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব নাম দিয়েছেন, যদিও বাংলাদেশ ছাড়া এ উৎসবে অংশ নিয়েছিল ভারত ও নেপালের নাটক। ভারতের চারটি দল পাঁচটি নাটক এবং নেপালের একটি দল একটি নাটক নিয়ে এ উৎসবে অংশ নেয়। অর্থাৎ ছয়টি বিদেশি নাটক এ উৎসবে দেখার সুযোগ পান ঢাকার দর্শকরা। উৎসবে মোট একুশটি নাটক প্রদর্শিত হয়, যার মধ্যে ছয়টি বিদেশি। গণিতশাস্ত্রের হিসেবে প্রায় ২৯ শতাংশ বিদেশি নাটক। একটি আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসবের অবয়বে এটি মোটেও স্বাস্থ্যবান গড়ন নয়, তারপরও বলতে হবে সরকারি আনুকূল্য ছাড়া একটি নাটকের দলের পক্ষে এটি প্রায় অসাধ্য সাধন করার মতো ঘটনা। শুধু নাটকের প্রতি ভালোবাসার কারণে এদেশের নাটকের লোকজন কত অসাধ্য সাধনই না করছে। তবে থিয়েটার আর্ট ইউনিট তাদের এ নাট্যোৎসবের মাধ্যমে দর্শকদের মাঝে সাড়া জাগাতে পেরেছে শুরুর সন্ধ্যা থেকেই। উদ্বোধনী দিনে শিল্পকলা একাডেমীর মূলমঞ্চে পরিবেশিত হয় কলকাতার স্বপ্নসন্ধানী নাট্যদলের প্রযোজনা ম্যাকবেথ। উইলিয়াম শেকসপিয়ারের এ নাটকের ভাষান্তর করেছেন উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায় এবং নির্দেশনা দিয়েছেন কৌশিক সেন। প্রথম দিনে ম্যাকবেথের চমৎকার প্রযোজনা সবাইকে আকৃষ্ট করে। এরপরে এই মঞ্চে পরপর আরো পাঁচটি দেশের বাইরের প্রযোজনা মঞ্চস্থ হয়। প্রযোজনাগুলো হলো – ভারতের মুর্শিদাবাদের নাট্যদল রঙ্গাশ্রমের সন্তাপ। মানব চক্রবর্তীর গল্পের কৌশিক চট্টোপাধ্যায়কৃত নাট্যরূপে সন্তাপ নাটকে উঠে এসেছে থার্ড জেন্ডার অর্থাৎ সমাজের কাছে যারা হিজড়া নামে পরিচিত তাদের সংগ্রামী জীবনের চালচিত্র। নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন সন্দীপ ভট্টাচার্য। এরপর পর পর দুই সন্ধ্যায় পরিবেশিত হয় ভারতের ভোপালের নাট্যদল রং বিদূষকের দুটি নাটক – সওদাগর এবং সিধিদার সিধি উর্ফ তুক্কে পে টুক্কা। প্রথম নাটকটি ব্রেখটের কাহিনি থেকে শ্রীকান্ত কিশোর কর্র্তৃক হিন্দি ভাষায় রূপান্তরিত এবং দ্বিতীয়টি একটি চীনা রম্যকাহিনি অবলম্বনে রাজেশ যোশী ও বানসি কাউলের রচনা। দুটি নাটকই নির্দেশনা দিয়েছেন বানসি কাউল। এই উৎসবের কল্যাণে ভোপালের এ নাটক দুটি দেখার সৌভাগ্য অর্জন করলেন ঢাকার নাট্যদর্শকরা। ভোপালের নাটক এবং বানসি কাউলের কাজ সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পাওয়া গেল।  বানসি কাউলের নাটকে শরীরের ভাষা ব্যবহারের চমৎকারিত্বে ঢাকার দর্শক নড়েচড়ে বসেছেন। সংগীত, নৃত্য, কোরিওগ্রাফি, জিমন্যাস্টিক, সর্বোপরি অনন্যসাধারণ অভিনয় দিয়ে ভোপালের এই নাটকের দলটি সবার মন জয় করতে সমর্থ হয়েছে। যে অভিনেতা লাফঝাঁপ করে শারীরিক কসরত করে অভিনয় করছেন, তিনিই আবার এসব করতে করতে গান করছেন, তাতে তাঁর না হচ্ছে দমের সমস্যা, না হচ্ছে তালকানা, না হচ্ছে সুর বিভঙ্গ। এসবের সঙ্গে চলছিল স্যাটায়ারের সুতীক্ষè কাজ। এরকম প্রায় পৌনে দুই-দুই ঘণ্টা দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখবার আশ্চর্য ক্ষমতা দেখালেন বানসি কাউলের অভিনয়শিল্পীরা। পঞ্চম সন্ধ্যায় নেপালের মান্দালা থিয়েটার পরিবেশন করে সুনকেসরী নাটকটি। নেপালের এই দলটির কাজ সম্পর্কে ঢাকার দর্শকরা গত বছর আইটিআইয়ের উৎসবে একটা ধারণা পেয়েছিলেন। এই দলটির কাজও বেশ প্রশংসনীয়। এবার তারা মঞ্চায়ন করে সত্যমোহন যোশী-রচিত এবং রাজন খাতিওয়াড়া-নির্দেশিত লোককাহিনি আশ্রয়ী এ নাটকটি। ঢাকায় মঞ্চায়নের মাধ্যমে এ নাটকের ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার শো অনুষ্ঠিত হয়। তবে চোখে পড়ার মতো বিষয় ছিল এ নাটকটির মহড়ার অভাব। আর এ নাটকের উপস্থাপনের ঢংটি দেখে মনে হয়েছে, তাঁরা যেন ঢাকার নাটকের আদলে নাটক নির্মাণে প্রয়াসী হয়েছেন। ষষ্ঠ সন্ধ্যায় ছিল ভারতের মুর্শিদাবাদের ঋত্বিক নাট্যদলের নাটক শেষ রক্ষা। রবীন্দ্রনাথের এ নাটকের সম্পাদনা ও নির্দেশনার দায়িত্বে ছিলেন বিপ্লব দে।
উৎসবের প্রথম ছয়দিনে ছয়টি বিদেশি নাটক পর পর থাকায় উৎসব সম্পর্কে একটা টানটান আগ্রহ ছিল দর্শকদের মধ্যে।

বানসি কাউলের সাক্ষাৎকার
সংগীত ও নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত ভারতের গুণী নাট্যনির্দেশক বানসি কাউল তাঁর নির্দেশিত দুটি নাটক নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন থিয়েটার আর্ট ইউনিটের নাট্যোৎসবে অংশ নিতে।  শিল্প ও শিল্পীর পক্ষ থেকে তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন অলোক বসু।
অলোক বসু : থিয়েটারের সঙ্গে নিজেকে জড়ালেন কীভাবে?
বানসি কাউল : সে চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ বছর আগের কথা। আমার জন্ম কাশ্মীরে। সেখানেই শৌখিন নাটকে অভিনয় আর ছবি আঁকাআঁকি করেছিলাম। পরে ১৯৬৭ সালে ভারতের ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামায় যাই নাটক নিয়ে পড়াশোনা করতে।
অলোক বসু : ওখানকার পড়াশোনা, শিক্ষক ও বন্ধুদের সম্পর্কে যদি সংক্ষেপে কিছু বলেন –
বানসি কাউল : এনএসডিতে পড়াশোনা করেছি ডিজাইনিংয়ের ওপর। ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামায় শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম ইব্রাহিম আল কাজির মতো গুণী নাট্যশিক্ষককে। আর সহপাঠী হিসেবে পেয়েছিলাম নাসিরুদ্দিন শাহ্, ওমপুরিসহ আরো অনেক কৃতিমান নাট্যবন্ধুকে।
অলোক বসু : এনএসডি শেষ করে কী করলেন?
বানসি কাউল : এনএসডির পড়াশোনা শেষে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় থিয়েটার ও ওয়ার্কশপ করতে শুরু করি। সত্তর-আশিটির মতো শহরে নানা ভাষায় নাটক নির্দেশনার কাজ করেছি। যেখানে কাজের সুযোগ পেয়েছি, সেখানে গিয়েই কাজ করেছি।
অলোক বসু : ভোপালে থিতু হলেন কীভাবে?
বানসি কাউল : একটি প্রজেক্ট নিয়ে গিয়েছিলাম মধ্যপ্রদেশের ভোপালে। সেখানে আদিবাসীদের  নাটক ও পথনাটক নিয়ে কাজ করেছি। বস্তিবাসীদের নিয়েও নাটক তৈরির কাজ করেছি সেখানে। আর এসব কাজের প্রয়োজনে অ্যাক্রোবেটিকস, আদিবাসীদের নাটক, বস্তিবাসীদের নাটক ও পথনাটক নিয়ে নানারকম চর্চা, অনুশীলন, কর্মশালা করেছি। ১৯৮৪ সালে ভোপালে একটি নাট্যদল প্রতিষ্ঠা করি। তারপর থেকে ওখানেই আছি। থিয়েটার করে যাচ্ছি।
অলোক বসু : ‘রং বিদূষক’ কি আপনার হাতে তৈরি নাট্যসংগঠন?
বানসি কাউল : হ্যাঁ। মধ্যপ্রদেশের ভোপাল শহরে ‘রং বিদূষক’ নাট্যগোষ্ঠী তৈরি করি ১৯৮৪ সালে। শুরুতে দলটি এতবড় ছিল না। আস্তে আস্তে বড় হতে হতে এ অবস্থায় এসেছে। এ দলের হয়ে অসংখ্য নাটক করেছি। এবার ঢাকায় আসা এই দলেরই দুটি নাটক নিয়ে।
অলোক বসু :  থিয়েটার আর্ট ইউনিটের বিশ বছর পূর্তির নাট্যোৎসবে আপনার সওদাগর এবং সিধিদার সিধি উর্ফ তুক্কে পে টুক্কা নাটক দুটি ঢাকার দর্শকদের মনোযোগ কাড়তে সমর্থ হয়েছে। সেইসঙ্গে আপনার ডিজাইনিংয়ের বিশেষত্বও চোখে পড়েছে সবার। আপনার কাজের ধরন সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন?
বানসি কাউল : আমি সবসময়ই ভিন্ন ধরনের থিয়েটার করার কথা ভাবতাম, যা আধুনিক, আন্তর্জাতিক এবং একই সঙ্গে একটি সামাজিক সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীরও প্রতিনিধিত্ব করে। সে কারণে আমি নানারকম কর্মশালা ও মেথডলজির মধ্য দিয়ে এগোই। ভারত নানারকম ভাষা ও সংস্কৃতির দেশ। নাটকের প্রয়োজনে আমি যে-কোনো ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে উপাদান সংগ্রহ করি, প্রয়োজনে বিদেশ থেকেও উপাদান গ্রহণ করি। আমি আমার নাটকের প্রডাকশনকে স্পোর্টসের চোখে দেখি। সেখানে আনন্দ-উল্লাস আছে, আছে নানা রং, নানা দৃশ্যকাব্য আর হাস্যরস।
অলোক বসু : আপনার প্রযোজনার ডিজাইন, মেকআপ ইত্যাদিতে কমেডি ডেল আর্টের সঙ্গে একধরনের সাযুজ্য লক্ষ করা যায়। এ বিষয়টি যদি একটু খোলাসা করে বলেন –
বানসি কাউল : (প্রবল আপত্তি তুলে বলেন) আমরা আমাদের নিজেদের দিকে না তাকিয়ে বাইরের দিকে তাকাই এবং বাইরেরগুলোকে মান হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করি। এটা ঠিক নয়। দেখুন, শুধু ভারতে নয়, বাংলাদেশের কোথাও কোথাও আপনি এ-ধরনের অনেক লোকনাট্য দেখতে পাবেন। আমরা অনেক সময়ই আমাদের সংস্কৃতি ভালো করে জানি না বলে বাইরের দিকে তাকাই। আমাদেরই তো অনেক সম্পদ রয়েছে।
অলোক বসু : বাংলাদেশের টাঙ্গাইল অঞ্চলে সং যাত্রা বলে একধরনের লোকনাট্য আছে –
বানসি কাউল :  হ্যাঁ, ভারতে আরো অনেক বিচিত্র আঙ্গিক রয়েছে। আমার যেটা ভালো লাগে সেটা নিয়ে কাজ করি। তবে লোকনাট্যে যে রিদম ও এনার্জি আছে, সেটা আমার খুব পছন্দ। আর এটা ব্যবহার করতে আমার অনেক ভালো লাগে।
অলোক বসু : বলছিলাম আপনার অভিনয়শিল্পীদের পোশাক ও মেকআপের কথা –
বানসি কাউল : দেখুন, প্রত্যেকটি মানুষের যে নিজস্ব অভিব্যক্তি, সেটাকে যদি পালটে দেওয়া হয়, তাহলে নতুন অভিব্যক্তিটি আর তার নিজের থাকে না, হয়ে যায় অন্যের। সারাবিশ্বে আজ সবকিছু নিজের আয়ত্তে আনার যে অসম প্রতিযোগিতা চলছে সেখানে কী হচ্ছে? প্রশাসন থেকে বিচারব্যবস্থা, উৎপাদন থেকে ব্যবসা – সবকিছুতে একটা মেকি অভিব্যক্তি, সবাই যেন ক্লাউন হয়ে চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার নাটকের কুশীলবরা তাই বিচিত্র সাজে ওইসব ক্লাউনকে দর্শকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন।
অলোক বসু : বাংলাদেশের নাটক সম্পর্কে আপনার মতামত শুনতে চাই।
বানসি কাউল : এখানে অনেক ভালো ভালো কাজ হচ্ছে। তবে দু-চারটা নাটক যা দেখেছি তাতে মনে হয়েছে নাটক যেন শুধু সংলাপের মাঝে আটকে না থাকে। অনেকেই ভালো কাজ করছেন, তাঁরা আরো ভালো করবেন, যদি শরীরের ভাষাটাকেও থিয়েটারের ভাষায় সম্পৃক্ত করতে পারেন।
অলোক বসু : আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
বানসি কাউল : আপনাকেও।
দেশের ভালো ভালো নাটক দিয়ে
সাজানো উৎসব
থিয়েটার আর্ট ইউনিটের এ নাট্যোৎসবে একসঙ্গে ঢাকার অনেক ভালো নাটক প্রদর্শিত হয়। পালাকারের নারীগণ, প্রাঙ্গণেমোরের আওরঙ্গজেবের মতো অতিসাম্প্রতিক প্রযোজনা যেমন এ আয়োজনে স্থান পেয়েছে, তেমনি স্থান করে নিয়েছে অনেকদিন আগেকার থিয়েটার প্রযোজনা পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, থিয়েটার আর্ট ইউনিটের সতেরো-আঠারো বছর আগেকার বিখ্যাত প্রযোজনা কোর্ট মার্শাল। এ উৎসবে কোর্ট মার্শাল নাটকটির ২০০তম মঞ্চায়নও হয়ে গেল। এছাড়া মধ্যবর্তী সময়ের নাট্যকেন্দ্রের নাটক আরজ চরিতামৃত, আরণ্যকের রাঢ়াঙ, প্রাচ্যনাটের রাজা এবং অন্যান্য, সুবচনের মহাজনের নাওসহ আরো কিছু ভালো নাটক উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, কোর্ট মার্শালের মতো বিখ্যাত নাটক যেমন দর্শককে আকৃষ্ট করেছে, তেমনি মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় আদিবাসীদের সংগ্রামী ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির উপস্থাপন হয়েছে আরণ্যকের রাঢ়াঙ নাটকের মধ্য দিয়ে। উপস্থাপিত হয়েছে মুক্তবুদ্ধি ও জ্ঞানচর্চার মানুষ আরজ আলী মাতুব্বরের জীবন ও জ্ঞানপিপাসার সংগ্রামের কথা আরজ চরিতামৃত নাটকে। ইতিহাসের আশ্রয়ে আওরঙ্গজেব এবং নারীগণের মতো নাটকও উৎসবকে আলোড়িত করেছে। মোদ্দাকথা, উৎসবে যে একুশটি নাটকের মঞ্চায়ন হয়েছে, এসবের বেশিরভাগই ভালো নাটক। সে বিবেচনায় থিয়েটার আর্ট ইউনিটের এ উৎসব আয়োজন দর্শকদের রঙ্গ হর্ষে মাতিয়ে রাখতে সমর্থ হয়েছে ভালো ভালো প্রযোজনা উপভোগের আনন্দ লাভের মধ্য দিয়ে।
একজন আসাদুজ্জামান দুলাল, তাঁর
থিয়েটার এবং ‘গো-যাত্রা’
গত বেশ কবছর যাবৎ থিয়েটার আর্ট ইউনিট এস এম সোলায়মান নাট্য প্রণোদনা দিয়ে আসছে। প্রতিভাবান নাট্যজনদের এ প্রণোদনা দেওয়া হয়। এবার এ প্রণোদনা দেওয়া হলো পাবনার চাটমোহরের নাট্যদল সমন্বয় থিয়েটারকে। থিয়েটার আর্টের প্রণোদনা প্রদান যে কতটা সার্থক হয়েছে, তার প্রমাণ সমন্বয় থিয়েটারের কার্যক্রম এবং উৎসবে প্রদর্শিত তাদের নাটক ‘গো-যাত্রা’র সফল মঞ্চায়ন। ঢাকা থেকে অনেক দূরের মফস্বল শহর চাটমোহর। এখানকার মানুষ আসাদুজ্জামান দুলাল। দীর্ঘদিন ধরে থিয়েটার করে আসছেন। তাঁর ভাষায় এই তিলোত্তমা ঢাকা মহানগর থেকে অনেক দূরে বসে, থিয়েটারের কোনোরকম সুযোগ-সুবিধা ছাড়া আমরা যা করছি, তা আদৌ নাটক কি না জানি না। তবে আমরা আমাদের কাজ করে যাচ্ছি নিয়মিতভাবে। তাঁর এই বিনয় আমাদের চমৎকৃত করে, যখন আমরা তাঁর রচনা ও নিদের্শনায় গো-যাত্রা নাটকটি মঞ্চে দেখতে পাই।
আসাদুজ্জামান দুলাল তাঁর যৌবনে মুক্তনাটকে নিবেদিতপ্রাণ মানুষ ছিলেন। মুক্তনাটকের সাংগঠনিক চর্চা বন্ধ হয়ে গেলেও তিনি তাঁর দর্শন থেকে বিচ্যুত হননি। তিনি সমন্বয় থিয়েটার গঠন করে বিশ বছর যাবৎ নাটকের চর্চা করে আসছেন চাটমোহরে। এই উৎসবে তিনি তাঁর রচনা ও নির্দেশনায় গো-যাত্রা নাটকটি নিয়ে অংশগ্রহণ করেন। অত্যন্ত চমৎকার বিষয়বস্তু নিয়ে নাটক। একজন কৃষক ইজ্জত আলী একটি এনজিও থেকে কিছু টাকা ঋণ করে শোধ করতে পারে না। তার সহায়সম্পদের মধ্যে আছে একটা গাভি ও একমাত্র সন্তান পালোয়ান। সে নিজে গাভির সঙ্গে জোয়াল কাঁধে নেয়। ছেলে লাঙল চষে। উদয়াস্ত পরিশ্রম করেও সে তার অবস্থার উন্নতি করতে পারে না। গরুটির সঙ্গে তার দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে। গরুর প্রতি তার মমত্ব বাড়ে, গড়ে ওঠে একধরনের বন্ধুত্বও। গাভিটাকে সে মা বলে সম্বোধন করে। রাত-বিরেতে ঘর ছেড়ে গোয়ালঘরে গিয়ে গাভির সঙ্গে সুখ-দুঃখের গল্প করে। কৃষক ইজ্জতের আচরণ দেখে অন্যরা ভাবে, সে গরু হয়ে যাচ্ছে। এনজিওর লোক ভাবে টাকা ফেরত না দেওয়ার কৌশল হিসেবে অস্বাভাবিক আচরণ করছে কৃষক। ওদিকে চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকা ঋণের টাকা আদায়ে এনজিওর লোক মরিয়া হয়ে ওঠে। কৃষককে সুস্থ করার জন্য নানারকম ফিকির শুরু হয়। শুরু হয় তার গরুটি তুলে নিয়ে যাওয়ার পাঁয়তারা। স্বার্থান্বেষী চেয়ারম্যান, ওঝা-পির-হুজুরের অপচিকিৎসা চলতে থাকে।  ইজ্জত আলীকে খাবার দেওয়া হয় না। পানি দেওয়া হয় না। একপর্যায়ে ইজ্জত আলী মারা যায়। তাকে কবর দেওয়া যাবে না বলে হুজুর ফতোয়া দেয়। কারণ ইজ্জত আলী মানুষ নয়, গরু। ইজ্জতের ছেলে পালোয়ান আক্ষেপ করে – গরু হয়ে থাকলে তার বাবা তো বেঁচে থাকত।
মৃত পিতার লাশ কলার ভেলায় তুলে মশারিতে ঢেকে জলে ভাসিয়ে দেয় পালোয়ান। ভেলার সেই মশারির মধ্যে উঠে বসে গরুটি। এনজিওকর্মী পুলিশ নিয়ে গরু নিয়ে যাওয়ার জন্য ভেলার মশারি খুলে দেখে ইজ্জত আলীর লাশের পাশে বসে মানুষের মতো বইঠা বাইছে তার প্রিয় গাভিটি। অসাধারণ গল্পের বিন্যাস। একজন মানুষের ক্রমে গরু হয়ে যাওয়া এবং গরুও মানুষের মতো আচরণ করার ব্যাপারটি সত্যিই অসাধারণ এবং অত্যাধুনিক। মডার্নিজম, পোস্টমডার্নিজমের কোনো তকমা দেওয়ার দরকার নেই আসাদুজ্জামান দুলালের কাহিনিকে। তাঁর ডিজাইনও সাদামাটা। কোনো সেটের ব্যবহার নেই, সে অর্থে প্রপস, লাইট, মিউজিকের ব্যবহারও নেই। যা আছে কাহিনি ও উপস্থাপনে প্রাণ। অসামান্য এই প্রযোজনাটির নির্দেশক আসাদুজ্জামান দুলাল তাঁর নিজের মতোই নিরাভরণ করেছেন এ প্রযোজনাকে। ব্যক্তি দুলালের যেমন রয়েছে অসাধারণ প্রাণপ্রাচুর্য এবং মানবিক ও সংবেদনশীল দর্শন, এ নাটকেও খুঁজে পাওয়া যায় তা-ই। নাটক শেষে দর্শকরা অনবরত করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানান আসাদুজ্জামাল দুলাল ও সমন্বয় থিয়েটারকে। দর্শকরা যখন জানতে পারেন কুশীলব এবং কলাকুশলীদের পরিচয় তখন শ্রদ্ধায় সবার মাথা অবনত হয়ে যায়। আসাদুজ্জামান দুলাল যাঁদের নিয়ে কাজ করেন তাঁদের কেউ রাজমিস্ত্রি, কেউ কাঠমিস্ত্রি, কেউ কৃষক, কেউ ছোট মুদি দোকানদার। শিক্ষাহীন, সম্পদহীন এসব মানুষকে নিয়ে আসাদুজ্জামান যে স্বপ্ন বুনে চলেছেন, তা সত্যিই অনন্য। আসাদুজ্জামান দুলাল যেন আমাদের মঞ্চের আর একজন হাবিব তানভির। জয়তু আসাদুজ্জামান দুলাল ও সমন্বয় থিয়েটারের কর্মীবৃন্দ।

বহিরাঙ্গনে বাংলার প্রাণের সংস্কৃতি
উৎসবে প্রতিদিন বহিরাঙ্গনের আয়োজন ছিল অত্যন্ত চমকপ্রদ। বাঙালি সংস্কৃতির যে প্রাণপ্রাচুর্য আর বৈচিত্র্য তারই উপস্থাপন ছিল বহিরাঙ্গনে। জারিগান, পালাগান, ঢাকঢোল যুদ্ধ, লাঠিখেলার মতো গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির সমাবেশ ঘটেছিল প্রতিদিন বিকেলে। নাগরিক জীবনে জারিগান বা লাঠিখেলা প্রায় দুর্লভ। মূলধারার দেশি-বিদেশি নাটকের পাশাপাশি এসব দুর্লভ লোকায়ত সংস্কৃতির উপস্থাপনে সফল হয়েছে ‘রঙ্গ হর্ষে বিংশ বর্ষে’ শিরোনামের এই আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব।

Leave a Reply