ফৌ জি য়া খা ন
‘নন্দিনী : রাজা, এইবার সময় হল।
রাজা : কিসের সময়?
নন্দিনী : আমার সমসত্ম শক্তি নিয়ে তোমার সঙ্গে আমার লড়াই।
রাজা : আমার সঙ্গে লড়াই করবে তুমি! তোমাকে যে এই মুহূর্তেই মেরে ফেলতে পারি।
নন্দিনী : তার পর থেকে মুহূর্তে মুহূর্তে আমার সেই মরা তোমাকে মারবে। আমার অস্ত্র নেই, আমার অস্ত্র মৃত্যু।’
রক্তকরবী/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আন্ডার কনস্ট্রাকশনের রয়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নন্দিনী চরিত্রের মহড়া করছে। নন্দিনীর সংকল্পবদ্ধ এই সংলাপের পর ছবি শেষ হয়। কিন্তু ততক্ষণে আমরা জেনে গেছি, এই সংকল্প কেবল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত রক্তকরবীর চরিত্র নন্দিনীর নয় – নন্দিনী চরিত্রে অভিনয় করিয়ে রয়াও একই সংকল্প বুকে নিয়ে আমাদের চোখের আড়াল হয়। আর কোনো সংলাপ নেই – নির্মীয়মাণ বহুতল ভবনে ভরা ঢাকার একটি টপ লং শটে শেষ হয় চলচ্চিত্র আন্ডার কনস্ট্রাকশন (২০১৫)। রুবাইয়াত হোসেন পরিচালিত দ্বিতীয় কাহিনিচিত্র এটি। সমাজে প্রচলিত ধর্ম, আইন, প্রথা এবং সংস্কার – সবই তো আসলে নারীবিরোধী। পুরুষেরই আধিপত্য সমাজে এবং রাষ্ট্রে। নারী এখানে পুরুষের দাসী, যৌনবস্ত্ত, সমত্মান উৎপাদনের যন্ত্র এবং নিম্নলিঙ্গ হিসেবে জীবনযাপন করতে বাধ্য। নিজের ব্যক্তিত্ব, মানমর্যাদা সবকিছু ধূলিসাৎ করে পুরুষের তৈরি নিয়মনীতি অক্ষরে অক্ষরে মেয়েরা পালন করবে – এই সমাজ আসলে তার চেয়ে বেশিকিছু নারীদের কাছে চায় না। সমাজের এই চাওয়াকে চ্যালেঞ্জ করে রুবাইয়াতের আন্ডার কনস্ট্রাকশন।
রয়া – তেত্রিশ বছরের পরিপূর্ণ মানুষ। নারীর শরীরে জীবনও তার নারীরই – বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার বাসিন্দা সে। এই ঢাকা একুশ শতকের প্রথম দশক পেরিয়ে দ্বিতীয় দশকের মধ্যভাগ পার করছে পৃথিবীর বুকে। একুশ শতকের পৃথিবী, জ্ঞানবিজ্ঞানের নিত্য আবিষ্কারের ভারে আলো আর অাঁধারের এক ঘূর্ণিচক্রে পড়েছে। এই পৃথিবীতে পথচলা মানুষেরাও চলেছে এমন গমত্মব্যে – যেখানে ধর্মান্ধ উগ্র জাতীয়তাবাদের হুংকার, করপোরেট পুঁজির দুর্দমনীয় তা-ব আর বিশ্বায়নের ধূম্রজালে অসাম্যের ঘোর অন্ধকার। এই পৃথিবীর মানচিত্রে আছে তৃতীয় বিশ্বের সদ্য নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া বাংলাদেশ। এই দেশের ‘মেয়েমানুষ’ রয়া আন্ডার কনস্ট্রাকশনের প্রধান চরিত্র। আন্ডার কনস্ট্রাকশনে সে মঞ্চ অভিনেত্রী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত রক্তকরবী নাটকের নন্দিনী করছে বারো বছর ধরে।
ঔপনিবেশিক-উত্তর রাজধানী ঢাকা যখন ধর্মান্ধ রাজনৈতিক সহিংসতা আর করপোরেট পুঁজির অপরিকল্পিত বল্গাহীন উলস্নাসে মত্ত তখন এই শহরের বাসিন্দা রয়া নীলকণ্ঠ পাখির পালক বুকে নিয়ে পিতৃতান্ত্রিকতার উন্মাদপ্রায় হিংস্রতার বিপরীতে অভীষ্ট লক্ষক্ষ্য পৌঁছবার জন্যে পথ হাঁটা চালিয়ে যেতে থাকে।
রয়া মধ্যবিত্ত পরিবারের সমত্মান। কোনো এক অভিনেত্রীর প্রেমে মশগুল হয়ে দুই সমত্মানসহ স্ত্রীকে ফেলে গেছে তার বাবা। অনুমান করা যায় (কারণ পরিচালক এ বিষয়ে দর্শককে কিছু জানাননি), রয়ার মা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় তত শিক্ষিত নন। সূচিকর্ম তার পেশা। রয়া উচ্চশিক্ষিত, সংস্কৃতিবান, মুক্তমনা মানুষ। মঞ্চনাটক তার ধ্যান-জ্ঞান, একে ঘিরেই নিজেকে সে বিকশিত করতে চায়। চিমত্মা আর মননে সদা স্বনির্ভর রয়া স্বামীর আয়ে ঢাকা শহরে উচ্চবিত্তের জীবনযাপন করে। তার স্বামী সামির স্থপতি, পেশাজীবী – ভালো স্বামী। অফিসের দু-দুটো মিটিং বাদ দিয়ে নন্দিনী হিসেবে রয়ার শেষ পারফরম্যান্স দেখতে আসে। আঙ্কিক নিয়মে অভ্যসত্ম সামির বড় বেশি নির্লিপ্ত। নিজে থেকে জিজ্ঞেস না করা পর্যমত্ম স্ত্রীর পারফরম্যান্স নিয়ে কোনো মমত্মব্য করে না। এই নির্লিপ্ততা বিছানায়, এমনকি তাদের একামত্ম মুহূর্ত পর্যমত্ম গড়াতে দেখি আমরা। তার বিপরীতে কাজের মেয়ে ময়না রয়াকে নিয়ে বেশি কনসার্নড। রয়ার মন খারাপের খুঁটিনাটি ঠিকই সে বুঝে নেয়। এমনকি হবু স্বামীর হাত ধরে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ও জানাতে ভোলে না, ফ্রিজে রয়ার রাতের খাবার রাখা আছে।
একা মা, নির্লিপ্ত স্বামী, কনসার্নড কাজের মেয়ে, পার্লারে আকস্মিক দেখা হওয়া পুরনো বন্ধু আর সারাক্ষণ দাবিয়ে রাখতে উন্মুখ থিয়েটার গ্রম্নপের দলনেতা রাসেলের সঙ্গে সম্পর্ক ও সম্পর্কহীনতার মধ্য দিয়ে রুবাইয়াত আন্ডার কনস্ট্রাকশনের রয়াকে নির্মাণ করেছেন। রয়া চরিত্রের মধ্য দিয়ে নারীজীবনের কিছু অমীমাংসিত বাসত্মবতা পরিচালক দর্শকের সামনে তুলে ধরেন। কোনো তত্ত্ব নয় – প্রতিদিনের যাপিত জীবনের খুঁটিনাটি নানা ঘটনার ভেতর দিয়ে পরিচালক আমাদের বারবার রয়া, রয়ার মা আর তার কাজের মেয়ে ময়নার নিজের মতো বাঁচার আকাঙক্ষার কথা মনে করিয়ে দেন। আর্থিক-সামাজিক-রাজনৈতিক যে বাসত্মবতায় ঢাকার মানুষের জীবন কাটছে এই সময়ে – রুবাইয়াতের চরিত্রেরা অবধারিতভাবেই সেই বাসত্মবতার ভেতরের মানুষ। তবে এই বাসত্মবতা আন্ডার কনস্ট্রাকশনের মানুষদের জীবনে বিশেষ কোনো ঝড় তোলে না – দূর থেকে আসা হালকা একটা বাতাসের মতন লেপটে থাকে।
আন্ডার কনস্ট্রাকশনের রয়া, তার মা আর কাজের মেয়ে ময়না। আর্থিক সামর্থ্যের বিবেচনায় এরা সমাজের তিনটি পৃথক শ্রেণির মানুষ। তিন শ্রেণির বাসিন্দা হলেও এই দেশে এই সময়ে নারীজীবনের বাসত্মবতা রূপায়ণে তারা তিনজনেই একটা সরলরেখায় উঠে আসে। ব্যক্তি সম্পর্ক, পারিবারিক জীবন আর সমকালীন সমাজে দিনযাপনে তাদের সম্মিলিত অভিজ্ঞতা চিত্রায়ণের মধ্য দিয়ে পরিচালক বাংলাদেশের নারীদের জীবনবাসত্মবতার একটা রূপ যেন অাঁকতে চেয়েছেন। রয়ার মা, রয়া, ময়না – এরা স্বাধীন (!) মানুষ। কিন্তু তারা আশ্চর্যরকমভাবে বিচ্ছিন্ন – সঙ্গের ভিতরে থেকেও নিঃসঙ্গ। স্বামী অন্যত্র সংসার পাতলেও রয়ার মা সংসারের হাল শক্তভাবেই ধরে রেখেছেন। দুই সমত্মানকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন, এ বয়সেও নিজের আয়েই চলেন তিনি। মেয়েদের আয় করার বহু পুরনো এক উপায় সেলাই। এই সেলাই করেই তিনি নিজের এবং তার সেলাইসঙ্গী আরো নারীদের আয়ের পথ করে নিয়েছেন। আর্থিকভাবে স্বনির্ভর, একক জীবনে অভ্যসত্ম এই নারী বাজার-হাট করেন, এমনকি মরণব্যাধিতে আক্রামত্ম হয়ে ঢাকায় রোগ নির্ণয়ের সব ব্যবস্থা শেষে লন্ডন প্রবাসী ছেলের কাছে চিকিৎসার জন্যে যাওয়ার সব আয়োজন তিনি নিজেই করে ফেলেন। মেয়ে রয়া বা মেয়ের জামাই সামিরকে তিনি এ ব্যাপারে বদার করেন না। এমনকি লন্ডন যাওয়ার আগের কয়েকটি দিনও তিনি নিজ বাড়িতেই একা নিজের মতন করে থাকার সিদ্ধামত্ম নেন। লেখাপড়া শিখেও চাকরি না করে জামাইয়ের আয়ে রয়ার নির্ভরতায় তিনি বিরক্ত, থিয়েটারে মেয়ের সম্পৃক্ততায় তার ঘোর আপত্তি। আমাদের সমাজের চোখে অভিনেত্রীরা আসলে ‘বেশ্যা’ কথাটি পেটের মেয়েকে শোনাতে একটুও দ্বিধা করেন না তিনি। নাটক-ফাটক বাদ দিয়ে রয়াকে সমত্মানধারণের পরামর্শ দেন – সংসারে আরো বেশি মনোযোগী হতে বলেন। পোশাকেও তিনি সমাজে নারীর জন্যে নির্ধারিত ‘পর্দা’ মেনে চলেন। হাতকাটা জামা পরে মায়ের বাড়িতে আসায় মেয়েকে তিরস্কার করেন। আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী রয়ার মা নারীদের জন্যে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বেঁধে দেওয়া প্রায় সব রীতিনীতি পালন করেন বিনা প্রশ্নে। কিংবা এ-ও বলা যায়, এসব বিষয় নিয়ে যে সমাজকে প্রশ্ন করা যায় তা তিনি ভাবতেই শেখেননি। এইখানে তিনি পিতৃতান্ত্রিক সমাজের মুখপাত্র হয়ে ওঠেন এবং মেয়ে রয়াকে নানান কথা শোনাতে কসুর করেন না।
পিতৃতান্ত্রিক সমাজ দুটি কাজ নারীর জন্যে অবশ্য পালনীয় বলে নির্ধারণ করেছে – বিয়ে বা ঘর-সংসার এবং সমত্মান ধারণ। রয়ার কাজের মেয়ে ময়না এই দুটি কাজই সানন্দে করছে। নিজের পছন্দে বিয়ে করেছে, সমত্মান নিয়েও তার মনে কোনো দ্বিধা নেই। গৃহকর্মীর কাজ ছেড়ে গার্মেন্টসে চাকরি নেয়। ময়না সাজতে, গয়না পরতে ভালোবাসে। বিয়ে উপলক্ষে রয়া কিছু গয়না তাকে উপহার দেয়। গয়নাগুলো পরে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নিজেকে দেখতে ভালোই লাগে তার। কিন্তু এই উপহার সে নিজের কাছে রাখার ভরসা করে না। স্বামী যে-কোনো সময় গয়নাগুলো কেড়ে নিতে পারে এ শঙ্কা তার মনে। উচ্চবিত্ত বাড়িতে নিশ্চিত থাকা-খাওয়া, আরাম-আয়াশ এবং রয়ার সঙ্গে একধরনের বন্ধুত্ব ছেড়ে এসে ভালোবেসে বিয়ে করা স্বামীকে সে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারে না। কারণ ময়নাদের স্বামীরা যে-কোনো সময় স্ত্রীর গয়না, টাকা বা অন্য সম্পদ কেড়ে নেওয়াকে তাদের অধিকার বলেই জ্ঞান করে! গয়নাগুলো সে রয়ার কাছেই জমা রাখে। পূর্ণ গর্ভকালেও গার্মেন্টসে কঠোর পরিশ্রম করে – অনাগত সমত্মানের একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ সে নিশ্চিতভাবেই চায়।
রয়া উচ্চশিক্ষিত, তার স্বামী সামির খুব ভদ্র, দায়িত্বশীল। চাকরি না করে পুরো সময়টা থিয়েটারের কাজে দেওয়ার মতো আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য সে তার স্ত্রীকে দেয়। রয়াকে সে কখনো মারধর তো দূরের কথা, বকাঝকাও করে না। তবে বাইরে থেকে দুজনে একসঙ্গে ফিরে তোয়ালে দেওয়ার জন্যে স্ত্রীকেই ডাকে সে। ট্যুরে যাওয়ার সময় নিজের অনুশীলন থামিয়ে রয়াকেই তার স্যুটকেস গুছিয়ে দিতে হয়। রয়া যখন রক্তকরবী পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে আত্মমগ্ন হয়ে কাজ করে এবং কাজের লোকের অভাবে স্বামীর পাতে রেডিমেড গস্নাস-নুড্লস তুলে দেয় – সামিরের সেটা ভালো লাগে না। খেতে বসে রূঢ় স্বরে রয়ার অতি ভদ্র স্বামী সামির বলেই বসে : ‘আর কতদিন এসব খেয়ে থাকব? একটা রান্নার লোক দেখো।’ দায়িত্বশীল, কর্তব্যপরায়ণ স্বামী সামির ট্যুরে যাওয়ার সময় স্ত্রীর জন্যে চেক লিখে রেখে যেতে ভোলে না – কিন্তু রক্তকরবী পরিচালনা নিয়ে রয়ার আত্মমগ্ন অনুশীলন মেনে নিতে কষ্ট হয় তার। সামনে নিয়ে আসে ঘর সামলানোতে নারীর তথাগত ভূমিকা আর বাচ্চা নেওয়ার পরিকল্পনা। স্বাধীন রয়া এখানে এসে আসলে পরাধীন হয়ে যায়, যখন দেখি দাম্পত্য জীবনে যে বিষয়গুলো পারস্পরিক আলাপ-আলোচনায় স্থির করার কথা, সেসব সিদ্ধামত্ম সামির নিজেই নিয়ে নেয়। এমনকি ঘর সাজানোতে কম্পোজিশনের ভারসাম্য নষ্ট হয় বলে রয়ার রাখা একটি ফ্লাওয়ার ভাস নির্দ্বিধায় সরিয়ে নিতে বলে সে! ফলে আন্ডার কনস্ট্রাকশনে রুবাইয়াতের স্বাধীন তিন নারী আসলে এই সমাজের অধসত্মন সত্তা – ‘দ্য আদার’ সিমন দ্য ব্যুভেয়ার যাদের ‘সেকেন্ড সেক্স’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন।
তবে আশার কথা এই যে, রুবাইয়াত তাঁর ছবিতে সমাজের এই ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’কে পর্দায় উপস্থাপন করতে গিয়ে নিজের অবস্থান খুব স্পষ্ট করেছেন। সুন্দর, ছোট্ট একটি চলচ্চিত্রিক কৌশল তিনি ব্যবহার করেছেন, যা আবার ময়না চরিত্র চিত্রণেও অমোঘভাবে কাজ করেছে। ময়না যতদিন রয়ার বাড়িতে ছিল – কাজের ফাঁকে প্রায় পুরোটা সময় সে টিভি দেখত। তার চোখ অবধারিতভাবেই হিন্দি ফিল্ম দেখানো চ্যানেলগুলোতে। তাবৎ বিশ্বে মূলধারার ছবিতে নারী পুরুষের কামনার বস্ত্ত, কাম উপশমের বাহনমাত্র। বলিউডের সিনেমাও তার ব্যতিক্রম নয়। সদ্য প্রেমে পড়া কিশোরী ময়নার আগ্রহ ইরোটিসিজমে ভরপুর হিন্দি ফিল্মে। ময়নার দেখা কয়েকটি ফিল্মের গান দৃশ্যায়নের অংশবিশেষ রুবাইয়াত তাঁর দর্শকদের দেখান; আমরা দেখি কাম উত্তেজনায় আর্দ্র পুরুষের কামনা নিবৃত্তির ‘বস্ত্ত’ হিসেবে নারীদেহ সেইসব দৃশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে। শত বছরের বেশি সময় ধরে চলচ্চিত্র-ব্যবসায় পুঁজি ফেরত আনার অন্যতম কাঁচামাল ‘নারীদেহ’ ব্যবহারের বিপরীত মেরুতে নিজের অবস্থান নির্মাতা হিসেবে রুবাইয়াত আমাদের জানিয়ে দেন। আন্ডার কনস্ট্রাকশনে প্রেম আছে, আছে অবদমিত প্রেম এবং কাম। এই কাম নারীর – দেহ সম্ভোগের আকাঙক্ষা এখানে সাবজেক্টিভ; জীবন ও সম্পর্কের এক অনিবার্য মেলবন্ধন। রয়ার বোরকা-পরা মায়ের অমত্মর্বাসকেও পর্দায় জায়গা দিয়েছেন পরিচালক। দর্শককে সুড়সুড়ি দেওয়ার জন্যে নয় – নারীদের নিত্য পরিধেয় হিসেবেই তিনি আন্ডারগার্মেন্টস দেখান স্বাভাবিকভাবে, স্বচ্ছন্দে। জীবনের অবিচ্ছেদ্য বিষয় হিসেবেই দেহ প্রসঙ্গ আনেন তিনি। এই ছবিতে ময়না স্বপ্নে বারবার সাপ দেখে। প্রেমে কাতর ময়নার পিরিয়ড বন্ধ চার মাস ধরে – সরাসরি এই কথা সে গৃহকর্ত্রী রয়াকে জানাতে পারে না। নিরুপায় ময়নার স্বপ্নে তখন সাপেরা হানা দেয় বারবার। রয়ার স্বপ্নেও আসে সাপ – সামির যখন দেশের বাইরে তখন গর্ভবতী গৃহকর্ত্রী ময়নাকে নিয়ে মানসিক চাপে বিপর্যসত্ম রয়া মায়ের কাছে ছুটে যায়, দিনদুপুরে ঘুমের মধ্যে বিশাল এক অজগর স্বপ্নে তার শয্যাসঙ্গী। বাসত্মবতার ন্যারেটিভে নির্মিত আন্ডার কনস্ট্রাকশনে স্বপ্নে দেখা সাপের এই ব্যবহারে আমাদের মনে পড়ে ফ্রয়েডকে। আমরা জানি, মনঃসমীক্ষক ফ্রয়েড স্বপেণ সাপ দেখাকে অবদমিত কামের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। ফ্রয়েডকে আরো একবার মনে পড়ে আমাদের। রয়া আর সামির যেদিন রয়ার মায়ের বাড়িতে রাতের খাবার খায়। মাথা ঢেকে রাখা সামিরের শাশুড়ি সেদিন বেশ যত্ন নিয়ে শাড়ি পরেন, স্বামীর প্রিয় পুডিং রান্না করেন মেয়েজামাইয়ের জন্যে। ছেড়ে গেছেন যে স্বামী তাঁর স্মৃতিচারণায় রয়ার গম্ভীর মা মেয়েজামাইয়ের কাছে প্রগলভ হয়ে পড়েন! এই দৃশ্যের পরিকল্পনায় ফ্রয়েড কোনোভাবে আন্ডার কনস্ট্রাকশনের পরিচালককে উদ্বুদ্ধ করেছে কি? এসব প্রশ্ন মনে এলেও এ-কথা আমাদের মানতেই হবে, শরীর, সম্পর্ক, কাম, প্রেম এবং নারীদেহ উপস্থাপনায় এই ছবির পরিচালক সাবজেক্টিভ – তাঁর নারী চরিত্রেরা কোনোভাবেই পুরুষের কাম, প্রেম আর ইচ্ছে পূরণের ‘অবজেক্ট বা বস্ত্তমাত্র’ নয়।
থিয়েটার অ্যাক্টিভিস্ট রয়া চরিত্র নির্মাণে পরিচালকের নারীবাদী অধ্যয়ন গূঢ় প্রভাব রেখেছে। তিনি সহায় হিসেবে বেছে নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত রক্তকরবী নাটকের টেক্সট। রক্তকরবীর আখ্যান যক্ষপুরী নামের এক নগর। এই নগরে শ্রমিকেরা মাটির তলা খুঁড়ে সোনা তোলার কাজে ব্যসত্ম। এখানকার রাজা জটিল আবরণের আড়ালে প্রাসাদে স্বেচ্ছাবন্দি। জালের আবরণে ঢাকা এই নগরে নন্দিনী এক ঝলক আশার আলো। ইট-কাঠ-পাথর আর জঞ্জালের খাঁচায় বন্দি নগরী যক্ষপুরীতে নন্দিনী আনন্দ প্রেম আর জীবনের(!) প্রতিরূপ। যক্ষপুরীর পুরুষেরা নিজেদের রচিত কারাগার ভাঙার প্রেরণা নিতে চায় নন্দিনীর নারীশক্তিকে ভর করে। নন্দিনী অপর পুরুষের জীবনে আনন্দ রসের সুধাপাত্র মাত্র। সমাজ যে সুন্দরী উর্বরা যৌবনবতী নারীকে আকাঙক্ষা করে তারই প্রতীক রক্তকরবীর নন্দিনী। তার নিজের কোনো চাওয়া নেই – অপরের অকাজের প্রয়োজন মেটাতে তার প্রয়োজন। রয়ার কাছে রবীন্দ্রনাথের নন্দিনী কবির অাঁকা পুরুষের চোখে দেখা নিখুঁত কাল্পনিক এক নারী। আর এখানেই তার আপত্তি। রয়া তার চারপাশে দেখা বাসত্মব নারীদের সঙ্গে নন্দিনীকে মেলাতে পারে না। একুশ শতকের বিশ্ব পরিবারে বেড়ে ওঠা রয়া নন্দিনীদেরকে ভিক্টোরীয় মূর্তিতে আর দেখতে চায় না। পুঁজির পেছনে বল্গাহীন উন্মাদনায় ছুটে চলা ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মানুষ আর মানুষ নেই – মানুষ এখানে বস্ত্ত উৎপাদনের হাতিয়ার বিশেষ; মানুষকে যন্ত্রবিশেষ করে তোলার যজ্ঞে চালকের আসনে বসে আছে তাবৎ বিশ্বের পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা – সমকালীন এই বাসত্মবতাকে তুলে ধরতে রুবাইয়াত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রক্তকরবীকে অমোঘ অস্ত্র করেছেন। আন্ডার কনস্ট্রাকশনের আখ্যানে রক্তকরবীর যক্ষপুরী সমসাময়িক বাংলাদেশের গার্মেন্টসশিল্প। রক্তকরবীতে যক্ষপুরীর সুড়ঙ্গের ডালা খুলে বন্দি রাজাকে মুক্ত করার স্বপ্ন দেখে নন্দিনী – অন্ধকার সরিয়ে আলোর বন্যায় ভাসিয়ে নিতে চায় সে, পাকা ফসলের মাঠ থেকে ভেসে আসা গানে মাতোয়ারা হয়ে বদ্ধঘরের দুয়ার ভেঙে সোনা রোদ আর মাতাল হাওয়ার মাঠে রাজাকে নিয়ে এসে মুক্ত শ্বাস নিতে চায়, ‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে আয় রে তোরা আয়’। রক্তকরবীর নন্দিনী মুক্তির দূত। রয়ার নন্দিনী তাই করপোরেট গার্মেন্টসের শিল্পে যন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত প্রতিবাদী গার্মেন্টস কর্মী। রক্তকরবী থেকে মুক্তির প্রেরণা আন্ডার কনস্ট্রাকশনের কাহিনিতে যোগ করে নারীবাদী রুবাইয়াত তাঁর চরিত্রগুলোকে ক্রমপরিণতির দিকে নিয়ে যান দৃঢ় পায়ে।
রয়ার মা যেমন, তেমনি তার দলনেতা রাসেল আন্ডার কনস্ট্রাকশন ছবিতে পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার একজন প্রতিনিধি। আন্ডার কনস্ট্রাকশনে রয়া বারো বছর ধরে সফলভাবে নন্দিনী চরিত্রে অভিনয় করে আসছে। দলপ্রধান রাসেল দলে নতুন আসা অল্পবয়সী মেহজাবীনকে নন্দিনী চরিত্রে রয়ার রিপেস্নস করেন। ঠিক এ সময়ে বাংলাদেশি কিউরেটর ইমতিয়াজ আসে। ইমতিয়াজ বাংলাদেশের মঞ্চনাটককে একটা ইউরোপীয় থিয়েটার ফেস্টিভ্যালে নিয়ে যেতে চায়। ওর আগ্রহ রয়াদের দলের রক্তকরবীতে। সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে রক্তকরবীকে ইউরোপীয় দর্শকের কাছে বছরব্যাপী উপস্থাপন করতে চায় ইমতিয়াজ। এই ঘটনাকে ঘিরে রয়া চরিত্রের মূল কনফ্লিক্ট দানা বেঁধে উঠতে দেখা যায়। আমত্মর্জাতিক অঙ্গনে দলীয় পরিবেশনার এ সুযোগ দলের জন্যে বিশাল প্রাপ্তি। ১৯২৬ সালে লেখা রক্তকরবীতে রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্য সভ্যতায় মানুষের ওপর যন্ত্রসভ্যতা কীভাবে আধিপত্য বিসত্মার করে তার কঠোর সমালোচনা করেছেন প্রতীক আর রূপকের আড়ালে। যন্ত্রের কারাগারে বন্দি পুরুষের জীবনে নারীরূপী নন্দিনী মুক্তি, আনন্দ, প্রেম আর প্রকৃতির প্রতিরূপ। রাসেল রবীন্দ্রনাথের দেখানো পথেই হাঁটতে চান। কিন্তু কিউরেটর ইমতিয়াজ সমসাময়িক পটভূমিতে রক্তকরবীর নতুন উপস্থাপনা চান। দলপ্রধান রাসেলের এখানে আপত্তি। ইউরোপের নাট্যমঞ্চে রক্তকরবীর মঞ্চায়ন দলের জন্যে একটি সুযোগ। কাজেই সমসাময়িক বাসত্মবতায় রক্তকরবী মঞ্চায়নে ইমতিয়াজের আগ্রহ বাতিল করতে পারেন না রাসেল। ইউরোপীয় সংস্করণ পরিচালনার দায়িত্ব পায় রয়া। অভিনয় এবং পরিচালনা দুটি ক্ষেত্রেই রয়া রক্তকরবীর প্রযোজনায় আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসে। রয়ার কাছে রক্তকরবী একটা সংঘর্ষ – জীবন আর মৃত্যুর, ভাব আর অভাবের। নন্দিনী আর রঞ্জনের প্রতি তার প্রেম – এই দুই-ই হলো জীবন। নন্দিনী বহমান জীবন। নন্দিনী আর রঞ্জনের প্রতি তার প্রেম জঞ্জাল, কংক্রিট আর লোহার গরাদের মধ্যে ফুটে থাকা রক্তকরবী ফুলটার মতো। রয়া তাই রক্তকরবীকে সমকালীন একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির প্রেক্ষাপটে নিয়ে আসে। এখানে নন্দিনী অমত্মঃসত্ত্বা গার্মেন্টসকর্মী। এই ফ্যাক্টরিতে মানুষ আর যন্ত্র একসঙ্গে বাস করে। মানুষগুলো যেন ধীরে ধীরে যন্ত্রে পরিণত হয়। রয়ার নন্দিনী এটা চায় না। ও বাচ্চাকে জন্ম দিতে চায়, বাঁচিয়ে রাখতে চায়। রয়ার রক্তকরবীতে রঞ্জন তাই কোনো প্রেমিক নয়, সে জন্ম না নেওয়া শিশু – সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ এক জীবন যা বিপুল সম্ভাবনায় বিকশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে। রক্তকরবীর যক্ষপুরী তার প্রযোজনায় হয়ে ওঠে যাপিত জীবনে দেখা তিন হাজারের বেশি কর্মী নিয়ে ধসেপড়া গার্মেন্টস রানা পস্নাজা। তার রক্তকরবীতে নন্দিনী যৌবনবতী উর্বরা কাল্পনিক কোনো নারী নয় – তারই বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়ে গার্মেন্টসের কাজে ঢোকা গৃহকর্মী গর্ভবতী ময়নার আদলে নন্দিনীকে নতুনরূপে উপস্থাপনের চ্যালেঞ্জ নেয়।
দলপ্রধান রাসেল থিয়েটারের মেয়েদের অভিনয়কর্মী হিসেবেই দেখতে অভ্যসত্ম। রক্তকরবীর পরিচালক হিসেবে রয়ার দক্ষতা নিয়ে সন্দিহান সে, যে-কোনো সুযোগে রয়াকে অপদস্থ করতে কসুর করে না। রাসেল, নারী যার জীবন ও মননে অধসত্মন সত্তা বৈ অন্য কিছু নয় – সে অমোঘ গলায় তাই বলে ওঠে : ‘আমি জানি তুমি কতটা ভাবতে পারো আর কতটা ভেলিভার করতে পারো! কাজটা শুরু করার আগে একবার নতুন করে চিমত্মা করো আসলেই তুমি কাজটা করতে চাও? মানে সংসার ফেলে রেখে পেস্নটা নিয়ে এক বছর তুমি ট্রাভেল করতে পারবে?’ এ প্রশ্নের উত্তর রয়ার কাছে খুব স্পষ্ট। থিয়েটার-জীবনে প্রথমবারের মতো পাওয়া বড় এ সুযোগটি কোনোভাবেই সে হাতছাড়া করতে চায় না। সমকালীন প্রেক্ষাপটে নিজের ইন্টারপ্রিটেশনে ইউরোপের নাট্যমঞ্চে রক্তকরবী উপস্থাপন করে থিয়েটারকর্মী হিসেবে তার রাজনৈতিক বোঝাপড়ারও একটা প্রকাশ সে দেখতে চায়। এ কাজে সক্ষমতার পুরোটা নিয়ে সে চেষ্টা করতে চায়।
রক্তকরবীর কাজে দলনেতা রাসেল নানাভাবে রয়াকে নিরুৎসাহিত করে; ঘরে তার স্বামী সামিরকেও রয়ার এই অর্জনে সুখী দেখি না। সামির বাবা হতে চায়। স্থাপত্যের আঙ্কিক নিয়মে জীবন ও সম্পর্ককে যে চালনা করে তার কাছে রয়ার থিয়েটার চর্চা খুব বেশি গুরুত্ব বহন করে না। বাংলাদেশে থিয়েটার চর্চা এখনো আয়মূলক কোনো কাজ নয়। থিয়েটারে অভিনয় কিংবা পরচালনা পুঁজিবাদী নব্য ধনতান্ত্রিক সমাজের কাছে কোনো গুরুত্ব বহন করে না। ফলে করপোরেট পুঁজির মানুষ সামির থিয়েটার নিয়ে স্ত্রীর এত আকুলতা দেখতে তাই নারাজ। সমত্মান ধারণ করা নিয়ে রয়া ঠিক এই সময় কী ভাবছে সেটা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত স্বামী সামির একবার জিজ্ঞেস করারও প্রয়োজন মনে করে না। রয়া দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কাজের ক্ষেত্রে প্রথমবার পাওয়া বড় একটি সুযোগ সে হারাতে চায় না। সমত্মান ধারণের পরিকল্পনা থেকে সে আপাতত পিছিয়ে আসে। বিষয়টি জেনে অতি ভদ্র প্রায় রোবোটিক নির্লিপ্ত সামির প্রথমবারের মতো কটু স্বরে বলে বসে : ‘তেত্রিশ বছর বয়স হয়ে গেছে, পরিপূর্ণ একজন মহিলা। যখন-তখন মাইন্ড চেঞ্জ করার সময় তোমার নেই, রয়া।’
সামিরের মুখে এ সংলাপটি দিয়ে পরিচালক রুবাইয়াত খুব বড় করে সামনে নিয়ে আসেন ঘরসংসার আর সমত্মান ধারণে নারীর ভূমিকার প্রসঙ্গটি। পুরুষপ্রধান সমাজে যে-কোনো কাজ করতে হলে নারীকে তার ঘরের ষোলোআনা দাবি মিটিয়েই করতে হয়। নারীর আয়মূলক কাজের বেলায় সমাজ কিছুটা হলেও অভিযোজন করে। কিন্তু টাকা পাবে না এমন কাজ তাও আবার সৃষ্টিশীল কাজে যুক্ত হতে চাইলে কতগুলো নির্মম বাসত্মবতার মুখোমুখি নারীদের হতে হয়। সমত্মানের জন্মদান এমনই এক বাসত্মবতা যখন নিজের শরীর ও অসিত্মত্বের প্রায় পুরোটা দেবার বিষয় সামনে আসে। মানুষের জীবনে তিরিশ থেকে চলিস্নশ বছর বয়সের সময়টা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ের মধ্যে পেশা ও সঙ্গী নির্বাচন, সম্পর্ক এবং অন্য সকল কাজ গুছিয়ে একটা কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে হয়। জীবনের বাকি সময়টা নিজের তৈরি করা এই কাঠামোটা টিকিয়ে রাখার কাজটাই প্রধান হয়ে ওঠে। বিবাহিত রয়া সমত্মান ধারণের ভাবনা আরো কিছুদিনের জন্যে স্থগিত রাখতে চায়। কারণ থিয়েটারের কাজে নিজের চিন্তা ও আদর্শের সৃজনশীল প্রকাশের ভেতর দিয়ে আত্ম-অবয়ব নির্মাণ এবং পুনর্নির্মাণ করতে চায় সে। রয়া, এই প্রথমবার থিয়েটারে পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে। এ কাজের ব্যাপারে প্যাশনেট সে – পূর্ণ পেশাদারি মনোযোগের সঙ্গে কাজটি করতে চায়। লন্ডনে তার ভাই আছে, মা সেখানে। সামির একজন দায়িত্বশীল স্বামী, অসুস্থ মায়ের সঙ্গে লন্ডনে যাওয়ার জন্যে রয়ার বিমান টিকিট বুকিং দিয়ে ফেলে – ওকে জিজ্ঞেস না করেই। মায়ের জন্যে রয়ার ভালোবাসার কমতি নেই – কিন্তু ওই সময়েই ইউরোপে ওর পরিচালনায় রক্তকরবীর প্রথম শো। এটা করা তার দায়িত্ব। এই গুরুদায়িত্ব পালনে এই সময় পিছিয়ে আসার আর কোনো সুযোগ রয়ার নেই। এমন একটা সুযোগ এবারই প্রথম তার হাতে এসেছে। এটা সে হাতছাড়া করতে চায় না। আর চায় না বলেই মরণব্যাধিতে আক্রামত্ম মা যখন চিকিৎসার জন্যে লন্ডন যাবেন – তখনো সে মায়ের সঙ্গে না যাওয়ারই সিদ্ধামত্ম নেয়। ব্যাপারটা সামিরের কাছে স্বার্থপরতার চূড়ামত্ম মনে হয়। নারীর জন্যে বড় কঠিন, নির্মম জীবনের এই অনিবার্য মুহূর্তগুলো। সে কি স্বার্থপর হবে – নাকি মেয়েদের জন্যে অবধারিতভাবে নির্ধারিত প্রজননের দায়িত্ব মুখ বুজে হাসিমুখে পালন করবে? একুশ শতকের দীক্ষায় দীক্ষিত নারীদের এর সহজ কোনো উত্তর জানা নেই সম্ভবত। রুবাইয়াতের রয়ার কাছেও নেই। তাই বলা যায়, আন্ডার কনস্ট্রাকশনের চিত্রনাট্যে রয়ার সিচুয়েশনে যদি সামির থাকত তবে পরিচালক এই সংলাপ রয়ার মুখে আরোপ করতে পারতেন না নিশ্চিত : sometimes, you are so selfish, Semeer!
আসলে রুবাইয়াতের ছবিতে আমরা নারীর চোখে চিত্রিত নারীর জীবন দেখি। উইমেন স্টাডিজের শিক্ষার্থী রুবাইয়াত তত্ত্বের আলোয় আন্ডার কনস্ট্রাকশনের চরিত্রগুলো নির্মাণ করেননি। বরং তিনি এমন একটি গল্প নির্বাচন করেন যে গল্পের নারী চরিত্ররা বারবারই দর্শককে মনে করিয়ে দেয় দেখো, আমি কিন্তু মানুষ। চরিত্রগুলোকে তিনি আমাদের অতিপরিচিত জীবনচিত্রের পটে এঁকেছেন – এদের যাপিত জীবনে খুব অনাড়ম্বর, স্বতঃস্ফূর্ত, প্রায় শব্দহীন স্বরে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর দিনযাপনের বাসত্মবতার কথা জানান। পরিচালক রুবাইয়াতের এই প্রকল্পে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রক্তকরবী হয়ে উঠেছে তাঁর অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। রুবাইয়াতের রয়া রবীন্দ্রনাথের কাল্পনিক নন্দিনীকে অস্বীকার করে, নিরেট নিরবকাশ গর্তের পতঙ্গ হয়ে ঘন কাজের মধ্যে সেঁধিয়ে থাকা যক্ষপুরীতে অকাজের প্রয়োজনে নন্দিনীকে সে আর সীমায়িত করে রাখতে চায় না। আনন্দ আর প্রেমের প্রতিরূপ ভাবের জগতের নন্দিনীকে রয়া তার চেনা পৃথিবীর ময়নারূপে অাঁকার বন্ধুর পথে নেমে দলপ্রধান রাসেলের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ-ঈর্ষা-হেনসত্মার মুখোমুখি হয়। স্বামী সামিরকেও পাশে পায় না। রক্তকরবীর রি-রিডিং নন্দিনীকে নতুনরূপে দেখার চেষ্টা আন্ডার কনস্ট্রাকশনের দুর্দমনীয় অভিযাত্রাকে প্রতীকীভাবে সমালোচনা করেছিলেন। রুবাইয়াত ধসেপড়া গার্মেন্টসের পটভূমিতে নন্দিনীকে গর্ভবতী পোশাক শ্রমিকের রূপে উপস্থাপন করে করপোরেট পুঁজির কাছে জিম্মি পোশাকশিল্প শ্রমিকের প্রাণনাশের সমালোচনা করেন। এরই ফোকর দিয়ে উঠে আসে অপরিকল্পিত নগর উন্নয়ন – রয়ার চারপাশে আকাশ আর বাতাসের পথ রুদ্ধ করে গড়ে উঠতে থাকা বহুতল ভবনের ঢাকা। এই ঢাকায় রয়ারা যেমন হাজার বছরের পিতৃতান্ত্রিকতায় ধ্বসত্ম, ঠিক একইভাবে শঙ্কিত মুক্তচিমত্মার হমত্মারক গোড়া মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক চেতনার প্রসারেও।
নির্মীয়মাণ বহুতল ভবন, পত্রিকার পাতায় উঠে আসা নারীদের নিপীড়িত জীবন, ধসেপড়া গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি রানা পস্নাজা – এ সবকিছু মিলিয়ে আন্ডার কনস্ট্রাকশন হয়ে ওঠে সমসাময়িক জীবনের এক বিশ্বাসযোগ্য ভাষ্য। চলচ্চিত্র ভাষার ব্যবহারে রুবাইয়াত প্রায় দেড়শো বছরের পুরনো এই শিল্পমাধ্যমে পূর্বসূরিদের দেখানো পথেই হেঁটেছেন। সেই হাঁটায় তিনি দৃঢ়ভাবেই পা ফেলতে পেরেছেন বলে মনে হয়। তিন বছর আগে ঢাকার সাভারে রানা পস্নাজা ধসে পড়েছিল। তৃতীয় বিশ্বের গরিব একটি দেশে তিন হাজারের বেশি মানুষ নিয়ে ধসেপড়া রানা পস্নাজা হঠাৎ করেই আমত্মর্জাতিক গণমাধ্যমে বেশ কিছুদিন আমাদের জায়গা করে দিয়েছিল। সে কারণেই কি আন্ডার কনস্ট্রাকশনের রয়া রক্তকরবীকে ইউরোপের দর্শকের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্যে রানা পস্নাজার ধসকে প্রয়োজনের চেয়েও একটু বেশি করেই পর্দায় নিয়ে আসে? এই প্রশ্নের উত্তর যা-ই হোক না কেন রক্তকরবীতে রূদ্ধমানবতার প্রতীক রাজার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নন্দিনীর একমাত্র অস্ত্র – মৃত্যুর সংকল্প। আবার নারী আর পুরুষের সাম্যহীনতার এ পৃথিবীতে ঘাত আর প্রতিঘাতে প্রতিমুহূর্তে নতুন করে নিজেকে বাঁচিয়ে তোলার ব্রতে ব্রতী আন্ডার কনস্ট্রাকশনের রয়া। পিতৃতন্ত্রের কারাগারে থেকেই সমসত্ম শক্তি দিয়ে এর বিরুদ্ধে লড়ার এক অনুচ্চারিত প্রত্যয় বুকে নিয়ে দর্শকের সামনে থেকে নির্মীয়মাণ শহর ঢাকার বুকে লীন হয় সে। রয়া চরিত্রের রূপকার আন্ডার কনস্ট্রাকশনের পরিচালক রুবাইয়াত হোসেনও পুরুষের পৃথিবীতে নারীর চলচ্চিত্র নির্মাণের পথে চলার লড়াই চালিয়ে যাবেন আশা করি।