জা কি র হো সে ন রা জু
তারেক মাসুদ সাধারণ জীবন-যাপন করেননি। তিনি যে জীবন বেছে নিয়েছিলেন, তা ছিল একসঙ্গে যোদ্ধার এবং প্রেমিকের।
সিনেমার জন্যে, তিনি সিনেমার মতোই জীবন-যাপন করেছেন। সিনেমায় আমরা যেমনটা দেখি – ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ চরিত্র ও ঘটনা, যুদ্ধ ও প্রেম – যেমনটি বাস্তব দুনিয়ায় ঘটে না, তারেক মাসুদ তেমন জীবনচর্চায় বিশ্বাসী ছিলেন। চলচ্চিত্রের চারকোনা পর্দাকে ভালোবেসে তিনি যেন এক সরলরৈখিক প্রেমের ও লড়াইয়ের জীবন বেছে নিয়েছিলেন। ধার্মিকেরা যেমন তাঁদের ‘কেবলা’ বা মোক্ষ বেছে নেন এবং জীবন কাটিয়ে দেন সেদিকে লক্ষ করে, তারেক তরুণ বয়সেই সেটি ঠিক করে নিয়েছিলেন – তিনি সিনেমার পর্দায় মানুষের গল্প বলবেন। শুনতে যেমন সহজ শোনাচ্ছে, এ কিন্তু তা নয় – এ ছিল তাঁর এক কঠিন পথ। চলচ্চিত্রের আয়ত পর্দাকে ভালোবেসে জীবন-যাপন করেছিলেন তিনি, অর্থ-সম্পদ, পরিবার, প্রতিষ্ঠা সবকিছু ছেড়ে এদেশে সিনেমার বিকাশের জন্যে লড়েছেন। এ লড়াইয়ের রূপটা কেমন ছিল, তার সুলুকসন্ধান করাই আমার এ-লেখার উদ্দেশ্য।
তারেক মাসুদ ও তাঁর জীবন-কর্ম নিয়ে আজকে আমাদের আলোচনা করতে হচ্ছে এক মর্মান্তিক ঘটনার ‘আফটারম্যাথ’ (Aftermath) ) হিসেবে। ১৩ আগস্ট ২০১১ দুপুর সাড়ে বারোটায় মানিকগঞ্জের কাছে একটি সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের অনেকের জীবন পালটে দিয়েছে। তারেক মাসুদ আমার অগ্রজ বন্ধু ছিলেন, ছিলেন এক ঐকান্তিক সুহৃদ। সেই কৈশোর থেকে সিনেমার প্রেমে পড়ে যে বন্ধুর পথ হেঁটে চলেছি, সে-পথে বুদ্ধি, পরামর্শ, সহযোগিতা দিয়ে আমাকে ব্যক্তিগতভাবে সমৃদ্ধ করেছেন যে ক’জন অগ্রজ সহযাত্রী, তারেক মাসুদ ছিলেন তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। সেজন্যে তারেক মাসুদের ওপর লেখা আমার জন্যে খুব সহজসাধ্য নয়, বিশেষত এ-সময়ে – যখন প্রায়ই, আধো-ঘুমে, আধো-জাগরণে আমি তাঁকে, তাঁর উপস্থিতি অনুভব করি!
তারেক মাসুদের ছবি নিয়ে এর আগে যে কটা নিবন্ধ-প্রবন্ধ লিখেছি Ñ মূলত ইংরেজিতে – আবশ্যিকভাবে সে লেখাগুলোর প্রথম পাঠক ছিলেন তিনি নিজেই। আমার কোনো কোনো মন্তব্যে বা বিশ্লেষণে ভিন্নমত পোষণ করলেও কখনো সেসব প্রকাশে তিনি দ্বিরুক্তি করেননি; আজকে যখন লিখছি তখনো মনে হচ্ছে এ লেখা কি তিনি দূর থেকে পড়ছেন!
ফিরে যাই তারেক মাসুদের লড়াই প্রসঙ্গে। আমি জানি যে আরো অনেকদিন, আমরা অনেকে মিলে তাঁর লড়াই, তাঁর কীর্তি ও কৃতিত্ব নিয়ে কথা বলে যাব। সেদিক থেকে এ-লেখা একটি প্রাথমিক খসড়া।
এখানে তারেক মাসুদের সিনেমা ও দর্শনকে আমি কীভাবে দেখি তার একটি রূপরেখা সূচনা করার চেষ্টা করছি। এ সূচনাকে আমি দুটি পর্বে উপস্থাপন করব। প্রথম পর্বে আমি তাঁর চারটি ছবি – সোনার বেড়ী (১৯৮৫), মুক্তির গান (১৯৯৫), মাটির ময়না (২০০২) ও অন্তর্যাত্রা (২০০৬) নিয়ে নাতিদীর্ঘ বিশ্লেষণ করব। দ্বিতীয় পর্বে আমি কিছু প্রস্তাবনা উত্থাপন করব তাঁর জীবন ও সিনেমার (তাঁর জন্যে যা ছিল সমার্থক) চর্চা বিষয়ে।
পর্ব এক : যে-জীবন সিনেমার
তারেক মাসুদ চলচ্চিত্র নির্মাণে ব্রতী হন ১৯৮০-র দশকের গোড়ার দিকে। ১৯৮২ থেকে ২০১১ পর্যন্ত তাঁর ছবি তৈরির (ও প্রদর্শনের) ‘ক্যারিয়ার’ ব্যাপ্ত ছিল প্রায় তিন দশকজুড়ে। আমি যে চারটি ছবির আলোচনা এখানে উপস্থিত করছি, সেগুলো বিভিন্নভাবে তাঁর চলচ্চিত্র-জীবনের বাঁকগুলোকে চিহ্নিত করেছে। একই সঙ্গে সিনেমাকে তিনি কত বিচিত্ররূপে অনুভব করেছেন ও তা জানাতে চেয়েছেন আমাদের সবাইকে, তার উদাহরণও এ ছবি চারটি। ভিএইচএস (হোম ভিডিও), ১৬ মি.মি., ডিজিটাল ভিডিও এবং ৩৫ মি.মি. – ছবি তৈরির চারটি ভিন্ন ফরম্যাটতিনি যাচাই করেছেন এ ছবিগুলোতে।১. সোনার বেড়ী (১৯৮৫)
স্বল্পদৈর্ঘ্যরে এ প্রামাণ্যচিত্রটি তারেক মাসুদের প্রথম চলচ্চিত্র। আশির দশকের মাঝামাঝি, অ-প্রাতিষ্ঠানিক কাজে ব্যবহৃত নন-প্রফেশনাল ভিডিও মাধ্যম ‘ভিএইচএসে’ তিনি ছবিটি নির্মাণ করেন। এর আগে ১৯৮২ সালে তিনি শিল্পী এস এম সুলতানের ওপর প্রামাণ্যচিত্র আদম সুরতের কাজ শুরু করেছেন, যেটি তিনি শেষ করেন সাত বছর পর, ১৯৮৯ সালে। প্রামাণ্যচিত্র হওয়ার কারণে সোনার বেড়ী ও আদম সুরত দর্শকের মাঝে খুব বেশি প্রদর্শিত হয়নি। খুব ব্যাপক জনপ্রিয়তাও পাননি তারেক মাসুদ এ ছবি দুটি দিয়ে, যা তিনি লাভ করেন ১৯৯৫ সালে নির্মিত মুক্তির গান ছবির মধ্য দিয়ে।
তারেক মাসুদের পরিণত পর্যায়ের চলচ্চিত্রের সাফল্যের আঁচে সোনার বেড়ী নামের স্বল্প বাজেটে নির্মিত তিরিশ মিনিট দৈর্ঘ্যরে ছবিটি যেন হারাতে বসেছে। এ-ছবিতে সমকালীন বাংলাদেশের নারীদের অবস্থান তুলে ধরেছেন তারেক তাঁর দৃষ্টিকোণ থেকে। বহু বছর ধরে ছবিটি প্রদর্শিত না হওয়ায়, বিশেষত সম্প্রতি ছবিটি দেখার সুযোগ নেই বলে, ছবিটি সম্পর্কে স্মৃতি থেকে লিখতে হচ্ছে। ছবিটির বিশেষ সম্পদ ক্যান্ডিড (Candid) ক্যামেরায় মেয়েদের তুলে ধরার চেষ্টা। মনে পড়ে – লুকানো (?) ক্যামেরায় এক কিশোরীর স্বতঃস্ফূর্ত লম্বা বিতর্ক তার মায়ের সঙ্গে সমাজে নারীর অধস্তন অবস্থান প্রসঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই চলচ্চিত্র উৎসবে ১৯৮৮ সালে ছবিটি বাংলাদেশের একমাত্র ও প্রথম প্রতিনিধিত্বকারী ছবি হিসেবে প্রদর্শিত হয়।
সোনার বেড়ী স্বল্পায়তনের হলেও, তারেক মাসুদের ছবি নির্মাণের প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি কারণে। বাম রাজনীতি ও ইতিহাসের ওপর পড়াশোনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দি পেরিয়ে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের বারান্দায় কিংবা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ছাদে যে তরুণ ছবি নির্মাণের আকাশ-কুসুম স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন, তাঁর অভিষেক ঘটে এ ছবিটির মধ্য দিয়ে। সমকালীন বাংলাদেশে আধুনিক মধ্যবিত্তের জীবন-ভাবনা, যা তারেকের প্রায় সব ছবিরই মূল সুর, তার শুরুটাও হয় এ ছবির মধ্য দিয়ে।
২. মুক্তির গান (১৯৯৫)
তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র মুক্তির গান। এ-ছবির বিষয় ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। এ-ছবি নির্মাণের কাহিনিটিও বেশ নাটকীয়।
লিয়ার লেভিন নামে একজন মার্কিন চলচ্চিত্র-নির্মাতা ১৯৭১-এর দ্বিতীয়ার্ধে কয়েক মাস ধরে একটি ১৬ মি.মি. ক্যামেরায় ধারণ করেছেন একটি শিল্পীদলের তৎপরতা, মূলত ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত অঞ্চলে।
শিল্পীদলটি একটি ট্রাক নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, গান গায়। তারা শরণার্থী শিবিরে যায়, হাসপাতালে যায়, গেরিলা ক্যাম্পে যায় – এসবই লেভিন ক্যামেরায় তুলে রাখেন। কিন্তু তারপর তিনি নিউইয়র্কে ফিরে আসেন, ব্যস্ত হয়ে পড়েন অন্যান্য চলচ্চিত্র নির্মাণ নিয়ে, বিশেষত বিজ্ঞাপন নির্মাণ নিয়ে তিনি ব্যস্ত থাকেন বছরের পর বছর। বিশ বছর পর, ১৯৯১ সালে নিউইয়র্কে তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তাঁর ধারণ করা ফুটেজ দিয়ে তাঁরা একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করতে চান।
১৯৯২ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত মূলত নিউইয়র্কের স্ট্যাটান আইল্যান্ডের একটি ছোট অ্যাপার্টমেন্টে চলে এ-ছবির ‘নির্মাণ’, যা ১৯৯৫ সালে রূপ নেয় মুক্তির গান প্রামাণ্যচিত্রে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এটিই সম্ভবত একমাত্র বা প্রধানতম ‘ফাউন্ড ফুটেজ’ ফিল্ম। তবে উল্লেখ করা জরুরি যে, মুক্তির গানে লেভিনের ধারণকৃত ফুটেজ ছাড়াও ব্যবহার করা হয়েছে বিভিন্ন দেশের সংবাদচিত্র-আর্কাইভ থেকে সংগৃহীত ফুটেজ। এমনকি ছবির গল্পভাষ্য নির্মাণের প্রয়োজনে কিছু সংক্ষিপ্ত দৃশ্য নতুন করে তারেক মাসুদ ধারণও করেছেন ১৯৯৩-৯৪ সালে। মুক্তির গানে শুধু বিভিন্ন উৎস থেকে সংগৃহীত দৃশ্যের সমাহার ঘটেছে তা-ই নয়, শব্দ যোজনার ক্ষেত্রেও এ ছবিতে অনেক কিছু যুক্ত করা হয়েছে, যার নিশানাও লেভিনের ফুটেজে ছিল না বা থাকা সম্ভবও ছিল না। অন্যভাবে বললে, কোনো পূর্বলিখিত চিত্রনাট্য বা চিত্রনাট্যের খসড়া ব্যতীতই এ ছবি নির্মিত হয়েছে প্রধানত সম্পাদনা-টেবিলে। এদিক থেকে এ-ছবি একটি ব্যতিক্রমী এবং সৃজনশীল চলচ্চিত্রিক নিরীক্ষার বিশেষ উদাহরণ, যা কেবল তারেক ও ক্যাথরিনের পক্ষেই করে ওঠা সম্ভব ছিল।
মুক্তির গানে আমরা কী দেখি? আমরা দেখি ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের খানিকটা কোমল, রোমান্টিক ধাঁচের নস্টালজিক বর্ণনা। তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ এ-ছবিকে আখ্যা দিয়েছেন ‘ন্যারেটিভ ডকুমেন্টারি’ বা ‘প্রামাণ্য গল্প’। পঁচাত্তর মিনিটের এ ছবিতে দৃশ্যের পর দৃশ্য সাজিয়ে, বেশ কিছু গান-সহযোগে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের একটা সরলরৈখিক কাহিনি তাঁরা এখানে উপস্থাপন করেছেন। এ-ভাষ্য নির্মাণে তাঁরা একজন কথক বা ‘ন্যারেটর’ তৈরি করেছেন Ñ তিনি তারিক আলী, শিল্পীদলের সদস্য এক চশমা-পরা শহুরে তরুণ। তারিকের কণ্ঠে মধ্যবিত্তের দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের এক সহজ-সরল ভাষ্য পাই।
এই সরল গল্প বলার ভঙ্গিটি মুক্তির গানের একটি সম্পদ, এ বৈশিষ্ট্যের কারণে ছবিটি ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। তবে এ গল্প যেন শুধু মধ্যবিত্তের মুক্তিযুদ্ধ, এখানে দেশের খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষ যেন অনেকটা অনুপস্থিত। তাই যেন ছবিটি শেষ হয় তারিকের কণ্ঠে একজন কৃষক মুক্তিযোদ্ধাকে পর্দায় উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে। মনে হয়, তারেক ও ক্যাথরিনও সচেতন ছিলেন গল্পভাষ্যের এ সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে। ধারণকৃত ফুটেজের সীমাবদ্ধতাও তারেক ও ক্যাথরিনকে বাধ্য করেছে একটি নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে ১৯৭১ ও মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলতে, তা-ও মনে রাখতে হবে। তবে মুক্তিযুদ্ধের মধ্যবিত্তীয় ও পুরুষতান্ত্রিক বর্ণনার সীমাবদ্ধতা কাটানোর জন্যেই তাঁরা যেন পরবর্তী দুই বছরে নির্মাণ করলেন আরো দুটি প্রামাণ্যচিত্র মুক্তির কথা (১৯৯৭) ও নারীর কথা (১৯৯৮)। মুক্তির গান ছবিটি দেশের বিভিন্ন জায়গায় দেখানোর অভিজ্ঞতার ভিস্যুয়াল রেকর্ডভিত্তিক এ-ছবি দুটি মুক্তিযুদ্ধে নারী ও বিভিন্ন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের দলিল হয়ে উঠেছে।
মুক্তির গান ছবিটি তারেক মাসুদের ছবি নির্মাণ-প্রক্রিয়ায় একটি আন্তর্জাতিক মাত্রা যোগ করেছে, যদিও ছবিটি আমাদের জাতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। ক্যাথরিন মাসুদের সঙ্গে তারেকের নির্মাতা হিসেবে যে যূথবদ্ধতা তা প্রথম ও প্রগাঢ়ভাবে লক্ষ করা যায় এ-ছবিতে, যা আমৃত্যু বজায় ছিল। মার্কিন চিত্রগ্রাহক লিয়ার লেভিনকেও চিহ্নিত করা যায় ছবিটির আরেকজন ‘সহ-রচয়িতা’ (Co-author) হিসেবে। তবে দু-দুজন আন্তর্জাতিক সহ-রচয়িতার সহযোগিতায় ও সাহচর্যের মধ্য দিয়ে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক লুপ্ত অধ্যায়কে সিনেমার পর্দায় জীবন্ত করে তোলা – তা সম্ভব হয়েছে তারেক মাসুদের মতো প্রতিভাবান জাতীয় ইতিহাসকারের কারণে, তাতে সন্দেহ নেই।
মুক্তিযুদ্ধের দুই যুগ পর যখন মুক্তির গান মুক্তি পেল দেশে তখন এক রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণ। দক্ষিণপন্থী বিএনপি সরকারের প্রথম আমলের (১৯৯১-১৯৯৫) তখন শেষ পর্যায়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চা নানা
কারণে ১৯৭৫-এর পর থেকেই সীমিত হয়ে এসেছিল। এমন পরিস্থিতিতে
১৯৯৫-৯৬ সালে মুক্তির গান ছবিটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি প্রাণবন্ত ভাষ্য উপস্থাপন করল সিনেমার পর্দায়। তরুণ প্রজন্মের অনেক দর্শক প্রথমবারের মতো আয়ত ফ্রেমে মুক্তিযুদ্ধের একটি প্রত্যক্ষ ভাষ্য দেখার সুযোগ পেলেন এ-ছবির মধ্য দিয়ে। এর মধ্য দিয়ে প্রামাণ্যচিত্রও যে ব্যাপক দর্শক দেখতে পারে, সে সত্য প্রতিষ্ঠিত হলো, আর তারেক ও ক্যাথরিনও চলচ্চিত্র-নির্মাতা হিসেবে উচ্চতর আসনে অধিষ্ঠিত হলেন।
৩. মাটির ময়না (২০০২)
মাটির ময়না নিঃসন্দেহে তারেক মাসুদের নির্মিত সবচেয়ে আলোচিত ছবি। মুক্তির গান বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে প্রদর্শিত হলেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ছবিটি খুব বেশি প্রদর্শিত হয়নি (ব্যতিক্রম, ১৯৯৭ সালে কাঠমান্ডুতে ‘ফিল্ম সাউথ এশিয়া’ উৎসবে ছবিটির পুরস্কারপ্রাপ্তি)।
মাটির ময়না আন্তর্জাতিক অঙ্গনে, বিশেষত পশ্চিমা চলচ্চিত্রামোদীদের কাছে তারেক মাসুদকে এশিয়ার অন্যতম প্রতিভাবান চলচ্চিত্রকার হিসেবে উপস্থিত করে। বিশেষত ২০০২ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে ফিলিস্তিনি চলচ্চিত্রকার এলিয়া সুলেমানের ডিভাইন ইন্টারভেনশন ছবিটির সঙ্গে যৌথভাবে মাটির ময়না আন্তর্জাতিক সমালোচক পুরস্কার (ক্রিটিকস প্রাইজ/FIPRESCI) জিতে নিলে বিশ্বব্যাপী চলচ্চিত্র বোদ্ধা মহলে এবং পশ্চিমা অগ্রসর দর্শকমণ্ডলীর মাঝে ছবিটি আলোচিত হয়। বাংলাদেশের যে গুটিকয়েক ছবি (উদাহরণত সূর্যদীঘল বাড়ীর ১৯৮০ সালে ম্যানহাইম চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার লাভ, চাকার ১৯৯২ সালে ডানকার্ক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার লাভ) এর আগে পশ্চিমা ও এশীয় চলচ্চিত্র অঙ্গনে সমাদৃত হয়েছে, মাটির ময়না যেন এক লাফে এগুলোকে ছাড়িয়ে যায়।
মাটির ময়না তারেক মাসুদের বহু বছরের চিন্তা ও চেষ্টার ফসল। ১৯৮০-র দশকে শর্ট ফিল্ম ফোরামে যোগ দেওয়ার সময় থেকে এই ছবি নির্মাণের ভাবনা তিনি ভেবে আসছেন। তাঁর নিজের শৈশব ও কৈশোর কেটেছে মাদ্রাসার চার দেয়ালে, তাঁর বোনটি মারা গেলেও সে-সময় তিনি তাকে দেখতে পাননি। ১৯৬০-এর দশকের পূর্ব পাকিস্তান ও তার নানা দার্শনিক স্রোতের ঘূর্ণাবর্ত ছাপ ফেলে কিশোর তারেকের মনে। ইসলামের নানা রূপ ও ব্যবহার – ধার্মিক বাবার রক্ষণশীল ইসলাম; মাদ্রাসার ভেতরে অ্যাকাডেমিক, ‘আরবি’ ইসলাম; গ্রামবাংলায় খেটে-খাওয়া মানুষের চর্চায় ইসলামের লোকধর্ম রূপ – এসবই তাঁকে প্রশ্নাকুল ও পরিণত করে তোলে পূর্ববঙ্গের/বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মনোজগৎকে বোঝার ক্ষেত্রে। এর প্রকাশ আমরা দেখি মাটির ময়না ছবিতে। ইসলামের নানা রূপ কীভাবে ১৯৬০-এর দশকে পূর্ব পাকিস্তানের জনমানসকে প্রভাবিত করেছে, আধুনিকতা এবং সেক্যুলারিজমের সঙ্গে ইসলামের আন্তঃসম্পর্ক – এ-ধরনের জটিলতর ভাবনার চলচ্চিত্রায়িত রূপ আমরা দেখি এ-ছবিতে। যুক্তরাষ্ট্রে সংঘটিত ৯/১১-এর ঘটনার কয়েক মাসের মধ্যে ছবিটি রিলিজ হয়। কেউ কেউ তাই এ-ছবিকে ইসলামের ‘রাজনৈতিকভাবে শুদ্ধ’ (Politically correct) একটি ভাষ্য বলে মন্তব্য করেছেন – যা ছবিটির বহুমাত্রিক আখ্যানকে অর্বাচীনভাবে দেখার ফল বলে আমার মনে হয়।
মাটির ময়না ছবিটির গল্প শেষ হয় মুক্তিযুদ্ধ শুরুর লগ্নে। সেদিক থেকে এটি মুক্তিযুদ্ধেরও ছবি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের যে-ধরনের প্রথাগত (Stereotypical) চিত্রায়ণ আমরা আমাদের বিকল্প সিনেমায় দেখি যেমন মুক্তিযোদ্ধা-রাজাকার দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে – এখানে তা অনুপস্থিত। কিশোর আনুর ইসলাম-বিশ্বাসী পিতা যিনি পাক সেনারা গ্রামে আসছে জেনেও নিজ বাড়ি ছেড়ে যেতে রাজি হন না, তাঁকে আমাদের চেনা রাজাকার চরিত্রের সঙ্গে মেলানো যায় না। ইসলামের মতোই মুক্তিযুদ্ধও যে নানাস্তরের এক সামাজিক ডিসকোর্স (Discourse) তা তুলে ধরার চেষ্টা আমরা পাই মাটির ময়না ছবিতে। সে অর্থে পূর্ববঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী – বাঙালি মুসলমানের আত্মসত্তা তা তুলে ধরার চেষ্টা আমরা পাই মাটির ময়না ছবিতে। সে অর্থে পূর্ববঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী – বাঙালি মুসলমানের আত্মসত্তা (Identity) বিকাশের যে প্রক্রিয়া বিশ শতকের মধ্যভাগে ও তার পরবর্তী কয়েক দশকজুড়ে চলে এসেছে, যার ধারাবাহিকতায় ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও ‘বাংলাদেশ’ রাষ্ট্রের জন্মলাভ, এই ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার চলচ্চিত্রিক ভাষ্য হয়ে উঠেছে ছবিটি। আমাদের স্মরণে পড়ে যে, তারেক ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন, আমাদের জাতীয় ইতিহাসের পঠন-পাঠনে ও পুনর্বিবেচনায় তারেকের ছিল অপার উৎসাহ; এমনকি তাঁর নতুন ছবি কাগজের ফুলের বিষয়ও ছিল বিশ শতকের প্রথমার্ধে এ-জনপদের সামাজিক ইতিহাস – এ-ছবির লোকেশন বাছাই করে ফেরার পথেই নিহত হন চলচ্চিত্রের এ ইতিহাসকার!
তারেক মাসুদের আত্মজৈবনিক মাটির ময়না তাই বস্তুত এ ভূখণ্ডের, আমাদের সকলের এক সামষ্টিক ইতিহাস। উল্লেখ্য যে, এটি ছিল তারেকের সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী, সবচেয়ে বড় বাজেটের চলচ্চিত্র-প্রকল্প। ফরাসি সরকারের সাউথ ফান্ডের অনুদানে নির্মিত ছবিটি বিশ্বব্যাপী প্রদর্শন ও বিতরণের দায়িত্ব পালন করে ফরাসি চলচ্চিত্র পরিবেশক এমকেটু। এইসব আন্তর্জাতিক উপাদান ছবিটির ভিস্যুয়াল ডিজাইনে এবং বিশ্বপ্রচারণায় প্রভাব ফেলেছে। একই সঙ্গে এসব আন্তর্জাতিক সম্পৃক্তি আমাদের ইসলাম-বিশ্বাসী, গ্রামীণ পূর্ববঙ্গীয় জনগোষ্ঠীর ইতিহাসকে হাজির করেছে বিশ্ব চলচ্চিত্র-মঞ্চে।
৪. অন্তর্যাত্রা (২০০৬)
তারেক ও ক্যাথরিনের যৌথ পরিচালনায় অন্তর্যাত্রা নির্মিত হয় দেশের প্রথম ‘ডিজিটাল’ ছবি হিসেবে। ছবিটি ডিজিটাল ক্যামেরায় চিত্রগ্রহণের পর পোস্ট-প্রডাকশন পর্যায়ে এটিকে ৩৫ মি.মি.-এ রূপান্তরিত (ব্লোআপ) করা হয়। এজন্যে অনেকে এ-ছবিকে ‘পূর্ণাঙ্গ’ ডিজিটাল ছবি বলতে চান না।
জাতীয়তাবোধ ও বিশ্বায়নের টানাপড়েন এ-ছবির মূল বিষয়। এক অর্থে তারেক ও ক্যাথরিনের যাপিত জীবনেও এ দুই ডিসকোর্সের সহাবস্থান আমরা দেখি, যে জন্যে মুক্তির গান থেকে শুরু করে তাঁদের পরবর্তী সব ছবিই নানাভাবে আন্তর্জাতিক চারিত্র্য পেয়েছে। অন্তর্যাত্রা ও কবছর পর নির্মিত রানওয়ে (২০১০) তাঁদের এ মনোভূগোলের চলচ্চিত্রিক প্রকাশ বলা যেতে পারে।
অন্তর্যাত্রা অভিবাসী মানুষের সমসাময়িক যন্ত্রণার গল্প। সোহেল নামে এক কিশোর যে বড় হয়েছে ব্রিটেনে তার মা শিরীনের সঙ্গে, তার ‘ঘরে-ফেরা’ (home-coming) এ-ছবির মূল থিম। শিরীন, স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্স হওয়ার পর সোহেলকে নিয়ে ব্রিটেনে পাড়ি জমায়। পনেরো বছর পর, স্বামীর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে শিরীন ফিরে আসে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে। কিন্তু দেশে ফিরে সে প্রত্যক্ষ করে এক অন্য ঢাকাকে, এক অন্য বাংলাদেশকে। স্মৃতি হানা দেয় বারবার, মাঝে মাঝে সে খুঁজে ফেরে তার তরুণ বয়সের সে পৃথিবীকে, যা ছেড়ে সে চলে গিয়েছিল বা যেতে বাধ্য হয়েছিল। সোহেল – যে শৈশব-কৈশোর কাটিয়েছে ব্রিটেনে, বাংলাদেশের স্মৃতি তার নেই, নেই তার কোনো ভাবাবেগ। কিন্তু প্রায়-তরুণ সোহেলের জন্যেও দেশ ও দেশের মানুষের সঙ্গে তার যে সাক্ষাৎ তা এক গভীর অভিজ্ঞতা নিয়ে আসে। তাকে ভাবতে শেখায় তার নিজের সম্পর্কে, তার বিশ্বায়িত আত্মপরিচিতি (globalized identity) যেন একটা স্থিতি পায় বাংলাদেশে এসে।
দেশান্তর বা অভিবাসনের যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক মাত্রা এবং সমসাময়িক বিশ্বে আমরা প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে যে এ মাত্রাগুলোর সঙ্গে বাদানুবাদে লিপ্ত, তা তারেক-ক্যাথরিন স্মরণ করিয়ে দেন আমাদের। এ-ও স্মরণ করিয়ে দেন যে, সিলেটের চা-বাগানের শ্রমিকেরাও এদেশে অভিবাসী।
ডিভি-৪০০ ক্যামেরায় স্বল্প বাজেটে চিত্রায়িত অন্তর্যাত্রার চিত্রগ্রহণ শুরু করেন তারেক-ক্যাথরিন যখন হল্যান্ডের রটারডাম চলচ্চিত্র উৎসব থেকে হুবার্ট বল্স ফান্ডের একটি চিত্রনাট্য উন্নয়ন অনুদান পান। চিত্রনাট্যের বদলে তাঁরা ছবিটির নির্মাণেই ঝাঁপিয়ে পড়েন। পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ কাউন্সিল ছবিটিতে কিছু অনুদান দেয়। আর মাছরাঙা প্রডাকশন ছবিটির স্থানীয় বিতরণ ও প্রদর্শনস্বত্বের বিনিময়ে ছবিটিকে ডিজিটাল থেকে ৩৫ মি.মি.-এ রূপান্তরের অর্থ জোগায়। বহুমুখী উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করে নির্মিত অন্তর্যাত্রা গুটিকয়েক চরিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরেছে আজকের বিশ্বায়িত সময়ে আমাদের সংকর আত্মসত্তা (hybrid identity) কীভাবে একে অপরের সঙ্গে মৌলিক বিভিন্ন প্রশ্নে প্রতিনিয়ত বিরোধে লিপ্ত।
পর্ব দুই : যে-জীবন যোদ্ধার
তারেক মাসুদের নির্মিত ছবির সংখ্যা খুব বেশি নয়। তাঁর প্রধান ও ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য’ (এ অভিধায় যদিও তিনি বিশ্বাস করতেন না!) চলচ্চিত্রকর্ম পাঁচটি মাত্র – কাহিনিচিত্র : মাটির ময়না (২০০২), অন্তর্যাত্রা (২০০৬) ও রানওয়ে (২০১০); প্রামাণ্যচিত্র : মুক্তির গান (১৯৯৫) ও আদম সুরত (১৯৮৯)। এর বাইরে তাঁর ‘অপ্রধান’ বা স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবির মধ্যে রয়েছে : সোনার বেড়ী (১৯৮৫), মুক্তির কথা (১৯৯৮), নারীর কথা (১৯৯৯), কানসাটের পথে (২০০৮), নরসুন্দর (২০০৯) এবং আরো কিছু ছবি। ১৯৮০-র দশকের শেষ দিকে তারেক ইউনিসন নামে একটি ছোট্ট অ্যানিমেশন ছবি এবং বন্ধু শামীম আখতারের সঙ্গে যৌথ পরিচালনায় সে নামে একটি দশ মিনিটের স্বল্পদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্রও নির্মাণ করেছিলেন।
উল্লেখ্য যে, প্রায় তিন দশকের চলচ্চিত্র নির্মাণজীবনে তিনি যে প্রধান পাঁচটি ছবি নির্মাণ করেছেন (তার মাঝে তিনটি ছবি আমি প্রথম পর্বে উপস্থিত করেছি), তাঁর প্রতিটি ছবির জন্যে তিনি তিন থেকে চার বছর ধরে কাজ করেছেন। প্রতি বছর বা বছরান্তে একটি ছবি নির্মাণ করে পাদপ্রদীপের আলোয় থাকতে হবে এমন মন্ত্রে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। বরং ছবির বিষয় নির্বাচন, কাহিনি বিন্যাস, প্রয়োজনীয় গবেষণাসহ সম্পূর্ণ চিত্রনাট্য লিখে, নানাজনের সঙ্গে আলোচনা করে সন্তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত তিনি ছবি নির্মাণ শুরু করতেন না। তারপর নির্মাণেরও প্রতিটি ধাপে প্রচুর সময়, যতœ ও অভিনিবেশ তিনি বিনিয়োগ করতেন, তার ফলে তাঁর ছবিগুলোকে আমরা, তাঁর অলস সহযাত্রী ও কথাপটু বন্ধুরা নাম দিয়েছিলাম – ‘সিনেমা দেরিতে’ (সিনেমা ভেরিতের অনুকরণে)। তিনি হাসিমুখে এসব কৌতুক, অনুযোগ গ্রহণ করতেন – অনেক সময় নিজেই নিজের সম্পর্কে কৌতুকগুলো ছড়িয়ে দিতেন। কিন্তু তাঁর ছবি নির্মাণের যে যুদ্ধ সে লড়াইয়ের ময়দান থেকে কখনো পিছপা হতেন না।
তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে বিকল্প ধারায়, অ-বাণিজ্যিক ছবি নির্মাণ অবশ্যম্ভাবীরূপে এক প্রকাণ্ড লড়াই। এ লড়াই, আমরা জানি Ñ বড় অসম এক লড়াই। সরকার ও রাষ্ট্রের অসহযোগিতা ও বাধার মুখে, বাণিজ্যিক সিনেমার দাপটের সামনে, বাজারমুখী গণমাধ্যম ও মধ্যবিত্ত, সর্বভুক ভোক্তাগোষ্ঠীর আহার্য হালকা বিনোদন-পসরার হাটে ঢাল-তরোয়াল ছাড়া নিধিরাম সর্দারের মতো কয়েক দশক ধরে তারেক মাসুদসহ আরো নির্মাতা (মোরশেদুল ইসলাম, তানভীর মোকাম্মেল, মানজারে হাসীন ও আবু সাইয়ীদ এক্ষেত্রে উল্লেখ্য) এ লড়াই লড়ে চলেছেন। এঁদের সবাই আমাদের চলচ্চিত্রের বিকাশে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন, তাঁদেরকে এ সুযোগে সালাম জানাই।
তারেক মাসুদ ১৯৮০-র দশকের গোড়া থেকে বিকল্প সিনেমার এ-কাফেলায় যোগ দেন এবং মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তিন দশকজুড়ে সম্ভবত এমন একটি সকাল, দুপুর বা বিকাল তাঁর যায়নি যখন তিনি সিনেমা নিয়ে কোনো না কোনো কিছু করে যাচ্ছেন। কর্মব্যস্ততা তাঁর ছিল সহজাত আর এ ব্যস্ততা ছিল আদ্যন্ত সিনেমাকে নিয়েই। যেটা গুরুত্বের সঙ্গে বলা দরকার – তিনি আদতে এই তিন দশক – তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়জুড়ে সিনেমা ছাড়া আর কিছুই করেননি। জীবিকার তাগিদে কোনো কোনো চলচ্চিত্রকার পূর্ণকালীন বা খণ্ডকালীন অন্য কোনো কাজ করে থাকেন, তারেক কখনই তা করেননি।
আপাদমস্তক একজন বিকল্প চলচ্চিত্রকারের জীবন তিনি যাপন করেছেন। রুটি-রুজি, বিত্ত-সমৃদ্ধি, সহায়-সম্পত্তি – আমরা সাধারণ মানুষেরা যেসব ‘অর্জনে’র পেছন পেছন ঘুরে, স্টিভ জবসের ভাষায় ‘অন্য মানুষের জীবন যাপন করে নিজের জীবনটাকে নিঃশেষ’ করে দিই, তারেক তা কখনই করেননি। ছবি নির্মাণের তহবিল সংগ্রহের জন্যে তিনি ভূ-ভারত চষে বেড়িয়েছেন। যখন যেখানে সম্ভব, যেভাবে সম্ভব দেশ-বিদেশের বিভিন্ন উৎস থেকে তিনি তাঁর ছবি নির্মাণের টাকা সংগ্রহ করেছেন। দলীয় ও গোষ্ঠীগত সংকীর্ণ রাজনীতির ঘেরাটোপে আটকা জাতীয় চলচ্চিত্র অনুদানকে তিনি সযতেœ পরিহার করেছেন। তা বাদে ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক বহুবিধ সূত্র থেকে তিনি ছবির জন্যে তহবিল সংগ্রহ করেছেন – এ তালিকায় তাঁর নিজের শাশুড়ি মিসেস শেপিয়ার থেকে শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাকেন্দ্র রামরুরও দ্বারস্থ হয়েছেন তারেক মাসুদ। এই সংগৃহীত তহবিলের অর্থের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহারে সদা সচেষ্ট ছিলেন তিনি, সীমিত সামর্থ্যইে কি করে ‘এক্সট্রা মাইলেজ’ পাওয়া যেতে পারে, তিনি আজীবন সে চেষ্টা চালিয়েছেন।
ছবি নির্মাণের তহবিল সম্ভাব্য-অসম্ভাব্য নানা সূত্র থেকে সংগ্রহ করলেও ব্যক্তিগত জীবনে খুব সাধারণ জীবন-যাপন করতেন তারেক। ১৯৮০-র দশকের দ্বিতীয় ভাগে শর্ট ফিল্ম ফোরামের শুরুর দিনগুলোয় তাঁকে সবসময় দেখেছি স্পঞ্জের চপ্পল পায়ে ঘুরে বেড়াতে। অনেকদিন তাঁর কেটেছে নিদারুণ অর্থকষ্টে। শুনেছি, সকালবেলা সোনার বেড়ীর একটি ভিএইচএস (VHS) কপি হাতে নিয়ে সারাদিন ঘুরে কোনো এনজিওর কর্তাব্যক্তির কাছে তা নগদে বিক্রি করে কিছু টাকা হাতে করে ফিরেছেন তাঁর ‘কম্যুনাল হাউসে’ বন্ধু-সতীর্থদের সঙ্গে একত্রে কিছু খাবেন বলে।
পরবর্তী জীবনে ক্যাথরিন ও তারেকের পরিবারে অত তীব্র অর্থকষ্ট না থাকলেও খুব বিত্তবৈভবময় জীবন তারেক কখনো উপভোগ করেননি। মুক্তির গান নির্মাণকালে তারেক নিউইয়র্কের বিখ্যাত পুরনো বইয়ের দোকান স্ট্রান্ডে কাজ করেছেন, বাড়ি ভাড়ার বদলে স্ট্যাটান আইল্যান্ডে
বাড়িওয়ালা জোনাথনের বাড়ির প্লাম্বিং ওয়ার্ক করে দিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে ঢাকার উত্তরায় বা তেজকুনীপাড়ায় তাঁর ও ক্যাথরিনের যে বাসস্থান তা প্রায় সবসময়ই মূলত ব্যবহৃত হয়েছে ছবি নির্মাণের একটি কেন্দ্র হিসেবে – আর সেখানেই তারেক ছিলেন সবসময় সাবলীল ও সপ্রতিভ। বিলাসবহুল বাড়ি বা দামি গাড়ি ব্যবহারের কোনো বাসনা তাঁর কখনো হয়েছে বলে মনে হয় না, যদিও তিনি তাঁর সুনাম ও সময়ের একটি ছোট্ট অংশ ব্যয় করতেন অর্থোপার্জনের উদ্দেশ্যে – যেমন, বিজ্ঞাপনী ছবি বা টিভির জন্য কোনো প্রযোজনার পেছনে – তাহলে গাড়ি-বাড়ি তাঁর নাগালেই ছিল।
কিন্তু তারেক যে ছিলেন সৃজনশীল, স্বাধীন সিনেমার যোদ্ধা। তিনি যেন ধনুর্ভঙ্গ পণ করে কোমর-ভাঙা লড়াইয়ে নেমেছেন যে তাঁর মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে নিছক টাকার প্রয়োজনে কোনো কাজ করবেন না, কোনো ছবি নির্মাণ তো নয়ই। যদিও দু-একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য বা প্রামাণ্য ছবি তিনি করেছেন কোনো উন্নয়ন-প্রতিষ্ঠানের প্রণোদনায়, তা তিনি করেছেন সে বিষয়বস্তুর সঙ্গে তাঁর নিজের একাত্মতার কারণে, টাকা উপার্জনের নিমিত্তে তিনি চাইলে এমন বহু ছবি বানিয়ে আরামের সঙ্গে জীবন কাটাতে পারতেন, যা তিনি ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি। স্বাধীন চলচ্চিত্রকারের স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপসহীন। আয়েশের বিনিময়ে তিনি তাঁর আত্মাকে বিক্রি হতে দেননি।
এ পর্যন্ত তারেক মাসুদের যে লড়াইয়ের চেহারাটা তুলে ধরেছি তা মূলত তাঁর চলচ্চিত্রকার হিসেবে ও চলচ্চিত্রকার হয়ে ওঠার লড়াই। এ লড়াই, যেমনটি আমি দেখিয়েছি, একটি বিরাট লড়াই তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তারেক মাসুদকে আমি যোদ্ধা বলছি বা সিনেমার যোদ্ধার শিরোপা দিতে চাইছি তা কেবল তাঁর ছবি নির্মাণের লড়াইয়ের জন্য নয়; তাঁর লড়াই ছিল আরো ব্যাপক।
তারেক মাসুদের জন্যে সিনেমা ছিল জীবন, সিনেমা ছিল তাঁর ধর্ম। তাই সিনেমার হেন কোনো ক্ষেত্র নেই যাতে তিনি অংশ নেননি। চলচ্চিত্র পরিচালকের হ্যাট পরে ‘ডিরেক্টর’ লেখা সংরক্ষিত চেয়ারে বসে বা দাঁড়িয়ে তিনি সিনেমার সঙ্গে তাঁর জীবনের বোঝাপড়া শেষ বলে মনে করেননি। সিনেমার পর্দায় একটি মনমতো ইমেজকে ফোটানোর জন্যে যা যা দরকার তা যেমন তিনি কনে বিদায়-দেওয়া পিতার মতো ধৈর্য ও ঔদার্য নিয়ে আয়োজন করেছেন, এ ইমেজ যেন দর্শকের মনে গিয়ে পৌঁছুতে পারে, অন্তত তার চোখের রেটিনায় প্রক্ষেপিত হয়, সে জন্যেও তিনি জীবনপাত করেছেন। আর এ দর্শক, যাঁর কাছে তিনি তাঁর ছবিকে পৌঁছাতে
চেয়েছেন, তিনি কেবল ঢাকা শহরের মধ্যবিত্ত চাকুরে বা ব্যবসায়ী নন। ভুরুঙ্গামারীর কৃষক, ছাগলনাইয়ার শ্রমিক বা ধামরাইয়ের মুদি দোকানির কাছেও তিনি তাঁর ছবি পৌঁছাতে চেয়েছেন। মুক্তির গান থেকে তাঁর এ প্রদর্শন-অভিযাত্রা শুরু, তাঁর শেষ ছবি রানওয়ের ক্ষেত্রেও তিনি তা চালিয়ে গিয়েছেন। মাইক্রোবাস নিয়ে, তরুণদের একটা দল নিয়ে, কখনো ক্যাথরিন ও শিশুপুত্র নিষাদকে নিয়ে ২০১০-এর বেশিরভাগ সময় তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন ঢাকার বাইরে বহু জায়গায় রানওয়ের প্রদর্শনী করে। যেখানে দর্শকে মিলনায়তন ভরে গিয়েছে, উচ্ছ্বসিত হয়ে এসএমএস করেছেন আমাদের মতো কয়েকজনকে, যাঁরা ঢাকাকে সারাদেশ বলে ধরে নিয়েছি! কখনো আমরা অনুযোগ করেছি ঢাকার দর্শকরা রানওয়ে দেখতে পারছে না বলে। তিনি হেসে জবাব দিয়েছেন – ‘আমি তো মাও সে তুংয়ের মতো গ্রাম দিয়ে শহরকে ঘেরাও করতে আসছি।’
সিনেমা প্রদর্শনে যেমন তারেক খেটেছেন, যুদ্ধ করেছেন, তেমনি তাঁর আরেকটি লড়াইয়ের জায়গা ছিল সিনেমা নিয়ে অধ্যয়নে, সিনেমাকে ঘিরে একটি আধুনিক সংস্কৃতির বিস্তারে। কেবল ছবি নির্মাণ, ছবি দেখা আর দেখানো নয়, সিনেমাকে ঘিরে বিশ্বব্যাপী যে সমকালীন চিন্তার ধারা তা তিনি জানতেন এবং জানাতেন। নিউইয়র্কে স্ট্রান্ড বুকশপে কাজ করার সময় সিনেমার ওপর তিনি প্রচুর বই পড়েছেন (১৯৯৩ সালে আমি নিউইয়র্কে গেলে তিনি আমাকে সে বুকশপ দেখাতে নিয়ে গিয়েছেন)। সে দোকান থেকে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গার ‘গ্যারাজ সেল’ থেকে তিনি বহু বই সংগ্রহ করেছেন। এসব বই এবং নতুন চিন্তার খোরাক তিনি তরুণদের সাগ্রহে জানাতেন। ঋত্বিক ঘটকের ওপর সুগত সিংহের লেখা নতুন বিশ্লেষণধর্মী বইটি আমি পড়িনি শুনে আমার জন্যে বইটির কপি পাঠিয়ে দিয়েছেন, পরে ফোন করে জানতে চেয়েছেন আমার মতামত বইটি নিয়ে। ২০০৬ সালে দিল্লিতে একটি চলচ্চিত্র উৎসবে গিয়ে এক ফাঁকে আমাকে নিয়ে ছুটে গিয়েছেন ‘জামেয়া মিলিয়া’র শিক্ষক সোহিনী চৌধুরীর কাছে, যেহেতু আমরা দুজনেই সিনেমা নিয়ে অধ্যাপনা করি।
তৃতীয় বিশ্বের চলচ্চিত্র আন্দোলন যে লড়তে হবে সম্ভাব্য সব ফ্রন্টে, বিশেষত বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে, এ ছিল তাঁর পরিষ্কার বিশ্বাস। এই লড়াইয়ে সিনেমার নতুন ধারা, সিনেমাচর্চার নতুন দিক এসব জানতে হবে, আলোচনা করতে হবে – এ ধারণা থেকেই তিনি তরুণদের নিয়ে আব্বাস কিয়ারোস্তামীর ছবির ওপর কর্মশালা করেছেন, ডিজিটাল মাধ্যম কীভাবে সিনেমার চেহারা পালটে দিচ্ছে তা নিয়ে সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করেছেন। ২০১০ সালে এসে কেন আমাদের চলচ্চিত্রশিল্প মুখ থুবড়ে পড়ছে, তা নিয়ে ঢাকার বাইরে প্রেক্ষাগৃহগুলোর অবস্থা দেখে বেড়িয়েছেন, আলোচনা করেছেন স্থানীয় দর্শক ও নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে।
শেষের বদলে
এইভাবে সিনেমার ‘টেক্সট’ (Text)থেকে ‘কনটেক্সট’ (Context) বা প্রেক্ষাপট পর্যন্ত তারেক মাসুদ ছুটে বেড়িয়েছেন, যেখানে সম্ভব সেখানেই হাত লাগিয়েছেন একজন ‘প্লাম্বার’ বা কারিগরের মতো। কাজেই তাঁর যে জীবন – আমি বলেছি সিনেমার জীবন – সে-জীবনে যে লড়াই, তা ছিল বহুমাত্রিক।
সিনেমার লড়াই করতে গিয়ে তিনি সাধারণ, আটপৌরে জীবনের সীমা ছাড়িয়ে এক অসাধারণ, অলৌকিক দ্বীপভূমিতে পৌঁছাতে পেরেছিলেন। সেই জগতে জাগতিক জীবনের পাওয়া-না-পাওয়ার তেমন গুরুত্ব নেই। ১৯৮৭-৮৮ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসবের সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন তারেক মাসুদ; আলমগীর কবির ছিলেন সভাপতি। সেই উৎসব আয়োজনের কাজে আমরা এক ঝাঁক কৈশোর-পেরোনো তরুণও জড়ো হয়েছিলাম। কাজের ফাঁকে ফাঁকে তারেক মাসুদ, আমরা যারা তখনো সিনেমার ও জীবনের হালচাল তেমন বুঝে উঠতে পারিনি, তাদেরকে বলতেন – ‘সিনেমা করতে চাইলে ঘাটে বাঁধা নৌকার সুতো ছেড়ে দাও। পেছনে যদি নৌকা বাঁধা থাকে, সেটি বারবার তোমাকে পিছু টানবে।’
আমরা অনেকেই নৌকার সুতো ছেড়ে দিতে পারিনি, বরং একাধিক নৌকা জড়ো করে তুচ্ছাতিতুচ্ছ ‘সাফল্যে’র সিঁড়ি গুনছি। তারেক ভাই, আপনি সব সুতো, সব নৌকার মায়া ত্যাগ করেছেন অনেক আগেই, জীবন সমর্পণ করেছেন সিনেমার মায়ার জগতে। কিন্তু এবার নাকি আপনি সিনেমার মায়ার জগৎ ছেড়ে এক চিরকালীন, অচেনা এক মায়াবী জগতে চলে গেছেন? কিন্তু এখন এ নিবন্ধ আমি কীভাবে শেষ করব, তারেক ভাই? গম্ভীর প্রাবন্ধিক ভাব নিয়ে যে লেখা শুরু করেছিলাম, যৌক্তিকতার বাঁধনে যে তার শেষ টানতে পারছি না!
আচ্ছা, এক কাজ করলে কেমন হয়, আপনি তো ভালো করেই জানেন, আজকের ডিজিটাল দুনিয়ায় অনেক ছবির শেষ অংশই নির্মাতারা ছেড়ে দিচ্ছেন দর্শকের মর্জির ওপর, নির্মাতা শুধু কয়েকটি সম্ভাবনা দিয়ে দেন ছবির শেষে। আজকে তাই যে পাঠক এ লেখা পড়ছেন, এ লেখাটি আপনাকে শেষ করতে হবে। আপনি কি নৌকার সুতো ছেড়ে দিয়ে সিনেমার, শিল্পের অতিলৌকিক জগতে যোগ দেবেন, তারেক মাসুদের মতো যোদ্ধাকে সঙ্গ দেবেন, না চোখ-মুখ বুজে নৌকার সুতো আরো কষে বেঁধে রাখবেন, সে বিবেচনা সম্পূর্ণই আপনার।