logo

ঢাকায় শম্ভু মিত্র : দুই অধ্যায়

অং শু মা ন  ভৌ মি ক

বিংশ শতকে এই ভারতীয় উপমহাদেশের বুকে যাঁরা নাট্যভাষার আধুনিকতার সন্ধান করেছিলেন এবং একটি উত্তর-উপনিবেশবাদী নাট্যচর্চার দিগন্ত খুলে দিয়েছিলেন, সেই পঙ্ক্তিতে একেবারে সামনের সারির নাম শম্ভু মিত্র (১৯১৫-৯৭)। আগামী ২২ আগস্ট তাঁর বয়স একশ পেরোবে। এমন দরের একজন নাট্যদ্রষ্টার একরকমের মূল্যায়ন তাঁর সমকাল করে। শম্ভু মিত্রের ভাগে তার কিছু কম জোটেনি। তাঁর নট ও নাট্যকার জীবনের আনাচ-কানাচ নাট্য সাংবাদিক, সমালোচক, ঐতিহাসিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আজো করে। শতবর্ষ একটি কষ্টিপাথর। শম্ভু মিত্রের শতবর্ষ উদ্যাপন শুরু হয়েছে। তাঁর বহুমুখী কৃতিকে উলটে-পালটে দেখার উদ্যোগ চলেছে ভারতে, বাংলাদেশে। উত্তরকাল কীভাবে তাঁকে মনে রাখবে এই অনেকান্ত মূল্যায়ন তার হদিস দেবে।

কলকাতা থেকে টের পেয়েছি যে বাংলাদেশ এই উদ্যোগে শামিল হয়েছে। থিয়েটার পত্রিকা তাঁর স্মরণে একটি ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে। মঞ্চকথা পত্রিকা তাঁকে মনে রেখেছে। বাংলা একাডেমির কীর্তিমান একুশের বইমেলার শেষ সন্ধ্যায় তাঁর নামাঙ্কিত স্মারক বক্তৃতা দিয়েছেন আবুল হাসনাত। আর ভাবতে ভালো লাগছে যে, দ্বিতীয় ঢাকা আন্তর্জাতিক নাট্য উৎসব ও নাট্য সংলাপ তাঁর স্মৃতিতে উৎসর্গ করা হয়েছে। শম্ভু মিত্র যে জাতীয় নাট্যশালার স্বপ্ন আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে থেকে লালন করেছিলেন, তাকে সাকার করার জন্য বারংবার উদ্যোগী হয়েছিলেন, কলকাতায় তা রূপায়িত হয়নি। তাঁর প্রয়াণের এক দশকের মাথায় ঢাকায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী প্রাঙ্গণে যে জাতীয় নাট্যশালা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে তা বাংলাদেশের নাট্যসমাজের অনেকদিনের সাধনার সম্পদ। এমন একটি নাট্যাঙ্গন শম্ভু মিত্রের শয়নে-স্বপনে-জাগরণে ছিল। আজ সেই জাতীয় নাট্যশালায় শ্বেতমর্মর-রচিত সোপান বেয়ে ওপরে উঠতেই প্রশস্ত চাতালের ওপর রাজা অয়দিপাউসের ভূমিকায় শম্ভু মিত্রের প্রমাণ আকারের আলোকচিত্র দেখে যুগপৎ রোমাঞ্চিত ও শিহরিত হচ্ছি। যে আকালের মুখে দাঁড়িয়ে সাবেক থেবাইয়ের রাজা অয়দিপাউস সত্যের সন্ধানে যাত্রা করেছিলেন, এই উৎসবের মূল সুর ‘থিয়েটার অ্যাগেইনস্ট ভায়োলেন্স’ উচ্চারণটির অন্তরালে সে-সুরটি শুনতে পাচ্ছি। এভাবে তাঁকে মনে রাখার জন্য ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইন্স্টিটিউটের বাংলাদেশ কেন্দ্র ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী এবং তাদের পৃষ্ঠপোষক সংস্কৃতি মন্ত্রককে সাধুবাদ জানাই।

আবার ভাবি, এমন শতবার্ষিকী তর্পণ বুঝি তাঁর প্রাপ্যই ছিল। এই ঢাকা, এই বাংলাদেশের সঙ্গে শম্ভু মিত্রের সংযোগ তো নিছক পোশাকি নয়। এর একটি গূঢ় ইতিকথা আছে। তাঁর সৃজনশীল দিনগুলিতে দু-দুবার এই ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। এসেছিলেন তাঁর আদর্শে তাঁর অনুপ্রেরণায় গড়ে ওঠা নাট্যদল বহুরূপীর কর্ণধার হয়ে। একবার ১৯৫৭ সালে, আরেকবার ১৯৭৪ সালে। আমরা যে-সময়ের কথা বলছি সে-সময় এ-ধরনের সফর খুবই দুর্লভ ছিল। প্রথমত পূর্ব পাকিস্তান, দ্বিতীয়ত বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সাংস্কৃতিক কূটনীতিতে বহুরূপীর ঢাকা আগমনের মাহাত্ম্য ছিল গভীর। এটি আমাদের আলোচনায় প্রাধান্য পাবে না। আমরা এই দুই সফরের দিকে সন্ধানী আলো ফেলে বুঝতে চাইব বাংলাদেশের থিয়েটারে এর কী প্রভাব পড়েছিল।

 

তখন ছিল পূর্ব পাকিস্তান

১৯৫৭ সালের ১৮ থেকে ২১ মার্চ ঢাকা সফর করেছিল শম্ভু মিত্রের দল বহুরূপী। তাদের আমন্ত্রণ পাঠিয়েছিল বুলবুল চারুকলা কেন্দ্র। নাটমঞ্চ ছিল আরমানিটোলা মহল্লার নিউ পিকচার হাউসে। সেখানে মঞ্চস্থ হয়েছিল বহুরূপীর দুটি প্রযোজনা ছেঁড়া তার ও রক্তকরবী।

শম্ভু মিত্রের নির্দেশনায় বহুরূপীর রক্তকরবী (১৯৫৪) প্রযোজনার কথা আপনারা সকলেই জানেন। রবীন্দ্রনাটককে আধুনিক মঞ্চভাষায় অনুবাদের একটি প্রমিত রূপ নির্মাণ করেছিল এই ঐতিহাসিক প্রযোজনা। উত্তর-১৯৪৭ পর্বে ভারত যখন সাহেবদের শিখিয়ে-পড়িয়ে যাওয়া বিলিতি ছাঁদের প্রসেনিয়াম থিয়েটারের ঘেরাটোপ থেকে বেরোনোর জন্য ছটফট করছে, স্মৃতিতে ও সত্তায় একটি ‘ভারতীয়’ নাট্য নির্মাণের পথে পা বাড়াচ্ছে, তখন বহুরূপীর রক্তকরবী একটি যুগান্তের সূচনা করেছিল। তার সর্বভারতীয় স্বীকৃতি মিলেছিল ২১ ডিসেম্বর ১৯৫৪, নয়াদিল্লির সাপ্রু হাউসে। স্বাধীন ভারতের সরকার বাহাদুরের বদান্যতায় অনুষ্ঠিত ন্যাশনাল ড্রামা ফেস্টিভালের মঞ্চে। বারোটি ভাষায় নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল
এ-উৎসবে। শ্রেষ্ঠত্বের রাষ্ট্রীয় শিরোপা পেয়েছিল বহুরূপীর রক্তকরবী। এর দুবছরের মাথায় আবার দিল্লি জয় করে রক্তকরবী। সাক্ষী ছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহরু, তস্য কন্যা ইন্দিরা গান্ধি, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইন্স্টিটিউটের কর্ণধার প্রমুখ। যে-ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইন্স্টিটিউট আমাদের এই উৎসবের কারিগর, তাদের উদ্যোগে মুম্বাইতে ১৯৫৬ সালের নভেম্বরে ওয়ার্ল্ড থিয়েটার কনফারেন্স আয়োজিত হয়। মুম্বাই রঙ্গভবনে ২ নভেম্বর বিদেশি অতিথি-অভ্যাগতদের উপস্থিতিতে রক্তকরবীর একটি স্মরণীয় অভিনয় হয়। এবারো উৎকর্ষের স্বীকৃতি মেলে। আধুনিক নাট্যকলায় স্বাধীন ভারত রাষ্ট্র কতখানি পারঙ্গম তার পরাকাষ্ঠা হয়ে ওঠে শম্ভু মিত্র-নির্দেশিত বহুরূপীর এ-প্রযোজনা।

এ-পটভূমি মাথায় রাখলে ১৯৫৭ সালের মার্চে পূর্ব
পাকিস্তানের রাজধানীতে বহুরূপীর আগমন কেবল একটি নাট্যদলের বিদেশ সফরের পর্যায়ে আটকে থাকে না, সহোদর দুই দেশের সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের সূচনাপর্বের একটি মাইলফলক হয়ে ওঠে। জানা যায়, ১৮ মার্চ উদ্বোধনী সন্ধ্যায় রক্তকরবী অভিনীত হয়। সেদিন নিউ পিকচার হাউস প্রেক্ষাগৃহ কানায় কানায় ভরা ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খান প্রেক্ষাগৃহে উপস্থিত ছিলেন। সংবাদে প্রকাশ যে, অসুস্থ শরীর নিয়েও তিনি প্রযোজনাটি দেখেছিলেন। পড়শী দুদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ-সফরের মাহাত্ম্য এর থেকে আন্দাজ করা যায়।

বহুরূপীর ঢাকা সফরের আগে ও সফর চলাকালে বেশ কয়েকটি সংবাদ সম্মেলন হয়। সে আমলের খবরের কাগজে খুবই গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয় খবরটি। ১২ মার্চ তারিখে মিল্লাত লিখেছিল :

বুল বুল চারুকলা কেন্দ্রের সাহায্যার্থে নাট্যাভিনয় প্রদর্শনের জন্য কলিকাতার বিখ্যাত নাট্য সম্প্রদায় ‘‘বহুরূপী’’ ঢাকা আগমন করিতেছেন। এই দলে মোট ৪০ জন সদস্য রহিয়াছেন। রবীন্দ্রনাথের ‘রক্ত করবী’ ও তুলসী লাহিড়ীর ‘ছেঁড়া তার’ মঞ্চস্থ করা হইবে। আগামী ১৮ই মার্চ ও ২১শে মার্চ স্থানীয় নিউ পিকচার হাউসে এই নাট্যাভিনয় অনুষ্ঠিত হইবে। (বানান অপরিবর্তিত)

 

শম্ভু ও তৃপ্তি মিত্রের একমাত্র সন্তান শাঁওলী অভিনয় করতেন ছেঁড়া তার নাটকে, ফুলজান ও রহিমুদ্দির মেয়ে বসিরের ভূমিকায়। স্মৃতিকথায় শাঁওলী লিখেছেন, ‘যতদূর মনে পড়ে বহুরূপী সেখানে পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে অভিনয় করে আসে। আবছা মনে পড়ে বহুরূপীকে সেখানে রক্তকরবীর একটি অতিরিক্ত অভিনয় করতে হয়েছিল।’

ঢাকার বেশ কয়েকটি বাংলা কাগজে শম্ভু মিত্র ও অমর গঙ্গোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার বেরিয়েছিল। ঢাকা প্রেস ক্লাবে একটি চা-চক্র হয়। উদ্যোগী হয়েছিলেন বহুরূপীর প্রাক্তন সদস্য কলিম শরাফী। অনেকের মনে থাকবে যে, কলিম শরাফী দীর্ঘদিন ১১এ নাসিরউদ্দিন রোডে মিত্র পরিবারের সঙ্গেই বসবাস করেছেন। আক্ষরিক অর্থেই শম্ভু মিত্রের ডান হাত ছিলেন তিনি। বহুরূপী গড়ে তোলায় তাঁর অবদান অনেকখানি। ১৯৫১ সাল নাগাদ তিনি পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন।

সেবার রক্তকরবী ছাড়াও মঞ্চস্থ হয়েছিল ছেঁড়া তার। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের অনতিপূর্বে দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে রংপুরের এক মুসলমান দম্পতির তালাককে কেন্দ্র করে আবর্তিত নাটকটি লিখেছিলেন তুলসী লাহিড়ী। কলকাতার অভিজাত মঞ্চে দর্শক উত্তরবঙ্গের বাহে উপভাষার প্রয়োগ শুনেছিল। ১৯৫০ সালে এটির প্রথম অভিনয় করে বহুরূপী। বসির সাজতেন শম্ভু মিত্র, ফুলজান হতেন তৃপ্তি মিত্র। মুনাফাখোর হাকিমুদ্দির চরিত্রে অভিনয় করতেন তুলসী লাহিড়ী। মহম্মদ জ্যাকেরিয়া তখন কলকাতায়, বহুরূপীর সক্রিয় সদস্য। এই প্রযোজনায় তমিজ সাজতেন তিনি। আবার শ্রীমন্তের ভূমিকায় তিনি আর মহম্মদ ইসরাইল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অভিনয় করতেন। ১৯৫৭ সালের মার্চের অনেক আগেই বহুরূপী ছেড়ে গিয়েছিলেন তুলসী লাহিড়ী। ফলে ঢাকায় তিনি আসেননি। তবে তাঁর নাটক পথিক বা ছেঁড়া তার সম্পর্কে ঢাকা বা পূর্ব
পাকিস্তানের সদর-মফস্বল ইতিপূর্বেই অবগত ছিল। জানা যাচ্ছে, ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে ছেঁড়া তার অভিনয় করে রংপুর জেলা সমিতি। তাতে পুত্রকন্যাসহ অভিনয় করেন আববাসউদ্দীন আহমদ।

ঢাকায় এসে সংবাদ সম্মেলনে বহুরূপীর পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছিলেন শম্ভু মিত্র। প্রাচ্যের নাট্যভাষা আবিষ্কারের যে নেশায় স্বাধীন বাংলাদেশ মেতে আছে, যে স্বাজাত্যবোধ থেকে বর্ণনাত্মক নাট্যরীতির উৎসে পৌঁছেছে, শম্ভু মিত্রের সেই ৫৮ বছর আগেকার বিবৃতিতে তার একটি স্পষ্ট রূপরেখা ছিল :

বহুরূপী ভালো করে ভালো নাটক করার উদ্দেশ্যেই গঠিত হয়। এই কাজ করতে গিয়ে আমরা অনুভব করি যে, আমরা নাটক করি পাশ্চাত্যের আদর্শে। পাশ্চাত্যের অনুকরণে মঞ্চ সাজাই, পাশ্চাত্যের অনুকরণে গল্প বানাই বা অভিনয় করি। অথচ পুরো প্রাচ্য মহাদেশে শিল্প প্রকাশের একটি বিশিষ্ট ভঙ্গি আছে, যেটা মোটেই পাশ্চাত্যের অনুকরণে নয়।… একথার দ্বারা আমরা কাউকে ছোট করতে চাইনে। আমরা শুধু বুঝতে চাই যে, আমাদের এই মহাদেশের শিল্প মানসে কোনো বিশেষ শিল্প রীতি আছে, যাকে শুদ্ধভাবে উপলব্ধি করবার চেষ্টা করলে আমাদের গভীর কথাগুলো একান্ত করে প্রকাশ করতে পারবো। কারণ পরের ধার করা ভাষায় ব্যবহারিক জীবনের মোটা কাজ হয়তো চালানো যায়, কিন্তু অন্তরের আবেগের যে বহু বর্ণ বৈচিত্র্য আছে তাকে ফুটিয়ে তোলা যায় না। তাই আমাদের এমন একটা থিয়েটার তৈরী করতে হবে, যেটা বিদেশীদের চতুর্থ শ্রেণীর অনুকরণ নয়, একেবারে আমাদের নিজস্ব এবং বিশিষ্ট থিয়েটার।

…তাই আমরা অনেক দিনই আশা করেছি যে, আমরা পূবর্ব পাকিস্তানে আমাদের নাটক নিয়ে আসবো। কারণ দেশজ সংস্কৃতির মূল এই পূবর্ব পাকিস্তানে গভীর ও বহুদিনজাত, এখানকার শিল্পীরা সেই ঐতিহ্য স্মরণ রেখে নতুন সংস্কৃতির রূপকার। এখানে মাটির গন্ধ জলের গন্ধ পূবের্ব যেমন লোকগাথায় প্রকাশ পেয়েছে আজও তেমনি পাচ্ছে এবং আরো ব্যাপকভাবে প্রকাশ পেতে চাচ্ছে।

আমরাও তাই আমাদের এই নাট্যবোধকে সেই দেশে যাচাই করে জানতে এসেছি যে আমরা ঠিকপথে কতোটা এগিয়েছি। কারণ এ কাজ আমাদের সকলের, প্রাচ্যের থিয়েটারকে উপলব্ধি করার, তাকে আজকের দিনের পরিপ্রেক্ষিতে রূপ দিয়ে নতুন করে সৃষ্টি করবার।

 

এ-কথা বলাই বাহুল্য, ১৯৫৭ সালের ঢাকায় নয়া আন্দাজের থিয়েটারের গাঙে জোয়ার আনেনি বহুরূপীর সফর। রক্তকরবী ও ছেঁড়া তারের চার-পাঁচটি অভিনয় জনমানসে কতটা ছাপ ফেলেছিল, নাট্যজনদের কতটা প্রাণিত করেছিল তার কোনো চটজলদি খতিয়ান আমাদের হাতে নেই। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি সংসদ বা ড্রামা সার্কেলের নাট্যচর্চার শুরুর দিকগুলিতে এ-ধরনের সফরের ইতিবাচক প্রভাব থাকবে এই অনুমান অলীক নয়। বিশেষত যখন মনে পড়ে যে, বহুরূপীর ঢাকা সফরের এক বছরের মাথায় ড্রামা সার্কেল রক্তকরবী প্রযোজনা করেছিল তখন এই মিথস্ক্রিয়ার স্পষ্ট আভাস মেলে।

খাতিরদারির পাশাপাশি একধরনের নজরদারিও যে ছিল তা টের পাওয়া যায়। সে-আমলের জনপ্রিয় দৈনিক সংবাদপত্র আজাদে ২০ মার্চ ১৯৫৭ একটি চিঠি বেরোয়। জনৈক আবদুল মজিদ তাতে লিখছেন :

 

জনাব সম্পাদক ছাহেব

সম্প্রতি কলকাতার বহুরূপী নাট্যগোষ্ঠিকে আমন্ত্রণ দিয়া আনা হইয়াছে, এর পূবের্ব আমন্ত্রণ খাইয়া গিয়াছেন শান্তিনিকেতনের শিল্পীরা। কই, কোন মুসলিম রাষ্ট্র হইতে এ জাতীয় কোন গোষ্ঠিকে আমন্ত্রণ জানাইয়া আনিতে দেখা যাইতেছে না কেন? মুসলমানে ও ইসলামে অরুচি ধরার গূঢ় মতলবটা কি? (বানান অপরিবর্তিত)

 

এ প্রসঙ্গে একটি কথার অবতারণা করি। প্রথমত, আমরা ১৯৫৭ সালের কথা বলছি। ইতিমধ্যে বাংলা ভাষার আত্মমর্যাদার দাবিতে বাহান্নর আন্দোলনে মথিত হয়েছে পূর্ব পাকিস্তান। ভাষাকে ভিত্তি করে একধরনের জাতীয়তাবোধ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ঢাকা ও এর সংলগ্ন অঞ্চলে। ফলত শান্তিনিকেতনের শিল্পীদের রবীন্দ্রসংগীত বা রাবীন্দ্রিক নৃত্যের উপস্থাপনায় শিল্পপিপাসুর আগ্রহ আছে, বহুরূপীর বাংলা নাটকেও আছে। কিন্তু প্রকারান্তরে রাষ্ট্র এ-ধরনের
আধা-সরকারি সাংস্কৃতিক বিনিময়কে সমর্থন করছে, এই ভাবনার সঙ্গে অনেকে সহমত ছিলেন না। ভারত ফলাও করে তার ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে আসছে। রবীন্দ্রনাথ হিন্দু ছিলেন না। শম্ভু মিত্র বা তাঁর শিল্পীবন্ধুরা প্রাতিষ্ঠানিক হিন্দুধর্মের ধ্বজা নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে আসেননি। ছেঁড়া তারে ষোলো আনাই মুসলমান সমাজের চিত্র। তবু একটি চালু খবরের কাগজের সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় এমন চিঠি যখন ছাপা হয়েছে, তখন বুঝতে হবে,শান্তিনিকেতন বা কলকাতায় অরুচির মোদ্দা জায়গাটা সাম্প্রদায়িক। এর সঙ্গে বাঙালি জাতীয়তাবোধের কোনো সম্বন্ধ নেই।

 

এবার স্বাধীন বাংলাদেশে

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় আধুনিক বাংলাদেশের পুরোধা নাট্যজনদের অনেকেই কলকাতায় যাতায়াত করেছেন। মামুনুর রশীদের মতো কেউ কেউ কর্মসূত্রে দীর্ঘকাল কলকাতায় থেকেছেন। ১৯৭১ সাল থেকে ক্যাথিড্রাল রোডের অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে ফি রবিবার অভিনয় শুরু করেছে বহুরূপী। এর পরপরই রঙ্গনাতে নিয়মিত অভিনয় শুরু করছে নান্দীকার। থিয়েটার অফ প্রোপাগান্ডার শিখর স্পর্শ করছেন উৎপল দত্ত। তারুণ্যের দীপ্তিতে সকলের নজর কাড়তে শুরু করেছে সুন্দরম, থিয়েটার ওয়ার্কশপ, চেতনা। কলকাতা মুখর হচ্ছে শম্ভু
মিত্র-উৎপল দত্ত-অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে। বাদল সরকার, মোহিত চট্টোপাধ্যায়, শ্যামল ঘোষ, অরুণ মুখোপাধ্যায়, মনোজ মিত্র, বিভাস চক্রবর্তীরা দ্রুত উঠে এসেছেন নাট্য মানচিত্রে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পর্বের তরুণ তুর্কিদের কাছে প্রবাসে দৈবের বশে শরণার্থী জীবনযাপনের এই নাটকীয় অভিজ্ঞতা এক চিরকালীন সম্পদ হয়ে থেকেছে। পরবর্তীকালে রামেন্দু মজুমদার, আতাউর রহমান, আলী যাকের, মামুনুর রশীদদের লেখালেখিতে তার ছাপ আছে। এই যোগাযোগের সূত্রেই একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমির আমন্ত্রণে বাংলা সাহিত্য সম্মেলনের মঞ্চে ঢাকায় আগমন ঘটে থিয়েটার ওয়ার্কশপের। এর কয়েক হপ্তার মাথায় ১৯৭৪ সালের মার্চ মাসে আবার বহুরূপী আসে ঢাকায়।

তখন ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের পালে হাওয়া লেগেছে। বহুরূপীর এই সফরেরও আয়োজক বুলবুল ললিতকলা একাডেমী বা বুলবুল একাডেমী অফ ফাইন আর্টস ওরফে বাফা। ৭ থেকে ১৪ মার্চ ১৯৭৪ অর্থাৎ লাগাতার সাতদিন ধরে ঢাকায় মঞ্চস্থ হলো বহুরূপীর প্রযোজনা। তবে বেইলি রোডের মহিলা সমিতি মিলনায়তনে বা পল্টনের ডিডিএওএ মঞ্চে নয়। ব্রিটিশ কাউন্সিল, ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্স্টিটিউট বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলিতেও নয়। নাট্যমঞ্চ হলো ওয়াপদা মিলনায়তন। মঞ্চস্থ হলো দুটি নাটক। অপরাজিতা (১৯৭১) আর পাগলা ঘোড়া (১৯৭১)। প্রথমটি চারবার, দ্বিতীয়টি তিনবার অভিনীত হলো। শম্ভু মিত্র এ দুটির কোনোটিতেই অভিনয় করতেন না। পাগলা ঘোড়া তাঁর নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হলেও তিন বছর আগে চোপ্?, আদালত চলছের পর তিনি নতুন কোনো প্রযোজনার হাল ধরেননি। দশচক্র, চার অধ্যায়, রাজা অয়দিপাউস, ডাকঘরের মতো পুরনো প্রযোজনাগুলিতে অভিনয় চালিয়ে গেলেও দলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ক্রমশ আলগা হয়ে আসছিল।

তবে কি শুধু পাগলা ঘোড়ার নির্দেশক হিসেবে ঢাকায় এসেছিলেন? না। এসেছিলেন বহুরূপীর কর্ণধার হিসেবে। ‘গ্রুপ থিয়েটার’ শিরোনাম নিয়ে যে নাট্য-আন্দোলন কলকাতার বুকে বিকাশের তুঙ্গ স্পর্শ করেছিল, ঢাকাতেও যার ঢেউ আছড়ে পড়েছিল, তার প্রতিভূ হিসেবে। আমাদের মনে পড়বে বহুরূপী স্থাপনার উদ্দেশ্যসংবলিত প্রচারপত্রের প্রথম চরণ – ‘আমরা ভালো নাটক অভিনয় করতে চাই, যে নাটকে সামাজিক দায়িত্বজ্ঞানের প্রকাশ ও মহত্তর জীবনগঠনের প্রয়াস আছে।’ গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের ধ্রুবপদ ছিল এই উচ্চারণ। কেবল কলকাতায় নয়, ঢাকাতেও।

বহুরূপী ততদিনে বাংলা ভাষায় নাট্যচর্চার একটি প্রবাদের নাম। আর এই প্রবাদের প্রণেতা শম্ভু মিত্র। স্বভাবতই সাড়া পড়েছিল ঢাকার বুদ্ধিজীবী মহলেও। বাঙালি জাতীয়তাবাদের
বিস্তারে বহুরূপীকে সদর্থক ভূমিকায় দেখতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজের বৃহত্তর অংশ। ‘স্বাগত বহুরূপী’ শীর্ষক একটি নিবন্ধে জামিল চৌধুরী লিখেছিলেন, ‘এই নাটক যাতে বহুসংখ্যক লোক দেখতে পান, তার জন্য অবশ্য আমাদের এখানকার নাট্যআন্দোলনের কর্মীদের ব্যবস্থা করতে হবে।’

‘বহুসংখ্যক লোক’ যাতে বহুরূপীর নাটক দেখতে পান, এই আগ্রহের একটি পশ্চাদভূমি ছিল। সে-আমলে ঢাকায় যাঁরা নাট্যনিবেদিতপ্রাণ ছিলেন তাঁদের কাছে শম্ভু মিত্রকে কাছ থেকে দেখা বা বহুরূপীর প্রযোজনা চাক্ষুষ করার আগ্রহ ছিল উত্তুঙ্গ। বাংলাদেশে ততদিনে টিকিট কেটে থিয়েটার দেখার চল হয়েছে। তবে বহুরূপীর প্রযোজনার প্রবেশমূল্য ছিল বেশ চড়া। ১০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১০০ টাকার মধ্যে। নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু এই আলোচককে জানিয়েছেন, ১০ টাকার টিকিট খরিদ করে তিনি ওয়াপদা মিলনায়তনে প্রবেশ করেছিলেন। রামেন্দু মজুমদার তস্য ভার্যা ফেরদৌসী মজুমদার সমভিব্যহারে বহুরূপীর প্রযোজনা দেখেছিলেন। কিন্তু গ্রুপ থিয়েটারের নবীন প্রজন্মের অনেক সেনানীই নেহাত অর্থনৈতিক কারণে এই সুযোগ পাননি। এ নিয়ে নাট্যশিল্পীদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছিল।

গণমাধ্যমও এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। ১৩ মার্চ ১৯৭৪ তারিখে দৈনিক ইত্তেফাকের ‘চিঠিপত্র’ বিভাগে জনৈক এইচ কে এস শামস উদ্দিন লিখেছিলেন, ‘আমাদের ধারণা, ইহার ফলে শুধু এখানকার সাধারণ দর্শকরাই বঞ্চিত হইবে না, বরং লেখক, নাট্যকার, নাট্যানুষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদেরও অনেকে বহুরূপীর বিখ্যাত নাটক দেখার সুযোগ পাইবেন না। অতঃপর আমাদের নাটকে যদি নূতনত্বের স্বাদ না থাকে, আমাদের নাটক কলিকাতার মানের ধারে কাছেও না যাইতে পারে, সেজন্য দায়ী থাকিবেন এইসব অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারাই।’

তবু কত মানুষ দেখেছিলেন সেইসব অভিনয়? ওয়াপদা মিলনায়তনে শুনেছি ৬০০ জনের স্থান সংকুলান হতো। প্রত্যেকটি অভিনয় পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে হয়েছে ধরে নিলে চার হাজারেরও বেশি মানুষ বহুরূপীর নাটক দেখেছিলেন, এ আমরা ধরে নিতে পারি। তারা কি প্রকৃতই বহুরূপীর প্রযোজনার রস-আস্বাদনের যোগ্য? এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ পেয়েছিল সংবাদমাধ্যমে। সিনেমা পত্রিকার ১৪ মার্চ ১৯৭৪ সংখ্যায় ‘নাট্যাভিনয় বা মিনাবাজার?’ শিরোনামীয় একটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন তাঁদের সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি। তাঁর আক্রমণের লক্ষ্য ছিল আয়োজক সংস্থা :

…বাফা কর্তৃপক্ষ স্বীকার করবেন কিনা জানি না, তবে সাম্প্রতিক নাট্যানুষ্ঠানটি তাঁদের নিজস্ব কোনো ব্যাপার ছিল না। বরং এর সাথে দেশের বৃহত্তর সাংস্কৃতিক দায়িত্বের প্রশ্নটি জড়িত।

কিন্তু বহুরূপীর নাটক দেখছে কারা? সেটাই এই মুহূর্তে ধূমায়িত হচ্ছে। এবং কোনো কোনো মহলে প্রচন্ড বিক্ষোভেরও আকার নিয়েছে এ প্রশ্নটি।

বাফা বহুরূপীর এই দুর্লভ অনুষ্ঠানগুলোতে দেশের কোন্ শ্রেণীকে সুযোগ দিয়েছেন? শোনা গেছে, গত এক সপ্তাহে ওয়াপদা মিলনায়তনে বিভিন্ন মডেলের গাড়ি, বিচিত্র বেশভুষা চর্চিত কেতাদুরস্ত নরনারী ইত্যাদি সব কিছু মিলিয়ে এক আকর্ষণীয় মীনাবাজারে পরিণত হয়েছিল। এই শ্রেণীর ড্রয়িংরুম সংস্কৃতিসেবীরাই ছিলেন ‘বহুরূপী’র নাটকগুলোর প্রধান দর্শক। পঞ্চাশ, একশত টাকার টিকিট অবলীলায় ক্রয় করে এরা কয়েকদিন এখানে অলস সন্ধ্যা কাটিয়েছে মাত্র। (বানান অপরিবর্তিত)

 

একই প্রতিবেদনে শম্ভু মিত্রকে উদ্ধৃত করে লেখা হয়েছিল, ‘দর্শকরা নাটক দেখে হাততালি দিচ্ছে, কিন্তু আমার সন্দেহ হয় এদের নাট্যানুরাগ সম্পর্কে।’ আয়োজক সংস্থার পক্ষে এমন শংসাপত্র স্বস্তিদায়ক হয়নি, এ না বলে দিলেও চলে! তবে সিনেমা পত্রিকা ওইদিন এই নাট্য-আয়োজনকে কেন্দ্র করে একটি রঙিন ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছিল। তাতে মিত্র দম্পতির পাতা জোড়া ছবিও ছাপা হয়েছিল। এছাড়া সংবাদের মতো প্রথম সারির দৈনিকে অভিনীত দুটি নাটকের চমৎকার সমালোচনাও বেরিয়েছিল।

অবশ্য বহুরূপীর সদস্যদের কাছে এই সফর ছিল তৃপ্তিদায়ক। শাঁওলী মিত্রের বইয়ে দেখছি ঢাকা সফরে গিয়ে ঢাকা বিমানবন্দরে বহুরূপীর সদস্যদের ছবি। সাদা ধুতি-পাঞ্জাবিতে উজ্জ্বল শম্ভু মিত্রের পাশে সাহেবি পোশাকে দাঁড়িয়ে তৎকালীন রাষ্ট্রদূত সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। জানা যাচ্ছে, ৭ মার্চ ১৯৭৪ উদ্বোধনী সন্ধ্যায় প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী খোন্দকার মোশতাক আহমদ। এসেছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন, ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার সুবিমল দত্ত। এর দুদিনের মাথায় ৯ মার্চ, শনিবার ঢাকার জাতীয় প্রেস ক্লাবে বহুরূপীকে সংবর্ধনা দিয়েছিল আয়োজক ঢাকা স্টুডেন্টস ইউনিয়ন ওরফে ডাকসু।

১০ মার্চ, রবিবার বাংলাদেশ দূরদর্শন থেকে চলচ্চিত্রায়িত হয় তৃপ্তি মিত্র নির্দেশিত ও অভিনীত নীতিশ সেনের নাটক অপরাজিতা। ফেরদৌসী মজুমদার নানান জায়গায় বলেছেন, অপরাজিতার এই প্রযোজনা দেখে একক অভিনয়ে আকৃষ্ট হয়েছিলেন তিনি। থিয়েটারের অবিস্মরণীয় প্রযোজনা কোকিলারাতে ফেরদৌসীর আশ্চর্য অভিনয়ের পটভূমি জুড়ে ছিল অপরাজিতার স্মৃতি। তবে এ-কথা স্বীকার্য যে, থিয়েটার ওয়ার্কশপের চাকভাঙা মধু ও রাজরক্তের মঞ্চায়ন যেভাবে বাংলাদেশের নাট্যজনদের আলোড়িত করেছিল, পাগলা ঘোড়া ও অপরাজিতার মঞ্চায়ন সেভাবে তাঁদের তাড়িত করেনি। এর প্রথম ও প্রধান কারণ, উপভোক্তাকুলের চরিত্র। পাগলা ঘোড়া বহুরূপীর সবচেয়ে মঞ্চসফল প্রযোজনা। এর নাটককার বাদল সরকারও ইতিপূর্বে বাংলাদেশে আদৃত। কিন্তু থিয়েটারওয়ালাদের নাগালের বাইরে থেকে গেলে তার আদর হয় কীভাবে?

বহুরূপীর কাছে এই ঢাকা সফরের পরম প্রাপ্তি এসেছিল ১০ মার্চ, রবিবার। সেদিন সকালে ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে যায় বহুরূপী। ঘটনাটি তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত, সরকারি দাওয়াত পেয়ে বহুরূপী ঢাকায় আসেনি। দ্বিতীয়ত, ইতিপূর্বে বঙ্গবন্ধু কোনো সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীকে তাঁর নিজস্ব বাসভবনে আমন্ত্রণ জানাননি। তৃতীয়ত, যে অভ্যর্থনা তিনি করেছিলেন তা অত্যন্ত আন্তরিক এবং সশ্রদ্ধ ছিল। এর স্মৃতি আজো বহুরূপীর প্রবীণদের মনে গাঁথা আছে।

পাগলা ঘোড়া প্রযোজনার প্রধান অভিনেত্রী হওয়ার সুবাদে এই সফরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন শাঁওলী মিত্র। পিতার জীবনীগ্রন্থে তিনি লিখছেন, ‘তবে সবচেয়ে যে-ঘটনা দাগ কেটেছিল তার (শাঁওলীর) মনে, তা হলো, বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের আবাসে যাবার দুর্লভ সৌভাগ্য। কোনও রাষ্ট্রনেতার বাড়িতে যে এমন অবাধে চলে যাওয়া যায়, এ ঘটনা তাকে যুগপৎ বিস্মিত ও বিহবল করেছিল। শোনা গেল বঙ্গবন্ধু নিমন্ত্রণ জানিয়েছেন সবাইকে। হ্যাঁ! সবাইকে মানে সবাইকেই! শম্ভু মিত্র থেকে শুরু করে যাঁরা শিফটার, তাঁদের পর্যন্ত! এই ঘটনাটাই তো এত ভালো, এত মন-ভরানো যে বলবার নয়। সেবার বহুরূপী থেকে কুড়িজনের একটি দল গিয়েছিল ঢাকায়। সেই কুড়িজন মিলেই যাওয়া হলো সেই ধানমন্ডির বিখ্যাত বাড়িতে। সাদাসিধে দোতলা বাড়ি। সামনে পোর্টিকো মতো। গাড়ি থেকে নামামাত্র সেই ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব বারান্দা থেকে নেমে গাড়ির কাছে এসে জড়িয়ে ধরলেন শম্ভু মিত্রকে। তাঁর লম্বা-চওড়া চেহারা, দরাজ হাসি যেন আজো খুব কাছ থেকে অনুভূত হয়! জড়িয়ে ধরতে ধরতে বলেছিলেন, ‘আমি প্রোটোকল-টোটোকল মানি না!’ আবার হাসি। বলছিলেন, ‘আপনি তো আমাগো জামাই!’ তৃপ্তির ঠাকুরগাঁও তো বাংলাদেশের অন্তর্গত! তাই ওই শব্দের ব্যবহার! তারপরে সাদরে সবাইকে বসার ঘরে নিয়ে বসানো। এমন কিছু বড়ো নয় সে-ঘর। বেশ ঘেঁষাঘেঁষি করেই বসতে হলো সবাইকে। খাবারে ছিল মূলত ফল। কোনো আড়ম্বর লক্ষিত হয়নি কোথাও। ছিল অন্তহীন আন্তরিকতা। কী আশ্চর্য যে লেগেছিল।’

১২ মার্চ ১৯৭৪। ইত্তেফাক লিখেছিল, ‘কলিকাতা হইতে আগত বহুরূপী নাট্য গোষ্ঠীর পরিচালক মিঃ শম্ভু মিত্র এবং মিসেস তৃপ্তি মিত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের জন্য গত রবিবার সকালে তাঁহার ধানমন্ডির বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন। তাঁহাদের সঙ্গে বহুরূপী নাট্য গোষ্ঠীর অন্যান্য শিল্পীও উপস্থিত ছিলেন।’

বহুরূপীর অন্দরমহলে কান পাতলে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, শুধু ঢাকা নয়, বাংলাদেশের অন্যান্য শহরেও বহুরূপীকে অভিনয় করতে হবে। আরো অনেক দিনের জন্যে আসতে হবে। সরকার আমন্ত্রণ জানাবে। শম্ভু মিত্র সম্মত হয়েছিলেন। অনুরোধ করেছিলেন, নাট্য সরঞ্জামের মসৃণ যাতায়াতের ব্যবস্থা করে দিলে বহুরূপীর আরও সুবিধা হবে।

এর পরের বছর বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যা এই প্রকল্পকে উদ্যোগপর্বেই বিনষ্ট করে। তবু ঢাকায় শম্ভু মিত্রের আগমনের এই দুই অধ্যায় দুই পড়শী দেশের সাংস্কৃতিক বিনিময়ের দুই পর্বের দুই মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হওয়ার দাবি রাখে। n

 

(২০ মার্চ ২০১৫ তারিখে ‘দ্বিতীয় ঢাকা আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব ও নাট্য সংলাপে’র অঙ্গ হিসেবে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর সেমিনার রুমে উপস্থাপিত বক্তৃতার পরিমার্জিত রূপ)

 

Leave a Reply