logo

ঢাকায় ইয়োরোপীয়দের সমাধিভূমি : জানা-অজানা

শা মী ম আ মি নু র র হ মা ন
১৬ মার্চ ১৮৯২, বিকেলবেলা। ঢাকার আহসান মঞ্জিল প্রাঙ্গণ লোকারণ্য। আমন্ত্রিত দেশি ও ইয়োরোপীয় অতিথিরা মঞ্জিলের ছাদে আসন নিয়েছেন। বুড়িগঙ্গার দুই ধারে ও নদীতীরবর্তী দালানগুলোর ছাদে মানুষের প্রচন্ড ভিড়। নদীতে নৌকায়ও অনেকে অবস্থান নিয়েছে। ঢাকার আকাশে মানুষ ওড়ার ঘটনা দেখার জন্য ঢাকাবাসী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। ওইদিন ঢাকার নবাব আহসান উল্লাহর আমন্ত্রণে ঢাকার আকাশে বেলুনে চড়েছিলেন এক মার্কিন নারী – জিনেট ভ্যানতাসেল। জিনেট বেলুনের সাহায্যে প্রায় ছয় হাজার ফুট উচ্চতায় পৌঁছানোর পর প্যারাস্যুট দিয়ে ঝাঁপ দিয়ে মাটিতে নেমে আসতে থাকেন। বাতাসের বেগ থাকায় জিনেট ভাসতে ভাসতে দূরে শাহবাগের নবাবের বাগানবাড়ির কাছে এসে পড়েন। সেখানে একটি ঝাউগাছে তাঁর প্যারাস্যুট আটকে যায়। প্যারাস্যুটের একটা অংশ ধরে মাটির পনেরো থেকে বিশ ফুট ওপরে ঝুলতে থাকেন জিনেট। কয়েকটি বাঁশ একসঙ্গে বেঁধে তার সাহায্যে জিনেটকে নিচে নামিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়। বাঁশ বেয়ে নিচে নেমে আসার সময় খুলে যায় বাঁশের বাঁধন। মাটিতে পড়ে মাথায় আঘাত পান তিনি। প্রায় অচেতন অবস্থায় জ্বরে ভুগে ১৮ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন বাংলাদেশের আকাশে ওড়া প্রথম মানুষ জিনেট ভ্যানতাসেল।
ঢাকার আকাশে ওড়ার ওইদিনটি ছিল রোমাঞ্চকর, ঘটনাবহুল ও বিষাদময়। এ ঘটনা ঢাকাবাসীকে যথেষ্ট নাড়া দিয়েছিল। জিনেট আমাদের আকাশজয়ের ইতিহাসের সূচনা করেছিলেন। তাঁকে সমাহিত করা হয় ঢাকার বিখ্যাত নারিন্দার খ্রিষ্টান সমাধিতে। এটা দীর্ঘদিন আমাদের অগোচরে ছিল।
২২ নভেম্বর ১৮৫৭। ইংরেজ সেনা ও স্বেচ্ছাসেবকেরা কাকডাকা ভোরে লালবাগ দুর্গে আক্রমণ চালায়। সে সময় সেপাইদের বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছিল ভারতের নানা শহরে। এর আগে ১৮ নভেম্বর চট্টগ্রামের দেশি সেপাইরা বিদ্রোহ করে ব্যারাক থেকে বেরিয়ে যায়। লালবাগ দুর্গের দক্ষিণ প্রান্ত ঘেঁষে বইত বুড়িগঙ্গা। ইংরেজ সেনারা দক্ষিণ গেট ও পূর্ব দিকের দেয়ালের কয়েকটি ভাঙা অংশ দিয়ে লালবাগ দুর্গে ঢুকে সেপাইদের ওপর আক্রমণ চালায়। শুরু হয় মরণপণ যুদ্ধ। যুদ্ধে প্রায় চল্লিশজন সেপাই ও পাঁচজন ইংরেজ সেনা নিহত হয়। নিহত পাঁচ ইংরেজ সেনাকে নারিন্দার সমাধিতে সমাহিত করা হয়। 

জিনেট ভ্যানতাসেল বা ওই পাঁচ ইংরেজ সেনার মতো ঢাকার নানা ঘটনা ও ইতিহাসের নানা অধ্যায়ে যেসব ইয়োরোপীয় কুশীলবের ভূমিকায় ছিলেন, তাঁদের অনেকেই ঢাকায় সমাহিত হয়েছিলেন। ১৯৪৭-এর পর এদেশ থেকে ইংরেজরা চলে গেলেও নানা স্থাপত্যে এবং সে-সময়ের সমাধিতে তাঁদের স্মৃতিচিহ্ন বা স্মারক রেখে গেছেন, যা ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে টিকে আছে।
ঢাকায় ইয়োরোপীয়দের আগমন ঘটে সতেরো শতকের প্রথম ভাগে। ব্যবসার উদ্দেশ্যে প্রথমে পর্তুগিজ এবং পরে ওলন্দাজ, ফরাসি, আর্মেনিয়ান, গ্রিক ও ইংরেজরা ঢাকায় আসেন। বাণিজ্যের পাশাপাশি ধর্ম প্রচারের জন্য এসেছিল মিশনারি। এসব ইয়োরোপীয় গড়ে তুলেছিলেন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, কারখানা, কুঠি, উপাসনালয়। পরে তাঁরা কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তাঁদের অনেকে ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। বংশপরম্পরায় থেকে যান দীর্ঘদিন। ঢাকার নানা কর্মকান্ডের সঙ্গে তাঁরা নিজেদের সম্পৃক্ত করেন। ঢাকাতেই অনেকে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁদের সমাহিত করা হয়েছে প্রধানত ঢাকার তেজগাঁও, আরমানিটোলা বা নারিন্দায়। ঢাকায় টিকে থাকা সমাধিগুলোর মধ্যে ওয়ারীর সমাধিটি প্রধান। এটি নারিন্দার বিখ্যাত বলধা গার্ডেনের বিপরীতে। আরমানিটোলার আর্মেনিয়ান চার্চের আঙিনায় এবং তেজগাঁও চার্চের প্রাঙ্গণেও ইয়োরোপীয়দের সমাধিভূমি রয়েছে।

নারিন্দার সমাধিভূমি
সম্ভবত সতেরো শতকের প্রথম দিকে এই সমাধিক্ষেত্র গড়ে ওঠে। কারণ, তখন থেকেই ঢাকায় পর্তুগিজদের আগমন ঘটেছিল। এখানে খ্রিষ্ট সম্প্রদায়ের জন্য এই সমাধিভূমির পাশেই ঢাকার প্রথম গির্জা প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর অবস্থান ওয়ারীতে বলধা গার্ডেনের বিপরীতে রাস্তার ওপারে। দক্ষিণ দিকে তিন রাস্তার সংযোগস্থলে এর প্রধান প্রবেশদ্বার। দুই পাশে দুটি পুরনো গেট হাউসের মতো শেড বা কুঠুরি আছে। ভেতরে ঢুকে সমাধির মধ্য দিয়ে সোজা পায়ে হাঁটা পথ ধরে গেলে এর শেষ প্রান্তে একটি প্রাচীন ভারতীয় রীতিতে তৈরি প্রবেশদ্বার চোখে পড়বে। এই পায়ে হাঁটা পথের শুরু ও শেষ প্রান্তে মিশেছে বাঁদিকের আরো দুটি পায়ে চলা পথ। ঢাকার সঙ্গে সম্পর্কিত ব্রিটিশরাজ তো বটেই, তারও আগে থেকে অনেক ইয়োরোপীয়র সমাধি ছড়িয়ে আছে এখানে। সরকারি চাকুরে, যাজক, সৈনিক, নাবিক, বিচারক, ডাক্তার, ব্যবসায়ী, জমিদার, সাধারণ নারী ও শিশুসহ নানা পেশার মানুষের কবর রয়েছে এখানে। এসব দেখে বোঝা যায়, তাঁরা নিজেদের দেশের বাইরে এখানেও তাঁদের একটি নতুন সমাজ গড়ে তুলেছিলেন। এক নীরব, স্থির, স্মৃতিকাতর পরিবেশে ছড়িয়ে আছে নানা স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত সমাধি ও বিচিত্র সব এপিটাফ। পথের দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে লম্বা সরু গাছ। রোদে তার ছায়া পড়ে পথ আর কবরগুলোর ওপর তৈরি হয়েছে সুনসান এক আধিভৌতিক পরিবেশ।
সমাধিগুলোতে পাওয়া প্রায় সব এপিটাফই কলকাতায় তৈরি। সতেরো শতকের প্রথম দিকে এই সমাধিভূমি গড়ে উঠলেও এখানে পাওয়া সবচেয়ে প্রাচীন সমাধিফলক বা এপিটাফটি ১৭২৫ সালের। কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা জোব চার্নক ১৬৯০-এর পরে কলকাতায় ঘাঁটি গেড়েছিলেন। সুতরাং ধরে নেওয়া যায়, এর পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ আঠারো শতকের এপিটাফগুলোই এখানে পাওয়া গেছে। আগের সমাধিগুলো সম্ভবত সাধারণ মানের ছিল, তাই সেগুলো টেকেনি। আবার এমনও হতে পারে যে, স্থানীয়ভাবে পাথরের এপিটাফ তৈরির সুযোগ কম ছিল বা ছিল না। সে কারণে এপিটাফ নির্মিতই হয়নি। ফলে সতেরো শতকের প্রাচীন সমাধিগুলো চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি কিংবা সাধারণ মানের হওয়ায় এ পর্যন্ত রক্ষা পায়নি।
তবে সতেরো শতকের প্রথমার্ধ থেকেই যে এখানে সমাধি ও গির্জা ছিল, অনেক যাজক বা পর্যটকের বিবরণে তার প্রমাণ মেলে। পাদরি সেবাস্তিয়ান মানরিক ঢাকায় আসেন ১৬২৪ থেকে ১৬২৯ সালের মধ্যে। তখন তিনি এখানে গির্জা দেখেছেন। পর্তুগিজ অগাস্টানিয়ানরা এটি তৈরি করেছিল। সে আমলে পর্তুগিজসহ বেশ কিছু ইয়োরোপীয় ঢাকায় বসবাস করত। ১৬৩২ সালে পর্তুগিজদের দৌরাত্ম্য ও উদ্ধত আচরণের কারণে সম্রাট শাহজাহানের নির্দেশে তাদের উৎখাত করে হুগলিতে পাঠানো হয়। সম্রাটের সঙ্গে একাত্মতা প্রদর্শনের জন্য নারিন্দার গির্জার যাজক ফাদার বেরনার্দোকে প্রহার করে হত্যা করা হয় ১৬৩২ সালে। ধরে নেওয়া যায়, তাঁকে এখানেই সমাহিত করা হয়েছিল। ফরাসি পরিব্রাজক জ্যঁ বাপ্তিস্ত তাভারনিয়ে ১৬৬৬ সালে এবং এর পরপরই নিকোলো মেনুচি ঢাকা সফর করেন। তাঁরা দুজনই এখানকার গির্জার কথা উলে�খ করেছেন। ১৭১৩ সালে ফাদার অ্যান্থনি বারবিয়ের ঢাকার এই গির্জা পরিদর্শন করেন। ১৭৮৯-এ বাংলার অগাস্টানিয়ানদের গির্জার যে তালিকা তৈরি হয়েছিল, তাতে নারিন্দার গির্জার উলে�খ পাওয়া যায়নি। তাই ধরে নেওয়া যায়, ১৭১৩ থেকে ১৭৮৯-এর কোনো এক সময়ে গির্জাটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। খুব সহজেই বোঝা যায়, বর্তমান সমাধিক্ষেত্রটি ছিল প্রকৃত অর্থে সেই গির্জাসংলগ্ন সমাধিক্ষেত্র বা চার্চ গ্রেভইয়ার্ড। পুরনো বিবরণ পাঠ ও বর্তমান স্থানটি পর্যবেক্ষণ করলে ধারণা করা যায়, ভেতরে মুসলিম রীতিতে নির্মিত গেটটি দিয়ে সমাধিভূমিতে প্রবেশ করতে হতো। পুরো সমাধিক্ষেত্রটি ছিল প্রাচীরঘেরা। এখনকার ভূমির ধরন ও সমাধির অবস্থান দেখে বোঝা যায়, গির্জাটি ছিল বর্তমান নতুন গেট দিয়ে ঢুকতেই ডান দিকের খালি সবুজ চত্বরের কোনো অংশে, যার একটি অংশ নিচু জলাশয় বা পুকুর ছিল। এখানে সমাধির তেমন কোনো চিহ্ন দেখা যায় না। সম্ভবত পুকুরটির পাশেই ছিল গির্জাটি। এই সবুজ চত্বরে মাটির নিচে প্রাচীন ইটের চিহ্ন দেখা যায়। তাতে মনে হয়, এখানে খননকাজ চালালে গির্জাটির ভিত্তির অস্তিত্ব হয়তো পাওয়া যাবে।
প্রথম অবস্থায় নারিন্দার সমাধিক্ষেত্রটি আয়তনে ছিল ছোট এবং ভারতীয় স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত ভেতরের গেটটির পেছনে দেয়ালঘেরা, অর্থাৎ পুবদিকে বিস্তৃত ছিল, যার বর্ণনা হেবার দিয়েছিলেন। সম্ভবত সতেরো দশকের মাঝামাঝি তা আরো প্রসারিত হয়ে উত্তরে ও উত্তর-পশ্চিমে বিস্তৃতি লাভ করে। ১৮২৪ সালের ২২ জুলাই বিশপ হেবার এই গোরস্থান পবিত্রকরণ অনুষ্ঠান সমাপন করেন। তাঁর লেখায় সে-সময়ের এই গোরস্থানের বর্ণনা রয়েছে :
চারদিকে জলাজঙ্গল। গোরস্থানে ঢোকার জন্য আছে একটি মুরীয় স্থাপত্যের ফটক। চারদিকে উঁচু প্রাচীর। গোরস্থানটি বেশ বড় কিন্তু কবরের সংখ্যা খুব কম… কিছু কিছু সমাধি বেশ সুন্দর। একটির কথা উলে�খ করছি। সমাধিটি মুসলমান পীর-ফকিরের কবরের ওপর যে ধরনের স্থাপত্য গড়ে তোলা হয়, ঠিক সে ধরনের উঁচু গথিক টাওয়ার। একই ধরনের ক্যাপুলা ও আটটি জানালা। বেশিরভাগ কবরের স্মৃতিফলক আইভীলতায় গেছে ঢেকে এবং অনেকগুলো পিপুলগাছের শেকড়ের জন্য ধ্বংসের পথে। আশপাশের জলাজঙ্গলে মাহুতসহ ঘুরে বেড়াচ্ছে কিছু হাতি। পুরো দৃশ্য এতটা বন্য যে, কোনো ড্রইং করতে পারলাম না বলে আফসোস হচ্ছে।
হেবার উল্লেখ করেছিলেন কয়েকটি কবরের কথা। কলকাতার কোম্পানির চ্যাপলিন রেভারেন্ড জোসেফ পেজেট এই ঢাকাতেই ২৬ মার্চ ১৭২৪ সালে ছাবিবশ বছর বয়সে মারা যান। উলি�খিত সমাধিটি হচ্ছে এখানকার সবচেয়ে পুরনো কবর, যা এখনো টিকে আছে।
ওয়ান্সি কোঁয়া নামের একজন চীনা খ্রিষ্টানের সমাধি রয়েছে, যিনি ১৭৯৬ সালের ৪ সেপ্টেম্বর মারা যান। তাঁর সমাধি-স্থাপনা গড়ে দেন তাঁর চীনা বন্ধু ওয়ানা চৌ। তবে এই সমাধিক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ও আকর্ষণীয় সমাধি হচ্ছে হেবারের উল্লিখিত মুসলিম রীতিতে করা সমাধিটি, যা আজো বিস্ময় জাগায়। হেবার ১৮২৪ সালে এ সমাধি পরিদর্শনকালে এই গোরস্থানের দারোয়ান এটিকে জনৈক ‘কলম্বো’ সাহেবের কবর বলে উল্লেখ করেন, যিনি ‘কোম্পানিকা নওকর’ অর্থাৎ কোম্পানিতে কর্মরত ছিলেন। কলম্বো সাহেব কে ছিলেন, তা রহস্যময়। উল্লিখিত এই টাওয়ার বা সমাধিগৃহে তিনটি কবর রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকবার এটি পরিদর্শন করেছি। তিনটি কবরের কোনোটাতেই এপিটাফ দেখিনি। ছিল এমন কোনো চিহ্নও সেখানে নেই। সেই কবরগুলোকে এখন পুরনো ধসে যাওয়া ভাঙা ইট-সিমেন্ট দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। ১৯১৭ সালে প্রকাশিত বেঙ্গল পাস্ট অ্যান্ড প্রেজেন্ট, ভলিউম ১৫-তে ওয়াল্টার কে. ফারমিঙ্গারের একটি নিবন্ধ আছে, শিরোনাম ‘সাম ওল্ড গ্রেভস অ্যাট ঢাকা’। ওই নিবন্ধে ফারমিঙ্গার স্টেপ্ল্টনের করা নারিন্দার কবরের যে তালিকা দিয়েছেন, সেখানেও কলম্বো সাহেবের পরিচয় নেই। তবে এই সমাধিভূমিতে ব্রিটিশ কোম্পানির কুঠির চাকুরে হিসেবে অনেকের সমাধি বা পরিত্যক্ত সমাধিফলক পেয়েছি। একটি নাথানিয়েল হলের সমাধিফলক। তিনি ১৭২৫-এর ১৩ সেপ্টেম্বর মারা যান। অপর সমাধিটি নিকোলাস ক্লেরেম বল্টের। বল্ট ১৬ নভেম্বর ১৭৫৫ সালে মারা যান। তাঁদের কেউ যে কলম্বো সাহেব নন, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়। কারণ, তাঁদের এপিটাফ এই সমাধিগৃহে পাওয়া যায়নি। তবে ঢাকা বিশেষজ্ঞ মুনতাসীর মামুন তাঁর এপিটাফ-সম্পর্কিত লেখায় স্টেপ্ল্টনের তালিকা থেকে উলে�খযোগ্য কয়েকজন সমাহিত ব্যক্তির নামের যে তালিকা দিয়েছেন, তাতে একজনের নাম উল্লেখ করেছেন – তিনি কলম্বো সাহেব (১৭২৮)।

স্টেপ্ল্টনের তালিকা আমার দেখার সুযোগ হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ষিত বেঙ্গল পাস্ট অ্যান্ড প্রেজেন্টের সেই কপিতে স্টেপ্ল্টনের তালিকাযুক্ত লেখাটির পাতাগুলো কেউ কেটে নিয়ে গেছে। স্টেপ্ল্টন কি উলি�খিত কলম্বো সাহেবের নাম এভাবেই পেয়েছিলেন? যদি পেয়েই থাকেন এবং সালটি যদি ১৭২৮ হয়ে থাকে, তবে এই এপিটাফের হদিস নেই। কারণ, সমাধিগৃহের ভেতরের দেয়ালে যে কয়টি এপিটাফ পেয়েছি, তাতে কলম্বো সাহেবের নাম নেই। সমাধিগৃহের দেয়ালে মোট পনেরোটি এপিটাফের সন্ধান পেয়েছি। এছাড়া আরো দুটো এপিটাফ ছিল, যার চিহ্ন রয়েছে কিন্তু হারিয়ে গেছে মূল এপিটাফ।
সমাধিগৃহের দেয়ালে প্রাপ্ত পনেরোটি এপিটাফের কোনোটিই কলম্বো সাহেবের নয়। হারিয়ে যাওয়া অন্য দুটি কলম্বো সাহেবের না-ও হতে পারে। কারণ, সৌধের ভেতরে চারটি প্রবেশপথের পাশের দেয়ালে গৌণ স্থানেই ছিল এ দুটোর অবস্থান। সমাধিটি যদি মূলে কলম্বো সাহেবের জন্য তৈরি হয়ে থাকে, তবে তা অন্তত গুরুত্বপূর্ণ অংশে স্থাপন করা হতো। উল্লেখ্য, সমাধিগৃহের অভ্যন্তরে পাশাপাশি তিনটি কবর রয়েছে। ভেতরে পনেরোটি এপিটাফের মধ্যে ছয়টি আঠারো শতকের আর আটটি উনিশ শতকের (১৭৪৬-১৮৬৯)। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি উল্লেখ করছি। ঢাকা ওলন্দাজ কুঠির প্রধান উইলিয়াম কার্কম্যানের (১৩ এপ্রিল ১৭৭৪) এপিটাফ রয়েছে এখানে। সম্ভবত ঢাকায় এটিই ওলন্দাজদের সবচেয়ে পুরনো এপিটাফ। স্টেপ্ল্টনের তালিকা এবং ১৮৮১ ঢাকার এক কমিশনার অফিসের নবিশ অনন্তকুমার নাগের করা একটি তালিকায় আরেক ওলন্দাজ কুঠির প্রধান ড্যানিয়েল ল্যাঙ্কহিটের এপিটাফ নারিন্দার সমাধিক্ষেত্রে খুঁজে পাইনি। ড্যানিয়েল ল্যাঙ্কহিট ১৭৭৫ সালে মারা যান। তাঁর এপিটাফ সম্ভবত চুরি হয়ে গেছে। ইংরেজদের মতোই এখানে ব্যবসা করতে এসেছিল ওলন্দাজরা। এখন যেখানে মিটফোর্ড বা সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ, ওলন্দাজদের কুঠি ছিল সেখানে। এছাড়া রয়েছে ঢাকা মিলের এমজি গ্লসের শিশুকন্যা এলিজা হেরিয়েট গ্লস। এলিজা মারা যায় ১৮৩৭ সালের ১৪ মে।

ঢাকার ইতিহাসপ্রেমীরা ঢাকা মিল বা মিল ব্যারাকের কথা জেনে থাকবেন। বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত এই ঢাকা সুগার ওয়ার্কস কোম্পানির চিনিকলটি ১৮৫০-এর পর কোনো একসময় উইলিয়াম ফলি কিনে নিয়ে ময়দার কল করেছিলেন। ১৮৫৭ সালে ভারতের সিপাহি বিদ্রোহের সময় ঢাকার সম্ভাব্য দেশি সেপাইদের বিদ্রোহ দমনে কলকাতা থেকে আসা সরকারি সেনাদের একটি অংশকে এই দালানে রাখা হয়েছিল। মিলটি কিনে নেয় সরকার এবং ১৮৬৭ সালের এক নির্দেশে এই মিল ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলকে ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে ঘোষণা করে। বর্তমানে এটি ব্যবহার করছে বাংলাদেশ পুলিশ।
সমাধিগৃহের অভ্যন্তরে সবচেয়ে দীর্ঘ এবং বড় যে স্মৃতিফলকটি পেয়েছি, সেটি বারবাদোসে জন্মগ্রহণকারী এজেকিয়েল বেকের। তিনি ১৭৯১ সালের ৩০ মার্চ সাঁইত্রিশ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। বেকের সমাধিফলকে উৎকীর্ণ লেখা থেকে জানা যায়, তিনি সাঁইত্রিশ বছর বয়সে দেশীয় এক ক্ষমতাসীন ব্যক্তির কোপানলে পড়ে তাঁর ক্ষমতার শিকার হন। বেক ব্যবসা করতেন সিলেটে। সিলেটের কালেক্টর জে উইলস বেকের ব্যবসার পতন ঘটান এবং তাঁকে সিলেট ছাড়তে বাধ্য করেন। বেকের প্রতি যে অভিযোগের ইঙ্গিত রয়েছে, তাতে মনে হয়, দুর্নামগ্রস্ত মানুষজনকে তিনি তাঁর ব্যবসায় নিয়োগ দিয়েছিলেন। সিলেট থেকে উৎখাতের পর শোকে মুহ্যমান বেক বেশিদিন বাঁচেননি। উল্লেখ্য, বেকের ফলকটি রয়েছে গৃহের অভ্যন্তরে প্রবেশ তোরণের ওপরে। এই সমাধিগৃহের সামনেই রয়েছে নারিন্দায় পাওয়া সবচেয়ে পুরনো জোসেফ পেজেটের কবর। এই সমাধিতে স্টেপ্ল্টনের তালিকায় উল্লিখিত ইংরেজ কুঠির ফ্যাক্টর নাথানিয়েল হল (১৩ সেপ্টেম্বর ১৭২৫), কোম্পানির রাইটার চার্লস ওয়াটকিন্স (২৫ জুন ১৭২৬) ও ভারতের প্রথম সার্ভেয়ার জেনারেল ও ভূগোলবিদ জেমস রেনেলের শিশুকন্যা জেনের সমাধি না পেলেও তাদের এপিটাফ পেয়েছি। সম্প্রতি সমাধিক্ষেত্রের পেছনের দেয়ালসংলগ্ন সদ্য নির্মিত একটি পাকা মেঝে ও দেয়ালে পেয়েছি আরো কিছু এপিটাফ।
জেনের এপিটাফটি এখনো অরক্ষিত অবস্থায় সমাধিক্ষেত্রে ঢোকার মূল ফটকসংলগ্ন প্রহরীর ঘরের পাশে মাটিতে পড়ে আছে। ওই ঘরের পাশে আজো টিকে আছে বেঙ্গল আর্মির মেজর জেনারেল হ্যামিলটন ভেচের সমাধি। ১৮৭৫ সালে তোলা নারিন্দার সমাধিভূমির দুটো আলোকচিত্র আছে ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে। একটিতে রয়েছে মুসলিম রীতিতে তৈরি প্রাচীন গেটটির ছবি। তাতে গেটের পেছনে সে সময়ের পুরনো অনেক সমাধির যে অস্তিত্ব পাই সেগুলো আজ আর নেই। দ্বিতীয় ছবিটিতে বিখ্যাত কলম্বো সাহেবের সমাধির আশপাশে ও তার দক্ষিণে যে সমাধিগুলো দৃশ্যমান, তারও কোনো অস্তিত্ব নেই এখন। কলম্বো সাহেবের সমাধির দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব অংশে ঐতিহাসিক পুরনো কবর ধ্বংস করে নতুন কবরের সংস্থান করা হয়েছে। এসব কবরের কিছু কিছু এপিটাফ পরবর্তী সময়ে কলম্বো সাহেবের সমাধিসৌধের ভেতরে দেয়ালে সেঁটে দেওয়া হয়েছে।
সমাধিগুলোর ধ্বংসের কাজ হয়েছে বিভিন্ন সময়ে, বিশেষ করে স্বাধীনতার পর ধ্বংস হয়েছে বেশি এবং এখনো হচ্ছে। বেশ কিছু পূর্ণ বা আংশিক এপিটাফ সমাধিক্ষেত্রের পেছনের দেয়ালে ও মেঝে, এমনকি পায়ে হাঁটা পথের ওপর প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। ঢাকার বিখ্যাত বিচারক শেরম্যান বার্ড জুনিয়রের সমাধিফলকসহ বেশ কয়েকটি সমাধিফলক পেয়েছি পায়ে হাঁটা পথের ওপর। শেরম্যান বার্ডের দুটি প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন ঢাকায় বিখ্যাত শিল্পী জর্জ চিনারি, শেরম্যানের স্ত্রী মিসেস বেস্ট শেরম্যানেরও একটি প্রতিকৃতি পাওয়া যায়। শেরম্যান বার্ড ১৮২৪ সালের ৪ অক্টোবর একচল্লিশ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর এপিটাফে তাঁর ব্যক্তিত্বের দীর্ঘ বর্ণনা আছে। বিশাল সেই স্তবগান।
‘As a son, a brother, a husband, father and a friend. He was a bright example of duty, affection, strength of principle, and unshaken fidelity. As a public officer of government, zealous, conscientious and just. His heart replete with goodness was regulated by a mind strong by nature and highly cultivated by education. His converse with this world contaminated not his genuine worth and bodily sufferings, to which he was too often prone, purified his soul, for its reception in the realms of bliss.’
সম্ভবত সে-সময়ের সম্ভ্রান্ত বা বিখ্যাত ব্যক্তির বেলায় এটা স্বাভাবিক ছিল। এখানে বেশ কয়েকটি এপিটাফ আছে, যেগুলো বেশ বর্ণনামূলক, অর্থাৎ সেখান থেকে সমাহিত ব্যক্তির জীবনের উলে�খযোগ্য ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়, অনুধাবন করা যায় তাঁর ব্যক্তিত্ব। যেমন শেওয়েন দম্পতি ও তাঁদের শিশুসন্তানের এপিটাফ। স্ত্রী রেবেকা শেওয়েন ১৭৬৬ সালের ৭ জানুয়ারি শিশুসন্তান আর্থারের জন্মের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মৃত্যুবরণ করেন। তখন তাঁর বয়স বাইশ বছর। এর আট মাস সাত দিন পর, সে বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর মারা যান শোকে মুহ্যমান স্বামী উইলিয়াম শেওয়েন। শিশুপুত্র আর্থারও বাঁচেনি, এই দম্পতির সঙ্গে তাকেও সমাহিত করা হয়।
আরেক সম্ভ্রান্ত নারী এন্টোনিয়া ফ্যালকনারের এপিটাফের কথা বলি। তিনি এ ফ্যালকনারের স্ত্রী। এন্টোনিয়া তাঁর দাদা দ্য ব্যারোন আয়রন ওয়ার্কসের প্রতিষ্ঠাতা বিখ্যাত ড. রকবাক ও তাঁর পিতার স্কটল্যান্ডের লিনলিথগোর কাছে কিনিয়েল প্রাসাদে ১৭ অক্টোবর ১৭৮৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ভাই ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যক্ষ ক্যাপ্টেন থমাস রকবাকের সঙ্গে তিনি ভারতে আসেন। ১৮২০ সালের ৩ জুন কলকাতায় তাঁর বিয়ে হয়। ঢাকায় ১৮ মার্চ ১৮২১ সালে সন্তান প্রসবকালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর শিশুসন্তানকে তাঁর সঙ্গেই সমাহিত করা হয়। নিচের লাইনটি দিয়ে স্মৃতিফলকটি শেষ হয় : ‘কোন মানুষ তার মতো এত ভালবাসা নিয়ে ও শোকাহত করে মৃত্যুবরণ করেনি।’ সেই এপিটাফে এন্টোনিয়ার ব্যক্তিত্বের বর্ণনা এভাবেই করা হয়েছে :
‘A lady who possessed the highest endowments of mind, and the sweetest charm of manners, and every elegant accomplishment of art & task & genius; but who was above all inestimable for the benevolence of her heart, and the exuberant tenderness & purity of her affections.’
এন্টোনিয়া ফ্যালকনারের এপিটাফটি ছিল ভাঙা এবং পায়ে হাঁটা পথের ওপর গাঁথা।
আরেকটি এপিটাফের উল্লেখ করছি। রবার্ট কার্টিস বাউয়েন পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে ২৮ ডিসেম্বর ১৮৫৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর একমাত্র পুত্রসন্তান মারা যায় এক বছর নয় মাস পাঁচ দিন বয়সে, ১৬ অক্টোবর ১৮৫০ সালে। তাঁর দ্বিতীয় কন্যা ইসাবেলা লুইসা তিন বছর দুই মাস পনেরো দিন বয়সে ২৯ ডিসেম্বর ১৮৫৫ এবং কনিষ্ঠ মেয়ে এলেন সোফিয়া এগারো মাস বয়সে ৯ জুলাই ১৮৫৬ মৃত্যুবরণ করে। শোকাহত স্ত্রী ও মা এই এপিটাফ গড়ে দিয়েছিলেন। এমন বহু এপিটাফ আছে, যার ভেতর দিয়ে এদেশে ইয়োরোপীয়দের একটি সমাজ গড়তে শিশু ও নারীদের কী বিরাট মূল্য দিতে হয়েছিল সে চিত্রটি সহজেই অনুভব করা যায়। দীর্ঘ বর্ণনামূলক এই এপিটাফগুলো প্রকৃত অর্থে সামাজিক ইতিহাসের এক অমূল্য উপাদান। পায়ে চলা পথে সমাধির পেছনের দেয়ালের গায়ে ও পাকা ভূমিতে উন্মুক্ত যেসব স্মৃতিফলক বা এপিটাফ পেয়েছি, তার একটি ফরাসি পিটার ব্রিলার্ডের। ফ্রান্সের পিকার্ডির অধিবাসী ব্রিলার্ড ঢাকা শহরের একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি ভারতে দশ বছর অবস্থান করেছিলেন। ১৮৩২ সালের ৮ জুন ঊনষাট বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। সমাধিটি গড়ে দিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী এলিজাবেথ ব্রিলার্ড।
কলম্বো সাহেবের সমাধির কাছেই রয়েছে একটি ডাবল টুম্ব বা দুটি সংযুক্ত কবর। কবর দুটির একটি ইংরেজ কুঠির প্রধান চৌত্রিশ বছর বয়সী রবার্ট ক্রফার্ড (মৃত্যু ২৭ আগস্ট ১৭৭৬) এবং অন্যটি তাঁর স্ত্রী এলিজাবেথ ক্রফার্ডের (মৃত্যু ২২ জুন ১৭৭৬)। দুই মাসের ব্যবধানে তাঁরা মৃত্যুবরণ করেন। পেছনের মেমোরিয়াল ওয়ালের কাছে একজন বাঙালি বিচারকের (সাব-অর্ডিনেট জজ) কবর খুঁজে পেয়েছি। তিনি প্রাণনাথ ব্যানার্জি, এমএবিএল; মৃত্যু ১২ ডিসেম্বর ১৮৯৭। এখানেই আরো একটি এদেশীয় খ্রিষ্টান পরিবারের কয়েকটি সমাধি পেয়েছি। (সম্ভবত ইয়োরোপীয়)

মুনতাসীর মামুনের লেখায় বা স্টেপ্ল্টনের তালিকায় ঢাকায় সিপাহি যুদ্ধে নিহত সৈনিকদের যে স্মারকস্তম্ভের উলে�খ রয়েছে, যতদূর মনে পড়ে, ১৯৮২ সালের দিকে সেটি আমিও দেখেছি। সেটি ছিল সম্ভবত এখনকার প্রধান দরজা দিয়ে ঢুকতে বাঁদিকে সরু যে রাস্তাটি চলে গেছে, তার শুরুতেই। সেখানে এখনো একটি স্মারকস্তম্ভ টিকে আছে, কিন্তু স্মৃতিফলকটি চুরি হয়ে গেছে। সন্দেহ করি, এটিই সেই স্মারকস্তম্ভ। মুনতাসীর মামুন দুজনের কথা লিখেছেন। আসলে এখানে দুজন নয়, পাঁচজন সেপাই সমাহিত হন। তাঁদের সবার জন্য একটিই স্মারকস্তম্ভ গড়া হয়েছিল। এই পাঁচজনের নাম সংরক্ষিত ডেথ রেজিস্টারে পাওয়া যায়। তাঁদের একজন হেনরি স্মিথ ২২ নভেম্বর যুদ্ধের দিন নিহত হন। যুদ্ধে আঘাতপ্রাপ্ত সেনা নেইল ম্যাকমুলেন ও জেমস মুরস ২৩ নভেম্বর এবং উইলিয়াম এসডেন ও রবার্ট ব্রাউন ২৪ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।
এখানেই রয়েছে ঢাকার বিখ্যাত আর্মেনি পোগোজ পরিবারের জমিদার জোয়াকিম গ্রেগরি নিকোলাস পোগোজ ও তাঁর ছেলে পলের সমাধি। জমিদার জে জি এন পোগোজ ১৮৪৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা ব্যাংকের একজন পরিচালক ছিলেন। ১৮৭৪ সালে তিনি ঢাকা পৌরসভার কমিশনারও হয়েছিলেন।
ওই সারিতে আরেকটি কবর চোখে পড়বে। সেটি ঢাকার বিখ্যাত গ্রিক ব্যবসায়ী মারকার ডেভিডের স্ত্রী এলিজাবেথের। সমাধিটির ওপরে রয়েছে পাথরের তৈরি মেরির মূর্তি। একটি শিশুর সমাধি আছে। ওর নাম ক্রিস্টিনা উইহেলসিনা কাপ। ১৯০৭ সালে তার মৃত্যু হয়। সাদা পাথরের তৈরি ক্রসের নিচে কারুকার্যসংবলিত অংশে বিড়ালসহ একটি শিশুর রঙিন প্রতিকৃতি ছিল, যা পাথরের পাতলা প্লেটে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি। ভিন্ন ধরনের এই অপূর্ব এপিটাফটি আমি ১৯৮২ সালেও দেখেছি। দুর্ভাগ্য, ক্রসটি ভেঙে ফেলা হয়েছে এবং বোঝা যায় যে ছবিটি খুলে নেওয়ার সময় সেটিও ভেঙে ফেলা হয়েছে। ক্রিস্টিনার সমাধির চারদিকে উৎকীর্ণ রয়েছে কয়েকটি চরণ।
‘A bud the gardener gave me
A sweet and lovely child
He gave it to our keeping
To cherish undefilled.’
নারিন্দায় প্রচুর সমাধিফলকের অধিকাংশই ধ্বংসপ্রাপ্ত বা বিলুপ্ত। এই অংশে শুধুমাত্র কয়েকটি টিকে থাকা উল্লেখযোগ্য সমাধির বর্ণনাতেই সীমাবদ্ধ থাকতে হলো।

আর্মেনিয়ান সমাধিভূমি
ঢাকার নারিন্দার সমাধিক্ষেত্রের পরই উল্লেখযোগ্য হলো আর্মেনিয়ান গির্জাসংলগ্ন সমাধিভূমি। আর্মেনিয়ানরা ঢাকায় আসে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে। উদ্দেশ্য ব্যবসা-বাণিজ্য। প্রায় দুই শতক ধরে ব্যবসায় তারা ঢাকায় যথেষ্ট উন্নতি করেছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লবণের ঠিকাদারি এবং পাট, কাপড় ও পানের ব্যবসায় তারা অর্জন করে প্রভূত অর্থ ও প্রতিপত্তি। জমিদারিও কিনেছেন কেউ কেউ। ঢাকায় শিক্ষার প্রসারে তাঁদের অবদান কম নয়। ঢাকার বিখ্যাত পোগোজ স্কুলটি তাঁদেরই গড়া। ১৭৮১ সালে আরমানিটোলায় নির্মিত গির্জাটি বাংলাদেশের একমাত্র আর্মেনি গির্জা। এই গির্জার প্রাঙ্গণেই আছে আর্মেনিদের সমাধিভূমি। ঢাকার প্রভাবশালী কয়েকটি আর্মেনি পরিবার হলো পোগোজ, আরাতুন, কোজা, মাইকেল, মানুক, হার্নি ও সার্কিস। এসব পরিবারের অনেক সদস্যকেই এই গির্জা প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়। ঢাকার আর্মেনি গির্জা নির্মাণের আগে এখানে ছোট উপাসনালয় ছিল। আঠারো শতকের শুরুতে এখানে মৃত ব্যক্তিদের সমাহিত করা শুরু হয়।
এই সমাধিতে বিভিন্ন সূত্রে সবচেয়ে পুরনো যে কবরটির উল্লেখ পাওয়া যায়, তা ব্যবসায়ী কোজা থোমানিয়ানের। তিনি ১৭৪৬ সালে মারা যান। কবরটি খুঁজে পাইনি। এখানে খুঁজে পাওয়া সবচেয়ে পুরনো কবর পারসাদানের মেয়ে ও মাইকেলের স্ত্রী গুল্টাটিকের। গুল্টাটিক ১৭৬২ সালে মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকার বিখ্যাত আর্মেনীয় পরিবার পোগোজ, সার্কিস, আরাতুন, মানুকসহ ঢাকার গ্রিকদেরও কিছু কবর এখানে রয়েছে। বিখ্যাত পোগোজ পরিবার ঢাকায় যথেষ্ট পরিচিত। জমিদার ও ঢাকার পৌরসভার কমিশনার জে জি এন পোগোজের (নারিন্দায় সমাহিত) দাদা এন এম পোগোজ ও বাবা জি এন পোগোজ, মা এলিজাবেথ সার্কিস এখানেই সমাহিত। এখানে সমাহিত নিকোলাস পিটার পোগোজ বা পোগোজ স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা এন পি পোগোজ। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন তাঁর ঢাকা স্মৃতি-বিস্মৃতির নগরীতে উলে�খ করেছেন :
পোগজ ঢাকায় কবে এসেছিলেন, বা তাঁর জন্ম কোথায় এবং কখন, তা জানা যায়নি। তবে অনুমান করা হয়, পরলোকগমন করেছিলেন তিনি ১৮৭০ সালে। মৃত্যুর আগে চলে গিয়েছিলেন লন্ডনে। এবং যাওয়ার আগে বোধ হয় তাঁর অস্থাবর সম্পত্তি/জমিদারি একটি ট্রাস্ট করে দিয়েছিলেন। একটি বিজ্ঞাপনে দেখি, ১৮৮৩ সালে এন পি পোগজ ট্রাস্ট কলকাতায় পোগজের বগুড়া ও পাবনায় জমিদারিসমূহ নিলামে উঠিয়েছে।
এন পি পোগোজ ৭ নভেম্বর ১৮৩০ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ঢাকাতেই মৃত্যুবরণ করেন ২৫ অক্টোবর ১৮৭৬ সালে। তিনি পোগোজ স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা; প্রথম থেকেই তিনি স্কুলটির জন্য আর্থিক সহায়তা করে যাচ্ছিলেন। স্কুলের প্রথম হেডমাস্টারও তিনি। কলকাতার পত্রিকা সংবাদ পূর্ণেন্দ্রোদয় ৩ জুন ১৮৫২ সংখ্যায় লিখেছে, ‘ইনি (এন পি পোগজ) স্বীয় অপ্রাপ্তবয়স্ক সময় পৈতৃক বিত্ত হইতে আত্মভরণ পোষণার্থে যে কিঞ্চিৎ অর্থপ্রাপ্ত হইতেন তাহা হইতে কর্তন করিয়া কিছু কিছু বিতরণ দ্বারা এ পর্যন্ত এই পাঠশালায় ব্যয় নির্বাহ করিয়া আসিয়াছেন…।’ উল্লেখ্য, স্কুলটির প্রতিষ্ঠাকাল ১৮৪৮, এ সময় এন পি পোগোজের বয়স মাত্র সতেরো-আঠারো বছর, যা পত্রিকাটির ভাষ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। ১৮৭৪-৭৫ সালে ঢাকা পৌরসভার দুজন আর্মেনি কমিশনার ছিলেন। একজন এন পি পোগোজ ও অপরজন বিখ্যাত জমিদার ব্যবসায়ী জে জি এন পোগোজ। সুতরাং, এন পি পোগোজ ঢাকাতেই মৃত্যুবরণ করেন, তবে ১৮৭০ নয়, ১৮৭৬ সালের ২৫ অক্টোবর। জমিদার জে জি এন পোগোজ দুই মাস পরই ৩ ডিসেম্বর ১৮৭৬ সালে মারা যান। নারিন্দায় এখনো তাঁর কবর টিকে আছে। উল্লেখ্য, এন পি পোগোজের স্ত্রী মেরি পোগোজ ১৮৭০ সালে ও জে জি এন পোগোজের স্ত্রী মেরিয়াম আবদাল ১৮৯৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন। দুজনেরই মৃত্যু হয় কলকাতায়।
প্রকৃতপক্ষে ১৮৫১ সালে জে জি এন পোগোজের (মা এলিজাবেথ সার্কিস) মামাতো বোন মারিয়াম সার্কিসকে বিয়ে করেন এন পি পোগোজ। উল্লেখযোগ্য ব্যবসায়ী মাইকেল সার্কিসের কবর এই সমাধিসৌধেই পাওয়া গেছে। মাইকেল সার্কিসের জন্ম ১৮৩৩ সালে, আর্মেনিয়ার সামাখিতে। নারায়ণগঞ্জে ছিল তাঁর ব্যবসা। সেখানেই ১ আগস্ট ১৮৯৭ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। তিনি ঢাকায় সমাহিত হন। সিলেটের চা-বাগানের মালিক জেমস ফিনলে তাঁর ব্যবসা কিনে নেন।
নারিন্দা গোরস্থানে মেরির মূর্তিসহ এলিজাবেথের সমাধির কথা নিশ্চয়ই মনে আছে আমাদের। এলিজাবেথের স্বামী ছিলেন মার্কার ডেভিড। তাঁর জন্ম ইরানে। তিনি ছিলেন প্রধানত পাটের ব্যবসায়ী। তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নাম এম ডেভিড অ্যান্ড কোম্পানি এবং বেঙ্গল রিভার সার্ভিস। ডেভিডের ব্যবসা কিনেছিলেন বিখ্যাত রণদাপ্রসাদ সাহা। ডেভিডের নয় সন্তানের তিনজনই ঢাকার আর্মেনিয়ান চার্চের আঙিনায় সমাহিত। ডেভিড অবশ্য পরে লন্ডনে চলে যান। ১৮৯৩ সালে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।
আরেক মাইকেল সার্কিসের গল্প বলি। এই মাইকেল অবশ্য স্টিফেনোজ পরিবারের সদস্য। তিনি এসেছিলেন আর্মেনিয়ার জুলফা থেকে। এখানেই তাঁর ও তাঁর স্ত্রী মারিয়াম খানুমের কবর রয়েছে পাশাপাশি। মাইকেল সার্কিস ১৭৯০ সালে আটান্ন বছর বয়সে এখানে মৃত্যুবরণ করেন। মাইকেল গড়েছিলেন অগাধ সম্পত্তি। সেই সম্পত্তি কয়েক পুরুষ ধরে ভোগ করার মতো বিশাল। এ দম্পতির কোনো সন্তান নেই। সবাই তা-ই জানে। এদিকে আর্মেনিয়ায় তাঁর আত্মীয়স্বজন জেনে গেছে যে, মাইকেলের দিন বদলে গেছে। তিনি অগাধ সম্পত্তির মালিক। তাই তাঁর এক চাচাতো বোন সুজ্যান তাঁর স্বামীসহ হাজির হলেন ঢাকায়, যদি ভাইয়ের আশ্রয়ে ভালোভাবে জীবনযাপন করা যায়। এর কিছু পরে এলেন মাইকেলের আরেক চাচা মার্টিরোড টার স্টিফেনোজ। উদ্দেশ্য একই। মাইকেল তাঁদের হতাশ করলেন না। তাঁদের তিনি ভালোভাবেই গ্রহণ করলেন। ঢাকায় বসবাসের বাড়ি, খাওয়াদাওয়াসহ তাঁদের জন্য সব ধরনের ব্যবস্থাই করলেন। কিন্তু মাইকেল বুড়ো ও দুর্বল হয়ে পড়লে ভাবলেন, কে ভোগ করবে তাঁর এই বিপুল সম্পদ। তিনি সবাইকে অবাক করে হঠাৎ করেই নতুন কথা শোনালেন। ঢাকার বিচারক মি. ডগলাসের উপস্থিতিতে ঘোষণা করলেন, প্রকৃতপক্ষে স্থানীয় এক মুসলিম রক্ষিতার গর্ভে আরাতুন মাইকেল নামে তাঁরই এক ছেলেসন্তান রয়েছে। তিনি চান, আরাতুন মাইকেলকে যেন তাঁর বৈধ সন্তান হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়।
এরপর মাইকেল সার্কিস বেশি দিন বাঁচেননি। আরাতুন, মি. স্টিফেনোজ ও সুজ্যান যৌথভাবে মাইকেলের সম্পত্তির জিম্মাদার হিসেবে দেখভাল করতে লাগলেন। মি. স্টিফেনোজও মৃত্যুর সময় আরাতুনকে তাঁদের পরিবারেরই বৈধ সদস্য হিসেবে সম্পত্তির তাঁর অংশের পরিচালনা ও ভোগ করার সকল ক্ষমতা দিয়ে যান। কিন্তু সুজ্যান ১৮০৩ সালে একটি উইল করলেন, যাতে আরাতুন ইচ্ছা করলে তাঁর অংশ, অর্থাৎ যা তিনি দেখভাল করছিলেন, তা গুটিয়ে ফেলতে পারেন। ১৮০৭ সালে সুজ্যান তাঁর নাতনি হানায়ির স্বামী এভিয়েটিক টার স্টিফেনোজের পক্ষে সম্পত্তি উইল করে দিলেন। শুরু হয়ে গেল মামলা, যা বছরের পর বছর চলেছিল। আদালত সুজ্যানের দ্বিতীয় উইলকে বৈধ ঘোষণা করলে আরাতুন মাইকেল নিজেকে প্রতারিত মনে করলেন। ঘটনার এখানেই শেষ নয়। মাইকেল সার্কিস নিঃস্ব অবস্থায় এদেশে এসে পরিশ্রম ও কষ্টের মাধ্যমে বিশাল সম্পত্তি গড়ে তোলেন। সেই সম্পদ গ্রাস করার লোভ এদের কতদূর চালিত করতে পারে, তা বোঝার জন্য আর একটু অপেক্ষা করতে হবে।
বিষয়টিকে আরো জটিল করার জন্যই যেন ১৮৩৫ সালে হঠাৎ করে সুজ্যানের নাতনি জামাই এভিয়েটিক টার স্টিফেনোজ মৃত্যুবরণ করলেন। এই স্টিফেনোজের একমাত্র সন্তান ছিল গ্যাব্রিয়েল টার স্টিফেনোজ। গ্যাব্রিয়েল প্রকৃতপক্ষে এভিয়েটিকের অবৈধ সন্তান। লক্ষ্মী নামের এক মুসলিম দাসীর গর্ভে তাঁর জন্ম। লক্ষ্মী পরে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করে টাকোই নাম ধারণ করেন। অবৈধ সন্তান সম্পত্তি পাবে না, তাই গ্যাব্রিয়েল তাঁর মায়ের সঙ্গে মিলে মিথ্যা উইল তৈরি করেন এবং টাকোই তাঁর স্বামীর অনেক সম্পত্তি কিনেছিলেন বলে আদালতের শরণাপন্ন হলেন। টাকোই ও এভিয়েটিকের সম্পর্ক কখনো আনুষ্ঠানিক বা বৈধ ছিল না এবং জমাকৃত উইল যে মিথ্যা এবং দাবিকৃত সম্পত্তি কেনার মতো অর্থ কোনোভাবেই তার পক্ষে অর্জন করা সম্ভব নয় বিবেচনা করে আদালত তাঁর ও তাঁর সন্তান গ্যাব্রিয়েলের দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। গল্পটা কিন্তু এখানেও শেষ হলো না।
মাইকেল সার্কিসের ছেলে আরাতুন মাইকেল দুটো বিয়ে করেছিলেন। আরাতুনের প্রথম স্ত্রী জারিপ খানের ছিল তিন সন্তান। এদিকে দ্বিতীয় স্ত্রী মারিয়ামের কোনো সন্তান ছিল না। আরাতুনের মৃত্যুর পর মারিয়াম এডমন্ড কেন্ট হিউমকে বিয়ে করলেন। ফলে প্রথম স্ত্রীর সন্তানেরা মারিয়ামের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিলেন। মারিয়াম স্বামীর মৃত্যুর পর বিয়ে করেছেন এবং যেহেতু আরাতুনের ঔরসে তাঁর গর্ভে কোনো সন্তানের জন্ম হয়নি, তাই আরাতুনের প্রথম স্ত্রীর সন্তানদের দাবি, মারিয়াম আরাতুনের সম্পত্তির কোনো ভাগ পেতে পারেন না। মারিয়ামের নতুন স্বামী অবশ্য আশা ছাড়লেন না। এডমন্ড আদালতে গেলেন। আরাতুনের দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে মারিয়ামের নামে যদি আরাতুনের সম্পদে কিছুটা ভাগ বসানো যায়, তো মন্দ কী। এদিকে জানা যাচ্ছে, মারিয়াম দুবার নয়, মোট তিনবার বিয়ে করেছিলেন। প্রথম স্বামী মার্টিরোজ টার কালুজ।
গ্যাব্রিয়েল ও টাকোইয়ের কথা বলেছিলাম, যাঁদের মিথ্যা উইল আদালত প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এবার তাঁদের কথা দিয়ে শেষ করব। গ্যাব্রিয়েলের ছিল তিন মেয়ে। এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে হেনরি পরিবারে। ঢাকার লুকাস নামে গ্রিক পরিবার ছিল। এই পরিবারের থিওডোর লুকাস ভাবলেন, গ্যাব্রিয়েলের তো অনেক সম্পত্তি পাওয়ার কথা। সুতরাং গ্যাব্রিয়েলের ভূসম্পত্তি ও এস্টেট থেকে অর্জিত টাকা বৈবাহিকসূত্রে প্রাপ্তির আশায় তাঁর বাকি দুই কন্যাকেই বিয়ে করে বসলেন। গ্যাব্রিয়েল তো আদালতে হেরে গিয়ে তাঁর পিতার সম্পত্তি কিছুই পাননি। ফলে মনে হয় হতাশ হয়ে পড়েন লুকাস। লুকাসের ভাগ্যে কিছু প্রাপ্তি হয়েছিল কি না, জানতে পারিনি। তবে লুকাস আরো একটি বিয়ে করেছিলেন বরিশালে, ১৮৬৩ সালে। কন্যার নাম হ্যারিয়েট অ্যানড্রিনা র্যাাবান। লুকাস ১৮৮৮ সালে বরিশালে মৃত্যুবরণ করেন এবং সেখানেই সমাহিত হন। এই গল্পের এখানেই শেষ।
এখানে সমাহিত এক দম্পতির কথা বলি। সেনেকেরিম টি এম হাইকাজোনি ও তাঁর স্ত্রী ক্যাথেরিন এস টি এম হাইকাজোনি যথাক্রমে ১২ জুন ১৮৯৭ ও ৩০ জুন ১৮৯৭ মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকার ইতিহাস বিষয়ে যাঁরা খোঁজখবর রাখেন, তাঁদের কাছে ১২ জুন ১৮৯৭ বেশ পরিচিত একটি দিন। সেদিন বিকেল পাঁচটা ১৫ মিনিটে কী হয়েছিল, তা ঢাকার নবাব আহসান উল��হ তাঁর নিজের রোজনামচায় লিখেছিলেন :
একটু পরেই ভূমিকম্প শুরু হলো। আমি বাড়ির দিকে যাচ্ছিলাম, রবারগাছের কাছে পৌঁছালে দালানের কার্নিশ ভেঙে পড়তে লাগল, আমি সেখানেই সেজদায় পড়ে গেলাম এবং স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের আগমন পর্যন্ত ওখানে সেজদায় রইলাম। এ রকম ভূমিকম্প আজ পর্যন্ত আর হয়নি।
১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পের মাত্রা অনুমান করা হয় রিখটার স্কেলে ৭ থেকে ৮-এর মধ্যে। এর মাত্রা ছিল প্রবল। ১২ জুনের পরও প্রায় দুই মাস ঢাকায় মৃদু ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় আর্মেনিয়ান চার্চ, সেন্ট থমাস চার্চ, সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ ভবন, ইডেন ফিমেল স্কুল, ইম্পিরিয়াল সেমিনারি, নবাববাড়িসহ বেশ কয়েকজন স্থানীয় ব্যক্তির বাড়ি। ভাওয়ালের রাজার ঢাকার বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বিচ্যুত হয় ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথ ও বিভিন্ন স্থানে গভীর গর্ত ও ফাটল দেখা দেয়। ঢাকা প্রকাশ (৩১ জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৪-৭ আষাঢ় ১৩০৪) পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ তুলে ধরছি :
জজ ম্যাজিস্ট্রেট প্রভৃতি সাহেবদিগের অধিকাংশ বাড়ি বাসের অনুপযুক্ত হইয়াছে। নবাব (আহসান উল্লাহ) পুত্রের (সলিমুল্লাহ) শাহীন মেডিকেল হল নামক ঔষধালয়টি একেবারে চূর্ণ হইয়াছে। তাহার দ্বিতলে হাইকোজানি নামধেয় আর্ম্মানী সাহেবেরা সপরিবারে ছিলেন। ১টি সাহেব ও ১টি মেম তখনই মরিয়াছেন। ৩টি মেম মুমূর্ষু একটি মেমের জীবনের কোন আশঙ্কা নাই। নাজিরের মঠের পতনে তন্মধ্যেস্থিত একটি বেশধারী সন্ন্যাসীর ও দুইটি ধোবার মৃত্যু হইয়াছে। প্রায় ৫ শত বাড়ি একেবারে নষ্ট ও ৮ হাজার বাড়ির কোন না কোন ক্ষতি হইয়াছে।
আহত এক মহিলা পরে মৃত্যুবরণ করেন। উল্লিখিত এই আর্মেনি দম্পতির কবর এই সমাধিভূমিতেই রয়েছে পাশাপাশি।
এই আর্মেনিয়ান চার্চের আর্চবিশপ পল ৫৫ বছর বয়সে মারা যান ১৮৩৪ সালে। এখানে তাঁর সমাধিটি উল্লেখযোগ্য।
সমাধিতে রয়েছে গ্রিক লুকাস ও আলেক্সান্ডার পরিবার, আর্মেনীয় পরিবার, মানুক, লাগারাস, হেনরিসহ নানা পদবির নানা পরিবারের সদস্যদের কবর। এখানে পাওয়া সবচেয়ে বয়স্ক মানুষের কবরটি হচ্ছে ইরানের সিরাজে জন্মগ্রহণকারী এভিয়েট টার গ্রেগরি। তিনি মারা যান ১৮৬২-এর ৯ মে, ১০৮ বছর বয়সে। স্বাধীনতার পরও যে বহু আর্মেনীয় ঢাকায় বসবাস করছিলেন, অনেক এপিটাফেই তার প্রমাণ মেলে। যেমন আর্চিবাল্ড মানুক ১৯৭৬ সালে মারা যান। আর্মেনি চার্চের আঙিনায় কবরের ওপর তেমন কোনো সৌধ গড়া হয়নি, নারিন্দায় যেমনটি করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বৈচিত্র্য শুধু একটিতে। তা হচ্ছে গির্জার মূল গেট দিয়ে ঢুকে সামনে এগিয়ে গেলেই প্রথমেই একটি মেরির মূর্তিসহ কবর চোখে পড়বে। কবরটি ক্যাটচিক এভেটিক টমাসের। টমাস ৫৬ বছর বয়সে ২৪ সেপ্টেম্বর ১৮৭৭ মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর শোকাহত স্ত্রী তাঁকে ‘বেস্ট অব হাজবেন্ড’ হিসেবে উলে�খ করেছেন। মেরির মূর্তির ডান হাত ভেঙে গেছে বা ভেঙে ফেলা হয়েছে। তবে প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও নারিন্দায় মেরির মূর্তিটি যেভাবেই হোক এখনো টিকে আছে।
আরেকটি এপিটাফের কথা বলি। আরাতুন গ্রেগরি সাইমন ১৭৮৯ সালের ২০ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। মৃত্যু ঢাকায়, ১ ডিসেম্বর ১৮৫৯। তাঁর স্ত্রী ছিলেন ওভসানা। তাঁদের চার মেয়ে। দুই মেয়ে সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়নি। সম্ভবত অল্প বয়সেই তাঁরা মারা গেছেন। বাকি দুজন মেরি সাইমন ও হ্যানা সাইমন। বড় হ্যানার জন্ম ১৮৩৭ সালে কলকাতায়, মেরি জন্মেছিলেন ঢাকায় ১৮৪৯ সালে। কে এই আরাতুন? ঢাকার এক আরাতুন খুব বিখ্যাত। সেই আরাতুন ছিলেন জমিদার ও শৌখিন। দক্ষিণ শাহবাজপুর (ভোলা) ও ময়মনসিংহের হোসেন শাহি পরগনায় ছিল তাঁর জমিদারি। ফরাশগঞ্জের বিখ্যাত রূপলাল হাউসের আদি বাড়িটি ছিল আরাতুনের। পরে ব্যবসায়ী রূপলাল দাস সম্ভবত সেটি কিনে নিয়ে কলকাতার বিখ্যাত মার্টিন কোম্পানিকে দিয়ে পুনর্নির্মাণ করান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি ভবনের পাশে আণবিক শক্তি কমিশন এলাকায় আরাতুনের বাগানবাড়ি ছিল। তিনি ঘুড়ি আর পায়রা ওড়াতে এবং মোরগের লড়াই দেখতে ভালোবাসতেন। তাই ঢাকাবাসী তাঁকে শৌখিন আরাতুন বলে ডাকত। আরাতুনের মৃত্যুর পর দুই মেয়েই জমিদারি বিক্রি করে কলকাতায় চলে যান।

১৮৪০ সালে লন্ডনে প্রকাশিত প্যানারোমা অব ঢাকাতে এক আরাতুনের বাড়ি দেখানো হয়েছে। তাঁর নাম এ এইচ আরাতুন। এ আরাতুনের বাড়িই হচ্ছে এখনকার রূপলাল হাউস। কিন্তু এই নামে কোনো এপিটাফ আর্মেনিয়ান চার্চের সমাধিভূমিতে পাইনি, পেয়েছি আরাতুন গ্রেগরি সাইমনের এপিটাফ। সমস্যা হলো, অন্য পদবিধারী পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও আরাতুন নামটি পেয়েছি।
আর্মেনিয়ান গির্জার সমাধি অঙ্গনের একটি বিশেষ দিক তুলে ধরতে চাই। সম্ভবত এর আগে এ বিষয়টি কোথায়ও উল্লিখিত হয়নি। এই অঙ্গনের মূল গেট দিয়ে ঢুকে এগিয়ে যেতে হাতের ডান দিকে সমাধিক্ষেত্রসংলগ্ন নিচু দেয়াল দিয়ে আলাদা করা আগাছায় প্রায় পূর্ণ অবহেলিত একখন্ড সবুজ ভূমি চোখে পড়বে। এখানে একটু যত্ন নিয়ে খুঁজলে সম্ভবত তিনটি কবরের সন্ধান পাওয়া যাবে। এগুলোর সমাধিফলক লুকানো রয়েছে সবুজ ঘাসের মধ্যে। এসব সমাধিফলক সম্পর্কে কোথাও কোনো উল্লেখ নেই। বর্তমানে এই গির্জা ও চত্বর দেখভাল করেন আর্মেনিয়ান ফাদার মার্টিন। আলাপকালে তিনি জানান, সে-সময় যেসব আর্মেনিয়ান আত্মহত্যা করেছিলেন, তাঁদের ওখানেই সমাহিত করা হয়েছিল। আত্মহত্যা করা পাপ, সেই বিবেচনায় ধর্মীয়ভাবে এসব সমাধিকে সুনজরে দেখা হতো না। তাই এই অপয়া সমাধিগুলো আলাদা করে রাখা হয়েছিল। অযত্নে তা আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়।
মূল সমাধিক্ষেত্রের মধ্যে দৃষ্টিনন্দন পাথরে খোদাই করা কারুকাজ ও এপিটাফের ভাষার মানের কারণে অনেকেরই বিশেষ দুটি সমাধি চোখে পড়বে। সেই দুটি সমাধির উল্লেখ করে এই আঙিনা থেকে বেরিয়ে আসব। একটি হচ্ছে জেকব বি. সুকিয়াসের স্ত্রী মেরি অ্যানের সমাধি। মেরি ১৯১২ সালের ২৫ অক্টোবর ২২ বছর বয়সে গত হন। সাদা মার্বেল পাথরের ওপর খোদাই করা দৃষ্টিনন্দন কাজ – ক্রুশ, নোঙর, পাতা, ফুলসহ হৃৎপিন্ডের ওপর লিপি। এপিটাফটি ইংরেজি ও আর্মেনি ভাষায় লেখা। তাতে ব্যবহৃত হয়েছে আর্মেনিয়ান লেখক এমডি টাগিআডিন্টসের আর্মেনিয়ান ভাষায় লেখা কয়েকটি চরণ। বাংলায় তার মানে, ‘আমার অমূল্য ক্ষতি জীবনের চেয়ে বড়। আমার কাছে, সে বিহীন জীবন মানে মৃত্যু।’
দ্বিতীয় কবরটির কথা বলি। ম্যাক এস ম্যাকারটিক ইরানের কেরমানে জন্মগ্রহণ করেন। ২৪ বছর বয়সে চাঁদপুরে তিনি মারা যান। তারিখ ২১ ডিসেম্বর ১৯২৯। তাঁর এক অজানা প্রেয়সী তাঁর কবরে কারুময় দৃষ্টিনন্দন একটি এপিটাফ গড়ে দিয়েছিলেন। মুনতাসীর মামুন সেটির ভাষান্তর করেছেন এভাবে – ‘তাকে ভালোবাসতাম বলেই তার অনুপস্থিতি আমার কাছে এত দুঃখের। স্মৃতিতে সে আমার কাছে। অজস্র নীরব অশ্রুর মধ্যে তাকে আমি এখনো সারাক্ষণ ভালোবাসি, স্মরণ করি, একান্ত আপন করে পেতে চাই।’

গ্রিক সমাধি
ভারতে গ্রিকদের আগমন সম্ভবত ষোড়শ শতকের শুরুতে। যেসব গ্রিক ভারতে এসেছিল, তাদের অধিকাংশই ছিল ব্যবসায়ী। কলকাতা ও ঢাকায় তারা ঠাঁই গেড়েছিল। ১৭৭০ থেকে ১৮০০ সালের মধ্যে দুই শতাধিক গ্রিক ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে বসবাস করছিল। কলকাতায় তাদের সংখ্যা ছিল আরো কম। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে তাদের ব্যবসা ছিল কাপড়, লবণ ও পাটের। সিলেটে ছিল চুনের ব্যবসা। ইয়োরোপের নানা দেশে তারা ঢাকা থেকে কাপড় রপ্তানি করত। উনিশ শতকের শুরুতেই ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতা ও চাপে পড়ে তারা বাংলার অভ্যন্তরে অন্য ব্যবসা, যেমন লবণ ও পাটের ব্যবসায় নিয়োজিত হয়।
এলেক্সিও আরগিরি প্যানাসিওটিস (পানিয়টি) বাংলায় গ্রিক সম্প্রদায়ের প্রধান হিসেবে স্বীকৃত ছিলেন। পানিয়টি ১৭৫০ সালে ভারতে আসেন। ১৭৭১ সালে লর্ড হেস্টিংস তাঁকে ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের মিসরে ব্যবসা করার অনুমতিপ্রাপ্তির জন্য কায়রোতে এক দূতিয়ালি মিশনে পাঠান। তিনি ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের পক্ষে ব্যবসার অনুমতি লাভ করেন। হেস্টিংস খুশি হয়ে গ্রিকদের কলকাতা গির্জা নির্মাণের অনুমতি দেন। পানিয়টি পরবর্তী সময়ে তাঁর ব্যবসা ঢাকায় নিয়ে আসেন এবং এখানেই ১৭৭৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন। এলেক্সিও এ পানিয়টির ছেলে আলেক্সান্ডার পানিয়টি নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে বেশ দাপটের সঙ্গেই লবণের ব্যবসা করছিলেন; সিলেটে শুরু করেছিলেন চুন উৎপাদনের ব্যবসা। পিতা-পুত্র প্রভূত অর্থ আয় করেছিলেন। ১৮২০ থেকে ১৮৪০ সালের মধ্যে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে গ্রিকদের ব্যবসার অবনতি ঘটতে থাকে।
গ্রিকদের পরবর্তী বংশধরদের অনেকেই অন্য পেশা বেছে নেয়। তাদের অনেকে সামরিক ও প্রশাসনিক কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়। বিখ্যাত রেইলি ব্রাদার্স নারায়ণগঞ্জে একটি জুট মিল প্রতিষ্ঠা করেছিল। এ মিল থেকে ইয়োরোপ, রাশিয়া ও আমেরিকাতেও পাট রপ্তানি হতো। তাদের সহায়তায় ১৮২১ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় ঢাকার গ্রিক গির্জা। কোথায় ছিল গ্রিক গির্জা? ১৮৪০ সালে লেফটেন্যান্ট কর্নেল ডেভিডসন ঢাকা পরিদর্শন করেন। তাঁর লেখায় তিনি ঢাকার গ্রিক গির্জার বর্ণনা দিয়েছিলেন। ৩০ ফুট গুণন ২০ ফুট একটি কক্ষে ছিল সেই উপাসনালয়টি। এর মেঝের ওপর তিনি পথিকৃৎ গ্রিক ব্যবসায়ী এলেক্সিও এ পানিয়টির কবর দেখেছেন। পানিয়টি ঢাকায় গত হন ১৭৭৭ সালে, আর গ্রিক গির্জা প্রতিষ্ঠা হয় ১৮২১ সালে। অর্থাৎ গির্জাটি গ্রিকদের সমাধিভূমির ওপর বা কাছেই তৈরি হয়েছিল। তবে গ্রিক গির্জার অবস্থানটি কোথায়, ডেভিডসন তা উল্লেখ করেননি।
গ্রিকদের অনেককেই ওই গির্জার আঙিনায় সমাহিত করা হয়েছিল, সে বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায়। এঁদেরই একজন ডিসপিনু লুকাস ২৯ ডিসেম্বর ১৮৭৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে সমাহিত করা হয়েছিল ঢাকার মৌলভীবাজার সংলগ্ন গোলবদন কবরস্থানে। ১৮৯৮ সালের বহুল উল্লিখিত ভূমিকম্পে গির্জাটি ধ্বংস হয়ে যায়। আর এরপর আমাদের স্মৃতি থেকেও সমাধিভূমি ও গির্জাটি ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়। কর্নেল ডেভিডসন রমনার কাছে গ্রিকদের একটি সমাধিভূমির কথা উল্লেখ করেছিলেন, যার অবস্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির প্রাঙ্গণসংলগ্ন। ঢাকা শহরের ১৮৫৯ সালের ম্যাপে এটির অবস্থান চিহ্নিত আছে। ডেভিডসন এখানকার সমাধিগুলোকে দেখেছিলেন অযত্নে পড়ে থাকা নোংরা অবস্থায়, আকর্ষণহীন এক গরু-ছাগলের বিচরণভূমির মতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে এসব সমাধি সরিয়ে ফেলা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে ১৯১৫ সালে ঢাকার পথিকৃৎ গ্রিকদের স্মৃতি রক্ষার্থে পুরান ঢাকার সেন্ট টমাস চার্চের পাদরি রেভারেন্ড জে এম ম্যাকডোনাল্ডের উদ্যোগে একটি সমাধিসৌধ নির্মাণ করা হয়, যা আজো টিকে আছে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত দ্য সানডে স্টেটম্যানের ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯১৫ সংখ্যায় এ বিষয়ে খবর বেরিয়েছিল। এর স্থাপত্য নকশা করেছিলেন সরকারি স্থপতি।
ধ্রুপদী গ্রিক স্থাপত্যরীতিতে এই সমাধিসৌধের পরিকল্পনা করা হয়। বর্গাকার এই সমাধিকক্ষের বাইরে চারদিকে নির্মাণ করা হয়েছে দুটি ডরিক স্তম্ভের ওপর একটি ত্রিভুজাকার পেডিমেন্ট। পেডিমেন্টের ওপরে সৌধের পুবদিকের প্যারাপেটের ওপর রয়েছে গ্রিক ভাষায় লেখা বাণী। তার অর্থ, ‘আশীর্বাদপুষ্ট তারাই যাদের তুমি (ঈশ্বর) নির্বাচন করেছ এবং তোমাতে আশ্রয় দিয়েছ।’ ভেতরে রয়েছে কালো পাথরের খোদিত মোট ১০টি এপিটাফ। ঢাকায় গ্রিকদের বেশি এপিটাফ পাওয়া যায়নি বলে এগুলোর গুরুত্ব রয়েছে। মোট ১০টি সমাধিফলকের একটি দ্বিভাষিক (ইংরেজি ও গ্রিক), পাঁচটি ইংরেজি ও চারটি গ্রিক ভাষায় লেখা। ইংরেজি ভাষায় লেখা একটি ফলক পূর্ণাঙ্গ অবস্থায় নেই। ফলে সেটির সম্পূর্ণ লেখা উদ্ধার করা যায়নি। গুরুত্ব থাকায় ১০টি ফলকের মূল বিষয় তুলে ধরছি :
১. দ্বিভাষিক (গ্রিক ও ইংরেজি) : এটি আলেক্সান্ডার কাইনাকোস ফিলিপ্পৌ পলিটুর স্ত্রী সুলতানা আলেক্সান্ডারের। তিনি ১৮০০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ৩৬ বছর বয়সে গত হন।
২. গ্রিক : এটি থিওডোর জর্জ ফিলিপ্পৌ পলিটুর স্ত্রী থিওডোসিয়া, তিনি মারা যান ১৮০৫ সালের ১০ এপ্রিল।
৩. গ্রিক : ক্যাসারিয়ার অধিবাসী জ্যাকব ইসাই আয়াকোবাগ্লেয়াস ৪৮ বছর বয়সে ১৮১৯ সালের ২২ জুন মৃত্যুবরণ করেন।
৪. গ্রিক : ১৮১০ সালের ১২ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন ফাদার নাথানিয়েল, তাঁর পিতৃভূমি ছিল সিফনস (ইজিয়ান দ্বীপের অন্তর্গত)। ১৭৩৬ সালে জন্মগ্রহণকারী নাথানিয়েল জীবনভর যিশুর বাণী প্রচার করেছিলেন।
৫. গ্রিক : ইস্তাম্বুলের কনস্টানটিন জর্জ মাভরোডগলু। তিনি ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। ১৮০৬ সালের ২৪ জুলাই ঢাকায় মারা যান।
৬. ইংরেজি : সেজেরাহর বাসিন্দা জোসেফ জর্ডান ও তাঁর দুই স্ত্রী ম্যাগডালিন ও সোফিয়া জর্ডান। জোসেফ ছিলেন নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ী, ৬০ বছর বয়সে ১৮১৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন।
৭. ইংরেজি : ঢাকার সেন্ট টমাস গির্জার গ্রিক ক্লার্ক বেসিল ডেমেটরিয়াস। ১৮৬০ সালে মারা যান। তাঁর সমাধিফলক এখানেই রয়েছে। তিনি রাইটিং মাস্টার এবং শিক্ষক হিসেবে ঢাকা কলেজে প্রায় ১০ বছর, কমিসারিয়েট অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে নয় বছর এবং পাশাপাশি সেন্ট টমাস গির্জার ক্লার্ক হিসেবে ৪০ বছর কর্মরত ছিলেন।
৮. ইংরেজি : জন এলিয়াসের সমাধিফলক। ঢাকার উত্তর-পশ্চিমে ২৫ মাইল দূরে মির্জাপুরে শিকার করার সময় বাঘের কবলে পড়ে ৩১ জানুয়ারি ১৮৩৬ সালে ৩৫ বছর বয়সে প্রাণ হারান। এই স্মৃতিফলকটি নিকোলাস, জন ও কনস্টানটিন এলিয়াস – একই পরিবারের এই এলিয়াস ভ্রাতৃত্রয়কে উৎসর্গ করা হয়েছে। এটিতে তাঁদের সাহসী শিকারি হিসেবে উলে�খ করা হয়।
৯. ইংরেজি : এটি জনৈক পস্কোলোর ভাঙা এপিটাফ। পুরো নামটি উদ্ধার করা যায়নি। তিনি ডিসেম্বর ১৮৩৩ সালে ৮২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মেয়ে রাইন জুলাই ১৮১৩-তে গত হন।
১০. ইংরেজি : এই সমাধিফলকটি বিশেষ কারণে ব্যতিক্রমী বলা যায়। এটি নিকোলাস ডেমেট্রাস এলিয়াসের সমাধিফলক। এলিয়াস ১৮৪৩ সালের ৫ মার্চ ৪৬ বছর বয়সে মারা যান। এই এপিটাফে আছে ল্যাটিন হরফে লেখা একটি উর্দু কবিতা। বেশ বোঝা যায়, এলিয়াস ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে যথেষ্ট ভালোভাবেই পরিচিত ছিলেন। তাঁর সমাধিফলকে তাঁরই পছন্দের একটি উর্দু কবিতা উৎকীর্ণ করা হয়েছে। সমাধিফলকটি এলিয়াসের বন্ধু বেসিল ডেমেট্রিয়াস ১৮৫৯ সালে তৈরি করেছেন।
দুনিয়াকা জো মজা হায়
হারজেসে কম না হোঙ্গা
চর্চা আহি রহেগা
আফসোস হাম না হোঙ্গা
(পৃথিবীর যে আনন্দ, তা কখনো কমে যাবে না। তারই চর্চা চলবে, দুঃখ শুধু আমি থাকব না।)
ডেভিডসনের লেখায় জানা যায়, ভারতীয় রমণী ও গ্রিকদের মধ্যে বিয়ের চল ছিল। সমাধিসৌধের অভ্যন্তরে সুলতানা আলেক্সান্ডার কি কোনো ভারতীয় রমণী? এদেশে ইয়োরোপীয় অনেকেই ভারতীয় নারীদের বিয়ে করেছিলেন। ১৭৮৯ সালে ইতালির চিত্রশিল্পী ফ্রান্সিসকো রেনাল্ডি ঢাকায় এমনই এক ইয়োরোপীয়ের দেশি মুসলিম বিবির ছবি এঁকেছিলেন। সুলতানা মারা যান ১৮০০ সালে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ৩৪ বছর। রেনাল্ডি যখন ঢাকায়, অর্থাৎ ১৭৮৯ সালে, সুলতানার বয়স তখন ২৩ বছর। সে আমলে কোনো শিল্পীকে দিয়ে পোর্ট্রেট অাঁকিয়ে নেওয়া ছিল ব্যয়বহুল ব্যাপার। হতে পারে যে, রেনাল্ডির অাঁকা সেই অজানা নারীই সুলতানা। রেনাল্ডির অাঁকা সেই নারীর পরিধেয় মসলিন ও অলংকার দেখলেই বোঝা যায়, তিনি ঢাকার কোনো ধনী ইয়োরোপীয়ের এদেশীয় বিবি।
তেজগাঁওয়ের সমাধিভূমি
ঢাকার ফার্মগেটে হলিক্রস কলেজের কাছেই রয়েছে ঐতিহাসিক তেজগাঁও গির্জা। এটি প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৬৭৭ সালে। এই এলাকায় একসময় ইংরেজদের কুঠি ছিল। পর্তুগিজদের হাতে প্রতিষ্ঠিত এ গির্জার প্রাঙ্গণে রয়েছে সমাধিক্ষেত্র। প্রায় সব পুরনো কবরই ছিল সাদামাটা ধরনের। এসব কবরের ওপর কোনো উঁচু মনুমেন্ট তৈরি হয়নি। প্রাচীন এই সমাধিক্ষেত্রে এখন আর পুরনো কবরগুলো টিকে নেই। বর্তমানে পুরনো সমাধি ভেঙে নতুন কবরের জায়গা করা হয়েছে। পুরনো কবরের কিছু এপিটাফ ঐতিহাসিক এই তেজগাঁও গির্জার অভ্যন্তরের দেয়ালে সেঁটে দেওয়া হয়েছে। গির্জার ভেতরে মেঝেতে অনেক এপিটাফ রয়েছে। এখানে সবচেয়ে পুরনো যে এপিটাফটি পাওয়া যায়, সেটি কোনো এক কয় ডেভিএটসের। ১৭১৪ সালে মারা যান তিনি।
ঢাকায় আরো একটি সমাধি রয়েছে, যেটি নারিন্দা সমাধিক্ষেত্রের বেশ কাছে। বলধা গার্ডেনের পেছনের দিকে অবস্থিত এই ব্যাপ্টিস্ট সমাধিক্ষেত্র ১৮৪২ সালে গড়ে ওঠে। ছোট সেই সমাধিক্ষেত্রটি বর্তমানে জঙ্গলাকীর্ণ। গেটও তালাবদ্ধ। এখানে তেমন উলে�খযোগ্য কোনো সমাধির অবস্থান জানা যায়নি।

স্থাপত্যমূল্য এবং প্রভাব : দেশে-বিদেশে
নারিন্দার সমাধিক্ষেত্র অনেককেই আকর্ষণ করেছিল। বিশেষ করে কলম্বো সাহেবের সমাধি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন বহু মানুষ। তাঁরা তাঁদের লেখায় কলম্বো সাহেবের সমাধিসৌধের কথা বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে উলে�খ করেছেন। স্থাপত্যরীতি ও আয়তনের দিক থেকে এমন আকর্ষণীয় খ্রিষ্টান সমাধিসৌধ বাংলাদেশে আর কোথাও নেই। ঢাকার সমাধিক্ষেত্র, বিশেষ করে নারিন্দার পুরনো অংশটি আকর্ষণীয়। এখানে আছে ঐতিহ্যবাহী ইয়োরোপীয় নব্য ধ্রুপদী বা নিউ ক্লাসিক্যাল স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত অনেক সমাধি। সমাধিগুলোর কাঠামোতে পিরামিড, ওবেলিক্স, প্যাভিলিয়ন বা উরন্স ব্যবহার করা হয়েছে। রয়েছে আয়তাকার বাঁধানো সাদামাটা ফ্ল্যাট গ্রেভস্টোন আকৃতির কবর।
তবে আগেই বলেছি, কলম্বো সাহেবের সমাধিটির রীতি একেবারেই আলাদা। এতে ভারতীয় স্থাপত্যের সঙ্গে ইয়োরোপীয় উপাদান দারুণভাবে এসে মিশেছে। এটিকে অন্তত বাইরে থেকে ভারতীয় বা এদেশীয় বলে মনে হয়। এই সমাধি ও প্রাচীন গেটটিতে ভারতীয় মুসলিম রীতি প্রকট হয়েই ধরা দেয়। স্থাপত্য ঐতিহ্য হিসেবে এই সমাধিসৌধের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রশ্ন জাগতেই পারে, হঠাৎ করে সমসাময়িক ইয়োরোপীয় নব্য ধ্রুপদী ধারার পরিবর্তে এমন খ্রিষ্টান সমাধিসৌধ কেনই বা মুসলিম বা ভারতীয় রীতিতে নির্মিত হলো? কিংবা সে-সময়ে ভারতের অন্য কোথাও কি ভারতীয় রীতিতে এভাবে খ্রিষ্টান সমাধি তৈরি হয়েছিল? তা জানতে হলে আমাদের মোগল ভারতের অন্য শহরের দিকে তাকাতে হবে, যেখানে ইয়োরোপীয়রা প্রথমে তাদের প্রধান ব্যবসার ঘাঁটি গড়ে তুলেছিল। যেমন গোয়া, সুরাট, হুগলি প্রভৃতি শহরে। পরবর্তী সময়ে ঢাকা ও কলকাতাতেও সে রকম ঘাঁটি বিস্তৃত হয়।
এসব অঞ্চলে আসা ইয়োরোপীয়দের কেউ মৃত্যুবরণ করলে এখানেই তাদের সমাহিত করা হয়। তাদের সমাধিসৌধ গড়ার জন্য নিয়োজিত ছিল এদেশীয় নির্মাণশ্রমিক ও শিল্পী। তাদের পরিচয় ছিল মুসলিম ও হিন্দু রীতির স্থাপত্যের সঙ্গেই। কিন্তু এগুলো খ্রিষ্টান সমাধি হওয়ায় তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল কিছু খ্রিষ্টধর্মীয় ও ইয়োরোপীয় উপাদান। সব মিলে কৌতূহলোদ্দীপক এক নতুন মিশ্ররীতির উদ্ভব ঘটে।
আগ্রায় কয়েকটি উলে�খযোগ্য খ্রিষ্টান সমাধি রয়েছে। ঐতিহাসিক গুরুত্বের পাশাপাশি স্থাপত্য হিসেবেও সেসবের গুরুত্ব আছে। যেমন জেরোম ভেরেনিওর কবর। ভেরেনিও তাজমহলের কবরের ওপর স্বর্ণের জালির কাজ করেছিলেন। তাঁর কবরটির আদল মুসলমান কবরের মতো। এ কবরে অনেক মুসলিম রীতির কারুকাজ রয়েছে। দেশীয় নানা রাজার অধীনে সেনাবাহিনীতে উচ্চ পদে যুক্ত ছিলেন পেরন নামে এক নাবিক। তাঁর সমাধিসৌধে রয়েছে মোগল স্থাপত্যরীতিতে খোদাই কাজ। এছাড়া সেখানে আছে এনায়েত মসিহ ও সমরুর কবর। ফরাসি সেনা সমরু মীর কাসিমের সেনাদলে উচ্চ পদে নিযুক্ত ছিলেন। সমরু এক মুসলিম নারীকে বিয়ে করেছিলেন। বিয়ের জন্য সেই নারী ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিষ্টান হন। সমরুর স্ত্রী সমরুর কবরে এক বিশাল সমাধিসৌধ গড়ে তুলেছিলেন। সেটিতে ভারতীয় শৈলীর ছাপ স্পষ্ট হয়ে আছে। সেখানে আরো আছে ইলিয়াস মার্চেন্ট ও হেসিংয়ের সমাধি। হেসিংয়ের সমাধিটি যেন বিখ্যাত তাজমহলের ক্ষুদ্র রূপ। জর্জ উইলিয়াম হেসিং দেশীয় রাজাদের হয়ে প্রতাপের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। গড়েছিলেন বিশাল সম্পত্তি। ১৮০৩ সালে তাঁর মৃত্যু হলে তাঁর সন্তানেরা এই বিশাল সমাধিসৌধ গড়ে তোলেন। ৫৮ ফুট বর্গাকার ও ১১ ফুট ৩ ইঞ্চি উচ্চতার বেদির ওপর ৩৪ ফুট ৯ ইঞ্চির বর্গাকার সুউচ্চ এই সৌধ মুসলিম রীতিতে তৈরি এক খুদে তাজমহল।
সুরাটেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। স্যার জর্জ অক্সেনডেন ও তাঁর ভাই ক্রিস্টোফারের মৃত্যুর পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যে তাঁদের জন্য সুরাটে সমাধিসৌধ গড়েছিল, তাতে ভারতীয় স্থাপত্যের প্রভাব বেশ প্রকট। ভারতে মোগলদের নির্মিত বৃহৎ সমাধি স্থাপত্য ইয়োরোপীয়দের যথেষ্ট নাড়া দিয়েছিল। ভারতে অবস্থিত অনেক ইয়োরোপীয়র সমাধি ইংল্যান্ডের তুলনায় আয়তনে ব্যাপক ও বিশাল। সে সময়ে ইংল্যান্ডে যার উদাহরণ দুর্লভ। সুরাটে অবস্থিত সমাধিভূমি সব দর্শনার্থীকেই মুগ্ধ করেছিল। এর প্রভাব যে ইয়োরোপেও পড়েছিল, সেটি অনেকেরই অজানা। ১৬৮৩ সালে লন্ডন থেকে আসা ইংরেজ তরুণ স্থপতি জন ভ্যানবুর্গ সুরাটের সমাধিক্ষেত্র দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন এবং এগুলোর অনেক ছবি এঁকেছিলেন, যা পরে বই আকারে গার্ডেন টেম্পল্ নামে প্রকাশিত হয়। ভ্যানবুর্গ ইয়োরোপেও ভারতের মতো এ ধরনের সমাধিসৌধ নির্মাণ করার পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছিলেন। তখন পর্যন্ত ইংল্যান্ডে এ বিষয়ে প্রায় কোনো ধারণাই ছিল না। এর ফলে আঠারো শতকে ইয়োরোপ ও ইংল্যান্ডে সবুজ বাগানবেষ্টিত পারিবারিক সমাধি নির্মাণ হয়ে উঠল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ধারণাটি ভারত থেকে ভ্যানবুর্গের মাধ্যমে পুরো ইয়োরোপে ছড়িয়ে পড়ে। উল্লেখ্য, ভ্যানবুর্গ সবুজ চত্বরে সমাধি নির্মাণের যে উচ্ছ্বাস ছড়িয়েছিলেন, তা প্যারিসের গ্রেট মেট্রোপলিটান সিমেট্রি তৈরির আগ পর্যন্ত এক শতকেরও বেশি সময় ধরে টিকে ছিল।
ভারতের মোগল সমাধিসৌধগুলো ইয়োরোপের সমাধিসৌধের ওপর যে প্রভাব ফেলেছিল সেটি ইয়োরোপীয় ঐতিহাসিকেরা প্রায় দুঃখজনকভাবে উপেক্ষা করেছেন। বেলফাস্টের দক্ষিণে একটি প্রসিদ্ধ বন্দর নকব্রেডা। এ বন্দরের অনেক ধনী পরিবারের সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যোগাযোগ ছিল। এখানে আসা অনেক ধনী ব্যবসায়ীর সমাধিতে ভারতীয় সমাধির প্রভাব উপেক্ষা করা যায় না বলে অনেকে মনে করেন।
সম্প্রতি নারিন্দার সমাধিক্ষেত্রকে বাংলাদেশের ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কারণ এই সমাধিক্ষেত্রের ঐতিহাসিক ও স্থাপত্য গুরুত্ব অসামান্য; যদিও দুর্ভাগ্যজনকভাবে এর বহু উলে�খযোগ্য সমাধি ও ফলক বিধ্বস্তপ্রায়। জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে, বিশেষ করে আশির দশক থেকে সেখানে যে নিরন্তর ধ্বংসযজ্ঞ চলছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে এই সমাধিক্ষেত্রের কোনো প্রাচীন নিদর্শনই টিকে থাকবে কি না বলা কঠিন। আশির দশকের শুরুতে যেসব এপিটাফ, ক্রুশ বা মনুমেন্ট সেখানে দেখেছি, তার অধিকাংশই চুরি হয়ে গেছে বা ধ্বংস হয়েছে বা ভেঙে পড়ার অপেক্ষায় রয়েছে। মার্বেল পাথরের সমাধিফলক ও ক্রুশ ভেঙে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সমাধির সর্বত্র অপরিকল্পিতভাবে গাছ লাগানো হয়েছে। এসব গাছের শিকড় বহু সমাধির ক্ষতির কারণ হবে। শিকড়ের কারণে এরই মধ্যে মূল কাঠামোর দেয়াল ফেটে গিয়েছে বা যাচ্ছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে একটি উল্লেখযোগ্য বৃহৎ প্যাভিলিয়ন ধ্বংস হয়েছে। বিখ্যাত কলম্বো সাহেবের সমাধির অনেক মিনার বা টারেট ভেঙে মাটিতে পড়ে আছে। এ সমাধির বিলুপ্তি এখন শুধু সময়ের ব্যাপার।
কলকাতা ও ভারতের অন্যান্য বহু শহরের কোনো কোনো ঐতিহাসিক সমাধিভূমি সে-দেশের সরকার তাদের প্রত্নতত্ত্ব সংস্থার মাধ্যমে রক্ষা করেছে। আজ কলকাতার পার্ক সিমেট্রি বা গোয়া, সুরাট, আগ্রার সব ঐতিহাসিক সমাধি সংরক্ষিত। নানা স্থান থেকে দর্শনার্থীরা সেইসব সমাধিভূমি দেখতে আসেন। সমাধি নিয়ে ঐতিহাসিক ও প্রত্নবিদদের মধ্যে নতুন করে উৎসাহ দেখা দিয়েছে। শুধু ভারতের আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়াই নয়, ইয়োরোপের নানা সংস্থা ভারতের এসব সমাধিক্ষেত্র রক্ষা ও গবেষণায় অংশগ্রহণ করছে। আগেই বলেছি, সম্প্রতি নারিন্দার সমাধিটি ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কিন্তু কেবল তাতেই এই সমাধি রক্ষা পাবে না, এই সমাধিভূমি রক্ষায় আরো বহু বিষয় ভাবার আছে। সেসব ভাবনার কিছু তুলে ধরছি –
১. এই সমাধিভূমি রক্ষার জন্য সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এবং এর স্বত্বাধিকারী খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের যৌথভাবে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। অন্যান্য বিশেষজ্ঞ – যেমন স্থপতি, ইতিহাসবেত্তা, নগর পরিকল্পনাবিদ, নিসর্গ স্থপতিসহ সবার পরামর্শ নিয়ে একটি সংরক্ষণ নীতিমালা প্রণয়ন ও তা দ্রুত কার্যকর করার জন্য উভয় সংস্থার মধ্যে চুক্তি সম্পাদন।
২. এই মুহূর্তে হুমকির সম্মুখীন কলম্বো সাহেবের সমাধি, প্যাভিলিয়ন ও পিরামিডগুলোকে রক্ষার জন্য দ্রুত প্রাথমিক ব্যবস্থা নেওয়া। প্রধান কাঠামোতে গজিয়ে ওঠা ক্ষতিকর সব গাছ ও শিকড় সাবধানতার সঙ্গে অপসারণ করা, যাতে কাঠামোর কোনো ক্ষতি না হয়।
৩. স্থাপত্য সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে সব কাঠামোর বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে দ্রুত জরিপ করা এবং সমাধিগুলোকে বিভিন্ন বিভাগে অর্থাৎ সময়কাল, অবস্থান, রীতি অনুযায়ী ভাগ করে তালিকাভুক্ত করা এবং ক্রমে সেগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া।
৪. পুরো সমাধিভূমির একটি মাস্টারপ্লান তৈরি করা, অপ্রয়োজনীয় ক্ষতিকর গাছগুলো সরিয়ে নতুন করে নিসর্গ পরিকল্পনা প্রণয়ন করে এটিকে বাগান সমাধিভূমিতে রূপান্তর করা।
৫. সমাধিভূমির ভেতরে একটি মেমোরিয়াল ওয়াল বা স্মৃতিদেয়াল নির্মাণ করা। পুরো সমাধির নিসর্গ-পরিকল্পনার সঙ্গে সংগতি রেখে এর স্থাপত্য নকশা প্রণয়ন করা। বিলুপ্ত কবরের স্মৃতিফলকগুলো এই স্মৃতিদেয়ালে থাকতে পারে। তাতে রাখা যেতে পারে সমাধির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, উল্লেখযোগ্য সমাহিত ব্যক্তির তালিকা ও সমাধির মানচিত্র। সমাধির প্রকারভেদ ও স্থাপত্যরীতির বর্ণনাও তাতে থাকতে পারে।
৬. বিশেষ কবরগুলোর কাছে দৃষ্টিনন্দন ফলক বসিয়ে সেগুলোকে চিহ্নিত করা জরুরি।
৭. ভেতরে পায়ে হাঁটা পথের বিস্তারিত নকশা করা ও রাতে পর্যাপ্ত আলোর পরিকল্পনা তৈরি করা।
৮. প্রধান রাস্তাসংলগ্ন সীমানাপ্রাচীরের নিচের কিছু অংশ নিরেট রেখে ওপরের অংশে দৃষ্টিনন্দন গ্রিল স্থাপন করা হলে বাইরে থেকে বাগান সমাধিক্ষেত্রটি দেখার অভিজ্ঞতা চমৎকার হবে। বাইরে থেকে সমাধিক্ষেত্রের ভেতরটি দৃষ্টিযোগ্য হওয়ার কারণে ভেতরের নিরাপত্তাও জোরদার হবে।
এই ঐতিহাসিক সমাধিক্ষেত্রটি জরুরি ভিত্তিতে সংরক্ষণের উদ্যোগ না নিলে ঢাকার ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান চিরতরে হারিয়ে যাবে। আগামী প্রজন্ম ভবিষ্যতে ইতিহাস বইয়ে পড়বে : ঢাকার নারিন্দায় একদা আকর্ষণীয় ও ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি খ্রিষ্টান সমাধিক্ষেত্রের অস্তিত্ব ছিল। 

সূত্র :
১. The Victorian Celebration of Death by James Stevens Curl, Sutton Publishing, 2000, England.
২. Armenian Graves, Inscriptions and Memorials in India, Dacca 1722-1977, Liz Chater, Chater Genealogy Publishing, 2011, England.
৩. Building of the British Raj in Bangladesh, Nazimuddin Ahmed, UPL, 1986, Dhaka.
৪. ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী, মুনতাসীর মামুন, অনন্যা, ২০০০, ঢাকা।
৫. Studies in Medieval Indian Architecture, R. Nath, M D Publications Pvt. Ltd, 1995, New Delhi.
সহায়ক প্রবন্ধ :
১. ‘Old Churches and Cemeteries of Dhaka’ Dhaka Past Present and Future, Perween Hasan, Asiatic Society, 1991, Dhaka.
২. ‘ঢাকার এপিটাফ’, ঢাকার হারিয়ে যাওয়া বইয়ের খোঁজে, মুনতাসীর মামুন, অনন্যা, ২০০৬, ঢাকা
৩. মুনতাসীর মামুন, দৈনিক প্রথম আলো, ৮ জুন ২০০৭, ঢাকা। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্প।
৪. ‘Ambivalent Heritage between affect and Ideology in Acolonial Cemetery’, Ashish Chadha, Paper, Stanford University, USA.
৫. ‘Ambitious Monumentality of 18th Century Romanticism Mausoleum At Christian Cemetery, Wari, Dhaka’. Md Ali Naki and Ziaul Islam, Paper Presented at the International Seminar on Future of the past, Architectural Conservation, BUET, Dhaka 1996
সহায়ক ওয়েবসাইট :
১. ‘Colonial Burial Culture in India’, http://www.uni-greifswald.de
২. ‘Glimpses of the Greek Community from the Dhaka University Gravestones’, Helen Abadzi, Indo-Hellenic Society for Culture and Development. http://www.elinepa.org

Leave a Reply