আ মি মু ল এ হ সা ন
আমাদের প্রিয় নগরী ঢাকা কি কোনো দূরবর্তী গ্রহ? প্রত্যেকের ব্যক্তিগত অথবা সম্মিলিত যাপনের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা অপরিচিত এক আবাসভূমি? ঢাকা কি এক অভিশপ্ত বধ্যভূমি? দগ্ধ ও বিবর্ণ? যদি তা না হয়, তাহলে এই শহরে তার নাগরিকদের বেঁচে থাকা এমন বিপ্রতীপ কেন? কেন এমন বদ্ধ, বিপদসংকুল আর প্রবঞ্চিত যাপন এর পথে পথে, বিস্তারে আর খণ্ডিত সব অবয়বে? ঢাকা কি কখনো সবুজে অবারিত হয়ে উঠবে না? পলাতক পাখিরা কি একদিন ফিরবে না এই শহরের আকাশে? আমরা কি একদিন আমাদের রাজধানীকে সকল সূচকের মানদণ্ডে বাসযোগ্য করে তুলব না?
একবিংশ শতকের এই পৃথিবীতে একটি শহর তার সমগ্র দেশের চেয়েও শক্তিশালী। শহরের সুচারু পরিকল্পনা এবং এর আঙ্গিক বিন্যাস তাই জাতীয় সমৃদ্ধির সঙ্গে সরাসরি জড়িত। এই নগরীর সুসংবদ্ধ গড়ে ওঠা একটি জটিল প্রক্রিয়া, যা নিয়ত পরিবর্তনশীল। শহর নির্মাণের বহুমাত্রিকতা তাই কিছু নীতিমালাপ্রসূত নথিপত্র দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। এর জন্য প্রয়োজন ভবিষ্যৎ নগরীর দৃশ্যকল্প নির্মাণ, এর সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং বিষয়ভিত্তিক প্রস্তাবনা।
ভবিষ্যৎ রাজধানীকে তার উচ্চতর সম্ভাবনাময় গঠন বিন্যাসে দেখেছেন স্থপতি, নগরবিদ কাজী খালিদ আশরাফ। ঢাকার রূপকল্পে তাঁর মেধাদীপ্ত প্রকাশনা ডিজাইনিং ঢাকা পাঠককে ক্রমশ এর বাস্তবিক সম্ভাব্যতার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। লেখক ডিজাইনিং ঢাকাকে উল্লেখ করেছেন এক বলিষ্ঠ অবিচল ‘মেনিফেস্টো’ নামে, যা আমাদের নগরনির্মাতাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পথনির্দেশনা হয়ে উঠেছে। লেখক ঢাকার দুর্বিষহ দুর্দশার কথা আলোচনা করার চেয়ে এর সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের দৃশ্যকল্প বিধৃত করেছেন। মূলত এই নেতিবাচক ব্যবচ্ছেদ আমাদের সকল উদ্দীপনাকে স্তব্ধ করে। লেখক তাঁর ডিজাইনিং ঢাকার সুদীর্ঘ পরিকল্পনা বৃত্তান্তে বর্তমান ঢাকার হতাশাগ্রস্ত অবয়বকে চিত্রিত করেননি। তিনি অগ্রসরমাণ নগরীর সকল সম্ভাবনাকে ঢাকার ভবিষ্যৎ রূপ হিসেবে নির্দেশিত করেছেন এবং তার বাস্তবিকতা পর্ব নির্দেশ করেছেন। তাত্ত্বিক পরিকল্পনার চেয়ে তিনি ‘ডিজাইনে’র বিষয়ে অধিক আগ্রহী হয়েছেন, যা প্রতিটি পরিসরকে তার সর্বোচ্চ সম্ভাবনার কাছে বাস্তবিক পৌঁছে দেবে। তার বিস্তৃত ‘মেনিফেস্টো’ শহরের অধিবাসীদের মাঝে সঞ্চালিত হবে, যার যূথবদ্ধ আয়োজন আমাদের আরো উচ্চতর সম্ভাবনার কাছে পৌঁছে দেবে।
কাজী খালিদ আশরাফ ভবিষ্যৎ ঢাকার যে দৃশ্যকল্প বিনির্মাণ করেছেন তা নিছক কল্পনাপ্রসূত নয়। এই নির্মাণ স্বপ্ন আবিষ্ট রোমান্টিসিজমও নয়, বরং বিপুল এক কর্মযজ্ঞের দিকনির্দেশনা। পরিবর্তিত সেই ঢাকার নির্মাণ সময়সাপেক্ষ এবং বিবিধ পর্যায়ের ধারাবাহিকতায় বিন্যস্ত। লেখক বিশ্বাস করেন, আমাদের সম্মিলিত প্রয়াস আর সুযোগ্য নেতৃত্ব এই রূপকল্পকে সত্য রূপ দেবে।
কাজী খালিদ আশরাফ আশির দশক থেকে স্থাপত্য ও নগর পরিকল্পনা বিষয়ে গবেষণায় নিয়োজিত রয়েছেন। তাঁর গবেষণার মূল কেন্দ্র বাংলাদেশ এবং রাজধানী ঢাকা। এ বিষয়ে তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা এবং বক্তৃতা দেশে ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রশংসিত হয়েছে। সহযোগী লেখক জেমস বেলুয়ার্দোর সঙ্গে তাঁর প্রধান প্রকাশনা ‘দ্য মেকিং অব মডার্ন সাউথ এশিয়া’ ১৯৯৭ সালে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত হয়। একই সময়ে সহযোগী লেখক প্রয়াত রাজিউল আহসান এবং সাইফ-উল-হকের সঙ্গে তিনি প্রকাশ করেন ‘পুন্ড্রনগর ট্যু শেরেবাংলানগর : আর্কিটেকচার ইন বাংলাদেশ’। তাঁর সম্পাদিত মনোগ্রাফ ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ আন্তর্জাতিক স্থাপত্য সমালোচনা কেন্দ্র থেকে ২০০৮ সালে পিয়েরে ভ্যাগো জার্নালিজম অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে। ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াই প্রেস থেকে প্রকাশিত হবে তাঁর নতুন গ্রন্থ দ্য হারমিটস হাট।
কাজী খালিদ আশরাফ বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রে স্থাপত্য ও নগর পরিকল্পনায় সর্বোচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশেও স্থাপত্য পেশায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন।
আরবান ডিজাইন অ্যাকশন গ্র“পের সহযোগিতায়, লোকা প্রেস থেকে প্রকাশিত নতুন গ্রন্থ ডিজাইনিং ঢাকা তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা। এই গ্রন্থটি পুনরুজ্জীবিত ঢাকার এক পূর্ণাঙ্গ স্বপ্নকল্প, যা ক্রমান্বয়ে সংহত হয়ে উঠেছে ধারাবাহিক প্রতিটি অনুচ্ছেদে, যেখানে লেখক ভবিষ্যৎ নগর নির্মাণের প্রায় সকল পর্যায়ক্রম বিশ্লেষণ করেছেন।
ডিজাইনিং ঢাকা – এই শহর নির্মাণেরই একটি বিস্তৃত আখ্যানভাগ, যা রচিত হয়েছে নির্মাণপর্ব শুরু হওয়ার অনেক আগেই। লেখক অনুভব করেছেন নগর নির্মাণের সুসংবদ্ধ কোনো পরিকল্পনা গ্রহণের পরিবর্তে আমরা ক্রমশ স্বপ্নহীন আর হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছি।
অদৃশ্যমান সেই শহরের নির্মাণকল্প আমরা কখনই দেখব না, যদি আমরা জানতে না পারি শহর কী? এবং শহর কেন? স্থপতি ও নগরচিন্তাবিদ কাজী খালিদ আশরাফ তাই এই বইয়ের ভূমিকাপর্ব বিস্তৃত করেছেন নগরজীবনের বহুমাত্রিক দর্শন আলোচনায়।
তিনি বলেছেন, শহর আসলে তার অধিবাসীদের প্রতিবিম্ব – আমরা যেমন – শহর তাকেই প্রতিবিম্বিত করে। স্থপতি রেনজো পিয়ানো বলেছেন, শহর অনবদ্য, কেননা তা ধারণ করে অসংখ্য যাপিত জীবনের মিশ্র অনুভব। শহর নির্মিত হয় সেই সময় আর তার অধিবাসীদের অসংখ্য ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে আশ্রয় করে। লেখক বর্ণনা করেছেন, শহরই হলো সভ্যতা। শহর আমাদের প্রত্যেকের নিজস্ব জীবনের সার্থকতা আর উদ্দেশ্যকে ধারণ করে। নগর দার্শনিক হেনরি লেফেবরে বলেছেন, শহর আমাদের বেঁচে থাকা আর সজ্ঞানতাকে প্রতিনিয়ত গ্রন্থিত করে। ‘রাইটস টু দ্য সিটি’ রচনায় লেফেবরে আরো বলেছেন, শহরে মানুষের অধিকার মানে শুধু বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য আর জীবিকার নিশ্চয়তা নয় বরং পার্ক, মেলা, জাদুঘর, বিনোদনকেন্দ্রসমূহে নাগরিকদের অবকাশ উদ্যাপনের সুযোগ সৃষ্টি করা। জাতীয় সংসদ ভবন কমপ্লেক্সের স্থপতি লুই আই কান যেমন বলেছিলেন, নগরের পথে হাঁটতে হাঁটতে একটি বালক যেন তার জীবনের গন্তব্যপথ ঠিক করতে পারে। এমন বিবিধ উদ্ধৃতির মধ্য দিয়ে লেখক কাজী খালিদ আশরাফ জানিয়েছেন, একটি নগর প্রকৃতপক্ষে এক একটি নাগরিক জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং সেইসঙ্গে তার যাপনকে অর্থবহ কিংবা অর্থহীন করে। একটি শহর কেবল জীবনের গন্তব্যকেই নির্দিষ্ট করে না বরং গন্তব্যের পথে তার যাত্রাপথ নির্দেশিত করে দেয়।
ডিজাইনিং ঢাকা গ্রন্থের শুরুতে ঢাকা উপস্থাপিত হয়েছে এই উপমহাদেশের ঐতিহাসিক পটভূমিতে। ঢাকার সদূরে সাভারের রাজবাড়ীতে প্রাপ্ত প্রতœবস্তু তার সময়কাল নির্দেশ করে ৬০০ খ্রিষ্টাব্দ। ১৫০০-১৬০০ খ্রিষ্টাব্দের ঢাকা মোগল সাম্রাজের অংশ হিসেবে দিল্লি থেকে পরিচালিত হয়েছে। সেই সময়ের ঢাকা ছিল সুবে বাংলার রাজধানী। ১৬৩৯ সালে সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজা রাজধানী ঢাকা থেকে রাজমহল এলাকায় সরিয়ে নেন, পরবর্তী সময় ১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা পুনরায় রাজধানীতে পরিণত হয়। ১৭০৩ সালে ঢাকার পরিবর্তে পাটনা বাংলার রাজধানী হয় আর এই সময় থেকে ইংরেজদের বাণিজ্য আগমন শুরু হয়েছিল। ভারতবর্ষে প্রবেশের জন্য তারা বাংলার বন্দরকে বেছে নিল। পরবর্তী দুশ বছরের ইংরেজ শাসনামলে ঢাকায় বিবিধ ব্রিটিশ-বাংলা তথা কলোনিয়াল স্থাপত্যের নির্মাণ সূচিত হয়। ১৯০৫ সালে বাংলা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। ঢাকা পূর্ব বাংলার রাজধানী রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৭-এ ভারত-পাকিস্তান বিভাজনে ঢাকা পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাজধানীতে পরিণত হয়। ইতিহাসের এই ধারাবাহিক বর্ণনায় লেখক উপমহাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ঢাকার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। সেই সঙ্গে এই রাজধানীর বুকে গড়ে ওঠা বিভিন্ন ইমারতের মাঝে কলোনিয়াল ধারায় কিছু ভবন, স্থপতি মাজহারুল ইসলামের অবদানে ঢাকায় আধুনিক স্থাপত্য এবং আমেরিকার স্থপতি লুই আই কানের শেরেবাংলানগর সংসদ ভবন কমপ্লেক্সের নির্মাণকে উল্লেখযোগ্য নির্মাণরূপে চিহ্নিত করেছেন। এই পরিসরে তিনি নগর পরিকল্পনায় ঢাকার ঐতিহাসিক ব্যর্থতার কথা জানিয়েছেন। চারশ বছরে বিভিন্ন রাজ্য শাসনের কাল অতিক্রম করেও ঢাকা একটি পরিকল্পিত নগরের অভিধা অর্জন করতে পারেনি। এই সময়কাল পর্যন্ত এমন কোনো পরিকল্পনা ঢাকার জন্য উপযোগী বলে বিবেচিত হয়নি, যা ঢাকাকে বিশ্ব মানচিত্রে একটি সুসংবদ্ধ বসবাসযোগ্য নগরী রূপে তুলে ধরবে। লেখক কাজী খালিদ আশরাফ কিছু ঐতিহাসিক তথ্য উল্লেখ করেছেন। ১৯১৭ সালে প্যাট্রিক গেডেস একজন বিখ্যাত স্কটিশ পরিকল্পনাকারী বিভিন্ন ভারতীয় নগরের পাশাপাশি ঢাকার পরিকল্পনা সম্পর্কে কিছু নির্দেশ প্রদান করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৫৯ সালে ব্রিটিশ পরিকল্পনা প্রতিষ্ঠান মিনোপ্রিয়, স্পেনসলি অ্যান্ড ম্যাককারলেন তৎকালীন ঢাকার জন্য অপর্যাপ্ত একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। কোনো পরিকল্পনাই প্রকৃতপক্ষে কার্যকর করা হয়নি।
১৯৫৯-এর ঢাকা মাস্টারপ্ল্যানকে আশ্রয় করে ১৯৯৫ সালে ঢাকা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান (ডিএমডিপি) প্রস্তুত করা হয়। ২০০৯ সালে এসে তা ‘ড্যাপ’ বা ‘ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান’ হিসেবে গেজেটভুক্ত করা হয়। শহরের সামাজিক ও পরিবেশগত দিকের প্রতি যথার্থ সংবেদনশীলতা না দেখানোর কারণে ‘ড্যাপ’ প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এর মাঝে ২০০৬ সালে দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে ‘ন্যাশনাল আরবান সেক্টর পলিসি’ তৈরি হয়। লেখক কাজী খালিদ আশরাফ এই সাম্প্রতিক পরিকল্পনা প্রয়াসের সমালোচনা করে বলেছেন, এই পরিকল্পনাসমূহের কোথাও ঢাকার ভূতাত্ত্বিক ভৌগোলিক পরিচিতিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ঢাকা তার জন্ম থেকে নদীবিধৌত, জলসংলগ্ন একটি ভূমিরূপ। অথচ প্রতিটি পরিকল্পনায় ঢাকাকে একটি শুষ্ক সমতল রূপে চিন্তা করা হয়েছে। শহর পরিকল্পনার শুরুতেই তার ভৌগোলিক পরিচয়কে অস্বীকার করা আমাদের আরেকটি ঐতিহাসিক ব্যর্থতা, যা ঢাকা নগরীর বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার একটি প্রধান কারণ।
লেখক তাঁর বর্ণনায় ঢাকার জলাকীর্ণ পাললিক ভূমিরূপকে ‘হাইড্রোলজিক্যাল’ বলে চিহ্নিত করেছেন এবং তার অপরিসীম গুরুত্বকে বারংবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। লেখকের ভাবনার কেন্দ্রে এই জলজ ভূমিরূপ, তার আপাত ব্যর্থতা এবং সম্ভাবনা দৃঢ়ভাবে অবস্থান করেছে।
দুটি মৌলিক প্রশ্নকে সামনে রেখে লেখক কাজী খালিদ আশরাফ তাঁর মূল আলোচনা শুরু করেছেন।
– ঢাকা কী হতে চায়?
– আমরা ঢাকাকে কী রূপে দেখতে চাই?
নির্মাণের ক্ষিপ্রগতি যেভাবে জল, স্থল, বনভূমি, কৃষিক্ষেত্র সব দৃশ্যমান দিগন্তকে ধ্বংস করে চারদিক আকীর্ণ করে তুলেছে, সেই ধারায় ঢাকা কী হয়ে উঠবে তার বর্ণনা আমাদের প্রতিদিনের হতাশাকেই পুনরুজ্জীবিত করবে। আমরা কী রূপে দেখতে চাই আমাদের রাজধানী – এই প্রশ্নের উত্তরে লেখক যে দৃশ্যকল্প নির্মাণ করেছেন তা আপাতদৃষ্টিতে ‘ইউটোপিয়া’ যা লেখক নিজেই অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক একটি পদক্ষেপ রূপে ব্যক্ত করেছেন। লেখক জানিয়েছেন, এই শহরে বসবাস করে আমরা নিরাশার সঙ্গে নিজেদের অজ্ঞানতাকেই প্রশ্রয় দিয়ে চলেছি। আমরা পরিকল্পনা করছি, ধানক্ষেতের ‘আল’-এর আদলে প্লট ভাগ করছি অথচ কোনো আশাব্যঞ্জক দৃশ্যকল্প নির্মাণ করছি না এই নগরকে নিয়ে। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিজেদের অবস্থান সংহত করে যেসব পরিকল্পনা আত্মস্থ করছি তাতে এর অধিবাসীরা ক্রমশ হন্তারক অভিব্যক্তি নিয়ে মুখোমুখি যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে। এমন শহরে আমরা ক্রমাগত বিভাজিত হয়ে পড়ছি, সংকীর্ণ-ক্ষুদ্রতায় কোনো পলাতক জীবনে বিপর্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। নগরের এমন বিকাশ প্রবলভাবে মানবতাবিরোধী ও অপসামাজিক।
লেখক উল্লেখ করেছেন, এমন প্রতিকূল বাস্তবতায় দুই ধরনের চ্যালেঞ্জ আমাদের সম্মুখে অবস্থান করছে। প্রথমত. এই শহরকে অনুধাবন করা, যা ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা এবং শহরের মূলভাব বা প্রবণতার নিরিখে আত্মস্থ করা প্রয়োজন, অন্যদিকে বিদ্যমান সংকটের অবসান। এই দুটি দিক একে অন্যের সঙ্গে ওতপ্রোত মিশে আছে। শুধুমাত্র সংকটের নিরসনকল্পই যেমন শহরকে রক্ষা করবে না, অন্যদিকে শুধু শহরকে বুঝতে পারা আমাদের তাত্ত্বিক অবস্থানে নির্জীব করে রাখবে।
এমন বাস্তবতায় ডিজাইনিং ঢাকা শুধু পরিকল্পনার নথিপত্র হয়ে ওঠেনি। লেখক পরিকল্পনার পাশাপাশি নগর ডিজাইন তথা ‘আরবান ডিজাইন’ শব্দটি বারংবার ব্যবহার করেছেন, যা আমাদের পরিকল্পনায় এ অবধি অনুপস্থিত থেকে গেছে। শহরের মানচিত্রকে প্রকৃত অর্থে মূর্ত করে তুলতে পরিকল্পক দলের পাশাপাশি এর ডিজাইন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। যে শহরের প্রতিটি বর্গমিটার অর্থের বিচারে এত মূল্যবান তার অনুপুঙ্খ ডিজাইনই কেবল এর সফল ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারে।
২০১১ সালে ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া ‘পোস্ট-কার্বন সিটি ডিজাইনে’র ওপর যে কনফারেন্স আয়োজন করেছিল তাতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল জলবায়ু পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্যের বিনাশ, পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর জ্বালানির ব্যবহার প্রভৃতি বিষয়। ঢাকা এ সকল উৎকণ্ঠার কেন্দ্রবিন্দুতে ধ্বংসের আশঙ্কায় দাঁড়িয়ে আছে। লেখক জানিয়েছেন, ক্ষতির তালিকা তৈরির চেয়ে এই বিপর্যয়ের প্রতিকারে এখনই কাজ শুরু করতে হবে।
স্থপতি ও নগরচিন্তাবিদ কাজী খালিদ আশরাফ তাঁর প্রস্তাবনা শুরুর আগে পুনর্বার ঢাকার দিকে তাকিয়েছেন। ঢাকাকে তুলনা করেছেন টোকিওর সঙ্গে, যা প্রতিমুহূর্তে পরিবর্তিত হয়ে চলেছে এবং এই প্রক্রিয়ার কোনো শেষ নেই। ঢাকা তার প্রকাশিত এবং অপ্রকাশিত সকল স্তর থেকে সুষম নগরবিন্যাসকে বিতাড়িত করেছে। এই শহর তার নিজস্ব নির্মাণভাষা আবিষ্কার করার আগেই নির্মিত হয়ে গেছে। বাড়িঘর, রাস্তা, খোলা জায়গা, জল-স্থলের সীমারেখার নির্মাণ কিংবা শহর-শহরতলি আর গ্রামীণ অঞ্চলের বিভাজন কীভাবে হবে এই সকল প্রকরণ নির্দিষ্ট হয়ে ওঠার আগে ঢাকা প্রবলভাবে আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। লেখক উল্লেখ করেছেন ‘যখন যেমন, তখন তেমন’ এই বাক্যাংশটি, যা এই নগরীর বিবিধ অরাজকতাকে নির্দেশ করে।
ক্ষতিকর নির্মাণের নির্বিকার আগ্রাসন, প্রবল শ্রেণিবৈষম্য এবং তাদের অন্তর্গত দূরত্ব, বিদ্যুৎ, পানি, জ্বালানির অনিশ্চয়তা, ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে যাওয়া সামাজিক সম্পর্ক তথা পাড়া-মহল্লার অবলুপ্তি, দুর্দশাগ্রস্ত রাস্তাঘাট এবং পরিবহন ব্যবস্থা, ভূমি ও জলাভূমির প্রতি নির্বিচার দখলদারিত্ব এবং সর্বোপরি মুক্ত সবুজ অঞ্চলকে ধ্বংসের অধিকারে নিয়ে যাওয়া – এসব মিলিয়ে এক অরাজক পরিস্থিতির মাঝে আমাদের জীবন অতিবাহিত হয়ে চলে। ক্রমান্বয়ে এই যাপনের সঙ্গে অভ্যস্ততার কারণে আমরা ভুলে যাই, কত সুন্দর আর অর্থময় হতে পারত এই শহরে আমাদের বেঁচে থাকা। রাজধানী ঢাকার এই জীর্ণরূপ ধীরে ধীরে সমগ্র দেশকেই আক্রান্ত করেছে। এই রিক্তশ্রী নগরীকে আদর্শ ধরে অসংখ্য ঢাকা গড়ে উঠেছে দেশজুড়ে। লেখক কাজী খালিদ আশরাফ এই প্রবণতাকে সবচেয়ে ক্ষতিকর আর হতাশাব্যঞ্জক বলে চিহ্নিত করছেন। যখন ঢাকার নিজেরই কোনো আদর্শিক অবস্থান নেই তখন তাকে অনুকরণ করা পক্ষান্তরে এই ক্ষতিকর রূপকে সহস্রগুণ করে তোলে।
সূচনাপর্বে গ্রন্থপরিচিতি লিখেছেন স্থপতি সাইফ-উল-হক। ডিজাইনিং ঢাকা প্রকাশনায় তাঁর অবদান অপরিসীম। এই বইটির বিভিন্ন অনুচ্ছেদেও মূল লেখক কাজী খালিদ আশরাফ স্থপতি সাইফ-উল-হকের মূল্যবান মতামত ও মতার্দশকে উদ্ধৃত করেছেন। স্থপতি সাইফ-উল-হক মনে করছেন, একটি নগরীর এমন অবাঞ্ছিত গড়ে ওঠাকে যদি বন্ধ করতে চাই তবে তা নতুনভাবে গড়ার মধ্য দিয়েই করা সম্ভব। তিনি সামগ্রিক মূল্যায়নে একটি উন্নত নগরীর জন্য তাঁর সুশাসনকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি ‘রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ বা রাজউকের প্রায়োগিক কর্মক্ষেত্রের সমালোচনা করেছেন। স্থাপত্য নগর ও পরিকল্পনার বিস্তৃত কর্মকাণ্ডকে পাশ কাটিয়ে রাজউক প্লট বরাদ্দ দেওয়া আর বাড়ির নকশা অনুমোদনের ছোট্ট গণ্ডিতে আটকে গেছে। অন্যদিকে সিটি করপোরেশনের কাজ বর্জ্য নিষ্কাশন আর রাস্তার উন্নয়নকর্মে সীমাবদ্ধ। এছাড়া বিভিন্ন খোলা জায়গা অধিকার করে সিটি করপোরেশনের মার্কেট ভবন নির্মাণে তাদের আগ্রহ ব্যাপকভাবে সমালোচিত।
এছাড়া ওয়াসা, ডেসা, তিতাস – যথাক্রম পানি, বিদ্যুৎ আর গ্যাস প্রদায়ী প্রতিষ্ঠানসমূহ নিজেদের সঙ্গে সমন্বয়হীনতায় আক্রান্ত থাকে। এই পরিস্থিতিতে নগরীর উন্নয়নকল্পে তাদের সম্মিলিত কোনো সুস্পষ্ট নীতিমালা বা কর্মপদ্ধতি থাকা সম্ভব নয়।
অপরদিকে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স, ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স এবং ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস – এই তিনটি প্রধান পেশাজীবী সংগঠনের সম্মিলিত অবস্থান-মতবিনিময় প্রয়োজন, যা নগর গঠনে আশাব্যঞ্জক ভূমিকা রাখতে পারে। পেশাজীবী এই সংগঠনের কোনো রকম আয়োজন নীতিনির্ধারক মহলে প্রভাব রাখছে না। বর্তমানে দেশে অনেক পরিবেশ সচেতন সক্রিয় সংগঠন করে উঠেছে, যাদের সাহসী পদক্ষেপের কারণে এখনো অনেক জলাভূমি, কৃষিক্ষেত্র দখলমুক্ত রাখা সম্ভব হয়েছে। স্থপতি সাইফ-উল-হক এমন সব সংগঠনের সম্মিলিত অবস্থান নগরীর সুশাসনের জন্য প্রয়োজনীয় মনে করেছেন।
ডিজাইনিং ঢাকা গ্রন্থে লেখক কাজী খালিদ আশরাফ ঢাকা নগরীর ছয় ধরনের ‘মরফোলজি’ বা গঠনকে চিহ্নিত করেছেন। যথা : বুড়িগঙ্গার দুই ধারে পুরাতন ঢাকা, রমনা-হাইকোর্ট এলাকায় ব্রিটিশ কলোনিয়াল স্থাপনা, ধানমন্ডি গুলশান উত্তরা এলাকার নতুন শহর যা প্রথমত. একটি বাড়ি একটি বাগান হিসেবে পরিচিত ছিল। নব্বইয়ের দশকে ছয়তলা মাল্টি ফ্যামিলি হাউজিং এবং বর্তমানে দশতলা হাউজিং ইউনিট হিসেবে অত্যন্ত ঘনবসতি অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। আমেরিকার বিখ্যাত স্থপতি লুই আই কানের ডিজাইনকৃত শেরেবাংলানগর এলাকা সম্পূর্ণ ভিন্ন এক নগর-প্রকরণ, যা প্রধানত সংসদ ভবন, এমপি হোটেল, হাসপাতাল এবং কিছু রো-হাউজিং এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছে। স্থপতি কানের ডিজাইনে এই অঞ্চল জলবিধৌত ‘গার্ডেন সিটি’ বা উদ্যান নগরীরূপে গড়ে উঠেছে।
এই চারটি নগরাঞ্চল ব্যতীত ঢাকার অবশিষ্ট এলাকা গড়ে উঠেছে যে বৈশিষ্ট্যে, তা যেন অন্তহীন এক ইট-কাঠ-কংক্রিটের ধূসর ঘনবসতি অঞ্চল। সেখানে অপ্রশস্ত পথ-ঘাট একে অন্যের গায়ে লেগে থাকা হতশ্রী নির্মাণের সারি আর অপর্যাপ্ত নাগরিক সুবিধায় বিপন্ন সব জনবসতি।
লেখকের বিশ্লেষণে ঢাকার সবশেষ ভগ্নাংশে নিুবিত্ত মানুষের বসবাস। রেললাইনের ধারে, ফুটপাথের পাশে কিংবা জলনিমগ্ন নিুাঞ্চলে বাঁশ, টিন, প্লাস্টিক-পলিথিনে উদ্বাস্তু এই আবাসন শহরের প্রায় চল্লিশ শতাংশ দরিদ্র মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে।
এই ছয়টি বিভাজনে – অসংগতিতে – ক্ষীয়মাণ সামাজিক সম্পর্কে – সংক্ষিপ্ত সবুজে আর পরস্পর থেকে নিজস্ব দূরত্বে গড়ে উঠেছে আমাদের রাজধানী ঢাকা। লেখকের দৃষ্টিতে এমন বসবাস প্রতিদিনই অসহনীয় সব প্রবঞ্চনার জন্ম দিয়ে চলেছে। এই শহরে তার নাগরিকদের যাপিত সময়কাল তাই বেদনাবিধুর আর বিয়োগান্তক।
লেখক কাজী খালিদ আশরাফ তাঁর ডিজাইনিং ঢাকার পরবর্তী অনুচ্ছেদে একে একে পনেরোটি নির্দিষ্ট বিষয়কে উল্লেখ করেছেন, যার মধ্য দিয়ে ঢাকার বাস্তবিক বদলে যাওয়ার পথনির্দেশনা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘকালীন শিক্ষকতার সময়জুড়ে লেখক তাঁর ডিজাইন স্টুডিওতে ঢাকা তথা বাংলাদেশের নগর পরিকল্পনা নিয়ে বিভিন্ন প্রজেক্ট করিয়েছেন। তাঁর পরিচালনায় এই সকল আরবান ডিজাইন এবং আর্কিটেকচার স্টুডিও নিয়ত মৌসুমি জলবায়ু অধ্যুষিত জলসংলগ্ন এই শহরের নির্মাণ কীভাবে হতে পারে সেই গবেষণায় নিয়োজিত থেকেছে। ডিজাইনিং ঢাকা হয়ে উঠেছে এসব গবেষণালব্ধ নতুন নির্মাণধারার এক পূর্ণাঙ্গ উপস্থাপনা, যা বাস্তবসম্মত, বৈজ্ঞানিক এবং প্রথম শ্রেণির মেধামানসম্পন্ন। স্থপতি, নগরচিন্তাবিদ, শিক্ষক, গবেষক এবং সর্বোপরি একজন সক্রিয় কর্মচঞ্চল ব্যক্তিত্ব কাজী খালিদ আশরাফ বিশ্বাস করেন, জীবনযাপনের সর্বনিু সূচকের পরিসংখ্যান নিয়ে ঢাকা তথা বাংলাদেশের ছোট-বড় শহরগুলো কেবল ধ্বংস হয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় বসে থাকবে না। আমাদের শহরগুলো একদিন জলবিধৌত ভূখণ্ডে নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুতে থাকা সব শহরের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে গড়ে উঠবে। রাজধানী ঢাকা এই ক্রান্তীয় নগরগুলোর নেতৃত্বে অবস্থান করবে। ঢাকা হবে বদ্বীপ ভূখণ্ডের শ্রেষ্ঠ রাজধানী – নদীশাসিত শস্যনির্ভর এক ভূখণ্ড। পরিবেশগত, সামাজিক আর অর্থনৈতিক মানদণ্ডে স্বয়ংসম্পূর্ণ এক আধুনিক বাঙালি নগরী।
কেবল স্বপ্ন গন্তব্য নয়, ঢাকা হবে সমগ্র বাংলাদেশের বদলে যাওয়ার নিয়ামক। ১৯৬৮ সালে বাংলাদেশের স্থাপত্যের প্রবাদপুরুষ মাজহারুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘শহরগুলো যেন আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে আত্মস্থ করে পরিবেশসম্মত সভ্য জীবনযাপনকে নিশ্চিত করতে পারে। নগরের বিন্যাস যেন নগর আর গ্রামের সকল বিভাজন আর যাপনের বৈপরীত্যকে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত করে দিতে পারে। আমাদের গ্রামীণজীবন যেভাবে পরিবেশকে নিজের অস্তিত্বের অংশ করে নিয়েছে সেই প্রবণতা যেন নগরজীবনেও ব্যাপিত হয়।
এবনেজার হাওয়ার্ড যে ‘গার্ডেন সিটি’র ধারণা দিয়ে সারাবিশ্বকে আমূল নাড়া দিয়েছিলেন, স্থপতি মাজহারুল ইসলামের নগরচিন্তা সেই মতাদর্শকেই অনুসরণ করেছে। সেই সঙ্গে তিনি বাংলাদেশের আদর্শ নগরজীবনের সবচেয়ে আলোকিত দৃষ্টান্তের রূপরেখা নির্দেশ করেছিলেন। মহান স্থপতির এই চিন্তাধারাকে কোনো নীতিনির্ধারক, পরিকল্পনাকারী বা স্থপতি কেউই এখন পর্যন্ত গ্রহণ করেননি বলে লেখক বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
ঢাকা বা বিভিন্ন জেলা শহরকে গড়ে তুলবার জন্য এর পার্শ্ববর্তী গ্রামাঞ্চলকে নিয়ে একসঙ্গে সামগ্রিক উন্নয়ন প্রয়োজন। শহর আর গ্রামের বিভাজন এই দুইয়ের ধ্বংস হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। শহরের প্রান্তিক অঞ্চলের উন্নয়ন তাই অত্যন্ত জটিল এবং স্পর্শকাতর বিষয়। জল-স্থলের প্রান্তে নির্মাণ ব্যবস্থাপনা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গ্রাম ও শহরের প্রান্তও অনেক মনোযোগ দাবি করে ।
আর্থ-গুগলে ঢাকার চারপাশের প্রান্তীয় অঞ্চলের দিকে তাকালে দেখা যায় সবুজ আর নীলের বিস্তার, সেই সঙ্গে টুকরো হয়ে থাকা গ্রামীণ বসবাস অঞ্চল, ধানক্ষেতের আল, উঁচু-নিচু ভূমিরূপ – সমগ্র বাংলাদেশের চিত্রও এমনি। নদীনালা, খালবিলের নকশা জালে ছোট-বড় সবুজ গ্রাম আর পার্শ¦বর্তী কিছু নাগরিক নির্মাণ যা একে অন্যের সঙ্গে বিবাদপূর্ণ আর অধিগ্রহণে, আগ্রাসনে পরস্পরবিরোধী।
লেখক মনে করছেন, শহর আর গ্রামের এই বিবদমান বৈসাদৃশ্যের পরিবর্তে আমরা এমন নগরী নির্মাণ করতে পারি, যা নাগরিক স্থাপনার সঙ্গে বন্যাপ্রবণতা, কৃষিজ অর্থনীতি আর গ্রামীণ সবুজের এক সুষম সম্পর্ক তৈরি করবে। সারাবিশ্বে উন্নত নগরীর ধারণায় আমাদের শহরগুলো ‘কৃষিজ নগরায়ণে’র সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবহারিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে।
রাজধানী ঢাকাকে পরিবর্তনের এই ধারায় নিয়ে আসতে হলে একই সঙ্গে বাস্তবতা আর কল্পনাকে আশ্রয় করে একটি স্বপ্নগন্তব্য তৈরি করতে হবে, যা পরিবেশের জন্য, মানুষের জন্য এবং অর্থনীতির জন্য কল্যাণকর হতে পারে।
লেখক জানিয়েছেন, আমাদের সামনে দুটো পথ খোলা আছে, এক. ঢাকা যেভাবে গড়ে উঠছে তাই বাস্তব ভেবে বসে থাকা, দুই. নগরজীবনের উন্নত ধারণা তৈরি করা, যা বর্তমান নগরপ্রবণতা থেকে বহুগুণে উন্নত এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ডিজাইনিং ঢাকা এই দ্বিতীয় ধারণার পথনির্দেশ করছে।
লেখক কাজী খালিদ আশরাফ এই বদলে যাওয়া শহরের জন্য পনেরোটি প্রস্তাবনা রেখেছেন। প্রতিটি স্তরে তিনি বিশদ আলোচনা, ড্রইং-ডায়াগ্রাম এবং উপাত্তের সংযোজনা উপস্থাপন করেছেন।
এক. নগরায়ণ নয়; নগর সংস্কৃতি : জ্যামিতিক রেখায় পথঘাটের বিন্যাস আর সারিবদ্ধ প্লটে সুউচ্চ অট্টালিকায় দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে শহরের বেড়ে চলাকে উৎসাহ দেওয়ার কিছু নেই। এমন নগরায়ণ তার নাগরিকদের জন্য শুভ হতে পারেনি। ভাবতে হবে, নগরে বসবাস কীভাবে মানবজীবনের সুন্দরতম অভিজ্ঞতা হয়ে উঠতে পারে। কীভাবে তা ভারসাম্যপূর্ণ সামাজিক পরিবেশ তৈরি করবে, কীভাবে তা প্রকৃতি, জলবায়ু আর ভূমিরূপের সঙ্গে ছন্দময় সংস্থাপনা দেবে এবং সর্বোপরি তা দৃশ্যগত নন্দনকেও অধিকার করবে।
লেখক শহরের আত্মা অনুসন্ধানের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। শহরকে বুঝতে হলে শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ওপর নির্ভরতা নয়, বরং অনুধাবন করতে হবে মানুষের নাগরিক জীবন, সম্ভাব্য সামাজিক বসবাস ও তার বিচরণক্ষেত্র। একটি নগরের প্রাণ হলো তার নাগরিকদের পারস্পরিক সামাজিক যোগাযোগ, যা তাদের জীবনকে অর্থময় আর প্রাণবন্ত করে। নগর নির্মাণে তাই কেবল এর অবকাঠামো নয়, তার ভেতরে মানুষের সম্মিলিত জীবনযাপনকে সার্থক করে তুলতে হবে। নগরজীবিতা বা নগর সংস্কৃতি মানুষের এই সম্মিলিত যাপনকে নির্দেশ করে। নগর পরিকল্পনায় তাই ভৌত স্থাপনাকে দৃশ্যমান করে তোলার অনেক আগে নগরের দর্শনকে আত্মস্থ করা জরুরি, যা অদৃশ্য কিন্তু প্রবলভাবে আমাদের অন্তর্গত অস্তিত্ব নির্দেশ করে।
দুই. জল আর স্থলের সমন্বয়ে বদ্বীপ অঞ্চলের নির্মাণ : বাংলাদেশ নিরঙ্কুশভাবে নদী-খালবিল তথা জল অধ্যুষিত এক ভূমিরূপ। অথচ নগর নির্মাণে আমরা প্রথমেই সেই কথা বিস্মৃত হই। আমাদের নগর পরিকল্পনা তার ভূমিরূপ আর জলবায়ুকে অগ্রাহ্য করে গড়ে উঠতে পারে না।
লেখক এই বিষয়টিকে প্রভূত গুরুত্ব দিয়েছেন – যা তিনি সংজ্ঞায়িত করছেন ‘হাইড্রো-ইকোলজিক্যাল’ নামে। ঢাকার অবস্থান হাইড্রো-ইকোলজিক্যাল ভূমিরূপে, তাই জলাভূমি ভরাট করে কেবল শুষ্ক-জলহীন ঢাকা নির্মাণ করার অর্থ সরাসরি পরিবেশ-প্রকৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। জল যেমন আমাদের ভূমিরূপের অংশ তেমনি তা আমাদের মনস্তত্ত্বের অংশ, আমাদের অস্তিত্বের অংশ। নগর পরিকল্পনায় তাই জল ও স্থল এই দুইয়ের সমান গুরুত্ব প্রয়োজন। ‘ল্যান্ড ইউজ’ বা ভূমি ব্যবহারের পরিবর্তে ভূমি ও জলের ব্যবহার আমাদের জন্য প্রযোজ্য। বিষয়টি যেন কখনই জল বনাম স্থল না হয়ে যায়।
লেখক প্রশ্ন রেখেছেন : ঢাকা কি তার জলনির্ভর বদ্বীপ ভূমিরূপকে আত্মস্থ করে ক্রান্তীয় অঞ্চলের পরিবেশের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ একটি নতুন নগর সংস্কৃতির ধারণা দিতে পারে না? জলের প্রকৌশল, বদ্বীপীয় ভূগোল, পরিবেশবান্ধব জ্বালানিশক্তি আর অগ্রসরমাণ কৃষিজ ব্যবস্থাপনা – সব মিলিয়ে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ, সমৃদ্ধ শহর হয়ে উঠবে না আমাদের ঢাকা?
তিন. প্রান্ত থেকে শুরু : শহর এবং গ্রাম যেখানে মিলিত হয়েছে কিংবা বিরোধে অবতীর্ণ হয়েছে সেই প্রান্তিক অঞ্চল থেকে শুরু করতে হবে, যাকে আমরা ভেবেছি নগরীর শেষ। যাকে মনে করা হয়েছে আদিম, অনগ্রসর, পতিত অঞ্চল। যেখানে শহরবাসীর সঙ্গে দেখা হয় কৃষকের আর একজন ভূমিদস্যু নির্মাতা মনে করে, এই সেই স্থান যা অবলীলায় বালু দিয়ে ভরাট করে বিক্রি করে দেওয়া যাবে বিভিন্ন ‘সিটি’ ‘ভ্যালি’র চিত্তাকর্ষক বিজ্ঞাপন দিয়ে।
সেই প্রান্তিক অঞ্চল অত্যন্ত স্পর্শকাতর, যেখানে জল, কৃষিকাজ আর বন্যাপ্রবণতাকে ঘিরে ভাবতে হবে একটি সামাজিক বলয়, যা অর্থনৈতিক সচ্ছলতার পাশাপাশি গ্রাম আর শহরকে এক বিন্দুতে সুষম গ্রন্থনা দেবে, যেখানে শহরের মৌলিক অবকাঠামো গ্রাহ্য করবে বন্যার জল আর কৃষিজ জীবনকে। এখানে সবুজ গ্রাম প্রবেশ করবে শহরাঞ্চলে আর শহরের সুযোগ-সুবিধা পৌঁছে যাবে গ্রামে। এই
প্রান্তীয় অঞ্চল উভয়ের জন্য একটি মোহনীয় সম্মিলন কেন্দ্র রূপে গড়ে উঠতে পারে।
গ্রাম পার্শ্ববর্তী ‘এজ সিটি’ বা প্রান্তীয় শহর, নদীর তীরবর্তী ‘লিনিয়ার সিটি’ বা ‘রৈখিক শহরে’র ত্রিমাত্রিক সম্ভাবনাকে লেখক বিবিধ চিত্রভাষায় উপস্থাপন করেছেন।
চার. ঢাকা একটি দ্বীপ : বুড়িগঙ্গা, তুরাগ আর বালু নদী ঢাকার চারপাশ ঘিরে আছে। ঢাকা এই তিনটি নদীর অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে থাকা একটি দ্বীপ। অথচ ঢাকার গড়ে ওঠার সঙ্গে বা বৃদ্ধির সঙ্গে এই নদীসংলগ্ন থাকাকে গ্রাহ্য করা হয়নি – সম্পৃক্ত করাও হয়নি। নদী হতে পারে শহরে যোগাযোগের মাধ্যম, নতুন অর্থনীতির নিয়ামক, পরিবেশগত ভারসাম্যের কেন্দ্রবিন্দু আর আমাদের সংস্কৃতির অংশ। লেখক প্রস্তাব করেছেন বুড়িগঙ্গার তীর থেকে মূল সদরঘাট টার্মিনাল সরিয়ে কিছু ছোট টার্মিনাল নদীর তীর ধরে নির্মাণ করা, ট্যানারি সরিয়ে দেওয়া, কিছু খালের সঙ্গে নদীর সংযোগ ঘটানো। সব মিলিয়ে তা বছরে আশি ইঞ্চি বৃষ্টিপাতের জল নিষ্কাশন থেকে শুরু করে অন্তর্বর্তী জল যোগাযোগ, পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি, নদীর ধারে ঘোড়দৌড়, নদীতে নৌকাবাইচ, নদীর তীরে বিভিন্ন মেলা এবং সর্বোপরি নগরকেন্দ্র গড়ে ওঠার মাধ্যমে আমাদের শহর হয়ে উঠতে পারে নদীনির্ভর-নদীবান্ধব বাংলার একটি শহর। লেখক উদ্ধৃত করেছেন, ‘বদ্বীপ থেকে ঢাকাকে সরানো যেতে পারে, কিন্তু ঢাকা থেকে বদ্বীপকে কখনই সরানো যাবে না।’
পাঁচ. বিযুক্ত ঢাকা, সংযুক্ত ঢাকা : এ অধ্যায়ে একটি বৃত্তাকার মালায় ছোট ছোট ঘনবৃত্তের মাধ্যমে নির্দেশিত হয়েছে কিছু ছোট শহর যেমন, মুন্সীগঞ্জ, দোহার, শ্রীনগর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, টাঙ্গাইল, ধামরাই প্রভৃতি। এই বৃত্তাকার চক্রের প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে রাজধানী ঢাকা। রাজধানী ঢাকা থেকে সরলরেখা সংযুক্ত করেছে প্রতিটি ছোট শহরকে। লেখক এর নাম দিয়েছেন ‘ঢাকা নেক্সাস’। মূলত ‘ঢাকা নেক্সাস’ নির্দেশ করছে ঢাকার ব্যাপিত হওয়া, ঢাকার বৃদ্ধি এবং তা উভমুখী নিবিড় যোগাযোগকে অক্ষুণœ রেখে। যোগাযোগের জন্য দ্রুতগতির ট্রেন, বিভিন্ন রুট ও সময় নির্ভর নিরাপদ বাস এবং নদীতে লঞ্চ-স্টিমার – এই তিন ধরনের গণপরিবহনের প্রচলন ঘটাতে হবে। একই সঙ্গে সহজলভ্য ট্যাক্সি সার্ভিসের প্রয়োজন।
‘ঢাকা নেক্সাসে’র প্রথম বৃত্তে সাভার, ধামরাই গাজীপুর, ঘোড়াশাল, মাওয়া ও নারায়ণগঞ্জ ঢাকার সঙ্গে যুক্ত হবে ব্যাপক গণপরিবহনের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে। এতে বাসস্থানকে দূরে রেখেও ঢাকায় কর্মক্ষেত্রে বা নাগরিক সুবিধার কেন্দ্রে আসা-যাওয়া করা যাবে। ‘ঢাকা নেক্সাসে’র পরবর্তী বৃত্তে সংযুক্ত হবে উত্তরে ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, জামালপুর; পশ্চিমে টাঙ্গাইল ও মানিকগঞ্জ; পূর্বে কুমিল্লা ও ভৈরব এবং দক্ষিণে পদ্মাপারের চাঁদপুর, ফরিদপুর ও মাদারীপুর। মনে রাখতে হবে, ‘ঢাকা নেক্সাসে’র গণপরিবহনভিত্তিক সংযোগ করিডর ছাড়া বাকি মধ্যবর্তী অঞ্চল থাকবে গ্রাম, কৃষিক্ষেত্র এবং বনজ অঞ্চলরূপে সংরক্ষিত। এসব সংযোগ করিডর যে সকল অঞ্চল স্পর্শ করে শহরে প্রবেশ করবে তা নতুন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র রূপে গড়ে উঠতে পারে। যেমন : ঢাকার উত্তরে টঙ্গী শিল্পাঞ্চল এই প্রক্রিয়ায় বর্তমানে অগোছালো অরাজক পরিস্থিতি কাটিয়ে তুরাগ তীরবর্তী অঞ্চলে নতুন এক সংযোগকেন্দ্র রূপে গড়ে উঠতে পারে।
সংযোগ করিডরকে ঘিরে কীভাবে ‘ক্লাস্টার সেটলমেন্ট’ বা গুচ্ছ আবাসন প্রয়োজনীয় জনঘনত্বকে সমৃদ্ধ নাগরিক সুবিধা দিতে পারে, লেখক কাজী খালিদ আশরাফ বিভিন্ন ত্রিমাত্রিক মডেলিংয়ের মাধ্যমে তা উপস্থাপন করেছেন।
ছয়. নগর মানে গতিময়তা : একটি সমৃদ্ধ শহর মানে তার নাগরিকদের জন্য ব্যাপিত পরিবহন ব্যবস্থা, যা তার গতিবিধিকে অবারিত ও মুক্ত রাখে। বিভিন্ন ধরনের গণপরিবহন একটি শহরকে গতিশীল রাখে। মিরপুর রোড আর ময়মনসিংহ রোড উত্তর-দক্ষিণে ঢাকার প্রধান যোগাযোগ সড়ক। পূর্ব-পশ্চিমে ঢাকাকে সংযুক্ত করবে এমন দীর্ঘ কোনো সড়ক ব্যবস্থা নেই। আবার ক্যান্টনমেন্ট, বিডিআর ও পুরাতন বিমানবন্দর – এই তিন সংরক্ষিত অঞ্চল ঢাকার সুষম সংযোগ ব্যবস্থাকে ব্যাহত করেছে। বিজয় সরণির পর একেবারে আশুলিয়া সড়কে এসে ঢাকার পূর্ব থেকে পশ্চিমে আসা-যাওয়া করা যায়, আশ্চর্যজনক হলেও এটি সত্যি – যা ঢাকার মতো একটি শহরে অবাস্তব পরিস্থিতি তৈরি করে রেখেছে।
যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আবাসন, কর্মক্ষেত্র, নাগরিক সুযোগ-সুবিধা, শহরের অবকাঠামো এবং অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞের সঙ্গে মিলিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে। সর্বোপরি ‘ঢাকা নেক্সাসে’র ধারণা ছাড়া তার পরিকল্পনা অসম্ভব। ঢাকা কীভাবে সম্প্রসারিত হবে, ভেতরে ও বাইরে সংযুক্ত হবে তার নেটওয়ার্কিং তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমান ঢাকার রাস্তাঘাট, ফ্লাইওভার সবই ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহারকে উৎসাহিত করছে, যা শহরের জন্য নেতিবাচক। একই সঙ্গে তা সামাজিক শ্রেণিবিভাজন ও বৈষম্যকে বাড়িয়ে দেয়। শহরের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের জন্য ছোট ট্রেন, বাস, ওয়াটার বোট-ফেরি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নাগরিকদের জন্য বিভিন্ন ধরনের গণপরিবহন মাধ্যম প্রয়োজন। বাস চলাচল নির্বিঘœ করতে রাস্তায় শুধু বাস লেন করা যায়। মানুষ টানা রিকশা পরিবহনকে লেখক অমানবিক ও অপ্রয়োজনীয় বলেছেন। বাইসাইকেল লেন, পায়ে হাঁটা পথ বা এলাকাভিত্তিক চক্রাকার বাস রুট রিকশার স্থলে অভিষিক্ত হতে পারে। এসব পরিবহন যেমন স্বাস্থ্যকর, তেমনি তা সামাজিক যোগাযোগও বাড়িয়ে দিতে পারে। রিকশাচালকদের কর্মসংস্থানে এসব গণপরিবহন নতুন ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে, যা তাদের জীবনযাত্রাকে আরো মানসম্পন্ন করবে।
পার্কিংয়ের সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন পয়েন্টে উঁচুতলার পার্কিং বিল্ডিং করা দরকার। সেই ভবনসমূহকে বহুমুখী ব্যবহার দেওয়া যেতে পারে। ভবনের প্রথম বা দ্বিতীয় তলায় বাণিজ্যিক ব্যবহার, পরবর্তী পাঁচ-ছয় তলা পার্কিং এবং তার পরবর্তী ফ্লোরসমূহ অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। বাসের ক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহার করা যাবে। শুধুমাত্র বাস সার্ভিসকে ব্যবহার করে কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোটা বা ব্রাজিলের কুরিচিবা তাদের গণপরিবহন ব্যবস্থাকে বিশ্বমানে নিয়ে গেছে, সেই সঙ্গে নগরের বিভিন্ন পতিত স্থানকে কার্যকর ভূমি ব্যবস্থাপনা দিয়েছে। আমাদের দেশেও সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে তেমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করা সম্ভব।
রেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে শহরের চারপাশের উঁচু বেড়িবাঁধ অঞ্চলকে ট্রেনরুট হিসেবে নির্মাণ করা যায় এবং শহর মধ্যবর্তী অঞ্চলকে এর সহায়ক নেটওয়ার্কে জালের ন্যায় বিন্যস্ত করা যায়। লেখক ট্রেনের মূল স্টেশনকে কমলাপুর থেকে টঙ্গীতে সরিয়ে নেওয়ার কথা বলেছেন। এখন নারায়ণগঞ্জ থেকে টঙ্গী দ্রুতগামী ট্রেন যোগাযোগ সম্ভব, যা একই সঙ্গে ঢাকার উত্তর-দক্ষিণ অঞ্চলের মধ্যে দ্রুত যোগাযোগ ঘটাতে পারে। আবার ঢাকা নেক্সাসের পরিকল্পনায় চক্রাকার ট্রেন সার্ভিস ‘ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্টে’র ধারণায় অনেক কার্যকর আবাসিক এলাকা তৈরি করতে পারবে।
লেখক আরো আশাবাদী হয়ে দ্বিতল ট্রেনলাইনের কথা বলেছেন। উত্তর-দক্ষিণে সম্প্রসারিত নিচের লেভেলের ট্রেন আন্তজেলাভিত্তিক যোগাযোগের জন্য ব্যবহৃত হবে। ওপরের লেভেলে মেট্রো রেল নারায়ণগঞ্জ থেকে গাজীপুর পর্যন্ত সম্প্রসারিত হবে। এছাড়া লেখক জলপরিবহন ব্যবস্থা হিসেবে ‘ওয়াটার বাস’ এবং রিভার ট্যাক্সি’র ধারণা দিয়েছেন, যা ঢাকার চারপাশে চক্রাকারে আবর্তন ছাড়াও শহরের মধ্যবর্তী অঞ্চলে যথাসম্ভব প্রবেশ করবে এবং যাত্রী পরিবহনে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
সাত. পথচারীদের জন্য প্রশস্ত পথ, গাড়ির ব্যবহার সীমিতকরণ : প্রশস্ত ফুটপাথ সভ্য শহরের অন্যতম প্রয়োজনীয় নাগরিক সুবিধাকে নির্দেশ করে। হেঁটে চলে ঘুরে বেড়ানোর সংস্কৃতি আমাদের শহর থেকে অদৃশ্য হয়েছে, হেঁটে চলা পথচারী যেন দারিদ্র্যের প্রতীক। ব্যক্তিগত গাড়ি হয়েছে জীবনের সাফল্যকে বিজ্ঞাপিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।
লেখক উদ্ধৃত করেছেন, ফুটপাথ বা সাইডওয়াক কখনই রাস্তার ধারে ড্রেনের কভার নয়, কিংবা রাস্তার পাশের উদ্বৃত্ত পরিসর নয়। ফুটপাথ পথচারীদের হেঁটে চলার, অপেক্ষা করার, দাঁড়িয়ে কথা বলার বা পত্রিকা পড়ার জায়গা হবে। তা আলোকিত থাকবে সবসময়, তাতে ক্লান্ত পথিকের বসার জায়গা থাকবে, সেই সঙ্গে থাকবে ছোট সবুজ কিংবা পানির ধারা। সাইডওয়াক ডিজাইনে যোগ হতে পারে চায়ের দোকান, পত্রিকা স্টল, রোদ-বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার জায়গা। অনেক ধনী দেশ হওয়া সত্ত্বেও হংকংয়ের নগর পরিকল্পনায় পথচারীবান্ধব রাস্তা তাদের গাড়ির ওপর নির্ভরতা কমিয়েছে – তাদের জন্য এটি একটি দৃষ্টান্ত যারা হেঁটে চলাকে দারিদ্র্যের বৈশিষ্ট্য বলে মনে করেন।
সংসদ ভবনের উত্তর পাশের মতো প্রশস্ত সাইডওয়াক ঢাকা শহরে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেই পথে হেঁটে যেতে যেতে যে-কোনো পথিকের মনে হবে কত সুন্দর হতে পারে একটি পথে হেঁটে চলার সব মুহূর্ত।
আট. আবাসন বিন্যাস শহরের প্রধান গঠন বিন্যাস : এখন পর্যন্ত ঢাকায় সেই আবাসন-ঐতিহ্য গড়ে ওঠেনি, যা একত্রে সামাজিকভাবে বসবাসের কোনোরকম অনুভব দেয়। উঁচু পাঁচিলঘেরা একেকটি বিচ্ছিন্ন প্লটে যে আবাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তা ক্ষয়িষ্ণু, ভেঙে পড়া সামাজিক জীবনকে নির্দেশ করে। পুরান ঢাকার মহল্লাভিত্তিক আবাসন কাঠামো এখনো আমাদের একমাত্র সমাজবদ্ধ জীবনের প্রতীক, যা এখন স্মৃতি মাত্র। লেখক এই প্লটভিত্তিক আবাসন ব্যবস্থার সমালোচনা করেছেন এবং কীভাবে এই প্লটগুলো এক হয়ে বড় হাউজিং ব্লক নির্মাণ করতে পারে তার উদাহরণ উপস্থাপন করেছেন। এমন সিটি ব্লক নিশ্চিত করতে পারে বিভিন্ন সার্ভিস বা সুযোগ-সুবিধা পরস্পরের মধ্যে ভাগ করে নেওয়া, যা সম্পদের অপচয় রোধ করবে। একই সঙ্গে তা বাড়ির অভ্যন্তরীণ সবুজ উঠান তৈরি করবে, যা অধিবাসীদের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত থাকবে, শিশুদের খেলার জায়গার সংস্থান হবে – ছোট বাগান করার পরিসর হিসেবেও তা ব্যবহৃত হবে। সেই সঙ্গে তা অধিবাসীদের জন্য আলো-বাতাস বয়ে আনবে। এমন সম্মিলিত আবাসন ব্যবস্থা কেবল সমৃদ্ধ সামাজিক সম্পর্ক তৈরি করবে না, তা অধিবাসীদের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করবে। এমন আবাসিক এলাকাগুলো গণপরিবহন ব্যবস্থার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত থাকবে। অধিবাসীরা পাঁচ মিনিটের পায়ে হাঁটা দূরত্বে সকল নাগরিক সুবিধা, কেনাকাটার স্থান, অফিস, পার্ক, কমিউনিটি স্পেস, ছোট পার্ক, খেলার জায়গা, স্কুল, ডে-কেয়ার খুঁজে পাবেন, যা স্বয়ংসম্পূর্ণ আবাসিক এলাকারূপে গড়ে উঠবে। বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের জন্য সহজে প্রাপ্য বিভিন্ন ধরনের ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা থাকবে, যা শ্রেণিবৈষম্য কমিয়ে আসবে। নির্মাণসমূহ কীভাবে আমাদের জলবায়ুর সঙ্গে সংগতি রেখে প্যাভিলিয়নের ধারণায় গড়ে উঠতে পারে এবং সেই সঙ্গে তা নগরের ছোট কৃষিক্ষেত্রও তৈরি করতে পারে লেখক তার ধারণা দিয়েছেন। এসব সবুজ বাগান একই সঙ্গে পরিবেশকে শীতল রাখবে, মানুষের খাদ্যের চাহিদা মেটাবে আর মুক্ত সামাজিক পরিসর তৈরি করবে।
নয়. খোলা জায়গার প্রয়োজনীয়তা নির্মিত ভবনের চেয়েও বেশি : আশুলিয়ার সড়কজুড়ে বিকেল-সন্ধ্যায় মানুষের ভিড় বলে দেয় সেই উন্মুক্ত অঙ্গন শহরের মানুষের জন্য কতটা প্রয়োজন। কেবল রমনা পার্ক আর ধানমন্ডির লেক অঞ্চল নয়, প্রতিটি আবাসিক এলাকায় চাই খোলা সবুজ প্রাঙ্গণ, তা যত ছোট আকারেই থাক না কেন। ঢাকাকে উদ্যাননগরী রূপে গড়ে তোলার দিকনির্দেশনা রেখেছিলেন স্থপতি মাজহারুল ইসলাম – সামগ্রিক উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে তা অর্জন সম্ভব। বাড়ির ছাদ, রাস্তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল, দেয়াল, রাস্তার মধ্যবর্তী আইল্যান্ড, এই সকল পতিত অংশে সবুজের সমারোহ সম্ভব, যা একই সঙ্গে ছোট ছোট সামাজিক যোগাযোগের স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। এছাড়া সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে অনেক ছোট-বড় আকারে পাবলিক স্পেস নির্মাণ প্রয়োজন, যা সবুজ অঞ্চল, ফোয়ারা, লাইটপোস্ট, বেঞ্চ, পত্রিকা স্ট্যান্ড, বিলবোর্ড, ভাস্কর্য সব মিলিয়ে এক ‘আরবান আর্ট’-এর চিত্রভাষা নির্মাণ করতে পারে। লেখক সামাজিক এই সব সম্মিলন কেন্দ্রকে ব্যবহার করার সংস্কৃতিতে ফিরিয়ে আসার কথা বলেছেন এবং পার্ক বা খোলা প্রাঙ্গণ নির্মাণের জন্য নীতিমালা গ্রহণের তাগিদ দিয়েছেন।
দশ. সুশাসন ও নগর ব্যবস্থাপনা : সিটি করপোরেশন হতে পারে মূল নগরীর সুশাসনের প্রধান কেন্দ্র। একেকটি ওয়ার্ড ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত হয়ে শহরের সর্বত্র নিয়মতান্ত্রিকভাবে নগরের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিতে পারে। আমাদের একটি ওয়ার্ডে যত মানুষের বসবাস, পৃথিবীর অনেক শহরেও এত জনসংখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না। শহরের মেয়র যেন সুদূরদর্শী এবং প্রাজ্ঞ হন, যাঁর সঙ্গে পেশাজীবী সকল সংগঠনের নিবিড় যোগাযোগ থাকবে। এছাড়া লেখক বিভিন্ন আবাসিক অঞ্চলের অধিবাসীদের সমন্বিত প্রয়াসকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন। নিজ এলাকার ছোট-বড় সমস্যা বা উন্নতিকরণের জন্য তাদের নিয়মিত সমাবেশ আর পারস্পরিক মতবিনিময় প্রয়োজন। এছাড়া বিভিন্ন দিবসভিত্তিক সাংস্কৃতিক প্রয়াসে নিজ এলাকার অধিবাসীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ তাদের নিজ অঞ্চলের প্রতি দায়িত্ব, অধিকার আর মমত্ববোধ জাগ্রত করবে। এভাবে যে সুশীল সমাজের জন্ম হবে তারা যেন তাদের অধিকারের বিষয়ে প্রতিনিয়ত সক্রিয় ভূমিকা রাখে। সেই কণ্ঠস্বরকে সঠিক জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব টেলিভিশন ও প্রিন্ট মিডিয়ার। লেখক আশা করেন, এভাবেই ঢাকা তার যোগ্য নেতৃত্ব খুঁজে নেবে।
এগারো. পুরাকীর্তিকে নগর সম্পদরূপে সংরক্ষণ : প্রাচীন স্থাপনা, তা হতে পারে একটি ভবন কিংবা একটি পথ বা একটি খিলান – সবই আমাদের অতীত ঐতিহ্যকে নির্দেশ করে। আমাদের প্রাচীন সেই নিদর্শন আমাদের ভবিষ্যতের পথনির্দেশনা দেবে। লেখকের স্মৃতিবিধুরতায় পুরান ঢাকাকে ঘিরে আমাদের মহল্লাভিত্তিক সামাজিক বেঁচে থাকা আর কারুকার্যময় একেকটি স্থাপনা – সবই আমাদের নগরীর অলংকার হয়ে বেঁচে থাকে। শাঁখারীবাজার থেকে লালবাগ, ওয়ারী থেকে আরমানিটোলা, বিবিধ সব নির্মাণ, বিচিত্র সেই সামাজিক পরিমণ্ডল সবই যেন সুরক্ষিত থাকে। সংরক্ষণ আর পুনর্নির্মাণের সুস্পষ্ট প্রক্রিয়াগত আর নীতিগত পরিকল্পনা এসব নগর ঐতিহ্যকে নতুন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করতে পারে। একইভাবে লেখক রমনা অঞ্চলের ব্রিটিশ কলোনিয়াল স্থাপনার সংরক্ষণকে জরুরি মনে করেন। সারা শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে এমন প্রতœতাত্ত্বিক ঐতিহ্য। সেই সঙ্গে অনেক অঞ্চল নিকট-অতীতে নির্মিত হয়েছে, যা আমাদের প্রাত্যহিক সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে গেছে, সেসব নির্মাণকেও সংরক্ষণের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
বারো. প্রভাবক স্থাপত্যে বিনিয়োগ : স্পেনের নিরুত্তাপ বিলবাও শহর যেমন আমূল বদলে গেছে স্থপতি ফ্রাংক গেহরির নির্মিত একটি জাদুঘরের কল্যাণে, ঢাকার বিভিন্ন মুক্ত সামাজিক সম্মিলন কেন্দ্র সেই সম্ভাবনায় নির্মিত হতে পারে। পুরাতন এয়ারপোর্ট এলাকা, কেন্দ্রীয় জেলখানা এলাকা, টঙ্গী ব্রিজ এলাকা, আশুলিয়ার জল-স্থলভূমি বা তেজগাঁওয়ের শিল্প এলাকা এমন অনেক স্বল্প ব্যবহৃত পরিসরে গড়ে উঠতে পারে উন্নত নগরকেন্দ্র। বিশ্বের সেরা দশ স্থপতিকে এসব অঞ্চল ডিজাইনের জন্য আহ্বান জানানো যেতে পারে। এর ফলে ঢাকা আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, যা অসংখ্য নতুন অর্থনৈতিক বিনিয়োগ ক্ষেত্র সৃষ্টি করবে। এই পরিবর্তন ঢাকাকে আমূল বদলে দিতে পারে – ঢাকা এই অঞ্চলের বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্ররূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। লেখক তাঁর নিজের এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন স্থাপত্য নমুনা উপস্থাপনের মাধ্যমে ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চলে বদলে যাওয়া স্থাপত্য-সংস্কৃতির ধারণা দিয়েছেন, যা পাঠককে উদ্দীপ্ত করতে পারে, একই সঙ্গে তা নীতিনির্ধারকদের সাহসী পদক্ষেপে অনুপ্রাণিত করতে পারে।
তেরো. নগর হবে বিবিধ ক্রীড়ানন্দের মিলনকেন্দ্র : শহর কেবল আবাসন, কর্মস্থল আর বাণিজ্যকেন্দ্র নয়। লেখক উদ্দীপ্ত আশাবাদিতায় ঢাকাকে উদ্ধৃত করেছেন এক উজ্জীবিত ক্রীড়াক্ষেত্ররূপে। রমনায় রেস খেলার ঐতিহ্য, নৌকাবাইচ ছাড়াও এলাকাভিত্তিক ছোট-বড় ক্রীড়াকেন্দ্র, খেলার মাঠ, বড় কোনো আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজনে এই শহর ক্রীড়ামুখী হয়ে উঠতে পারে। এই শহর তখন আনন্দভূমি হবে, শরীরচর্চা আর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের আকরভূমি হয়ে গড়ে উঠবে, যার মধ্য দিয়ে নারী-পুরুষ বালক-বালিকা শ্রেণি-ধর্ম-নির্বিশেষে এই নগরীর অধিবাসীরা তাঁদের জীবনকে আনন্দময় করে তুলবেন।
চোদ্দ. নতুন অর্থনীতির জন্য প্রয়োজন নতুন এক নগরভাষা : বিভিন্ন নগরকেন্দ্র, বাণিজ্যকেন্দ্র যখন সুষম যোগাযোগ ব্যবস্থার সহায়তায় সারা দেশের সঙ্গে শক্তিশালী নেটওয়ার্কের মাধ্যমে গড়ে উঠবে তখন ঢাকার জন্য উর্বর হয়ে উঠবে অনেক নতুন অর্থনীতির বিনিয়োগ ক্ষেত্র, যা তাকে আঞ্চলিক বাণিজ্য থেকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্কে নিয়ে যাবে। কেবল তৈরি পোশাক আর অপ্রকাশিত ‘ইনফরমাল ইকোনমি’র এই শহর তখন এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতির জন্ম দেবে।
পনেরো. ঢাকা হতে পারে নতুন পরিবেশতাত্ত্বিক মডেল : যদিও জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বিপজ্জনক কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছে এই শহর, তবু ঢাকা ঘুরে দাঁড়াতে পারে সব বিপদ জয় করে। ঢাকা তার পেশাজীবিতা আর আবাসন ব্যবস্থার ধারণাকে আমূল পরিবর্তন করে পরিবেশবান্ধব জীবন-জীবিকায় প্রতিস্থাপিত হতে পারে। প্রাকৃতিক সংগঠনকে কাজে লাগিয়ে নতুন করে নির্মিত ঢাকা তার জ্বালানির জন্য জলবিদ্যুৎ, সৌরশক্তি আর বায়োগ্যাস-নির্ভর হতে পারে। এমন জ্বালানি ক্ষেত্র অনেক কর্মসংস্থান তৈরি করবে। কৃষিভিত্তিক সবুজ নগরায়ণের ফলে ঢাকা কার্বন নির্গমনকে শূন্যের ঘরে নামিয়ে আনবে। নিরাপদ পানি আর খাদ্যের জোগান দেবে নগরীর অন্তর্গত কৃষিজ অঞ্চল, সেই সঙ্গে সৌরশক্তি ব্যবহার, বৃষ্টির পানির সুচারু ব্যবস্থাপনা, নিময়তান্ত্রিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আর একেকটি কার্যকর স্বয়ংসম্পূর্ণ স্থাপত্য নির্মাণ আমাদের প্রতিদিনকার জীবনযাপনের সকল প্রকরণকে বদলে দিতে পারে। ছন্দময় সংস্থাপনায় উজ্জীবিত ঢাকা সারা পৃথিবীর কাছে এক অবিস্ময়রণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে গড়ে উঠবে।
লেখক কাজী খালিদ আশরাফ এভাবেই তাঁর আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন ডিজাইনিং ঢাকার প্রতিটি অনুচ্ছেদে। তিনি একে বলেছেন, ‘ইউটোপিয়া’, যা প্রচলিত ‘ইউটোপিয়া’ থেকে পৃথক। লেখকের এই দৃশ্যকল্প কার্যকর সমাধানের পথনির্দেশকেও সংবলিত করেছে। এই ইউটোপিয়া দুর্বল-আবেগতাড়িত নয়, বরং তা সংহত এবং নিবিড়ভাবে বাস্তবতাকে নিরীক্ষার পর নির্মিত। এই স্বপ্ন তাঁর ব্যক্তিগত নয়, এই আকাক্সক্ষা আরো অনেক প্রাণের। লেখক তাঁর জীবনের সবচেয়ে সংবেদনশীল, উৎপাদনক্ষম সময়জুড়ে দীর্ঘদিনের নগর গবেষণায় এই গ্রন্থের উপকরণ সন্নিবিষ্ট করেছেন। এই গ্রন্থের ডিজাইন পর্বে শহরের বিবিধ উপাদানকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তার সমাধান আন্তর্জাতিক মানের। ডিজাইনিং ঢাকা লাইব্রেরিতে, বুক শেলফে তুলে রাখা অন্য যে-কোনো গ্রন্থের মতো নয়, এই গ্রন্থ নিশ্চিতভাবে সম্প্রসারিত হওয়ার সম্ভাবনায় নির্মিত হয়েছে, যা এই দেশের নগর পরিকল্পনাকারী, স্থপতি, প্রকৌশলী আর রাজনৈতিক নেতৃত্বকে নতুনভাবে শিক্ষিত করে তুলবে।
ঢাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের ছোট-বড় সব শহর যেদিন সত্যি সত্যি তার নাগরিকদের স্বপ্নভূমি হয়ে গড়ে উঠবে, সেদিন নিশ্চয়ই এই প্রকাশনা সত্যিকার মূল্যায়নে অভিনন্দিত হবে। সেই সঙ্গে এর সকল প্রাজ্ঞ পাঠক প্রাণিত থাকবেন এই স্বপ্নযাত্রার সঙ্গী হতে পেরে। স্বপ্নহীন সংশয়ে আকীর্ণ এই জনপদে যাঁরা ভবিষ্যৎ রাজধানীকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন এবং নিজেদের সেই নির্মাণের ধারায় নিয়োজিত রাখেন তাঁরা নিশ্চিত জানবেন, আমাদের অন্ধকার সময়ে এই ‘ইউটোপিয়া’র কতটা প্রয়োজন ছিল।