ফ য়ে জু ল আ জি ম
২০১৪-এর ৮ জুলাই, বাংলাদেশের অতি জনপ্রিয় একটি জাতীয় বাংলা দৈনিকের বিজ্ঞাপনের জন্য নির্ধারিত পাতায় এক কলাম-দুই ইঞ্চি পরিমাপের প্রায় অকিঞ্চিৎকর একটি বিজ্ঞাপন ছাপানো হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবে অনেকের নজরে পড়ার কথা নয়। সাদা-কালো একটি ফটোগ্রাফের নিচে সংক্ষিপ্ত এক বাক্যে লেখা – ‘চিত্রশিল্পী আমিনুল ইসলামের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলী’। বাংলা বানানের ব্যাপারে সচেতন দৈনিকটির সংশ্লিষ্ট বিভাগও ছিল নিস্পৃহ। বাংলাদেশে শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালনকারী এই পত্রিকায় এবং জানামতে অন্য কোনো কাগজে এদেশে চারুকলা আন্দোলনের প্রথম প্রজন্মের এই শিল্পীর স্মরণে কোনো প্রতিবেদন বা কোনো সংবাদ বা অন্য কোনো কিছু স্থান পায়নি। বাংলাদেশে শিল্পী আমিনুল ইসলামের ছয় দশকের পথচলায় তাঁর কোনো সহযাত্রী এই বিজ্ঞাপনটি নিবেদন করেননি। উক্ত বিজ্ঞাপনটির নিচে কোনো পরিচয় উল্লেখ না করে শুধুমাত্র লেখা – রুবী ইসলাম। সংশ্লিষ্টদের জানার কথা যে, বিজ্ঞাপনদাতা প্রয়াত শিল্পীর সহধর্মিণী।
বর্তমান লেখার বিষয় অবশ্য শিল্পী আমিনুল ইসলাম নয় – শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। প্রায় চার-দশক আগে প্রয়াত, বাংলাদেশে চারুকলার পথিকৃৎ শিল্পী জয়নুল আবেদিনের জন্মশতবর্ষ সমাগত। বিস্মৃতির এই যুগে শতবর্ষ আগে সার্বিক অর্থে চরম বিরুদ্ধ পরিবেশে জন্ম নেওয়া এই চরিত্র, এদেশের চারুকলা তথা সংস্কৃতিতে তাঁর অপ্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থান ও ভূমিকাকে পুনরায় অবলোকন কিংবা মূল্যায়নের যথোপযুক্ত সময় উপস্থিত। বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের প্রারম্ভে জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে এদেশে চারুকলার অভিযাত্রায় শামিল হয়েছিলেন আমিনুল ইসলামও, যথাক্রমে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী হিসেবে। ঢাকা কলেজের মেধাবী ছাত্র আমিনুল ইসলাম বৈষয়িক জীবনের সম্ভাবনাকে উপেক্ষা করে শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে অজানা অনিশ্চিত পথে পা বাড়িয়েছিলেন।
ছয়-দশকের অধিক সময় ধরে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাংলাদেশে চারুকলার চর্চা এখন শহুরে মানুষের সাংস্কৃতিক জীবনের অন্যতম অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। অথচ খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, এই সমাজেই শিল্পকলা ও শিল্পীকুল ব্রাত্য-উপেক্ষিত হিসেবে বিবেচিত ছিল। শিল্পীদের ছন্নছাড়া প্রায় সমাজবহির্ভূত জীবনচর্চাই শুধু নয়, সামাজিক জীবনযাপনের জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ পেশাও ছিল এই দৃষ্টিভঙ্গির অন্যতম কারণ। অবশ্য সমাজের স্বাভাবিক অগ্রগতি ও মধ্যবিত্তের বিত্তবৈভব বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে এবং সামাজিক প্রয়োজনীয়তার সূত্রে ক্রমান্বয়ে শিল্পীদের সম্পর্কে সমাজের মনোভঙ্গির পরিবর্তন ঘটেছে। নিকট অতীতের শিল্পী নামের লক্ষ্মীছাড়ারা এখন অনেক ক্ষেত্রে লক্ষ্মীর বরপুত্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন। এমনকি সামাজিক কৌলীন্যে কুলীনকুলের একাসনেও তাঁদের আসন প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। একসময় শিল্পকলাকে মানুষ প্রাতিষ্ঠানিক চর্চাযোগ্য বিষয় হিসেবে গণ্য করেনি। শিল্পী অর্থে প্রচলিত শিক্ষাহীন কৌলিক কারিগরি জ্ঞানসর্বস্ব একদল প্রান্তিক মানুষকে বিবেচনা করা হতো। বর্তমানে বিশ্বায়নের এই যুগে চারুকলা একটি পাঠযোগ্য বিষয় হিসেবে প্রচলিত শিক্ষার সর্বোচ্চ পর্যায়ভুক্ত হওয়ায়, শিল্পকলা ও শিল্পীকুলের সামাজিক-শ্রেণিগত উত্তরণ সাধিত হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানভিত্তিক অন্যান্য পেশার মতো শিল্পকলাও অন্যতম পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে চলেছে। পরিণামে সমাজে শিল্পীদের সম্পর্কে প্রচলিত কাল্পনিক ভাবমূর্তি এখন বাস্তব মানুষের রূপপরিগ্রহ করেছে। এই লেখার শুরুতে উল্লিখিত বাংলাদেশের চারুকলা আন্দোলনের অগ্রগণ্য শিল্পী আমিনুল ইসলাম সম্পর্কে সামগ্রিক নিস্পৃহতা সম্ভবত সেই প্রবণতারই প্রতিফলন। এই প্রজন্মের কাছে জয়নুল আবেদিন বা আমিনুল ইসলাম প্রমুখ আইকনিক শিল্পীর নাম পাঠ্যপুস্তকের দুই মলাটের মধ্যে সীমাবদ্ধ। মূলত শিল্পকলার এই প্রজন্মের প্রতিনিধিদের মাঝে এই উপলব্ধি প্রায় অনুপস্থিত যে, তাঁদেরই পূর্বসূরিদের অজানা দুর্গম পথে সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়েছিল। এদেশের চারুকলার পথিকৃৎদের সামনে বাঁধানো কোনো পথ ছিল না, বাধা ছিল বিস্তর। সমস্ত প্রতিকূলতার পাহাড় ডিঙিয়ে পথ নির্মাণ করেই পথে নামতে হয়েছিল তাঁদের।
বাংলাদেশে চারুকলার পথ নির্মাণের অগ্রপথিক জয়নুল আবেদিন, এ-বক্তব্য প্রায় প্রশ্নাতীত। একটি অপ্রস্ত্তত সমাজে বিরুদ্ধ পরিবেশে শিল্পকলার বীজ বুনেছিলেন তিনি। জয়নুল একাধারে স্বনামখ্যাত চিত্রকর, সার্থক সংগঠক। সমাজ তাঁকে শিল্পাচার্য অভিধায় ভূষিত করেছে। নানা কারণে আমাদের সংস্কৃতিজগতে তিনি এক স্মারকতুল্য চরিত্র। যে-যুগ যে-সমাজে তাঁর আবির্ভাব, যে-কোনো বিবেচনায় তাকে ব্যতিক্রম বলা চলে। শিল্পী হওয়ার চরম স্পর্ধাকে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে প্রতিষ্ঠিত করাই শুধু নয়, একটি অনালোকিত জাতির শৈল্পিক স্বপ্নযাত্রার কান্ডারি হয়েছিলেন তিনি। অর্ধশতাব্দী ধরে নানা বিবর্তনের ভেতর দিয়ে আমাদের দেশে প্রবহমান শিল্পকলায় সৃজনে ও খ্যাতিতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিল্পীর আবির্ভাব ঘটেছে। সেখানে এবং সম্ভবত অনাগতকালেও শিল্পী জয়নুল আবেদিনের অবস্থান সন্দেহাতীতভাবে নির্ধারিত থাকবে।
বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাঙালি শিক্ষিত মুসলমান সমাজ তার আত্মপরিচয়ের সাংস্কৃতিক বিভ্রান্তির ঘেরাটোপে আচ্ছন্ন থেকেও মূলধারায় নিজস্ব অবস্থান নির্ণয়ের সংগ্রামে লিপ্ত ছিল। এই সামগ্রিক অনিশ্চিত পরিবেশে সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্রে দু-একজন ব্যতিক্রমী চরিত্রের আবির্ভাব দেখা যায়। যেমন, সাহিত্য-সংগীতে কাজী নজরুল ইসলামের আবেগতাড়িত সরব উপস্থিতি, জসীমউদ্দীনের কবিতা আর আববাসউদ্দীনের গানে বাংলার উপেক্ষিত বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর হৃদয়স্পন্দন এবং বুলবুল চৌধুরীর নৃত্যকলার সমকালীনতা বাংলার সংস্কৃতির পরিমন্ডলে মুসলিম প্রতিনিধিদের উপস্থিতির স্বাক্ষর বহন করে। সাংস্কৃতিক কালচক্রে চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিনের আবির্ভাব বিচ্ছিন্ন সাংস্কৃতিক চক্রাবর্তের যোগসূত্র হিসেবে দেখা যেতে পারে। নিঃসন্দেহে সমকালে এসব অসময়োচিত চরিত্র বৃহত্তর বাঙালি সংস্কৃতিতে ভিন্নমাত্রা সংযুক্ত করেছিল। বাঙালির সম্প্রদায়গত স্বাতন্ত্র্যের মাঝে ক্রিয়াশীল থেকেও চেতনায় ও ভঙ্গিতে স্বযোগ্যতায় সংস্কৃতির কুলীনকুলে তাঁদের অবস্থান নির্ণীত হয়েছিল।
ঊনবিংশ শতকে ইংরেজ ঔপনিবেশিকতার ঘেরাটোপে বাঙালির সুপ্ত জাতীয় চেতনা জাগ্রত হয়েছিল বলে একটি খন্ডিত ধারণা প্রচলিত আছে। বাংলার রেনেসাঁস নামে কথিত এই জাগরণ ছিল পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত উচ্চবর্ণের হিন্দু মধ্যবিত্তের নেতৃত্বে ও পরিমন্ডলে। পাশ্চাত্য প্রণোদনায় জাগরিত এ-চৈতন্য স্বাভাবিকভাবে নিজস্ব সম্প্রদায়গত ঐতিহ্য ও মনমানসিকতাকে বহন করেই বিকশিত হয়েছিল। এদিকে পাশ্চাত্য জ্ঞানভান্ডারে বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের স্ব-আরোপিত অংশগ্রহণ ছিল না বলে সেই কথিত জাগরণে তাদের উপস্থিতি দৃশ্যমান ছিল না। পরিণামে আর্থসামাজিক জীবনের সমান্তরাল মননে ও চেতনায় উভয় সম্প্রদায়ের মাঝে স্বাভাবিক দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। অথচ ধর্মীয় বিশ্বাসে আলাদা হওয়া সত্ত্বেও উপনিবেশ-পূর্ব যুগে শত শত বছর ধরে লোকায়ত পর্যায়ে সম্প্রদায়গত সহনশীল ও সাবলীল সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বজায় ছিল। ইংরেজ উপনিবেশ-আরোপিত শাসনের পরিণামে পাশ্চাত্য আধুনিকতার অনুপ্রবেশের সূত্রে সম্প্রদায়গত বিভাজনের দেয়াল সংস্কৃতিতে প্রতিফলিত হয়েছিল। ফলে পরবর্তীকালে জাগতিক জীবনে মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্নতার কারণে পিছিয়ে পড়া মুসলমান বাঙালি ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য প্রকাশের মাঝে নিজের সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব রক্ষায় সচেষ্ট হয়। ঊনবিংশ শতকে নবজাগ্রত সংস্কৃতিতে স্বাভাবিকভাবে হিন্দু মূল্যবোধের প্রাধান্য থাকায় বিংশ শতকের প্রথমার্ধে বাঙালি মুসলমান ক্রমান্বয়ে সামগ্রিক জাতীয় জীবনের স্রোতধারায় সম্পৃক্ত হতে থাকলে সেখানে দ্বিমুখী প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়। বিশেষ করে মুসলমান সমাজে যেখানে ধর্মীয় গুরুদের প্রভাব ছিল প্রবল, সেখানে ললিতকলা সম্পর্কে অজ্ঞতাপ্রসূত ভ্রান্ত ধারণা সম্ভাব্য মুসলমান শিল্পীদের স্বপ্ন কণ্টকাকীর্ণ করে তুলেছিল। উপরন্তু অর্থনৈতিক নিরাপত্তা কিংবা সামাজিক মর্যাদার বিবেচনায় সামগ্রিক বাঙালি সমাজেই পেশা হিসেবে শিল্পকলার চর্চাকে বিশেষ উৎসাহের দৃষ্টিতে দেখা হয়নি। এই প্রেক্ষাপটে সহজেই অনুমিত যে, পূর্ববঙ্গের প্রান্তিক অবস্থান থেকে আসা জয়নুল আবেদিনকে নানা প্রতিবন্ধকতার দেয়াল অতিক্রম করেই শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে হয়েছিল। শুধু শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার নিরন্তর সংগ্রামই নয়, একই সঙ্গে আগামীর শিল্পীদের জন্য পথ নির্মাণের প্রায় অসম্ভব কল্পনা ও দুঃসাহস তিনি ধারণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে জয়নুলের সাফল্যে এখন এ-কথা আমাদের বলতে দ্বিধা নেই যে, তাঁর হাতেই বাঙালি মুসলমানের শিল্পকলা চর্চার সূত্রপাত ঘটেছিল।
ঊনবিংশ শতকে বাঙালির সাংস্কৃতিক জাগরণে হিন্দু মধ্যবিত্তের সুকর্ষিত জীবনবোধের প্রতি তুলনায়, বিংশ শতাব্দীতে নবাগত বাঙালি মুসলমান সাংস্কৃতিক চেতনা ছিল বিশেষভাবে আবেগপ্রসূত, স্বতঃস্ফূর্ত ও সাবলীল বৈশিষ্ট্যের। কিন্তু সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তমসাচ্ছন্ন এ-সময়ে বাংলার রেনেসাঁসের মুসলমান প্রতিনিধি হিসেবে নজরুল, জসীমউদ্দীন, আববাসউদ্দীন ও বুলবুল চৌধুরীরা স্বতন্ত্র এবং স্বমহিমায় ভাস্কর হয়ে উঠেছিলেন। বাঙালি মুসলমানের এই সাংস্কৃতিক অগ্রদূতদের মাঝে চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন তাঁর নিজস্ব মাধ্যমে সৃজনশীলতার মানদন্ডে সুউচ্চ অবস্থানের দাবিদার হয়ে উঠেছিলেন। উল্লেখ্য, দৃশ্যকলার ক্ষেত্রে তখন একদিকে নব্যবঙ্গীয় ভাবাবেগের জোয়ারে ভাটার টান, অন্যদিকে তরুণ শিল্পীদের মাঝে পাশ্চাত্য আধুনিকতার মাতাল হাওয়ার আহবান। বাংলা চিত্রকলার এই সন্ধিক্ষণে জয়নুল তাঁর চিত্রাঙ্গিক নির্মাণে সতর্ক অবস্থানে থেকে মৌলিক সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন। তিনি সমকালীন আধুনিক চেতনাকেই ধারণ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর আধুনিকতা বাংলার চিরায়ত লোকঐতিহ্যের নির্যাস অবলম্বন করেই বিকশিত হয়েছিল। জয়নুল আবেদিন তাঁর শিল্পের বিষয় নির্বাচনে সম্প্রদায়গত চেতনার ঊর্ধ্বে উঠে অন্ত্যজ শ্রেণি তথা মানবতাবাদকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। চল্লিশের দশকের সামাজিক বাস্তবতায় একজন তরুণ মুসলমান শিল্পীর এ-অবস্থান সুদৃষ্টি এবং উল্লেখ করার মতো বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচনা করা চলে।
প্রসঙ্গক্রমে এখানে স্মর্তব্য যে, বাংলার সাংস্কৃতিক নবজাগরণে নতুন যুগের শিল্পকলার আবির্ভাব কিছুটা বিলম্বে ঘটেছিল। বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে অবনীন্দ্রনাথের হাত ধরেই আধুনিক বাংলা চিত্রকলার অভিযাত্রা। অবনীন্দ্রনাথকে যদি বলা যায় অতীতচারী-রোমান্টিক, তাহলে তাঁরই ভাবশিষ্য নন্দলাল হবেন ভারতীয় ঐতিহ্যসম্ভূত আধুনিক রোমান্টিক। এদিকে পাশ্চাত্য আধুনিকতার পাঠ নিয়েও যামিনী রায় প্রকাশিত হলেন বাংলা লোকচিত্রের উত্তরসূরি রূপে। অবনীন্দ্রনাথ বিস্মৃতির আড়াল থেকে প্রাচ্যকে টেনে আনলেন আধুনিকতার প্রাঙ্গণে। নন্দলাল সে-আধুনিকতাকে ধারণ করে ভারতের হৃদয়ের সন্ধানে নেমেছিলেন। আর যামিনী লোকায়ত বাংলাকে হাতে করে নিয়ে এলেন নাগরিক আধুনিকতার ভিন্ন জগতে। এই তিন মহীরুহের ছত্রচ্ছায়ায় আধুনিক বাংলা চিত্রকলার ত্রিধারার ঘেরাটোপে আচ্ছন্ন না হয়ে, প্রান্তিক অবস্থান থেকে আসা জয়নুল আবেদিন একটি স্বতন্ত্র কিন্তু স্বকীয় বৈশিষ্ট্য নির্মাণে সমর্থ হয়েছিলেন।
নানা কারণে একটি ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে যে, জয়নুলের চরিত্রজ্ঞাপক চিত্রাঙ্গিক যামিনী রায় কিংবা কালীঘাট পটচিত্র দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিল। সরল দৃষ্টিতে এ-ধারণার একটি সাধারণ চাক্ষুষ বাস্তবতা হয়তো খুঁজে নেওয়া যায়। এখানে এ-কথা স্মরণ করা যায় যে, কালীঘাট চিত্রাঙ্গিক সম্পর্কে সুখ্যাত পন্ডিত উইলিয়াম আর্চারও পাশ্চাত্য-প্রভাবিত বলে একটি বিভ্রান্ত সিদ্ধান্ত পোষণ করতেন। ঐতিহ্যবাহী বাংলা পটের অবিচ্ছেদ্য অংশ কালীঘাট চিত্রকলার প্রণিধানযোগ্য দুটি দিক দৃশ্যমান। প্রথমত, পেশাদার স্বাধীন শিল্পী হিসেবে বিষয় নির্বাচনে নিম্নবর্গীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে সামাজিক চেতনার প্রতিফলন। দ্বিতীয়ত, রেখা ও রঙের ন্যূনতম ব্যবহারের মাধ্যমে বিষয়বস্ত্তর সহজ-সরল উপস্থাপন। আমরা জানি যে, ভারতবর্ষের সকল চিরায়ত ধ্রুপদী চিত্রকলায় রেখার প্রাধান্য থাকলেও সর্বভারতীয় চিত্রকেন্দ্রগুলোতে এর রূপায়ণ একরকম নয়। ভারতের পশ্চিমাংশের প্রধান শিল্পকেন্দ্রসমূহে চিত্রকলায় ব্যবহৃত রেখা সুচিক্কন, সুললিত এবং বুদ্ধিবৃত্তিক। পক্ষান্তরে পূর্ব-ভারতে বিশেষ করে বাংলা-পটের রেখা মেদবহুল, সহজিয়া ও জৈবিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। যামিনী রায় উপরোক্ত আঙ্গিককে প্রায় সরাসরি কিন্তু তাঁর পরিশীলিত নৈপুণ্যে ব্যবহার করেছিলেন। জয়নুল আবেদিনের চিত্রকলার মুখ্য চরিত্র কালীঘাটচিত্রীদের মতো নিম্নবর্গীয় প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। তাঁর চিত্রের প্রাণ, এতে ব্যবহৃত সুদৃঢ় রেখার সুগঠিত শারীরিক সৌষ্ঠব এবং এর সচলমান জৈবিক চরিত্র। চিত্রকলায় রেখা যে আকার ও দৃশ্যকে নির্মাণ করে জয়নুলের চিত্রাবলি এরই সার্থক মেলবন্ধন। সাদা-কালো বা ন্যূনতম বর্ণের ব্যবহার তাঁর চিত্রকলার রেখাভিত্তিক গঠনধর্মী বৈশিষ্ট্যকে সর্বসাধারণের কাছেও প্রাঞ্জলভাবে উপস্থাপিত করেছিল। কলকাতা আর্ট স্কুলে পাশ্চাত্য পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জয়নুলের চিত্রকলা আধুনিকতার আবহে বাংলার জনজীবন ও শিল্পের ভাষাকে এক ভিন্নমাত্রায় উন্নীত করেছিল। মূলত গত শতকের চল্লিশের দশকে বাংলা আধুনিক চিত্রকলায় ক্ষয়িষ্ণু নব্যবঙ্গীয় চিত্রধারার বিপরীতে তরুণ প্রজন্মের শিল্পীদের পাশ্চাত্য আধুনিকতা চর্চার ঘূর্ণাবর্তে জয়নুল আবেদিনের চিত্রকর্ম প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধের ভূমিকা পালন করেছিল। হৃদয়ে ও মননে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনাচারকে ধারণ করে তিনি বাংলার লোকায়ত চিত্রাঙ্গিকের মূল সুরকে বর্ণনা করলেন আধুনিকতার কাঠামোর মাঝে। সেদিক থেকে তাঁকে বলা যায় বাংলার চিরায়ত লোকশিল্পের আধুনিক রূপকার।
ভারতবর্ষের রাজনৈতিক কালান্তরের টালমাটাল সময়ে সমসাময়িক কলাবিশারদদের কাছে শিল্পী হিসেবে প্রাপ্য স্বীকৃতি থেকে জয়নুল আবেদিন বেশ কিছুটা বঞ্চিত হয়েছিলেন বলেই প্রতীয়মান। অথচ অগ্রজ সমসাময়িক বিনোদবিহারী বা রামকিংকরের কথা যদি বাদও দেওয়া যায়, তাঁরই সমসাময়িক পরিতোষ সেন, চিন্তামনি কররা শিল্প-সমালোকদের কাছে যে প্রশংসা অর্জন করেছিলেন এর কানাকড়িও জয়নুলের ভাগ্যে জোটেনি। ১৯৪৬ সালে কলকাতা দাঙ্গার প্রাক্কালে মুসলিম লীগের উদ্যোগে আয়োজিত এবং জয়নুল, সফিউদ্দীন, কামরুল, শফিকুল আমিন প্রমুখ শিল্পীর অংশগ্রহণে ‘মুসলিম শিল্পীদের শিল্পকলা প্রদর্শনী’ – সমসাময়িক সমালোচকদের কাছে এই শিল্পীদের সম্পর্কে নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছিল বলে মনে করা যায়। জয়নুলের চিত্রকর জীবনের ক্রান্তিকালে অসময়োচিত ভারত বিভাজন আধুনিক বাংলা চিত্রকলায় তাঁর প্রাপ্য অবস্থানকে কক্ষচ্যুত করেছিল।
বাঙালির আধুনিক সংস্কৃতিতে জয়নুল আবেদিনের অবদান মানে ও মননে সুউচ্চ কৃতিত্বের দাবিদার। পরবর্তীকালে বিভক্ত বাংলায় সম্পূর্ণ অপ্রস্ত্তত একটি সমাজে শিল্প-আন্দোলন গড়তে গিয়ে শিল্পের কান্ডারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন তিনি। চারুকলার অনিশ্চিত অভিযাত্রায় শিল্পের পথে পথ ভেঙে এগিয়ে চলার নিরন্তর সাধনায় ব্যাপৃত থাকা তাঁর পক্ষে হয়তো সম্ভব হয়নি। কিন্তু এই অহল্যা ভূমিতে শিল্পকলার যে কর্ষিত ক্ষেত্র প্রস্ত্তত করেছিলেন তিনি, ছয় দশকের পথচলায় তা আজ পত্রপল্লবে পুষ্পিত বৃক্ষে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে আধুনিক শিল্পকলার অবিসংবাদিত অগ্রদূত জয়নুল আবেদিন। বাঙালি মুসলমানের সাংস্কৃতিক জাগরণের রেনেসাঁস-মানব হিসেবে তাঁকে বিবেচনা করা চলে। জাগতিক জীবনের দুর্ভিক্ষ আঁকতে গিয়ে জয়নুল শিল্পী হয়ে উঠেছিলেন। জীবন-সায়াহ্নে মানুষের রুচির দুর্ভিক্ষের কথা বলতে গিয়ে মূলত সামাজিক সংকট উত্তরণের পথনির্দেশনা দিয়েছিলেন তিনি। সৌন্দর্য একটি বিমূর্ত ধারণা হলেও মানুষের শুভাশুভ বিবেচনার নির্ণায়ক। ‘জয়নুল’ শব্দের অর্থের মাঝে সৌন্দর্যের মৌলিক চরিত্র বর্তমান। জন্মশতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে জয়নুল আবেদিন স্বনামেই দেশ-জাতি-শিল্পের কাছে সুন্দরের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। n