logo

জয়নুল আবেদিন বিস্ময়কর শিল্প-প্রতিভা

নজরুল ইসলাম

জয়নুল আবেদিন ভারতীয় উপমহাদেশের বিস্ময়কর শিল্প-প্রতিভা, এ সত্য উন্মোচিত হয়েছিল তাঁর বয়স যখন মাত্র ২৯, তাঁর আঁকা ১৯৪৩-এর বাংলার দুর্ভিক্ষ চিত্রমালার মাধ্যমে। অবশ্য তার কিছু আগে থেকেই তিনি একজন প্রতিভাবান দক্ষ চিত্রশিল্পী হিসেবে সর্বভারতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন, তবে সেগুলো ছিল প্রায় প্রথাসিদ্ধ বাসত্মববাদী নিসর্গদৃশ্য রচনার জন্য। দুর্ভিক্ষ চিত্রমালা জয়নুলকে একেবারে ভিন্ন মাত্রায় পরিচিত করায়। ব্রিটিশ ভারতের ঔপনিবেশিক বাসত্মবতায় তাঁর ছবির আঙ্গিক ও বক্তব্য ছিল রীতিমতো বিপস্নবাত্মক। পরবর্তী রাজনৈতিক পালাবদল, বিশেষ করে দেশভাগ ও পাকিসত্মান নামক এক নতুন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা তাঁর ব্যক্তিগত জীবনও বদলে দেয়। তিনি স্বপ্ন দেখেন পূর্ব পাকিসত্মান তথা বাঙালির জন্য আধুনিক শিল্পকলার জগৎ প্রতিষ্ঠার। তাঁর প্রতিভা, শ্রম, ব্যক্তিত্ব ও সাংগঠনিক মেধা এই স্বপ্ন পূরণে ভূমিকা রেখেছে। তিনি বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পচর্চার জনক এবং এখনো পর্যমত্ম এদেশের চিত্রকলার সবচাইতে গুরম্নত্বপূর্ণ শিল্পী।
তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জের এক নিমণমধ্যবিত্ত শিক্ষেত মুসলমান পরিবারে জয়নুল আবেদিনের জন্ম। তাঁর বাবা শেখ তমিজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন সরকারি চাকুরে, পুলিশের সাব ইনস্পেক্টর, মায়ের নাম জয়েনবুন্নেসা, যাঁর নামের আদ্যক্ষর দিয়ে শুরম্ন হয়েছে জয়নুল ও তাঁর অন্য তিন ভাইয়ের নাম (কাকতালীয়ভাবে তাঁর স্ত্রী জাহানারা আবেদিনের নামের আদ্যক্ষরও একই)। ব্রহ্মপুত্র নদের পস্নাবন অববাহিকার অত্যমত্ম শামত্ম সুনিবিড় ও রোমান্টিক পরিবেশে তিনি বেড়ে উঠেছেন। তাঁর শৈশব এবং তারম্নণ্যের প্রধানতম অর্জন ছিল বলতে গেলে এই প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যের অভিজ্ঞতা। তাঁর শৈল্পিক মানসিকতা নির্মাণে প্রকৃতির প্রভাব ছিল অসামান্য ও সুদূরপ্রসারী। তিনি বলতে ভালোবাসতেন, ‘নদীই আমার শ্রেষ্ঠতম শিক্ষক’। তাঁর জীবনের প্রথম দশ-এগারো বছর কেটেছে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, কেন্দুয়া, মিঠামইন ও শেরপুর থানা সদরে। তারপর ১৯২৩ সন থেকে ময়মনসিংহ শহরে, তদ্দিনে তাঁর বাবা শহরে নিজের বাড়ি বানিয়েছেন। তিনি প্রথমে ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে (পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যমত্ম) ও পরে মৃত্যুঞ্জয় স্কুলে (নবম ও দশম শ্রেণি পর্যমত্ম) শিক্ষালাভ করেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষা না দিয়ে তিনি কলকাতায় গিয়ে আর্ট স্কুলে ভর্তি হন ১৯৩২ সনে। অবশ্য তার আগে বাড়িতে কাউকে কিছু না জানিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে একবার কলকাতা ঘুরে আসেন আর্ট স্কুল দেখার উদ্দেশ্য নিয়ে।
ময়মনসিংহে তাঁর জীবনের শুরম্নতেই তিনি শৈল্পিক প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন। ১৯৩০ সনে বোম্বের ক্রনিকল পত্রিকায় চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পুরস্কার লাভ করেছিলেন, এর জন্য তাঁর সম্পূর্ণ অপরিচিত গলফ্ খেলার এক ছবি এঁকেছিলেন। চিত্রাঙ্কনের প্রতিভার আগ্রহ ও দক্ষতা দেখে তাঁর স্কুলের প্রধান শিক্ষক তাঁকে কলকাতায় আর্ট স্কুলে পাঠাবার পরামর্শ দিয়েছিলেন তাঁর বাবাকে। বহু দূরের শহর কলকাতায় গিয়ে শিল্পকলা শেখার দীর্ঘ এবং কঠিন ছাত্রজীবন শুরম্ন না করা পর্যমত্ম স্বসিত্ম পাচ্ছিলেন না জয়নুল আবেদিন। ১৯৩২ থেকে ১৯৩৮ সন পর্যমত্ম তিনি কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুলের ছাত্র ছিলেন। কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হওয়াটা জয়নুলের জন্য আদৌ কষ্টসাধ্য ছিল না, ভর্তি পরীক্ষায় তিনি খুব ভালো করেছিলেন। প্রখ্যাত শিল্পী মুকুল দে তখন আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ। তিনি জয়নুলের প্রতিভা চিনতে ভুল করেননি। সমস্যা ছিল জয়নুলের আর্থিক অবস্থা। কলকাতায় থেকে আর্ট স্কুলের পড়ার খরচ নির্বাহ করা ছিল খুব কঠিন। ইতিমধ্যে তাঁর স্বল্প মাইনের সৎ পুলিশ অফিসার বাবা চাকরি থেকে অবসর নিয়েছিলেন। তখনকার দিনে মেধাবী ও অসচ্ছল ছাত্রদের জন্য জেলা বোর্ডের বৃত্তির ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু সে বৃত্তি দেওয়া হতো প্রথম বর্ষ পরীক্ষার ফল বেরোবার পর, অধ্যক্ষের সুপারিশে। মুকুল দে জয়নুলের জন্য প্রথা ভেঙে সুপারিশ করেছিলেন প্রথম থেকেই তাঁকে বৃত্তি দেওয়ার জন্য, ভর্তি পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে। জেলা বোর্ড অধ্যক্ষের সুপারিশকে সম্মান দেখিয়ে জয়নুলের জন্য মাসিক ১৫ টাকা বৃত্তি অনুমোদন করেছিল। তখনকার দিনে ১৫ টাকা কলকাতা শহরেও সামান্য ছিল না, জয়নুলের আর্ট স্কুলে পড়া এতে কিছুটা সহজ হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া আর্ট স্কুলের কনিষ্ঠ বন্ধু কলকাতাবাসী আনোয়ারম্নল হকের (১৯১৮-৮০) সহযোগিতার বড় ভূমিকা ছিল। কিছুদিন পরে অবশ্য জয়নুল বিভিন্ন পত্রপত্রিকা বা অন্যান্য মাধ্যমে ইলাস্ট্রেশন করে বাড়তি উপার্জন করতে পেরেছেন। সবকিছু মিলিয়ে অনাত্মীয় শহর কলকাতায় তাঁর টিকে থাকা সম্ভব হয়েছিল। কলকাতা আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ মুকুল দে জয়নুলের প্রতি খুবই সহানুভূতিশীল ছিলেন, ভেবেছিলেন মফস্বলের সাধারণ পরিবারের ছেলে জয়নুলের জন্য প্রাচ্যকলা বিভাগ বা কমার্শিয়াল আর্ট বিভাগ অধিকতর প্রাসঙ্গিক হবে, কিন্তু জয়নুলের যেহেতু ইচ্ছা ছিল প্রকৃত শিল্পী হওয়া, তিনি তাই সেদিকে গেলেন না, বরং প্রথম থেকেই মূলধারার শিল্পকলা ‘পেইন্টিং’ বিভাগে নাম লেখালেন। অধ্যক্ষ তাঁর ইচ্ছাই মেনে নেন।
শৈশবে তাঁর ওপর প্রকৃতির প্রভাব এবং কলকাতায় আর্ট স্কুলে ইউরোপীয় বাসত্মববাদী ধারার শিল্পাঙ্কন পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ তরম্নণ জয়নুল আবেদিনকে একজন দক্ষ নিসর্গশিল্পী হিসেবে গড়ে তুলেছিল। অ্যাকাডেমিক ধারার সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেও তিনি বিহারের সাঁওতাল পরগনা ও ময়মনসিংহের নিসর্গদৃশ্যের ওপর বেশ কিছু স্মরণীয় স্কেচ এবং জলরং চিত্র এঁকেছেন। প্রসঙ্গত উলেস্নখ করতে হয় ময়মনসিংহের শহর-প্রামত্ম ও ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর রেল ব্রিজ বিষয়ক ছবি দুটোর কথা, ১৯৩৩ সনে আঁকা, মাত্র দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তিনি তখন, অথচ কী চমৎকার ড্রইং এবং আলোছায়ার মুনশিয়ানা। তিনি ১৯৩৮ সনে নিখিল ভারত প্রদর্শনীতে গভর্নরের স্বর্ণপদক লাভ করেন। এ পুরস্কার ছিল ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র নদ নিয়ে আঁকা তাঁর একগুচ্ছ জলরং ছবির জন্য। ১৯৩৮ সনেই কলকাতা আর্ট স্কুলের চূড়ামত্ম পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করেন এবং ১৯৩৯ সনে শিক্ষকতার একটি স্থায়ী পদে নিয়োগ লাভ করেন। অবশ্য দুবছর আগে থেকেই তিনি অস্থায়ী শিক্ষক নিযুক্ত হয়েছিলেন, যা ছিল একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা।
গভর্নরের স্বর্ণপদক লাভের পর আরো কিছুকাল পর্যমত্ম জয়নুল আবেদিন প্রাকৃতিক পরিবেশেরই এক রোমান্টিক রূপকার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি তখন ছিলেন এক অরাজনৈতিক ব্যক্তি, একজন বিশ্বসত্ম নিসর্গশিল্পী। কিন্তু ১৯৪৩-এর বাংলার দুর্ভিক্ষ জয়নুল আবেদিনকে একেবারে বদলে দেয়। রোমান্টিক নিসর্গশিল্পীকে রূপামত্মরিত করে ফেলে এক দুর্দামত্ম বিদ্রোহী ব্যক্তিত্বে। অতঃপর সারাটি জীবনই বিক্ষুব্ধ থেকে গেছেন তিনি।
দুর্ভিক্ষ শুরম্ন হওয়ার পরপরই জয়নুল তাঁদের ময়মনসিংহের বাড়িতে ফিরে যান। সেখানেও দুর্ভিক্ষের যে মর্মামিত্মক দৃশ্যাবলি দেখতে পান তাতে তিনি ভীষণভাবে ব্যথিত হন এবং আবার কলকাতায় ফিরে আসেন। কিন্তু দুর্ভিক্ষপীড়িত দুস্থ মানবতা যেন সে যাত্রায় তাঁর সঙ্গী হয়ে আসে। তেতালিস্নশে কলকাতা মহানগরে ঘটেছে মানবতার চরম অবমাননা। ডাস্টবিনের উচ্ছিষ্ট থেকে খাদ্যান্বেষণে তীব্র প্রতিযোগিতা চলেছে মানুষ আর কুকুরের মধ্যে। ঊনত্রিশ বছর বয়স্ক জয়নুল এ রকম অমানবিক দৃশ্যে প্রচ-ভাবে মর্মাহত হন, আতঙ্কে শিউরে ওঠেন, আবেগাপস্নুত হয়ে পড়েন। কিন্তু সে আবেগ তিনি কাজে লাগান সেসব দৃশ্যাবলির শিল্পরূপ দিতে। অন্যভাবে বলা যায়, সেই আবেগই তাঁকে তাড়িত করে, বাধ্য করে অমানবিক পরিস্থিতির এক মানবিক শিল্প নির্মাণে।
জয়নুল তখন আর্ট স্কুলের একজন শিক্ষক, তাঁর আয় সামান্য। দুর্ভিক্ষের বাজারে উন্নতমানের শিল্পসামগ্রী তখন যেমন ছিল দুর্লভ তেমনি দুর্মূল্য। সে কারণে তিনি বেছে নেন শুধু কালি আর তুলি। শুকনো তুলিতে কালো চীনা কালির টানে স্কেচ করতে থাকেন অতি সাধারণ সসত্মা কাগজের ওপর। এসব কাগজ ছিল ঈষৎ পীতবর্ণের। এমনকি তিনি প্যাকেজিং কাগজও ব্যবহার করেছেন। সাধারণ স্বল্পমূল্যের এসব অঙ্কনসামগ্রী ব্যবহার করে তিনি যে শিল্প সৃষ্টি করলেন তা-ই পরিণত হলো অমূল্য সম্পদে। এমন এক অসাধারণ শক্তিশালী অঙ্কনশৈলীর মাধ্যমে তিনি দুর্ভিক্ষের করম্নণ বাসত্মব দৃশ্যাবলি চিত্রায়িত করলেন, যার কোনো পূর্ব দৃষ্টামত্ম উপমহাদেশের চিত্র ঐতিহ্যে ছিল না। সমসাময়িক শ্রদ্ধাভাজন শিল্পসমালোচক ও সি গাঙ্গুলি ১৯৪৪ সনে জয়নুলের দুর্ভিক্ষের ড্রইং সম্পর্কে লিখেছেন, ‘তাঁর এসব নির্মম তুলির টানের দুঃসাহসিকতার মধ্যে একাধারে ছিল স্বতঃস্ফূর্ততা ও সততা এবং তার সাথে আবার যুক্ত হয়েছিল আপোসহীন বাসত্মবতা, যা কিনা বাংলার আধুনিক শিল্পীদের কাজে একেবারেই বিরল এক বৈশিষ্ট্য। তাঁর এই অসাধারণ কাজের মাধ্যমে তিনি আধুনিক চিত্রকলার এক নতুন অধ্যায় উন্মোচন করলেন। জয়নুলের ড্রইংগুলো ১৯৪৩-এর বাংলার ইতিহাসের ক্ষেত্রে এক অমূল্য বিশ্বসত্ম দলিল হয়ে থাকলো। মানবজীবনের শোচনীয় পরিণতির মধ্যেও সৌন্দর্যের পূজারী হিসেবে এই শিল্পী বাংলার বিদ্যমান সসত্মা ভাবপ্রবণ নিমণ পর্যায়ের চিত্রধারাকে উন্নীত করলেন এক সম্মানজনক সত্মরে।’ দুর্ভিক্ষ চিত্রমালার চিত্রসংখ্যা দুডজন বা তার কমবেশি, এগুলোর মধ্যে একটি ছবি ‘ম্যাডোনা ১৯৪৩’ শিরোনামে প্রতীকী মূল্য পেয়েছে। ছবিটিতে একটি শিশু তার মায়ের সত্মনের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তার বাঁচার আকুতিতে, মা মৃতপ্রায়। অতি করম্নণ এক দৃশ্য। আরেকটি ছবিতে এক মা তার শিশুসমত্মানের জন্য সামান্য অন্ন ব্যবস্থায় আকুল, অন্য একটিতে কিশোরী বোন শিশু ভাইটিকে খাওয়াতে উদগ্রীব, চরম ক্ষুধাতে সেণহের দৃষ্টামত্ম।
জয়নুল আবেদিনের দুর্ভিক্ষের স্কেচগুলো শুধু সমাজবাসত্মবতার স্মারক হিসেবে নয়; বরং যুগপৎ এগুলোর শৈল্পিক উৎকর্ষের জন্যেও গুরম্নত্বপূর্ণ। ও সি গাঙ্গুলির বস্ত্তনিষ্ঠ মূল্যায়নের সঙ্গে আমরা আরো যোগ করতে পারি ১৯৫২ সনে প্রদত্ত প্রখ্যাত ব্রিটিশ শিল্পসমালোচক স্যার এরিখ নিউটনের মমত্মব্য, ‘এগুলো অত্যমত্ম চমৎকার ড্রইং, এগুলোর মধ্যে সেই অসম্ভব ব্যাপারটিই ঘটেছে, এক অভূতপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের।’ ১৯৪৩ সনের বাংলার দুর্ভিক্ষের ওপর সমকালীন অনেক শিল্পীই ছবি এঁকেছেন, কারো কারো কাজ বিশেষ উলেস্নখের দাবিদার। কলকাতার বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখক শ্রীপান্থ তাঁর সেদিনের শিল্পীদের চোখে পঞ্চাশের মন্বমত্মর : দায় শীর্ষক গ্রন্থে (কলকাতা, পুনশ্চ, ১৯৯৪) তেরোজন শিল্পীর কাজের নমুনা ছেপেছেন, তাতে সর্বাধিক ২২টি শিল্পী চিত্তপ্রসাদের, ১৪টি জয়নুলের, সোমনাথ হোর, সুধীর দসত্মগীর ও গোবর্ধন আশের ৪টি করে, রামকিঙ্করের ২টি ও বাকি শিল্পীদের ১টি করে। সবার কাজের পাশে জয়নুলের ছবিগুলো যে যথেষ্ট ভিন্ন মাত্রার, এমনটিই আমাদের মনে হয়। তাঁর দুর্ভিক্ষের চিত্রমালার মাধ্যমেই জয়নুল আবেদিন চিহ্নিত হলেন বাংলার শিল্পকলার প্রথম সমাজবাসত্মবতার শিল্পী হিসেবে।
তাঁর দুর্ভিক্ষ চিত্রমালার মাধ্যমে জয়নুল আবেদিন মানবতাবাদ ও সমাজতন্ত্রের পক্ষে ভূমিকা রেখেছেন। ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ নিয়ে সে বছরই কলকাতায় যে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল তাতে জয়নুল তাঁর দুর্ভিক্ষ চিত্রমালা নিয়ে অংশগ্রহণ করেন। কম্যুনিস্ট পার্টির মুখপত্র The People’s War পত্রিকায় ১৯৪৫ সনের ২১ জানুয়ারি সংখ্যায় জয়নুলের ওপর একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। এতে জয়নুলকে ‘এক তরম্নণ বাঙালি মুসলমান’ হিসেবে পরিচয় করানো হয়। সঙ্গে ছিল তাঁর একটি ফটোগ্রাফ এবং দুর্ভিক্ষ চিত্রমালার তিনটি ছবির প্রতিলিপি। কাগজটি তাঁর সম্বন্ধে লিখেছিল, ‘বাংলার ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পীসংঘের একজন সদস্য জয়নুল। এই সংঘটি সমগ্র বাংলার সকল শিল্পী ও লেখকের এরকম একটি প্রতিষ্ঠান যার প্রধান কর্তব্যই ছিল সমস্যাতাড়িত জনগণকে সাহায্য করা। আর এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, সে সকল সময়েই এঁদের একজন অগ্রণী সদস্য থাকবে।’ জয়নুল সম্পর্কে পত্রিকাটির মূল্যায়ন যে বস্ত্ততই অত্যমত্ম সঠিক ছিল একথা পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয়েছে।
জয়নুল আবেদিন তাঁর দুর্ভিক্ষের ছবি সম্পর্কে নিজে কিছু কথা বলেছেন ১৯৭৩ সনে দিলিস্ন বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে যে সম্মানজনক ডি.লিট ডিগ্রি প্রদান করে, তার জন্য তাঁর লিখিত বক্তব্যে, তিনি বলেছেন, ‘ছবির বিষয় ও বক্তব্য ছবির স্টাইল ঠিক করে দেয়। উদাহরণ হিসেবে আমার ১৯৪৩ সনে আঁকা বাংলার দুর্ভিক্ষের স্কেচগুলোর কথা বলা যেতে পারে। পুরো বিষয়টি ছিল মানবতার জন্য অত্যমত্ম দুর্ভাগ্যজনক, নিষ্ঠুর ও অসম্মানজনক। যাদের আমি শৈশব থেকে চিনি সেইসব যন্ত্রণাকাতর কৃষকের মুখ বারবারই আমার মনে পড়ে। দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ রূপ এবং অসহায় মানুষের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ আমাকে প্রবলভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে, বরং বলা উচিত আমাকে বাধ্য করেছে ছবি আঁকায় সহজ, সরল ও সরাসরি স্টাইল অনুসরণে। রং, রেখা এবং কম্পোজিশনে যতদূর সম্ভব মিনিমাইজেশন করতে। সবগুলো স্কেচ ছিল কালো রঙের ও তুলির আঁচড়ের। কোনো পরিকল্পিত আঙ্গিক ছিল না, দৃশ্যের পুরোটুকু তুলে ধরার কোনো তাগিদও ছিল না। আমি জানি না এভাবে আঁকা কতটুকু ফলপ্রসূ হয়েছে, তবে আমার সে সময়কার অনুভূতি ও পরিস্থিতির সার্বিকতা অভিপ্রকাশে এই স্টাইলই আমি খুঁজে পেয়েছিলাম। সমালোচকগণ আমার এসব কাজ বিশেস্নষণ করেছেন এবং আমি তাঁদের সুচিমিত্মত মতামত দ্বারা ব্যাপকভাবে উপকৃত হই, যা পরবর্তীকালের দিনগুলোতেও আমাকে প্রভাবিত করেছিল। আমি দুর্ভিক্ষের দৃশ্যগুলো এঁকেছি প্রায় উন্মাদের মতো। কেন আমি এমন করেছিলাম? কেনই বা আমি ওসব এঁকেছিলাম? ওটা ছিল আমার একটি ক্ষুব্ধ অভিব্যক্তি; একটি প্রতিবাদ। ঐ সময়কার পরিস্থিতির বিরম্নদ্ধে, মানুষের ভয়াবহ ভোগামিত্মর বিরম্নদ্ধে আমার একটি বক্তব্য। আজও আমি ভাবি সেই দুর্ভিক্ষের কথা যা ছিল মানুষেরই তৈরি। মানুষই মানুষের জন্য দুর্ভোগ সৃষ্টি করে। আমি শুধু চেষ্টা করেছি আমার মতামত ও অনুভূতি তুলে ধরার।’ (‘দিলিস্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানজনক ডি.লিট ডিগ্রি গ্রহণ অনুষ্ঠানে জয়নুল আবেদিনের ইংরেজি ভার্সনের বাংলা ভাষ্য’। সূত্র : নজরম্নল ইসলাম, জয়নুল আবেদিন : তাঁর কাজ ও কথা, ঢাকা : পাঠক সমাবেশ, ২০০২, পৃ ১০৮-১০৯)।
১৯৪৩ সনে আঁকা দুর্ভিক্ষ চিত্রমালার পর কিছুদিন, বলা যায় পুরো ১৯৪৪ সন, তিনি বিভিন্ন মাধ্যম, যেমন লিনোকাট, ড্রাই পয়েন্ট, তেলরং এবং কালি ও ওয়াশ মাধ্যমে দুর্ভিক্ষের উলেস্নখযোগ্য আরো কিছু ছবি এঁকেছেন। এসব ছবিতে রেখা আরো মোটা হয়েছে, কালিতে অনেকটাই চৈনিক বা জাপানি আঙ্গিকের কাজ। একটি বিষয় নানাভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, রোগা, দীর্ঘদেহী এক যুবকের লাঠি হাতে কুঁজো হয়ে বসে থাকার দৃশ্য। ১৯৪৪-এ আঁকা (২৪ x ১৯ সেমি) ছবিটি অসাধারণ শক্তিমান। এই সনের একইভাবে শুকনো তুলির টানে আঁকা একটি কাকের ছবি অত্যমত্ম জীবমত্ম মনে হয়। প্রায় একই স্টাইলে তিনি বিদ্রোহী কবি নজরম্নল ইসলামের একটি পার্শব প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন ১৯৪৬ সনে (শ্রাবণ ১৩৫৩ সালে)।
অবশ্য কাছাকাছি সময়ে তিনি বিহারের দুমকা অঞ্চলের নিসর্গদৃশ্যের যেসব জলরং ছবি আঁকেন, সেগুলোর স্টাইল একেবারেই ভিন্ন, অনেকটা ইম্প্রেশনিস্ট ধারার সাবলীল জলরং ল্যান্ডস্কেপ। ছবিগুলোতে তারিখ উলেস্নখ নেই, তবে ইংরেজিতে তাঁর নাম স্বাক্ষর রয়েছে।
দেশবিভাগের বছরখানেক আগে (৮ অক্টোবর ১৯৪৬) জয়নুল বিয়ে করেন, ঢাকার মেয়ে জাহানারা আহমেদকে, দাম্পত্য জীবনের প্রথম বছরটি তাঁদের কলকাতায় কাটে।
১৯৪৭ সনে উপমহাদেশে দুটো স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হলো, তারপর জয়নুল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র পাকিসত্মানের অন্যতম প্রদেশ পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকায় চলে আসেন। তিনি কলকাতা আর্ট স্কুলে তাঁর চাকরিটি ছেড়ে ঢাকায় এসে নর্মাল টিচার্স ট্রেনিং স্কুলের অঙ্কন শিক্ষকের কাজ পান। কিন্তু তখন থেকেই তিনি এদেশে একটি চারম্নশিল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শুরম্ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তবে এ সম্পর্কে তিনি চিমত্মাভাবনা শুরম্ন করেছিলেন কলকাতা থাকতেই। বিষয়টি আলাপ করতেন আনোয়ারম্নল হক, সফিউদ্দীন আহমেদ ও কামরম্নল হাসানের সঙ্গে। সলিমুলস্নাহ ফাহমীর পরামর্শ ও সাহায্যও নিচ্ছিলেন। তখনকার সামাজিক ও রাজনৈতিক বাসত্মবতায় তাঁর এই উদ্যোগটি ছিল রীতিমতো বিপস্নবাত্মক ঘটনা। তাঁর শিল্পী হিসেবে খ্যাতি, অসাধারণ সাংগঠনিক মেধা, তৎকালীন শিল্পী সহকর্মী ও বন্ধুদের সহযোগিতা এবং কতিপয় বাঙালি সরকারি কর্মকর্তার সাহায্য ইত্যাদি সবকিছু মিলিয়েই সম্ভব হয়েছিল ১৯৪৮ সনে এদেশের প্রথম আর্ট স্কুলের প্রতিষ্ঠা। তখন এর নাম ছিল ‘গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টস’। জয়নুল আবেদিনকেই অধ্যক্ষ নির্বাচন করে আর্ট ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হলেও শুরম্নর প্রথম কয়েক মাস তাঁর বন্ধু শিল্পী আনোয়ারম্নল হক অস্থায়ী অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন, কারণ তখন জয়নুল আবেদিনকে করাচিতে কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য ও প্রচার বিভাগের আর্ট ডিজাইনার নিযুক্ত করা হয়েছিল। তিনি করাচি থেকে ফিরে ১৯৪৯ সনের ১ মার্চ ইনস্টিটিউটের স্থায়ী অধ্যক্ষের দায়িত্ব বুঝে নেন। তাঁর সহযাত্রী ছিলেন আনোয়ারম্নল হক, সফিউদ্দীন আহমেদ, কামরম্নল হাসান প্রমুখ, সকলেই কলকাতার আর্ট স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক বা ছাত্র। করাচিতে একটি ভালো পদে তাঁর স্বল্পকালীন চাকরি কেন্দ্রীয় সরকারের জ্যেষ্ঠ আমলাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের সুযোগ করে দিয়েছিল।
অধ্যক্ষ হিসেবে ইনস্টিটিউটটি গড়ে তোলার কঠিন কাজে তিনি নেতৃত্ব দেন। মাত্র দুকামরার সেই ইনস্টিটিউটকে ১৯৫৬ সনের মধ্যেই তিনি এক অতি চমৎকার আধুনিক প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করেন। পরবর্তীকালে এটি পূর্ব পাকিসত্মান চারম্ন ও কারম্নকলা মহাবিদ্যালয় এবং স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশ চারম্ন ও কারম্নকলা মহাবিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। আরো পরে মহাবিদ্যালয়টি সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হসত্মামত্মরিত হয় এবং প্রথমে চারম্নকলা ইনস্টিটিউট ও সম্প্রতি আটটি বিভাগসহ চারম্নকলা অনুষদে উন্নীত হয়। কলেজ ক্যাম্পাসের নকশা নির্মাণে সরকার দেশের শ্রেষ্ঠ বাঙালি স্থপতি মাজহারম্নল ইসলামকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। চারম্নকলা ইনস্টিটিউটের ক্যাম্পাসের যে নান্দনিকতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শিল্পী জয়নুল আবেদিন ও স্থপতি মাজহারম্নল ইসলামের যৌথ পরিকল্পনায় তা এদেশের ক্যাম্পাস স্থাপত্যের এক মানদ- হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে চারম্নকলা ক্যাম্পাসের বকুলতলা ঢাকা শহরের অন্যতম জনপ্রিয় উন্মুক্ত সাংস্কৃতিক চত্বরে পরিণত হয়েছে।
ইতোমধ্যে আগস্ট ১৯৫১ থেকে আগস্ট ১৯৫২ জয়নুল আবেদিন সরকারি বৃত্তি নিয়ে এক বছরের জন্য ইংল্যান্ড ও ইউরোপে কাটান। সেখানে অবস্থানকালে তিনি লন্ডনের সেস্নড স্কুল অব আর্টে প্রিন্ট মাধ্যমে উচ্চতর প্রশিক্ষণ লাভ করেন ও বিভিন্ন চারম্নকলা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেন। তিনি তাঁর নিজের শিল্পকর্মের প্রদর্শনীও করেন। তাঁর কাজ ইংল্যান্ডের বিদগ্ধজনের অকুণ্ঠ প্রশংসা অর্জন করে। তাঁর এই ইংল্যান্ড ভ্রমণটি শুধু যে তাঁকে পাশ্চাত্য জগতে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল তা-ই নয়, এতে করে তাঁর নিজের দৃষ্টি আরো প্রসারিত হয় এবং সম্ভবত এর মাধ্যমেই বাংলাদেশের চারম্নকলা চর্চা শুরম্ন থেকেই এক প্রাণবমত্ম আধুনিকতার চরিত্র গ্রহণ করতে পেরেছিল। আবেদিনের এই ইউরোপ ভ্রমণ তাঁকে বাংলার সমৃদ্ধ লোকশিল্পের মর্যাদা ও গুরম্নত্ব সম্পর্কেও বিশেষভাবে সচেতন করে তোলে। জয়নুল তাঁর ছাত্রাবস্থায় ও তারম্নণ্যে যদিও অবনীন্দ্রনাথের নব্য-ধ্রম্নপদী ধারা কিংবা যামিনী রায়ের বাংলার লোকঐতিহ্যসমৃদ্ধ শিল্পশৈলীর প্রতি তেমন আকৃষ্ট ছিলেন না, কিন্তু ’৫২-তে বিলেত থেকে ফিরে এসে তিনি এদেশের স্থানীয় শিল্পঐতিহ্যের সঙ্গে পাশ্চাত্যের আধুনিক শিল্প-আন্দোলন ও কৌশলাদি সমন্বয় সাধনে ব্রতী হন। ইতোমধ্যে তিনি নানান অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। তৎকালীন বিদ্যমান রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক পরিস্থিতি থেকেই তিনি বাঙালি সংস্কৃতির ওপর বৈরী পশ্চিম পাকিসত্মানি আধিপত্যবাদী মনোভাব সম্পর্কে সচেতন হন। বিশেষ করে ভাষা-আন্দোলন এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। তিনি তখন থেকেই চিত্রকলায় এক ধরনের আধুনিক বাঙালিত্ব ফুটিয়ে তোলার পক্ষে সুস্পষ্ট ও জোরালো মত ব্যক্ত করতে থাকেন। তাঁর এই মানসিকতা তাঁর নিজের কাজের মধ্যেও প্রতিফলিত হয়েছে। ১৯৫১ সনে এবং এর অব্যবহিত পরে আঁকা তাঁর ছবিতে একটি অসাধারণ আঙ্গিকের পরিচয় পাওয়া যায়। এই আঙ্গিকের প্রাথমিক পর্যায়ে দেখা যায়, জয়নুল গ্রামবাংলার অতি সাধারণ প্রাত্যহিক অথচ অত্যমত্ম প্রতীকী গুরম্নত্বসম্পন্ন দৃশ্যাবলি এঁকেছেন। ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ চিত্রমালার সেই তুলির বলিষ্ঠতা ও সাবলীলতা আবার প্রাণ পেয়েছে এ সময়ের কাজে। অধিকাংশ কাজ জলরং বা গোয়াশে করা। ব্যবহৃত জলরঙের বৈশিষ্ট্য হালকা এবং অনুজ্জ্বল, তুলির টান এবং কম্পোজিশন বা স্পেস ব্যবহার অত্যমত্ম প্রাচ্যধর্মী। অন্যদিকে বিষয় উপস্থাপনা ও ড্রইং পাশ্চাত্য-বাসত্মবধর্মী। এভাবে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের এক অপরূপ সমন্বয় ঘটেছে তাঁর শিল্পকর্মে। ‘ঝড়’ শীর্ষক ছবিটি এক অসাধারণ কাজ। এতে বাংলাদেশের কালবৈশাখীর আকস্মিকতা ও উদ্দামতা ধরা পড়েছে অতি চমৎকারভাবে। বিন্যাসের সংক্ষেপ্ততায় ছবিটি বিশেষভাবে আকর্ষণীয়। একইভাবে আরেকটি সুন্দর জলরং ছবি ‘মই দেয়া’। ‘কালবৈশাখী ঝড়’ কিংবা ‘মই দেয়া’, এ দুটো ছবির
পট-বিন্যাসের বিশেষ আকর্ষণীয় বিষয় ছিল, ছবির বিশাল অংশ জুড়ে প্রায় শূন্যতা সৃষ্টি করা। এই সিরিজের আরেকটি গুরম্নত্বপূর্ণ কাজ মাঝারি সাইজের একটি জলরং, যার শিরোনাম ‘বিদ্রোহী’। পরবর্তী সময়ে এটি একটি প্রতীকে রূপামত্মরিত হয়েছে। একটি অবাধ্য গাভী ষাঁড়ের মতো প্রচ- শক্তিতে তার বাঁধন ছিঁড়ে ছুটে যাচ্ছে। তুলির টানের শক্তি ও সাবলীলতা অসাধারণ। ক্ষেপ্রতার সঙ্গে আঁকা হলেও ছবিতে বিভিন্ন অংশের সূক্ষ্ম উপস্থাপনায় চরম মুনশিয়ানা ধরা পড়ে। পাকানো দড়ি কিংবা গরম্নটির পায়ের খুর, এসবের ডিটেলস লক্ষণীয়। এই আঙ্গিকেই প্রায় একই সময়ে (১৯৫১), তিনি ছবি এঁকেছেন সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে। সুগঠিত সুন্দর সাঁওতাল নর-নারীকে বিষয় করে চিত্তাকর্ষক ছবিও এঁকেছেন। গ্রামের সাধারণ কৃষক অথবা প্রামিত্মক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি সাঁওতাল নর-নারীর ব্যক্তিত্ব তিনি অতিরঞ্জিত অবয়বে উপস্থাপন করেন। সাধারণ মানুষ বা প্রামিত্মক মানুষকে বাসত্মবের চাইতে বড় করে দেখানোর চিমত্মা জয়নুলের আগে এ অঞ্চলের চিত্রকলায় খুব একটা দেখা যেত না। (দুদশক পরে এস এম সুলতানের কাজে আমরা এই দর্শনের প্রসারণ দেখেছি)। লক্ষণীয়, জয়নুল আবেদিন ১৯৫১ সনের আগস্ট থেকে ১৯৫২ সনের সেপ্টেম্বর মাস পর্যমত্ম বৃত্তি নিয়ে ইংল্যান্ড ও ইউরোপে, মূলত লন্ডন শহরে অবস্থান করছিলেন। এই সময়ের ছবিতে তাঁর স্বাক্ষর ও কোনো কোনোটিতে তারিখ থেকে মনে হয় এসব ছবি বিলেতে যাত্রার কিছু আগে এবং কিছু বিলেতে থাকতে এঁকেছেন।
এর পরপরই ’৫২-৫৩-তে জয়নুল গড়ে তোলেন এক চমৎকার নতুন ঢং, যাকে ‘আধুনিক বাঙালি’ ঢং বলা চলে। এই ঢঙের কাজের সঙ্গে যামিনী রায়ের ছবির ঢঙের কিছু সামঞ্জস্য দেখা যায়। জয়নুলের এই ঢঙের কাজে বাংলার লোকশিল্পের নানা মোটিফ এবং রং বিন্যাসের প্রভাবও লক্ষণীয়। তাঁর এ সময়ের কাজগুলোকে রোমান্টিক মেজাজের বলে চিহ্নিত করা যায়। বছর কয়েক আগে জয়নুল বিয়ে করেছেন, তাঁর সমত্মানদের জন্ম হয়েছে এরই মাঝে। ১৯৫১ সনের প্রথম দিকে তিনি শামিত্মনগরে ছোট একতলা একটি বাড়িসহ বিঘা দেড়েক জমি কেনেন, সেখানে বসবাস শুরম্ন করেন। সংসারে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য এসেছে। এক বছর বিলেত ও ইউরোপে অবস্থান ও ভ্রমণের সময় ও পরে তাঁর চিমত্মাচেতনায় বড় রকমের পরিবর্তন আসে। পশ্চিমের আধুনিকতাই শুধু নয়, আমাদের শিল্পকলার ভিত হতে হবে একেবারে দেশজ, লোককলা ও লোকজীবনই হবে উৎস, এ চিমত্মা থেকে নতুন আঙ্গিকের অন্বেষা। নতুন আঙ্গিকের ছবি সবই অবয়বভিত্তিক, তবে তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিতে উপস্থাপিত। আধা-বিমূর্ত (এমনকি কিছু ছবিতে জ্যামিতিক) ফর্মে নির্মিত হয়েছে মানব-মানবীর শরীর। অনেক ক্ষেত্রে প্রথাগত পারসপেকটিভের শর্ত মানা হয়নি। জলরং, গোয়াশ এবং তেলরং, নানা মাধ্যমে আঁকা ছবির এক সাধারণ বৈশিষ্ট্য উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার, তবে অবিমিশ্র প্রাথমিক রং নয়। ছবিগুলো আকারে-আয়তনে ছোট বা মাঝারি। অধিকাংশ ছবি মহিলাদের জীবনযাপন নিয়ে, এসব ছবিতে পলস্নী-রমণীগণ নদীর ঘাটে যাচ্ছেন জল আনতে বা সণান করতে। অনাবিল প্রশামিত্মতে প্রসাধনে নিযুক্ত, একক, যুগল কিংবা ত্রয়ী মহিলার চিত্র। মা ও শিশুও রয়েছে। গ্রামীণ কর্মী পুরম্নষের জীবনও ধরা পড়েছে এই সময়কার কাজে। একটি গোটা সিরিজ গড়ে উঠেছে এসব ছবি নিয়ে। এগুলোর মধ্যে কিছু স্মরণীয় কাজ হলো ‘গুণটানা’, ‘পলস্নী-রমণী’, ‘আয়না নিয়ে বধূ’, ‘একাকী বনে’, ‘পাইন্যার মা’, ‘মা ও শিশু’, ‘তিন পলস্নী-রমণী’, ‘মুখ চতুষ্টয়’ ইত্যাদি। প্রতিটি ছবিই অসাধারণ। ‘মুখ চতুষ্টয়’ অনেকটাই পাশ্চাত্য আধুনিকতা প্রভাবিত।
জয়নুলের এই ‘আধুনিক বাঙালি’ রীতির কাজগুলো দেখে একজন ব্রিটিশ শিল্পসমালোচক, রিচার্ড উইলসন, ১৯৫৫ সনে লিখেছিলেন, ‘(Now) he has made a brilliant synthesis of abstractionist technique with the melodic flowing lines.’ (The Sunday Statesman, Calcutta, 23 January, 1955, quoted in Anwar Dil, ‘Zainul Abedin’, in Bangladesh : An Intercultural Memoir, Dhaka, Adorn Books, 2011, p 68.)’। জয়নুল আবেদিন অবশ্য তাঁর এই শিল্প আঙ্গিকটি খুব বেশি দিন ধরে রাখেননি।
পঞ্চাশের দশকের শেষভাগেই তিনি বরং ফিরে যান তাঁর প্রথম পর্যায়ের বাসত্মবধর্মী আঙ্গিকে, যার বৈশিষ্ট্য ছিল গতিময় ও শক্তিশালী রেখা। মাঝেমধ্যে তিনি বিমূর্ত প্রকাশবাদী আঙ্গিকে কিছু ছবি এঁকেছেন, তবে তাঁর স্বাচ্ছন্দ্য ছিল বাংলার খেটে খাওয়া কর্মী মানুষের জীবনসংগ্রামের ছবি আঁকাতেই, যার আঙ্গিকগত পরিচয় বলা যায় অনেকটা রীতিবদ্ধ বাসত্মববাদী। ১৯৫৯ সনে আঁকা তাঁর বিশাল তেলরঙের একটি কাজ, শিরোনাম ‘সংগ্রাম’, এই ধারারই প্রতীক। (এই ছবির একটি এগ-টেম্পারা সংস্করণ রয়েছে ১৯৫৪ সনের)। এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে গরম্নর গাড়ির এক চালককে প্রাণপণ শক্তিতে কাদার মধ্যে আটকে পড়া তার গাড়িটিকে ঠেলে তুলতে। চালকের এই সংগ্রাম, এক নিঃসঙ্গ একক মানুষের সংগ্রাম, এ সংগ্রামের যেন কোনো শেষ নেই। ইতোমধ্যে জয়নুল আবেদিন আরেকবার দীর্ঘ বিদেশ ভ্রমণের সুযোগলাভ করেন, এবার জাপান হয়ে যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো, কানাডা, ব্রিটেন, জার্মানি, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, ইতালি, সুইজারল্যান্ড ও স্পেন যান। এসব দেশের শিল্প ও শিল্পীদের অনেকের সঙ্গেই পরিচয় ঘটে। নিজের কাজেরও প্রদর্শনী করেন। তাঁর আমত্মর্জাতিক যোগাযোগ বাড়ে। কিন্তু বাসত্মবে দেখা যায়, অর্ধেক পৃথিবী ঘুরে এসে তিনি তাঁর ‘আধুনিক বাঙালি’ আঙ্গিকটি একরকম পরিহার করেন। বরং ফিরে যান ’৪৩-এর বিস্ময়কর মোটা রেখা ও ’৫১-এর সাবলীল রং প্রয়োগের একটি সমন্বিত বাসত্মবধর্মী আঙ্গিকে। প্রায় গোটা ষাটের দশক, ’৬০-৬৮ জয়নুলের হাতে রং-তুলিতে তেমন স্মরণীয় সৃজন চোখে পড়েনি, বরং স্কেচধর্মী নদী ও নিসর্গচিত্র বা পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের জীবন নিয়ে ছবি এঁকেছেন। মধ্য ষাটে তিনি পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে চারম্নকলা বিভাগ প্রতিষ্ঠায় সময় দিয়েছেন। ১৯৬৭-তে ঢাকার চারম্নকলা কলেজের অধ্যক্ষ পদ থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে প্রায় বছর দুয়েক পাকিসত্মান সরকারের অনারারি আর্ট অ্যাডভাইজারের ভূমিকা পালন করেছেন। সব মিলিয়ে ষাটের দশক তাঁর জন্য কিছুটা ম্রিয়মাণ ছিল। দশকের শেষ বছর থেকে আবার তিনি অন্য রকম।
১৯৬৯ সনের গণ-আন্দোলন তৎকালীন স্বৈরশাসনের বিরম্নদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল। স্বৈরশাসনের শুরম্ন ১৯৫৮ সনের সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। বাংলাদেশে (অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিসত্মানে) বাঙালির রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির দাবিই ছিল গণ-আন্দোলনের মূল কথা। তখন এদেশের চিত্রশিল্পীরাও জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হন এবং ১৯৭০ সনের ফেব্রম্নয়ারি মাসে আর্ট কলেজে নবান্ন শীর্ষক এক বিশাল প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। আপাদমসত্মক এক বাঙালি জাতীয়তাবাদী, জয়নুল, বাংলার মানুষের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। শহীদ মিনারের সামনে প্রদর্শনের জন্য তিনি ব্যানার এঁকেছেন, ২১ ফেব্রম্নয়ারি উপলক্ষে প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিনগুলোর জন্য প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছেন, লিখেছেনও এগুলোতে, আর মিছিলেও তিনি অংশ নিয়েছেন। এমনকি তিনি জননেতা মওলানা ভাসানীর সঙ্গে ১৯৭১-এর ফেব্রম্নয়ারি মাসে ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত বিশাল জনসভায় ভাষণও দিয়েছেন। এভাবে দেখা যায় জয়নুল ছিলেন তাঁরই সমকালীন মেক্সিকোর শিল্পী ডেভিড সিকিওরসের ভাষার সেই ‘বিপস্নবী সমাজবাদী শিল্পী’। জয়নুল ১৯৫৬-৫৭ সনে বিশ্ব ভ্রমণের একপর্যায়ে মেক্সিকো বেড়াতে গিয়ে রিভেরা ও সিকিওরসের কাজের সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ পেয়েছিলেন।
দেশজ ঐতিহ্য আবার তাঁকে তাড়া করতে থাকে। ১৯৭০ সনের ‘নবান্ন’ প্রদর্শনীর জন্য বিশেষভাবে আঁকা ৬৫ ফুট দীর্ঘ একটি স্ক্রলচিত্র নিয়ে নেতৃত্ব দেন জয়নুল আবেদিন। স্ক্রলের কাগজের প্রস্থ ছিল ৪ ফুট। কালো চীনা কালি, জলরং আর মোম ব্যবহার করেছেন স্ক্রলটি আঁকতে। এই চিত্রমালায় তিনি তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাস। ‘সোনার বাংলা’র সুখ ও শামিত্মর দিনের চিত্র দিয়ে শুরম্ন, তারপর ঔপনিবেশিক শাসনের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত বাংলার ক্রমনিঃস্বতার পরিণতি, চরম দারিদ্র্যাবস্থা, দুর্ভিক্ষ অবধারিতভাবে দুঃখী দরিদ্র মানুষের গ্রামত্যাগী হয়ে শহরমুখী যাত্রা। এ এক মহা আলেখ্য।
স্পর্শকাতর দৃশ্যাবলি, হৃদয়স্পর্শী উপস্থাপনা, অত্যমত্ম সহজ সরল আঙ্গিক অথচ অসাধারণ তার আবেদন। হাজার হাজার মানুষ ‘নবান্ন’ প্রদর্শনীতে এসে এই ছবি দেখেছে। পরে তাঁর শামিত্মনগরের বাড়িতে গিয়েও অনেকে দেখেছে। তাঁর বাড়ি ছিল যেন এক খোলামেলা জাদুঘর। সবার ছিল অবারিত প্রবেশাধিকার। তিনি দর্শকদের উৎসাহ দিতেন ‘নবান্ন’ দীর্ঘচিত্রের শেষ অংশে অনেকটা জায়গা জুড়ে তাঁদের নিজের নাম সই করতে। এভাবে অসংখ্য মানুষকে শিল্পকলার সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছেন। এঁদের মধ্যে যেমন ছিলেন দেশ ও বিদেশের নামিদামি মানুষ, তেমনি ছিলেন বাংলার সাধারণ মানুষ। এভাবে জয়নুল একধরনের অংশগ্রহণমূলক শিল্পকলার বা ‘পার্টিসিপেটরি আর্টের’ সূচনা করেন। এ ধরনের উদাহরণ তিনি পঞ্চাশের দশকেও রেখেছিলেন। একটি সুন্দর উদাহরণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারম্নকলা অনুষদের ডিনের কক্ষে প্রদর্শিত জয়নুলের ‘নদীতে নৌকা’ জলরং ছবির চারদিকে দর্শকদের স্বাক্ষর।
জয়নুল আবেদিন ছিলেন মুক্তিকামী মানুষ। স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য যাঁরা সংগ্রাম করেন তাঁদের সবার সঙ্গেই একাত্মতা জানাতে উৎসাহী ছিলেন তিনি। ১৯৭০ সনে যখন তাঁর বয়স প্রায় ৫৬, তিনি আরব লীগের আমন্ত্রণে ছুটে যান মধ্যপ্রাচ্যের সমর ক্ষেত্রে, আল-ফাতাহ গেরিলাদের সঙ্গে চলে যান যুদ্ধফ্রন্টে। সেখানে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি আঁকেন, তাঁর সেসব ছবির প্রদর্শনী হয় একাধিক আরব দেশে। মুক্তিযোদ্ধারা তাতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। প্যালেস্টাইন থেকে দেশে ফিরতে না ফিরতে জয়নুলের নিজের দেশেই এক প্রলয়ঙ্করী ঝড় আঘাত হানে দেশের উপকূলীয় এলাকায়, তিন লক্ষাধিক মানুষ এই ঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে প্রাণ হারায়। প্রচ- মানসিক ধাক্কা খান জয়নুল আবেদিন। কিন্তু বসে না থেকে একটি রিলিফ টিমের সঙ্গে ছুটে যান দুর্যোগ আক্রামত্ম এলাকায়। দুঃখী মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। পরে তিনি সেখানকার মর্মস্পর্শী দৃশ্যাবলির কিছু কিছু তুলে ধরেন তাঁর তুলিতে, কালিতে। দুর্যোগ এলাকা থেকে ফিরে এসে নবান্ন আঙ্গিকেই আঁকেন আবার একটি দীর্ঘ স্ক্রলচিত্র। ‘মনপুরা ৭০’ শীর্ষক এই স্ক্রলটি ছিল ৩০ ফুট দীর্ঘ। কালো কালি এবং মোম সহযোগে আঁকা হয়েছে স্ক্রলের ছবি। এতে দেখানো হয়েছে সত্মূপীকৃত লাশের দৃশ্য, ‘আমরা শুধু মৃত্যুতেই একতাবদ্ধ হই’ – এ ছবির সামনে দাঁড়িয়ে জয়নুল দুঃখভারাক্রামত্ম হয়ে বলতেন। তবে স্ক্রলটির একেবারে শেষ প্রামেত্ম শিল্পী স্থাপন করেন এক বলিষ্ঠ পুরম্নষকে। এখনো জীবিত এবং মাথা নিচু করে বসে আছে ধ্বংসসত্মূপ থেকে বাঙালির সম্ভাব্য পুনরম্নত্থানের প্রতীক হিসেবে। অসাধারণ শক্তিশালী বিশাল কাজ। তখন তিনি শুধু যে এই দীর্ঘ স্ক্রলটিই এঁকেছেন তা নয়, পাশাপাশি এ বিষয়ে অনেকগুলো মাঝারি আয়তনের ছবিও এঁকেছিলেন, যার একটিতে মওলানা ভাসানীর প্রতিকৃতি এঁকেছেন দুর্যোগাক্রামত্ম মানুষের ত্রাণকর্তা হিসেবে। রাজনৈতিক নেতা বা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে বিষয় করে এভাবে ছবি আঁকার ঐতিহ্য ছিল না বাংলাদেশের আধুনিক চিত্রকলায়। এক্ষেত্রে তিনিই পথিকৃৎ। স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে অনেকে এদিকে এগিয়ে এসেছেন।
উনিশশ সত্তরের ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত সেরে উঠতে না উঠতেই শুরম্ন হলো মুক্তিযুদ্ধ। নিজ দেশে বন্দিজীবন কাটাতে বাধ্য হলেন জয়নুল। কিন্তু সর্বক্ষণই তাঁর দুর্ভিক্ষ চিত্রমালা বুকে আঁকড়ে ধরে রাখলেন।
মুক্তিযুদ্ধ জয়নুলের মনে প্রচ- আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বিজয় অর্জনের পর পরই তিনি পূর্ণোদ্যমে লেগে যান শিল্পচর্চা সংগঠনের কাজে। এবারে লোকশিল্প তাঁর কাছে প্রাধান্য পেতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর সমর্থনে তাঁর কাজ এগিয়েও যায়, কিন্তু ঘাতকদের গুলিতে জাতির জনকের মর্মামিত্মক মৃত্যু ও পরবর্তী সময়ে দেশের রাজনৈতিক সংকট তাঁকে অত্যমত্ম ব্যথিত করে। তাঁর কর্মচাঞ্চল্যে ভাটা পড়তে থাকে। তাঁর মন খারাপ হতে থাকে। সুপুরম্নষ স্বাস্থ্যবান দীর্ঘদেহী জয়নুলের স্বাস্থ্য দ্রম্নত ভেঙে পড়তে থাকে। তিনি যেন বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর সময় দ্রম্নত শেষ হয়ে যাচ্ছে। তিনি ছুটলেন তাঁর আজীবন লালিত স্বপ্ন ‘লোকশিল্প জাদুঘর’ প্রতিষ্ঠার কাজে। তাঁর ইচ্ছা ছিল এই জাদুঘরে সংরক্ষেত হবে দেশের মূল্যবান লোকশিল্প, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এখান থেকেই নতুন প্রেরণা পাবে। লোকশিল্প সংরক্ষণের জন্য আন্দোলন শুরম্ন করেছিলেন তিনি সেই পঞ্চাশের দশক থেকেই। ১৯৫৫ ও ১৯৫৮ সনে নিজের কলেজে লোকশিল্প প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিলেন। লেখালেখিও করেছেন এর পক্ষে। ‘জাদুঘর ও আর্ট গ্যালারির পক্ষে’ শিরোনামের তাঁর ইংরেজিতে লেখা একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে তৎকালীন পাকিসত্মানের সিভিল অ্যান্ড মিলিটারি গেজেট নামক দৈনিকের ২৮ মে, ১৯৬৩ তারিখে (নজরম্নল ইসলাম, জয়নুল আবেদিন : তাঁর কাজ ও কথা, ২০০২)। জয়নুল তাঁর নিজের শিল্পকর্ম সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের জন্যও একটি চিত্রশালা প্রতিষ্ঠার কথা ভেবেছিলেন। এ দুটো প্রতিষ্ঠানেরই বাসত্মবায়ন প্রক্রিয়ার শুরম্নটা তিনি তাঁর মৃত্যুর আগেই দেখে যেতে পেরেছেন।
লোকশিল্প জাদুঘরটি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয় স্থাপিত হয়। এর ঐতিহাসিক তাৎপর্য ও গুরম্নত্ব রয়েছে। ঢাকা থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দক্ষেণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত সোনারগাঁ একসময়ে বাংলার অন্যতম রাজধানী শহর ছিল। মোগল আমলে এই অঞ্চল প্রসিদ্ধ ছিল মসলিন কাপড় তৈরির কেন্দ্র হিসেবে। এখনো এ অঞ্চলে সুন্দর সুন্দর হাতের কাজ হয়। তাঁতে কাপড় তৈরি হয়। অন্যদিকে জয়নুল তাঁর নিজের ছবির গ্যালারির স্থান নির্বাচন করেন ময়মনসিংহে তাঁর অতি প্রিয় ব্রহ্মপুত্র নদের তীরের একটি পুরাতন ভবনে। এটাই তাঁর জন্য স্বাভাবিক ছিল। ময়মনসিংহ তাঁর নিজের জেলা। এখানকার নৈসর্গিক পরিবেশই গড়ে তুলেছিল তাঁর শিল্পমানস, এখানকার জেলা বোর্ডই কলকাতায় তাঁর শিল্পকলা শিক্ষাকালে প্রথম পর্যায়ের অতি জরম্নরি বৃত্তিটি দিয়ে তাঁকে উৎসাহিত করেছিল। জয়নুল আবেদিন তাঁর এসব ঋণের কথা ভোলেননি কখনো। সুযোগ পেলেই ঋণ পরিশোধের চেষ্টা করেছেন। তাঁর জন্মস্থান ময়মনসিংহকে উপহার দিয়েছেন একটি আর্ট গ্যালারি আর বাংলাদেশের জনগণকে দিয়েছেন তাঁর সারাজীবনের শিল্পকর্মের বৃহৎ সম্ভার। এসবের মধ্যে মহামূল্যবান দুর্ভিক্ষ চিত্রমালার অধিকাংশ স্কেচও রয়েছে। তাঁর এই শিল্পসম্ভার বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের জয়নুল গ্যালারিতে সংরক্ষেত।
জয়নুল আবেদিনের জন্ম সাধারণ পরিবারে। তিনি জীবনযাপনও করেছেন সাধারণ বাঙালির মতোই। সরল কিন্তু আত্মবিশ্বাসী জয়নুল সমাজের শক্তিধর ব্যক্তিত্ব এবং দরিদ্র চাষি সবার সঙ্গেই অত্যমত্ম স্বচ্ছন্দে মেলামেশা করতে পারতেন। তারাও যেন তাঁকে আপন মানুষ মনে করত। তিনি ছিলেন এক অসাধারণ মজলিশি মানুষ, অক্লামত্ম আড্ডা দিতে পারতেন। তাঁর কথা বলার ভঙ্গিটি ছিল একেবারেই নিজস্ব ও অননুকরণীয়। ময়মনসিংহের আঞ্চলিকতার টান ছিল ভাষায়। তিনি ছিলেন যেমন আমুদে, তেমনি রসিক। তিনি ভালোবাসতেন শিশুদের, ভালোবাসতেন ভালো খাবার, বিশেষ করে গ্রামবাংলার খাবার। তিনি ছিলেন চা প্রেমিক এবং ধূমপানে আসক্ত। নিরবচ্ছিন্নভাবে সিগারেট খেতেন। এই অভ্যাসই হয়তো শেষে তাঁর কাল হয়েছিল।
দীর্ঘ ছমাস ফুসফুসের ক্যান্সারে ভুগে মাত্র ৬২ বছর বয়সে তাঁর জীবনাবসান হয়। অবশ্য জীবনের শেষ সময় পর্যমত্ম তিনি আঁকার কাজ অব্যাহত রাখেন। ১৯৭৬ সনের ২৮ মে তারিখে তাঁর মৃত্যুর মাত্র কদিন আগে হাসপাতালে শুয়ে তিনি তাঁর নিজস্ব ঢঙে শেষ ছবিটি আঁকেন, দুটো মুখ, বলিষ্ঠ মোটা রেখায়, কালো কালি আর মোম ব্যবহার করে।
যে জয়নুল আবেদিন সাধারণ শিক্ষার ক্ষেত্রে ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগেই বিদ্যালয় ছেড়েছিলেন, পরবর্তীকালে ১৯৭৩ সনে তাঁকেই ভারতের দিলিস্ন বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানসূচক ডি.লিট ডিগ্রি প্রদান করেছে। পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৬৪-৬৫) এবং স্বাধীন বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৯৭৩-৭৫) তিনি ছিলেন ভিজিটিং প্রফেসর। তিনি বাংলা একাডেমির সভাপতির পদ অলংকৃত করেছেন ১৯৭২-৭৪ দুবছর। বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭৫ সনে তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক নিযুক্ত করেন। আজীবন তিনি ছিলেন জনগণের শিল্পী এবং জনগণেরই মানুষ। আবার দেশ-বিদেশের রাষ্ট্রনায়ক এবং প–তগণ তাঁকে অতি উঁচু দৃষ্টিতে দেখতেন। তাঁর অসাধারণ শিল্প-প্রতিভা ও মহৎ মানবিক গুণাবলির জন্য তিনি বহু পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছেন, সরকার এবং জনগণের কাছ থেকে পেয়েছেন সম্মান। রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণে তিনি অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন, দুবার সোভিয়েত ইউনিয়ন (১৯৬১ ও ১৯৭৮)।
বাংলাদেশে চারম্নকলার উন্নয়নে জয়নুল আবেদিন তাঁর অবদানের যথার্থ স্বীকৃতি পেয়েছেন ‘শিল্পাচার্য’ সম্বোধনে। এ শিরোপা তাঁকে উপহার দিয়েছে তাঁরই গুণমুগ্ধ ছাত্রছাত্রীরা (১৯৬৭)। দেশবাসীও এ নামেই তাঁকে শ্রদ্ধা জানায়।
বাংলাদেশে জয়নুল আবেদিনের গুরম্নত্ব, তিনি যেমন ছিলেন একজন শিল্পী তেমনি ছিলেন এদেশের আধুনিক শিল্পকলা আন্দোলনের পথিকৃৎ। তাঁর মানবিক গুণাবলির জন্যও তিনি বিশিষ্ট। প্রচ- শক্তিশালী এবং অত্যমত্ম সংবেদনশীল এক শিল্পী জয়নুল আবেদিন। কিন্তু শিল্পকলাকে কখনই তিনি সাধারণ জীবনের বাইরের কোনো বিষয় বলে গণ্য করেননি। ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ – এমন আদর্শের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলেন না জয়নুল আবেদিন। আবার প্রোপাগান্ডা আর্টেও তিনি বিশ্বাস করতেন না। শিল্প জীবনেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, এটাই ছিল তাঁর দর্শন। তাঁর কাছে শিল্প হচ্ছে জীবনেরই এক প্রকাশ আর এর উদ্দেশ্য হলো মানবসমাজকে সমৃদ্ধ ও সুন্দর করে তোলা। তাঁর নিজের মুখের কথাই তাঁর জীবনদর্শন ও শিল্পচিমত্মার পরিচায়ক। তিনি বলেন, ‘আমি নিজে শিল্পকর্ম করে যতটা আনন্দ পাই তার চেয়ে বেশি আনন্দ পাই শিল্পকে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে দেখলে, আমার নিজের শিল্পকে জীবনে প্রবিষ্ট হতে দেখলে। ছবি আঁকার সাফল্যের চেয়ে আমি তৃপ্তি পাই আরো অনেকে ছবি আঁকতে পারবে এমন একটি প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করার প্রচেষ্টায়। কেননা এখান থেকে জন্ম নেবে সুন্দরের নির্মাতারা, এখান থেকে জন্ম নেবে সুন্দরের চিমত্মা ও সুন্দর। আমি একটি সুন্দর বা মহৎ ছবি এঁকে আর কতদূর কী করতে পারব। ‘শিল্পকলা শুধু শিল্পকলার জন্য’, এ ধরনের বিশ্বাস আমার নয়। আমি বিশ্বাস করি শিল্পকলা মানুষের জন্য। তার জীবনকে সুঠাম ও সুন্দর করার জন্য। প্রকৃতি, মানুষ, জীবন সবকিছু যখন এক হয়ে যাবে তখনই সম্ভব হবে সবচেয়ে সুন্দরের সৃষ্টি। সেই অবস্থায় আমাদের পৌঁছুতে হবে, সকল মানুষকে, সারাবিশ্বের মানবসমাজকে। বাঙালি জাতিকেও এই অবস্থায় পৌঁছুতে হলে সকলকে সুন্দরের মর্ম বোঝাতে হবে, শিল্পকলার চর্চা সেজন্যই সর্বজনীন করা একামত্ম বাঞ্ছনীয়। তার জন্য জাতীয় চিত্রশালা, জাতীয় লোকশিল্প জাদুঘর ইত্যাদি প্রয়োজন। চাই সর্বসত্মরে শিল্পশিক্ষা। অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য যেমন কাম্য তেমনি কাম্য হওয়া উচিত সুন্দর রম্নচিশীল ও সৎ জীবন, শৈল্পিক জীবন। আমি বারবার বলি, আমাদের বর্তমান দুর্ভিক্ষ ততটা ভাতের নয়, যতটা রম্নচির দুর্ভিক্ষ। একে দূর করতেই হবে। হয়তো অর্থনৈতিক দারিদ্র্য এবং রম্নচির দারিদ্র্য সমামত্মরালভাবে অগ্রসর হয়। সেক্ষেত্রে আমাদের সংগ্রাম ঐ উভয় দারিদ্রে্যর বিরম্নদ্ধেই হওয়া উচিৎ। আমি সুন্দর প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের অন্যতম সৈনিক মাত্র।’ (সূত্র : ‘জয়নুল আবেদিনের শিল্পভাবনা : একটি সাক্ষাৎকার’, নজরুল ইসলাম, সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ১৫ মার্চ, ১৯৭৪, পুনর্মুদ্রণ : জয়নুল আবেদিন : তাঁর কাজ ও কথা, ২০০২।’)
১৯৪৮ সনে জয়নুল আবেদিনের হাতে যে চারম্নকলা বৃক্ষের চারা রোপণ হয়েছিল আজ ৬৭ বছরে সেটিকে মহীরম্নহ বলেই মনে হয়। বিশেষ করে যখন দেখি, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সামগ্রিক শিল্পচর্চায় ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে, শিল্পীর সংখ্যা বেড়েছে, পৃষ্ঠপোষকতার মাত্রা বেড়েছে, গ্যালারি ও শিল্পাঙ্গনের সংখ্যা বেড়েছে, প্রদর্শনীর সংখ্যা বেড়েছে। শিল্প বিষয়ক প্রকাশনার ধরন ও মান বেড়েছে। শিল্পে আমত্মর্জাতিক যোগাযোগ বেড়েছে এবং শিল্পকর্মের চাহিদা ও আর্থিক মূল্যও বেড়েছে। জাতীয় জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে শিল্পীসমাজ ও শিল্পকলার মর্যাদা বেড়েছে। এ সবকিছুর জন্যই বাংলাদেশের শিল্পীসমাজ ও সমগ্র জাতি শিল্পাচার্যের প্রতি কৃতজ্ঞ।
২০১৪ সনের ডিসেম্বর থেকে ২০১৫ ডিসেম্বর পর্যমত্ম গোটা বছর যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশের শিল্পানুরাগী মানুষ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জন্মশতবার্ষিকী (১৯১৪-২০১৪) পালন করছে। এই আয়োজন শিল্পাচার্যের প্রতি ও বাংলাদেশের শিল্পকলার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন। 
অক্টোবর, ২০১৫
নজরম্নল ইসলাম, প্রবন্ধকার, শিক্ষাবিদ ও শিল্পসমালোচক।

Leave a Reply