logo

জ্যাক দ্য ড্রিপার : দুর্বিনীত জ্যাকসন পোলক

আ ন্দা লি ব  রা শ দী

আঠারো বছর বয়সী জ্যাকসন পোলক ১৯৩০ সালে ভাইকে লিখলেন : ‘আমার ড্রইং, খোলামেলাভাবেই তোমাকে বলছি, অত্যন্ত বাজে, একেবারে পচা। মনে হয়, এতে স্বাধীনতা ও ছন্দের কত অভাব। আমার ড্রইং বড় শীতল এবং প্রাণহীন। ডাক খরচ দিয়ে পাঠাবার উপযুক্ত তো নয়ই।’

নিজের আঁকা ছবি নিয়ে যে বয়সে অহংকারী হয়ে ওঠার কথা, জ্যাকসন পোলককে দেখা গেল বড্ড বাড়াবাড়ি রকমের নির্মম আত্মসমালোচক। আর তাঁর পরিণত বয়সের ছবি নিয়ে চিত্র-সমালোচক রবার্ট কোটস লিখলেন, জ্যাকসন পোলকের ছবিগুলো তাঁর এলেবেলে শক্তির অগোছালো বিস্ফোরণ ছাড়া আর কিছুই নয়। সুতরাং এসব অর্থহীন।

এখানে-ওখানে রং ছড়ালেই কি আর ছবি হয়? তাঁর কালের সমালোচকদের অনেকেই ভেবেছেন, জ্যাকসন পোলকের মতো যে কেউ পাগলের মতো চারদিকে রং ছড়াতে পারে। তাঁকে নিয়ে বই লিখেছেন হেলেন হ্যারিসন, অবশ্যই জ্যাকসনের মরণোত্তরকালে; তিনি লিখেছেন, ‘হ্যাঁ তা তো সত্যিই। যে কেউ চারদিকে রং ছড়াতে পারে, আমিও তো তাই বলি। কিন্তু এটা যে শেষ পর্যন্ত কিছু একটা হয়ে ওঠে না।’

যেভাবে রং ছড়ান না কেন জ্যাকসন পোলকের

চর্চাই হোক কি পাগলামি – শেষ পর্যন্ত শক্তিশালী কিছু একটা হয়ে উঠেছে। রঙের বিস্তার শিল্পীর ভাষায় একটি ‘বার্তা’ দিতে পেরেছে।

ওল্ড মাস্টারদের কথাই ধরুন কি ভ্যান গগ বা মনের মতো ইম্প্রেশনিস্টদের কেউ, কিংবা বিমূর্ত চিত্রকলার শিখরবাসী পিকাসো কিংবা মাতিস – যাঁদের একটি ছবি অবলীলায় একশ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়ে যায়, আপনার যত অপছন্দের শিল্পীই হোন না কেন জ্যাকসন পোলক কিন্তু তাঁদেরই পাশাপাশি অবস্থান নিয়েছেন একশ মিলিয়ন ক্লাবে।

জ্যাকসন পোলক এখানেই থেমে নেই। ১৯৪৮ সালে তাঁর আঁকা ছবিগুলোর মধ্যে ‘৫ নম্বর’ ছবিটি ২০০৬ সালে নিলাম ডাকে উঠল, হাতুড়ির তিন ঘা পড়ল একশ চল্লিশ মিলিয়ন ডলার ডাকের পর।

১৯৪৮-এর ‘৫ নম্বর’ ছবিটি বিশ্বরেকর্ড করল, সে রেকর্ড এখনো ভাঙেনি। খোলাবাজার থেকে ডলার কিনলে তখন দিতে হতো বাংলাদেশি টাকায় এক হাজার একশ নব্বই কোটি টাকা।

পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হওয়া ছবিটির নাম ১৯৪৮-এর ‘৫ নম্বর’ ছবি কেন?

লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ‘মোনালিসা’, মাইকেলেঞ্জেলোর ‘আদমের সৃষ্টি’ টিশিয়ানের ‘ভেনাস’, ক্লদ মনের ‘সূর্যোদয়’, ভ্যান গগের ‘সূর্যমুখী’, সালভাদর দালির ‘স্মৃতির একগুঁয়েমি’, মাতিসের ‘নৃত্য’, পিকাসোর ‘আয়নার সামনে বালিকা’ – সব ছবিরই তো নাম আছে। নাম থাকাটা কি খুব জরুরি? না থাকলে অসুবিধে কোথায়?

ছবির নাম মোনালিসা না হলে আমরা কি বিশ্বখ্যাত এ ছবিটির নারীকে অন্য কোনো নামে জানতাম – প্যাট্রিসিয়া কিংবা সামান্থা, লেডি গাগা কিংবা কার্লোস ব্র“নি? ভেনাসকে মনে হতো আমাদের অবচেতনের নির্বসন এক প্রতিবেশী-কন্যা?

জ্যাকসন পোলক শুরুতে তাঁর ছবির এমন নামই দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর মনে হলো, নাম ছবির ব্যাপ্তি কমিয়ে দেয়। ছবি দেখতে আসা দর্শক পূর্বধারণায় পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে আসেন আর ছবির মধ্যে তাঁর ধারণালব্ধ বিষয়কেই খোঁজ করেন। ছবি নিজেকে যেভাবে উপস্থাপন করছে তা আর দেখা হয়ে ওঠে না। একটি নাম সেঁটে দেওয়ার মানে ছবিটি একটি বিষয়কে প্রতিনিধিত্ব করছে। কিন্তু শিল্পীর কাজটি যে আরো বড়, আরো অর্থবহ। নাম সেঁটে দিয়ে ছবিকে সীমাবদ্ধ করে রাখার বিরোধিতা করে জ্যাকসন পোলক একসময় নামহীন ছবি আঁকতে শুরু করলেন। নামই একটি চিত্রকল্পের সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু সংখ্যা কি পারে?

৮ x ৪ ফুট ফাইবার বোর্ডে তেলরঙে ১৯৪৮ সালের ‘৫ নম্বর’-এ শিল্পী কী এঁকেছেন? দর্শকরা কী দেখছেন এ ছবিতে?

জ্যাকসন পোলক বরাবর চেয়েছেন ছবি কীভাবে নিজেকে দর্শকের সামনে উপস্থাপন করে, দর্শক তা দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠুন। সেজন্যই তাঁর ছবি নিয়ে অনেক বিতর্কের পর সবাই বলতে বাধ্য হন, তিনি ছবি দেখার ধারাটি পালটে দিয়েছেন।

চিত্রকলার জগতে ২০১২ আসলে জ্যাকসন পোলক বর্ষ, শিল্পীর জন্মের শতবর্ষ উদ্যাপনের বছর।

দুর্বিনীত জ্যাকসন

২৮ জানুয়ারি ১৯১২ যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চলীয় অঙ্গরাজ্য ওয়াইওমিঙ্গের কোডিতে পল জ্যাকসন পোলকের জন্ম। বাবা লেরয় পোলক মূলত কৃষক, পরে সরকারের জরিপ দফতরে চাকরি নিয়েছিলেন। মা স্টেলা ম্যাকক্লুর গৃহবধূর বেশি কিছু নন। পাঁচ সন্তানের কনিষ্ঠতম জ্যাকসন পোলক চার বছর বয়সে খেলতে খেলতে চাপাতি দিয়ে নিজের আঙুল কেটে ফেলেন, ক্ষত শুকাতে অনেকটা সময় কেটে যায়। আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের কাছে জ্যাকসন একটি ছোট্ট শয়তান : অস্থির, পাগলাটে, ঝুঁকিপূর্ণ, সমস্যাগ্রস্ত, বিকারপ্রবণ আবার তাঁর মাতলামি ও উদ্ভট আচরণ উপভোগ করার জন্য উৎসাহী বন্ধুরা তাঁর হাতে বোতলের পর বোতল অ্যালকোহল তুলে দিয়েছেন। তাঁর বেড়ে ওঠা অ্যারিজোনা ও ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে। শৈশবেই বাড়ি থেকে পালিয়ে মালগাড়িতে চেপে চলে গেলেন ওকলাহামা ও টেক্সাস। তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে উঠল সেখানকার ভবঘুরে ও মাতালদের সঙ্গে, বেপরোয়া যৌনকর্মীরাও যোগ হলো তাঁর প্রিয়জনের তালিকায়।

স্কুলের গণ্ডি পেরোতে পারেননি। দীর্ঘ চুল, উদ্ভট পোশাক এবং শিক্ষাঙ্গনের সঙ্গে অসামঞ্জ্যপূর্ণ মেজাজের জন্য স্কুলের খাতা থেকে তাঁর নাম কাটা যায়। কার্যত স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ায় শৈশবে তাঁর আর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা হয়ে ওঠেনি।

জ্যাকসন পোলক লিখেছেন : আমার শৈশবে মানুষ আমাকে আতঙ্কগ্রস্ত ও বিরক্ত করে তুলত। সেজন্যই আমার চারপাশে দেয়াল তুলে নিজেকে রক্ষা করতে হয়েছে। আমাকে থাকতে হয়েছে নিজের প্রকোষ্ঠে।

১৯৩০-এর দশকে দারিদ্র্য তাঁকে এতটাই প্রান্তবর্তী করে ফেলেছিল যে, কখনো কখনো তাঁকে খাবারও চুরি করতে হয়েছে। ১৯৩৮ সালে তাঁর চিত্তবৈকল্য এত তীব্র হয়ে ওঠে যে, ক্রমাগত কিছুকাল তাঁকে হাসপাতালে কাটাতে হয়। বেঁচে থাকার সংগ্রাম মুখ্য হয়ে উঠলে ছবির জগৎ তাঁকে টানতেই থাকে। বিচিত্র কর্মজীবনে জ্যাকসন পোলককে শিশুদের স্কুলে দারোয়ানের চাকরি করতে হয়েছে। নিউইয়র্কে মূর্তি পরিষ্কার করার জন্য ক্লিনার হিসেবে নিয়োগ লাভ করেছেন। সেনাবাহিনীতে নাম লেখাতে গিয়ে শারীরিক অযোগ্যতার জন্য বাদ পড়ে গেছেন। কিছুকাল করাতকলে কাঠ চেরাইয়ের কাজও করেছেন।

শৈশবে অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে ঘুরে বেড়িয়েছেন আদিবাসী আমেরিকানদের এলাকা ফিনিক্সে; যৌবনে রাতের পর রাত কাটিয়েছেন নিউইয়র্ক শহরের রাস্তায়, পতিতালয়ে। একদিকে যখন অন্ধকার, অন্যদিকে শহরের আকাশছোঁয়া অট্টালিকার ভেতর উজ্জ্বল ও বর্ণিল আলোর বৈপরীত্য তাঁকে বিস্মিত করেছে; শিশুসুলভ মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে রয়েছেন আলো ও আঁধারের দিকে। এবার জ্যাকসন নিজেকে প্রকাশ করতে ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। সারারাত জাগতেন, ছবি আঁকতেন, ঘুমোতেন কোলাহলময় দিনদুপুরে। একবার বাবাকে লিখলেন, আর সত্তরটা বছর ভালো কাটাতে পারলে আমি হয়ে উঠব একজন সত্যিকারের ভালো শিল্পী।

তিনি শিল্পী হয়েই বাঁচতে চেয়েছেন। কিন্তু যে জীবন তিনি যাপন করেছেন, দারিদ্র্য এমনই নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছিল যে, বাবার মৃত্যুর পর সমাহিত হবার আগে শেষবারের মতো বাবার মুখটি দেখতে বাড়ি ফেরার মতো টাকা তাঁর হাতে ছিল না (পাশাপাশি একবার ভাবা যাক, তাঁর একটি ছবিই বিক্রি হয়েছে একশ চল্লিশ মিলিয়ন ডলারে।)।

১৯৪১ সাল থেকে পরস্পর পরিচিত হলেও ১৯৪৬ সালে তাঁকে ভয়ানক আর্থিক দুর্দশা থেকে উদ্ধার করে শিল্পী লি ক্রাসনার বিয়ে করেন এবং নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। ধনাঢ্য আমেরিকান শিল্প-সমঝদার পেগি গগেনহেইমের অর্থানুকূল্যে নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ডে একটি কাঠের বাড়িতে পোলক-ক্রাসনার নিবাস ও স্টুডিও স্থাপন করেন। কিন্তু জ্যাকসন পোলকের যে জীবন তা ঘর বাঁধার নয়, ভাঙার। পেগি গগেনহেইমের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গড়ে ওঠে আবার ভেঙে যায়। লি ক্রাসনার তাঁর সন্তান ধারণে সম্মত হননি, আবার তাঁকে তালাক দিতেও অস্বীকৃতি জানান। একসময় তাঁর সঙ্গ থেকে দূরে থাকার জন্য লি ক্রাসনার প্যারিসে চলে আসেন। লির শূন্যস্থান দখল করেন জ্যাকসনের রক্ষিতা রুথ ক্লিগম্যান।

১৯৫৬-র ১২ আগস্ট লি ক্রাসনার নিউইয়র্ক থেকে ফোন পেলেন, আগের রাতে অ্যালকোহলের প্রভাবে থাকা অবস্থায় গাড়ি চালিয়ে তাঁর স্বামী জ্যাকসন পোলক দুর্ঘটনা ঘটিয়েছেন। ১১ আগস্ট রাতের বেলা দুর্ঘটনাস্থলে নিহত হন ‘অ্যাকশন পেইন্টিং’য়ের অন্যতম প্রধান গুরু। সঙ্গে নিহত হয়েছেন আরো একজন। আহত অবস্থায় বেঁচে আছেন রুথ ক্লিগম্যান।

জ্যাকসন পোলকের অপঘাত মৃত্যু সংস্কৃতিজগতের একটি পুরনো প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে – মেধাবী শিল্পী হলেই তাঁকে এমন   আত্মবিনাশী হতে হবে?

জ্যাক দ্য ড্রিপার

বিমূর্ত অভিব্যক্তিবাদ – অ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিজমের অন্যতম পুরোধা, শিল্পের সন্ন্যাসী জ্যাকসন পোলক।

লস অ্যাঞ্জেলেসের ম্যানুয়াল আর্টস হাই স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হন শৈশবেই। আঠারো বছর বয়সে। জ্যাকসন থোমাস হার্ট বেনটনের আর্টস স্টুডেন্টস লিগ অব নিউইয়র্কে ভর্তি হন। তাঁর আগ্রহ তখন ছবি আঁকাতে, ছবির তাত্ত্বিক পাঠে নয়। থোমাস বেনটনের গ্রামীণ চিত্রমালা তাঁকে আকৃষ্ট করে। কিন্তু তাঁর সবচেয়ে বেশি পছন্দ বেনটনের ছন্দময় রঙের ব্যবহার এবং রং ব্যবহারে তাঁর অবাধ স্বাধীনতা। রঙের স্বাধীন ব্যবহার গড়ে তোলে তাঁর অসনাতন শিল্পমানস।

ইউরোপের একটি সাধারণ প্রবণতা ইউরোপের বাইরের যে-কোনো শিল্প-প্রচেষ্টা ও শিল্প-আন্দোলনকে হেয় করে দেখা। ইউরোপীয়দের মজ্জাগত এই উন্নাসিকতাকে গুঁড়িয়ে দেন জ্যাকসন পোলক। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর বিমূর্ত ধারার তরুণ, মেধাবী ও অগ্রসরমান শিল্পীদের অনেকেই ইউরোপের শিল্প-সবক এড়িয়ে জ্যাকসনের অবয়বহীন ছবির দুরন্তপনাকে কবুল করে নেন।

তুলিতে রং নিয়ে ইজেলে রাখা ক্যানভাসে আঁচড় দেওয়ার শিল্পী তিনি নন। জ্যাকসন পোলক আবিষ্কার করলেন নিজের ধারা। ফ্লোরে বিছিয়ে নিলেন ক্যানভাস। ক্যানভাসের ওপর ফোঁটায় ফোঁটায় ফেললেন তরল রং। ক্যানভাসে তখন ছোট-বড় অনেক বহুবর্ণ রঙের ডিবি। জ্যাকসন পোলক নেমে গেলেন কাঠি হাতে, বড় ক্যানভাস হলে তার ভেতরেই। শুরু হয়ে গেল তাঁর সৃষ্টিশীলতার উন্মত্ততা। এভাবেই তিনি এঁকেছেন তাঁর শ্রেষ্ঠ ছবিগুলো। একবার কুড়ি ফুট দীর্ঘ ক্যানভাসে ছবি আঁকতে গিয়ে দেখলেন মেঝেতে কুলোচ্ছে না। সুতরাং পাশের কক্ষের দেয়াল ভেঙে মেঝের পরিসর বাড়িয়ে নিলেন।

ফোঁটায় ফোঁটায় ফেলা ড্রিপ থেকেই তিনি হয়ে উঠলেন ‘জ্যাক দ্য ড্রিপার’।

ড্রিপ বা ড্রিপার শিল্পী লি ক্রাসনারের কাছে অপছন্দের শব্দ। এতে জ্যাকসন পোলকের ছবির নন্দনতাত্ত্বিক বিষয়গুলোকে খাটো করা হয় বলে তাঁর ধারণা।

ব্যাকরণ না মানা এই চিত্রশিল্পীর জীবনের ১৯৪৭ থেকে ১৯৫০ – এই সময়টিই চিহ্নিত হয়েছে ‘ড্রিপ পিরিয়ড’ হিসেবে। তাঁর শ্রেষ্ঠ কাজগুলো এ-সময়েরই।

জ্যাকসন পোলক মার্কিন পপ আর্টের প্রথম মেগাস্টার। তাঁর ছবিকে একদিকে যেমন বলা হয়েছে নিুরুচির বাজে রকম মশকরা, অন্যদিকে তাকে বলা হয়েছে দুঃসাহসী বিপ্লবী।

একসময় তিনি ক্যানভাসের ওপর সিরিঞ্জ দিয়ে রং ছড়িয়েছেন। রঙের সঙ্গে কখনো মিলিয়েছেন কাচের মিহিন গুঁড়ো। তখন জ্যাকসন এবং একই ঘরানার শিল্পীদের পরিচিতি – ‘অ্যাকশন পেইন্টার’।

দৈন্যদশার তারুণ্যে চারদিক থেকে প্রত্যাখ্যাত জ্যাকসন অনুভব করলেন, ছবি আঁকার জন্য স্টুডিও চাই। কজন বন্ধু মিলে একটি মুরগির খামারের একাংশ দখল করে ধ্র“পদী চিত্রের বেশ কিছু পোস্টকার্ড দেয়ালে সেঁটে তৈরি করলেন নিজস্ব স্টুডিও, কিন্তু ধরে রাখতে পারলেন না। তারপর বিদ্যুৎ সংযোগহীন একটি গোলাঘরকে স্টুডিওর জন্য বেছে নিলেন। তাঁকে প্রতিদিনই অপেক্ষা করতে হতো কখন দিনের আলো ফুটবে।

অসনাতন জ্যাকসন পোলক বললেন, ‘আমার ছবি ইজেল থেকে ওঠে আসে না। আমার দুমড়ানো-মুচড়ানো ক্যানভাস শক্ত মেঝে কিংবা দেয়ালে পুঁতে আমি কাজ করতে পছন্দ করি। আমি চাই শক্ত পৃষ্ঠদেশের প্রতিরোধ। মেঝেতেই আমি বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। আমি অনুভব করি, আমি তখন ছবির আরো কাছে, আমি ছবিরই অংশ। আমি ছবির চারপাশে ঘুরতে পারি, চারদিক থেকে আঁকতে পারি; আক্ষরিক অর্থেই আমি তখন ছবির ভেতরেই থাকি।’

‘আধুনিক চিত্রশিল্পী সময় ও পরিসরে কাজ করে বর্ণনার বদলে তার অনুভূতিই প্রকাশ করে থাকে।’

তিনি আরো বলেন : ‘আমি যখন ছবি আঁকি, আমি কী করছি সে সম্পর্কে অবহিত থাকি না। এটার সঙ্গে যখন এক ধরনের পরিচিতি প্রতিষ্ঠিত হয়, আমি বুঝতে পারি আমি কী চাইছি। ছবি বদলে যাওয়া, ইমেজ নষ্ট করা – এসব নিয়ে আমি আদৌ আতঙ্কিত নই, কারণ ছবির তো নিজেরই জীবন রয়েছে, আমি সেই জীবন্ত ছবিটাকে প্রতিভাত হতে দিই। কিন্তু যখন আমি নির্মীয়মাণ ছবির সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ফেলি তখন সবই উলটপালট হয়ে যায়। তা না ঘটলে ছবিতে একটা বিশুদ্ধ ঐকতান থাকে, খুব সহজ আদান-প্রদান ঘটে, আর চমৎকারভাবে ছবিটা ওঠে আসে।’

রং ঢালতে গিয়ে কি দুর্ঘটনা ঘটছে না? তাঁরই ভাষ্য : ‘ছবির কাজ করতে করতে যখন বুঝতে পারি আমি কী করতে যাচ্ছি, রং ঢালতে তখন আর দুর্ঘটনা ঘটে না, এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।’

পল হিবার্ট জ্যাকসন পোলকের জীবনের কিছু ঘটনা চিহ্নিত করেছেন : জার্মান-আমেরিকান চিত্রশিল্পী হ্যান্স হফম্যান জ্যাকসনের কাজে প্রকৃতির উদ্ভাসন দেখে তাঁকে তাঁর সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করার আমন্ত্রণ জানালেন। জ্যাকসন পোলক তাঁকে জানিয়ে দিলেন – ‘আমিই প্রকৃতি’।

তাঁর ‘ড্রিপ অ্যান্ড স্প­্যাশ’ ছবিতে চটে গিয়ে চিত্রসমালোচক লিখলেন তাঁর ছবির কোনো আগা-মাথা নেই – শুরু কোথায়, শেষ কোথায় কে জানে!

জ্যাকসন পোলক বললেন, চিত্রসমালোচক নিন্দার্থে এ-কথা বললেও সত্যি কথাটাই বলেছেন। তিনি আমার ছবির প্রশংসাই করেছেন। দর্শক ভেবে ছবির শুরু ও শেষ পরিবর্তিত হতে থাকবে। ছবিই জানে কোথায় তার শুরু, কোথায় শেষ। জ্যাকসন পোলক চিত্রশিল্পী হয়ে ওঠার আগে ভাস্কর হতে চেয়েছিলেন। তখন বাবাকে লিখলেন : আমার ইচ্ছেমতো হাতুড়ি চালিয়ে যতক্ষণ না পাথুরে পর্বতকে আমার মনের মতো করে গড়তে পারব, আমি অতৃপ্তই থেকে যাব।

জ্যাকসন ছবি আঁকার আগে ড্রইং কিংবা স্কেচ করা ছেড়ে দিয়েছিলেন। তখন সরাসরি রং মেশাতে শুরু করেন। অথচ ১৯৩০-এর দশকে জ্যাকসন তাঁর কয়েকটি নোট বই কেবল পিকাসোর গুয়ের্নিকা এঁকেই ভরে ফেলেছেন।

ভিন্নধারার শিল্পীকে তো ভিন্ন পথই ধরতে হয়েছে। ‘…আমি চিত্রশিল্পীর সচরাচর ব্যবহার্য হাতিয়ার ইজেল, প্যালেট, ব্রাশ এসব থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি। আমার পছন্দ কাঠি, রাজমিস্ত্রির কর্ণিক, ছুরি, চুইয়ে পড়া তরল রং, বালু, কাচের গুঁড়া…।

বিট প্রজন্মের শিল্পী জ্যাকসন পোলক আমেরিকার জন্য অনতিক্রম্য মেগাস্টারই হয়ে রইলেন।

চলচ্চিত্রের পোলক

২০০০ সালে স্টিভেন নাইফে ও জর্জ স্মিথের লেখা ‘জ্যাকসন পোলক : অ্যান আমেরিকান সাগা’ অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে অস্কারের মনোনয়ন পাওয়া জীবনভিত্তিক চলচ্চিত্র পোলক। এড হ্যারিসের পরিচালনায় জ্যাকসন পোলকের জীবনভিত্তিক এই চলচ্চিত্রে এড হ্যারিস নিজেই নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন।

১৯৪৯ সালে লাইফ ম্যাগাজিন জ্যাকসন পোলককে নিয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে একটি প্রশ্ন রাখা হয় – ‘জ্যাকসন পোলক কি আমেরিকার সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পী?’ শিল্পভুবন নতুন করে আলো ফেলে তাঁর ওপর। এরপর তাঁকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। প্রকারান্তরে লাইফ ম্যাগাজিন তাঁকে আমেরিকার সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পীর মর্যাদাই প্রদান করে। পোলক চলচ্চিত্রের শুরুতে দেখা যায়, ১৯৫০ সালের একটি প্রদর্শনীতে জ্যাকসন একজন ভদ্রমহিলাকে অটোগ্রাফ দিচ্ছেন – তারপর ফ্লাশব্যাক ১৯৪১; মদ্যপ জ্যাকসন তাঁর ভাই চার্লস পোলকের সঙ্গে নিউইয়র্কের একটি ছোট্ট, কম ভাড়ার অ্যাপার্টমেন্টে ভাগাভাগি করে থাকছেন। চার্লসের স্ত্রী সন্তানসম্ভবা হওয়ায় তাঁদের ইচ্ছে জ্যাকসন চলে যাক।

এ-সময় চিত্রশিল্পী লি ক্রাসনার জ্যাকসন সম্পর্কে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। চার্লসকে সেনাবাহিনীতে নেওয়া হয় কিন্তু মানসিক অসুস্থতার জন্য জ্যাকসন বাদ পড়ে যান। লি ক্রাসনার তাঁকে নিজের বাড়ি নিয়ে যান। তিনি কখনো মা হবেন না, ছবি আঁকা ছাড়বেন না – এ ধরনের অনেক শর্ত দিয়ে জ্যাকসন পোলককে বিয়ে করেন। জ্যাকসন ক্রমাগত তাঁর বিশ্বাস ভঙ্গ করতে থাকেন। তাঁর পানাসক্তি বেড়ে যায়। লি ক্রাসনার তাঁর কাছ থেকে দূরে সরে যান। রুথ ক্লিগম্যানের সঙ্গে জ্যাকসন সম্পর্কিত হয়ে পড়েন। তাঁর বয়স যখন চুয়াল্লিশ বছর, মাতাল অবস্থায় রুথ এবং রুথের বন্ধু এডিথ মেৎজারকে নিয়ে গাড়ি চালাবার সময় মারাত্মক দুর্ঘটনায় জ্যাকসন ও এডিথ ১১ আগস্ট ১৯৫৬ মৃত্যুবরণ করেন। ১২ আগস্ট ১৯৫৬ ফোন পেলেন লি ক্রাসনার – তাঁর স্বামী আর নেই। তিনি তখন প্যারিসে। ছবিটি শেষ হয়েছে লি ক্রাসনারকে নিয়ে – তিনি জ্যাকসন স্টুডিওতে কাজ করে যাচ্ছেন।

তাঁর মৃত্যুর পর লি আরো আটাশ বছর বেঁচে ছিলেন। মার্সিয়া হার্ডেন লি ক্রাসনারের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন।

জ্যাকসন পোলককে যাঁরা কাছে থেকে দেখেছেন তাঁরা মনে করেন শিল্পী এই চলচ্চিত্রে অনেকটাই উঠে এসেছেন।

এড হ্যারিস তাঁর বাবার কাছ থেকে পেয়েছিলেন জ্যাকসন পোলকের জীবনী এবং দশ বছর বিভিন্ন আঙ্গিকে কাজ করে ছবিটি নির্মাণ করেছেন। এড হ্যারিস জ্যাকসন পোলক হয়ে এই চলচ্চিত্রে নিজেই ড্রিপলিং পদ্ধতিতে রং ফেলে ছবি এঁকেছেন।

ইজেলের বদলে মেঝে, তুলির বদলে কাঠি

জ্যাকসন পোলকের তখনো বিশ্বখ্যাতি আসেনি। তাঁকে নিয়ে প্রবল বিতর্ক, শিল্পের নামে হঠকারিতা আর চলতে দেওয়া যায় না; জ্যাকসন পোলক বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলছেন, যখন চারদিকে এমন হুমকি – তিনি এর কিছুই আমলে নেননি। কথাও বলেননি, সাক্ষাৎকারও দেননি।

১৯৫০-এ তিনি মুখ খুললেন উইলিয়াম রাইটের কাছে, রেডিওর জন্য রেকর্ড করা একটি সাক্ষাৎকারে। সাক্ষাৎকারটি শেষ পর্যন্ত প্রচারিত হয়নি। তারই অংশবিশেষ –

উইলিয়াম রাইট : পোলক সাহেব, আপনার কাছে আধুনিক শিল্পকলার মানে কী?

জ্যাকসন পোলক : যে সময়ে আমরা বাস করি, আমার কাছে শিল্পকলা সে-সময়ের ব্যক্ত প্রত্যাশার চেয়ে বেশি কিছু নয়।

উইলিয়াম রাইট : ধ্র“পদী ধারার শিল্পীদের হাতেও কি তাঁদের সময়ের প্রত্যাশা প্রকাশ করার কোনো হাতিয়ার ছিল?

জ্যাকসন পোলক : হ্যাঁ, তাঁরা তাঁদের সময়কে ভালোভাবেই প্রকাশ করতে পেরেছেন। প্রত্যেক সংস্কৃতিরই তার আশু লক্ষ্যসমূহ প্রকাশের উপায় জানা আছে। কৌশল সব যুগের জন্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। যে ব্যাপারটা আমাকে আকৃষ্ট করছে তা হচ্ছে আজ শিল্পীকে বিষয়বস্তুর জন্য নিজের বাইরে আর যেতে হচ্ছে না। শিল্পীরা বিভিন্ন উৎস থেকে বিষয়বস্তু আহরণ করেন, তাঁরা নিজের ভেতর থেকে কাজ করেন।

উইলিয়াম রাইট : তাহলে আপনি কি বলবেন আধুনিক শিল্পীরা কাজের গুণাগুণকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছেন? এই গুণাগুণই ধ্র“পদ শিল্পকর্মকে মূল্যবান করে তুলত। এখন শিল্পী একে বিচ্ছিন্ন করে শুদ্ধতর প্রকরণে ব্যবহার করছেন।

জ্যাকসন পোলক : হ্যাঁ, ভালো কাজগুলোর বেলায় তো বটেই।

উইলিয়াম রাইট : পোলক সাহেব, আপনার পেইন্টিং পদ্ধতি নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে, বহু ধরনের মন্তব্য হয়েছে। আপনি কি এ সম্পর্কে কিছু বলতে চান?

জ্যাকসন পোলক : আমি মনে করি, নতুন চাহিদা মেটাতে নতুন টেকনিক দরকার হবে। আর আধুনিক শিল্পীরা তাঁদের পথ পেয়ে গেছেন, তাঁদের বক্তব্য প্রদানের উপায় তাঁদের জানা … প্রতিটি কাল তার নিজস্ব টেকনিক খুঁজে বের করে।

উইলিয়াম রাইট : তাহলে আপনি বলতে চাইছেন, সাধারণ মানুষ এবং সমালোচক সকলকেই নতুন টেকনিক ব্যাখ্যা করার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে।

জ্যাকসন পোলক : হ্যাঁ, তার মানে অনেকটা তা-ই। নতুন যুগের নতুন টেকনিকের নতুনত্ব কেটে যেতে হবে, আর আমি মনে করি আমরা আধুনিক শিল্পকলার গভীরতর অর্থ আবিষ্কার করব।

উইলিয়াম রাইট : তাহলে প্রতিবারই একজন সাধারণ মানুষকে শিল্পী জ্যাকসন পোলককে জিজ্ঞেস করতে হবে, কেমন করে তাঁর আঁকা ছবি বুঝতে পারবে? কিন্তু অন্য কোনো আধুনিক ছবি – তাহলে আধুনিক শিল্পকলা কেমন করে বুঝে উঠবে?

জ্যাকসন পোলক : আমার মনে হয়, তাদের দেখতে হবে নিষ্ক্রিয়ভাবে – ছবিটা তাদের কি দিতে যাচ্ছে তা-ই গ্রহণ করতে হবে, একটি বিষয়কে সামনে এনে নয়, অথবা ছবিতে তারা কি দেখতে চাইছে সেই পূর্বনির্ধারিত একটি ধারণা নিয়ে নয়।

উইলিয়াম রাইট : এটা বলা কি ঠিক হবে যে, শিল্পী অবচেতন অবস্থা থেকে আঁকছেন আর ক্যানভাসই ছবির দর্শকের অবচেতন হিসেবে ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে?

জ্যাকসন পোলক : আধুনিক চিত্রকলার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে অবচেতন। আমি মনে করি, অবচেতনের তাড়না পেইন্টিং দেখার প্রশ্নে বিশেষ ভূমিকা রেখে থাকে।

উইলিয়াম রাইট : তাহলে বিমূর্ত চিত্রকলায় কোনো জানা অর্থ কিংবা চেনা বস্তুকে খুঁজতে গেলে তা অনুধাবনের বদলে তাৎক্ষণিকভাবে বিচ্যুত হবারই কি কথা?

জ্যাকসন পোলক : যেভাবে মানুষ সংগীত উপভোগ করেন আমার কাজও সেভাবে উপভোগ করা উচিত … অন্তত সে সুযোগটা আমার কাজকে দেওয়া উচিত।

উইলিয়াম রাইট : আমার তো মনে হয়, সব ব্যাপারেই এমন একটা সুযোগ দেওয়া দরকার। ভালো সংগীত পছন্দ করার রুচি নিয়ে কেউ জন্মগ্রহণ করেন না। তাঁদের শুনতে হয় এবং আস্তে আস্তে তা বোঝার ক্ষমতা এবং ভালোবাসার রুচি তৈরি হয়। আধুনিক চিত্রকলা যদি একইভাবে কাজ করে তাহলে তো দীর্ঘ সময় ধরে একজনকে এই অনুশীলন করতে হবে, যাতে ঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারেন।

জ্যাকসন পোলক : হ্যাঁ, তাতে অবশ্যই কাজ হবে।

উইলিয়াম রাইট : ধ্র“পদ ধারার শিল্পীদের ক্ষেত্রে বিষয়ের গুরুত্ব অনেক; পৃথিবীর বিভিন্ন বিষয়ের প্রতিনিধিত্ব করেছে তাঁদের আঁকা ছবি। আর আধুনিক শিল্পী তাঁর ওপর এ বিষয়ের প্রভাবকে এঁকে তাঁর পৃথিবীকে প্রকাশ করেছেন।

জ্যাকসন পোলক : হ্যাঁ, আধুনিক চিত্রশিল্পী সময় ও পরিসর নিয়ে কাজ করছেন – তাঁর অনুভূতিকে অবলম্বন করে, বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে নয়।

উইলিয়াম রাইট : তাহলে পোলক সাহেব, আপনি বলুন, কেমন করে আধুনিক চিত্রকলা হয়ে উঠল?

জ্যাকসন পোলক : এটা দীর্ঘ ঐতিহ্যের একটি অংশ – সেজান থেকে কিউবিস্ট, পোস্ট কিউবিস্ট এভাবেই যেমন করে আঁকা হচ্ছে আজকের ছবি।

উইলিয়াম রাইট : তাহলে এটা অবশ্যই অভিব্যক্তির একটি ফসল?

জ্যাকসন পোলক : হ্যাঁ।

উইলিয়াম রাইট : আমরা কি অনুসৃত পদ্ধতির প্রশ্নটি উত্থাপন করতে পারি – অনেকের কাছে এটা এখন গুরুত্বপূর্ণ। আপনার ছবি আঁকার পদ্ধতি কেমন করে গড়ে উঠল এবং কেন এভাবে আঁকছেন বলবেন কি?

জ্যাকসন পোলক : পদ্ধতি হচ্ছে প্রয়োজনের তাগিদে স্বাভাবিকভাবে গড়ে ওঠা একটি বিষয় – আধুনিক শিল্পীকে নিয়ে যে পৃথিবী তা প্রকাশের প্রয়োজন তাঁরই খুঁজে পাওয়া একটি পথ … আমি মেঝের ওপর (ক্যানভাস বিছিয়ে) ছবি আঁকি, এটাকে অস্বাভাবিক মনে করার কারণ নেই – প্রাচ্যদেশীয় শিল্পীদের কেউ কেউ তা করতেন।

উইলিয়াম রাইট : আপনি যে রং ব্যবহার করছেন তা ক্যানভাসের ওপর কেমন করে কাজ করছে? আমি জানি আপনি তুলি বা এ ধরনের কিছু ব্যবহার করেন না, তাই তো?

জ্যাকসন পোলক : আমার ব্যবহৃত রঙের প্রায় সবটাই তরল ও বহমান ধরনের। আর তুলি হিসেবে আমি যা ব্যবহার করি তা তুলি হিসেবে নয় বরং কাঠি হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তুলি তো ক্যানভাসের গা স্পর্শ করে না, কেবল ওপর দিয়ে বয়ে যায়।

উইলিয়াম রাইট : ক্যানভাসে তুলির বদলে কাঠি আর তরল রং ব্যবহারের সুবিধের দিকটা কি বলবেন?

জ্যাকসন পোলক : বেশি পরিমাণ স্বাধীনতা পাওয়া, ক্যানভাসে ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়ানো আর অধিকতর স্বস্তির সঙ্গে কাজ করা।

উইলিয়াম রাইট : তুলিকে নিয়ন্ত্রণ করা যতটা সহজ এটা কি তার চেয়ে কঠিন নয়? মানে আমি বলতে চাইছি, বেশি পরিমাণ রং ঢেলে দেওয়ার, রংটা ছড়িয়ে পড়ার এ ধরনের আরো কিছু ঘটার সম্ভাবনা কি বেশি নয়? তুলি ব্যবহার করলে ক্যানভাসে যেখানটাতে যতটুকু রং দরকার লাগাতে পারছেন এবং আপনি জানতেও পারছেন এটা কেমন দেখাবে।

জ্যাকসন পোলক : আমি তা মনে করি না … অভিজ্ঞতার সঙ্গে রঙের প্রবাহ অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব – দুর্ঘটনাক্রমে কী ঘটল, আমি তা ব্যবহার করি না।

উইলিয়াম রাইট : ফ্রয়েড বলেছেন, দুর্ঘটনা বলে কিছু নেই। আপনিও কি তাই মনে করেন?

জ্যাকসন পোলক : আমার ধারণা, আমিও তা-ই মনে করি।

ইউলিয়াম রাইট : তাহলে ক্যানভাসটা কেমন হবে তার কোনো পূর্বকল্পিত চিত্রকল্প আপনার মনে আসে না?

জ্যাকসন পোলক : … একটা সাধারণ ধারণা থাকে – আমি কী করতে যাচ্ছি আর ফলাফলটা কী হবে।

উইলিয়াম রাইট : তাতে প্রাথমিক স্কেচের ব্যাপারটা একেবারেই থাকছে না?

জ্যাকসন পোলক : হ্যাঁ, যেভাবে কেউ ড্রইং করছে, আমিও সেভাবেই পেইন্টিংয়ে চলে যাচ্ছি – এটা একেবারে সরাসরি। আমি ড্রইং ধরে কাজ করি না। আমি স্কেচ আর ড্রইং করি না, স্কেচে রং বসিয়ে পেইন্টিং চূড়ান্ত করি না। আমি মনে করি, পেইন্টিং আজকাল আরো কাছের, আরো সরাসরি; সরাসরি বক্তব্য উপস্থাপনের সম্ভাবনা এতেই বেশি।

উইলিয়াম রাইট : তার মানে, আপনার প্রতিটি ছবি, সমাপ্ত প্রতিটি ক্যানভাস সম্পূর্ণ মৌলিক।

জ্যাকসন পোলক : হ্যাঁ, সবই সরাসরি তৈরি করা।

উইলিয়াম রাইট : পোলক সাহেব, এবার সার্বিকভাবে আধুনিক পেইন্টিং নিয়ে বলুন। আপনার সমকালীনদের ব্যাপারে কী মনে করছেন?

জ্যাকসন পোলক : একালের ছবি অনেক জীবন্ত, প্রাণোচ্ছল এবং উদ্দীপনাময় – যেদিকে পেইন্টিং এগোচ্ছে – ইজেল থেকে সরে আসছে – অনেকটা দেয়ালে আঁকা ছবির মতো হয়ে উঠছে।

উইলিয়াম রাইট : আপনার অনেক ছবির ক্যানভাস অস্বাভাবিক আকৃতির, তাই নয়?

জ্যাকসন পোলক : আকারটা ব্যবহারিক ধরনের নয় – ৯ x ১৮ ফুট। কিন্তু আমি বড় ক্যানভাসে কাজ করতে পছন্দ করি – ব্যবহারিক ধরনের হোক বা না হোক যখনই সুযোগ পাই আমি এ ধরনের ক্যানভাসে কাজ করি।

উইলিয়াম রাইট : ছোট ক্যানভাসের চেয়ে বড়টা কেন বেশি উপভোগ করেন বলবেন কি?

জ্যাকসন পোলক : ঠিক তা নয় – ২ x ২ ফুট মাপের চেয়ে বড় আকারের ক্যানভাসে আমার স্বস্তি বেশি। বড় জায়গাটাই আমার পছন্দের।

উইলিয়াম রাইট : আপনি বললেন, ‘বড় জায়গা’! আপনি কি ক্যানভাসের ওপর বসে ছবি আঁকেন?

জ্যাকসন পোলক : খুব কমই তা করি। কখনো কখনো ক্যানভাসের ভেতরে থেকে কাজ করতে হয়।

উইলিয়াম রাইট : (আপনার স্টুডিওর) কোণে নতুন একটা কিছু দেখতে পাচ্ছি, গ্লাসের ওপর কাজ করেছেন। এ সম্পর্কে কিছু বলুন।

জ্যাকসন পোলক : আমার জন্যও নতুন। এই প্রথমবারের মতো গ্লাসের ওপর ছবি আঁকলাম। এটা বেশ মজার। আধুনিক স্থাপত্য, আধুনিক নির্মাণে কাচের ওপর কাজ করার বেশ সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি।

উইলিয়াম রাইট : গ্লাসের ওপর যা এঁকেছেন, আঁকার পদ্ধতিটি কি আপনার স্বাভাবিক পদ্ধতি থেকে ভিন্ন?

জ্যাকসন পোলক : সাধারণভাবে বলতে গেলে – একই।

উইলিয়াম রাইট : বেশ তো, আধুনিক ভবনের জন্য যদি আপনাকে এ ধরনের অনেক কাজ করতে হয় আপনি কি বিভিন্ন ধরনের কৌশল ব্যবহার করে যাবেন?

জ্যাকসন পোলক : হ্যাঁ, সম্ভাবনা তো সীমাহীন।

উইলিয়াম রাইট : আপনার ছবি আঁকার পদ্ধতি, আপনার কৌশল আপনি কি সৃষ্টি করেছেন সে কারণেই গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষণীয়।

জ্যাকসন পোলক : আমারও তাই মনে হয়। স্বাভাবিকভাবে ফলাফলটাই হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ। যতক্ষণ ছবিটা একটা কিছু প্রকাশ করছে কীভাবে তা আঁকা হলো এতে তেমন হেরফের হবার কথা নয়। কৌশল হচ্ছে বক্তব্য প্রকাশের একটি উপায়।

জ্যাকসন পোলকের আঁকা উল্লেখযোগ্য ছবি

১৯৪২ : নর ও নারী, চাঁদরমণী, স্টেনোগ্রাফিক ফিগার

১৯৪৩ : প্যাসিফে, নীল (মবিডিক), গোপনের অভিভাবকবৃন্দ, নারী-নেকড়ে

১৯৪৬ : উষ্ণতার চোখ, চাবি, ঝিকিমিকি করা বস্তু, চায়ের কাপ

১৯৪৬ : ক্যাথিড্রাল (বিস্তারিত বিবরণ), পূর্ণ অতল পঞ্চম

১৯৪৮ : নম্বর ১, নম্বর ১এ, নম্বর ৫, নম্বর ২৬এ : কালো ও সাদা

১৯৪৯ : নম্বর ১, নম্বর ৮

১৯৫০ : নম্বর ১ : ল্যাভেন্ডার মিস্ট, নম্বর ৩০ : শারদীয় ছন্দ, এক : নম্বর ৩১, নম্বর ৩২

১৯৫২ : নম্বর ১০ : সমকেন্দ্রাভিমুখ, নম্বর ১১ : ব্লু পোলস

১৯৫৩ : গভীর, ইস্টার ও টোটেম।

Leave a Reply