logo

জাতীয় স্মৃতিসৌধের স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন

ব দ রু ল  হা য় দা র

আজ ১০ নভেম্বর। সকাল থেকেই ব্যস্ত ছিলাম। ৮:৩০ মিনিটে লেকের ধারে হেঁটে হেঁটে অফিসে গেলাম। সাইট ঘুরে। ২টায় ফের অফিসে… বন্ধু সুফী ফোন করল… সাধারণত গপ্পো মারতে, বলল, অত হাসিস না, খবরটা শুনে থমকে যাবি।… মাইনুল চলে গেছে … ২:৫৫-তে।

ধাক্কাটা বোধ হয় কোনো প্রচন্ড সাইক্লোনের সঙ্গেই তুলনা চলে। হাতে ফোন ধরা, আমি… মনে হচ্ছে গাঢ় কৃষ্ণকায় কোনো তরলে তলিয়ে যাচ্ছি।

আমি ওর পূর্বাপর অবস্থা সম্বন্ধে একদমই জানতাম না… গতকাল ওর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, আমাকে কেউ জানায়নি।

অফিস থেকে বের হলাম … ওর ডেড বডি National Heart Institute-এ… কোনো রিকশা বা বেবি নেই, জোরে হাঁটছি… ধাক্কা খাচ্ছি, কেউ বোধ হয় গালিও দিলো। দ্রুত রিকশায় পৌঁছলাম… চোখ ঝাপসা… চোখে মনে হয় কোনো সমস্যা হয়েছে। হাসপাতালের সিঁড়িতে হোঁচট খেয়ে নিজেকে সামলে নিলাম। তালা খুলে মর্গে ঢুকলাম… চাদরে ঢাকা, ও কে? মাইনুল তো কোনোদিন এতটা চুপচাপ ছিল না… খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ওর কথা শুনতে বাধ্য করত। চাদর সরালাম, চোখ বন্ধ, মুখ হাঁ করা, কপালে হাত দিলাম, কই এখনো তো ঠান্ডা হয়ে যায়নি। নিজেকে কত সামলাব… পুরো শরীর কাঁপিয়ে কানণা… আমি কেন পারছি না, কেন পারছি না নিজেকে সামলাতে… এখনো লিখতে বসে আমার চীৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে… চোখ কিছুতেই শাসন মানছে না।

আসার পথে ফোনে রবিউল ভাই ও NTV-র জহিরুল আলমকে খবরটা দিয়েছিলাম। এমনিতেই খবরটা ততক্ষণে ছড়িয়ে গিয়েছিল সারা দেশে। মর্গ থেকে বের হতেই দেখি ক্যামেরা/মাইকের ঝাঁক।

আমাকে, কে আমি, আমি তো কেউ না!

ওর ছোট মেয়ে গড়াগড়ি যাচ্ছে, রানা ভাই ও অন্যান্য আত্মীয়রাও সেখানে, তাদের সঙ্গে কথা বলুন।

না না, আপনি তো কাছের বন্ধু… কিছু বলুন।

বললাম … কান্নার জলের ফোঁটা দিতে পারি, অন্য কিছু নয়।

সুফী, শফিক এলো… ঝাঁকে ঝাঁকে ক্যামেরা আমাদের দিকে… কিছু বলুন। আমরা ভিড় ঠেলে বাইরে চলে এলাম।

শুধু বলতে ইচ্ছা করেছিল, এতদিন কোথায় ছিলেন আপনারা? প্রচন্ড অবহেলায় মাইনুল চলে গেল। সে যা দিয়ে গেল, হাজার বছরেও তা দাঁড়িয়ে থাকবে বাংলাদেশের বুকে। এতদিন কেন কোনো খবর রাখেননি?

বাসায় ফিরলাম, ঘুম আসছে না। আমি কেবলই ফিরে যাচ্ছি আমাদের ছাত্রজীবনে স্থাপত্য বিভাগে, সোহরাওয়ার্দী হলের ৪০৬ নং রুমের সেই বিচিত্র দিনগুলোতে। আমরা তিন বন্ধু আলমগীর, মাইনুল ও আমি একসঙ্গে ৪০৬ নং রুমে উঠলাম, কয়েক মাস পরে মুমিনও এলো। চারজনের মধ্যে মাইনুল শুধু প্রজেক্ট জমা ও পরীক্ষার সময় হলে থাকবে, বাকি সময় মাঝে মাঝে আসবে। তাই ওর চৌকিটা রুমের ছয় ফুট উঁচু দুটো আলমারির ওপরে বসানো ছিল। যখন এসে থাকত তখন সানন্দেই ছয় ফুট ওপরে চৌকিতে ঘুমাত। থিয়োরি পরীক্ষার সময় আমরা সবাই একসঙ্গে পরীক্ষার প্রস্ত্ততি নিতাম। মাইনুল ছয় ফুট উঁচুতে শুয়ে চোখ বুজে শুনত। এভাবে শুনে শুনেই পরীক্ষা দিত। কতটা মেধাবী হলে শুনে শুনেই পরীক্ষা দিয়ে স্থাপত্যে প্রথম শ্রেণি পাওয়া যায়। ক্লাসে ডিজাইন প্রজেক্টে ভালো ছিল, তবে আহামরি গোছের কিছু নয়। নতুন নতুন অদ্ভুত চিন্তা ছিল তার মধ্যে। তাতে প্রশংসাও মিলত, আবার উল্টোটাও।

মুক্তিযুদ্ধকালে আমাদের বন্ধু হাবিবের উর্দু রোডের বাড়িটা ছিল আমাদের ডেরা। সেখানে থেকেই নানা কর্মকান্ড হতো। পি. কে. নামের এক্সপ্লোসিভের মধ্যে ডেটোনেটর লাগিয়ে বোমা তৈরি হতো। মাইনুল ঠিক করল রাইফেলের সাইলেন্সার বানাবে। বিভিন্ন বইপত্র ঘেঁটে ওয়ার্কশপে দৌড়াদৌড়ি করে ওকে শেষমেশ রণে ভঙ্গ দিতে হয়েছিল।

লোকজনের সঙ্গে কম কথা বলত। ভাবখানা, সে কম কথার মানুষ। আমরা, ওর কাছের বন্ধুরা জানি সে আসলে কী। কথার যন্ত্রণায় আমাদের অতিষ্ঠ করে তুলত যতক্ষণ একসঙ্গে থাকতাম। একসঙ্গে যখন পড়তাম পরীক্ষার আগে, হঠাৎ হঠাৎ-ই একদম অন্য প্রসঙ্গে চলে যেত, যেমন –

‘জাপান কেন বাংলাদেশকে লোন দেয়?’

একটা সময় আমরা যখন প্রেমট্রেম নিয়ে ব্যস্ত, মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতেই বর্তে যাই, তখনো ওকে প্রেম করা বা মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশার কোনো চেষ্টাই করতে দেখা যায়নি। মাইনুল ব্যস্ত থাকত বিভিন্ন অদ্ভুত অদ্ভুত বিষয় নিয়ে, চোখ বুজে গান শুনতে ভালোবাসত, কোনোদিন ওর মুখে কোনো গানের কলি আওড়াতে শুনিনি।

১৯৭৬-এ আমরা পাশ করে বের হলাম। দেশে তখন মোট শ’খানেকের কম স্থপতি বুয়েট থেকে বেরিয়েছে। স্থপতি বা আর্কিটেক্ট বললে কেউ চেনে না। বলতে হয় আর্কিটেক্ট-ইঞ্জিনিয়ার, তাহলেই কিছুটা মূল্যায়ন হয়। বাড়িঘর, দালানকোঠা সিভিল ইঞ্জিনিয়াররাই ডিজাইন করে। ওরা বলল, ‘এরা আবার কারা!’ প্রায় সব কনসাল্টিং ফার্মের মালিকও ইঞ্জিনিয়ার, আমাদের চাকরি নেই। আমি বাংলাদেশ কনসালট্যান্ট লি.-এ ঢুকলাম, আমাদের শিক্ষক স্থপতি মোস্তফা কামালের হাত ধরে। মাইনুল ইয়াহ কনসালট্যান্টে মাসতিনেক থেকে বাংলাদেশ কনসালট্যান্টে যোগ দিলো, মুনিমও এলো। বিশাল নতুন প্রজেক্ট, জাতীয় জাদুঘর। কামাল ভাই মূল ডিজাইনটা করলেন, সঙ্গে সংগতে ছিলাম মাইনুল, মুনিম ও আমি। আরও বেশ কিছু কাজ করলাম আমরা একসঙ্গে। ফকিরাপুলের আমার বাসা হয়ে উঠল অফিসের পর আড্ডাখানা – কেউ সংসার পাতেনি তখনো। ব্যাচের প্রায় সবাই আসত, মাঝে মাঝে রাত কাটিয়ে পরদিন আমরা ফের অফিসে। আমরা সবাই তখন মোটরসাইকেলের গর্বিত মালিক। সপ্তাহের ছুটির দিন এলেই মাইনুলের ছাই রং HONDA 50 C.C.সহ সবাই  মোটরসাইকেলে মিছিল করে বের হয়ে যেতাম – কাঁচপুর, সাভার, নারায়ণগঞ্জ বা জয়দেবপুর – বেশ মজাতেই কাটত সে দিনগুলো।

 

অফিসে আমার টেবিলের পেছনে মাইনুলের টেবিল। মাঝে মাঝেই পেছনে থেকে আওয়াজ –

‘এই শুনছিস?’

তারপর আমার উত্তরের তোয়াক্কা না করে কোনো অদ্ভুত এক প্রসঙ্গের অবতারণা। তেতো কুইনাইন খাওয়ার মতো ওর কথা শুনতে হতো। ওর ডাকে সাড়া না দিলে বা কথা না শুনলে কোনো কোনো সময় তাবিজ আকৃতির কাগজের টুকরা পেছন থেকে আমার টেবিলে এসে পড়ত। অসংখ্য ভাঁজ খুলে যা দেখতাম, ইরান বা আফগানিস্তান, অ্যাটম বোমা, তেলের দাম, আমেরিকার অস্ত্র ব্যবসা ইত্যাদি। সবচেয়ে আশ্চর্য, কী মনে করে প্রতিটি লেখার নিচে নাম সাইন ও তারিখ লিখতে কখনোই ভুল করত না। এখনো আমার কাছে গোটা দশেক তাবিজ সংরক্ষিত আছে। একটায় লেখা আছে, Oliver Twist গল্পটা ছোট বেলায় comic-এ ‘‘দেখেছিলাম’’। গল্পের শেষের দিকটা আমি দিবা স্বপ্ন দেখতাম – ‘‘সুন্দর বাড়ী’’ Mainul 1981. যা সে কোনোদিনই পায়নি।

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে রাশিয়া সফরের সময় প্রায় শহরেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহতের অনেক স্মৃতিসৌধ দেখে এবং ভোলগাগ্রাদে ‘মাদার মাদারল্যান্ড কমপ্লেক্স’ দেখে অভিভূত হন। দেশে ফিরে তিনি বললেন, আমাদের শহীদদের জন্যও কবর এবং স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করতে হবে। তার ফলশ্রুতিতেই স্মৃতিসৌধ। স্থান নির্ধারিত হলো সাভারে। প্রাথমিকভাবে ২৪ একর জমি নিয়ে মাস্টারপ্ল্যান হলো। নাম দেওয়া হলো, ‘অজ্ঞাতনামা শহীদদের স্মৃতিসৌধ’। স্মৃতিসৌধের পুরো কমপেলক্সটার ডিজাইন পিডব্লিউডির স্থাপত্য অধিদপ্তরের স্থপতি আব্দুর রশিদের তত্ত্বাবধানে করা। সঙ্গে ছিলেন স্থপতি অপরেশ দাশ, মনসুর আহমেদ ও অন্য বেশ কয়েকজন স্থপতি। সৌধের জন্য নির্ধারিত স্থানটি পুরো কমপ্লেক্সের শেষ প্রান্তে। শুধু সামনে থেকেই কাছে যাওয়া যাবে, চারদিকে ঘুরে দেখবার অবকাশ নেই। সৌধটির ডিজাইনও পিডব্লিউডির করার কথা। কিন্তু স্থপতি মাজহারুল ইসলাম ও অন্যদের চেষ্টায় সেটা প্রতিযোগিতায় আসে।

বঙ্গবন্ধু সেখানে দু-তিনবার শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু নিহত হলেন। অজ্ঞাতনামা শহীদদের স্মৃতিসৌধ প্রকল্পটি ১৯৭৫ থেকে ’৭৮ সাল পর্যন্ত ফাইলবন্দি হয়ে অবহেলায় পড়ে রইল।

এর মধ্যে ১৯৭৯ সালে শুনলাম স্মৃতিসৌধের স্থাপত্য ডিজাইন প্রতিযোগিতা হবে। মাইনুল জমা দিলো ডিজাইন। তিন কোনা ১৫০ ফুট উঁচু পিলার, উপরটা আড়াআড়িভাবে কাটা, বাঁশের মতো। আহামরি কিছুই না। আমরা সেবার কেউ জমা দেইনি বা দিতে পারিনি। কিছুদিন পর মানসম্মত না হওয়াতে সব নকশা বাতিল করে নতুন প্রতিযোগিতার আহবান করা হয়। এবার আমরা সবাই অংশগ্রহণের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়লাম।

 

অফিসের পর আমার ফকিরাপুলের বাসায় আড্ডা তখন পরিণত হলো ডিজাইন সেন্টারে। সবাই লুকিয়ে লুকিয়ে চিন্তা, অাঁকিবুকি করে যাচ্ছি। জমা দেওয়ার দিন ঘনিয়ে এলো। সবার সারা রাত জেগে কাজ করার খাটুনি শেষ হচ্ছে না। যে যার বাসায় ফাইনাল ড্রইং করে মডেলের জন্য আমার বাসায় এলো। প্রত্যেকের মডেলের বেজ তো স্থাপত্য অধিদপ্তরের নকশায় করা হয়েছিল অনেক আগেই। জমা দেওয়ার দিন সকালে মাইনুল কাগজের ঠোঙায় করে কতগুলো টুকরা বোর্ড নিয়ে এলো। ঠোঙা থেকে একটা একটা করে বোর্ডের টুকরা জায়গায় বসাল। আমাদের কাজ বন্ধ হয়ে গেল, স্তব্ধ সবাই, একি দেখাল মাইনুল। আমি বললাম, আমারটা জমা দেবার কোনো মানে হয় না। কে যেন বলল – আরে, পুরস্কার তো তিনটা।

মাইনুলের ডিজাইনটা সম্পর্কে একটু বলি। আমরা সবাই স্থাপত্যে পড়াশোনার সময় প্রথম/দ্বিতীয় বর্ষে ‘হাইপারবোলিক প্যারাবোলয়েড’ সম্পর্কে জানি। খুব সহজ জিনিস। একটা কোণের অসম দুই বাহুকে সমানসংখ্যক ভাগ করে এক বাহুর দূরের ভাগগুলোর সঙ্গে অন্য বাহুর কাছের ভাগগুলো যোগ করলে সরলরেখাগুলো একটি বক্র অবস্থার সৃষ্টি করে। অত্যন্ত মজার ব্যাপার।

মাইনুলের ডিজাইনকৃত স্মৃতিসৌধের সামনে থেকে তাকালে মনে হবে, ওই রকম দুটো হাইপারবোলিক প্যারাবোলয়েড সংযুক্তি। খুব সহজেই বলে দিলাম।

কিন্তু সেটা দ্বিমাত্রিক (two dimension) কাগজের ড্রইং থেকে ত্রিমাত্রিকে (three dimension) রূপ দেওয়াটাই মাইনুলের অপূর্ব সৃষ্টি। পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য কিছু সৌধের মধ্যে এটা অন্যতম – আমার বিশ্বাস।

যাহোক, মাইনুল আর আমি মডেল ও ড্রইং নিয়ে রিকশায় করে স্থাপত্য অধিদপ্তরে গেলাম। মাইনুলের ডিজাইন দেখে হইচই পড়ে গেল – সবাই বলতে লাগল, এটা নির্বাচিত না হয়ে যায় না। জুরিদের বিচারের আগেই সবার বিচারে মাইনুল জয়ী। যথাসময়ে প্রতিযোগিতার ফল ঘোষণা করা হলো। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় সবাই আমাদের ব্যাচের রবিউল ভাই ছাড়া।

মাইনুল প্রথম

মোস্তফা দ্বিতীয়

রবিউল ভাই ও ইয়াসমীন-ইমামউদ্দিন তৃতীয় যৌথভাবে।

আমাদের পায় কে! এমনিতেই আমাদের গর্ব, আমরাই বুয়েটের একমাত্র ব্যাচ যারা সবাই প্রথম শ্রেণি পেয়েছি।

এবার সেই গর্ব আরো তুঙ্গে উঠল। কিন্ত ফলাফল ঘোষণাই শেষ, বাস্তবে তার প্রতিফলন হলো না বহুদিন। মাইনুল আস্তে আস্তে নিজেকে গুটিয়ে ফেলছিল। ওর মনে নানা রকম ভয় ঢুকতে শুরু করল। এমনিতেই সে কিছুটা সন্দেহপ্রবণ ছিল। যখন দেখল সৌধ নির্মাণের কোনো প্রক্রিয়াই নেই, তার মনে হতে লাগল, এর পেছনে বাংলাদেশের বিপক্ষের শত্রুরা কাজ করছে।

ইতোমধ্যে সে বিয়ে করল, পারিবারিকভাবে। দুঃখের বিষয়, বউয়ের সঙ্গেও বনিবনা হলো না। অনেক কথাই আমাদের বলত জীবন সম্পর্কে, সংসার সম্পর্কে, তখনকার দিনগুলো সম্পর্কে। আমাদের শুনতে হতো – বলার হয়তো কিছুই ছিল না।

১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলো। ১৯৭৬-এ আমরা পাশ করে বের হলাম। জেনারেল জিয়া ক্ষমতায়। স্মৃতিসৌধ ফাইলবন্দি। আমরা তখন শহীদুল্লাহ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসে – আমাদের দিনগুলো চলে যাচ্ছিল কোনো রকমে। ১৯৮১ সালে জেনারেল জিয়া নিহত হলেন। জেনারেল এরশাদ ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে। ১৯৮২ সালে হঠাৎ করেই ঠিক হলো, ১৬ ডিসেম্বর এরশাদ স্মৃতিসৌধের উদ্বোধন করবেন। মাইনুলকে ত্বরিত যোগাযোগ করা হলো, কাজ শুরুর জন্য।

ঠিক হলো যেহেতু মাইনুলের নির্মাণকাজের অভিজ্ঞতা কম, সেজন্য শহীদুল্লাহ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের সহযোগিতায় ডিটেইল ডিজাইন দাঁড় করানো হবে। মাইনুল সর্বমোট দুই লক্ষ টাকা ফি পেয়েছিল। শহীদুল্লাহ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস নিয়েছিল পঞ্চাশ হাজার টাকা, যা নিজে থেকেই ও দিয়েছিল। ড্রইং সব মাইনুলই করত – মাঝে মাঝে স্থপতি রবিউল হুসাইন ও আমি ওর সঙ্গে সহযোগিতা করতাম, বিভিন্ন প্রসঙ্গে আমাদের মতামত দিতাম।

প্রাথমিক অবস্থায় মাইনুলের ডিজাইনে আটটি ডানা ছিল। ওর মাথায় তখন সৌধকে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একাত্মকরণের চিন্তা। এর মধ্যে পিডব্লিউডির ইঞ্জিনিয়াররা ডানাগুলোর যে পুরুত্বের কথা বললেন তাতে জায়গার সংকুলান হচ্ছিল না। মাইনুলের মাথায় তখন নানা চিন্তা।

 

৫২ থেকে ৭১ – আন্দোলন ৭ –                    ৭

৭ মার্চ                                                      ৭

২৫ মার্চ                    ২+৫ =                      ৭

১৬ ডিসেম্বর            ১+৬ =                     ৭

৭ বীরশ্রেষ্ঠ                                               ৭

 

ধন্য মাইনুল! মিলালি কীভাবে! মাইনুল ৭টি ডানায় স্মৃতিসৌধকে দাঁড় করাল। কনকর্ডকে নির্মাণকাজ দেওয়া হলো, সময় মাত্র ৯০ দিন। দ্রুতগতিতে কাজ এগিয়ে চলল। মাইনুল আর আমি প্রায়ই চলে যেতাম সাভারে। রাতদিন কাজ চলছে। তদারকির ভার পিডব্লিউডির ওপর।

মাইনুলকে কেউ চিনেই না। ৯৫ দিনে নির্মাণকাজ শেষ হলো। এলো ১৬ ডিসেম্বর, জেনারেল এরশাদ জাতীয় স্মৃতিসৌধ উদ্বোধন করবেন। সাজ সাজ রব চারদিকে, কিন্তু মাইনুলের কোনো খবর কেউ রাখেনি, সাধারণ নিমন্ত্রণ পর্যন্ত পায়নি। সে আর আমরা কয়েকজন জনতার ভিড়ে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখলাম। অনুষ্ঠান শেষ হলে ভেতরে গেলাম। মাইনুলের সাফল্যের হাসিমাখা চেহারা ভুলবার নয়।

এমনিতেই অন্তর্মুখী, বিশেষ কয়েকজন ছাড়া কারো সঙ্গে কথা বলার বা মেশার কোনো চেষ্টা ওর ছিল না। হঠাৎ করে জাতীয় পর্যায়ে ওর ডিজাইনের স্বীকৃতি, সঙ্গে সীমাহীন অবহেলায়, সে আস্তে আস্তে নিজেকে গুটিয়ে ফেলল। ইতোমধ্যে সংসার ভেঙে গেল – দুই মেয়েসহ স্ত্রী তাকে ত্যাগ করল। মাইনুল নিজেকে আরো গুটিয়ে ফেলল। মনে পড়ে, আমরা একবার সুন্দরবন গেলাম মাইনুল ও তার স্ত্রীসহ, বড় মেয়ে বিদিতা তখন একদম ছোট। মাইনুলের উচ্ছল প্রাণবন্ত রূপ আবার নতুন করে দেখেছিলাম তখন।

’৮৬-তে আমি চাকরি ছেড়ে স্বতন্ত্রভাবে কাজ শুরু করলাম। ১৯৭৬ সালে পাস করার পরপরই আমরা একটি কনসাল্টিং ফার্ম করেছিলাম –  মাইনুল, দুলু, মুনিম ও আমি মিলে। দুলু ও মুনিম বিদেশে চলে গেলে এবং আমি শহীদুল্লাহ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস ছেড়ে দেবার পর ’৮৭ সালে মাইনুলও এসে আমার সঙ্গে যোগ দিলো। অফিস সেই ফকিরাপুলে –   আমার বাসা। মানসিক অশান্তি, কাজকর্মে অনীহা, স্মৃতিসেŠধের কারণে বাংলাদেশের বিরুদ্ধবাদী দেশ থেকে অজানা ভয়ভীতি ওকে আস্তে আস্তে গ্রাস করে ফেলতে লাগল।

এরই মধ্যে ১৯৮৮ সালে মাইনুলকে একুশে পদক দেওয়া হলো। কথা বলে তখন মনে হতো, পদকের কারণে ওর ভয়টা যেন ক্রমাগত বেড়েই চলছে। সে নির্জনবাসে চলে গেল। ওর নানা কবি গোলাম মোস্তফার শান্তিনগরের জনমানবহীন বিধ্বস্ত বাড়ির অন্ধকার একটি খুপরিতে সে তখন থাকে। অসুস্থ, বাইরের জগতের সঙ্গে সম্পর্কচ্যুত জীবন, –  কথায় আরো অসংলগ্নতা। আমরা বন্ধুরা কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমি মাঝে মাঝে গিয়ে ওর সঙ্গে গল্প করে আসতাম।

এর মধ্যে প্রথম আলোর মসিউল আলম আমার কাছে এলেন। মাইনুল কারো সঙ্গে কথা বলে না। মাঝে মধ্যে সেই বাড়ির গেট থেকে আমাকেও ফেরত আসতে হতো – সে গ্রিলের দরজা খুলত না। অনেক বুঝিয়ে ওকে রাজি করানো হলো, দেশ ওর সম্বন্ধে জানতে চায়। রাজি হলো। মসিউল আলম ওর ইন্টারভিউ নিলেন। প্রথম আলোর প্রথম পাতায় ফিচারটা এলো। স্থপতি সমাজ, দেশের ও বাইরের অগণিত মানুষ প্রথম আলোর সঙ্গে যোগাযোগ করল। বিদেশে অবস্থানরত কিছু স্থপতি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। প্রস্তাব দিলেন, সমস্ত খরচ তাদের, মাইনুলের সঠিক চিকিৎসা করে সসম্মানে ওকে দেশে ফেরত পাঠাবেন। শুধু পরিবারের সম্মতি লাগবে। যাহোক, ওর বিদেশ যাওয়া হয়নি। ঢাকাতেই ড. মোহিত কামালের তত্ত্বাবধানে বনানীর একটি ক্লিনিকে ওর চিকিৎসা চলল বহুদিন। ডাক্তার ও ক্লিনিক মাইনুলের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে কোনো খরচ নিলেন না। তারা অনেক করেছিলেন। তাদেরকে কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমাদের ছিল না।

তারপর মাইনুল মোটামুটি ভালো। উঠল শান্তিনগর ইস্টার্ন হাউজিং অ্যাপার্টমেন্টে, থাকত মা ও ভাইয়ের সঙ্গে। স্থপতি রবিউল হুসাইন ওর খোঁজখবর রাখতেন। বললেন আবার শহীদুল্লাহ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসে  যোগ দিতে – যৎসামান্য বেতনের বিনিময়ে। রবিউল ভাইকে মাইনুল ভীষণ শ্রদ্ধা করত, রাজি হয়ে গেল। ইচ্ছামতো অফিসে যেত, কোনো কাজে মন নেই। কেউ কিছু বলত না, ওকে তেমন কাজও দেওয়া হতো না। এক সময় অফিসের অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে মাইনুল আবার চাকরি ছেড়ে দিলো। তারপর আর কোনোখানেই কোনো কিছুতেই জড়ায়নি।

ওর সঙ্গে আমার গত কয়েক বছরে মাসে-দুই মাসে একবার দেখা হতো। আমরা সন্ধ্যায় বেইলি রোডে হাঁটতাম, খেতাম আর শুনতাম ওর কথার ফুলঝুরি। ওর অনেক অসংলগ্ন কথাই আমাকে মূল্যবান মনে করে শুনতে হতো। ডায়াবেটিস আক্রান্ত মাইনুল কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করে না। ওর দুই মেয়ের প্রতি প্রচন্ড টান ওকে অনেকটাই বাস্তব জগতে নিয়ে এসেছিল শেষদিকে।

দিনে দিনে ওকে বাংলাদেশের ইতিহাসের একজন গুরুত্বপূর্ণর্ মানুষ হিসেবে মনে করতে শুরু করেছিলাম। মনে হতো আমাদের চেয়ে বিশাল উচ্চতায় ওর অবস্থান। ওর বন্ধু হতে পেরে আমরা অবশ্যই গর্ব বোধ করতাম।

দুর্ভাগ্য আমাদের, সঠিক সময়ে ওর মূল্যায়ন হলো না। বেঁচে থাকতে কোনো খোঁজখবর না রেখে, কোনো মূল্যায়ন না করে মৃত্যুর পরে শোকসভা, শোক প্রস্তাব করার মূর্খদের কালচার এ দেশ থেকে কবে যাবে?

Leave a Reply