আ হ মে দ খা লে দ
প্রাচীন রোমের দাসবিদ্রোহের নেতা, কিংবদন্তির সেই স্পার্টাকাসের সঙ্গে যদি তুলনা করা হয় অমর সুরস্রষ্টা শহীদ আলতাফ মাহমুদকে, হয়তো অনেকেই বিস্মিত হবেন। মেনে নিতে কষ্টও কি হবে না একটু? কোথায় সেই শিকল-ছেঁড়া দাসনেতা, আর কোথায় আমাদের প্রাণের মানুষ – আত্মভোলা, মানবদরদি শিল্পী – আলতাফ মাহমুদ!
তুলনাটা কিন্তু অমূলক নয়; যথার্থ। আর এ বিশ্বাস যে-কারো মনেই গভীরভাবে দানা বাঁধবে, যদি তিনি সেন্টু রায় নির্মিত আলতাফ মাহমুদ প্রামাণ্যচিত্রটি দেখেন।
আলতাফ মাহমুদ নামটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের অতি প্রিয় গানের কলি, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্র“য়ারি’; জড়িয়ে আছে ভাষা আন্দোলন; বাংলাদেশের মানুষের স্বাধিকার আন্দোলনের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, এমনই আরো নানা অনুষঙ্গ। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর – বাহান্নর একুশে ফেব্র“য়ারি থেকে একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধ পর্যন্ত – ইতিহাসের যে কয়টি সোপান বেয়ে বাঙালি তার নিজস্ব স্বাধীন রাষ্ট্রটি পেল, তার সমস্ত পর্যায়ের সঙ্গেই আলতাফ মাহমুদ জড়িয়ে ছিলেন, কোনো-না-কোনোভাবে। আর এ ধাপগুলো ডিঙাতে ডিঙাতে, নিজস্ব শিল্পীসত্তাকে আবিষ্কার করতে করতে, নিজের অজান্তেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন গণজাগরণের শিল্পী। বাঙালিকে জাগিয়ে তুলবার, উজ্জীবিত করে তুলবার শিল্পী। মুক্তির শিল্পী। সেজন্যই সেন্টু রায়ের প্রামাণ্য ছবিতে স্পার্টাকাস থিমটির সঙ্গে ব্যক্তি আলতাফ মাহমুদের উত্থানের কাহিনিটি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
আলতাফ মাহমুদের জন্ম বরিশাল শহরে, ১৯৩৩ সালে। বরিশাল জিলা স্কুল থেকে ১৯৪৮ সালে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন। অল্প বয়সেই সংগীতে তাঁর মেধা এবং সংগীতের প্রতি দরদ প্রকাশ পেয়েছিল। স্কুলে থাকতেই গানবাজনাচর্চার শুরু। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গণসংগীত গেয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বরিশালের বিখ্যাত বেহালাশিল্পী সুরেন রায় ছিলেন তাঁর প্রথম সংগীতগুরু। বামপন্থী ছাত্ররাজনীতি করতে শুরু করেন আলতাফ মাহমুদ ওই বয়সেই। পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন।
১৯৫০ সালে আলতাফ মাহমুদ ঢাকায় আসেন। সেই বছরই ধূমকেতু শিল্পী সংঘে যোগ দেন। ভাষা আন্দোলনে তাঁর ছিল সক্রিয় ভূমিকা; জাগরণী গান গেয়ে মানুষকে সেই সময়ে উদ্দীপ্ত করে তোলেন তিনি। আর পরবর্তী সময়ে ভাষাশহীদদের স্মরণে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত গানটিতে সুরারোপ করে বাংলার জনমানসে চিরদিনের জন্য পাকা আসনটি জয় করে নেন।
১৯৫৬ সালে ভিয়েনায় অনুষ্ঠিতব্য বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে, শিল্পী হিসেবে, যোগ দেবার আমন্ত্রণ পান তিনি। কিন্তু ভিয়েনায় যাবার উদ্দেশ্যে করাচিতে গিয়ে পৌঁছালে, পাকিস্তান সরকার তাঁর পাসপোর্ট আটক করে। আলতাফ মাহমুদ ঢাকায় আর ফিরে আসেননি সেই সময়। করাচিতেই থেকে যান, ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত। তখন তিনি করাচিতে উচ্চাঙ্গসংগীতে তালিম নেন ওস্তাদ আবদুল কাদের খাঁ, ওস্তাদ রমজান আলী খাঁ এবং ওস্তাদ ওমরাও বন্দু খাঁর কাছে। ওই সময়েই তাঁর আলাপ-পরিচয় হয় সুরস্রষ্টা তিমিরবরণ, সংগীত পরিচালক দেবু ভট্টাচার্য এবং নৃত্যপরিচালক ঘনশ্যামের সঙ্গে।
ঢাকায় ফিরে আলতাফ মাহমুদ বিভিন্ন চলচ্চিত্রে সংগীত-পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। জহির রায়হানের চলচ্চিত্রে তাঁর সুরারোপিত গান মানুষের মনকে নাড়া দিয়েছিল বিশেষভাবে। ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীসহ
বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি; পাশাপাশি সক্রিয় ছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনে। ষাটের দশকে, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে আর মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তাঁর সুরারোপিত দেশাত্মবোধক ও গণজাগরণের গানগুলো মানুষকে, সেই সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে তুলেছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের সরাসরি নানাভাবে সাহায্য করেছেন তিনি।
১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আলতাফ মাহমুদকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর আলতাফ মাহমুদ আর বাড়ি ফিরে আসেননি। ধারণা করা হয়, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে নিহত হন তিনি।
ওপরে সংক্ষেপে বর্ণিত ঘটনাগুলোসহ আরো নানা ঘটনার বয়ান রয়েছে সেন্টু রায় নির্মিত প্রামাণ্যচিত্রে। সেই সঙ্গে রয়েছে আস্ত একটি চরিত্রের উদ্ঘাটন। সেই চরিত্রটির নাম আলতাফ মাহমুদ।
আলতাফ মাহমুদ প্রামাণ্যচিত্রটি শুরু হয়েছে অজিত রায়ের গান দিয়ে। সঙ্গে কয়েকটি সাক্ষাৎকারের টুকরো অংশে, কেন আলতাফ মাহমুদের স্মৃতির টানে চলে আসে স্পার্টাকাস-প্রসঙ্গ – এ বিষয়টি পরিষ্কার করা হয়েছে। আর এর সঙ্গেই শুরু হয়ে গেছে স্পার্টাকাস থিমের ‘লাইটমোটিফ’, যা এ চলচ্চিত্রে ফিরে ফিরে এসেছে, আর একে পূর্ণাবয়ব একটি কাঠামো দিয়েছে। এ থিমের চরম প্রকাশমুহূর্তটি রয়েছে এ চলচ্চিত্রের শেষ দৃশ্যে, যেখানে ক্রুশবিদ্ধ স্পার্টাকাসের আদলে চলে আসে ক্রুশবিদ্ধ আলতাফ মাহমুদের ছবি।
পুরো প্রামাণ্যচিত্রটি অনেক সাক্ষাৎকার, অসংখ্য আর্কাইভাল ফুটেজ, স্থিরচিত্র, আলতাফ মাহমুদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার অভিনীত দৃশ্য, অভিনব শব্দসংযোজন এবং সংগীতের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে। এ ছবির অন্যতম আকর্ষণীয় দিক – আর্কাইভাল ফুটেজ, সংগৃহীত চিত্র, আলোকচিত্র ও নানা দৃশ্যের মাধ্যমে গড়ে তোলা সিকোয়েন্স, যা সাক্ষাৎকার ও অভিনীত দৃশ্যগুলোর মাঝে গ্রথিত করা হয়েছে নিপুণ হাতে। অন্য দৃশ্যের পূর্ণ ফ্রেমের বিপরীতে পরিচালক এদের এনেছেন মূল ফ্রেমের মধ্যে ছোট ভিন্ন ফ্রেমে। আবার অভিনীত দৃশ্যের কিছু কিছু স্থিরচিত্রও যখন চলে আসে একই রকম ছোট ফ্রেমে – ডকুমেন্টারির দৃশ্যায়নের মাঝে ডকুফিকশনের আবেশ তখন দর্শকের মনকে আচ্ছন্ন করে তোলে।
নব্বই মিনিটেরও বেশি দৈর্ঘ্যরে প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটি, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, দর্শকের মনে টানটান কৌতূহল জাগিয়ে রাখে। আর সে কৌতূহলের সমাপ্তিও ঘটে সফলভাবে – অভিনব দৃশ্যরূপে – শেষ দৃশ্যে। নানা উপাদানে সমৃদ্ধ ন্যারেটিভটিকে পরিচালক কখনই ঝুলে যেতে দেননি। আলতাফ মাহমুদের জীবনকাহিনির পাশাপাশি তাতে সংযোজিত হয়েছে আরো টুকরো টুকরো অনুষঙ্গ, যা আবার আলতাফ মাহমুদের জীবন ও চরিত্রের ওপরই ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণে আলো ফেলেছে।
সংগীত এ ছবির অন্যতম অনুষঙ্গ। আলতাফ মাহমুদের সংগীতজীবন, সেই সঙ্গে সংগীতের বৃহত্তর দ্যোতনা ও আবেশকে এ ছবিতে সফলভাবে নিয়ে আসা, অনেক দিক থেকেই ছিল এই ছবি নির্মাণের বড় চ্যালেঞ্জ। সে চ্যালেঞ্জ পূরণে পরিচালক সফল, অনেকাংশেই। কারণ এ ছবির টানটান আমেজটি ধরে রাখার পেছনে অন্যতম সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে এ ছবির সংগীত। আলতাফ মাহমুদের নিজস্ব সংগীতসৃষ্টি ব্যবহারের পাশাপাশি এ ছবিতে ব্যবহৃত হয়েছে দেশি-বিদেশি ধ্র“পদী সংগীত, বাংলার নানা লোকগীতি ও জাগরণের গণসংগীত। এ ছবির সংগীতবিন্যাস পরিচালকের নিজের হাতে করা। অত্যন্ত সফলভাবেই তিনি দায়িত্বটি সম্পন্ন করেছেন।
এ ছবির অভিনীত দৃশ্যগুলোর বেশির ভাগ উপস্থাপনাই বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে। কেবল সদ্য ঢাকায়-আগত আলতাফ মাহমুদ হিসেবে লম্বা চুলের আধুনিক ফতুয়াধারী যুবকের চেহারা, হয়তো, কিছুটা বিসদৃশ ঠেকে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংস অত্যাচারে ছেঁড়াখোঁড়া আলতাফ মাহমুদের চেহারার নির্মাণটি দারুণ মর্মস্পর্শী। তবে সেই বীভৎস মুখ বারবার না দেখিয়ে একবার দেখালেই তার অভিঘাত দর্শকের মনে হয়তো স্থায়ী হতো বেশি।
প্রচুর সাক্ষাৎকার ব্যবহার করা হয়েছে এ প্রামাণ্যচিত্রে। এসব সাক্ষাৎকারে-কথনে আর মর্মস্পর্শী স্মৃতিচারণায় – আলতাফ মাহমুদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এবং তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো ফুটে উঠেছে চমৎকারভাবে। তবে সব সাক্ষাৎকারে, ফ্রেমিঙের একটা সমন্বিত ধারাবাহিকতা থাকলে ভালো হতো।
ছবির শেষভাগের সাক্ষাৎকারগুলোয়, আলতাফ মাহমুদের জীবনের যে-পরিণতি ফুটে উঠেছে, তা হৃদয়বিদারক। সেই বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে পর্দায় ফুটে ওঠা দৃশ্যাবলিও দর্শকের মন ও অনুভূতির ওপর কশাঘাত চালায় নির্মম দক্ষতায়।
সেন্টু রায় (জন্ম : ১২ জুন, ১৯৫৪) নিবেদিতপ্রাণ একজন সংস্কৃতিকর্মী। স্বাধীন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনগুলোর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিবিড়। উদীচীর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি একসময়। পরবর্তীকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলচ্চিত্রে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালেই তিনি তৈরি করেন যুদ্ধাপরাধের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র, যেখানে নুরেমবার্গ ট্রায়ালের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিষয়টিও উঠে আসে। এরপর, আরো কয়েকটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র তৈরির ধারাবাহিকতায় আলতাফ মাহমুদ প্রামাণ্যচিত্রটি তাঁর সর্বশেষ নির্মাণ।
গণসাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত নিজেই। সেজন্যই হয়তো আলতাফ মাহমুদের মতো গণজাগরণের শিল্পীকে চলচ্চিত্রের বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন সেন্টু রায়। আর আলতাফ মাহমুদের শিল্পীসত্তার পেছনকার শ্রমনিষ্ঠ, রাজনৈতিক-অঙ্গীকারবদ্ধ মানুষটিকে উদ্ঘাটন করেছেন দৃশ্যরূপে, পরম পারঙ্গমতায়। এই চলচ্চিত্রে, আলতাফ মাহমুদের জীবনের ঘটনাগুলোকেই শুধু পাই না আমরা – পাই মানুষ আলতাফ মাহমুদকে। যে মানুষটি ছিলেন স্পার্টাকাসের মতন বিদ্রোহী, আবার এক সন্তের মতন সফেদ।
আলতাফ মাহমুদ বাঙালির হৃদয়ক্ষরিত এক নাম। তাঁর ওপর নির্মিত এই প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটি দেখতে বসলে তাই বুকে জাগে আবেগের ঢেউ, আর চোখ হয়ে ওঠে অশ্রুসজল।
- ঠিকানা
- সপ্তম বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । আশ্বিন ১৪২৫ । October 2018
- পুরানো সংখ্যা
- সপ্তম বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । পৌষ ১৪২৪ । December 2017
- ষষ্ঠ বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । বৈশাখ ১৪২৩ । May 2017
- ষষ্ঠ বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । কার্তিক ১৪২৩ । November 2016
- পঞ্চম বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । বৈশাখ ১৪২৩ । May 2016
- পঞ্চম বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । অগ্রহায়ন ১৪২২ । November 2015
- চতুর্থ বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । আষাঢ় ১৪২২ । June 2015
- তৃতীয় বর্ষ । চতুর্থ সংখ্যা । কার্তিক১৪২১ । November 2014
- তৃতীয় বর্ষ । তৃতীয় সংখ্যা । আষাড় ১৪২১ । July 2014
- তৃতীয় বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । ফাল্গুন ১৪২০ । February 2014
- তৃতীয় বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । কার্তিক ১৪২০ । Novembeer 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । চতুর্থ সংখ্যা । শ্রাবণ ১৪২০ । July 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । তৃতীয় সংখ্যা । বৈশাখ ১৪২০ । April 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । পৌষ ১৪১৯ । January 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । আশ্বিন ১৪১৯ । September 2012
- প্রথম বর্ষ । চতুর্থ সংখ্যা । জ্যৈষ্ঠ ১৪১৯ । May 2012
- প্রথম বর্ষ । তৃতীয় সংখ্যা । ফাল্গুন ১৪১৮ । February 2012
- প্রথম বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । অগ্রহায়ন ১৪১৮ । November 2011
- প্রথম বর্ষ । প্রথম সংখ্যা। ভাদ্র ১৪১৮ । August 2011