logo

জন রাস্কিন ও জয়নুল আবেদিন

বো র হা ন উ দ্দি ন  খা ন  জা হা ঙ্গী র

জন রাস্কিনের শিল্পচিন্তা জয়নুল আবেদিনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। রাস্কিন ব্রিটিশ শিল্পের একজন সেরা শিল্প-সমালোচক শুধু নন, তিনি তাঁর সময়ের একজন সেরা শিল্প-সমালোচক। তিনি তাঁর বিস্তৃত পড়াশোনার সঙ্গে মিলিয়েছেন তাঁর বিভিন্ন অনুভূতি আর তাঁর বিভিন্ন অনুভূতিতে যুক্ত করেছেন তাঁর সময়ের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গগুলো। অবাধ ধনতন্ত্রের বিরোধিতা করেছেন রাস্কিন আর কলোনিয়াল ধনতন্ত্র নিয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন জয়নুল আবেদিন। অবাধ ধনতন্ত্রের অন্য নাম অর্থনৈতিক লিবারেলিজম, তার ইচ্ছা সবকিছু মার্কেট ফোর্সেসের কাছে ছেড়ে দেওয়া। রাস্কিনের এই বক্তব্য আবেদিনের শিল্প বোঝার জন্য জরুরি। আবেদিন প্রকৃতি কিংবা নিসর্গ কিংবা নিসর্গের মধ্যেকার মানুষজনকে ধরতে চেয়েছেন। রাস্কিন এখান থেকে শিল্পের স্বভাব বুঝতে চেয়েছেন। শিল্প ফিজিক্যাল এবং এম্পেরিক্যাল বাস্তব বোঝার চেষ্টা। এই চেষ্টা থেকে উৎসারিত হয় সেনসুয়ালিস্ট নান্দনিকতা। আবেদিনের কাজের স্বরূপ এখানেই। আবেদিনের শিল্প-ভাবনার কেন্দ্র ভিত্তি মূল পৌরাণিক পৃথিবী থেকে সরে এসেছে মানুষের সমাজে। মানুষের সমাজটা সত্য। এই সমাজটা পৌরাণিকতার মধ্যে আবদ্ধ নয়। কলকাতার আর্ট স্কুলের ভাবাদর্শ থেকে তিনি বহুদূর সরে এসেছেন। কলকাতায় তিনি দেখেছেন লাগামহীন ধনতন্ত্র কীভাবে মানুষকে হত্যা করে, সরকার ও রাষ্ট্রের দায়িত্বহীনতা : মানুষের প্রতি দায়িত্বহীনতা থেকে কি পৌরাণিকতার উদ্ভব? মানুষ দুর্ভিক্ষে না খেয়ে মরে যায়। সরকার উদাসীন এবং নির্লিপ্ত। শিল্পও তাই। এই প্রশ্নের জবাব আবেদিন খুঁজেছেন ঢাকায়। যারা শাসিত তাদের জীবনের মান নষ্ট করে শিল্প হয় না। মানুষের রুচিবোধ বিকৃত করে শিল্প হয় না। আবেদিন একটা আর্ট স্কুল খোলার লড়াই করেননি, তিনি লড়াই করেছেন অবাধ ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে, দেখিয়েছেন আঙুল তুলে শাসক ও শাসিত দুপক্ষকেই অবাধ ধনতন্ত্র, কলোনিয়াল ধনতন্ত্র মানুষের জীবনের নান্দনিক চরিত্র কীভাবে নষ্ট করে দেয়, বিকৃত করে দেয়। বড়লোকদের রুচিহীন বিলাসিতার বিজ্ঞাপনের জন্য আর্ট স্কুল নয়। আর্ট স্কুল একদিকে রুচি তৈরি করে, অন্যদিকে মানুষের কাছে দায়বদ্ধতা শেখায়। আবেদিন ঈশ্বরের রাজত্ব থেকে মানুষের সমাজে শিল্পকে সরিয়ে এনেছেন এভাবেই।
খুব সম্ভব আবেদিন রাস্কিন পড়েননি। কিন্তু রাস্কিনের জীবন সম্বন্ধে দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে তিনি বসবাস করেছেন। রাস্কিন ভেবেছেন, বড় আকারের শিল্পায়ন পরিবেশের দিক থেকে এবং নান্দনিকতার দিক থেকে ভয়াবহ। তাঁর কাছে নান্দনিক সুস্থ সমাজ হচ্ছে সেটি, যেখানে প্রত্যেক ব্যক্তি নিজেকে প্রকাশ করতে সমর্থ কল্পনাকুশলতা ও সৃষ্টিশীলতার মধ্যে দিয়ে। এই প্রকাশই মূল্যবোধ তৈরি করে এবং বিশ্বাসকে শক্তিশালী করে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ধনতন্ত্র সবকিছু ধ্বংস করে এবং করে চলেছে এবং চূড়ান্তে করবে। সেজন্য নন-ইন্ডাস্ট্রিয়াল সমাজের কথা ভাবতে হবে। মার্গারেট মিড এ ধরনের সমাজের কথা ভেবেছেন : বালিনিজ সমাজে জীবনের সকল দিক আচ্ছন্ন করে আছে শিল্প। প্রত্যেক ব্যক্তি কিছু-না-কিছু জোগান দেয় শিল্পকে। শিল্প হচ্ছে জীবনকে বুঝবার মহান এক মাধ্যম।
আবেদিন রাস্কিনের মতো ভেবেছেন। লোকজ শিল্পের প্রতি : নন-ইন্ডাস্ট্রিয়াল শিল্পের প্রতি তাঁর আকর্ষণের কারণ এখানে। তিনি দেখেছেন অ-নান্দনিক পরিবেশ ও পরিসরে বাঁচার অর্থ হচ্ছে ধূসর এক মনোক্রমের মধ্যে বাঁচা। এভাবে জীবনযাপন মানুষকে একটি ভয়াবহ দুর্যোগের দিকে ঠেলে নিয়ে যায়। মানুষের জীবন ধ্বংসের দিকে অগ্রসর হয়। মানুষ তখন বেঁচে থাকার কোনো পথ খুঁজে পায় না। হাভেলের চিন্তার মধ্যে বঙ্গীয় শিল্পের মুক্তি নেই। বঙ্গীয় শিল্পের মুক্তি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মধ্যে ও নন-ইন্ডাস্ট্রিয়াল সমাজ গড়ে তোলার মধ্যে। আধুনিকতা কিংবা আধুনিক আন্দোলনের মধ্যে তিনি কোনো বিপ্লব খুঁজে পাননি। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে আধুনিকতা থেকে নান্দনিক দিক, বাস্তবিক জীবন থেকে দূরে সরে যেতে বাধ্য হয়েছে, নান্দনিকতা বিদ্যমান বাস্তবিকতা থেকে অন্য বাস্তবে আশ্রয় খুঁজেছে, সে-বাস্তব হচ্ছে শিল্পীর কল্পনার স্পেস, শিল্পীর পরিপ্রেক্ষিত উদ্ভাবনের মধ্যে দিয়ে শিল্পী নিজেই তাঁর চিত্রিত ভুবনের স্রষ্টা হয়ে উঠেছেন। শিল্প সেজন্য মানুষী বিভিন্ন দক্ষতার পরিপূরক আর নয় : এমন ভাবনা আবেদিনকে অস্থির করেছে। শিল্প হয়ে উঠেছে বিশেষ এবং অনন্য এক ভুবন স্রষ্টার দিক থেকে।
আবেদিন হয়তো এসব কারণে লোকজ শিল্পের দিকে ঝুঁকেছেন। তাঁর মনে হয়েছে, কল্পনাকুশল কাজ অন্যান্য শিল্প কাজ থেকে আলাদা। শিল্পের মতাদর্শের বদল ঘটেছে। মতাদর্শের বদলের দরুন কাজের স্বরূপ বদলেছে। আধুনিকতার নান্দনিক দিক শূন্যতাকে তুলে ধরে, আধুনিকতার ব্যর্থতা স্পষ্ট করে। আবেদিন বিংশ শতাব্দীতে এসে ধনতন্ত্রের মানবিক সম্ভাবনা নাকচ করেছেন, কলকাতার ব্রিটিশ কলোনিতে ধনতন্ত্রের মানবিকতা খুঁজে পাননি, তেমনি ঢাকার পাকিস্তানি কলোনিতে ধনতন্ত্রের মানবিকতা খুঁজে পাননি। তিনি স্পষ্ট বুঝেছেন ধনতন্ত্র মানবিক নয়, ধনতন্ত্রের পক্ষে মানবিক হওয়া সম্ভব নয়। এই তিক্ত সত্য, আবেদিনের অনেক আগেই, রাস্কিন ধরতে পেরেছেন। ধনতন্ত্রের মধ্যে নান্দনিক সম্ভাবনা নেই, ঊনবিংশ শতাব্দীতে রাস্কিন বুঝতে পেরেছেন। ধনতন্ত্রে কি কোনো নান্দনিক দিক খুঁজে পাওয়া যায়? রাস্কিনের জবাব : না। রাস্কিনের কাছে নান্দনিকতার দুটি দিক আছে। একটি হচ্ছে সেনসুয়াস আনন্দ। অপরটি হচ্ছে সৌন্দর্যবোধ। দুটি মিলিয়ে মানুষের নৈতিকতা। শিল্পের এই মরালিস্টিক অ্যাপ্রোচ রাস্কিনকে সমালোচনার সম্মুখীন করেছে। আবেদিনের মধ্যে শিল্প সম্বন্ধে এই মরালিস্টিক অ্যাপ্রোচ কাজ করেছে। মরালিটি কী? রাস্কিনের কাছে মরালিটি হচ্ছে আবেগ, সেন্টিমেন্ট, অনুভবময়তার কাঠামো, কল্পনাকুশল এবং প্রতীকময় চিন্তার সকল ভূভাগ। আবেদিনের কাছে শিল্প তা-ই। রাস্কিনের মতো আবেদিন ভিসুয়াল সেনসেসনের ওপর নির্ভর করেছেন যে-সেনসেসন স্বাভাবিক ফর্ম থেকে উৎসারিত। এখানেই নিহিত শিল্পের িপ্রচুয়াল মূল্য কিংবা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গভীর গভীরতর শিকড়।
আবেদিন বুঝেছেন ধনতন্ত্রের সংস্কৃতি শিল্পকে মার্কেট কমোডিটিতে পর্যবসিত করেছে এবং একই সঙ্গে অন্যান্য কমোডিটির বিজ্ঞাপনে পরিণত করেছে। এই পর্যবসিতকরণ বিপজ্জনক। শিল্পের মধ্যে ফ্রিডমের যে-সম্ভাবনা আছে তা নষ্ট করে, আবেদিন এই নষ্টামির বিরুদ্ধে সবসময় রুখে দাঁড়িয়েছেন। তিনি যখন শিল্পের বিভিন্ন ম্যাটেরিয়াল নিয়ে কাজ করেছেন : যেমন যে-স্টাইল তিনি ইনহেরিট করেছেন, যে সমস্ত কনভেনশন তিনি পালন করেছেন, যে সমস্ত বিষয় তাঁর সামনে দিগন্ত খুলে দিয়েছে কিংবা তাঁর হাত টেনে ধরেছে, তিনি বুঝেছেন তাঁর জন্য শিল্পের সম্ভাবনা এবং মানুষের জন্য শিল্পের সম্ভাবনা।

Leave a Reply