আ ন্দা লি ব রা শ দী
বিংশ শতকের শ্রেষ্ঠ ভারতীয় নারী চিত্রশিল্পী ‘ভারতীয় ফ্রিদা কালো’-খ্যাত অমৃতা শেরগিল মাত্র আঠাশ বছর বেঁচে ছিলেন। জীবদ্দশায় তাঁর আঁকা ছবি বহুল প্রশংসিত হলেও তেমন বিক্রি হয়নি। ছবি এঁকে স্বস্তিদায়ক জীবনযাপনের স্বপ্ন পূরণ হয়নি। এখন ভারতের নারী চিত্রশিল্পীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হয় অমৃতার ছবি।
শিখ বাবা এবং হাঙ্গেরিয়ান মায়ের সন্তান অমৃতার জন্ম ৩০ জানুয়ারি ১৯১৩ বুদাপেস্টে; পিয়ানো, বেহালা এবং ছবি আঁকায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন বয়স দশ ছোঁয়ার আগেই। কিন্তু তিনি জানতেন তাঁকে রং-তুলিতে বিকশিত হতে হবে। ইতালি ও প্যারিসে জলরং, তেলরঙের বাইরেও ফ্রেসকো এবং তামা-খোদাইয়ে হাত পাকান। তাঁর আঁকা ‘ইয়ং গার্লস’ তাঁকে ১৯৩৩ সালে প্যারিসের গ্র্যান্ড স্যালোনের সদস্য হওয়ার পথ প্রশস্ত করে দেয়।
১৯৩৭ সালে তিনি আঁকেন তাঁর বিখ্যাত ট্রিলজি : ‘ব্রাইড’স টয়লেট’, ‘ব্রহ্মচারিস’ এবং ‘সাউথ ইন্ডিয়ান ভিলেজার্স’।
তাঁর বিখ্যাত তেলরং ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘জিপসি গার্ল ফ্রম জেবেজনি’, ‘সেলফ পোর্ট্রটে’, ‘ন্যুড’ (চারকোলে করা কয়েকটি ‘ন্যুড’ও রয়েছে), ‘প্রফেশনাল মডেল’, ‘ইয়ংম্যান উইথ অ্যাপলস’, ‘গ্র“প অব থ্রি গার্লস’, ‘হিল ওমেন’, ‘ইন দ্য লেডিস এনক্লোজার’, ‘টু গার্লস’, ‘এনশিয়েন্ট স্টোরি টেলার্স’ ও ‘ক্যামেলস’।
যশোধারা ডালমিয়ার ‘অমৃতা শেরগিল : এ লাইফ’, ভিভান সুন্দরমের ‘অমৃতা শেরগিল – লাইফ অ্যান্ড ওয়ার্কস’, খুশবন্ত সিং, ওমা নায়ার, খালিদ হাসান, অরবিন্দ আদিগা, নাভিনা সুন্দরম্ প্রমুখের লেখা থেকে অংশবিশেষ নিয়ে, মূলত ভাষান্তরিত করে এই নিবন্ধটি প্রণয়ন করা হয়েছে।
অনস্বীকার্য, অমৃতা শেরগিল তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীদের বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছেন। তাঁর কিছু মুগ্ধ করা চিত্রকর্ম দেখার সুযোগ নিবন্ধকারের হয়েছে।
অমৃতার জন্মকথা
ম্যারি আনতোয়িনেত মেয়ে অমৃতার জন্মের কথা লিখেছেন : দানিয়ুব নদীর তীরে হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে চারশ বছরের পুরনো মোহনীয় ও মনোরম শহর বুদার আঁকাবাঁকা বর্ণিল রাস্তাগুলো হাঁটু পর্যন্ত বরফে ঢাকা পড়ে আছে। ৩০ জানুয়ারি ১৯১৩ শীতের উজ্জ্বল রোববারের এক তুষারঝরা সকাল। জমাটবাঁধা দানিয়ুব থেকে ওঠে আসা আঁকড়ে ধরা শীতল বাতাস তীক্ষè শিস বাজিয়ে বয়ে চলছে, সাদা রং ধরেছে তুষারঢাকা জানালা, ফুল কিংবা সুচালো তারকার জটিল ছবি কেউ যেন জাদুকরী হাতে জানালার কাচের ওপর এঁকে রেখে গেছে। জানালার ভেতর থেকে তাকালে দেখা যায়, বাইরে উজ্জ্বল চোখ-ঝলসানো সাদা বরফঢাকা বুদার পাহাড় যেন এক পরির রাজ্য। এমনই একদিনে অমৃতা এই পৃথিবীতে নেমে এলো। আমি আমাদের পারিবারিক বুড়ো ডাক্তারের দয়ার্দ্র বিস্মিত কণ্ঠ শুনতে পাই – ‘এটা একটা মেয়েশিশু! দারুণ মিষ্টি। ঈশ্বর তার হেফাজত করুন।’ কয়েক মিনিট পরই নার্স নরম তুলতুলে লেপে ঢাকা একটি ছোট পুঁটুলি এনে আমাকে দিলো… এই সুন্দর দৃশ্যটি দেখে আমার অন্তর স্পন্দিত হলো, একটা মাংসের দলা যেন আমার গলা রুদ্ধ করে দিলো, আমার ঠোঁটের কাছে গড়িয়ে আসা কথাগুলো অস্ফুট রয়ে গেল। কাজেই আমি পরম আনন্দে ফোঁপাতে শুরু করলাম। প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চের ঘণ্টা দুপুরের ঘোষণা দিলো আর পৃথিবীতে আনীত ছোট্ট নতুন অস্তিত্ব তার প্রথম কান্না ধ্বনিত করল।
দৈন্যদশার শৈশব
প্রথম মহাযুদ্ধের পুরো সময়টাই কেটেছে দৈন্যদশায়। অমৃতার বাবা ওমরাও সিং লিখেছেন :
মহাযুদ্ধ শুরু হলো। ভারত থেকে আমাদের যে আয় নিয়মিত পাঠানো হতো, তা একেবারেই বন্ধ হয়ে গেল। আর্থিক কারণে আমরা দুনাহারাসতি গ্রামে চলে গেলাম। আমাদের এবং শিশুদের দুশ্চিন্তাহীন জীবনের অবসান ঘটল। আমার স্ত্রী অবিরাম খেটে রান্না করে, কাপড় ধুয়ে, যেভাবে সম্ভব বাচ্চাদের লালন-পালন করতে লাগল – তার উদার ও স্বাধীনচেতা প্রকৃতির বিকাশ ঘটল। আমিও প্রচণ্ড শীত ও হিমেল ও বরফ-জমাট আবহাওয়ায় জ্বালানি কাঠ কাটতে এবং কুয়ো থেকে পানি আনতে শুরু করি। সন্তানদের এই সযতœ লালন মায়ের সঙ্গে তাদের নৈকট্য আরো বাড়িয়ে দেয়। যুদ্ধাবস্থায় খাদ্যদ্রব্যের অপর্যাপ্ত সরবরাহের কারণে আমাদের সন্তান পর্যাপ্ত দুধ ও দুধের তৈরি মাখন থেকে বঞ্চিত হয়। একবার অমৃতা তার আধ-খাওয়া একটি মিষ্টান্ন যখন অভিনেত্রী জাযাই মারিকে দিয়ে দেয়, তিনি মন্তব্য করেন, ‘এই সুন্দর ও নিঃস্বার্থ মেয়েটি জীবনে সুখী হবে।’ তারপর এলো স্প্যানিশ ফ্লুর মড়ক, বেচারি অমৃতা আক্রান্ত হলো। আমরা ভেবেছি, মেয়েটি আর বাঁচবে না। সে সময় গ্রামে কোনো ডাক্তার ছিল না। বেপরোয়া হয়ে অমৃতার ছোট বোনকে সঙ্গে নিয়ে ডাক্তার আনতে পাশের গ্রামে চলে যান। ডাক্তার আসতে অস্বীকার করেন, নিজের গ্রামেই তাঁর ব্যস্ততার শেষ নেই। তারা যখন ফিরে আসে, আমি তখন অমৃতার দিকে চোখ রেখে নিরুপায় হয়ে তার জন্য প্রার্থনা করে চলছি। মেয়েটি তখন ধীরে ধীরে সেরে উঠতে শুরু করেছে। একসময় সে অসুস্থতা কাটিয়ে ওঠে।
অমৃতার বাবা-মা
বাবা ও মাকে নিয়ে অমৃতা লিখছেন :
আমার বাবা সরদার ওমরাও সিং শেরগিল পাঞ্জাবের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকে উঠে এসেছেন। পরিবারটি পরে ইউপিতে বসতি স্থাপন করে। বাবাকে পরিচিত করিয়ে দেবার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না, যদিও কিছুটা অসামাজিক প্রকৃতির মানুষ। তিনি দার্শনিক হিসেবে, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের শিক্ষার্থী হিসেবে, সামাজিক মুক্তির, বিশেষ করে নারীমুক্তির অগ্রদূত হিসেবে যথেষ্ট পরিচিত ছিলেন। তিনি অত্যন্ত শিল্পমনা এক হাঙ্গেরিয়ান নারী – আমার মাকে বিয়ে করেছিলেন। আমার যে সাফল্য তার জন্য ঋণী আমার মা’র কাছে – শৈশব থেকেই তিনি আমাকে উৎসাহ দিয়ে এসেছেন, আমার শিল্প-বিকাশের সংগ্রামে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন। আমার ছোট বোন ও আমার জন্ম হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে; (প্রথম) মহাযুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমরা সেখানে থাকতে বাধ্য হই।
অমৃতা কি লেসবিয়ান?
প্যারিস জীবনে একটি স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টে অমৃতা প্রীতম ও ম্যারি লুই শ্যাসেনে ভাগাভাগি করে থাকতেন। দুজনের মধ্যে লেসবিয়ান যৌনসম্পর্কের বেশ রটনা হয়। তার মা চিন্তিত হয়ে পড়েন। কিন্তু মাকে লেখা একটি চিঠিতে (ফেব্র“য়ারি, ১৯৩৪) তিনি এ সম্পর্কের কথা অস্বীকার করেন :
ম্যারি লুইর সঙ্গে আমার কখনো কিছু ঘটেনি। ভবিষ্যতেও কিছু ঘটার সম্ভাবনা নেই। তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পার। আমি জানি, তুমি কতটা বস্তুনিষ্ঠ এবং বুদ্ধিমতী, তোমাকে তাই খোলামেলাভাবে বলছি। আমাকে এটা স্বীকার করতেই হবে যে, পুরুষ মানুষের সঙ্গে যৌনসম্পর্ক স্থাপনের যেসব অসুবিধার কথা তুমি বলেছ, আমি তার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত আর আমার যে যৌন চাহিদা কোনোভাবে শারীরিক প্রক্রিয়ায় তা মেটানো দরকার। কারণ আমি বিশ্বাস করি, একজনের যৌনবাসনাকে পুরোপুরি শিল্পে রূপান্তর করা সম্ভব নয়; সারাজীবন এই শিল্পকে আদর্শ মেনে যৌনপ্রশান্তি লাভের চিন্তা যে কেবল চপল মস্তিষ্কের নির্বোধ কুসংস্কার, তা আমি জানি। কাজেই আমি ভেবেছি, সুযোগ এলে কোনো নারীর সঙ্গে আমি সেরকম সম্পর্ক গড়ে তুলব। খোলামেলাভাবে বলতে গেলে মানতেই হবে, আমিও ভেবেছিলাম ম্যারি লুই একই ধরনের অস্বাভাবিক কামনার একজন নারী। আসলে ম্যারি লুই একজন স্বাভাবিক নারী, তার চমৎকার আকর্ষণীয় ও আগ্রহোদ্দীপক অস্বাভাবিক ছলাকলা দেখাই যথেষ্ট। কিন্তু কোনোভাবেই সে লেসবিয়ান নয়। সে অদ্ভুত ধরনের একজন মানুষ। তার যৌনজীবন কেমন সে ধারণা আমার একেবারেই নেই। এ বিষয়টি সবসময়ই সে এড়িয়ে চলেছে কিংবা আমার প্রশ্ন উপেক্ষা করেছে। সংক্ষেপে বলতে গেলে আমাদের মধ্যে কখনো কোনো ধরনের যৌনসম্পর্ক স্থাপিত হয়নি আর এতে আমি একসময় এই উপসংহার টানি যে, তার কোনো ধরনের যৌনজীবন নেই। তবে আমি মনে করি, তার মধ্যে এক ধরনের তাত্ত্বিক বাতিকগ্রস্ততা এবং প্রদর্শনপ্রিয়তা কাজ করত আর এটা তুমিও দেখেছ জনসমক্ষে সে আমার হাত ধরে রাখত, অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাত, পাঁচ মিনিট পরপর আমাকে মনে করিয়ে দিত আমি কত সুন্দর এবং তার ওপর আমার কী প্রভাব। কিন্তু যখন আমরা কেবল দুজন আর কেউ নেই, সে দ্রুত নিজেকে বদলে ফেলত – যেন সে ভিন্ন এক মানুষ। তোমাকে আমার এটুকুই বলার ছিল।
ভেঙে যাওয়া বাগদান
লেসবিয়ান সম্পর্কের দিকে অমৃতার এই ঝুঁকে পড়ার দায় অনেকটাই তাঁর মায়ের। তিনি যুক্তপ্রদেশের রাজা নবাব আলীর পুত্র প্যারিসবাসী সুদর্শন ইউসুফ আলী খানকে বাড়তি প্রশ্রয় দিয়ে অমৃতার কাছাকাছি নিয়ে এসেছেন। অমৃতা তাঁকে বিয়ে করতে সম্মত হন এবং বাগদানও সম্পন্ন হয়। কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন রুচির দুটি মানুষের নৈকট্য বরং বেশি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অমৃতা ছোঁয়াচে যৌনরোগে আক্রান্ত হন এবং মামাতো ভাই ভিক্টর এগানের শরণাপন্ন হয়ে রোগমুক্তির ওষুধ গ্রহণ করতে থাকেন। সময়টা ছিল প্রবল মানসিক যন্ত্রণার – তিনি ছোট বোন ইন্দিরাকে লিখেছেন, ‘মা এখন আমাকে বলির পাঁঠা বানাতে চান।’ একপর্যায়ে নিজের জীবন ও বিয়ের দায়িত্ব নিজ হাতে নিয়ে নেন। মাকে লেখেন :
ইউসুফকে কোনোভাবেই বিশ্বাস করা যায় না। কেবল ভিক্টরের বোন বাবাকেই যে প্রেম নিবেদন করে বেড়াচ্ছে, তা-ই নয়, রাস্তায় সুদর্শন যত মেয়ে সামনে পড়ে তার চোখ তাদের সকলকে অনুসরণ করে বেড়ায়। তাছাড়া মুসলমানি ধারার বিয়েতে সতর্ক হওয়ার প্রয়োজনও রয়েছে। … ধরা যাক, ইউসুফ বহু নারীতে আসক্ত এবং স্ত্রীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে অসমর্থ; সে যদি আবার বিয়ে করতে চায়, আমি কিছুই করতে পারব না, কারণ আইন আমাকে রক্ষা করবে না। … আমি তাকে বিয়ে করতে যাচ্ছি না কি সে সিদ্ধান্ত আমিই নিতে যাচ্ছি। অক্টোবরের মধ্যে চূড়ান্ত হাঁ কিংবা না আমিই জানিয়ে দেব।
(২৫ আগস্ট ১৯৩১, মাকে লেখা অমৃতার চিঠি থেকে।)
প্যারিসের স্কুলে
প্যারিসে ছবির স্কুলে অমৃতার ক্লাসমেট বরিস তাসলিৎস্কি নিজেও পরবর্তীকালে বিখ্যাত শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। দুজনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা কম হয়নি। অমৃতার বিখ্যাত ছবি ‘ইয়ংম্যান উইথ অ্যাপলসে’র (১৯৩২) যুবকটি বরিসই, অন্য কেউ নন। হ্যান্ডসাম যুবক বরিস গায়ে সাদা শার্ট, হাতে তিনটি লাল আপেল, ১৯৩০-এর দশকে প্যারিসের প্রদর্শনীতে অন্যতম আকর্ষণে পরিণত হয়। বরিস অমৃতাকে ভালোবাসার কথা অকপটে জানিয়ে গেছেন :
তার সঙ্গে আমার দেখা ১৯৩০-এ, আমি ব্যু আর্টসের শিক্ষার্থী। যখন অমৃতা ঢুকল চারদিকে অতিকায় নীরবতা, কারণ তার উপস্থিতিই বিশাল। আমার বয়স তখন উনিশ আর অমৃতার সম্ভবত সতেরো। এত কম বয়সে সে এত ভালো ছবি আঁকছে যে, আমাকে বিস্মিত হতে হয়। আমি তার প্রেমে পড়ে যাই। এটাই একমাত্র শিল্প শিক্ষালয়, যেখান ছেলেমেয়ে পাশাপাশি বসতে পারে, অন্য তিনটিতে বসার ব্যবস্থা আলাদা। কিছুকাল পর আমি এখান থেকে চলে যাই নদী পেরিয়ে ল্যুভে। এই সময়ে অমৃতা আমার তিনটি পোর্ট্রেট করেছে, আর আমার মায়ের একটি। আমাকে পোর্ট্রেটগুলো বিক্রি করে ফেলতে হয়। আমিও অমৃতার দু-তিনটি পোর্ট্রেট করি। অমৃতা আমাদের বাড়িতে আসত। যখন ছুটি কাটাতে যেত, তার ফোনোগ্রাম আর রেকর্ডগুলো আমার কাছে রেখে যেত। তার মা ছিল সংগীতশিল্পী এবং আধো-হাঙ্গেরিয়ান। তাদের বাড়িতে প্রায়ই গানের আসর বসত। আমি খুব গরিব ছিলাম আর সে কারণেই (তার মা) একবার আমাকে সতর্ক করে দিয়েছিল, ওকে স্পর্শ করবে না। বরিস বলেছেন, অমৃতা মানুষের জীবনাচরণ নিয়ে অত্যন্ত আগ্রহী ছিল। চিত্রকলা ও সংগীতের সঙ্গে তার আবেগময় সম্পৃক্ততা। তার মা অনেকটা অনলবর্ষী ব্যক্তিত্ব, বাবাকে কদাচিৎ দেখা গেছে আর বোনটির মধ্যে বড্ড লুকোচুরি। ‘আমি তার প্রেমে ডুবেছিলাম, কিছুটা সময় তার কাছ থেকে একই রকম সাড়া পেয়েছি, তারপর একদিন আমাকে বলল হাঙ্গেরিতে তার এক কাজিনের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে। তাকে সে বিয়ে করবে। তার নাম ভায়োলা।’
প্যারিসে অমৃতার শেষ বছর ১৯৩৪ দুজনের মধ্যে মাঝেমধ্যে দেখা হয়ে যেত। নিরাবেগ অভিবাদনে পরস্পরকে স্বাগত জানাতেন। ততোদিনে বরিসও রাজনীতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েছেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালে কমিউনিস্ট শিল্পী বরিস গ্রেফতার হন। নাৎসি বাখেনওয়ান্ড বন্দিশিবিরে আটকে রাখা হয়। এখানেই তাঁর মাকে হত্যা করা হয়। ১৯৪৬ সালে মুক্ত বরিস পাবলো পিকাসো ও অন্যান্য শিল্পীর সঙ্গে ‘প্রতিবাদের জন্য শিল্প’ শীর্ষক প্রদর্শনী করেন। তিনি রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন।
বরিসের বয়স যখন নব্বই বছর, অমৃতার জীবনী-গ্রন্থকার যশোধারা ডালমিয়া তাঁর সঙ্গে প্যারিসের স্টুডিওতে দেখা করেন। তিনি লেখককে বলেন :
একসময় আমাদের দেখা হলে ‘গুড মর্নিং’ কিংবা ‘গুড ইভনিং’ বিনিময় করেছি, কিন্তু সেই উষ্ণতা আর ছিল না। প্যারিস ছেড়ে যাবার পর তার সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি। ১৯৮৪ সালে ফেস্টিভ্যাল অব ইন্ডিয়া ইন প্যারিসে’ বড় এক চিত্রপ্রদর্শনীতে ক্যাটালগের প্রচ্ছদে অমৃতার ছবি দেখে আমি পুরনো সেই দিনগুলোতে ফিরে যাই। তার ছবির যেসব রিপ্রোডাকশন দেখলাম তা সে সময়কার ছবির চেয়ে অনেক বেশি বদলে গেছে। সেগুলো ছিল সরল, তাতে থাকত সামাজিক কৌতূহলের প্রকাশ। প্যারিসে থাকাকালীন অমৃতা সাধারণত ন্যুড এবং পোর্ট্রেটই আঁকত আর তার সবই প্যারিসের প্রভাবে। কিন্তু পরের যেসব ছবি দেখলাম তা ভিন্ন প্রভাবের, তাতে মানুষের জীবন বিধৃত।
ভারতের টানে
অমৃতা ভারতে ফিরতে চাইলেন। নিজের শিল্পবোধের অভ্যুদয় নিয়ে তিনি লিখলেন, ‘১৯৩৩-এর শেষদিক থেকে ভারতে ফিরে যাবার তীব্র ইচ্ছে আমাকে তাড়িয়ে বেড়াতে শুরু করল, অবর্ণনীয় এক অনুভূতি আমাকে জানিয়ে দিল চিত্রশিল্পী হিসেবে আমার নিয়তি ভারতেই নির্দিষ্ট। … আমার আঁকা ছবিতে রঙের ঐশ্বর্যপূর্ণ ব্যবহার দেখে আমার অধ্যাপক প্রায়ই বলতেন, পশ্চিমের মলিন স্টুডিওতে আমার যে ধাত তার বিকাশ ঘটছে না, প্রাচ্যের রং ও আলোর সত্যিকার পরিবেশে আমার শৈল্পিক ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটবে।’
ভারতের জন্য প্রবল আকুতি সত্ত্বেও তিনি স্বীকার করেছেন, প্যারিসই তাঁকে নতুন করে শিল্পের দীক্ষা দিয়েছে।
তিনি লিখেছেন, ‘আধুনিক চিত্রকলাই আমাকে ভারতীয় পেইন্টিং ও ভাস্কর্য অনুধাবন ও মূল্যায়নে সমর্থ করে তুলেছে। এটা আমার মনে হতেই পারে, কিন্তু এতটা পথ পেরিয়ে ইউরোপ না এলে আমি কখনো অনুধাবনই করতে পারতাম না যে অজন্তা গুহার দেয়ালচিত্র আর গিমে জাদুঘরের ছোট ভাস্কর্য যে গোটা রেনেসাঁর চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’
ঠাকুরের ড্রইং
অমৃতার প্যারিসবাস তাঁকে পেইন্টিংয়ের পাশাপাশি ফ্রেসকো টেকনিক, ভাস্কর্য এবং কপার এনগ্রেভিংও শিখিয়েছে। বার্ষিক পোর্ট্রটে ও স্টিল লাইফ প্রতিযোগিতায় তিনি টানা তিন বছর পুরস্কৃত হয়েছেন। ওমরাও সিং মেয়ের কথা লিখছেন :
স্যালোন আর্টস স্টুডেন্টস সার্কেল অব ওমেনের প্রদর্শনীতে অমৃতার ছবি দেখতে আমরা থিয়েটার পিগালেতে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি, একই ভবনে পাশের একটি কক্ষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আধুনিক ধাঁচের ড্রইং প্রদর্শনী চলছে। আমরা তা দেখতে গেলাম। আধুনিক শিল্পীরা যে অদ্ভুত বিকৃত শৈলী ব্যবহার করে আঁকেন, যার নজির আমরা পাশের কক্ষগুলোতে দেখেছি, রবীন্দ্রনাথের ছবিও সেরকমই। আর ঠাকুরের কাজ নিয়ে অমৃতা মন্তব্য করল, ‘তাঁর ড্রইংগুলো আমার কাছে তাঁর কবিতার চেয়েও বেশি পছন্দের।’
প্রেমিক ও স্বামী ভিক্টর
ভিক্টর এগানকে লেখা চিঠি থেকে :
অমৃতা তখন প্যারিসে, ভিক্টর হাঙ্গেরিতে। ভিক্টরকে ১৯৩৮ সালে বিয়ে করেন। ভিক্টরকে লেখা চিঠিগুলোতে শিল্পের জন্য তাঁর সংগ্রাম, নিজের সঙ্গে দ্বন্দ্ব, ভিক্টরের জন্য ভালোবাসা, নিজের ব্যক্তিত্বের সংকটসহ অব্যক্ত এক অমৃতা প্রীতম উঠে এসেছেন। তিনি লিখেছেন : কখনো কখনো এমন হয় আমি কাজের মধ্যে ঢুকে পড়ি। তখন দিনরাত অবিরাম কাজ করে যাই।
কিংবা আমি অন্য মানুষকে জয় করতে পারি কিন্তু নিজেকে জয় করতে পারি না – এ এক বিদঘুটে অবস্থা। গৌরব কিংবা সম্ভবত আমার অহংকারকে আমি পরাস্ত করতে পারি না। আমার দুর্বলতা স্বীকার করে সাহায্য চাওয়ার বদলে আমি বরং ধ্বংস হয়ে যাব।
কয়েকটি চিঠির নমুনা
মার্চ ১৯৩১
তুমি একজন সৎ মানুষ এবং বিনয়ের কোনো ভণিতা না করে আমি বলছি, আমি তোমার যোগ্য নই। আমি শিল্পী হিসেবে যোগ্য এটা প্রমাণ করার মতো আমার অনেক সুযোগ ছিল। কিন্তু মানুষ হিসেবে নিজেকে অযোগ্য মনে হয়। আমার অনেক ত্র“টি-বিচ্যুতি, কিংবা আমি হয়তো এতটুকুই জানি যে, আমার চরিত্রের অনেক দুর্বল দিক রয়েছে। একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় – আমার যে দুর্বলতা আছে, সে সম্পর্কে আমি সচেতন।
১৯৩১ (মাস উল্লেখ নেই)
বাবা ও মা আমার সম্পর্কে যেসব কথা বলে থাকেন তারপরও কেউ আমাকে এতটা ভালোবাসে যে আমাকে বিস্মিত হতে হয়। মাঝে মাঝে আমি নিজেকে খুব জঘন্য ভাবতে শুরু করি – সম্ভবত তাঁরাই ঠিক আর আমি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন একজন মানুষ। আমি অবাক হই এবং বিশ্বাস করতে পারি না যে, কেউ আমাকে এতোটা ভালোবাসে। কখনো কখনো মনে হয় তাঁরা যা বলছেন তা সত্যি, বকাঝকা আমার প্রাপ্য এবং আমার সম্পর্কে তাঁদের ভবিষ্যদ্বাণী ফলতে যাচ্ছে (ব্যাপারটা কত ভয়াবহ ভেবে দেখো!)। বিদ্বেষপরায়ণ অঙ্গুলি উঁচিয়ে আমাকে দেখিয়ে বলবে, ‘আমরা বলিনি ঘৃণ্য চরিত্রের জন্য অমৃতার বিয়েটা শুরুতেই ভেঙে যাবে?’ আমার সকল প্রচেষ্টার পরও আমাকে নিয়ে যেসব কথাবার্তা তার বিরুদ্ধে লড়াই করে আমি প্রমাণ করতে সমর্থ নাও হতে পারি যে, আমি নোংরা, উদ্ধত, অকৃতজ্ঞ মানুষ নই। আমি ইন্দু (বোন ইন্দিরা) ও তার বন্ধুকে আঁকছি, অন্য প্রান্তে একজন মডেলকে আঁকছি – সে একটা কিছু পরিষ্কার করছে। চিঠির সঙ্গে এর একটি ছবি পাঠিয়ে দিচ্ছি। দেখতেই পাচ্ছ, ছবির মেয়েটি বিষণœ। আমার ছবিতে এই বিষণœতাকে তুলে ধরছি। মডেলের শরীরের সাদা রং – তার বিপরীতে তারুণ্য, শক্তি, বাদামি চুল, লাল গাল, লাল পোশাক। এই বড় থিমের চিন্তাটি আমাকে উদ্দীপিত করছে। … আমি আমার সৌন্দর্যকে উপভোগ করব, কারণ সৌন্দর্য বড় সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য আমাকে দেওয়া হয়েছে; সৌন্দর্য বড় স্বল্পজীবী একটি বিষয়। যাকগে, ঈশ্বরকে অনেক ধন্যবাদ – তিনি আমাকে সৌন্দর্য ছাড়া আরো কিছু দিয়েছেন।
জানুয়ারি ১৯৩২
যে পথ আমাকে আমার লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যাবে আমি সে পথেই এগিয়ে যাব – তা হচ্ছে পেইন্টিং, যা আমার সত্তাকে ভরিয়ে দেয়। আরো অনেক নিশ্চয়তার সঙ্গে আমি আমার ডাক শুনতে পাই – সম্ভবত আমার একমাত্র ডাক।
অপ্রতিরোধ্য শক্তি দিয়ে আমি অনুভব করি, বিয়ে আমার জন্য নয়, আমি জন্মগ্রহণ করেছি শিল্পের জন্য।
গতকাল স্থির-জীবন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছে, আমি দ্বিতীয় পুরস্কার পেয়েছি।
মে ১৯৩৩
আমি স্যালোনের এক্সট্রা-অর্ডিনারি সদস্য নির্বাচিত হয়েছি। অবশ্য তাদের যে আমি খুব বড় মনে করি তা নয়, তারা বেশ উদ্ধত – তবে এর সুবিধে হলো জুরিদের বিচার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে না গিয়ে আমৃত্যু প্রতিবছর আমার দুটো করে ছবি প্রদর্শনের সুযোগ পাব। আমি তাতেই খুশি – আমি উপযুক্ত মনে করি এমন ছবিই বেছে নিতে পারব, স্যালোনের অনুমোদন অনুযায়ী নয়। আমি আগামী বছরের জন্য দুটো বড় কম্পোজিশনের পরিকল্পনা করেছি – এতে অনেক মানুষ থাকবে, আর ছবিগুলো হবে একটি শিল্পশালা নিয়ে। এক কোণে থাকবে একদল মানুষ আর থাকব আমি ছদ্মবেশ নিয়ে – অন্য একজন ব্যক্তি হিসেবে।
আগস্ট ১৯৩৩
… আমি নিশ্চিত, আমি আগের চেয়ে ভালো ছবি আঁকছি। আমার নিজের সম্পর্কে এবং কাজ সম্পর্কে আমি আগের চেয়ে নিশ্চিত যে আমার কাজ আর আমার মনের অবস্থার ওপর নির্ভরশীল নয়। কিন্তু একটা প্রশ্ন আমাকে পাগল করে তোলে : শান্ত থেকে কি সত্যিকারের শিল্প সৃষ্টি করা যায়? …
১০ অক্টোবর ১৯৩৩
তুমি লিখেছ, তুমি চক্ষু সার্জন হতে যাচ্ছ না। ঠিকই করেছ। তোমার যা করতে ইচ্ছে করে সবসময় কেবল তা-ই করবে। আমিও আশা করব, আমার যেন সবসময় সেই শক্তি থাকে, যা আমাকে দিয়ে ইচ্ছের সঙ্গে সংগতি রেখে কাজ করিয়ে নেবে। তুমি যদি ইচ্ছের বাইরে অন্য কিছু করো তুমি সবসময়ই উদ্বিগ্ন হয়ে থাকবে, নিজেকে নিয়ে তোমার অতৃপ্তি থেকে যাবে। সারাজীবন তোমাকে নিজের কাছে সৎ হতে হবে। এতে সফল না হলে ব্যাপারটা ভয়ানক হয়ে উঠবে। সাফল্যের জন্য পছন্দটা তোমাকেই করতে হবে। নতুবা ক্রোধের অনুভূতি তোমাকে পেয়ে বসবে, অসহায় ক্রোধ – অন্যেরা তোমাকে যা করতে বলছে, তুমি তা-ই করে যাচ্ছ।
সিমলা, ফেব্র“য়ারি ১৯৩৫
আমি সুখী, কারণ আমি অনেকগুলো কাজ করেছি। এখানে ফিরে আসার পর আমার অনেকটা উন্নতি হয়েছে। আমি ভিন্নভাবে ভিন্ন শৈলীতে স্বাভাবিকভাবে এঁকে যেতে পারি। সবকিছু খুব সহজভাবে আসে। প্যারিসে রয়ে গেলে আমি এটা অর্জন করতে পারতাম না – শৈলীর জন্য সেখানে আমি যে কসরত করছিলাম তা স্বাভাবিক ছিল না আর জোর করে তা চাপানোটাকে আমি ঘৃণা করেছি। কিন্তু একটা কিছু আমাকে শ্বাসরুদ্ধ করে চলছিল, আমি সানন্দে কাজ করতে পারিনি। ভেরোসে (হাঙ্গেরি) কাটানো দু-তিন মাস সময় ছাড়া ধূসর ধোঁয়া ও গভীর ধূসর স্থাপনা ও পরিবেশ আমাকে অনেক ভুগিয়েছে। সেখান থেকে মুক্ত হয়ে আমি এখন বর্ণিল পোশাকের ওপর দৃষ্টি দিতে পারছি, বিশেষ করে আমার দৃষ্টিসীমায় পেইন্টিংস আর পেইন্টার নেই। আমি এখন নিঃশ্বাস নিতে পারি, আমি চলতে পারি, আমি আঁকতে পারি।
ম্যালকম পর্ব
ব্রিটিশ সাংবাদিক ম্যালকম মাগারিজের সঙ্গে অমৃতার দেখা ১৯৩৫-এর এপ্রিলে সিমলাতে। ম্যালকম তাঁকে প্রবলভাবে আন্দোলিত করেন। অমৃতা ছোট বোন ইন্দিরাকে লিখেছেন :
অসাধারণ এক ইংরেজ ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। মা তার সম্পর্কে তোমাকে অবশ্যই লিখেছে, আর তুমিও তার সম্পর্কে ভুল ধারণা নিয়ে বসে আছ। আমি যাদের সঙ্গে মিশেছি সে নিঃসন্দেহে তাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রাণবন্ত আকর্ষণীয় মানুষ।
ম্যারি লুইকে বাদ দিলে তার মতো আর কারো সঙ্গে আমার দেখা হয়নি – ম্যারির সঙ্গে অনেক বিষয়ে তারও যথেষ্ট মিল রয়েছে (তার ব্যাপারে আমার যে অনুভূতি, আমার ব্যাপারেও তার একই অনুভূতি)। আর এখানকার একঘেয়ে ও নীরস কলঙ্ক রটনাকারী জনতার মাঝে আমরা দুজন পরস্পরের কাছে তীব্র স্বস্তির মতো।
অমৃতা তাঁকে একটু বেশিই ভালোবেসেছিলেন। ম্যালকম তাঁর ডায়েরিতে যা লিখেছেন, তাতে মনে করার কারণ রয়েছে যে অমৃতা প্রতারিতই হয়েছেন। অমৃতার সান্নিধ্যকে একদিকে আনন্দদায়ক অন্যদিকে ক্লান্তিকর বলেছেন। অমৃতার মাকে বলেছেন – ভয়ংকর কুরুচিপূর্ণ হাঙ্গেরিয়ান ইহুদি নারী। কলকাতার স্টেটসম্যানের চাকরি ছেড়ে লন্ডনে ইভনিং স্ট্যান্ডার্ডে যোগ দেবার জন্য ভারত ছাড়ার ঘটনাটিকে তিনি দেখেছেন ‘মুক্তি’ হিসেবে।
বিদায়ের দিনটি উঠে এসেছে তাঁর ডায়েরিতে :
আমাকে বিদায় জানাতে অমৃতা খুব ভোরে স্টেশনে এলো – এটা তার জন্য অত্যন্ত অস্বাভাবিক সময়। আমরা দুজন প্ল্যাটফর্ম ধরে এ-প্রাপ্ত ও-প্রান্ত হাঁটাহাঁটি করলাম যতক্ষণ না বন্ধুর পথের ছোট ট্রেনটির ছাড়ার সময় হয়। জানালাপথে আমরা কথা বলতে থাকলাম তীক্ষè হুইসেল বেজে যতক্ষণ না ট্রেনটি চলতে শুরু করে। আমরা কৃত্রিম কথোপকথন চালিয়ে গেলাম। অমৃতা বলল, আমাদের কতগুলো মধুর মুহূর্ত রয়েছে – তা সত্যি; আবার কতগুলো কৃষ্ণ মুহূর্তও আছে। আমি জানালাপথে বাইরে তাকিয়ে যতক্ষণ না সে দৃশ্যের বাইরে চলে যায়, হাত নাড়তে থাকলাম। আমি জানতাম, তার সঙ্গে আমার আর কখনো দেখা হবে না। আমি শুনেছি ১৯৪১-এ মাত্র সাতাশ বছর বয়সে (আসলে আঠাশ) অমৃতার রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে। পরে এটাও শুনেছি, তার মা আত্মহত্যা করেছে। দুটো মৃত্যুর কোনোটাই আমাকে বিস্মিত করেনি।
পাশ্চাত্যে নয়, প্রাচ্যে
অমৃতা শেরগিলের বোনের ছেলে ও খ্যাতিমান শিল্পী ও অমৃতার জীবনীকার ভিভান সুন্দরম্ লিখেছেন :
ইউরোপে থাকাকালীন অমৃতা প্রতিবছরই হাঙ্গেরি যেতেন – একদিকে প্যারিস ও ফরাসিদের কাছ থেকে দূরে থাকতে (প্যারিস ও ফরাসিদের জন্য তাঁর বড় কোনো ভালোবাসা গড়ে ওঠেনি) এবং অন্যদিকে হাঙ্গেরির গ্রামাঞ্চলে নিজের মানুষদের সান্নিধ্য লাভ করতে। তাঁর কাছে হাঙ্গেরি ভালোবাসা ও সৌন্দর্যের দেশ আর এখানকার সরল ও সৎ কৃষক, তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি তাঁর বিশেষ প্রিয়। …
প্যারিসে আধুনিক চিত্রশিল্পের অভ্যুদয় ঘটেছে এমন একটি সমাজ থেকে যেমন ধনতন্ত্রের ঐতিহাসিক বিকাশ একটি সাম্রাজ্যবাদী স্তরে এসে পৌঁছেছে। এখানে আধুনিক চিত্রকলার অনেক নিরীক্ষা প্রযুক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আর এর ধরন অনেক ক্ষেত্রে যান্ত্রিকতা এবং সমাজের অমানবিকীকরণ প্রতিফলিত করে। অমৃতা যে পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন, সেখানে এসব সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। তিনি যখন প্যারিসে গেলেন বিংশ শতক হয়ে উঠল কেবল তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা।
তার মানে এই নয় যে, সমকালীনতা এবং শিল্প-সংস্কৃতির অগ্রগামী আন্দোলন সম্পর্কে তিনি বিস্মৃত ও প্রতিক্রিয়াশীল ছিলেন। তিনি আগ্রহ নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, তাঁর পছন্দের লেখকদের মধ্যে ছিলেন বোদলেয়র, ভ্যালেরি, দস্তোয়ভস্কি, থোমাস মান, জেমস জয়েস, ডি এইচ লরেন্স এবং আদ্রে আদি ও ডেজো সাজবোর মতো লেখক। তাঁর সাহিত্যরুচি উপন্যাসের অন্তর্দর্শী ও মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ের প্রতি তাঁর আগ্রহকে প্রকাশ করে। অমৃতার প্রিয় উপন্যাসের তালিকায় ছিল : দস্তোয়ভস্কির দ্য ব্রাদার্স কারামাজোভ, দ্য ইডিয়ট এবং দ্য পসেসড; থোমাস মানের দ্য ম্যাজিক মাউন্টেন এবং মার্শেল প্র“স্তের সোয়ানস ওয়ে ও রিমেমব্র্যান্স অব পাস্ট থিংস।
অমৃতা ভারতে ফিরে এলেন কারণ প্যারিসগমনের প্রাথমিক উত্তেজনা মিইয়ে যাবার পর মেট্রোপলিশে তাঁর অভিজ্ঞতা যন্ত্রণাদায়ক। তাঁর রোমান্টিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রাবল্য পশ্চিমের সমাজ ও শিল্পের যে বিপুল পরিবর্তন তা প্রত্যাখ্যান করে। তাঁর আনুষ্ঠানিক শিল্প মনোজগৎ সময়ের চেয়ে তিরিশ বছর পিছিয়ে; তিনি সম্ভবত অনুধাবন করতে পেরেছেন নিজেকে এগিয়ে নিয়ে প্যারিসের আধুনিক চিত্রকলায় গুরুত্বপূর্ণ কোনো অবদান রাখা তাঁর পক্ষে অসম্ভব। তিনি জানতেন ভারতের চিত্রকলায় তেমন গুরুত্বপূর্ণ কেউ নেই, সেখানে কাজ করার প্রয়োজনই বেশি : তাঁর লক্ষ্যই তাঁকে আত্মানুসন্ধানের জন্য ভারতে ফিরে যেতে তাগিদ দিতে লাগল। ক’বছর পর তিনি ঘোষণা করলেন, ‘ইউরোপ পিকাসো, মাতিসে এবং অন্যান্যের, ভারত কেবল আমার।’
অমৃতার প্যারিসজীবনে তাঁর ওপর যাঁদের স্পষ্ট প্রভাব পড়েছে তাঁরা হলেন পল সেজান, পল গঁগা এবং তাঁর শিক্ষক লুসিয়েন সিমো।
অমৃতার বিয়ে
বিয়ে তাঁর জন্য নয় – এ কথা ভিক্টর এগানকে লেখা চিঠিতে যেভাবেই বলুন না কেন প্যারিস থেকে ভারতে ফিরে এসে সিমলায় অবস্থানের দিনগুলোতে ছবি আঁকার পাশাপাশি বিয়ের কথাও ভাবতে শুরু করেন। এ পর্যন্ত নিঃসঙ্গ একক জীবন তাঁর ভালোই কাটছিল। কিন্তু যখন ভবিষ্যতের দিকে তাকান নিজেকে ‘নিঃসঙ্গ বুড়ি’ হিসেবে কল্পনা করে আতঙ্কিত হন।
শৈশব থেকেই তিনি জেনে এসেছেন, একদিন তাঁর প্রিয়তম বন্ধু এবং মামাতো ভাই ভিক্টর এগানকে বিয়ে করবেন। তিনি এক বন্ধুকে লিখলেন, আমি নিজেকে ভালোভাবেই বোঝাতে সক্ষম হয়েছি যে, বিয়ে করার জন্য আমার জন্ম হয়নি। কিন্তু আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি … আমি কোনো আদর্শ স্ত্রী হতে পারব বলে মনে করি না।’ অমৃতার জীবনীগ্রন্থ থেকে একাংশ :
ভিক্টর তখন হাঙ্গেরিতে, তখনো চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করছে। দুজনই সম্মত হন যত শিগগির সম্ভব অমৃতা হাঙ্গেরিতে ফিরে আসার এবং ভিক্টরের মেডিক্যাল স্কুল শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রায় দেড় বছর সেখানেই থাকবেন। অমৃতা এটাও স্পষ্ট করে জানালেন, তারপর দুজনেই ভারতে ফিরে যাবেন কারণ তিনি কেবল ভারতেই ছবি আঁকার কাজটি করতে পারবেন, ইউরোপে নয়।
অমৃতার মা-ই একসময় এই যুগলকে কাছাকাছি হবার সুযোগ করে দেন। দুজনের বিয়ের প্রস্তাবটি তাঁরই। কিন্তু অমৃতা যখন মা-বাবাকে জানালেন যে, তিনি ভিক্টরকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন, তাঁরা পুরোপুরি বিরুদ্ধে চলে গেলেন। তাঁর মা চাইলেন, অমৃতা ধনাঢ্য ও সামাজিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত কাউকে বিয়ে করুক; বাবার অসম্মতি এত নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে বিয়েতে। বিয়ের যে সিদ্ধান্তই তিনি গ্রহণ করে থাকুন না কেন, তাঁর প্রণয়প্রার্থীদের তিনি তেমন প্রত্যাখ্যান করেননি। সিমলাতে স্বল্পকালীন অবস্থান ওয়াল্টার কলিন্স নামের এক ইংরেজ যুবকের সঙ্গে তার নৈকট্যের সুযোগ সৃষ্টি করে। তিনি তাঁর সঙ্গে মানসিক ও শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে যান। হাঙ্গেরিতে যাবার পথে তিনি নিশ্চিত হন যে, তিনি গর্ভবতী হয়ে পড়েছেন। তিনি চাইলেন জাহাজেই তাঁর গর্ভপাতের ব্যবস্থা করা হোক। জাহাজের ডাক্তার চেষ্টা করলেন, কিন্তু সফল হলেন না। অমৃতার জীবনীগ্রন্থ থেকে :
জাহাজ যখন নেপলসে ভিড়ল তিনি অবাক হয়ে দেখলেন ভিক্টর তাঁর জন্য প্রতীক্ষা করছেন। ভিক্টরও জাহাজে উঠলেন এবং তাঁরা একসঙ্গে জেনোয়া পর্যন্ত সফর করলেন – অমৃতার গর্ভধারণের কোনো প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলো না। জেনোয়াতে নেমে তাঁরা একসঙ্গে রাত কাটালেন এবং পরদিন বুদাপেস্টের ট্রেন ধরলেন। ১৯৩৮-এর জুলাই মাসের প্রথম দিকে তাঁরা বুদাপেস্ট পৌঁছলেন, অবস্থান করলেন ভিক্টরের মায়ের দু’রুমের ফ্ল্যাটে। … হাঙ্গেরির জন্য সময়টা মোটেও শান্তিপূর্ণ ছিল না। নাৎসিরা হাঙ্গেরির সীমান্তে। হাঙ্গেরি ও চেকোস্লোভাকিয়া নিজেদের মধ্যে বিরোধে জড়িয়ে। ভিক্টরের চাচা, একজন সরকারি কর্মকর্তা দুজনকে সতর্ক করে দিলেন যে যুদ্ধ আসন্ন এবং তাদের অবিলম্বে ভারতে চলে যাওয়া উচিত। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সতর্কবার্তা এলো দেরিতে; সংরক্ষিত সেনাসদস্য হিসেবে ভিক্টরের ডাক পড়ল।
শিগগিরই অমৃতার রক্তপাত শুরু হলো এবং বড় একটি জমাটবাঁধা রক্তখণ্ড বেরিয়ে এলো। অমৃতার স্বাস্থ্য নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ভিক্টর পরীক্ষার জন্য এটি মেডিক্যাল ল্যাবরেটরিতে পাঠালেন। তিনি জানলেন, এটি একটি মৃত ভ্রƒণ। অমৃতার গর্ভধারণ তাঁদের সম্পর্কের ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। প্রথম সুযোগে ভিক্টর যখন রেজিমেন্ট থেকে বুদাপেস্টে ফিরলেন, ১৬ জুলাই ১৯৩৮ রেজিস্ট্রার অফিসে তাঁদের অনাড়ম্বর বিয়ে সম্পাদিত হলো। পরদিনই ভিক্টরকে তাঁর রেজিমেন্টে যোগ দিতে হয়। মেডিক্যাল কোরের ডাক্তারদের সীমান্তে পাঠিয়ে দেওয়া হলেও আরো সৈন্য নিয়োগের জন্য তাঁকে শহরেই রেখে দেওয়া হয়।
বুদাপেস্টে অমৃতার অবস্থান সুখকর হয়নি। তিনি বিষণœতায় ভুগতে থাকেন। এর মধ্যে শহরতলি ও গ্রামে ঘুরে ঘুরে যা কিছু তাঁর মনে লাগে তার স্কেচ করতে থাকেন। হাঙ্গেরির স্মৃতি নিয়ে আঁকা তাঁর কয়েকটি স্মরণীয় ছবি ‘হাঙ্গেরিয়ান মার্কেট প্লেস’, ‘উইন্টার সিন’, ‘হাঙ্গেরিয়ান চার্চ স্টিপল’, ‘দ্য পটেটো পিলার’, ‘ন্যুড’, ‘হাঙ্গেরিয়ান পেজেন্ট’ এবং ‘টু গার্লস’।
প্রত্যাবর্তন ভারতে
রণাঙ্গন এড়াবার জন্য ভিক্টর দীর্ঘ ছুটি নিয়ে সস্ত্রীক দেশত্যাগ করেন। ১৯৩৯-এর জুন মাসের মাঝামাঝি কলম্বো হয়ে ভারত এসে পৌঁছেন। তারপর শুরু হয় নবদম্পতির অর্থনৈতিক সংগ্রাম। ডাক্তার হিসেবে ভিক্টরের মাসিক আয় একশত ষাট রুপি, আর অমৃতার মা মেয়ের জন্য প্রতিমাসে সরবরাহ করতেন একশো রুপি – ভালো জীবনযাপন করার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হতে শুরু করে। যুদ্ধ ও বিষণœতা দুজনের জীবনকেই জটিল ও দুঃসহ করে তোলে। অমৃতার ছবি নিয়ে প্রশংসার বন্যা বয়ে যায়। কিন্তু তা বিক্রি হয় না। অমৃতা রং-তুলি থেকে হাত গুটিয়ে নিতে শুরু করেন। ভিক্টরের সঙ্গে সম্পর্ক শীতল হতে থাকে। মানুষ সম্পর্কে তাঁর বিপুল আগ্রহ দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে। মানুষের কাছে আর যেতে ইচ্ছে করে না। ১৪ মার্চ ১৯৪১ বোন ইন্দিরাকে লেখেন, ‘আমি নার্ভাস ক্রাইসিসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, এখনো তা অতিক্রম করতে পারিনি। আমি সৃজনহীন হয়ে পড়ছি, অসন্তুষ্ট হচ্ছি, বিরক্তি আমাকে ঘিরে রেখেছে, আমি এমনকি কাঁদতেও পারছি না।
ভিক্টর ও অমৃতা লাহোরে চলে আসেন। অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়। এই দম্পতি একটি ছোট ফোর্ড কার কিনতে সমর্থ হয়।
রাভিতে দেহভস্ম
৩ ডিসেম্বর ১৯৪১ অমৃতা অসুস্থ হয়ে পড়েন। ডাক্তার স্বামী ভিক্টরের মতে তিনি আমাশয়ে ভুগছিলেন। তাঁর অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটে এবং তিনি অজ্ঞানাবস্থায় চলে যান। ৬ ডিসেম্বর অবস্থার চরম অবনতি ঘটলে যখন ডাক্তার রঘুবীর সিংকে ডাকা হয়, তিনি বলেন, অনেক দেরি হয়ে গেছে। ভয়াবহ জলশূন্যতা ও পেরিটোনাইটিসে তাঁর অন্ত্র বিক্ষত হয়ে যায়। ভিক্টর যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করেননি এই অভিযোগও ওঠে। ৭ ডিসেম্বর ১৯৪১ রাভি নদীর তীরে শিখ শ্মশানে মা-বাবাসহ অল্পসংখ্যক বন্ধু ও স্বজনের উপস্থিতিতে মাত্র আঠাশ বছর বয়সে তখনকার ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী অমৃতা শেরগিলের চিতায় অগ্নিসংযোগ করা হয়। পরদিন তাঁর দেহভস্ম ছড়িয়ে দেওয়া হয় রাভি নদীর স্রোতে।