আ বু ল ম ন সু র
আমাদের দৃশ্যকলার ক্রমযাত্রাপথের এক ক্রামিত্মলগ্নে সম্ভবত আমরা দাঁড়িয়েছি যখন বিবিধ বিচিত্র উপায় ও উপকরণ আমাদের সামনে নানান পথের ইশারা সাজিয়ে রেখেছে। অনুমিতভাবেই এর প্রায় সবই এসেছে পশ্চিম থেকে এবং স্বাভাবিকভাবেই আমাদের বিবিধ বয়েসি শিল্পীকুলের একটি উলেস্নখযোগ্য অংশ এসবের দ্বারা আন্দোলিত অনুপ্রাণিত হয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ শিল্পকর্ম উপহার দিচ্ছে। শিল্পনামীয় এ সকল উপস্থাপন কতটা তাদেরই রয়ে যাচ্ছে আর কতটা আমাদের হয়ে উঠতে পারছে সেটি নিয়ে অবশ্য কারো তেমন মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। আমাদের পূর্ববর্তী সময়কালসমূহে, বিশেষ করে পঞ্চাশের দশকে, যখন আমাদের প্রথম প্রজন্মের শিল্পীকুল পশ্চিমের বিভিন্ন দেশে উচ্চতর শিক্ষা নিতে গিয়ে তখন সপ্রচল বিমূর্ততার সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগে বিমোহিত হয়ে পড়েছিলেন এবং দেশে ফিরে বিমূর্ততাই আধুনিকতা বলে একটি ভ্রামত্ম ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এখনো সে ধরনের একটি সংকটের মধ্যে আমরা নিপতিত হতে চলেছি কি না তা ভেবে দেখা দরকার।
মাঝবয়েসি ও তরম্নণ শিল্পীদের অনেকেই এখন ইনস্টলেশন, ভিডিও ও পারফরম্যান্সের দিকে ঝুঁকেছেন। এটি অস্বাভাবিক বা অন্যায্য নয় এবং কেউ কেউ এসব মাধ্যমে উৎকৃষ্ট শিল্পসৃষ্টিও করছেন। গতানুগতিকের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে নতুন সৃজনপথের অনুসন্ধানও নিশ্চয় আমাদের চারম্নশিল্পের চলিষ্ণুতার প্রমাণ। কিন্তু এখানেও সমসাময়িক থাকার বিভ্রামিত্মকর উপলব্ধির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে চিত্র বা ভাস্কর্য সৃষ্টিতে প্রতিশ্রম্নতিশীল কিছু কিছু তরম্নণ ইনস্টলেশন বা পারফরম্যান্স করবার চেষ্টা করছেন। চিত্র রচনায় যে তরম্নণ শিল্পীটি যথেষ্ট প্রতিভার পরিচয় রাখছেন তিনিও যখন পারফরম্যান্স করার অপটু প্রয়াস চালাতে থাকেন তখন পঞ্চাশের দশকের মতোই একটি প্রপঞ্চময় সংকটের পদধ্বনি যেন আবারো শোনা যায়। এধরনের পরিস্থিতিতে অবস্থার বিচক্ষণ বিবেচনার মাধ্যমে স্থানিক চেতনা ও কালিক সচেতনতার সমন্বয় সাধন করে সমকালের আপন অভিব্যক্তি নির্মাণ করতে পারাই যথার্থ শিল্পীর অনুসন্ধান। বলা চলে পঞ্চাশের দশকে এ সংকট উত্তরণের পথ আবিষ্কারে শিল্পী রশিদ চৌধুরী একটি পথনির্দেশকের ভূমিকা পালন করেছিলেন। পাশাপাশি নভেরা আহমেদ ও কাইয়ুম চৌধুরীর কাজেও এ প্রয়াস আভাসিত হচ্ছিল বটে, তবে বলা চলে যে রশিদ চৌধুরীর শিল্পশৈলীতেই আমরা প্রথম লক্ষ করি সমকালের সঙ্গে স্বভূমির এক সফল সম্মিলন। আজ প্রায় একই রকম এক সংকটের দৃশ্যপটে অবস্থান করে ১ এপ্রিল রশিদ চৌধুরীর জন্মদিনকে উপলক্ষ দাঁড় করিয়ে তাঁর শিল্পপ্রয়াসের একটি নবতর পাঠের আয়োজন হয়তো অপনোদনে সহায়ক হবে আমাদের বর্তমান দিশাহীনতার।
বাংলাদেশে চারম্নশিল্পের চর্চা সূচিত হয়েছে ১৯৪৮ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন কর্তৃক ঢাকায় আর্ট ইনস্টিটিউট স্থাপনের মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে পঞ্চাশের দশকজুড়ে যাঁরা এ শিক্ষালয়ে শিল্পশিক্ষা নিয়েছেন তাঁদের মোটাদাগে পঞ্চাশের দশকের শিল্পী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ দলে রয়েছেন আমিনুল ইসলাম, মুর্তজা বশীর, হামিদুর রাহমান, রশিদ চৌধুরী, কাইয়ুম চৌধুরী, দেবদাস চক্রবর্তীর মতো খ্যাতিমান চিত্রশিল্পীরা, আর কলকাতা থেকে পড়ে আসা এঁদের সমসাময়িক মোহাম্মদ কিবরিয়া এবং য়ুরোপে শিল্পশিক্ষা নিয়েও এদেশের তৎকালীন শিল্পজগতে আলোড়ন তোলা নভেরা আহমেদ। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশে উচ্চতর শিক্ষার জন্য বিদেশ গমনের সুযোগ এঁদের অনেকেই লাভ করেছিলেন এবং সে সূত্রে পশ্চিমের সমকালীন শিল্পের সঙ্গে প্রথমবারের মতো এদেশীয় শিল্পীর ঘটে সরাসরি পরিচয়।
রশিদ চৌধুরীর সমসময়ের পঞ্চাশের দশকের অধিকাংশ শিল্পীই তখনকার পাশ্চাত্য শিল্পে সপ্রচল অভিব্যক্তিবাদী বিমূর্ততাকেই আধুনিক হওয়ার অন্যতম উপাদান হিসেবে মনে করেছেন এবং এ শিল্পের চর্চার ভেতর দিয়ে একটি নিজস্ব শৈলী অর্জনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা লাভের উপায় অনুসন্ধান করেছেন। এটি মানতেই হবে যে এঁদের অনেকেই ছিলেন যথেষ্ট প্রতিভাবান এবং আমাদের শিল্পকলাজগতের একটি পালাবদল এঁদের হাত দিয়েই ঘটেছে। আমত্মর্জাতিক শিল্প অঙ্গনের সঙ্গে এ অঞ্চলের মানুষের পরিচয় ঘটিয়েছেন এঁরা এবং নিজেদের কাজে তার মোটামুটি মানসম্পন্ন উদাহরণও সৃষ্টি করেছেন। তবে এসব ইতিবাচকতার বিপরীতে এঁরাই আবার শিল্পের সঙ্গে দর্শকের একধরনের বিচ্ছিন্নতারও সূচনা ঘটিয়েছেন, যা নানানভাবে আমাদের শিল্পজগতের অঙ্গাঙ্গী বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। এঁরা যে নির্বস্ত্তকতার চর্চা করেছেন তার পেছনে পশ্চিমা বিমূর্ততাবাদীদের মতো কোনো তাত্ত্বিক ভাবনা বিশেষ কাজ করেনি এবং অনেক সময়ই এগুলি আমাদের প্রেক্ষাপট ও প্রাসঙ্গিকতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বলা যাবে না। এসব ছবি প্রায়শই কোনো গভীর ভাবনা বা বক্তব্য প্রকাশের প্রণোদনা থেকে সৃষ্ট নয়, কারিগরি কুশলতার অভ্যসত্মতায় দৃষ্টিসুখকর তলনির্মাণ মাত্র।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে শিল্পজগতের এ অবস্থার প্রেক্ষাপটে রশিদ চৌধুরীর স্বাতন্ত্র্য অনুধাবনের চেষ্টা করা যেতে পারে। প্রথমত তাঁর ব্যক্তিজীবন থেকে কিছু বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ঘটনার প্রতি দৃষ্টিক্ষেপ করা যায়, যার মাধ্যমে হয়তো রশিদ-চরিত্রের ভিন্নতার একটি ইঙ্গিত আমরা পেয়ে যেতে পারি। কারণ যে-কোনো সৃজনকর্মেই কোনো না কোনোভাবে স্রষ্টার অমত্মর্নিহিত চরিত্রেরই বহিঃপ্রকাশ বটে। এমনও বলা হয়ে থাকে যে, সকল সৃষ্টিই আসলে শিল্পীর আত্মজীবনী বই অন্য কিছু নয়। ব্যক্তিশিল্পীর চেতন-অবচেতন মনের বিচিত্র রসায়নের এক জটিল যৌগিক ফসল তার শিল্পীসত্তা, মহৎ শিল্পীর ক্ষেত্রে এ আমত্মসম্পর্ক আরো নিগূঢ় ও বহুমাত্রিক এক প্রক্রিয়া। একে সম্পূর্ণভাবে শনাক্ত করা যেমন সহজ নয়, তেমনি বিভিন্ন সময়ে এর বিভিন্ন রকম ব্যাখ্যান হতে পারে। তবু এধরনের অবলোকনের মাধ্যমেই হয়তো শিল্পস্রষ্টার জীবন ও শিল্পকর্মের একটি অর্থবহ মূল্যায়ন প্রণীত হতে পারে।
রশিদ চৌধুরীর জীবনপঞ্জির দিকে তাকালে আমরা কিছু কিছু ঘটনা লক্ষ করব, যেসব তাঁর স্বাতন্ত্র্যকে চিহ্নিত করতে সহায়ক হতে পারে। ফ্রেস্কো, ভাস্কর্য ও ট্যাপিস্ট্রি বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে প্রথমেই তিনি জানান দিচ্ছেন গতানুগতিক তৈলচিত্র অঙ্কনের পথে তিনি পা বাড়াচ্ছেন না। পরবর্তী সময়ে ট্যাপিস্ট্রিকে তাঁর শিল্পসাধনার প্রধান মাধ্যম হিসেবে নির্বাচন করার মধ্যে যেমন এ মানসিকতার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে তেমনি বাঙালির অন্যতম শিল্পঐতিহ্য বয়নশিল্পের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ একটি মাধ্যম গ্রহণের দ্বারা ইতিহাসের উত্তরাধিকারকে বহনের দায়ও তিনি সচেতনভাবে নিজ স্কন্ধে নিচ্ছেন। এধরনের সচেতনতা ও ঝুঁকি গ্রহণের মানসিকতা তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে বিশেষ দেখা যাবে না। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে খ-কালীন শিক্ষকতার সময়কালে নব্য কবিগোষ্ঠী ‘না’-এর সঙ্গে সম্পৃক্ততাও তাঁর নতুনত্বসন্ধানী সচেতন মানসিকতারই পরিচায়ক। সরকারি চারম্ন ও কারম্নকলা মহাবিদ্যালয়ে প্রাচ্যকলা বিষয়ে তিনিই ছিলেন প্রথম শিক্ষক, এখানেও নতুন পথের অনুসন্ধানে তাঁর আগ্রহ প্রতিভাত। আরো পরে জীবনের মধ্যপর্বে জীবিকা ও সংসারের বিরাট ঝুঁকি নিয়ে চারম্নকলার সম্পূর্ণ অকর্ষিত একটি এলাকা চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে চারম্নকলা শিক্ষাদানের সূচনা করা, চট্টগ্রাম চারম্নকলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করা তাঁর ব্যতিক্রমী জীবনদর্শনের বৃহৎ উদাহরণ।
রশিদ চৌধুরী মূলত অবশ্যই ট্যাপিস্ট্রিশিল্পী। শিল্পের এই শাখায় তিনি গোটা ভারতীয় উপমহাদেশেই অন্যতম দিশারিশিল্পী এবং নিঃসন্দেহে আজ পর্যমত্ম অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এখানেই তিনি সবচেয়ে মৌলিক এবং আমাদের আধুনিক শিল্পধারায় শিল্পী হিসেবে গুরম্নত্বপূর্ণ। তবে ট্যাপিস্ট্রি ছাড়াও রশিদ চৌধুরী চিত্র রচনা করেছেন তেলরঙে, টেম্পেরায়, গোয়াশে এবং জলরঙে। এগুলির সংখ্যাও নেহাত কম নয়। এছাড়া স্বল্পসংখ্যক হলেও করেছেন পোড়ামাটিতে ভাস্কর্য ও বিভিন্ন মাধ্যমে ছাপাই ছবি। তাঁর সৃজনকর্মের বিবেচনায় এ সকল মাধ্যমে করা শিল্পকর্মের প্রতিও যথাসম্ভব নজর দেওয়া প্রয়োজন।
কোথা থেকে রশিদ চৌধুরী সংগ্রহ করেন তাঁর শিল্পের মালামাল? শৈশব-বাল্যের স্মৃতিতে ধরা হিন্দু-মুসলমানের গ্রামীণ সংস্কৃতির আবেশটি রশিদ চৌধুরী তাঁর চেতন-অবচেতন থেকে কখনোই পুরোপুরি মুছে ফেলেননি। পরবর্তী কর্মমুখর ও ঘটনা-উত্তাল জীবনের সঙ্গে এসবের সরাসরি সম্পর্ক ছিল সামান্যই, তবু তাঁর সৃষ্টিকর্মে ঘুরেফিরে এই কৃষি-সামমত্ম ঐতিহ্যেরই আনাগোনা – হিন্দু দেবদেবীমূর্তি, বিশেষ করে রাধাকৃষ্ণ ও দুর্গামূর্তি, ঢোলবাদন, লাঠিখেলা, মহররমের মিছিল, যাত্রা, পালাগান, পুঁথিপাঠ, কথকথা-পাঁচালি ইত্যাকার আয়োজন। সেইসঙ্গে পটের ছবি, লক্ষ্মীর সরা, আলপনা, চিত্রিত কাঁথা, শখের হাঁড়ি, মাটির পুতুল ও খেলনার গড়ন নিশ্চয়ই তাঁর মধ্যে একধরনের স্বভাবজাত আকর্ষণ নির্মাণ করতে সমর্থ হয়েছিল। তাঁর পরবর্তী শিল্পীজীবনের দিকে একটু সংবেদী ও বিশেস্নষণী দৃকপাত করলে এসবের সঙ্গে তাঁর শিল্পকর্মের একটি সম্পর্কসূত্র আবিষ্কার করা সম্ভব।
প্রাথমিক পর্বে তাঁর কাজে একদিকে পশ্চিমা আধুনিক আঙ্গিকতার বোধ ও অন্যদিকে নিজের শিকড় থেকে প্রেরণা গ্রহণের অভীপ্সার মধ্যে একটি টানাপড়েন লক্ষ করা যায়। বিষয় হিসেবে বাল্যস্মৃতি-বিজড়িত রূপকথা-কথকতা-পাঁচালির জগৎ দেখা দিতে শুরম্ন করে। এর মাঝে প্রবল প্রভাব হয়ে আবির্ভূত হন আরাধ্য শিল্পী মার্ক শাগাল। এটি তাঁর স্বকীয়তা অর্জনের পথে সহায়ক না বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল আজ তা সঠিকভাবে নিরূপণ সম্ভব নয়, কারণ শিল্পীর অমত্মর্জগতের বিনির্মাণ বিবিধ যৌগের এক জটিল রসায়ন, সেখানে কোন উপাদানটি শেষ পর্যমত্ম কার্যকর তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এই সময় থেকেই ট্যাপিস্ট্রি বা বয়নশিল্পকে তিনি তাঁর প্রধান প্রকাশমাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে শুরম্ন করেন। পরবর্তী সময়ে বিবিধ প্রভাব-প্রেরণা-অভিঘাত-অভিজ্ঞতাকে জারিত করে ক্রমশ একটি সুস্পষ্ট নিজস্বতায় উপনীত হতে সময় লেগেছে, লেগেছে একাগ্র অভিনিবেশ, আঙ্গিককুশলতা ও চৈতন্যবোধের সমন্বয়। তবে এই চূড়ামত্ম পর্বের কাজের মধ্যেই পাব সেই পরিশীলন ও সম্মিলন, যেখানে লৌকিক পুতুল-প্রতিমার ঐতিহ্যিক অবয়ব এক দ্বিমাত্রিক বিমূর্ত গড়ন ও আলোছায়ার দ্বান্দ্বিক বিন্যাসে গড়ে তোলে পূর্ণতা ও সামগ্রিকতার ঐকতান।
তবে এমনটি বলা যায় যে ট্যাপিস্ট্রির বিশিষ্ট শিল্পী হিসেবে রশিদ চৌধুরীর পূর্ণ প্রকাশ বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তরকালেই ঘটেছে, এবং এটিকেই তাঁর পরিপূর্ণ বিকশিত পর্যায় হিসেবে গণ্য করা চলে। প্রকাশমাধ্যম হিসেবে এই সময় ট্যাপিস্ট্রিতেই নিজেকে সমর্পিত করাতে এই মাধ্যমের চরিত্র ও সীমাবদ্ধতাও নিশ্চয় শিল্পীকে বাধ্য করেছিল এর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ একটি শৈলী নির্মাণ করে নিতে। বুননের মাধ্যমে নির্মিত পট তার কিছু নিজস্ব প্রয়োগবিধি মেনে চলে, সেখানে রংতুলি চালনার মতো যথাইচ্ছা বর্ণের ছায়া বা মাত্রা নির্মাণ করা সম্ভব নয়, কিছু সীমাবদ্ধ বর্ণের সমতলীয় প্রয়োগে দ্বিমাত্রিক তলে এখানে শিল্পীকে কাজ করতে হয়। ফলে পটে আকৃতি ও বর্ণের দ্বিমাত্রিক বিন্যাস অর্থাৎ ডিজাইন বা নকশার সার্বিক ঐক্যবোধ এখানে অধিক গুরম্নত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয়। রশিদ চৌধুরী এ বিষয়ে পূর্ণমাত্রায় সচেতন ছিলেন। এখানে অবশ্য পারীর আকাদমি জুলিয়াতে তাঁর শিক্ষক আধুনিক ট্যাপিস্ট্রির জনক জঁ লুরসাতের প্রসঙ্গ উলেস্নখ করা অসমীচীন হবে না। রশিদ চৌধুরীর ওপর পথিকৃৎ শিক্ষকের প্রভাব ছিল প্রভূত। বলা যেতে পারে, বয়নশিল্পের লোকজ ভিত ও এর নির্মিতিগত সংস্থাপন-জ্ঞান রশিদ চৌধুরীর ভালোরকম অধিগত হওয়ার পেছনে এই শিক্ষকই ছিলেন অনুপ্রেরণা। বলা হয়ে থাকে, রশিদ চৌধুরীর ট্যাপিস্ট্রিতে পশ্চিমা স্টেইন্ড গস্নাস-সদৃশ বৈশিষ্ট্য পরিদৃষ্ট হয়, এখানেও জঁ লুরসাতের প্রভাব কাজ করে থাকতে পারে।
স্ট্রাকচার বা সংগঠনের বাঁধুনিই রশিদ চৌধুরীর ট্যাপিস্ট্রি ও অন্যান্য সৃষ্টির সবচেয়ে জোরালো গুণ। এই সংগঠনের মূল সূত্রগুলি কী? সেগুলি কিন্তু নিতামত্মই সরল ও পরিমিত, বেসিক ডিজাইন বা মৌলিক নকশার নিয়ম মেনে গড়া। মূল গড়নটি তিনি নিয়েছেন বাংলার ঐতিহ্যিক বিগ্রহশৈলী থেকে, বিশেষ করে দেবীপ্রতিমার প্রচলিত রূপের আদল থেকে। সেখানেও দশভুজা দুর্গা, রাধাকৃষ্ণ ও কালীমূর্তির উত্তোলিত হাতের বিভিন্নমুখী বিন্যাস তাঁকে আকৃষ্ট করেছে বেশি। এর নিম্নাংশের আনুভূমিক জোরালো ভিতের বিপরীতে ঊর্ধ্বমুখী গতিময়তাকে বিমূর্তায়িত ও ছন্দোবদ্ধ রূপবন্ধে রূপামত্মরিত করে তিনি নির্মাণ করেছেন তাঁর মৌল আকৃতির কাঠামো, এরই নানান ছোটখাটো রূপভেদ ঘটিয়ে তৈরি হয়ে যায় ডৌলের বিবিধ রকমফের, মূল অবয়বের ভেতরে ছোট ছোট আকৃতির বৈচিত্র্যময় সংস্থাপন। উলস্নম্ব ও আনুভূমিক রেখা ও আকারের চেয়েও তাঁর পক্ষপাত কৌণিক রেখা ও আকারে সৃষ্ট টানাপড়েনের দিকে। এগুলোর মধ্যে সম্পর্ক নির্মাণ করে ফোঁটাফুটকি, অাঁচড়, স্ট্রোক। এভাবে একই সঙ্গে একটি জোরালো স্থিতি ও টান টান অস্থিরতার বিপরীত চাপ দর্শকের দৃষ্টিকে টেনে রাখে। মাঝে মাঝে রেখার সর্পিল ও ছন্দিত ব্যবহারে কি কান্দিনস্কি থাকেন অবচেতনে? চিত্রতলের বিন্যাসে ও দীপ্র বর্ণের নৃত্যশীল বিচরণে এই শিল্পীর প্রভাব পরবর্তী পর্যায়ে হয়তো আরো বিশেষভাবে অনুভূত হবে। কান্দিনস্কির মতোই রশিদ চৌধুরী আজীবন ছিলেন সংগীতের বিশেষ অনুরাগী এবং চিত্রের পটে সাংগীতিক সিম্ফনির আবেশ উভয়ের শিল্পের অন্যতম চরিত্র।
সংগঠনের ঐক্যকে যদি রশিদ চৌধুরীর ট্যাপিস্ট্রির শরীর হিসেবে দেখি তবে বর্ণ ও আলোকচ্ছটাকে বলা যেতে পারে এর প্রাণ। সাধারণভাবে কালো বা গাঢ় রঙের পটভূমির বিপরীতে উজ্জ্বল প্রাথমিক বর্ণের বিরোধাভাস সৃষ্টির কৌশলেই তিনি নির্মাণ করেন এই আকর্ষণ। মোদ্দাভাবে এটি তাঁর সমসাময়িক চিত্রের বেলায়ও প্রযোজ্য, যদিও উভয় ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রমেরও অভাব নেই। অবিমিশ্র প্রাথমিক বর্ণ ব্যবহারের উদ্দীপনাটি নিশ্চয় তিনি লাভ করেছিলেন এদেশীয় লোকচিত্রকলার ঐতিহ্য থেকে, বিশেষ করে পটচিত্র ও লক্ষ্মীর সরার প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল প্রশ্নাতীত। এখানে রশিদ চৌধুরীর শিল্পে আধুনিক প্রেক্ষাপটে লোকশিল্পের উপাদান ব্যবহারের বহুল আলোচিত প্রসঙ্গটি এসে পড়ে। এটি প্রথমেই উলেস্নখ করা দরকার যে বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পপ্রয়াসে লোককলাকে আশ্রয় বা ব্যবহার কোনো নতুন ঘটনা নয়। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, সফিউদ্দীন আহমেদ থেকেই এর কিছু কিছু প্রয়োগ দেখা যাবে, যা পঞ্চাশের দশক নাগাদ কামরম্নল হাসান, কাইয়ুম চৌধুরী ও রশিদ চৌধুরীতে এসে তাঁদের সৃষ্টির অন্যতম উপাদান হিসেবে পরিদৃশ্যমান হয়ে ওঠে। নভেরা আহমেদের ভাস্কর্যেও এটি তাৎপর্যময় রূপবন্ধ হিসেবে দেখা দিতে শুরম্ন করে। কামরম্নল হাসান তাঁর প্রাথমিক পর্বে অনেকটা যামিনী রায়ের ঢঙে কালীঘাটের পট-পুতুল-সরাচিত্র ইত্যাদির রূপবন্ধ প্রায় সরাসরি উপস্থাপন করেছেন, যদিও পরবর্তী সময়ে ক্রমশই তিনি সংশেস্নষিত একটি নিজস্ব শৈলীর দিকে এগিয়েছেন। কাইয়ুম চৌধুরী লোককলার বিষয়বস্ত্ত বা বর্ণকে বিশেষ নেননি, তিনি উপাদান নিয়েছেন লোককারম্নকলার দৃশ্যমান মটিফ থেকে – নকশিকাঁথা, গ্রামীণ পিঠা, আলপনা, জামদানি বা নৌকার গলুইয়ের নকশার আদল থেকে। নভেরার কাজে দেখি পুতুল ও খেলনার গড়নের সঙ্গে আধুনিক পশ্চিমা ভাস্কর্যের সমন্বয়ের প্রয়াস। এখানে উলেস্নখ্য যে অনুপ্রেরণা হিসেবে লোকজীবনের উপাদানকে নিলেও এই ধারার সমসাময়িক বা পরবর্তী অন্যান্য শিল্পীর মতো রশিদ চৌধুরী লোকশিল্পের দৃশ্যজ মটিফ, আঙ্গিক বা প্রকৃতিকে বিশেষ ব্যবহার করেননি। তাঁর গ্রহণের ধরনটি অনেকটাই অপ্রত্যক্ষ, রূপকাশ্রিত ও রূপামত্মরিত। অন্যরা যেখানে আকৃষ্ট হয়েছেন লোককলার সহজিয়া দৃশ্যগত উপাদানে সেখানে রশিদ চৌধুরী বেছে নিয়েছেন লোকজীবনের অপ্রত্যক্ষ গল্পগাথা, পুরাণ, পুঁথি-পাঁচালি, পূজা-পার্বণ আর তাঁদের স্মৃতি ও স্বপ্নের জগৎ। যদিও দৃশ্যমান অবয়ব হিসেবে প্রতিমা-কাঠামো বা বর্ণিকাভঙ্গে লোকজ বর্ণের প্রেরণা কাজ করেছে, কিন্তু রশিদ চৌধুরী সেসবকে এমনভাবে বিমূর্তায়িত ও রূপামত্মরিত করেছেন যে আমরা তার নির্যাসটুকুই অনুভব করি, প্রত্যক্ষতার সীমাবদ্ধতার মধ্যে তা আর আবদ্ধ থাকে না।
পটভূমির বিপরীতে আকৃতির জোরালো বহির্রেখা ও জাঁকালো রং যে দ্যোতনা সৃষ্টি করে তা দর্শনক্রিয়ায় তীব্রতর হয়ে ওঠে আলোর দীপ্তিময় উদ্ভাসে ও স্পেস বা পরিসরের বুদ্ধিদীপ্ত বিন্যাসে। বস্ত্ততপক্ষে রশিদ চৌধুরীর ট্যাপিস্ট্রি ও চিত্রকর্মের একটি অনন্যসাধারণ গুণ এর ভেতর থেকে বিচ্ছুরিত আলোর দ্যুতি। সমগ্র পটজুড়ে খ- খ- সাদা ও অন্যান্য হালকা বর্ণের সুচিমিত্মত সুসংবদ্ধ বিন্যাসের মাধ্যমে অমত্মঃস্থিত আলোকচ্ছটার পরিস্ফুটন তাঁর নিজস্ব এক পদ্ধতি, যা তাঁর দ্বিমাত্রিক পটকে দিয়েছে এক দুর্লভ ভিন্নতর মাত্রা। বর্ণচ্ছটার নৃত্যময় ছন্দ আর পটভূমি ও অবয়বের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্মাণে পরিসরের সুপরিকল্পিত ব্যবহার তাঁর সৃষ্টিকে দিয়েছে এক সাংগীতিক ঐকতান। ফলে, অনেকটা মাতিসের মতোই, আলংকারিকতার প্রামত্ম স্পর্শ করেও তাঁর ছবি নিছক নকশা হয় না, চিত্রগুণের ঐশ্বর্যসমৃদ্ধ সৃজনশীল ক্রিয়া হয়ে ওঠে। আবেগই রশিদ চৌধুরীর সৃজনক্রিয়ার চালিকাশক্তি, সন্দেহ নেই। আবেগ প্রবলই ছিল, তবে পটের সংস্থাপনকৌশল ও ঐক্যবোধের লাগাম আবেগের রাশ সঠিকভাবেই টেনে রেখেছিল, ফলে সসত্মা ভাবাবেগ তাঁর শিল্পের ওপর কখনো খবরদারি করতে পারেনি।
ট্যাপিস্ট্রি করতে গিয়ে তিনি ভেবেছেন দেশীয় প্রযুক্তি ও উপাদানের কথা। ১৯৬৪ সালেই সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে স্থাপন করেছিলেন উপমহাদেশের প্রথম ট্যাপিস্ট্রি কারখানা। ট্যাপিস্ট্রির উপাদান হিসেবেও নানান দেশীয় উপকরণ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, ব্যবহার করেছেন পাট-পশম-রেশম সুতা প্রভৃতি দেশি বস্ত্ত। এসবই রশিদ চৌধুরীর স্বদেশ ও সমাজভাবনার প্রতিচ্ছবি।
তাঁর শিল্পকে কি প্রচলিত অর্থে সমাজসচেতন বলা যাবে? এ প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়। তাঁর সহজাত প্রবৃত্তি আবেগময়তায়, রোমান্টিক স্বপ্নচারিতায়। তাঁর শিল্পে যে পূর্ণতার সংহতি সেও হতে পারে সমাজের অপরিপূর্ণতার বিরম্নদ্ধে অবস্থান, অপ্রাপণীয়ের প্রতি তাঁর স্মৃতিতাড়িত স্পৃহা। সমসাময়িক প্রবণতার বাইরে গিয়ে আধুনিক মনন ও আঙ্গিকের অভ্যমত্মরে দেশের মর্মমূলকে স্পর্শ করবার যে তাড়না তার ভেতর দিয়েই রশিদ চৌধুরীর সমাজচেতনার ধরনকে বুঝতে হবে। একাত্তরে করা তাঁর ‘বাংলায় বিদ্রোহ’ স্কেচ বা পরবর্তীকালে ওসমানী মিলনায়তনের জন্য করা বৃহৎ ট্যাপিস্ট্রিতে সমসত্ম পটভূমি জুড়ে মানুষ-বৃক্ষ-পশুপাখি সমেত বাংলার চিরমত্মন প্রকৃতির যে ঘূর্ণায়মান রম্নদ্র রূপ তার মধ্য দিয়েও প্রতীয়মান হয়ে ওঠে সময়ের প্রেক্ষাপটে শিল্পীর প্রতিরোধের বাণী। তাঁর বিরম্নদ্ধতা কোনো রাজনৈতিক চেনা প্রতিবাদের ভাষায় ব্যক্ত হয় না, সেটি ব্যক্ত হয় প্রায়শই তাঁর নিজস্ব স্মৃতি-স্বপ্নের মিশেল দেওয়া রূপকাশ্রয়ী বয়ানে। বাংলার ঐতিহ্যিক বুননশিল্পকে আত্মপ্রকাশের মূল মাধ্যম হিসেবে বেছে নেওয়া, এর কাঁচামাল হিসেবে পাট, রেশম বা পশমের মতো দেশি উপকরণের প্রয়োগ, প্রায়োগিকধর্মী শিল্পশিক্ষালয়ের স্বপ্ন, কারম্নশিল্পপলস্নী স্থাপনের পরিকল্পনা, গণভবনের অভ্যমত্মরীণ সজ্জা পরিকল্পনায় সম্পূর্ণ দেশীয় মাধ্যমের শিল্পিত ব্যবহার ইত্যাদি কর্মমুখী ভাবনার মধ্য দিয়েই প্রতীকায়িত হয়েছে রশিদ চৌধুরীর স্বদেশচেতনাপ্রবাহ। এর সংবেদকে গতানুগতিক আঙ্গিকের সমাজসচেতনতার ছাঁচে ফেলে হৃদয়ঙ্গম করা যাবে না।
রশিদ চৌধুরীর মৃত্যুর ত্রিশ বছর পর আজ তাঁকে নিয়ে এটুকু অতিকথনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছি বর্তমানের দৃশ্যকলাজগতের প্রবণতা নিয়ে কিছু প্রশ্ন মনের মধ্যে ঘাই মারার কারণে। হয়তো ভবিষ্যতে এ নিয়ে আরো আলোচনা, বিতর্ক, মতবিনিময় প্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে। আর সে বিবেচনার ক্ষেত্রটিতে রশিদ চৌধুরী দেখা দেবেন গুরম্নত্বপূর্ণ সোপান হিসেবে এবং এসবের মধ্য দিয়ে নির্মিত হয়ে উঠবে এ কালের অর্থবহ শিল্পের পটভূমি। n