logo

ছবি দেখা ছবি কেনা

মো বা শ্বি র  আ ল ম  ম জু ম দা র

তি নি ছবি আঁকিয়ে নন। কিন্তু ছবি ভালোবাসেন। চিত্রসমালোচক বারিদবরণ ঘোষ। ছবি দেখার কৌতূহল নিয়ে বলেন এরকম করে, ‘একটি রেখা কেমন করে ছবি হয়ে ওঠে – এটি দেখতে আমার প্রবল কৌতূহল।’ শিল্পসংগ্রাহক দুর্জয় রহমান জয় হয়তো ছবি সংগ্রহ করেন অন্যরকম করে। তিনি সতেরো বছর আগে ধানমন্ডির একটি গ্যালারির চ্যারিটি শো থেকে কিছু শিল্পকর্ম সংগ্রহ করেন। সেই থেকে তাঁর সংগ্রহের শুরু। বাংলাদেশের ছয় দশকের শিল্পচর্চার ইতিহাসে শিল্পসংগ্রাহকের পদচারণা খুব বেশি সময়ের নয়। খুব কম দামে আমাদের খ্যাতিমান শিল্পীরা একসময় তাঁদের সৃষ্টিকর্ম বিকিয়ে দিয়েছেন। ব্যক্তিগত সম্পর্কের সূত্র থেকেও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও পটুয়া শিল্পী কামরুল হাসান, এস এম সুলতান তাঁদের সৃষ্টিকর্ম অনেককে উপহার দিয়েছেন। শিল্প সংগ্রহের প্রকৃত ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিয়ে অর্থের বিনিময়ে শিল্পকর্ম প্রদান শুরু হয় চার দশক আগে থেকে। ১৯৬২ সালে ঢাকায় শিল্পসমালোচক সাদেক খান ও ফরিদা হাসানের উদ্যোগে ‘আর্ট এনসেমবল’ গ্যালারি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিল্পকর্ম বিপণন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়, যেটি ১৯৭৫ সালে বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে জনরুচির পরিবর্তন হতে শুরু করে আমাদের দর্শকের নন্দনতাত্ত্বিক চেতনায় শিল্পরূপ উদয় হয়। ঢাকা আর্ট ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি বাংলাদেশে শিল্পকলার বাজার সৃষ্টিতে বড় ভূমিকা পালন করে। ১৯৭৬ সাল থেকে শুরু হওয়া এশীয় দ্বিবার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনী থেকে বাংলাদেশ অঞ্চলের শিল্পীদের শিল্পকর্মের গুরুত্ব বিশ্বব্যাপী প্রকাশ পায়। ক্রমে এশীয় অঞ্চলের শিল্পীদের মাঝে বাংলাদেশি শিল্পীদের ছবির বাজার তৈরি হতে শুরু করে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে গ্যালারি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিল্পসংগ্রাহকের পরিধি বাড়তে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্যালারি হলো – বেঙ্গল গ্যালারি অব্ ফাইন আর্টস্, শিল্পাঙ্গন, গ্যালারি চিত্রক, গ্যালারি কায়া, বেঙ্গল আর্ট লাউঞ্জ। বাংলাদেশের শিল্পসংগ্রাহকদের মধ্যে দুর্জয় রহমান জয় ব্যতিক্রম।

১৯৯০-এর শেষভাগে তাঁর শিল্প সংগ্রহের সূচনা। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী। তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে রয়েছে সাতশো পঞ্চাশটির বেশি বাংলাদেশি শিল্পকর্মের সংগ্রহ। আধুনিক ও সমসাময়িক শিল্পকলার প্রতি তাঁর প্রচন্ড আগ্রহ রয়েছে। বিশ্বখ্যাত শিল্পী পাবলো পিকাসো, হেনরি ম্যুর, লুসিয়ান ফ্রয়েড, ফ্রান্সিস বেকন, অ্যান্ডি ওয়ারহল ও ডেভিড হকনির পাশাপাশি প্রাচ্যের যোগেন চৌধুরী, সনৎ কর, সুনীল দাশ ও যামিনী রায়ের অাঁকা ছবি দুর্জয় রহমানের সংগ্রহে রয়েছে। তিনি আন্তর্জাতিক পরিসরে শিল্পকর্মের নিলামে অংশগ্রহণ করে বিশ্বখ্যাত তারকা শিল্পীদের কাজ সংগ্রহ করেছেন। বাংলাদেশের শিল্পীদের মধ্যে শিল্পী রফিকুন নবীর সত্তরটি কাজ দুর্জয় রহমানের সংগ্রহে রয়েছে। ১৯৯৭ সালে প্রথম শিল্পী রফিকুন নবীর কাজ সংগ্রহ করেন। পটুয়া শিল্পী কামরুল হাসানের (১৯২১-৮৮) প্রিন্ট, জলরঙের কাজ ছাড়াও সফিউদ্দীন আহমেদের (১৯২২-২০১২) তিনটি এচিং ও অ্যাকুয়াটিন্ট, আমিনুল ইসলামের চারটি ক্যানভাসে তেলরঙের কাজ, শিল্পী আবদুর রাজ্জাকের একটি এচিং ও একটি কালি ও জলরঙের কাজসহ মোট বিয়াল্লিশটি বাছাই করা বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলের খ্যাতিমান শিল্পীদের কাজ নিয়ে প্রদর্শনী সাজানো হয়েছে। আমিনুল ইসলামের কাজে আধুনিকতার সঙ্গে নিজস্ব উদ্ভাবনী মেজাজ আমরা লক্ষ করি। এ-প্রদর্শনীতে রাখা তিনটি কাজ তিন ধরনের। এক্ষেত্রে শিল্পসংগ্রাহকের রুচিবোধ স্পষ্ট হয়েছে। মোহাম্মদ কিবরিয়ার (১৯২৯-২০১১) শিরোনামহীন কাজটি ২০০২ সালে অাঁকা। ‘স্টিল লাইফ’ ছবিটি মিশ্র মাধ্যমে ২০০৭ সালে অাঁকা। আবদুর রাজ্জাকের (১৯৩২-২০০৫) করা এচিং ‘স্ট্যান্ডিং ফিগার’ ও জলরঙে অাঁকা তিনটি ছবি বাস্তবধর্মী। ২০০২ সালে কাইয়ুম চৌধুরীর (জন্ম ১৯৩২) অাঁকা ‘অ্যাট দ্য এন্ড অব দ্য ডে’, ‘সেলফ পোর্ট্রেট’, ‘একাত্তর বুক কভার’, ‘ওল্ড ঢাকা’ ছবিগুলোতে জ্যামিতির চলাচল স্পষ্ট। ১৯৬৭ সালে মুর্তজা বশীরের (জন্ম ১৯৩২) অাঁকা দেয়াল, ১৯৭৭ সালের এপিটাফ ও পাখা সিরিজের ছবিটি ২০০৫ সালে অাঁকা। মুর্তজা বশীরের তিনটি সিরিজের তিন রকমের কাজ এ-প্রদর্শনীতে দর্শক প্রত্যক্ষ করেন। এছাড়া নিতুন কুন্ডুর একটি তেলরঙের কাজ, সমরজিৎ রায় চৌধুরীর তেলরঙের একটি কম্পোজিশন, হাশেম খানের তিনটি জলরঙের কাজ, মনিরুল ইসলামের দুটি কাজ, মাহমুদুল হকের একটি লিথোপ্রিন্ট ও একটি তেলরঙের ছবি, শহীদ কবিরের ক্যানভাসে তেলরং ও বোর্ডে ট্যাম্পেরা মাধ্যমের কাজ, শাহাবুদ্দিনের পাঁচটি কাজ প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হচ্ছে। বিশ্বখ্যাত শিল্পী পাবলো পিকাসোর লিথোগ্রাফ পোর্ট্রেট ‘ডি ভাসার্ড’ ছবিটি ১৯৫৮ সালে অাঁকা। পিকাসোর আরেকটি ছবি ‘জ্যাকুলিন লিসান্টে’ জ্যামিতি ও গতির আবহ স্পষ্ট। হেনরি ম্যুরের ‘মাদার অ্যান্ড চাইল্ড’ ছবিটি সালের উল্লেখ না থাকলেও বেশ পুরনো মনে হয়েছে। গত বছরের বিশ্ব ছবির বাজারে নতুন রেকর্ড সৃষ্টিকারী শিল্পী ফ্রান্সিস বেকনের একটি লিথোগ্রাফ প্রিন্ট এ-প্রদর্শনীতে রয়েছে। ছবির কোনো শিরোনাম নেই। গোলাকৃতির টেবিলে আছড়ে পড়া মানুষের দেহাবয়বে মস্তক অস্পষ্ট। ছবির জমিনের উপরিভাগের জানালা দিয়ে আলো এসে পড়ছে মানুষের দেহে। শিল্পসংগ্রাহক দুর্জয় রহমান জয়ের সংগ্রহের প্রদর্শনী থেকে দর্শক বাংলাদেশের ছবির বাজার ও সংগ্রাহকের নন্দনবোধ সম্পর্কে ধারণা পাবেন। বেঙ্গল আর্ট লাউঞ্জে গত ২৪ জানুয়ারি শুরু হওয়া এ-প্রদর্শনী শেষ হয়েছে ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪।

Leave a Reply