হা স না ত আ ব দু ল হা ই
এক
আন্তর্জাতিক চারুশিল্পের প্রদর্শনীর আয়োজন একসময় শিল্পোন্নত পাশ্চাত্যের দেশগুলির সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের একচেটিয়া বিষয় হয়ে ছিল। ব্রাজিলের সাও পাওলো শহরে ১৯৫১ সাল থেকে আয়োজিত বিয়েনিয়াল (দ্বি-বার্ষিক) প্রদর্শনী হিসাবের বাইরে রাখলে, গত শতাব্দীর আশির দশক থেকে আন্তর্জাতিক চারুশিল্প প্রদর্শনীর আয়োজনে পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী দেশগুলির আধিপত্য ক্রমান্বয়ে হ্রাস পায়। উন্নয়নশীল যেসব দেশ বর্তমানে আন্তর্জাতিক চারুশিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন করে আসছে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস (২০০৪) প্রকাশিত কনটেম্পরারি আর্ট নামের বইতে তাদের উদ্বোধনী বছরের কালানুক্রমিক একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে। এই প্রদর্শনীগুলি হলো : হাভানা বিয়েনিয়াল (১৯৮৪); শারজাহ, ইউএই, বিয়েনিয়াল (১৯৯৩); কোয়াংজু, দক্ষিণ কোরিয়া বিয়েনিয়াল (১৯৯৫); জোহানেসবার্গ বিয়েনিয়াল (১৯৯৫); সাংহাই বিয়েনিয়াল (১৯৯৬); মার্কোসুর, ব্রাজিল বিয়েনিয়াল (১৯৯৭); ডাক-আর্ট, সেনেগাল বিয়েনিয়াল (১৯৯৮); বুসান, দক্ষিণ কোরিয়া বিয়েনিয়াল (১৯৯৮); প্রাগ বিয়েনিয়াল (২০০৩)। পাশ্চাত্যের বাইরে শিল্পোন্নত জাপানের ফুকোওকা ট্রিয়েনিয়াল (১৯৬৮) এবং ইয়োকোহামা ট্রিয়েনিয়াল (২০০১) প্রদর্শনীর উল্লেখও এই সঙ্গে করা যায়, কেননা শিল্পজগতের ওপর পাশ্চাত্যের একচেটিয়া আধিপত্য অবসানে এই দুটি প্রদর্শনীও ভূমিকা রেখেছে। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের প্রকাশিত বইটিতে উল্লিখিত বিয়েনিয়াল শিল্প প্রদর্শনীর তালিকায় ১৯৮১ সাল থেকে ঢাকায় আয়োজিত বিয়েনিয়ালের নাম না থাকার একটা কারণ হতে পারে উপযুক্ত প্রচারণার অভাব এবং আন্তর্জাতিক শিল্প-সমালোচকদের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকা।
আশির দশক থেকে উন্নয়নশীল দেশে দ্বি-বার্ষিক চারুশিল্প প্রদর্শনী আয়োজনের পেছনে কারণ হিসেবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এইসব দেশের জাতিসত্তার সম্মানসূচক এবং ন্যায্য পরিচিতি লাভের অভীপ্সার কথা উল্লেখ করেছেন শিল্প-সমালোচক আর্থার ডান্টো (১৯৯৭)। তিনি এই প্রসঙ্গে সাংস্কৃতিক কর্মকা–র মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলির নিজেদের ‘স্বপ্নরাষ্ট্র’ (‘ট্রান্সন্যাশনাল ইউটোপিয়া’) প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। উত্তর-উপনিবেশবাদের অন্যতম ব্যাখ্যাতা হোমি ভাবা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এই তৎপরতার জন্য তৃতীয় বিশ্বের চারুশিল্পীদের শিল্পচর্চায় গৌরবময় ঐতিহ্য এবং সমকালে অর্জিত উচ্চমান সম্বন্ধে বহির্জগতের উদ্দেশ্যে প্রচারণার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন (১৯৯৪)। এ প্রসঙ্গে তিনি সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তির দেশগুলির শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে উচ্চমন্নতা বোধেরও উল্লেখ করেছেন। ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার সংশোধনের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে তিনি তৃতীয় বিশ্বের শিল্পচর্চাকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করেন।
আইডিওলজি (হোমি ভাবা বর্ণিত) এখন আগের মতো প্রাসঙ্গিক না হলেও শিল্পকলা প্রদর্শনী আয়োজনের পেছনে প্রচ্ছন্নভাবে হলেও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে। একটি দেশের সরকার রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অগ্রগতির নিদর্শন হিসেবে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অর্জনের ওপর আলোকপাতে আগ্রহী হয়। এর মাধ্যমে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়, এই বিশ্বাস কারণ হিসেবে প্রধান ভূমিকা রাখে। স্বাভাবিক কারণেই এ পর্যন্ত ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বি-বার্ষিক এশীয় চারুশিল্প প্রদর্শনী উপলক্ষে যেসব ব্রোশিয়োর প্রকাশিত হয়েছে তার ভূমিকায় উল্লিখিত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের কথা না বলে শিল্পীদের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান এবং বিভিন্ন দেশের শিল্পকলা চর্চায় সাম্প্রতিক ধারা ও প্রবণতা সম্বন্ধে অবহিত হওয়ার ওপরই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অলিখিত থাকলেও, প্রদর্শনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের শিল্পচর্চার গৌরবময় ঐতিহ্য এবং সমকালীন শিল্পকর্মের মানের উৎকর্ষ ও বৈচিত্রের প্রতি অন্য দেশের শিল্পী ও দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণও অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। ১৯৮১ সাল থেকে যাত্রা শুরু করে ২০১৬ পর্যন্ত সপ্তদশ চারুশিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন অব্যাহত রেখে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শিল্পজগতে তার আসন বেশ সমেত্মাষজনকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে বলা যায়। কিন্তু যথার্থ স্বীকৃতি এবং গুরুত্ব লাভের জন্য আরো প্রচারণার প্রয়োজন রয়েছে। বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাস এই উদ্দেশ্যে আরো তৎপর হতে পারে। প্রদর্শনীতে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কয়েকজন কিউরেটর এবং শিল্প-সমালোচককে আমন্ত্রণ করে নিয়ে এলে এই উদ্দেশ্য পূরণ অনেকটাই সম্ভব হবে।
দুই
১৯৮১ সালে যখন দ্বি-বার্ষিক এশীয় চারুশিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয় সেই সময় বাংলাদেশের আয়োজক, উদ্যোক্তা এবং পরামর্শকদের মধ্যে শুধু ধারণা নয়, এই দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করবেন শুধুমাত্র এশিয়া মহাদেশের দেশগুলির শিল্পীরা। নামের সঙ্গে সংগতি রেখে সেই জন্য প্রথম দ্বি-বার্ষিক প্রদর্শনীতে এশীয় দেশের শিল্পীদের শিল্পকর্মই স্থান পেয়েছিল। এর মাধ্যমে এশিয়া মহাদেশের চারুশিল্পের ঐতিহ্য ও সমকালীন শিল্পীদের ওপর আলোকপাত করা যাবে বলে আশা করা গিয়েছিল। প্রাচ্যের শিল্পচর্চাকে প্রতীচ্যের শিল্পধারা থেকে আড়াল করে রাখার জন্য নয়, এশিয়া মহাদেশের শিল্পের অতীত ও সমকালীন শিল্পধারার বৈশিষ্ট্যের ওপর আলোকপাতের জন্যই ভৌগোলিক সীমানা নির্ধারিত রাখার পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রথম দ্বি-বার্ষিক প্রদর্শনীর পর থেকে ঢাকার এশীয় শিল্প প্রদর্শনীতে অন্যান্য মহাদেশের শিল্পীদের কাজও প্রদর্শিত হচ্ছে। এর ফলে শুধু ‘এশীয়’ নামটি অর্থহীন হয়ে পড়েনি, প্রদর্শনীর পেছনে যে প্রধান উদ্দেশ্য ছিল তাও ব্যাহত হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। এ সমস্যার একটা সমেত্মাষজনক সমাধান প্রয়োজন।
তিন
যে-কোনো ধরনের শিল্প প্রদর্শনীর আয়োজনে শিল্পকর্ম নির্বাচন (কিউরেশন) প্রাথমিক এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। শিল্পীদের অংশগ্রহণে প্রদর্শনীর পরিধি যত বড় হতে থাকে, এই প্রক্রিয়া তার অনুষঙ্গ হিসেবে ততই জটিল এবং সময়সাপেক্ষ হয়ে পড়ে। অনেক প্রদর্শনীর আয়োজকরা এ দায়িত্ব পালনের জন্য পেশাদার কিউরেটর নিয়োগ করে থাকেন। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত দেশি কিংবা বিদেশি পেশাদার কিউরেটর নিয়োগ না করে প্রবীণ শিল্পীদের সমন্বয়ে গঠিত নির্বাচন কমিটির মাধ্যমে প্রদর্শনীর জন্য শিল্পকর্ম বাছাই করা হয়ে আসছে। এই কমিটির কাজ আরো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে বিদেশ থেকে এক কি দুইজন পেশাদার কিউরেটর অন্তর্ভুক্ত করা বিবেচনায় আনা যায়। এর পাশাপাশি বাছাই কমিটির সদস্যদের সাহায্যের জন্য শিল্পকর্ম বাছাইয়ের ভিত্তি হিসেবে একটা নির্দেশিকা তৈরি করা হলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ যেমন কিছুটা সহজ হবে, শিল্পকর্ম নির্বাচনের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলার সম্ভাবনা থাকবে কম। এ প্রসঙ্গে নিউ ইয়র্কের মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্টের (মমা) একটি প্রদর্শনী উপলক্ষে ছাপা ব্রোশিয়োরে যা বলা হয়েছিল তার একটি অংশের উল্লেখ করা যায় (১৯৯২)। ভূমিকায় লেখা হয়েছিল, শিল্পকর্ম ‘চোখে পড়া’ আর ‘দেখার’ মধ্যে পার্থক্য আছে। অনেক বস্ত্তই চোখে পড়ে, কিন্তু মনোযোগ দিয়ে দেখা হয় কমই। যে শিল্পকর্ম শুধু ‘চোখে পড়ার’ মতো না, মনোযোগ দিয়ে ‘দেখার’ দাবি রাখে সেগুলিই প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া উচিত।’ এরপর ব্রোশিয়োরে বলা হয়েছে, প্রদর্শনীতে শিল্পকর্ম বাছাইয়ের জন্য দুটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত। প্রথমত. সংশ্লিষ্ট শিল্পকর্মের গুণগত উৎকর্ষ প্রচলিত তত্ত্ব ও ধারণার ভিত্তিতে বিচার করতে হবে। দ্বিতীয়ত. সামগ্রিকভাবে বাছাই করা শিল্পকর্মের সমাবেশে বৈচিত্রপূর্ণ পরিবেশনা সম্ভব হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এই দুটি শর্ত পূরণ করতে গিয়ে কোনো শিল্পকর্ম ‘দেখার’ মতো না হলেও ‘বৈচিত্রের’ জন্য নির্বাচিত করার যৌক্তিকতা থাকবে। ‘দেখার’ মতো সব ‘কাজ’ই যদি একই বিষয় বা ধারার হয়ে যায় তাহলে প্রদর্শনীর আকর্ষণ যেমন কমে যেতে পারে, সেইসঙ্গে তার প্রতিনিধিত্বশীলতাও অনুপস্থিত হতে পারে বলে এই বিশেষ বাছাই পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে। এর ফলে শিল্পকর্ম বাছাইয়ের প্রক্রিয়া অনমনীয় না হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে আপস করার সুযোগ থাকবে, প্রদর্শনীর গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করার জন্য অনেক সময় যার প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশের দ্বি-বার্ষিক এশীয় চারুশিল্প প্রদর্শনীতে পাঠানো শিল্পকর্ম বাছাইয়ের জন্য ওপরে উল্লিখিত মমার অনুসৃত নীতি বিবেচনা করা যেতে পারে।
চার
সপ্তদশ দ্বি-বার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীর জন্য এক সূত্র অনুযায়ী বাংলাদেশের ৫৫৬ জন শিল্পী তাঁদের ‘কাজ’ জমা দিয়েছিলেন। সেখান থেকে নির্বাচন কমিটি ১৪৮ জন শিল্পীর মোট ১৫৪টি শিল্পকর্ম বাছাই করেছে (২০১৭)। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী এইসব শিল্পী ছাড়া বাংলাদেশের আমন্ত্রিত ৫৪ জন প্রবীণ ও প্রতিষ্ঠিত শিল্পীর একটি করে ‘কাজ’ প্রদর্শিত হয়েছে। এই হিসাবে প্রদর্শনীর মোট ২৮৩টি শিল্পকর্মের মধ্যে ১৭০টি ছিল বাংলাদেশি শিল্পীর এবং বিদেশি শিল্পীদের পাঠানো ছবি থেকে বাছাই করা ‘কাজ’-এর সংখ্যা ছিল মোট ১১৩টি। বাংলাদেশ ব্যতীত অন্যান্য অংশগ্রহণকারী দেশের সংখ্যা ৫৪ হলেও তাদের প্রতিনিধিত্বকারী শিল্পকর্ম বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম হওয়ার কারণে প্রদর্শনীর আন্তর্জাতিক চরিত্র কিছুটা ক্ষুণ্ণ হয়েছে বলা যায়। বিদেশ থেকে আরো বেশি শিল্পকর্ম কেন আনা গেল না, তার কারণ খুঁজে নিয়ে পরবর্তী দ্বি-বার্ষিক প্রদর্শনীর জন্য এখন থেকেই প্রস্ত্ততি নেওয়া প্রয়োজন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, ১৯৮১ সালে প্রথম দ্বি-বার্ষিক এশীয় চারুশিল্প প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছিল ১৪টি দেশ এবং প্রদর্শিত ছবির মোট সংখ্যা ছিল ৩৭০টি। অংশগ্রহণকারী দেশের সংখ্যা বর্তমানে অনেক বৃদ্ধি পেলেও প্রদর্শিত শিল্পকর্মের সংখ্যা যে হ্রাস পেয়েছে, এ তথ্য প্রদর্শনীর অগ্রগতিতে বৈষম্যের পরিচয় দেয়, যা বেশ দুশ্চিন্তার বিষয়। এদিকে আয়োজকদের দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।
পাঁচ
চারুশিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয় সাধারণ ও শিল্পরসিক দর্শকের উপভোগের জন্য এবং অন্যান্য শিল্পীর উপলব্ধির উদ্দেশ্যে। শিল্পীরা নিজেদের অধীত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে শিল্পকর্ম যেমনভাবে সহজে উপলব্ধি করেন শিল্পরসিক দর্শক সেইভাবে পারেন না, আর সাধারণ দর্শকরা তো এক্ষেত্রে আরো অসহায় বোধ করেন। শিল্প-সমালোচক দার্শনিক ওয়াল্টার বেনজামিন যদিও বলেছেন, সহজলভ্য হওয়ার জন্য সমকালীন (আধুনিক) শিল্পকর্ম পারিপার্শ্বিক জগৎ এবং চলমান জীবন সম্বন্ধে মানুষের জ্ঞান ও পরিচিতি সম্প্রসারিত করেছে (১৯৩৬), আধুনিক শিল্পের জটিলতা যে সাধারণ ও শিল্পরসিক দর্শকের কাছে প্রায়শই দুর্বোধ্য মনে হয়, একথাও অস্বীকার করার উপায় নেই। দর্শকদের উপলব্ধিতে (উপভোগেও) সহায়তা করার জন্য শিল্প-সমালোচক যেমন প্রদর্শনীর শিল্পকর্মের ব্যাখ্যা ও আলোচনা করে থাকেন, মিউজিয়াম বা গ্যালারিও প্রদর্শিত শিল্পকর্মের বর্ণনা দিয়ে দর্শকদের সাহায্য করতে পারে। মমার ১৯৯২ সালে প্রকাশিত ‘অ্যান ইনভিটেশন টু সি’ ব্রোশিয়োরে প্রদর্শিত ১৫০টি শিল্পকর্মের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে (১৯৯২)। দ্বি-বার্ষিক এশীয় চারুশিল্প প্রদর্শনী উপলক্ষে প্রতিবারই সচিত্র ব্রোশিয়োর প্রকাশ করা হয়, কিন্তু ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখে সমাপ্ত সপ্তদশ দ্বি-বার্ষিক প্রদর্শনীর জন্য যে বিশাল বইটি ছাপা হয়েছে সেখানে প্রথমবারের মতো অংশগ্রহণকারী প্রতিটি দেশের শিল্পকলার ঐতিহ্য ও সমকালীন শিল্পচর্চা সম্বন্ধে সংক্ষেপে হলেও সুলিখিত যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তা সকল শ্রেণির দর্শকদের প্রদর্শিত শিল্পকর্ম উপলব্ধিতে সাহায্য করবে। এর পাশাপাশি যদি প্রদর্শনী শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শিল্প-সমালোচকদের আমন্ত্রণ জানিয়ে প্রদর্শিত শিল্পকর্মের রিভিউ করা হতো তাহলে সেই লেখা দর্শকদের আরো সহায়তা করতে পারত। ভবিষ্যতে এই ধরনের রিভিউয়ের (এবং প্রিভিউ বা প্রদর্শনী শুরুর আগে লিখে ছাপানো) জন্য আয়োজকরা পদক্ষেপ গ্রহণ করলে প্রদর্শনী আয়োজনের উদ্দেশ্য পূরণ অনেকটা সম্ভব হবে। এর পাশাপাশি প্রদর্শনী চলাকালে একাধিক সেমিনার আয়োজন করে প্রদর্শিত ‘কাজ’-এর ব্যাখ্যা দেওয়ার কর্মসূচি থাকলে দর্শকরা উৎসাহবোধ করবে এবং উপকৃত হবে।
ছয়
এই দীর্ঘ ভূমিকার (আশা করি অপ্রাসঙ্গিক নয়) পর দ্বি-বার্ষিক প্রদর্শনীর শিল্পকর্মের আলোচনায় আসা যেতে পারে। প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো, প্রতিটি অংশগ্রহণকারী দেশের প্রত্যেক শিল্পীর প্রতিটি ‘কাজের’ আলোচনা সম্ভব না এবং তার হয়তো প্রয়োজনও নেই। এই রিভিউয়ের যে উদ্দেশ্য তা হলো মমার ব্রোশিয়োরে বাছাই প্রক্রিয়া সম্বন্ধে যা বলা হয়েছে সেই দুটি মানদ- ব্যবহার করে নির্বাচিতভাবে আলোচনায় যাওয়া। প্রথমত, ‘কাজের’ গুণগত ‘উৎকর্ষ’ বিচার এবং দ্বিতীয়ত, সামগ্রিকভাবে প্রদর্শনীর ‘বৈচিত্র’ বিবেচনায় এনে আলোচনার সুবিধার জন্য প্রদর্শিত ‘কাজ’ নির্বাচন করা। প্রথম কাজটি করতে গিয়ে ‘চোখে পড়া’ আর ‘মনোযোগ দিয়ে দেখা’র তুলনা মনে রেখে যে শিল্পীর ‘কাজ’ দেখতে উৎসাহিত করেছে, এই রিভিউ সেগুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ। দ্বিতীয় যে শর্ত বা মানদ- মমার ব্রোশিয়োরে উল্লিখিত অর্থাৎ ‘বৈচিত্রের’ অনুসন্ধান, তার জন্য অংশগ্রহণকারী দেশের পাঠানো ‘কাজ’ এবং প্রদর্শনীর সামগ্রিক আয়োজনের ভিত্তিতে শিল্পকর্মের আলোচনা করা হবে। এই রিভিউ যে সবক্ষেত্রেই নির্মোহ, নিরাসক্ত এবং নির্ভুল হবে, সেই নিশ্চিতি নেই।
সাত
একসময় ছিল যখন শিল্পকলা প্রদর্শনীতে তৈলচিত্র, জলরং, ড্রইং আর ভাস্কর্যই স্থান পেত। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকেই এর পরিবর্তন ঘটেছে এবং প্রদর্শনীতে এইসব পরিচিত মাধ্যমের শিল্পকর্ম ছাড়াও থাকছে বিভিন্ন ধরনের ইনস্টলেশন, মিক্সড মিডিয়ার কাজ (যা ইনস্টলেশন হিসেবেও গণ্য), ফটোগ্রাফি ইত্যাদি। সম্প্রতি দ্বি-বার্ষিক এশীয় প্রদর্শনীতে যুক্ত হয়েছে পারফরম্যান্স শ্রেণির প্রদর্শনী। সমকালীন শিল্পভুবনের প্রতিনিধিত্ব করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন মাধ্যমের সমাবেশ যে প্রদর্শনীতে বৈচিত্রের মাত্রা যোগ করে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শিল্পকর্ম বাছাই করার অন্যতম মানদ–র মধ্যে রয়েছে ‘বৈচিত্র’ নিশ্চিত করা, তার উল্লেখ আগেই করা হয়েছে। এর একটা অসুবিধা হলো, যখন বহু মাধ্যমের অনেক কাজ প্রদর্শনীর জন্য পাঠানো হয় সেই সময় স্থানাভাবে গ্যালারি বা মিউজিয়াম বেশ অসুবিধায় পড়ে এবং কিছু ভালো কাজ বাদ পড়ে যেতে পারে।
প্রদর্শনীর শিল্পকর্মের আলোচনার আগে দ্বিতীয় যে বিষয় নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা প্রয়োজন সেটি ট্র্যাডিশন বা ঐতিহ্য বনাম সমকালীন ধারার কাজের প্রসঙ্গ। পাশ্চাত্যের সমকালীন প্রদর্শনীতে ট্র্যাডিশনাল এবং আধুনিক শিল্পকর্মের বিভাজন অতটা স্পষ্ট নয়, যা দেখা যেতে পারে এশিয়া, আফ্রিকা, এমনকি লাতিন আমেরিকায়। পাশ্চাত্যে ট্র্যাডিশনাল শিল্পধারার অনুসরণ শিল্পীর আইডেনটিটি প্রতিষ্ঠার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয় কিংবা তাদের জন্য দায়বদ্ধতার মধ্যে পড়ে না। আধুনিক শিল্পধারা ব্যবহার করেই তাদের পক্ষে আত্মপরিচয় তুলে ধরা সম্ভব এবং যেহেতু আধুনিক শিল্পধারা তাদের দেশের অতীতের শিল্পচর্চার ধারাবাহিকতায় বিবর্তিত সেই কারণে ট্র্যাডিশনাল শিল্পকলা প্রতিফলনের জন্য তাদের কোনো উদ্বেগ বা প্রণোদনা থাকে না। অবশ্য কারো কারো কাজে বিষয় বা পদ্ধতির ব্যবহারে ঐতিহ্য ভূমিকা রাখে। প্রাচ্যের বা আফ্রিকার শিল্পীদের এক্ষেত্রে থাকতে হয় দোটানার মধ্যে; ট্র্যাডিশন থেকে সরে এলে আইডেনটিটির সমস্যা দেখা দিতে পারে, যার জন্য তাদের কেউ কেউ ট্র্যাডিশন-নির্ভর শিল্পকর্মই সৃষ্টি করেন। আবার এক শ্রেণির শিল্পী আধুনিক শিল্পধারার সঙ্গে ট্র্যাডিশনের সঙ্গে কিছু উপকরণ বা আঙ্গিক ব্যবহার করে স্বকীয়তা রক্ষার চেষ্টা করেন। তৃতীয় একটি শ্রেণির শিল্পীরা দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভুলে পাশ্চাত্যের শিল্পধারার অনুসরণ করেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। সপ্তদশ দ্বি-বার্ষিক এশীয় প্রদর্শনীতে এই তিন শ্রেণির কাজই রয়েছে, বিশেষ করে এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার শিল্পীদের ক্ষেত্রে। পাশ্চাত্যের শিল্পীদের এইভাবে শ্রেণিভুক্ত হতে হয়নি, তাদের ট্র্যাডিশন-নির্ভর কাজের সংখ্যা নগণ্য। তবে চারুকলার ভাষা আন্তর্জাতিক হয়ে যাওয়ার কারণে এবং পাশ্চাত্যের দেশগুলি এক্ষেত্রে এগিয়ে থাকার জন্য আধুনিক এবং সমকালীন ধারার কাজের সংখ্যাই বেশি প্রদর্শিত হয়েছে।
আট
পাশ্চাত্যের দেশগুলির শিল্পীরা ঐতিহ্য নিয়ে তেমন মাথা ঘামায় না, একথা বলা হলেও সপ্তদশ দ্বি-বার্ষিক এশীয় চারুশিল্প প্রদর্শনী উপলক্ষে প্রকাশিত ব্রোশিয়োরে দেখা গেল যে অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশের শিল্পকলার পরিচিতিতে বলা হয়েছে : ‘আমাদের এই আবাসভূমি অস্ট্রেলিয়া একসময় এশিয়াভুক্ত কোনো দেশ ছিল। গত ১৫০ বছরে অস্ট্রেলিয়া রূপান্তরিত হয়েছে একটি বহু-সাংস্কৃতিক দেশে এবং বর্তমানেও সেই সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণের ধারা অব্যাহত রয়েছে।’ এই মন্তব্যে অতীত ঐতিহ্যকে স্বীকার করে একটি বহু-সাংস্কৃতিক দেশ হিসেবে পরিচয় দেওয়ার মাধ্যমে অতীত ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মেলবন্ধনের প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া থেকে যে দুটি ‘কাজ’ প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে তার একটিতে আদিবাসীদের ‘ড্রিমওয়ার্ক’ শিল্পরীতির কিছুটা প্রতিফলন দেখা যায়। এডওয়ার্ড বোথা নামের একই শিল্পীর দ্বিতীয় কাজটির কম্পোজিশন এবং ফর্ম পোস্ট-মডার্ন পদ্ধতির, সেখানে একাধিক মোটিফের সম্মিলন পোস্ট-মডার্নের ‘একলেকটিক’ চরিত্রের। ছবিটিতে একাধিক উপকরণের সমাবেশে কোলাজের চরিত্র এসেছে। পরিচিতি অনুযায়ী আর্জেন্টিনার শিল্প-ঐতিহ্যও অস্ট্রেলিয়ার মতো বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর লোকজ শিল্পধারার সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় আধুনিক শিল্পচর্চায় ভূমিকা রেখেছে। প্রদর্শনীতে যে ইনস্টলেশন স্থান পেয়েছে সেটি বিশুদ্ধ আধুনিক ধারার। দেয়ালে ঝোলানো কাগজ, ফটোগ্রাফ এবং ভিডিওর সমন্বয়ে তৈরি কাজটিতে ছোট আকারের ফিগার থাকলেও বৈশিষ্ট্যে প্রধানত বিমূর্ত। ইনস্টলেশনটি আটটি দৃশ্যে বিভক্ত, যার মধ্যে কোনো কেন্দ্রবিন্দু শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। এই কারণে কাজটির সামগ্রিক কম্পোজিশন বেশ দুর্বল। অস্ট্রিয়ার শিল্পী গুস্তাভ ক্লিম্ট এবং অস্কার কোকোস্কার নাম পৃথিবীখ্যাত। সংগীতের মতো চিত্রশিল্পের জন্যও দেশটি সুপরিচিত। এদেশের শিল্পচর্চায় আধুনিকতাই প্রাধান্য পেয়েছে, ট্র্যাডিশন বলতে যা আছে তা এই আধুনিকতার পটভূমি। এভা চোউং ফ্যাক্স নামটি অস্ট্রীয় নয়, খুব সম্ভবত শিল্পী একজন অভিবাসী। ক্যানভাসে আঁকা তার চার প্যানেলের ছবিটি তেলরঙের হলেও একটি রংই ব্যবহার করা হয়েছে। প্রায় একই দৈর্ঘ্যের এবং আকারের ছোট আঁচড় কালো রঙে ক্যানভাস চিত্রিত করেছে এমন ঘননিবিষ্টভাবে যে অপটিকাল ইল্যুশন সৃষ্টি হয়ে গেছে। এই ইফেক্ট আকস্মিক নয়, পরিকল্পিত সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। প্রদর্শনীর এটি একটি উল্লেখযোগ্য কাজ। ব্রোশিয়োরে ইংরেজি বর্ণমালার ধারানুক্রম অনুযায়ী এর পরই ভুটানের নাম এসেছে। ভুটানের ট্র্যাডিশনাল শিল্পরীতির নাম ‘জরিং চুসুম’, যার মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মের প্রশান্তি ও নির্মলতার বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত। ট্র্যাডিশনাল এই ধারায় আঁকা ছবির পাশাপাশি দেশটিতে আধুনিক শিল্পরীতির চর্চাও যে জনপ্রিয় হয়েছে তার নিদর্শন দেখা গেল শিল্পী ওয়াং চুকের ‘চার বন্ধু’ শীর্ষক তেলরঙের ছবিতে। কম্পোজিশন, ফর্ম এবং রঙের ব্যবহারে এটি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। জাম্পেন চেদার নৈসর্গিক দৃশ্যের ছবিটি জলরঙে, এখানে ফর্মের মিনিমালিস্ট বৈশিষ্ট্য এবং সামনের দিকে অনেকখানি স্পেস শূন্য রেখে দেওয়ায় অতিলৌকিকতার আবহ সৃষ্টি হয়েছে। শিল্পী ওয়াংদির মিক্সড মিডিয়ার কাজ ট্র্যাডিশনাল হলেও আঙ্গিকের ব্যবহারে আধুনিক। এই ছবিটিও মনোযোগ দিয়ে ‘দেখার’ মতো। ব্রুনাইয়ের শিল্পকলার পরিচিতি দিতে গিয়ে বলা হয়েছে : ‘চিত্রকলা ও ভাস্কর্যে অতীতের মতো বর্তমানেও ব্রুনাই তার শৈশবের পর্যায়েই পড়ে আছে।’ প্রদর্শনীতে ব্রুনাইয়ের যে তিনটি ছবি প্রদর্শিত হয়েছে তার মধ্যে মোহাম্মদ ফয়েজ বিন হাজি মোর্শেদীর ক্যানভাসের ওপর অ্যাক্রিলিক রঙে তৈরি ‘রুটেড’ ছবিটি সব দিক দিয়ে এতই আধুনিক এবং সফল সৃষ্টি যে ওপরের উক্তি অতি বিনয়ের প্রকাশ বলে মনে হয়। বুলগেরিয়ার শিল্পীদের সম্বন্ধে পরিচিতিতে বলা হয়েছে : প্রতিষ্ঠিত শিল্পীরা একদিকে যেমন চিত্রকলার চিরায়ত বিদ্যা সম্বন্ধে অবগত আছেন, তেমনি সমসাময়িক চিত্রকলার নন্দনতাত্ত্বিক কলাকৌশল অনুসন্ধানেও রয়েছেন অত্যন্ত সচেতন।’ সাইবার আর্টের মাধ্যম ব্যবহার করে তৈরি শিল্পী চাভদারোভের ‘অর্ফিউস’ নামের ছবিটি অত্যাধুনিক এবং উঁচুমানের। শিল্পী টোডোরোভার আঁকা প্রতিকৃতিতে চরিত্রের চোখের দৃষ্টির অন্তর্ভেদী তীক্ষ্ণতা ছবিটির মান সম্মানজনক পর্যায়ে এনেছে। কম্বোডিয়ার চারুকলার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ছিল, কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে বিভিন্ন পশ্চিমা শিল্পধারার সঙ্গে সেই ঐতিহ্য মিশে প্রায় অচেনা হয়ে গেছে। তারপর থেকে দেশটিতে আধুনিক শিল্পরীতির অনুসরণে শিল্পচর্চা হচ্ছে। এটিই কলোনির অধীনে একটি ছোট দেশের আত্মপরিচিতি হারানোর কঠিন বাস্তবতা। কোং বোলাকের ফিগারেটিভ ড্রইং বিষয়ে কম্বোডীয় হলেও আঙ্গিকে আধুনিক। ছবিটির মান এমন পর্যায়ের নয় যার জন্য এটি দেশের উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। কানাডার দৃশ্যচিত্র সম্বন্ধে বলা হয়েছে : শুরুর দিকে দেশীয় শিল্পীদের হাত ধরে কানাডিয়ান শিল্পীরা যাত্রা করলেও অভিবাসী শিল্পীদের মাধ্যমে দেশীয় ঐতিহ্য এবং আধুনিক শিল্পধারার মিশ্রণ ঘটে। বহু-সংস্কৃতিনির্ভর শিল্পচর্চার কথা এখানে বলা হলেও প্রদর্শনীতে পাঠানো কেভিন হান্টের ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক রঙে তৈরি দুটি ছবিতে পাশ্চাত্যের আধুনিক ধারার অনুসরণই দেখা যায়। ‘ইউনিটি’ শীর্ষক ছবিতে জ্যাকসন পোলকের প্রভাব স্পষ্ট এবং দ্বিতীয় ছবি ‘প্রিজম’ ড্রিপ পেইন্টিং আঙ্গিকের না হলেও বিমূর্ত প্রকাশবাদের শ্রেণিভুক্ত। প্রথম ছবিটির ক্যানভাস জুড়ে রং এবং রেখা দৃষ্টিকে পীড়া দেয়; দ্বিতীয়টির মার্জিনের স্পেস শূন্য রেখে রঙের ব্যবহার ‘চোখে পড়া’র মতো, যদিও মনোযোগ দিয়ে ‘দেখার’ মতো নয়। বাইরের যেসব দেশ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছে তাদের মধ্যে চীনই সবচেয়ে বেশি ছবি পাঠিয়েছে। এইসব ছবির মধ্যে রয়েছে গত ৩০ বছরের ঐতিহ্যভিত্তিক কাজ এবং আধুনিক ধারা অনুসরণের প্রতিফলন। একমাত্র শিল্পী উ জিয়ান আনের ‘নিউ ইন্টারপ্রিটেশন অফ দি টেল অফ হোয়াইট স্নেক’ ছবিটি ছাড়া বাকি সাতটি ছবিই কম্পোজিশনে, ফর্মে এবং রঙের ব্যবহারে আধুনিক ধারার। ঐতিহ্যভিত্তিক শিল্পধারায় তৈরি চীনের বিখ্যাত নৈসর্গিক দৃশ্যের কোনো ছবি না থাকায় দর্শকরা নিশ্চয়ই হতাশ হয়েছেন। পাবলো নেরুদার ভাষায় ‘চিলি লাতিন আমেরিকার পশ্চিমে একচিলতে একটি দেশ।’ কিন্তু ছোট এই দেশটি খনিজ পদার্থের প্রাচুর্যে, শিল্প-কারখানার প্রসারে এবং শিক্ষার অগ্রগতির জন্য বেশ পরিচিত। দেশটির উত্তরে মরুভূমির সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের আর্থিক-সামাজিক পার্থক্য সৃষ্টির কারণে পাশাপাশি ভিন্ন ধারার শিল্পচর্চার বিকাশ ঘটেছে। কালক্রমে দেশটিতে আঞ্চলিক ঐতিহ্যভিত্তিক এবং বহির্দেশীয় শিল্পধারার সৃষ্টি হয়েছে। প্রদর্শনীতে মাত্র একটি কাজ পাঠানো হয়েছে; এটি শিল্পী দাগমারা আনা উইসিকিয়েলের ‘জয়েন্ট গেম’ নামের ইনস্টলেশন, যা প্রদর্শনীতে গ্র্যান্ড প্রাইজ লাভ করেছে। শিল্পী উত্তরের মরুভূমিপ্রধান অঞ্চলের হওয়ার জন্যই মনে হয় উষর-ধূসর প্রকৃতি ইনস্টলেশনের পটভূমিতে প্রাধান্য পেয়েছে। ইনস্টলেশনটির সাফল্য বৈরী পরিবেশে একটি মানুষের প্রত্যয়ী পদক্ষেপে যাত্রার অভিব্যক্তি প্রদর্শনে। গোলাকার প্রস্তরখ–র অদূরে একটি পথিকের ক্ষুদ্র অবয়ব যে বৈপরীত্য সৃষ্টি করেছে, সেখানে কম্পোজিশনের ভারসাম্য বেশ শিল্পসম্মত। পরিচিতিতে শিল্পী দাগমারা বলেছেন, চিলির শিল্পচর্চা এগিয়েছে বহু-সংস্কৃতির সংমিশ্রণকে কেন্দ্র করে। তাঁর ইনস্টলেশনে এই মন্তব্যের অবশ্য প্রতিফলন নেই এবং মাত্র একটিই কাজ পাঠানোর জন্য চিলির তথাকথিত বহু-সাংস্কৃতিক চিত্রকলার পরিচয় পাওয়া যায়নি। লাতিন আমেরিকার আর একটি দেশ কলম্বিয়া, যেখানে জন্মগ্রহণ করেছেন বিশ্বনন্দিত ভাস্কর বোতেরো এবং সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী গার্সিয়া মার্কেজ। দেশটির শিল্পচর্চার ইতিহাস তিনশো বছরের পুরনো বলে পরিচিতিতে লেখা হয়েছে। তবে দেশটি শিল্পকলার ভুবনে পরিচিত হয়েছে গত পঞ্চাশ বছরের শিল্পচর্চার জন্য। পরিচিতির শেষে যে উপসংহার টানা হয়েছে তা সকল দেশের জন্যই কাম্য : ‘সর্বোপরি একটি স্বাস্থ্যকর, শিল্পবান্ধব পৃথিবী তখনই গড়ে তোলা সম্ভব যখন ব্যক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক, মুনাফানির্ভর ও মুনাফাহীন সকল প্রতিষ্ঠান একযোগে ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ স্লোগানে সুর মেলাবে।’ এই বিশ্বাস যেমন শিল্পের রাজনীতিকরণের বিরুদ্ধে, একইভাবে বাণিজ্যিকীকরণের বিরোধিতাও করে। খুব আশাবাদী না হলে এমন ভবিষ্যতের কথা ভাবা যায় না। হুয়ান রোদরিগো এসকোবার ক্যানভাসে তেলরং ব্যবহার করে ‘অ্যাটমসফিয়ার’ নামে তৈলচিত্রের মাধ্যমে নিজ দেশ কলম্বিয়ার প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ছবিটি পোস্ট-মডার্ন ধারার, যেখানে সন্নিবেশিত হয়েছে পরস্পরবিচ্ছিন্ন বিভিন্ন মোটিফ। ছোট এবং বড় চতুষ্কোণের গ–তে অবস্থিত মোটিফগুলির ভেতর গতির আভাস পাওয়া যায়, যা ছবিটিকে অতি সাধারণ হওয়ার পরিণতি থেকে রক্ষা করেছে। ইংরেজি বর্ণমালার ধারানুক্রম হিসেবে এরপর এসেছে ক্রোয়েশিয়া। পূর্ব ইউরোপের এই ছোট এবং সম্প্রতি স্বাধীন হওয়া দেশের শিল্পচর্চা সম্বন্ধে বাইরের পৃথিবীতে প্রায় কিছুই জানা নেই। পরিচিতিতে বলা হয়েছে : ‘শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে ক্রোয়েশিয়ায় প্রথাগত রীতি-পদ্ধতি এবং নতুন কলাকৌশল ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, সবকিছু সমানভাবে উপস্থিত। একদিকে যেমন ভিডিও প্রযুক্তি, ইনস্টলেশন, বৈদ্যুতিক ও রোবোটিক অনুষঙ্গনির্ভর কাজ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে ড্রইং, পেইন্টিং, প্রথাগত ফটোগ্রাফি কিংবা ঐতিহ্যগত চারুকলার কাজ হচ্ছে।’ এই চিত্র একটি উন্নয়নশীল দেশ, যা ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার সংমিশ্রণের চেষ্টা করছে তার অকৃত্রিম প্রতিভূ। প্রাচ্যের অনেক দেশের শিল্পচর্চাই ক্রোয়েশিয়ার শিল্পভুবনের যে পরিচিতি দেওয়া হয়েছে তার সঙ্গে মিলে যাবে। ক্রোয়েশিয়ার শিল্পচর্চায় বৈচিত্র্যের উল্লেখ করা হলেও দেশটির প্রতিনিধিত্ব করছে মাত্র একটি কাজ, রোমিনা দুমিকের ‘টাইম ইজ লাইফ’ নামের অতি সরল একটি ইনস্টলেশন। সরলতা এবং খুব প্রত্যক্ষ ভিজ্যুয়াল উপস্থাপনা হওয়ার কারণে এটি মধ্যমানের বেশি বলা যায় না। উত্তর কোরিয়া সামরিক প্রস্ত্ততি নিয়ে এত ব্যস্ত যে, সেখানে শিল্পকলার চর্চা হচ্ছে, সেই সংবাদ আশার সঞ্চার করে। হয়তো একদিন এর মাধ্যমেই সেই দেশে স্বাভাবিক জীবন যাপন সম্ভব হবে। পরিচিতি থেকে জানা গেল যে, দেশটিতে চারুকলার বিভিন্ন শাখা যেমন তৈলচিত্র, ভাস্কর্য, হস্তশিল্প, সূচিকর্ম ও ঐতিহ্যভিত্তিক অন্যান্য শিল্পকর্মকে উন্নত করার জন্য সরকারিভাবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। দেশটি থেকে পাঠানো হয়েছে পাঁচজন শিল্পীর পাঁচটি ‘কাজ’, যার সবই ঐতিহ্যভিত্তিক। একটি ছাড়া বাকি চারটিতেই সাদা রঙের পটভূমিতে কালো রঙের ব্যবহার করা হয়েছে। এই মনোক্রম বর্ণবিন্যাসে ছবিগুলি হয়েছে ‘চোখে পড়ার মতো’, মনোযোগ দিয়ে দেখার মতো নয়। মিশর প্রাচীনতম সভ্যতার দেশ, তার চিত্রকলা, বিশেষ করে দেয়ালে রঙিন মিউরাল আঁকার ঐতিহ্য, পৃথিবীতে সবচেয়ে পুরনো। এমন দেশে চারুশিল্পের চর্চা সমৃদ্ধ এবং অগ্রগামী হবে, এমন ভাবাই স্বাভাবিক। প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী শিল্পীদের সম্বন্ধে বলা হয়েছে, ‘এইসব শিল্পীর সৃষ্টিশীল শিল্পকর্মে একদিকে যেমন দেখা যায় নান্দনিক মূল্যবোধ, আত্মপ্রকাশের বিভিন্ন পদ্ধতি এবং জাতীয় ঐতিহ্যের প্রতিফলন, অন্যদিকে রয়েছে বর্তমান ও ভবিষ্যতের আশাবাদ। … রং ও রেখায় মিশরের লোকগাথা, পরিবেশ ও জীবনাচরণ সহজেই দৃষ্টিগোচর হয়। কিছু চিত্রকর্ম নিরীক্ষাধর্মী, সেখানে দেখা যায় চমৎকার সব প্রতীকাশ্রয়ী কাহিনি আর উদ্বুদ্ধ করে এমন বর্ণচ্ছটা।’ পরিচিতির এই বর্ণনার সঙ্গে প্রদর্শিত দুটি ছবির মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। একই শিল্পী ইব্রাহিম এলমাথির দুটি ছবিতে না আছে লোককাহিনির আভাস, না দেখা যায় রঙের বর্ণচ্ছটা। ডিজিটালি মডিফাইড ইমেজে শিল্পীর সৃজনশীলতার উৎকৃষ্টতা বৃদ্ধি পেয়েছে, এমন বলা যাবে না। লোকসংখ্যার স্বল্পতার জন্য ফিনল্যান্ডের শিল্পকলাচর্চার পরিসর বেশ সীমিত। কিন্তু এই দেশ থেকেই বেরিয়ে এসেছেন এরো সারিনেন এবং আলভার আল্টোর মতো বিশ্ববিখ্যাত স্থপতি ও সাইবেলিউসের মতো কম্পোজার। পরিচিতিতে আর্থিক সাহায্যের ও স্বীকৃতির অভাবের কথা বলার পর জানানো হয়েছে, ‘ফিনল্যান্ডে শিল্পীরা স্বাধীনভাবে কাজ করে চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন এবং গ্যালারি প্রতিষ্ঠা করেছে।’ এই তথ্য থেকে যে বাস্তবতা বের হয়ে আসে তা হলো দেশটিতে শিল্পীরা বেশ সক্রিয়। এঁদেরই একজন শিল্পী ইনকেরি জানট্টি, যার ট্রিপটিচের মতো তিনটি ফটোগ্রাফ পাশাপাশি প্রদর্শিত হয়েছে। তিনটি ফটোগ্রাফেই দেখা যায় একটি অন্ধকার ঘর, খোলা জানালার বাইরে আলো এবং বিভিন্ন ভঙ্গিতে জানালার সামনে দাঁড়ানো একটি নারীর ফিগার, যা রহস্য সৃষ্টিতে সফল কিন্তু ‘ইউ আর ওয়েটিং ফর এ ট্রেন’, এই শিরোনামের সঙ্গে বিষয়ের সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় না। আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে দেখানোর মতো ‘কাজ’ এটি নয়। ফ্রান্স একসময় পৃথিবীতে চারুশিল্পের রাজধানী ছিল। অনেক শিল্প-আন্দোলনের সূত্রপাত এই দেশে, বিশেষ করে প্যারিস শহরে, যেখানে এখনো অনেক দেশি-বিদেশি শিল্পীর বসবাস এবং শিল্পচর্চা অব্যাহত। পরিচিতিতে বলা হয়েছে, বিংশ শতাব্দীতে আধুনিক শিল্পকলার যাত্রারম্ভ হয়। এ সময় ফ্রান্সের শিল্পীরা প্রথাগত স্টাইলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে নতুন ধারার কাজ শুরু করে। … ফ্রান্সের বর্তমান সময়ের শিল্পীরা সমগ্র পৃথিবীর নানা বিষয়, ঘটনা ও প্রবাহ বিষয়ে সচেতন। তাঁরা ভাব ও ভাবনাকে প্রকাশের জন্য যে-কোনো মাধ্যমকে ব্যবহার করার জন্য প্রস্ত্তত।’ এই উক্তিতে অতিরঞ্জন নেই। প্রদর্শনীতে ক্যামিল ফলতেঁর ক্যানভাসে তেলরঙে করা ছোট, মাঝারি এবং বড় আকারের ছয়টি কাজ ওপরে-নিচে এবং পাশাপাশি রেখে একটা ডিজাইন সৃষ্টি করা হয়েছে, যার উদ্দেশ্য একটি বক্তব্য রাখা। ছয়টি খ– গাছের কা–র ফর্ম হালকা রঙে দেখানোর ফলে শিরোনামের বিষয়বস্ত্ত ‘ডেড ট্রি’ উপস্থাপিত হয়েছে সফলভাবে। ফ্রান্সের দ্বিতীয় শিল্পী গ্রেগরি দ্য গল প্রিন্টের পাঁচটি প্যানেলে একই রমণীর দেহের নানা ভঙ্গি কখনো নগ্নভাবে, কখনো অর্ধাবৃত রেখে প্রদর্শন করেছেন। একমাত্র কালো রং ব্যবহার করে সাদা-কালোর বৈপরীত্যে পাঁচটি প্যানেলের কাজে যেমন স্পষ্টতা এসেছে, একই নারীদেহের পাঁচটি ভিন্ন ভঙ্গির প্রদর্শন করে কাহিনি তৈরি হয়েছে। প্রকাশভঙ্গির বলিষ্ঠতার জন্য প্রিন্টের এই কাজটি ‘দেখার মতো’ হয়েছে। জার্মানির শিল্প-ঐতিহ্যও প্রাচীন। কিন্তু ঐতিহ্যের অনুসরণ নয়, আধুনিকতার নানা রূপের বৈশিষ্ট্য আবিষ্কারে বর্তমানে সেদেশের শিল্পীরা ব্যস্ত। পরিচিতিতে বলা হয়েছে, শিল্পকলার অঙ্গনে একই সঙ্গে দেখা যাবে পেইন্টিং এবং আলোকচিত্রের গ্রাফিক উপস্থাপনা, ভাস্কর্য এবং বস্ত্ত ও স্থাপনাশিল্প।’ প্রদর্শনীতে হার্থা মিয়েসনারের ‘এ লং ওয়ে’ শীর্ষক শিল্পকর্মে পাঁচটি পৃথক আকারের স্বচ্ছ কাগজে হাই এন্ড ফটোগ্রাফি দেখানো হয়েছে। বিষয়টি স্বয়ংব্যাখ্যিক না হলেও লাল ও কালো রঙের নানা টোনের মিশ্রণে নান্দনিকতা সৃষ্টি হয়েছে। ম্যারিনা হারম্যানের ‘প্যাশন’ শীর্ষক কাজটিও বিমূর্ত ধারার, যেখানে ব্যবহৃত হয়েছে মিক্সড মিডিয়া। ধূসর স্পেসের ভেতর আয়তাকার কম্পোজিশনটি গড়ে উঠেছে নানা রঙের পরস্পর জড়ানো বৃত্ত এবং ধূসর ও কালো রঙে এলিপটিকাল আকারের ফর্ম ওপরে-নিচে সন্নিবেশিত হওয়ার ফলে। দূর থেকে দেখলে কম্পোজিশনটি মনে হবে ভাসমান এবং ওজনহীন। আঙ্গিকের কুশলতার জন্য এই ছবিটিও ‘দেখার’ মতো। গ্রিসের শিল্পকলার ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। চিত্রকলার তুলনায় ভাস্কর্যের জন্যই দেশটির ব্যাপক খ্যাতি। গ্রিসের সমকালীন শিল্পকলা বলতে মূলত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তী সময়ের সৃষ্টিকেই বোঝানো হয়। এইসব কাজই আধুনিক ধারার অনুসারী এবং নিরীক্ষামূলকও বটে। দ্বি-বার্ষিক এশীয় চারুশিল্প প্রদর্শনীতে গ্রিসের মাত্র একজন শিল্পীর কাজ প্রদর্শিত হয়েছে। অ্যালেক্সিও সোটোসের ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিকে আঁকা ‘এ স্যাডো ওভার দি স্যাডো’ শীর্ষক অর্ধ-বিমূর্ত ছবিতে একটি মানুষের অবয়ব ও তার পেছনে কয়েকটি ছায়ার কম্পোজিশনে জ্যামিতিক শৃঙ্খলা ফর্মগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করেছে, যা না হলে অবয়ব ও ছায়াগুলির মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন সম্ভব হতো না। নানা টোনের রং ব্যবহার করে ফর্মগুলির ওজনের তারতম্য দেখানোর প্রয়াস বেশ সফল। ভারতের শিল্প-ঐতিহ্য সুপ্রাচীন এবং তার রয়েছে নিজস্ব শিল্পধারা। পাশ্চাত্যের সংস্পর্শে আসার পর ঐতিহ্যভিত্তিক শিল্পধারা এবং পাশ্চাত্যরীতির মধ্যে কোনটি অনুসরণ করা উচিত, এ নিয়ে ভারতীয় শিল্পীদের মনে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। ব্রিটিশ শাসনের সময়ে কেউ কেউ ঐতিহ্যভিত্তিক শিল্পকলার চর্চা করলেও পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ প্রমুখ শিল্পীর পরামর্শে শিল্পীরা ক্রমে ক্রমে পাশ্চাত্যের শিল্পরীতি গ্রহণ করেন। তবে অধিকাংশ শিল্পীরই শেষ পর্যন্ত লক্ষ্য হয় উভয় ধারার মেলবন্ধনের মিশ্রিত আঙ্গিক ব্যবহার। বর্তমানে শিল্পকর্মের বিষয় ভারতীয় হলেও আঙ্গিক ও রীতির দিক দিয়ে প্রায় সব ভারতীয় শিল্পীই পাশ্চাত্যের রীতির অনুসারী। প্রদর্শনীতে অমিত বিশ্বাসের ‘দি ব্যাচিলার’, কৌশিক গুপ্তের ‘এ ট্রু স্টোরি অফ দ্য পাস্ট’ অথবা ‘ইন সার্চ অফ দ্য পাস্ট’, শাহনা ভিনিতা করিমের ‘বার্থ অফ ক্রিয়েটিভ প্রসেস’, সুমিত সরকারের ‘জার্নি’, সুরজিৎ রায়ের ‘প্রাইভেট পেইন্টস’, কৌশিক হালদারের ‘সামারি’ কিংবা রজত রায়ের ল্যান্ডস্কেপ সমকালীন শিল্পরীতির অনুসারী, যেখানে বাস্তবতার সঙ্গে মিশেছে ফ্যান্টাসি। শিল্পগুণের বিচারে কৌশিক গুপ্তের ছবি দুটি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ড্রইংয়ের নৈপুণ্য জয়মত্মী বসাকের ‘ফল উইন্টারস্কেপ’ ছবির প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই ছবিতে স্পেসের ব্যবহারেও কুশলতার পরিচয় পাওয়া যায়। গোবিন্দ সরকারের তিনটি এচিংয়ের মধ্যে ‘আনটাইটল্ড-৩’ রেখা ও রঙের সমন্বয়ে সফল সৃষ্টি। সব মিলিয়ে প্রদর্শনীতে ভারতের অংশগ্রহণ সমেত্মাষজনক বলতে হবে, সংখ্যার ভিত্তিতে এবং উৎকর্ষের বিবেচনায়। ইন্দোনেশিয়ার শিল্পকলায় কৌম স্মৃতি ও আবেগ প্রাধান্য পেয়েছে, এর উল্লেখ করা হয়েছে পরিচিতিতে। এই উক্তির দৃষ্টান্ত দেখা যায়, এন্টোনিউস খোর আঁকা ‘রিমেমবারিং ইন দ্য পাস্ট-৪’ শীর্ষক ক্যানভাসে মিক্সড মিডিয়ার কাজে। টিয়ারামা ডেম রুথের ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিকে আঁকা ছবিটি নবীন শিল্পীর বলে মনে হয়, কম্পোজিশন, ফর্ম এবং রঙের ব্যবহার এতই সাধারণ। মাত্র দুটি ছবি দেখে একটি দেশের শিল্পচর্চার চরিত্র ও দিকদর্শন সম্বন্ধে সাধারণকৃতভাবে কিছু বলা যায় না, তবে প্রদর্শনীতে পাঠানো দুটি ছবি দেখে মনে হয়, ইন্দোনেশিয়ার শিল্পচর্চায় ঐতিহ্য ও আধুনিকতা সমকালেও পাশাপাশি চলছে। সমকালীন ইরান সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অনেক পর্যবেক্ষকের কাছেই কৌতূহলের বিষয়। তার রয়েছে প্রাচীন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আর বর্তমানে রাষ্ট্রীয় মতাদর্শের নির্দেশনা। পরিচিতিতে খোলাখুলিভাবেই বলা হয়েছে : ‘ইরানের সমসাময়িক শিল্পকলা এখনো অনেক সমালোচনা, বিতর্ক ও দার্শনিক বোঝাপড়ার মধ্যে রয়েছে। তবু আমরা এটা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে, কিছু সীমাবদ্ধতা ও তর্ক এবং আলোচনা থাকা সত্ত্বেও ইরানে বিশ্বমানের শিল্পচর্চার ভিত্তিপ্রস্তর ইতিমধ্যেই স্থাপিত হয়েছে।’ যাঁরা ইরানের সিনেমা দেখেছেন কিন্তু সমকালীন চিত্রকলা দেখার তেমন সুযোগ পাননি, তাঁরা ওপরের মন্তব্য মেনে নিতে দ্বিধা করবেন না। প্রদর্শনীতে যে তিনজন শিল্পীর ‘কাজ’ দেখানো হয়েছে তার মধ্যে দুজনই মহিলা, যে তথ্য রক্ষণশীল বলে দেশটির বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের সমালোচনার অসারতা প্রমাণ করে। তাঁদের শিল্পকর্ম দেখে বেশ বোঝা যায়, ইরানের শিল্পীরা ঐতিহ্যের প্রতি অনুগত হয়েও সমকালীন ধারা ও পদ্ধতির অনুসরণে পিছিয়ে নেই। ফেরিদুন ওমিডির ক্যানভাসে তেলরং এবং রুপালি কাগজ ব্যবহার করা কাজটিতে পদ্ধতিগতভাবে ঐতিহ্যের প্রভাব থাকলেও কম্পোজিশন এবং রঙের জন্য আধুনিক বিমূর্ত ধারার অন্তর্ভুক্ত। সিডা আজারি মারহাবির দুই প্যানেলের ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক রঙে যে অর্ধ-বিমূর্ত ছবি, সেখানে ইম্প্রেশনিস্ট রীতির অনুসরণ স্পষ্ট, বিশেষ করে রঙের স্বচ্ছতায়। জাহারা জাহারগোলির তৈলচিত্রের কম্পোজিশনে পোস্ট-মডার্ন ধারার আদর্শে বিচ্ছিন্ন ইমেজের সংকলন বাস্তবের খণ্ডিত রূপ তুলে ধরেছে। সব মিলিয়ে তিনটি ‘কাজেই’ ইরানের তিন শিল্পী বৈশ্বিক শিল্পরীতির সমসাময়িক রূপের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। আয়ারল্যান্ড পাশ্চাত্যের দেশ, সুতরাং তার শিল্পচর্চায় পাশ্চাত্য রীতি ও পদ্ধতি প্রাধান্য পাবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পরিচিতি থেকে জানা যায় যে, মাত্র দুশো বছর আগে প্রচলিত আইরিশ শিল্পে সূক্ষ্ম আলংকারিক সৌকর্যই ছিল প্রধান বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ ধর্মভিত্তিক আইকনের শিল্পই ছিল জনপ্রিয়। আর্থসামাজিক উন্নতির পথ ধরে দেশটি বর্তমানে পাশ্চাত্যের
যে-কোনো দেশের সমতুল্য, তার দৃষ্টান্ত প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী পাঁচজন শিল্পীর কাজ দেখে বোঝা যায়। সবগুলি ছবিই এচিং পদ্ধতির। এই ধরনের কাজ দেখলেই ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের লেখা, ‘আর্ট ইন দি এজ অফ মেকানিক্যাল প্রডাকশন’ প্রবন্ধটির কথা অনেকের মনে পড়ে যাবে, যেখানে তিনি কোনো ছবির এ ধরনের বহু সংস্করণের ফলে সংস্কৃতির গণতন্ত্রায়ণের কথা বলেছেন; সঙ্গে সঙ্গে কপি সহজলভ্য হওয়ার জন্য মূল ছবির ‘অরা’ বা শ্রদ্ধামিশ্রিত রহস্যময়তা যে থাকে না, তারও উল্লেখ করেছেন (১৯৩৬)। প্রিন্টমেকিং পদ্ধতির ছবি তৈরি এই দুই বিপরীত বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত হয়ে অবমূল্যায়নের সম্ভাবনা রোধের উদ্দেশ্যে সীমিতসংখ্যক কপি তৈরির প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে। প্রদর্শনীতে এচিংসহ অন্যান্য প্রিন্ট পদ্ধতির ছবির নিচে কোনো সংখ্যা না দেখা যাওয়া একটা ত্রম্নটি বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। মাইক ডাভোরেনের মনোক্রমে করা লিনোকাট ছবিটি ডিটেইলসের নিপুণ বিন্যাসে প্রায় ফটোগ্রফির গুণসম্পন্ন; তার সৃজনশীলতার অন্য দৃষ্টান্ত রঙের ব্যবহারে। মেরি গ্যালেহারের ড্রাই পয়েন্ট এচিং পরাবাস্তববাদী ধারার মনে হলেও পরস্পর সম্পর্কহীন ফর্মের সমাবেশে পোস্ট-মডার্নিস্ট বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। নোরাহ ব্রেনানের মনোপ্রিন্ট বিমূর্ত প্রকাশবাদী হলেও রঙের ব্যবহারে মিতব্যয়ী। শেন ক্রোটির সাদা-কালোর লিনোকাট সরলতার জন্য সাধারণ মানের হয়ে গিয়েছে। ইতালির শিল্পকলার ঐতিহ্য নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। কিন্তু এই গৌরবময় ঐতিহ্য যে তার শিল্পীদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে, পরিচিতিতে এই মন্তব্য অনেককে অবাক করে দেবে। পরিচিতির লেখকের মতে, ‘আমাদের শিল্প-ঐতিহ্যের অবস্থান থাকবে এমন যেন তাকে একটি সমৃদ্ধ কাঠামো বলে মনে হয়। এই সমৃদ্ধ কাঠামো থেকে নতুন নতুন চিত্রভাষা ও সৃজনপ্রক্রিয়া তৈরি হবে।’ এই বিশ্বাস সমকালীন ইতালিয়ান শিল্পীদেরও; তার প্রমাণ প্রদর্শনীতে পাঠানো দুটি ছবি। মারিয়া লুইসার ক্যানভাসে কালো রঙের অ্যাক্রিলিক ব্যবহার করে মোটা দাগের রেখায় ফুটিয়ে তোলা দুটি মুখের সঙ্গে কমিক বইয়ের অঙ্কন পদ্ধতির ফিগারের মিল রয়েছে, যার জন্য এটি পোস্ট-মডার্ন রীতির বলা যায়। মিনিমালিস্ট কম্পোজিশনের জন্য ছবিটিকে ড্রইং বলে মনে করা যেতে পারে। কনস্ট্যানটিন মিগলিওরিনির তৈলচিত্র ‘এট্টেসা-২’ ছবিটি ফর্মের খ–ত রূপ এবং একাধিক পটভূমি ব্যবহার করে পোস্ট-মডার্নধর্মী হয়েছে। বিষয় ভিন্ন হলেও ছবি দুটি একই ধারার সফল প্রতিনিধিত্ব করছে। শিল্পক্ষেত্রে জাপানের খ্যাতি বহুদিনের। এদেশের শিল্পচর্চায়ও রয়েছে অতীত ও বর্তমানের দ্বন্দ্ব এবং সমন্বয়ের প্রক্রিয়া। পরিচিতিতে বলা হয়েছে : কেউ চেষ্টা করেছেন ঐতিহ্যিক মূল্যবোধ ও আধুনিক জীবনের বাস্তবতার মধ্যে যতটা সম্ভব সংগতি আনার; আবার কেউবা ব্যস্ত থাকছেন প্রাচীন শিল্প পদ্ধতির মানদ-গুলি ব্যবহার করে আধুনিক নাগরিক জীবনের পরিপূর্ণ প্রকাশের জন্য চিত্ররূপ অঙ্কনে।’ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী চারজন শিল্পীর চারটি ‘কাজ’-এর মধ্যে দুটি ক্যানভাসে তেলরঙের এবং দুটি ইনস্টলেশন। চারটিতেই সমকালীন ধারার অনুসরণ দেখা যায়। তেলরঙের ছবি দুটিতে কম্পোজিশনের বিশৃঙ্খলা এবং রঙের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার বেশ হতাশাব্যঞ্জক। আকান টাজাইয়ের মিক্সড মিডিয়ার ইনস্টলেশন ছাড়া অন্য কোনো কাজই জাপানের সুনাম রক্ষা করতে পারেনি। কুয়েত তেলসমৃদ্ধ হলেও তার সংস্কৃতি নিয়ে গর্ব করার মতো ঐতিহ্য তো বটেই, চিত্রকলায় সমকালীন অর্জনও উল্লেখ করার মতো নয় বলে যাঁরা মনে করেন, তাঁদের কাছে প্রদর্শনীতে দেখানো কুয়েতের শিল্পকর্মগুলি চমকে দেওয়ার মতো মনে হবে। ১৯৭৩ সালে কুয়েতে আধুনিক শিল্প-আন্দোলন শুরু হয়েছে বলা হলেও, প্রদর্শনীতে পাঠানো শিল্পকর্মগুলির গুণগত উৎকর্ষ দর্শকদের মনোযোগ দিয়ে ‘দেখতে’ আকর্ষণ করবে। কুয়েতের ১০ জন শিল্পীর মধ্যে ছয়জনই কাজ করেছেন ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক রং ব্যবহার করে এবং চারজনের ‘কাজ’ মিক্সড মিডিয়া শ্রেণির। মূর্ত, অর্ধ-মূর্ত এবং বিমূর্ত – তিন শ্রেণির ছবিতেই আধুনিক ধারা ও পদ্ধতির সফল অনুসরণ দেখা যায়। জাবের আহমদের ‘আনটাইটলড-২’ কিংবা খালেদ আল শাট্টির ছবি দুটির যে-কোনোটি সম্মানজনক পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য ছিল। লেবানন মধ্যপ্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা দেশ, অন্তত নাগরিক জীবনের বিচারে। কিন্তু যে ধাতুপাত্র এবং মৃন্ময় পাত্র তৈরির জন্য দেশটির খ্যাতি তার কোনো নিদর্শন প্রদর্শনীতে ছিল না। হাগোপ সুলাহিয়ান এবং হিল্ডা কেলেকিয়ান, শিল্পী দুজনের কাজ বিমূর্ত প্রকাশবাদ ধারার খুবই সাধারণ উদাহরণ। লেনা কালাইকিয়ানের কাগজে অ্যাক্রিলিক ও মিক্সড মিডিয়ার কাজটি জ্যাকসন পোলকের ছবির কথা মনে করিয়ে দেয়। লেবাননের শিল্পীরা আধুনিক ধারার অনুসরণ করছেন বলে মনে হয় কিন্তু মনোযোগ দিয়ে ‘দেখার’ মতো কাজ অন্তত এই প্রদর্শনীতে পাঠানো হয়নি। লুক্সেমবুর্গ ইউরোপের দেশ হিসেবে যে সেই মহাদেশের শিল্পধারার অনুসারী তা বলাই বাহুল্য। ডেনি মার্টিনের দুটি ছবি তেলরঙের, যার মধ্যে প্রথমটিতে ফিগারের বিন্যাস এবং জ্যামিতিক ফর্ম পরাবাস্তববাদের আবহ সৃষ্টি করেছে। তাঁর দ্বিতীয় কাজ ‘এসকেপ’ বিশুদ্ধ বিমূর্তবাদী; মনোটাইপে করা এই কাজটি কম্পোজিশনের কুশলতার জন্য উল্লেখ করার মতো। মালয়েশিয়া ব্রিটিশ উপনিবেশের শাসনে ছিল প্রায় একশ বছর, যখন সেখানকার একাধিক নৃগোষ্ঠী নিজস্ব সাংস্কৃতিক সত্তা নির্মাণে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। অপরদিকে জাতিগতভাবে সকল নৃগোষ্ঠী বহিরাগত শাসকদের থেকে পৃথক সাংস্কৃতিক সত্তা গড়ে তোলারও প্রয়াস পেয়েছে, যা ছিল জটিল এক প্রক্রিয়া। পরিচিতি যিনি লিখেছেন তিনি পেশায় একজন স্থপতি বলে মনে হয়। তাঁর ভাষায় : ‘আমি আমার শিল্পকর্মসমূহে আধুনিকতার ধারা রপ্ত এবং প্রতিফলিত করেছি।’ কিন্তু তিনি এও বলেছেন যে, মালয়েশিয়ার শিল্পীরা তাদের জাতিগত স্বকীয়তাকেও (ঐতিহ্য) ভাষ্যরূপ দিতে তৎপর। ঔপনিবেশিক শাসনের অভিজ্ঞতা যেসব দেশের হয়েছে তাদের সাংস্কৃতিক পরিচিতি, বিশেষ করে শিল্পকলার চর্চায় অতীত ও বর্তমানের একটা বোঝাপড়া যে সমাধান হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে, মালয়েশিয়ায় সেই একই চিত্র দেখা যায়। কলোনিয়াল বাস্তবতাই জন্ম দিয়েছে পোস্ট-কলোনিয়াল প্রতিক্রিয়া ও আত্মপরিচিতি সুস্পষ্ট করে নির্মাণের তাড়নাকে। অনেক ক্ষেত্রেই শিল্পচর্চার আন্তর্জাতিক ভাষা, যা নির্মিত হয়েছে সাবেক কলোনিয়াল শাসকদের দেশে, তার প্রভাবই প্রধান হয়েছে উত্তর-ঔপনিবেশিক সময়ের শিল্পীদের কাজে। নেতিবাচকভাবে এবং সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখে বলতে হয় যে, রাজনৈতিক ভিত্তিতে উপনিবেশবাদের অবসান হলেও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে (অর্থনীতির ক্ষেত্রে তো বটেই) তার আধিপত্য পরোক্ষে বজায় থেকেই যায়। উপনিবেশবাদ যেমন পাশ্চাত্যের বড় দেশগুলির নির্মাণ ও ব্যবহারিক পদ্ধতি ছিল, উত্তর-উপনিবেশবাদে একমাত্র রাজনীতির ক্ষেত্রে অটোনমি ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে তাদের সেই ভূমিকা থেকে গেছে। তফাতটা এই যে, এখন আর আগের মতো বিদেশি শাসকদের চাপ দেওয়ার প্রয়োজন হচ্ছে না, চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও নেই। একজন নোগোগি থিও ইয়োঙ্গো ইংরেজি ভাষা বাদ দিয়ে নিজ দেশ কেনিয়ার ভাষা সাহিত্যচর্চায় ব্যবহার করলেই সেই আধিপত্যের সমাপ্তি ঘটবে না। অনগ্রসরতার জন্যই উন্নয়নশীল দেশে উত্তর-উপনিবেশ পর্বে আসার পরও উপনিবেশের সব উত্তরাধিকার থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় নেই। দ্বি-বার্ষিক প্রদর্শনীতে মালয়েশিয়া থেকে যে দুটি শিল্পকর্ম পাঠানো হয়েছে তাদের ব্যবহৃত পদ্ধতি ও আঙ্গিক যে পশ্চিমের আধুনিক ধারার উপরিউক্ত কারণে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আর এই ক্ষেত্রে মালয়েশিয়াই একমাত্র দৃষ্টান্ত নয়। অনেক সাবেক ঔপনিবেশিক দেশের জন্য এটাই স্বাভাবিক বাস্তবতা এবং হয়তো অনির্দিষ্টকালের ভবিতব্য। কিন্তু মালয়েশিয়ার দুই শিল্পীর আধুনিক ধারার কাজে যে গুণগত উৎকর্ষ দেখা যায় না, সেই বিষয়টি বেশি পীড়াদায়ক। অনুকরণও যখন অসফল হয় সেই ক্ষেত্রে একূল-ওকূল, দুই কূল যাওয়ার ব্যর্থতায় ম্রিয়মাণ হতে হয়। মরিশাস ভারত মহাসাগরে ক্ষুদ্র এক দ্বীপের দেশ। সেখান থেকে তিনজন শিল্পীর ভিন্ন মাধ্যমে করা তিনটি কাজই পাশ্চাত্যের আধুনিক ধারার এবং তিনজনের কাজই দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো। মিয়ানমার থেকে চারজন শিল্পীর যে কাজ প্রদর্শিত হয়েছে সেখানে ঐতিহ্যিক ধারা এবং সমকালীন পাশ্চাত্যের ধারা, উভয় প্রভাবই দেখা যায়। শিল্পকর্ম বিচারের প্রচলিত মানদ– কাজগুলি মাঝারি মানের ওপরে উঠতে পারেনি। নেপালের চারজন শিল্পীর মধ্যে দুজনের শিল্পকর্মে অতীত ও সমকালীনতার সংমিশ্রণ ঘটেছে, অন্য দুজন অনুসরণ করেছেন পাশ্চাত্যের অবিমিশ্র আধুনিক ধারা। শিল্প উৎকর্ষের জন্য রবীন্দ্র শ্রেষ্ঠার ইনস্টলেশনধর্মী কাজ ‘ওয়ার অর নো ওয়ার’ উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে অপ-আর্টেরও প্রভাব রয়েছে। নরওয়ে শিল্পজগতে এডভার্ড মানচের ‘দ্য স্ক্রিম’ ছবিটির জন্য সুপরিচিত। প্রথম মহাযুদ্ধের পর নরওয়ের শিল্পীরা পরাবাস্তববাদী ধারার প্রভাবে এলেও বর্তমানে বিমূর্ত প্রকাশবাদ অনুসরণের পাশাপাশি নতুন ধারার উদ্ভাবনেও তৎপর। এরই ধারাবাহিকতায় বিকশিত হয়েছে অভিব্যক্তিবাদী রীতির চিত্রকলা। প্রদর্শনীতে গ্রেটে মার্সটেইন নামক শিল্পীর অ্যাক্রিলিকে করা কাজটি অভিব্যক্তিবাদ এবং অবয়ববাদের মিশ্রণে তৈরি; পেইন্টিংটির কম্পোজিশনের দুর্বলতা আর রঙের ব্যবহারে বিচক্ষণতার অভাব চোখকে পীড়া দেয়। পাশ্চাত্যের শিল্পী হলেই যে সমকালীন ধারার চর্চায় সফল হওয়া যায় না, এটি তার একটি দৃষ্টান্ত। এ থেকে এই উপসংহারে আসা যায় যে, ঐতিহ্য একজন শিল্পীর শ্রেষ্ঠত্ব বা সীমাবদ্ধতা নির্ধারণে খুব একটা ভূমিকা রাখে না। ব্যক্তিগত প্রতিভাই হয় নিয়ামক। সুতরাং সাবেক উপনিবেশবাদী দেশগুলির শিল্পধারা অনুসরণ করেও সাবেক কলোনির শিল্পীদের মধ্যে যাঁরা প্রতিভাবান তাঁরা শুধু সফল নন, পাশ্চাত্যের শিল্পীদের অতিক্রম করে যাওয়ারও সম্ভাবনা রাখেন। এখনো যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় এমন হয়নি তার প্রধান কারণ শিল্পের বাজারে সাবেক কলোনির শিল্পীদের প্রবেশ ও স্বীকৃতি লাভে নানা প্রতিবন্ধকতা। দ্বি-বার্ষিক এশীয় চারুশিল্প প্রদর্শনীতে পশ্চিমের অকশন হাউস (সোদবি’স, ক্রিস্টি ইত্যাদি), চিত্র-সমালোচক এবং শিল্পকলাবিষয়ক পত্রিকার সম্পাদকদের অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হলে এইসব প্রতিবন্ধকতার অনেকগুলি দূর করা সম্ভব। নরওয়ের প্রসঙ্গে আবার ফিরে গিয়ে শুধু এইটুকু বলতে হয় যে, এডভার্ড মানচের দেশ থেকে আরো বেশি উৎকৃষ্ট মানের ছবি আসা উচিত ছিল। নেদারল্যান্ডস রেমব্রাঁ, ভ্যান গঘ এবং পিয়েট মন্ড্রিয়ানের মতো বিশ্ববিখ্যাত শিল্পীর দেশ। এমন শিল্প-ঐতিহ্যসমৃদ্ধ দেশ থেকে মাত্র একজন শিল্পীর ক্যানভাসে পিগমেন্টের মিনিয়েচারধর্মী যে ছবি প্রদর্শিত হয়েছে তার প্রকৃতি ডিজাইনধর্মী এবং গুণগতভাবে মাঝারি মানসম্মত বলা হলেও অত্যুক্তি হয়। কার অবহেলায় নেদারল্যান্ডসের এই নগণ্য অংশগ্রহণ? ওমান মধ্যপ্রাচ্যের ছোট একটি দেশ, যেখানে অন্যান্য দেশের মতো নিজস্ব শিল্প-ঐতিহ্য থাকলেও জনসংখ্যার স্বল্পতার জন্যই আধুনিক শিল্পচর্চায় উল্লেখ করার মতো তৎপরতা অনেকেই আশা করেন না। প্রদর্শনীতে পাঁচজন শিল্পীর পাঁচটি ছবি পাঠিয়ে শুধু নয়, সেগুলিতে ব্যবহৃত রীতি ও পদ্ধতির অত্যাধুনিকতা দর্শক-সমালোচকদের অবাক করেছে নিঃসন্দেহে। এসা আল মুফারজির এবং মরিয়ম আল জাদজালির ইনস্টলেশন দুটি গঠনে নিপাট এবং বিষয়ের উপস্থাপনায় লক্ষ্যভেদী। উপকরণ এবং পদ্ধতির ব্যবহারে মিতব্যয়িতা দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো। এই দুটি কাজের মধ্যে অন্তত একটি সম্মানজনক পুরস্কার পেতে পারত। পাকিস্তানে নারীদের সামাজিক অবস্থান এখন যে বেশ নাজুক, তা মাঝে মাঝে মিডিয়ার খবর থেকেই জানা যায়। কিন্তু সেদেশের সংস্কৃতিতে, বিশেষ করে শিল্পকলার ক্ষেত্রে, মেয়েরা যে বেশ অগ্রসর তার পরিচয় পাওয়া গেল প্রদর্শনীতে পাঠানো দুই মহিলার শিল্পকর্ম দেখে। ফিলিস্তিনে অনেক দিন থেকে যে ধ্বংস ও মৃত্যুর ট্র্যাজেডি চলছে তার পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে শান্ত পরিবেশে ধীরে-সুস্থে সুকুমারবৃত্তির চর্চা কল্পনা করা যায় না। কিন্তু বৈরী সময়ের মুখোমুখি হয়েও ফিলিস্তিনি নর-নারীর সত্তা অপরাজিত থেকেছে, যার প্রমাণ পাওয়া গেল সেদেশটি থেকে পাঠানো দুটি ছবি দেখে। পরিচিতিতে বলা হয়েছে, ফিলিস্তিনের মূল ভূখণ্ড জন্মগ্রহণকারী ও বেড়ে ওঠা শিল্পীরা প্রধানত অবয়ববাদী, আর মূল ভূখণ্ডের বাইরের শিল্পীদের কাজে দেখা যায় বিমূর্ত প্রকাশবাদের প্রভাব। এই বিভাজন কি অস্তিত্বের অভিজ্ঞতার ভিন্নতার প্রতিফলন? এই প্রশ্ন দেখা দেবে দর্শকের মনে। বিখ্যাত ইনকা সভ্যতার দেশ পেরুর শিল্পকলার ঐতিহ্য যে শুধু প্রাচীন নয়, সমৃদ্ধও, তা সহজে অনুমান করা যায়। কিন্তু মাত্র একজন শিল্পীর একটিমাত্র ছবি দেশটির যথার্থ প্রতিনিধিত্ব করতে পারেনি। ছবিটি মূলত বিমূর্ত ধারার, নিচে ডানপাশে নীল রেখায় একটি মানুষের মুখের আদল কম্পোজিশনে অভিনবত্ব এনেছে। তবু ছবিটি মাঝারি মানের, এর বেশি কিছু বলা যায় না। এশিয়ার উন্নত শিল্পধারার মধ্যে অন্যতম প্রধান শিল্পধারার জন্য ফিলিপাইন খ্যাতি অর্জন করেছে। প্রদর্শনীতে তিনটি প্যানেলের যে ইনস্টলেশন দেখানো হয়েছে তার মাধ্যমে দেশটির প্রতিনিধিত্ব করা গেছে বলা যাবে না, বরং এই কাজের ওপর চীন ও জাপানের সিল্ক স্ক্রিনের প্রভাবের কথা মনে পড়বে অনেকের। এত কাছের দেশ ফিলিপাইন থেকে কেন মাত্র একটা ছবি এলো, এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। পোল্যান্ডে বাংলাদেশের বেশ কিছু শিল্পী প্রশিক্ষণে গেছেন এবং তাদের কাছ থেকেই সেদেশের শিল্পচর্চার অগ্রগতি, বিশেষ করে গ্রাফিক্সে, শোনা গিয়েছে। প্রদর্শনীতে পোল্যান্ড থেকে যে দুটি ছবি পাঠানো হয়েছে তার মধ্যে শিল্পী বিটা শোকোলোস্কার ছবিটি বিমূর্ত ধারার; রঙের অত্যুজ্জ্বল ব্যবহারের জন্য এটি দৃষ্টিকে পীড়া দেয়। তুলনায় আলেকজাড্রা গ্যাব্রিয়েলার ‘সিম্পলি সিটি’ শীর্ষক লিনোকাটের কাজ সরলতার ভেতর শিল্পগুণম–ত। ছবিটিতে ছোট পরিসরে সাদা-কালোর বৈপরীত্য বিশালতার ইঙ্গিত দেয়। কাতারের পরিচিতিতে বলা হয়েছে : অন্যান্য দেশের মতো কাতারও সংস্কৃতির জগতে পরিচিত হওয়ার জন্য শিল্পকলাচর্চার প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছে এবং এর জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ভূমিকা রেখেছে। কাতারের শিল্পচর্চায় ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রাধান্য পায়নি বলেই মনে হয়। প্রদর্শনীতে পাঠানো দুজন শিল্পীর দুটি কাজই আধুনিক ধারার, একটি মিক্সড মিডিয়ায় এবং অন্যটি ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক ব্যবহার করে তৈরি। দুটি ছবিই মাঝারি মানের, তবে নাদিয়া আল মুদাকার অবয়ববাদী ছবিতে ইম্প্রেশনিস্ট ধারার রং ব্যবহার কৌতূহল সৃষ্টি করে। প্রজাতন্ত্রী কোরিয়ার
শিল্প-ঐতিহ্য প্রাচীন এবং এদেশের শিল্পীদের কাজে অতীত ও সমকালীনতার সংমিশ্রণ প্রধান বৈশিষ্ট্য। কিন্তু প্রদর্শনীতে যে ছয়জন শিল্পীর কাজ পাঠানো হয়েছে তাঁদের সবাই আধুনিক ধারার অনুসরণ করেছেন; সব কাজই বিমূর্ত ধারার। একটি ইনস্টলেশন ছাড়া বাকি সাতটিই চিত্রকলা, যার মধ্যে ছয়টি মিক্সড মিডিয়ায় আর একটি ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিকের কাজ। ঐতিহ্যভিত্তিক দু-একটি ছবি থাকলে দেশটির প্রতিনিধিত্ব পূর্ণতা পেত। ভারত মহাসাগরে অবস্থিত প্রায় অপরিচিত রিইউনিয়ন নামের দ্বীপদেশটি ফরাসি সংস্কৃতির প্রভাবে থেকেও নিজ ঐতিহ্যের ভিত্তিতে শিল্পচর্চা অব্যাহত রেখেছে। প্রদর্শনীতে মিকেল বোয়ারের দুটি ভাস্কর্যের কাজে অতীত এবং আধুনিকতার সংমিশ্রণ ঘটেছে। রাশিয়ায় কমিউনিজমের অধীনে সমাজবাদী বাস্তবতার আদর্শে শিল্পকলার বিভিন্ন মাধ্যমে বড় স্কেলের অনেক কাজ হয়েছিল। সে সবই ছিল অবয়ববাদী এবং তাদের উদ্দেশ্য ছিল মতাদর্শের প্রচার। বর্তমানে সেদেশে বিমূর্ত ধারার শিল্পচর্চার ওপর বিধিনিষেধ না থাকলেও প্রদর্শনীতে পাঠানো প্রায় সব কাজই অবয়ববাদী। তবে সেগুলিতে বাস্তবের হুবহু অনুকরণ নেই, অবয়বের ফর্ম বেশ স্টাইলাইজড। চারটি ছবির মধ্যে অন্তত তিনটিতে পরাবাস্তববাদের প্রভাব চোখে পড়ে। রাশিয়ার কাছ থেকে বিভিন্ন মাধ্যমের আরো বেশি ছবি আশা করা গিয়েছিল। সৌদি আরবের পরিচিতিতে বলা হয়েছে যে, ‘শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে আর পাঁচটা দেশ যে মান ও স্তরে পৌঁছেছে, দেশকে সেখানে পৌঁছে দেওয়া কর্তৃপক্ষের লক্ষ্য।’ এখানে ঐতিহ্যের কোনো প্রসঙ্গ নেই, আধুনিকতার পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার জন্য সমকালীন ধারার অনুসরণই কাম্য বলে ধরা হয়েছে। দুজন শিল্পীর যে দুটি কাজ প্রদর্শনীতে দেখানো হয়েছে তার একটি কালো মার্বেলে তৈরি বিমূর্ত ভাস্কর্য; দ্বিতীয়টি লোহার শিক দিয়ে তৈরি খাঁচার ভেতর কংক্রিটের ওপর উপবিষ্ট মানুষের ফিগারসহ একটি ইনস্টলেশন। সামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে ইনস্টলেশনটির একাধিক ব্যাখ্যার সম্ভাবনা কাজটিকে উল্লেখযোগ্য করেছে। সিঙ্গাপুর ছোট দ্বীপের দেশ হলেও অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য পৃথিবীতে প্রবাদপ্রতিম। তার সঙ্গে সংগতি রেখে শিল্পচর্চা এগিয়ে গিয়েছে, এমনটাই মনে হবে অনেকের কাছে। হয়তো তা হয়েছেও বাস্তবে। কিন্তু প্রদর্শনীতে তেলরঙের মাত্র একটি যে ছবি পাঠানো হয়েছে সেটি শিক্ষানবিশির বলে মনে হবে। এমন যে অপ্রত্যাশিত ঘটনা, তার পেছনের কারণ কী? ছবিটি সিঙ্গাপুরের মর্যাদা রক্ষা করেনি, দ্বি-বার্ষিক প্রদর্শনীর ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ণ করেছে। কৃষ্ণ আফ্রিকার দেশের মধ্যে একমাত্র দক্ষিণ আফ্রিকাই কেন প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছে, এই প্রশ্ন দেখা দেবে। যদি প্রদর্শনীটিকে আন্তর্জাতিক চরিত্র দেওয়াই বর্তমানের উদ্দেশ্য হয়, তাহলে আফ্রিকার আরো কয়েকটি দেশের অংশগ্রহণের প্রয়োজন ছিল। আফ্রিকার যে-কোনো দেশই ঐতিহ্যিক পদ্ধতিতে তৈরি ভাস্কর্যের জন্য সুপরিচিত এবং খ্যাত। এই ধারার চর্চা এখনো অব্যাহত আছে এবং অনেক আধুনিক শিল্পীর (পিকাসো তাঁদের একজন) কাছে ঋণী। পরিচিতিতে বলা হয়েছে, বিমূর্ত শৈল্পিক প্রকাশভঙ্গি দক্ষিণ আফ্রিকার প্রধান শিল্পধারা। প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী একমাত্র শিল্পী পামেলা সিলভারের দুটি ছবি এচিং মাধ্যমের এবং বিমূর্ত শ্রেণিভুক্ত। একটিতে রেখার দাগ প্রশস্ত এবং অন্যটির তুলনায় স্পেসের অনেকখানি অংশ জুড়ে আছে ফর্ম। এই বৈশিষ্ট্য ছাড়া ছবি দুটির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। মনে হয় যেন একই সিরিজের দুটি কাজ। শিল্পগুণে উঁচু মানের নয় ছবি দুটি। শ্রীলঙ্কার নিরবচ্ছিন্ন ধারায় প্রবাহিত ঐতিহ্যের অন্তর্গত হিসেবে ‘সিরিগাওয়া’ ফ্রেসকোর কথা বলা হয়েছে। বর্তমানে দেশটির শিল্পকলার চর্চা বহু-সংস্কৃতির বৈচিত্র্যে মণ্ডিত, যার জন্য সমকালীন শিল্পকলাচর্চার সীমানা ক্রমশ প্রসারিত হয়েছে। এর ফলে প্রচলিত মাধ্যম, পেইন্টিং ও ভাস্কর্যের গণ্ডি অতিক্রম করে শিল্পীরা ব্যবহার করছেন পরিবেশনা, স্থাপনা, মিক্সড মিডিয়া, ভিডিও ইত্যাদি মাধ্যম। অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় যে, এই প্রবণতা এখন বিশ্বজনীন। আধুনিক হলেও পুরনো মাধ্যম চমক সৃষ্টি করে না, যার জন্য নতুন মাধ্যমের দিকেই ঝোঁক বেশি শিল্পীদের। দ্রম্নত পরিবর্তনশীল পরিবেশে, অস্থির সময়ে নতুন মাধ্যমগুলিই যেন বেশি প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে শিল্পীদের কাছে নিজেদের অনুভূতি প্রকাশের জন্য। নিজের স্বকীয়তা প্রমাণের সুযোগ ও নতুন যুগের আধুনিক ধারার মাধ্যমে বেশি পাওয়া যায়, এটাও একটা কারণ হিসেবে কাজ করে। এর ভালো-মন্দ, দুটো দিকই আছে, যে প্রসঙ্গে লেখার শেষে আসা যাবে। শ্রীলঙ্কার যে চারজন শিল্পী চারটি কাজ প্রদর্শনীতে দেখিয়েছেন তার সবই ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিকে তৈরি পেইন্টিং এবং একটি তামার ভাস্কর্য। আধুনিক ফ্যান্টাসি-রিয়েলিস্ট (আমার বর্ণনায়) ধারায় তৈরি মালিকা সঞ্জিভানীর ‘মাই পোর্ট্রেট’ কম্পোজিশনে এবং রঙের ব্যবহারে উঁচুমানের। তামার পাত দিয়ে তৈরি লতাপাতার বর্তুলাকার ভাস্কর্যটি ফর্মের বিশদ সৃষ্টিতে এবং ডিটেইলসের কাজের জন্য উল্লেখযোগ্য। সব মিলিয়ে প্রদর্শনীতে শ্রীলঙ্কার প্রতিনিধিত্ব সমেত্মাষজনক। তাজিকিস্তান মধ্য এশিয়ার দেশ, যার চিত্রকলা সম্বন্ধে বাইরের পৃথিবী কমই অবগত। পরিচিতিতে খোলাখুলিভাবে বলা হয়েছে, ‘তাজিকিস্তানে সমসাময়িক চিত্রকলা অন্যান্য শিল্পমাধ্যমের মতো এখনো জনপ্রিয়তা অর্জনে ব্যর্থ বলা চলে। বাজার বা নিয়মিত সমর্থনের অভাবে এদেশের শিল্পীরা সমসাময়িক শিল্পচর্চায় সচেতন ও দায়িত্বশীল হওয়ার পরিবর্তে দুঃসাহসিক ও শৃঙ্খলাহীন হয়ে পড়েছে।’ এই পরিস্থিতিতেও যে শিল্পকলার চর্চা চলছে তার জন্য প্রশংসা করতে হয়। প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী তাজিকিস্তানের একমাত্র শিল্পী ইলিওস মামাদজানোভের ক্যানভাসে তেলরঙের কাজকে মোটেও শৃঙ্খলাহীন বলা যায় না। কম্পোজিশন, ফর্ম এবং রঙের ব্যবহারে ছবিটি পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্টদের কথা মনে করিয়ে দেয়। সবার জানা থাকলেও শিল্পকলার চর্চায় বাজারের ভূমিকা অথবা সমর্থন-গোষ্ঠীর (সরকার?) পৃষ্ঠপোষকতার কথা তাজিকিস্তান যেমন স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে সেইভাবে অন্য কোনো দেশ করেনি। এই স্পষ্ট ভাষণে শিল্পচর্চার মৌলিক সমস্যাটি উঠে এসেছে। থাইল্যান্ডের শিল্পকলা সম্বন্ধে যে পরিচিতি দেওয়া হয়েছে, সেখানে এই লেখায় মাঝে মাঝেই যে বক্তব্য রাখা হয়েছে, তার প্রতিধ্বনি শোনা যায় : বিভিন্ন পশ্চিমা শিল্প-আন্দোলনের অনুষঙ্গ-প্রসঙ্গের সঙ্গে নিজস্ব শিল্পচেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির সংমিশ্রণের মধ্য দিয়ে শিল্পকলার নতুন মতাদর্শের দিকে অগ্রসর হচ্ছে থাই শিল্পীরা।’ এই উক্তি খুব উচ্চাকাঙক্ষী, কেননা নিজস্ব মতাদর্শ গড়ে তোলা এককভাবে একটি দেশের পক্ষে এখন আর সম্ভব না, আন্তর্জাতিক চিন্তাভাবনা এবং প্র্যাকটিসের সঙ্গে সংযোগ সংমিশ্রণের প্রক্রিয়াতেই তা এসে যায়। শিল্পকলার বৈশ্বিক মূলধারার বাইরে থেকে একটি দেশ কেবল সংমিশ্রণের ক্ষেত্রেই নিজের উদ্যোগ, উদ্ভাবন এবং চর্চার প্রকৃতিতে অবদান রাখতে পারে। পাশ্চাত্যের দেশগুলি আধুনিক শিল্পচর্চায় এত এগিয়ে গিয়েছে যে, তাদের থেকে পৃথক হয়ে নিজস্ব মতাদর্শ তৈরি এবং আঙ্গিক ও পদ্ধতি নির্মাণ পাশ্চাত্যের বাইরের কোনো দেশের শিল্পীদের পক্ষে সম্ভব না। এটা তাদের প্রতিভার সীমাবদ্ধতার কারণে নয়, মূলত আধুনিক শিল্পজগতের অর্থনীতি ও রাজনীতির জন্যই। পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ করেই নয়, দেশজ ঐতিহ্যের মিশ্রণ করে হাইব্রিড ধারার উদ্ভাবন করতে পারাটাই হবে অন্যান্য দেশের শিল্পীদের জন্য বিশাল সাফল্য। এই মন্তব্যের পর আবার থাইল্যান্ডের শিল্প প্রসঙ্গে ফেরা যায়। প্রদর্শনীতে যে তিনজন থাই শিল্পীর শিল্পকর্ম দেখানো হয়েছে তাঁদের দুজনের কাজ মিক্সিড মিডিয়ায় এবং একজন ব্যবহার করেছেন ড্রইংয়ের মাধ্যম। তাওয়াটচাই সারিসুইটের মিক্সড মিডিয়ার কাজে বিভিন্ন টোনে সাদা রং ব্যবহৃত হয়েছে, যার জন্য ফর্মগুলি শনাক্ত করতে সময় নেয়। উপলব্ধির পর সেই পরিশ্রম ও প্রয়াস সার্থক মনে হয়। কায়েসুয়ানের মিক্সড মিডিয়ার কাজে থাই মোটিফের ব্যবহার আধুনিকতার সঙ্গে ঐতিহ্যের মিলন ঘটিয়েছে। থাইল্যান্ডের ছবি তিনটি মাঝারি মানের, কিন্তু যে দুজন শিল্পীর নাম করা হলো তাঁদের কাজ দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
তুরস্ক অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ইউরোপ ও সেন্ট্রাল এশিয়ার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক ছিল। অষ্টাদশ শতক থেকে দেশটির শিল্পকলা ক্রমশ তার নিজস্বতা ত্যাগ করে পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির অনুসরণ করতে শুরু করে। ফলে শিল্পচর্চায় একটি নতুন ধারার সৃষ্টি হয়। ঐতিহ্যিক শিল্পধারা সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় না এবং তার রেশ এখনো রয়েছে। প্রদর্শনীতে তুরস্কের একমাত্র ছবি শিল্পী এনিক সিমেনের ক্যানভাসে তেলরঙের কাজটি এমন যে তা ইম্প্রেশনিজম ধারার কথা মনে করিয়ে দেয়। উৎকর্ষের দিক দিয়ে ছবিটি খুব উঁচু মানের নয়। তুরস্ক থেকে আরো শিল্পকর্ম প্রদর্শনীতে আসা উচিত ছিল। যুক্তরাজ্যের শিল্পকলা পাশ্চাত্যের চারুশিল্পের অবিচ্ছেদ্য অংশ। দেশটির অনেক শিল্পী বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করে খ্যাতি অর্জন করেছেন। শিল্পকলার ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় যত শিল্পধারা এসেছে সবগুলিতেই এই দেশের শিল্পীরা কাজ করেছেন। কেউ কেউ নতুন ধারারও সৃষ্টি করেছেন। যেমন, ড্যামিয়েন হার্স্ট ফর্মালডিহাইডে পশুর খ–ত অংশ রেখে অথবা ট্রেসি এমিনের চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী ইনস্টলেশন ‘মাই বেড’, যেগুলি পোস্ট-মডার্ন ধারার বলা যেতে পারে। এমনকি ডেভিড হকনির পপ আর্টের আদলে আঁকা দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ দৃশ্যের ছবিতে এমন ঝলমলে আভাস দেখা যায় যে, সেগুলি আধুনিক রিয়েলিস্ট ধারায় নতুন সংযোজন বলে মনে করা যেতে পারে। প্রদর্শনীতে মাত্র একজন ব্রিটিশ শিল্পীর ছবি থাকা বেশ হতাশাব্যঞ্জক। কাগজের ওপর অ্যাক্রিলিক রঙে করা আন্দ্রিয়াস টমলিনের ছবি দুটির ফিগার স্টাইলাইজড। কম্পোজিশনের জ্যামিতিক মাত্রা এবং রঙের জন্য ছবিটি নিরীক্ষাধর্মিতার বৈশিষ্ট্য পেয়েছে। ছবি দুটি সমকালীন ধারায় রিয়েলিস্টধর্মী আঁকার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। যুক্তরাষ্ট্রের পরিচিতিতে বলা হয়েছে, দেশটির শিল্পকর্মকে কোনো একটি জাতীয় পরিচয় দিয়ে সীমাবদ্ধ করা যায় না। বিমূর্ত প্রকাশবাদ ধারার সূত্রপাত করা ছাড়া দেশটির চিত্রকলার কোনো অনন্য পরিচয় বা বৈশিষ্ট্য নেই। যে পপ আর্টের জন্য তার খ্যাতি সেটি এসেছে ব্রিটেন থেকে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের চিত্রকলা সম্বন্ধে একটি সাধারণ ধারণা হলো এই যে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় চিত্রকলাজগতের রাজধানী প্যারিস থেকে নিউ ইয়র্কে চলে আসে, তার পর থেকে এদেশে দেশি-বিদেশি শিল্পীরা নতুনত্বের সন্ধানে উৎসাহী। বেশ কয়েকটি মিউজিয়াম স্থাপিত হওয়ার পর এবং বড় বড় করপোরেট হাউস ছবি কেনার ও সংগ্রহের প্রতি আগ্রহ দেখানোর জন্য এই দেশের চিত্রজগৎ অত্যন্ত প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। দ্বি-বার্ষিক প্রদর্শনীতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে মাত্র দুটি ছবি এসেছে, যা তার সাম্প্রতিক শিল্পচর্চা সম্বন্ধে খুবই আংশিক ধারণা দেয়। অ্যাডাম মরিস এলেশের মিক্সড মিডিয়ার কাজ অর্ধ-বিমূর্ত পদ্ধতির হলেও স্পেসের বিভাজনে জ্যামিতিক যে শৃঙ্খলা দেখা যায় তার ফলে উৎকর্ষের পরিচয় পাওয়া যায়। আপাতদৃষ্টিতে ছবিটিতে রঙের প্রতি যে অযত্নের ছাপ তা বিমূর্ত ভাব ফুটিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে। সারাহ শুসটারের পেইন্টিং ইনস্টলেশন অনাবশ্যকভাবে দীর্ঘ, যার জন্য মনোযোগ রক্ষা করা সহজ হয় না। কাজটি মাঝারি মানের। প্রদর্শনীতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব সমেত্মাষজনক, একথা বলা যাবে না। ভিয়েতনামের শিল্পকলার ইতিহাস বেশ প্রাচীন। এদেশে চীনের বৌদ্ধ এবং ভারতের হিন্দু শিল্পকলার প্রভাব একসময় প্রবল ছিল। তবে লোকায়ত শিল্পে দেশটির নিজস্ব সৃজনশীল ঐতিহ্যের স্বাক্ষরও দেখা যায়। ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ভিয়েতনামের অনেক শিল্পী অন্যান্য উপনিবেশের মতো আন্তর্জাতিক শৈল্পিক আদান-প্রদান প্রক্রিয়ায় জড়িত হয় এবং অংশগ্রহণ করে। ভিয়েতনাম থেকে প্রদর্শনীতে কেন একটি মাত্র ছবি এসেছে, এ প্রশ্ন অনেকেই করবেন। দাক দাওনের সিল্কের ওপর প্রিন্টের কাজটি ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মিশ্রণে হলেও শিল্পের গুণগত মানে উল্লেখযোগ্য নয়।
নয়
বাংলাদেশের পরিচিতিতে বলা হয়েছে : ‘প্রায় সাত দশক আগে ব্রিটিশ-ভারতীয় শিল্প-ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার নিয়ে বাংলাদেশের শিল্পকলার যাত্রা শুরু (২০১৬)।’ এই বর্ণনায় ঐতিহ্য এবং ঔপনিবেশিক শাসকদের দেশে প্রচলিত শিল্পধারার সংমিশ্রণের ইঙ্গিত রয়েছে। লোকায়ত ঐতিহ্যের অনুসরণে কেউ কেউ কাজ করলেও বিশ্বের সকল প্রান্তের শিল্পভাবনাকে গ্রহণ করে অগ্রসর হয়েছেন বাংলাদেশের শিল্পীরা। বর্তমানে যেসব শিল্পী কাজ করছেন তাঁরা আঙ্গিকগত সব মাধ্যম এবং ধারা ও পদ্ধতিগুলিই ব্যবহার করছেন। প্রদর্শনীতে বাংলাদেশের শিল্পীদের কাজই সবচেয়ে বেশি, যার জন্য সমকালীন শিল্পচর্চা সম্বন্ধে একমাত্র বাংলাদেশের প্রসঙ্গেই সম্যক ধারণা সম্ভব। একমাত্র বিষয় ছাড়া, আঙ্গিক ও পদ্ধতির ব্যবহারে নতুন প্রজন্মের প্রায় সব কাজই আন্তর্জাতিক চরিত্রের। বাংলাদেশি যেসব শিল্পী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছেন তাঁদের মধ্যে অ্যাক্রিলিক মাধ্যম ব্যবহার করেছেন সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শিল্পী (৩৫ জন)। এরপরই রয়েছেন মিক্সড মিডিয়া ব্যবহারকারী শিল্পীরা (২৫ জন)। ছাপচিত্র মাধ্যমে কাজ করেছেন ১৬ জন শিল্পী। ১৩ জন শিল্পী ব্যবহার করেছেন কাঠ খোদাই মাধ্যম। তেলরঙের কাজ করেছেন ৯ জন শিল্পী আর ভাস্কর্য তৈরি করেছেন ১১ জন। দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবহৃত প্রচলিত মাধ্যম ড্রইং, জলরং এবং তৈলচিত্রের ব্যবহার হ্রাস সব দেশের মতো বাংলাদেশেও দেখা যাচেছ। এইসব মাধ্যমের ওপর অ্যাকাডেমিক কঠোর শৃঙ্খলার প্রভাব একটা কারণ হলেও পরিবর্তনশীল সমাজে মানুষের রুচির পরিবর্তনও এর জন্য দায়ী বলা যায়। বর্তমান সময়ের জীবন ও তার পরিবেশ ব্যাখ্যায় নতুন মাধ্যমের প্রয়োজনীয়তার কথাও উল্লেখযোগ্য।
এবারের প্রদর্শনীতে প্রথমবারের মতো পারফরম্যান্স আর্ট স্থান পেয়েছে। বিভিন্ন বিষয় উপস্থাপনার জন্য এই মাধ্যমের কাজে শারীরিকভাবে অংশগ্রহণ করেছেন শিল্পীরা, যাঁদের মধ্যে মেয়ে ও পুরুষ উভয়ই ছিল। বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করে একটা পরিস্থিতি, দৃশ্য বা ঘটনা সৃষ্টি করে পারফরম্যান্স আর্ট পরিবেশনা করা হয়েছে। প্রধানত মূক হয়ে, কেবল অঙ্গভঙ্গির সাহায্যে, কখনো বা সংক্ষিপ্ত উচ্চারণে অথবা আবহসংগীত যোগ করে শিল্পী/শিল্পীরা তাঁদের উদ্দিষ্ট বক্তব্য প্রকাশ করেছেন এই মাধ্যমে। সরাসরি দেখানোর পাশাপাশি ভিডিওতে প্রদর্শিত হয়েছে নতুন আঙ্গিকের এই আর্ট। একে বলা যায়, সচল ইনস্টলেশন আর্ট; এখানেও মিক্সড মিডিয়া ব্যবহার করা যায়, যা কেউ কেউ করেছেনও। ইনস্টলেশন আর্টের মতো পারফরম্যান্স আর্টেরও কোনো প্রচলিত পদ্ধতি বা রীতি বা কোনো নিয়ম নেই। তবে ইনস্টলেশনে যেমন একটা শিল্পভাবনা বা শিল্পরূপ সৃষ্টি প্রধান লক্ষ্য হয়ে থাকে, পারফরম্যান্স আর্ট তার স্থানে বিশেষভাবে বক্তব্যপ্রধান। এই বক্তব্যে কখনো সামাজিক, কখনো রাজনৈতিক বিষয়কে কেন্দ্র করে ক্ষোভ বা প্রতিবাদ থাকে। এই কারণে পারফরম্যান্স আর্টের পরিবেশনায় শুধু দর্শক না, যার বা যাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বা প্রতিবাদ জানানো হয় সেই প্রতিপক্ষ অদৃশ্যে হলেও উপস্থিত থাকে। সেই জন্য মাধ্যমটি বেশ স্পর্শকাতর। এখানে বলা প্রাসঙ্গিক যে, সভ্যতার উষালগ্ন থেকেই বিনোদনের জন্য অথবা অতিলৌকিক শক্তির প্রতি ভক্তি ও প্রার্থনা জানানোর উদ্দেশ্যে মানুষ নানা অঙ্গভঙ্গি করেছে যদিও সেসব শিল্প হিসেবে বিবেচিত হয়নি। দ্বি-বার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে মোট ১২ জন শিল্পী পারফরম্যান্স আর্ট প্রদর্শন করেছেন, যার মধ্যে ৬ জন ছিলেন মহিলা।
দশ
বাংলাদেশি যেসব শিল্পী (আমন্ত্রিত ব্যতীত) প্রদর্শনীতে বিভিন্ন মাধ্যমের কাজ নিয়ে অংশগ্রহণ করেছেন তাঁদের সবার সম্বন্ধে বলতে গেলে লেখা দীর্ঘ হয়ে যাবে। সেই জন্য মাধ্যমভিত্তিক সেইসব শিল্পীর সংক্ষিপ্ত আলোচনা থাকবে, যাঁদের কাজ ‘মনোযোগ দিয়ে দেখার মতো’ ছিল। অন্য যেসব কাজ ‘চোখে পড়ার মতো’ শ্রেণির, সেসবও উল্লেখযোগ্য, গুণগত উৎকর্ষের জন্য না হলেও বৈচিত্রের জন্য। এই শ্রেণির কিছু কাজেরও আলোচনা হবে। সবাই মিলে অংশগ্রহণ করেছেন বলেই প্রদর্শনীতে বাংলাদেশের শিল্পীদের উপস্থিতি ছিল উৎসাহের বিষয় এবং সমেত্মাষজনক। তাঁরা সবাই আন্তরিক হয়ে বাংলাদেশের শিল্পভুবনের প্রতিনিধিতব করেছেন, উপহার দিয়েছেন তাঁদের পরিশ্রম ও মেধার ভিত্তিতে সৃষ্ট শিল্পকর্ম।
বাংলাদেশের শিল্পীরা যেসব মাধ্যমের কাজ প্রদর্শনীতে দিয়েছেন তার মধ্যে জলরং এবং ড্রইংয়ের কাজ ছিল সবচেয়ে কম, যথাক্রমে ৬ এবং ১। মনে হয় শিল্পীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রাথমিক পর্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হওয়ার জন্য পরিণত পর্যায়ে পৌঁছে শিল্পীরা এই দুটি মাধ্যম অতিক্রম করে পরবর্তীকালে রপ্ত মাধ্যমগুলিতে কাজ করার আকর্ষণ বৃদ্ধি পেয়েছে। শৈল্পিক গুরুত্বে এই দুটি মাধ্যম যে অনুল্লেখ্য নয় কামরুল হাসানের জলরঙের ছবি এবং মুর্তজা বশীরের ড্রইং সে কথা জানিয়ে দেয়। প্রদর্শনীতে অলকেশ ঘোষের জলরঙে নদী-মেখলা বাংলাদেশে বর্ষা ঋতুর শ্যামল-সজল প্রকৃতি ব্যক্ত হয়েছে। অমিত নন্দী এবং আজমির হোসেনের জলরংও প্রাণবন্ত। অমিত নন্দী স্পেসকে যেভাবে ভেঙেছেন, জলরং আঙ্গিকে তা অভিনব। ড. মলয় বালার এক রঙা কাজে আয়তাকার কম্পোজিশনের ভেতর প্রায় অদৃশ্য অবয়ব যেমন শিল্পকুশলতার পরিচয় দেয়, তেমনি জলরঙের মাধ্যমে বৈচিত্র্য সৃষ্টির সম্ভাবনার প্রতিও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ফরহাদ হোসেনের ‘প্রকৃতি ও মাছ’ ক্যালিগ্রাফি হলেও ড্রইং শ্রেণির, আঙ্গিকের ভিত্তিতে এবং বিষয়ের জন্য। কম্পোজিশনের কুশলতায় কাজটিতে বিভিন্ন ফর্মের সন্নিবেশ শিল্প-সৌকর্য সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশি শিল্পীদের কাছ থেকে অ্যাক্রিলিক মাধ্যমের কাজ সবচেয়ে বেশি এসেছে। বিপাশা হায়াত অভিনয় জগতে ব্যস্ত থাকলেও চিত্রশিল্পী হিসেবে প্রদর্শনীতে অ্যাক্রিলিকের যে কাজটি দিয়ে সম্মানজনক পুরস্কার লাভ করেছেন সেটি উপকরণের অভিনব ব্যবহারে এবং একরঙে বহুতলের সৃষ্টিতে দৃষ্টিনন্দন। আবদুর রশীদ তৌফিকের অ্যাক্রিলিকের কাজে ফটোগ্রাফির নেগেটিভের চরিত্র এবং বিভিন্ন মোটিফের সমন্বয় পোস্ট-মডার্নিস্ট ধারার একলেকটিসিজম বা সংমিশ্রণের বৈশিষ্ট্য দিয়েছে। একই অনুভূতি ও চিন্তার উদ্রেক হয় আতিয়া ইসলাম এ্যানির অ্যাক্রিলিকের কাজ দেখে। কম্পোজিশনের কুশলতায় ফারজান আহমদের অ্যাক্রিলিকের কাজ উল্লেখযোগ্য। রেজাউন নবীর অ্যাক্রিলিকের কাজে স্পেসের জ্যামিতিক বিভাজনের ভেতর রং দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ফর্ম তৈরি এবং একটি ছায়াময় ফিগারের উপস্থিতি বৈচিত্র্য সৃষ্টি করেছে। ফিদা হুসেনের অ্যাক্রিলিকে তৈরি মুখের অভিব্যক্তি প্রাণবন্ত; ছবিটিতে রঙের ব্যবহার ড্রইংয়ের বলিষ্ঠতা নিয়ে এসেছে। সুলতানা শারমিনের ‘মাই ডেইলি লাইফ’ অ্যাক্রিলিকের মাধ্যমে কোলাজ সৃষ্টি করেছে বলে মনে হয়। স্পেসের জ্যামিতিক বিভাজন এবং ফর্মের পৃথক ও স্পষ্ট উপস্থাপনায় মোজাইকের দৃঢ়তার পরিচয় পাওয়া যায়। এম এম মিজানুর রহমান ‘আননোন ফেস’ ছবিতে অ্যাক্রিলিকে ট্যাপেস্ট্রির ঠাস বুনন সৃষ্টি করেছেন। টাইগার নজিরের অ্যাক্রিলিক কাজে বাংলার পটচিত্রের খ- খ- উপস্থাপনা দৃষ্টি আকর্ষণ করে। লোকায়ত মোটিফের সঙ্গে আধুনিক যান (বিমান) যুক্ত করে তিনি পপ আর্টের আভাস দিয়েছেন। রেজা হুদার অ্যাক্রিলিকের কাজ ‘ন্যারেটিভ ওয়াল’ কম্পোজিশনে এবং রঙের ব্যবহারে দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
বাংলাদেশের শিল্পীরা অ্যাক্রিলিক মাধ্যমের পরই ইনস্টলেশন মাধ্যম ব্যবহার করেছেন বেশি। অভিনবত্ব ও সৃজনশীলতার সুযোগ বেশি থাকায় এই মাধ্যম নবীন, প্রবীণ সব শিল্পীর কাছেই ছিল আকর্ষণীয়। ষষ্ঠদশ দ্বি-বার্ষিক প্রদর্শনীতে এই মাধ্যমে গ্র্যান্ড প্রাইজ পেয়েছিলেন গুলশান হুসেন। সপ্তদশ প্রদর্শনীতে তাঁর ইনস্টলেশন বক্তব্যের প্রত্যক্ষতায় এবং উপস্থাপনার উৎকর্ষে মনোযোগ দিয়ে দেখার মতো। আনিসুজ্জামান সোহেলের পেইন্টিং ও ভাস্কর্য নিয়ে তৈরি ইনস্টলেশন পরিচ্ছন্নতায় এবং সারল্যে জেন ধর্মের প্রশান্তি জানায়। কাজটি জেন শিল্পের মতোই মিনিমালিস্ট। আতিকুল ইসলামের ভিডিও ও মাটি দিয়ে তৈরি ইনস্টলেশনের ত্রিমাত্রিকতা এবং মিনিমালিস্ট বৈশিষ্ট্য দৃষ্টিনন্দন। সানাউলস্নাহর ইনস্টলেশনে খুব সাধারণ উপকরণ দিয়ে ত্রিমাত্রিক প্রেক্ষিতে ভাস্কর্যের রূপ সৃষ্টি প্রশংসনীয়। মাছের সংখ্যা খুব বেশি হওয়ায় আবদুল মোমেন মিল্টনের ইনস্টলেশন প্রশংসনীয় হতে গিয়েও হলো না। তবু এটি উল্লেখযোগ্য বৈচিত্র্যের জন্য। মিক্সড মিডিয়ায় আফরোজা জামিল কঙ্কার ইনস্টলেশন উপকরণের ব্যবহারে বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং উপস্থাপনায় দৃষ্টিনন্দন। জিহান করিমের ভিডিও ইনস্টলেশনে নানা আকারের বৃত্ত পরিপ্রেক্ষিতকে রহস্যময় করে তুলেছে, এই জন্য কাজটিতে প্রযুক্তির ব্যবহার সৃজনশীলতাকে অতিক্রম করে যায়নি।
সংখ্যার দিক দিয়ে এর পরই বাংলাদেশি শিল্পীরা বেশি কাজ করেছেন মিশ্র মাধ্যমে। এই আধুনিক মাধ্যমও পাশ্চাত্যের শিল্পভুবন থেকে নেওয়া এবং এটি সৃজনশীলতার বৈচিত্র্যে সীমাহীন হওয়ার কারণে শিল্পীদের কাছে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ইনস্টলেশন হিসেবেও কেউ কেউ মিক্সড মিডিয়ার ব্যবহার করেন। যেমন আফরোজা কঙ্কা, যাঁর কথা আগেই বলা হয়েছে। উপকরণের নিপুণ ব্যবহারে আইভি জামানের ‘টাইমকিপার’ শীর্ষক মিশ্র মাধ্যমের কাজটি উল্লেখযোগ্য। সিরামিক ব্যবহার করে মারুফা চৌধুরী মিশ্র মাধ্যমে যে কাজ করেছেন সেটি অতি উন্নত এবং নিপুণ হাতে তৈরি নকশিকাঁথার মতো দেখায়। ফর্ম এবং রং, উভয়ের ব্যবহারেই নিয়ন্ত্রণের পরিচয় রয়েছে। রাশেদুল হুদার মিশ্র মাধ্যমে সূক্ষ্ম রেখার একই ফর্ম ওপরে-নিচে এবং পাশাপাশি রেখে স্পেস পূর্ণ করলেও ধূসর রঙের ব্যবহারে শূন্যতার ব্যঞ্জনা সৃষ্টি হয়েছে। মাহমুদুল হাসানের ‘অচিন পাখি’ ইনস্টলেশন কিংবা মিশ্র মাধ্যম, যে-কোনো শ্রেণিতেই পড়তে পারে। এই কাজে যা উল্লেখযোগ্য তা হলো ফিগারগুলির উড়বার ভঙ্গিতে উদ্দাম গতিশীলতা। সাবিরা শাহানুরের মিশ্র মাধ্যমে পায়ের ছাপ শুধু কালো রঙের ফ্রেমে বন্দি হয়ে থেকে খুব সাধারণ দেখাতে পারত, কিন্তু মাঝখানে তিনটি সমান্তরাল দাগ দিয়ে স্পেস বিভক্ত করার জন্য গভীরতর অর্থ সৃষ্টি হয়েছে। শর্বরী রায় চৌধুরীর ‘কম্পোজিশন অন ইয়োলো’ দুটি প্যানেলের ভেতর ভিন্ন রঙে বিভিন্ন ফর্ম নানাভাবে সাজিয়ে যে ডিজাইন সৃষ্টি করা হয়েছে তা অঁরি মাতিসের কথা মনে করিয়ে দিলেও বিমূর্ত হওয়ার জন্য স্বকীয়তা পেয়েছে। দুই প্যানেল মিলে শান্ত স্নিগ্ধতার প্রকাশ দৃষ্টিনন্দন এবং মনে আনন্দ সৃষ্টি করে।
সংখ্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশি শিল্পীদের ছাপচিত্রের কাজ চতুর্থ। এই মাধ্যমে নবীন, প্রবীণ অনেক শিল্পী যে পারদর্শিতা অর্জন করেছেন তার দৃষ্টান্ত ছিল সপ্তদশ দ্বি-বার্ষিক প্রদর্শনীতে। আবুল হুসেন ঢালীর সাদা-কালোর বৈপরীত্যে সৃষ্ট বিমূর্ত এচিং এবং অমিত মিত্রের এচিংয়ে ছয়টি প্যানেলে ভিন্ন ভিন্ন রঙের বর্গগুলিতে বিমূর্ততা এচিং মাধ্যমে নতুন বৈশিষ্ট্য যোগ করেছে। রশিদ আমিনের ‘ফ্লোরাল ইমেজ’ ড্রাই পয়েন্টে প্রিন্ট সূক্ষ্ম রেখার মাধ্যমে যে বিমূর্ত ফর্ম তৈরি করেছে তা বেশ আকর্ষণীয়। বাংলাদেশি শিল্পীদের ছাপচিত্রের অধিকাংশই ছিল বিমূর্ত ধারার, যা বেশ ব্যতিক্রমী। ছাপচিত্রে বাংলাদেশি শিল্পীরা যে বেশ অগ্রসর তার অনেক স্বাক্ষর রয়েছে প্রদর্শনীতে।
বাংলাদেশি শিল্পীদের ১১টি ভাস্কর্য প্রদর্শিত হয়েছে। এ এম কাওসার হোসেনের স্টেইনলেস স্টিলে তৈরি ভাস্কর্যটি ল্যান্ডস্কেপে চমৎকারভাবে মিশে গিয়েছে। এই কাজে একাধিক মাত্রার ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। রমিজ আফরোজ শাহীর ভাস্কর্য ‘কম্পোজিশন-২’ ফর্ম ও টেক্সচারের জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ করে। শান্তনু মণ্ডলের ভাস্কর্যে আড়ষ্টতা এবং গতির দ্বন্দ্ব সফলভাবে সৃষ্টি হয়েছে। অর্ধ-বিমূর্ত ফর্মে বিভিন্ন অংশের ব্যালান্স প্রশংসনীয়। সুমন বর্মণের ‘ডিজায়ার উইংস’ অসমান এবং অমসৃণ উপকরণ ব্যবহার করে ফর্মে বৈচিত্র্য এনেছে।
কাঠ খোদাইয়ের ১০টি কাজ প্রদর্শন করে বাংলাদেশের শিল্পীদের কাছে এই মাধ্যমের জনপ্রিয়তা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেকের কাজই প্রমাণ করে যে, এই মাধ্যমে তাঁরা বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন এবং পারদর্শিতা দেখাতে সক্ষম। আমিরুল মোমাইনিন চৌধুরীর ‘অ্যাজ ইট অ্যাপিয়ারসে’ ফিগার ও মোটিফের ডিটেইলস বিস্ময়কর। ভিড়াক্রান্ত হয়েও প্রতিটি ফর্মই স্পষ্ট। আকাশে উড্ডীয়মান মানুষের ফিগার মার্ক শাগালের কথা মনে করিয়ে দেয়, যদিও এই কাজে বর্ণিলতা নেই। আনিসুজ্জামানের কাঠ খোদাইয়ের কাজে শহরের দৃশ্যের বাস্তবতা ফটোগ্রাফির মতো প্রতিনিধিত্বশীল।
সপ্তদশ দ্বিতীয় এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে বাংলাদেশি শিল্পীদের ক্যানভাসে তেলরঙে করা ছবির সংখ্যা ছিল মোট ৯টি, যার মধ্যে বিমূর্ত ধারার কাজই ছিল বেশি। এই মাধ্যমের ব্যবহার কম হওয়ার পেছনে একটা কারণ এটি সময়সাপেক্ষ। দ্বিতীয় কারণ, অন্যান্য নতুন মাধ্যমে (স্থাপনা, মিশ্র মাধ্যম, ভিডিও ইত্যাদি) সৃজনশীলতার প্রকাশে যেমন স্বাধীনতা রয়েছে তৈলচিত্রে তার বেশ অভাব। তেলরঙের পদ্ধতিতে তুলনামূলকভাবে বেশি শৃঙ্খলা শিল্পীদের ওপর একটা চাপ সৃষ্টি করে বলেও সবসময় এই আঙ্গিকের ব্যবহার করা হয় না। এসব সত্ত্বেও যেসব শিল্পী তেলরঙের কাজ করে প্রদর্শনীতে দিয়েছেন তাঁদের প্রশংসা করতে হয়। পপ আর্টকে বিষয় করে আফিয়া আবিদা সুলতানার কাজে স্পেসের বিভাজন রঙের ব্যবহারে ছবির দুই অংশে চমৎকার ভারসাম্য এনেছে। মাকসুদা ইকবাল নীপার বিমূর্ত প্রকাশবাদী তৈলচিত্রে লাল রঙের পটভূমিতে নীলের আভাস এবং এই দুই রঙের ব্যবহারে যে টেক্সচার সৃষ্টি হয়েছে তার জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নাজিয়া আন্দালিব প্রিমার বিমূর্তবাদী ছবিতে বিভিন্ন রঙের মিশ্রণ প্রায় দুঃসাহসিক, কিন্তু অন্তিমে নান্দনিক সৌন্দর্য সৃষ্টিতে সফল। সামিনা নাফিস তাঁর ক্যানভাসের স্পেস বিভক্ত করেছেন বিভিন্ন আকারে, যার ভেতর এঁকেছেন লোকজ মোটিফ। বিষয় এবং রঙের ব্যবহারে এই কাজটি ঐতিহ্যনির্ভর। ওয়াদুদ কাফিলের ক্যানভাসে ছয়টি আয়তাকার প্যানেলের রং এবং শূন্য স্পেসের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার ডিজাইনের সৃষ্টি করেছে।
এবারের প্রদর্শনীতে প্রথমবারের মতো পারফরম্যান্স আর্ট স্থান পেয়েছে, এর উল্লেখ আগেই করা হয়েছে। ইনস্টলেশন আর্টের মতো পারফরম্যান্স আর্টেরও কোনো নির্ধারিত পদ্ধতি বা রীতি কিংবা নিয়ম নেই। এই আঙ্গিকে শিল্পীদের স্বাধীনতা অবাধ, একথা বলা যায়, তবে স্পেসের সীমাবদ্ধতা থাকে। অনেকটা রিচুয়ালের মতো মনে হলেও ওয়াল্টার বেঞ্জামিন যাকে বলেছেন ‘অঁরা’ বা শ্রদ্ধামিশ্রিত বিস্ময়, তেমন প্রতিক্রিয়া হয় না দর্শকদের মনে এই জন্য যে, শিল্পীদের আর তাদের মধ্যে বলতে গেলে কোনো দূরত্ব থাকে না। তবে কৌতূহল সৃষ্টি হয় এবং সচেতনতা দেখা দেয়, সাময়িকভাবে হলেও। ইনস্টলেশনের মতো পারফরম্যান্স আর্ট সহজ থেকে জটিল হতে পারে। প্রদর্শনীতে যেসব পারফরম্যান্স আর্ট স্থান পেয়েছে তার সবগুলির বক্তব্য স্পষ্ট হলেও শিল্পরূপে বিশিষ্ট হতে পারেনি। রিতু সাত্তার আর অর্পিতা লোপা দুটি শর্তই পূরণ করেছেন, একথা বলা যায়। জুয়েল রবের কাজটি ইনস্টলেশনধর্মী এবং উপস্থাপনায় সরল।
এগারো
প্রদর্শনীতে যেসব শিল্পী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছেন তাঁদের বাইরে বাংলাদেশের এবং বিদেশের প্রবীণ ও প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানিয়ে তাঁদের শিল্পকর্ম দেখানো হয়েছে। এইসব আমন্ত্রিত শিল্পীর অধিকাংশের কাজই পুরনো, যার জন্য তাঁদের সাম্প্রতিক শিল্পচর্চা সম্বন্ধে ধারণা করা সম্ভব না। তবে ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা তুলে ধরার জন্য এইসব পুরনো ‘কাজ’ ভূমিকা রাখে। যারা নতুন কাজ দিয়েছেন তাঁদের শিল্পচর্চার সাম্প্রতিকতম প্রবণতার পরিচয় পাওয়া যায়, যা বিশেষ আকর্ষণের বিষয়। আমন্ত্রিত শিল্পীদের কাজগুলি নিজ নিজ দেশের অন্য শিল্পীদের পাশাপাশি রাখা হলে দেশগুলির শিল্পচর্চার কালানুক্রমিক পরিচয় পাওয়া যেত।
ফ্রান্স থেকে যেসব আমন্ত্রিত শিল্পীর ‘কাজ’ দেখানো হয়েছে তাঁদের নাম দেখে মনে হয় অধিকাংশই অভিবাসী এবং ফার্স্ট জেনারেশন ফরাসি। তাঁদের সবার কাজই আধুনিক এবং সমকালীন ধারার (প্রকাশবাদী, বিমূর্ত প্রকাশবাদী অথবা আমার ভাষায় ফ্যান্টাসি রিয়েলিস্ট)। আকিরা আবের সূক্ষ্ম রেখার সাহায্যে তৈরি ফর্মের ট্রিপটিচ এবং হেক্টর সঁনিয়ার নানা রঙে তৈরি বিভিন্ন আকারের ফর্ম ও তাদের সন্নিবেশ বিমূর্ততার ভেতর যে বিভিন্ন তলদেশের আভাস দেয় তার মধ্যে নিয়ন্ত্রিত সৃজনশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়। শিলিন চেনের শিল্পকর্ম কম্পোজিশন ও রঙের ব্যবহারে উৎকর্ষের পরিচায়ক। ভারতের ধীরাজ চৌধুরীর ‘পেইন্টার্স প্রটেস্ট’ বক্তব্য প্রকাশে সফল কিন্তু পোস্টারের মতো প্রচারধর্মী হওয়ার কারণে শিল্পিত মনে হয় না। জাপানের টেটসুরা নোডার উডকাটের ছবিতে জলরঙের স্বচ্ছতা এবং কম্পোজিশনের কুশলতা দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পোল্যান্ডের রাফল স্ট্রেইনের ছাপচিত্র ব্যতিক্রর্মী কিছু নয়। থাইল্যান্ডের শিল্পী আন পিসনের কাঠের ওপর লকারের কাজে সেদেশের শিল্প-ঐতিহ্যের পরিচয় পাওয়া যায় কিন্তু রঙের জন্য নিষ্প্রভ দেখায়। যুক্তরাষ্ট্রের মুস্তফা আরশাদের ‘হিস্ট্রি-১’ বিভিন্ন ফর্ম ও মোটিফের সংমিশ্রণে পোস্ট-মডার্নিজমের ‘একলেকটিক’ চরিত্র পেয়েছে। বাংলাদেশের আমন্ত্রিত প্রবীণ ও প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের সংখাই বেশি। আবদুস সাত্তার এবং আবদুস শাকুরের ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিকের ‘কাজ’ দুটিতে ঐতিহ্য উপস্থিত, বিষয় এবং পদ্ধতির ব্যবহারে। অলকেশ ঘোষের জলরঙে বর্ষা ঋতুর নদী, আকাশ ও নৌকার দৃশ্য অর্ধ-বিমূর্ততায় মায়াময় দেখায়। চন্দ্রশেখর দের ক্যানভাসে তেলরঙের কাজটি মোটিফ, কম্পোজিশন ও রঙের ব্যবহারে উৎকৃষ্ট। ফরিদা জামানের ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিকের কাজে রঙের সাহায্যে একাধিক তলের সৃষ্টি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। গৌতম চক্রবর্তীর পেইন্টিংটি স্টাইলাইজড ফর্ম এবং গতির আভাসের জন্য জীবন্ত। হামিদুজ্জামান খানের কালো মার্বলের ভাস্কর্যে কৌণিকতা এবং বিভিন্ন মাত্রা শিল্প-সৌন্দর্যমণ্ডিত। মার্বেলের ভেতর আঁকাবাঁকা সাদা রং বৈচিত্র এনেছে। হাশেম খানের তেলরঙের কাজ ‘কাক ডাকা ভোর’ কম্পোজিশন, ফর্ম এবং রঙের ব্যবহারে অর্ধ-বিমূর্ততার ধারায় বিষয়কে কুশলতার সঙ্গে ব্যক্ত করেছে। জামাল আহমদের ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিকে রিয়েলিস্টধর্মী কাজ নগ্ন নারীদেহের কম্পোজিশনে শিল্প সুষমা রয়েছে। কালিদাস কর্মকারের ‘অ্যালুভিয়াল’ সিরিজের কাজে মিস্টিক আভাস উল্লেখযোগ্য। কে এম কাইয়ুম গাছের কা-কে রঙের ব্যবহারে প্রায় বিমূর্তভাবে উপস্থাপনে সফল। কনকচাঁপা চাকমার তেলরঙে বুদ্ধের মুখের প্রশান্তি এবং ধ্যানমগ্নতা রং ও রেখায় ভাস্বর। গাছের ডাল ভেঙে যে শিল্পীর মৃত্যু হয়েছিল, খালেদ মাহমুদ মিঠু, তাঁর ছবিতে কেটে ফেলা গাছের গুঁড়ির দৃশ্য একাধিক কারণেই ট্র্যাজিক ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করে। মাহমুদুল হক বিমূর্ত প্রকাশবাদ ধারার শিল্পী, প্রদর্শনীতে তাঁর ‘আনটাইটল্ড’ শীর্ষক ছবিতে মাঝখানের লাল রঙের একমাত্রিক ফর্ম ত্রিমাত্রিকতার দ্যোতনা এনেছে। মোহাম্মদ ইউনুসের ‘ইমেজ’ শীর্ষক মিক্সড মিডিয়ার কাজে বিমূর্ততা রহস্যের আভাস দেয়। মোহাম্মদ ইকবালের তেলরঙে করা ‘নোমাডিক ফেসে’ চোখের দৃষ্টি জীবন্ত এবং আন্তর্ভেদী হওয়ার কারণে রিয়েলিস্টিক ধারার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। মোখলেসুর রহমানের উডকাটে রঙের মিশ্রণ ও ফর্মের সন্নিবেশ আকর্ষণীয়। মনিরুল ইসলামের ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিকের কাজ ‘জার্নি থ্রু আননোন’ ছবিতে অতিলৌকিকতার আবহ দেখা যায়। মনসুরুল করিমের ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিকের কাজটি অর্ধ-বিমূর্ত ধারার, কেননা ছবিতে ছোট আকারে হলেও বিভিন্ন বস্ত্ত ও প্রাণীর ফর্ম দেখা যায়। ছবিটি কম্পোজিশনে জটিল, রঙের ব্যবহারেও ব্যতিক্রমী। মোস্তাফিজুল হকের ‘স্প্রিন্ট’ ছবিতে দ্রম্নত ধাবমান দুটি অশ্বের ফিগার প্রাণবন্ত, তবে লাল রঙের প্রাধান্য কী অর্থ বহন করে তা স্পষ্ট না। মনিরুজ্জামানের ক্যানভাসে তেলরঙে করা ‘হোমলেস’ ছবিতে চারটি অর্ধ-বিমূর্ত ফিগার হালকা রঙের আভাসে ফুটে উঠেছে, তাদের সামনে, পেছনে কিংবা পাশে আর কোনো ফর্ম না থাকায় রিক্ততা ও একাকিত্বের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। মুর্তজা বশীরের ক্যানভাসে তেলরঙের ‘এপিটাফ ফর দি মার্টার’ একটি পরিচিত সিরিজের অন্তর্ভুক্ত এবং সেই কারণে অনেকের কাছে পরিচিত। তবে সিরিজের অন্য সব ছবির মতো এই কাজটির পটভূমি সাদা রঙের নয়, হালকা বাদামি রঙের (আবহাওয়ার জন্য?) যার মাঝখানে শিলালিপির মতো ওভাল আকারের নানা রঙের আঁকা প্রতীকটি মহাকাশে ভাসমান গ্রহের মতো দেখায়। প্রবীণ শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিকে এঁকেছেন ‘শকড মাদার’ শীর্ষক ছবি, যেখানে নদীবেষ্টিত বিশাল চরাচরে মৃত সন্তানকে কোলে নিয়ে শোকসন্তপ্ত মায়ের নির্বাক বিলাপ বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে রঙের ব্যবহারে। মোস্তফা খালিদ পলাশের ‘ফায়ার অ্যাঞ্জেলস’ ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিকের ব্যবহার করে যে বিমূর্ততার সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্যে বিপদের সংকেত যেমন আছে, সেইসঙ্গে দৃপ্তভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়ামূর্তিগুলির উপস্থিতি অভয়ও দান করে। মাত্র কয়েকটি রং ব্যবহার করে এই বিশেষ পরিস্থিতি ও বিষয়ের উপস্থাপনায় কুশলতা রয়েছে। নাসিম আহমেদ নাদভির ধূসর এবং হালকা কালো রঙে আঁকা ছবিতে প্রকৃতির বিপন্নতার ইঙ্গিত বোধগম্যভাবেই দেওয়া হয়েছে। স্পেসে নানা বিভাজন করে বড় এবং ছোট অর্ধ-বিমূর্ত ফিগার এঁকে পরিমিতিবোধের পরিচয় দিয়েছেন নাঈমা হক। নাসরিন বেগমের ছবিতে ফিগারের পেছন দিকে উড়ন্ত ফুল এবং লতাপাতা পরাবাস্তববাদী ছবির মতো দেখায়। নাজলী লায়লা মনসুরের ‘বার্থ অফ এ নেশন’ বাংলাদেশের জন্মের বলিষ্ঠ প্রতিনিধিত্ব করেছে শুভ এবং অশুভ প্রতীকের সমন্বয়ে। তাঁকে বাংলাদেশের অ্যাবসার্ড রিয়েলিস্ট ধারার সফল শিল্পী বলা যায়। তাঁর ছবির রাজনৈতিক বক্তব্য সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তিনি নিঃসন্দেহে একজন কমিটেড এবং অ্যাকটিভিস্ট শিল্পী। নিসার হোসেনের ‘ম্যাডোনা’ দুঃস্বপ্নের চিত্র যেন, যেখানে নিরানন্দ পরিবেশ এবং কর্কশ রং পৈশাচিক উলস্নাসের আভাস দিচ্ছে। রফিকুন নবীর ‘রিভার ম্যান’ ছবিতে আকাশ, নদী এবং নৌকার পটভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকা মাছ হাতে কিশোরসহ তিনজন জেলের দেহের বলিষ্ঠ ভঙ্গি এবং দৃষ্টিতে আশাবাদ ব্যক্ত হয়েছে। আধুনিক পদ্ধতিতে আঁকা রিয়েলিস্ট ধারার ছবির মধ্যে নিরীক্ষাধর্মিতার এটি একটি উৎকৃষ্ট উদাহারণ। রঞ্জিত দাশ ক্যানভাসকে জ্যামিতিক বর্গ এবং বৃত্তে বিভক্ত করে রঙে ও রেখায় এঁকেছেন অর্ধ-বিমূর্ত ফিগারের অস্পষ্ট অবয়ব। একপাশে তাকিয়ে থাকা মুখের হতবাক এবং অসহায় দৃষ্টি মর্মমূলে নাড়া দেয়। রনজিতের ছবিতে সবসময় একটা বিষয় থাকে, যা রং এবং রেখার সমন্বয়ে প্রতিফলিত হয় জ্যামিতিক আকারের ভেতর। ভাস্কর রাশার ‘অপরচুনিস্ট’ কাঠে তৈরি ভাস্কর্যের সরলতা এবং প্রত্যক্ষতা বক্তব্যকে স্পষ্ট করে তুলেছে। রেজাউল করিমের ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক রঙে ব্যক্ত হয়েছে একটি বিশাল ট্র্যাজেডির মর্মন্তুদ কাহিনি, যার শোকগ্রস্ত সাক্ষীরা ভিড় করেছে পটভূমিতে প্রায় অদৃশ্য হয়ে। রোকেয়া সুলতানার টেম্পেরায় করা ‘আর্থ, ওয়াটার, এয়ার’ কম্পোজিশন এবং অনুজ্জ্বল রঙের ব্যবহার স্নিগ্ধতার পরিচয় দেয়। পুরনো ঢাকা প্রাণবন্ত এবং উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে সমরজিত রায় চৌধুরীর বহু বর্ণিল ছবিতে। রং ও রেখার ব্যবহার পুরনো পরিবেশের সৌন্দর্য সৃষ্টিতে সফল। শাহাবুদ্দিন আহমেদের পরিচিত বিষয় মুক্তিযোদ্ধা; প্রদর্শিত ছবিতে দ্রম্নত ধাবমান ফিগারের বলিষ্ঠ ভঙ্গিতে সাহস এবং বীরত্বের আভাস স্পষ্ট। রঙের ব্যবহার বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যময়। মিক্সড মিডিয়ায় করা শহীদ কবিরের ‘হিট’ ছবিতে ছোট আকারের বৃত্তগুলি ঘন সন্নিবিষ্ট হয়ে শক্তির প্রতীকের মতো দেখায়। শিরোনামের ‘হিট’ এখানে এনার্জি অথবা পাওয়ারের প্রতিনিধিত্ব করছে। শাজাহান আহমদ বিকাশের ‘টিয়ার্স অফ হ্যাপিনেস’ অপ-আর্ট ধারার এবং মিনিমালিস্ট প্রকৃতির। নানা ভাঁজে তৈরি হলুদ এবং নীল রঙের ফর্ম শূন্যে ভাসমান বস্ত্তর মতো দেখায়। শেখ আফজাল যে বাংলাদেশে রিয়েলিস্ট ধারার শিল্পীদের মধ্যে পুরোধায়, তার দৃষ্টান্ত প্রদর্শনীতে দেখানো ছবি ‘মাই সারাউন্ড’। শিশির ভট্টাচার্যের ‘আনটাইটলড’ শীর্ষক ছবি পপ আর্টধর্মী। সৈয়দ আবুল বারক আলভীর ‘সং অফ নেচার’ ছবিতে বাংলাদেশের শ্যামল প্রকৃতির বিমূর্ত প্রতিফলন। ভাস্কর আবদুলস্নাহ খালেদের কাঠে তৈরি কুক্কুটের ভাস্কর্য টেক্সচারের ডিটেইলসে এবং ভঙ্গিতে প্রাণবন্ত। সৈয়দ হাসান মাহমুদের ছবিতে নিরাভরণ পটভূমিতে তিনটি সাদা কাগজের খেলনার প্লেন উড়ে যাওয়ার ভঙ্গি গতি এবং স্বাধীনতার সার্থক বিমূর্ত প্রতীক। সৈয়দ জাহাঙ্গীর বহুদিন থেকে নদী, নৌকা এবং জলের মানুষের দৃশ্য নিয়ে ছবি আঁকছেন; ব্যবহার করছেন একই গঢ় নীল এবং সোনালি রং। তাঁর কৃতিত্ব এই যে, এর ফলে না বিষয়ে, না কম্পোজিশন, ফর্ম বা রঙের ব্যবহারে একঘেয়েমির সৃষ্টি হয়েছে। প্রদর্শনীর জন্য আঁকা নৌকাবাইচের (চ্যালেঞ্জ) দৃশ্যের অভিনবত্ব হলো দুটি নৌকা এবং প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী মানুষ এমনভাবে পরস্পর মিশে গেছে যে একটি ফর্মেরই অস্তিত্ব রয়েছে বলে মনে হয়। অর্ধ-বিমূর্ত ধারার ছবি হিসেবে এই কাজটিতে আধুনিকতার স্বাক্ষর রয়েছে। স্বপন চৌধুরীর ‘লাইফ অ্যান্ড টাইম’ শীর্ষক বিমূর্ত প্রকাশবাদী ছবিতে নানা জ্যামিতিক ফর্ম বৈচিত্র্য এনেছে। ‘ফরচুন’ শীর্ষক ছবিতে তাজুল ইসলামের ট্যাপেস্ট্রি প্রয়াত শিল্পী রশিদ চৌধুরীর কথা মনে করিয়ে দিলেও এই কাজে ওপর থেকে নিচে অথবা নিচ থেকে ওপরে ধাবমান ফর্মগুলির গতিশীলতা শিল্পীর স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠায় সফল।
বারো
প্রতিবারের মতো সপ্তদশ দ্বি-বার্ষিক এশীয় চারুশিল্প প্রদর্শনীতে জুরির সদস্যরা প্রদর্শিত শিল্পকর্ম দেখে তিনটি গ্র্যান্ড প্রাইজ এবং ছয়টি সম্মানজনক পুরস্কার দিয়েছেন। জুরি কমিটির পাঁচজন সদস্যের মধ্যে মাত্র একজন ছিলেন বাংলাদেশের শিল্পী; অন্যরা জাপান, পোল্যান্ড, কোরিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া থেকে এসেছিলেন। জুরি কমিটিতে বিদেশি সদস্যরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার পরও বাংলাদেশের দুজন শিল্পী তিনটির মধ্যে দুটি গ্র্যান্ড প্রাইজ এবং ছয়টির মধ্যে সবগুলি সম্মানজনক পুরস্কার পাওয়ার বিষয়টি অনেককেই বিব্রত করেছে। বাংলাদেশের শিল্পী যাঁরা পুরস্কার পেয়েছেন তাঁদের ছবির উৎকর্ষের জন্যই পেয়েছেন, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই এবং বিচারকদের অধিকাংশ বিদেশি হওয়ায় পক্ষপাত প্রদর্শনের প্রশ্ন উঠতে পারে না। একথা কেউ বলছে না, কিন্তু আয়োজনকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশি শিল্পীদের প্রায় সবগুলি পুরস্কার পাওয়া অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছে কারো কারো কাছে। অনানুষ্ঠানিকভাবে অনেকেই বলেছেন যে, ভবিষ্যতে বিদেশি এবং বাংলাদেশি শিল্পীদের মধ্যে পুরস্কার সমানসংখ্যক রাখা সমীচীন, বিশেষ করে সম্মানজনক পুরস্কারের ক্ষেত্রে। গ্র্যান্ড প্রাইজের প্রসঙ্গে প্রস্তাব রেখেছেন কেউ কেউ যে তিনটির মধ্যে দুটির বেশি বাংলাদেশের শিল্পীদের দেওয়া উচিত হবে না (কাকতালীয়ভাবে সপ্তদশ প্রদর্শনীতে তাই হয়েছে)। পুরস্কার প্রদানের নীতি পরিবর্তন করার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা প্রয়োজন, একথা সপ্তদশ প্রদর্শনীর পর বেশ শোনা যাচ্ছে। এই আলোচনা এবং প্রস্তাবনা বাংলাদেশের শিল্পীদের যোগ্যতা সম্পর্কে কোনো ইঙ্গিত দিচ্ছে না, কেবল আয়োজক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের আন্তরিকতা ও বদান্যতার পরিচয় দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে।
সপ্তদশ দ্বি-বার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীর জন্য গঠিত জুরি কমিটি বাংলাদেশের কামরুজ্জামান স্বাধীন ও হারুন-উর-রশিদকে এবং চিলির দাগমারা আনা উইসিকিয়েলকে গ্র্যান্ড প্রাইজ প্রদান করেছে। তিনজনের শিল্পকর্মের মাধ্যমই ছিল ইনস্টলেশন, যা থেকে এই মাধ্যমের অব্যাহত জনপ্রিয়তা এবং অর্জিত শিল্প সৌকর্যের প্রতি স্বীকৃতির পরিচয় পাওয়া যায়। ১৯৫০ সালে টেট মডার্নে ট্রেসি এমিন ‘মাই বেড’ শীর্ষক ইনস্টলেশনের জন্য টার্নার প্রাইজ পাওয়ার পর থেকে বিশ্বব্যাপী শিল্পীদের মধ্যে এ মাধ্যমের প্রতি আকর্ষণ বেড়েই চলেছে, যার কিছু কারণ আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। কামরুজ্জামান স্বাধীনের ইনস্টলেশনটি মূল্যায়নের কোনো নির্ধারিত মানদ- না থাকলেও ইনটুইশন এবং শিল্পবোধের ভিত্তিতে শ্রেষ্ঠ বলে স্বীকৃতি দিতে ইতস্তত করবেন না কেউ। এটি বিশাল এবং অসাধারণ কাজ, যার পেছনে নিশ্চয়ই রয়েছে অনেকদিনের পরিকল্পনা, উপকরণ ব্যবহার নিয়ে চিন্তাভাবনা, এবং সার্বিক কম্পোজিশন সম্পর্কে ধারণা চূড়ান্তকরণ প্রক্রিয়া। হঠাৎ করে আবেগের বশবর্তী হয়ে কিংবা সৃজনশীলতার স্বতঃস্ফূর্ত জোয়ারের প্রভাবে এমন ইনস্টলেশনের সবকিছু সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব না। ধারণায় এবং নির্মাণে ও উপস্থাপনায় কামরুজ্জামান স্বাধীনের কাজ এতই অরিজিনাল যে, এর শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে নিশ্চয়ই জুরি কমিটিকে বেশি চিন্তাভাবনা বা আলোচনা করতে হয়নি। পৃথিবীর অন্য সব প্রদর্শনীর কথা বলা যাবে না, কিন্তু বাংলাদেশের প্রদর্শনীর ইতিহাসে এমন মৌলিক ও বিশাল ইনস্টলেশন এর আগে প্রদর্শিত হয়নি। কাজটির একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো এখানে চমক সৃষ্টি বা শকড করার কোনো উদ্দেশ্য কাজ করেনি। উদ্ভট বস্ত্ত দিয়েই চমক সৃষ্টি বা শকড করা যায় দর্শককে। কামরুজ্জামান স্বাধীনের ইনস্টলেশন মোটেও উদ্ভট নয়, বরং কঠোর বাস্তবতার প্রতিফলন। একপাল ক্ষুধার্ত ইঁদুর এভাবেই প্রাচীর ডিঙিয়ে ভিড় করে প্রায় দিশেহারা হয়ে ছুটে আসতে পারে। এর সাব-টেক্সট হলো ক্ষুধার জন্য ইঁদুর যা করতে পারে, মানুষের পক্ষেও তা সম্ভব। আপাতদৃষ্টিতে এই শিল্প সৃষ্টির পেছনে এটাই সম্ভাব্য রাজনৈতিক বক্তব্য, যা কোনো নির্দিষ্ট রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমানা অতিক্রম করে যায়।
দ্বিতীয় গ্র্যান্ড প্রাইজ পেয়েছেন চিলির শিল্পী দাগমারা উইসকেইন, তাঁর ইনস্টলেশনের বিষয় অর্ধ-বিমূর্ত এবং সেই কারণে বক্তব্যে কিছুটা অস্পষ্ট। এর অর্থ উদ্ধার সহজেই সম্ভব না। দেশের পরিচিতিতে শিল্পী দাগমারা বলেছেন, তাঁর দেশ উত্তরের মরুভূমিপ্রধান প্রকৃতি এবং দক্ষিণের শিল্পোন্নত অঞ্চলে বিভক্ত। তিনি উত্তরাঞ্চলের শিল্পী হিসেবে সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ দ্বারাই প্রভাবান্বিত হয়েছেন। পরিচিতিতে তিনি বলেছেন : ‘আমার অঞ্চলের সমকালের শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে এখানকার ভূ-বৈশিষ্ট্য, বিশেষত মরুভূমির অবস্থান ও প্রভাব অপরিসীম গুরুত্ব পেয়েছে।’ অন্যত্র তিনি বলেছেন : ‘আমার প্রকল্পের মাধ্যমে পৃথিবীর শুষ্কতম মরুভূমিতে দৃশ্যচিত্র বা ভিজ্যুয়াল চিত্রকর্মের নির্মাণপ্রক্রিয়ার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হয়েছে।’ এরপর তিনি আবার বলেছেন : ‘এই দূরবর্তী উত্তরাঞ্চলে যেসব অর্থনৈতিক কর্মকা- ঘটেছে তার ছায়া রয়েছে শিল্পীর মানসপটে ও তার কর্মে।’ দাগমারা ভিডিও এবং সাউন্ড সহযোগে যে ইনস্টলেশন তৈরি করেছেন তার অর্থ বা তাৎপর্য খুঁজতে হলে তাঁর বক্তব্যের অনুসরণে চিলির উত্তরাঞ্চলের ভূ-প্রকৃতি এবং অর্থনৈতিক কর্মকা- সম্বন্ধে জানতে হবে। অর্থাৎ এই কাজটির রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষিত রয়েছে। তবে শিল্পীর নিজের ভাষায় তাঁর কাজটি কেবল উত্তরাঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করে না, সামগ্রিকভাবে চিলির বহু-সাংস্কৃতিক চিত্রকলাচর্চার বিচার-বিশ্লেষণের জন্য আহবান জানায়। এই অর্থে দাগমারার ইনস্টলেশন চিলির জাতীয় পরিচিতির সাংস্কৃতিক প্রতীক। উষর ধূসর প্রকৃতির মাঝখানে একটি বিশাল প্রস্তরখণ্ডের দিকে একজন মানুষের ক্লান্তির ভারে কিন্তু প্রত্যয়ের সঙ্গে হেঁটে যাওয়ার মধ্যে যে প্রতীকী ব্যঞ্জনা তার তাৎপর্য বিশ্বজনীন। এর সঙ্গে তুলনীয় হেমিংওয়ের ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সির নায়ক চরিত্রের। কামরুজ্জামান স্বাধীনের মতোই দাগমারার ইনস্টলেশন উদ্দেশ্য-উদাসীন শিল্পকর্ম নয়, যদিও অর্ধ-বিমূর্ত।
বাংলাদেশের হারুন-উর-রশিদ যে তৃতীয় গ্র্যান্ড প্রাইজ পেয়েছেন সে সম্বন্ধে ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি স্টারে দেওয়া একটি ইন্টারভিউ থেকে জানা যায় যে, তিনি তাঁর ছেলের সঙ্গে খেলনা নিয়ে খেলার সময় হঠাৎ ইনস্টলেশনটির আইডিয়া মাথায় আসে। কিন্তু তাঁর কাজের যে শিরোনাম ‘রেস্টলেস ওয়েভ অফ টাইম’ তার সঙ্গে কম্পোজিশন ও ফর্মের সম্পর্ক খুব স্পষ্ট বলে মনে হয় না। সম্ভবত জুরির সদস্যরা কাজটির শিল্প সৌকর্য ইনটুইশনের মাধ্যমে উপলব্ধি করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ইনস্টলেশনটির সামাজিক-রাজনৈতিক বক্তব্য আছে, একধরনের দার্শনিকতা বা মিস্টিক দৃষ্টিভঙ্গিও এখানে কাজ করছে।
আমাদের জানা নেই, পুরস্কার দেওয়ার জন্য ‘কাজ’ নির্বাচনের আগে জুরির সদস্যরা শিল্পীর কাছে তাঁর শিল্পকর্মের ব্যাখ্যা চেয়ে থাকেন কি না। যদি এমন করা না হয় তাহলে ভবিষ্যতের জন্য এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ভাবা যেতে পারে। এর দ্বারা জুরি সদস্যদের শিল্পবোধ, বিচারক্ষমতা বা অভিজ্ঞতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা হচ্ছে না। সিদ্ধান্ত গ্রহণে নিজের এবং শিল্পীর ধারণা ও উদ্দেশ্য মিলিয়ে নেওয়াই হবে শিল্পীদের দেওয়া এই ব্যাখ্যার প্রধান উদ্দেশ্য।
বাংলাদেশি যে ছয়জন শিল্পী সম্মানজনক পুরস্কার পেয়েছেন তাঁদের চারজনের কাজই বিভিন্ন শ্রেণির ইনস্টলেশন। এর ফলে দেখা যায় যে, গ্র্যান্ড প্রাইজ আর সম্মানজনক পুরস্কার মিলিয়ে ইনস্টলেশন মাধ্যম পুরস্কার প্রাপ্তিতে সবার তুলনায় এগিয়ে। এখানেও বিভিন্ন মাধ্যমের মধ্যে পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে একটা যুক্তিসংগত ভারসাম্য আনার কথা ভাবা যেতে পারে। নতুন মাধ্যমটির (ইনস্টলেশন) অধিক জনপ্রিয়তা মেনে নিয়েও অনেকদিনের প্রচলিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত মাধ্যমগুলি যেমন তেলরং, ভাস্কর্য, ড্রইং ও ছাপচিত্র প্রতিযোগিতায় পেছনের সারিতে চলে যাওয়া কাঙিক্ষত হতে পারে না। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের প্রকাশিত কনটেম্পরারি আর্ট বইতে নতুন মাধ্যমের ব্যবহারে যে পুরনো মাধ্যমগুলি পেছনে পড়ে যাচ্ছে, এ নিয়ে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করা হয়েছে। বইটির মতে, পেইন্টিং আর্ট ডিসকোর্সের পাদপ্রদীপের সামনে থাকা উচিত (২০০৪)। এই প্রসঙ্গে বলা যায় যে, অয়েল পেইন্টিং, ভাস্কর্য এবং ছাপচিত্র এই সব পুরনো এবং প্রতিষ্ঠিত মাধ্যমগুলি সেকেলে হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। কেননা এসব আঙ্গিকে নতুন উপকরণের বিষয় (অ্যাবসার্ড রিয়েলিজম) এবং আধুনিক পদ্ধতির আত্তীকরণ অনেকদিন থেকে হচ্ছে। এখনকার পেইন্টিং দেড়শো বছরের অ্যাকাডেমিক পেইন্টিংয়ের মতো নয়। ভাস্কর্যেও এসেছে রূপান্তর, উপকরণের ব্যবহারে এবং আঙ্গিকগত পদ্ধতিতে। বিদেশের শিল্পচর্চায় যেখানে পেইন্টিং বা ভাস্কর্যের মাধ্যম ব্যবহৃত হচ্ছে সেখানে এই রূপান্তরিত মাধ্যমই প্রাধান্য পাচ্ছে। একটি আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী নিরাসক্ত ভূমিকা বা আয়োজকের দায়িত্ব গ্রহণ করে শিল্পচর্চার সকল মাধ্যম এবং ধারার পৃষ্ঠপোষকতা করবে, এমনকি নতুন মাধ্যম ও ধারার উদ্ভাবনে নেতৃত্ব দেবে, এমনটাই প্রত্যাশিত। মিউজিয়াম বা গ্যালারির উদ্দেশ্য ও ভূমিকা প্যাসিভ না হয়ে হতে হবে অ্যাকটিভ যেন সৃজনশীলতা নতুন খাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রবাহিত হতে পারে। প্রতিটি আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীরই থাকা উচিত এমন একটি অলিখিত নেতৃত্বের ভূমিকা। এই ভূমিকা রক্ষণশীল না হলে বিতর্কের ঊর্ধ্বেই থাকবে। বিয়েনিয়াল প্রদর্শনীর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের উল্লেখ করা হয়েছে এই লেখার শুরুতেই, এখন এর সাংস্কৃতিক নেতৃত্বের দায়িত্বের প্রতিও দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলো। চিত্রকলা প্রদর্শনীর রাজনৈতিক সংস্কৃতি কেবল সংকীর্ণ অর্থে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি শিল্প-আন্দোলনের দিকনির্দেশনায় নতুন চিন্তার বিকাশ ঘটাতে সহায়ক হবে এবং প্রয়োজনে নেতৃত্বও দেবে। এই দুই উদ্দেশ্যের ভিত্তিতেই চিত্র প্রদর্শনীর রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পূর্ণতা পেতে পারে। উপসংহারে আবার এই প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাবে। এখন সম্মানজনক ছয়টি পুরস্কার প্রদান প্রসঙ্গে সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক।
বাংলাদেশের যে ছয়জন সম্মানজনক পুরস্কার পেয়েছেন তাঁদের মধ্যে বিপাশা হায়াতের কার্ডবোর্ডে অ্যাক্রিলিক প্লাস্টিক পেইন্টের কাজটি একই সঙ্গে সমতল থেকে ভিন্নতার জন্য রিলিফের কাজ এবং পেইন্টিং, যা বেশ অভিনবত্বের পরিচায়ক। এর আগেই ছবিটি সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়েছে, যার পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। দিলীপ কুমারের ‘প্রকৃতি’ শীর্ষক মিক্সড মিডিয়ার কাজটি বিভিন্ন মোটিফের ব্যবহারের কারণে যে একলেকটিসিজমের বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে তার জন্য এটি সমকালীন বা পোস্ট-মডার্ন শ্রেণির বলা যায়। ছবিটির স্পেস ফর্মে পরিকীর্ণ হলেও সাংঘর্ষিক কোনো পরিণতি দেখা দেয়নি, কম্পোজিশন নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই রয়েছে। বরং ফর্মগুলি ভাসমান, এমন অনুভূতির সঞ্চার হয়। জেহান করিমের ভিডিও ইনস্টলেশন ত্রি-মাত্রিক প্রেক্ষিতে ভিন্ন আকারের একাধিক বৃত্ত সৃষ্টি করে দৃষ্টিনন্দন হতে পেরেছে। কুন্তল বড়ুয়ার ‘ঢাকা রোড’ মিক্সড মিডিয়ার ইনস্টলেশন। কাজটি আকর্ষণীয় কিন্তু পুরস্কার পাওয়ার দরকার ছিল কি না সে বিষয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। কাজটির প্রধান দুর্বলতা এটি অনাবশ্যকভাবে জটিল। রাজীব কুমার রায়ের মিক্সড ইনস্টলেশন ‘গ্লোবালাইজেশন অফ পলিটিক্স’ কাজটিতে রাজনৈতিক বক্তব্য আছে বলে মনে হয় কিন্তু তা উপস্থাপনার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়নি। শ্যামল চন্দ্র সরকারের ইনস্টলেশন কয়েকটি বিভিন্ন শ্রেণির পশুর বিভিন্ন ভঙ্গিতে একই দিকে তাকিয়ে থাকার দৃশ্য। এটি ভাস্কর্যধর্মী যদিও দুটি মাধ্যমের মধ্যে ভেদরেখা এখানে ক্ষীণ। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, ইনস্টলেশনটি কি শিল্প সৌকর্যের না বক্তব্যের জন্য স্বীকৃতি পেয়েছে? জুরি কমিটির সদস্যরা আমার চেয়ে বেশি অভিজ্ঞ এবং জ্ঞানী, তাঁদের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিভ্রান্ত বোধ করার জন্য আমি লজ্জিত এবং ক্ষমা প্রার্থী।
তেরো
এই রিভিউতে প্রায়ই ‘আধুনিক’ এবং ‘সমকালীন’ ধারার আর্টের উল্লেখ করা হয়েছে। দুটি শব্দ সমার্থক নয় বলেই, এদের ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়োজন, যা প্রদর্শনীর অন্তর্ভুক্ত ‘কাজ’-এর তো বটেই সামগ্রিকভাবে শিল্পকলাজগতের এবং শিল্প ইতিহাস সম্বন্ধে যথার্থ ধারণা লাভে সাহায্য করতে পারে।
আধুনিক চিত্রকলা বা মডার্ন আর্ট কবে থেকে শুরু হয়েছে, এ নিয়ে চিত্রকলার ইতিহাসবিদ, আর্ট ক্রিটিক এবং শিল্পীদের মধ্যে মতৈক্যের বেশ অভাব। এই প্রসঙ্গে আর্ট ক্রিটিক হার্বাট রিডের বই থেকে উল্লেখ করা যেতে পারে : ‘আধুনিক শিল্পকলার সূচনা কবে তা বলা বেশ কঠিন। গাছের শেকড়ের মতো এর উৎস নানা স্তরে এবং গতি-প্রকৃতি অনেক ক্ষেত্রে পরস্পরবিরোধী। বেস্নকের বিপস্নবী রোমান্টিসিজম, ডেভিডের বিপস্নবী ক্লাসিসিজম, কনস্টেবলের বৈজ্ঞানিক প্রকৃতিবাদ অবশ্যই এর ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। আবার দেলাক্রোয়াঁর ঐতিহাসিক আদর্শবাদকেও বাদ দেওয়া যায় না। কুর্বে এবং মানের বাস্তবতাবাদ, এডওয়ার্ড মানচের এবং ভ্যান গঘের প্রকাশবাদ এবং বার্নার্ড এমিল ও পল গগাঁর প্রতীকবাদও আধুনিক শিল্পকলার সূচনায় প্রণোদনা হিসেবে কাজ করেছে। এইসব আদর্শ এবং মতবাদ ও পদ্ধতিগত ধারা ফভিজম, কিউবিজম, কনস্ট্রাক্টিভিজম এবং পরাবাস্তববাদের মতো আধুনিক শিল্প-আন্দোলন ও ধারার পেছনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে এবং পরিণতিতে আধুনিক শিল্পধারার প্রকৃতি নির্ধারণ করেছে’ (১৯৬৪)। হার্বাট রিডের বক্তব্য অনুযায়ী ফভিজম, কিউবিজম, কনস্ট্রাক্টিভিজম এবং পরাবাস্তববাদ দিয়ে মডার্ন আর্ট বা আধুনিক ধারার শিল্পকলার যাত্রা শুরু। সময়কালের হিসেবে আধুনিক শিল্পকলার এই আবির্ভাব ক্রমিক পর্যায়ে বিশ শতকের গোড়ার দিকে। এর সমাপ্তি ঘটেছে বিশ শতকের সত্তরের দশকে, যখন মডার্ন আর্টের সর্বশেষ ধারা বিমূর্ত প্রকাশবাদ পরিণত পর্যায়ে পৌঁছে এবং তার বিপরীতে নতুন শিল্পধারার বিকাশ ঘটতে শুরু করে। কিন্তু তারপরই আধুনিক চিত্রকলার ওপর যবনিকা পতন হয়নি, কেননা কোনো কোনো শিল্পীর কাজে এখনো কিউবিজম, এমনকি পরাবাস্তববাদের প্রভাব দেখা যায়, আর বিমূর্ত প্রকাশবাদ তো এখনো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিল্পীদের কাছে এক জনপ্রিয় মাধ্যম। সৃজনশীল মনের বিশেষ অনুভূতির প্রকাশে বিমূর্ত প্রকাশবাদ তার প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। আধুনিক চিত্রকলার ধারা আগের মতো ব্যবহার করা না হলেও সমকালীন চিত্রকলার ধারা তাকে অস্বীকার করে না।
অন্য এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, মডার্ন আর্টের সূত্রপাত হয় ১৮৬৩ সালে প্যারিসে, যখন ফরাসি অ্যাকাডেমির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তার অধীনস্থ স্যালোঁর প্রদর্শনীতে দেওয়া কতিপয় ফরাসি নবীন শিল্পীর চিত্রকর্ম জুরির সদস্যরা বাছাই না করে বাদ দিয়ে দেন (২০০৫)। সম্রাটের নির্দেশে এইসব অ্যান্টি-এস্টাবলিশমেন্ট শিল্পীর চিত্রকর্ম বিকল্প স্থানে, নতুন এক স্যালোঁতে দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়। দর্শকরা অফিশিয়াল স্যালোঁর জুরিদের সঙ্গে একমত হলেও বিদ্রোহী শিল্পীদের ব্যতিক্রমী ধরনের আঁকা ছবির প্রদর্শনী দেখার জন্য নতুন স্যালোঁতে যান। কৌতূহলী দর্শকদের ভিড় হয় সেখানে অফিশিয়াল স্যালোঁর তুলনায় অনেক বেশি। কেননা তাঁরা নতুন শিল্পীদের শিল্পরুচি দেখতে বেশ কৌতূহল বোধ করেন। দেখার পর জুরির সদস্যরা যে সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন, তাঁরা সেই মত প্রকাশ করেন এবং নতুন শিল্পীদের ছবি নিয়ে হাসিঠাট্টা করেন দল বেঁধে। কেননা, বিষয়ে এবং শৈলীতে এসব ছিল প্রচলিত শিল্পকর্ম থেকে একেবারেই ভিন্ন। যে ছবিটি সবচেয়ে সমালোচিত এবং উপহাসিত হয় সেটি এডওয়ার্ড ম্যানে নামের শিল্পীর আঁকা তৈলচিত্র ‘দ্য পিকনিক লাঞ্চ’। ছবিটি ল্যুভ মিউজিয়ামে টিসিয়ানের আঁকা ছবির অনুকরণ কিন্তু এখানে বিষয় ছাড়া অন্য সব ডিটেইলসের ক্ষেত্রে শিল্পী ম্যানে অনেক স্বাধীনতা নিয়েছিলেন। চরিত্রগুলির পোশাকে, নগিণকা নারী চরিত্রের দর্শকদের দিকে সরাসরি তাকিয়ে থাকার ভঙ্গিতে এবং পার্সপেক্টিভের ব্যবহারে দুটি ছবির মধ্যে বিশাল পার্থক্য ছিল। ওল্ড মাস্টার্সদের ছবি দেখে অভ্যস্ত দর্শকরা ম্যানের অবিমৃশ্যকারিতার দৃষ্টান্তে উপহাস করেছেন একযোগে। দর্শকরা যা সঙ্গে সঙ্গে উপলব্ধি করতে পারেননি তা হলো পরিবর্তনশীল সমাজে ছবি আঁকার পদ্ধতি ও মানদ- বদলে গিয়েছে, যার জন্য নতুন পদ্ধতি ও ভাষার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল।
মানের ‘পিকনিক লাঞ্চ’ দিয়ে অ্যাকাডেমি পদ্ধতির বিপরীতধর্মী যে শিল্পচর্চা শুরু হলো তা কয়েক বছরের মধ্যে নতুন শিল্প-আন্দোলনের সূচনা করে। এইভাবে আবির্ভূত হলো ‘ইম্প্রেশনিজম’ নামের আধুনিক শিল্পরীতি। কম্পোজিশন, ফর্ম এবং রঙের ব্যবহারে এই ধারার ছবি ছিল আগের তুলনায় একেবারেই ভিন্ন। অ্যাকাডেমিক পদ্ধতির বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহ সফল হয়েছিল, যার জন্য ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে মডার্ন আর্ট বা আধুনিক ধারার শিল্পকলার যাত্রা শুরু হয় বলে অনেকে মনে করেন।
আমেরিকার প্রভাবশালী আর্ট ক্রিটিক ক্লিমেন্ট গ্রিনবার্গ ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্বে যে নতুন শিল্প পদ্ধতি ও ধারার আবির্ভাব দেখতে পেলেন তার নাম দিলেন আভাঁ-গার্দ, অনুবাদে ‘অতি আধুনিক’। তিনি শিল্পের সামাজিক, ঐতিহাসিক ভূমিকা বাদ দিয়ে শিল্পকর্মের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং গুণগত মানের প্রতি গুরুত্ব দিলেন। উনিশ শতকের মধ্যবর্তী সময় থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর প্রথম পর্ব পর্যন্ত নিরীক্ষাশীল নবীন শিল্পীদের কাজ নিরবচ্ছিন্নভাবে দেখে তাঁর এই বিশ্বাস হয় যে এমন শিল্পকর্মই প্রয়োজন সংস্কৃতিকে সজীব এবং গতিশীল রাখার জন্য। তাঁর মনে কোনো সন্দেহ থাকল না যে পুরনো সংস্কৃতি বিদায় করার জন্য এ ধরনের নতুন দৃষ্টিসম্পন্ন সংস্কৃতিরই প্রয়োজন। গ্রিনবার্গের মতে, আর্টের নির্যাস হলো তার শুদ্ধতায় এবং স্ব-ব্যাখ্যাত হওয়ার গুণে। মুখের কথার বর্ণনায় নয়, ভিজ্যুয়াল ইমেজ দিয়েই আর্ট নিজেকে ব্যাখ্যা করবে দর্শকের কাছে, এই ছিল তাঁর ধারণা। মডার্ন আর্টকে সেই জন্য প্রতিনিধিত্বশীলতার কথা না ভেবে দর্শকের দৃষ্টির সামনে প্রয়োজনে বিমূর্ত হয়েও দেখা দিতে হবে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করলেন পিকাসোর ১৯১৩ সালে আঁকা ‘গিটার’ নামে ছবিটি, যা ছিল কিউবিস্ট ধারার প্রথম কোলাজ। পরিত্যক্ত কাগজ, পুরনো ওয়াল পেপার এবং গিটারের ভগ্নাংশের ইমেজ দিয়ে তৈরি কিউবিস্ট ধারার প্রতিনিধিত্বকারী এই ছবিটি অর্ধ-বিমূর্ত ধারার। মানে, সেজান, পিকাসো, মাতিস, হুয়ান মিরো, জ্যাকসন পোলক, নোল্যান্ড – এইসব শিল্পীর কাজে গ্রিনবার্গ আভাঁ-গার্দ বা মডার্ন আর্টের বৈশিষ্ট্য দেখতে পেলেন, কেননা এঁদের কেউই আক্ষরিকভাবে বাস্তবের প্রতিনিধিত্ব করতে চাননি। যে সব কাজে বাস্তবের আক্ষরিক প্রতিফলন রয়েছে বা প্রতিফলনের চেষ্টা দেখা যায় সে সব তাঁর কাছে জগাখিচুড়ি (কিসচ্) বলে মনে হয়েছে এবং তাদের আম-জনতার সংস্কৃতি ছাড়া আর কিছু বলা যায় না বলে তিনি মত দিয়েছেন। মডার্ন আর্টকে তিনি ক্লাসিক্যাল, অ্যাকাডেমিক এবং রক্ষণশীল শিল্পকর্ম থেকে পৃথক করে ক্ষান্ত হননি, আম-জনতার উপলব্ধিতে আসে এমন শিল্পকর্মও বাদ দিয়েছেন। ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে গ্রিনবার্গ আভাঁ-গার্দ এবং জগাখিচুড়ি (কিসচ্) আর্টের মধ্যে পার্থক্য ব্যাখ্যা করেন। আর্ট শিক্ষার অ্যাকাডেমিতে এবং নাগরিক আম-জনতার সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে কিসচ্ বা জগাখিচুড়ি আর্ট, এর ওপরে জোর দিয়েছেন তিনি তাঁর লেখায় (১৯৩৯)। ১৯৫০-এর দশকে আমেরিকায় বিমূর্ত প্রকাশবাদের চর্চা শুরু হওয়ার পর তিনি এই নতুন ধারার মডার্ন আর্টের প্রধান এবং প্রভাবশালী প্রবক্তা হয়ে গেলেন। ১৯৩০ সালে ইউরোপে মডার্ন আর্টের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল বলে তিনি মনে করেছেন তার পূর্ণবিকাশ ঘটল আমেরিকায়, বিমূর্ত প্রকাশবাদের আবির্ভাবে। তিনি বিমূর্ত প্রকাশবাদের পদ্ধতি, রীতি ও উদ্দেশ্য নিয়ে লিখে গেলেন অক্লান্ত হয়ে। কিউবিস্ট এবং প্রথম পর্বের মডার্ন আর্টিস্টদের উল্লেখ করে তিনি বললেন যে, তাঁরা ঠিকই বুঝেছিলেন পেইন্টিং মানে জানালা দিয়ে বাইরের পৃথিবী দেখে ছবি এঁকে তার প্রতিনিধিত্ব করা না। ছবি আঁকা মানে বাইরের দৃশ্যের পুনর্নির্মাণ করা, যার প্রধান বৈশিষ্ট্য হবে ত্রিমাত্রিকতার স্থানে দ্বি-মাত্রিকতার ব্যবহার, কেননা পেইন্টিং হলো ফ্ল্যাট জমিনে রঙের প্রলেপ। প্রথমদিকের বিমূর্ত শিল্পীরা ফ্ল্যাট সারফেসের কথা জানলেও রং দিয়ে সারফেসে ফর্ম, উঁচু-নিচু টেক্সচার এবং রং দিয়ে ত্রিমাত্রিকতার সৃষ্টি করতে চেয়েছেন, ঠিক যেমন প্রাক-আধুনিক ধারার শিল্পীরা অ্যাকাডেমিক অনুসরণে করতেন। গ্রিনবার্গ বললেন, আধুনিক আর্টের বিশুদ্ধতা তখনই আসবে যখন রেখা, ফর্ম, কনটুর, রং সবই ফ্ল্যাট সারফেসে মিশে যাবে। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত আর্ট ক্রিটিক রোজেনবার্গ এসে অ্যাকশন পেইন্টিং দিয়ে বিমূর্ত প্রকাশবাদ নতুন রূপে আবির্ভূত হয়েছে বলার আগে পর্যন্ত গ্রিনবার্গ ছিলেন ইউরোপ এবং আমেরিকায় মডার্ন আর্টের প্রধান প্রবক্তা। তাঁর বিরুদ্ধে একটি সমালোচনা ছিল এই যে, তিনি মডার্ন আর্টে মহিলা অথবা অশ্বেতাঙ্গ শিল্পীর কোনো ভূমিকা দেখেননি। তাঁর সম্বন্ধে আর একটি সমালোচনার ইঙ্গিত ইতিমধ্যেই দেওয়া হয়েছে : তিনি ছিলেন আর্টকে গণমানুষের উপলব্ধির বাইরে রাখার পক্ষে। আরো অনেক পরে থিওডর অ্যাডর্নো এই একই এলিটিস্ট ধারণা পোষণ করেছিলেন (১৯৯১)। তিনি মডার্ন আর্ট না বলে উল্লেখ করেছিলেন ‘হাই আর্ট’-এর অর্থাৎ উঁচুমানের শিল্পকর্ম যা সাধারণ মানুষের জন্য নয় এবং গণসংস্কৃতি বলতে যা বোঝায় তা তাঁর কাছে নিকৃষ্ট প্রকৃতির। অ্যাডর্নো অবশ্য আধুনিক শিল্পকলার বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিশদ ব্যাখ্যা দেননি কিংবা তার সংজ্ঞা নিয়েও চিন্তা করেননি।
আধুনিক শিল্পের প্রকৃতি সম্বন্ধে একটা ধারণা দেওয়ার পর এর পরবর্তী আর্ট মুভমেন্টের আবির্ভাব নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন। কেননা এই পর্বকেই বর্তমান লেখায় বলা হয়েছে ‘সমকালীন ধারা’। উল্লেখযোগ্য যে, আধুনিক আর্টের মতো সমকালীন আর্টও একটি নির্দিষ্ট ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবির্ভূত হয়নি, বিভিন্ন ধারা ও পদ্ধতির সমন্বয়েই এই ধারা অগ্রসর হয়েছে, যেগুলি নিজের নামেই পরিচিত ছিল। ষাটের দশকে বিমূর্ত প্রকাশবাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা দিলো ‘পপ আর্ট’, যেখানে দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহার্য নানা সাধারণ দ্রব্য, জনপ্রিয় ভোগ্যপণ্য, সেলিব্রিটির প্রতিকৃতি শিল্পের বিষয় হিসেবে ব্যবহৃত হলো। পদ্ধতিগতভাবেও এলো পরিবর্তন। ব্রিলোর কার্টন বক্স থেকে শুরু করে মেরিলিন মনরোর ছবি পৌনঃপুনিকভাবে সিল্ক স্ক্রিনে ছাপানো, সবই পপ আর্টের অন্তর্ভুক্ত হলো। ব্রিটেনে শুরু হলেও পপ আর্টের বিকাশ ঘটল আমেরিকায়, ষাটের দশকে। এর পরই এলো দৃষ্টিকে বিভ্রান্ত করে এমন রেখা এবং ফর্মে তৈরি ‘অপ-আর্ট’ নামে শিল্প। তারপর সৃষ্টি হলো কনসেপচুয়াল আর্ট। এই শেষের দুটি অবশ্য দীর্ঘস্থায়ী হলো না তবে আধুনিক ধারার শিল্পের সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিলো। শুধু সাধারণ উপকরণ ব্যবহার নয়, প্রকাশভঙ্গিতেও এইসব নতুন মাধ্যম ছিল অভিনব। চমক সৃষ্টি করলেও শিল্পের যে নানা পরিচয় হতে পারে দর্শকরা সেকথা জানতে পারল। বিমূর্ত প্রকাশবাদের প্রতিক্রিয়ায় এবং প্রতিবাদ হিসেবে এইসব শিল্প মাধ্যম একটা ভূমিকা পালন করল। পপ আর্টের স্থানে এরপর জনপ্রিয় হলো ফটোগ্রাফির ইমেজ নিয়ে তৈরি শিল্প। এরপর আশির দশকে এলো ভিডিও এবং এসবের সংমিশ্রণে মিক্সড মিডিয়া; ইন্টারনেট নিয়ে এলো ওয়েবসাইটের বিশ্বব্যাপী বিতরণ ও প্রদর্শনের সুযোগ। ষাটের দশকে শুরু হয়েছিল ইনস্টলেশন নামে যে শিল্প মাধ্যম, ক্ষণিক বিরতির পর আশির দশক থেকে সেটি আবার জনপ্রিয় হয়ে উঠল। এইসব মাধ্যমে মূর্ত এবং বিমূর্ত দুই ধারারই ভূমিকা থাকল, কখনো স্বতন্ত্র হয়ে, কখনো মিশ্র আকারে। এইসব মাধ্যম নিয়েই গড়ে উঠেছে শিল্পের সমকালীন ধারা।
আধুনিক-পরবর্তী শিল্পধারার কোনো সাধারণ নামকরণ সঙ্গে সঙ্গেই করা হলো না, মাধ্যমগুলি পৃথকভাবে পরিচিত এবং ব্যবহৃত হতে থাকল। ১৯৭০-এর দশক থেকে দর্শন-সাহিত্য-স্থাপত্যে ব্যবহৃত ‘পোস্ট-মডার্ন’ নামের পরিচিতি একসময় শিল্পকলার উত্তর-আধুনিক পর্বের ধারা, পদ্ধতি ও আদর্শগুলি ধারণ করার জন্য ব্যবহার করলেন কেউ কেউ। এঁদের মধ্যে ছিলেন আর্থার ডান্টো, যার মতে সমকালীন শিল্পধারা যা ‘পোস্ট-মডার্ন’ হিসেবে পরিচিত হয়েছে, তারপর শিল্পকলার ইতিহাসে নতুন কোনো ধারা আসবে না, একই ধারার চর্চা হতে থাকবে ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যমের সাহায্যে। তিনি সেই জন্য পোস্ট-মডার্ন আর্টকে বললেন ‘এন্ড অফ আর্ট’ (১৯৯৭)। এখন পর্যন্ত অবশ্য সমকালীন শিল্পধারার চর্চার পরিচয় দিতে গিয়ে সাধারণ যে সংজ্ঞা, পোস্ট-মডার্ন, এর ব্যবহার খুব ব্যাপক নয়। তার পরিবর্তে সমকালীন শিল্পধারার বিভিন্ন মাধ্যমই পৃথকভাবে উল্লেখিত হচ্ছে। আধুনিক-পরবর্তী পর্বে শিল্পকলাচর্চায় কতিপয় বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে পোস্ট-মডার্নিজমের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি মিলে যাওয়ায় আধুনিক শিল্পধারার পর সমকালীন শিল্পধারাকে পোস্ট-মডার্ন বা উত্তর-আধুনিক শিল্পকলা বলা যায় বেশ যৌক্তিকভাবে। এই সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি হলো : উত্তর-আধুনিকতা চর্চায় সমগ্রের ওপর না হয়ে খ–র/অংশের ওপর আলোকপাত করা হয়; লোকসংস্কৃতি বা পপ কালচার গুরুত্ব পায়; ভোগ্যপণ্যের সংস্কৃতি আলোচনার/শিল্প সৃষ্টির বিষয় হয়; একটি মাধ্যমের সঙ্গে মিশ্রিত করে অন্য মাধ্যমের ব্যবহার করা হয়; বিভিন্ন ধরনের বহু উপকরণ একত্র করে নতুন কিছু সৃষ্টি করা হয় (একলেকটিসিজম)। ইনস্টলেশন, মিক্সড মিডিয়া এবং ভিডিও ফটোগ্রাফি ব্যবহারে সস্তা ও পরিত্যক্ত উপকরণ সংগ্রহ করে শিল্পরূপ দেওয়া হয় ইত্যাদি।
দ্বি-বার্ষিক প্রদর্শনীতে যেসব শিল্পকর্ম এসেছে সেগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, সমকালীন ধারার শিল্পের (পোস্ট-মডার্ন) অনুসরণই হয়েছে বেশি। আধুনিক শিল্পধারা অদৃশ্য হয়ে যায়নি; মিক্সড মিডিয়ায় তো বটেই, বিমূর্ত প্রকাশবাদী কাজে তার উপস্থিতি দেখা যায়। মনে হয় আধুনিক ধারার শিল্পকলার এটাই হবে স্থায়ী পরিচিতি। পোস্ট-মডার্নের অধীনে যেসব মাধ্যম ব্যবহৃত হচ্ছে তার মধ্যে চমক আছে, সৃজনশীলতার স্বাধীনতা আছে কিন্তু ব্যবহারে সহজ হওয়ার কারণে গুণগত উৎকর্ষে ঘাটতি থাকার সম্ভাবনাও বেশি। পোস্ট-মডার্ন ধারার শক্তির জায়গা হলো এর সমকালীন সামাজিক-রাজনৈতিক এবং প্রযুক্তিভিত্তিক প্রাসঙ্গিকতা। এই ধারা বর্তমান সময় এবং এখনকার চঞ্চল ও অস্থির জীবনের সমস্যা ধারণে ও তার প্রতিফলনে অনেকটাই সফল। এই প্রতিফলনকে হুবহু বাস্তবভিত্তিক বলা না গেলেও নির্মিত দৃশ্যকল্প (কনস্ট্রাকটেড ইমেজ) হিসেবে গ্রহণযোগ্য। প্রযুক্তির দ্রম্নত পরিবর্তনের জন্য পোস্ট-মডার্ন ধারার অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন শিল্পমাধ্যমের চর্চায় বিভিন্নতা আসবে দ্রম্নতগতিতে, একথা বলা যায়। তবে আর্থার ডান্টোর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী পোস্ট-মডার্নিজম থেকে নতুন কোনো ধারা বা আন্দোলনে যে উত্তরণ ঘটবে না, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
চৌদ্দ
শিল্পীদের শিল্পকর্মে লোককথা থেকে শুরু করে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর জীবন ও পরিবর্তনশীল পরিবেশের প্রতিনিধিত্ব থাকবে – এটাই স্বাভাবিক। অবশ্য প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি বেশ জটিল, কেননা যা দৃশ্যমান তাই প্রকৃত বাস্তব নয়, অথবা তার পরিপূর্ণ পরিচয় দেয় না, একথা প্লেটো থেকে শুরু করে আর্ট হিস্টোরিয়ান ই এম গমব্রিখ বেশ স্পষ্ট করে জানিয়েছেন (১৯৬৯)। শিল্পকর্মে একশ ভাগ বাস্তব থাকে, এমন দাবি একজন ফটোগ্রাফারও করবে না কিন্তু বাস্তবই যে তার ভিত্তি সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। অন্যভাবে বলা যায়, শিল্পে বাস্তবের সাদৃশ্য থাকে, কেননা শিল্প সৃষ্টি হয় শিল্পীর মনে বাস্তবের দৃশ্য দৃষ্টির সাহায্যে যে ইমেজ তৈরি করে তার ফলে। আধুনিক শিল্পকর্মে শুধু জীবন ও পরিবেশের যে বাস্তবতা শিল্পী দেখতে পান তার প্রতিফলন থাকে না, তার নিজস্ব চিন্তাভাবনাভিত্তিক ইমেজও তৈরি হয়, যার কিছু মূর্ত এবং কিছু বিমূর্ত। যেহেতু শিল্পী সমাজে বসবাসকারী মানুষ হিসেবে চিন্তাভাবনা করেন সেই জন্য তাঁর বিবেচনায় এবং বিচারে নির্মিত নিজস্ব বাস্তবতা আছে। বলা যায়, দৃশ্যমান বাস্তবতার জগৎই শিল্পীকে কখনো দৃশ্যমান আবার কখনো অদৃশ্য বিমূর্ত ভুবনের দিকে নিয়ে যায়। শিল্পকর্মে মূর্ত-বিমূর্ত, অর্ধ-বিমূর্ত যে বিষয়েরই উপস্থাপনা করা হোক না কেন বিশুদ্ধ বাস্তবতার নিরিখে সেসবের মধ্যে তারতম্য থাকতে পারে কিন্তু তাকে অভিজ্ঞতা (ইন্দ্রিয়জ এবং ইন্দ্রিয়াতীত) প্রসূত বাস্তবতা বলে না মেনে উপায় থাকে না। শিল্পীর দেখা বাস্তব আর দর্শকের ধারণায় বাস্তবের মধ্যে পার্থক্য থাকতে পারে, একথা জানার পরও শিল্পকর্মের বাস্তবতার প্রতিনিধিত্ব (রিপ্রেজেনটেশন) কৌতূহল ও আগ্রহের বিষয় হয়। এই ‘বাস্তব’ সমকালীন জীবন ও পরিবেশকে শিল্পী কোন দৃষ্টিতে দেখছেন এবং তার ভিত্তিতে কী ভাবছেন (বস্ত্তবাদী, বিমূর্ত) শিল্প প্রদর্শনীর শিল্পকর্ম সে সম্বন্ধে ধারণা দিতে পারে, এই উপলব্ধি প্রদর্শনীর গুরুত্বের ইঙ্গিত দেয়। বাস্তবতার ভিত্তিতে শিল্পী কোন বক্তব্য রাখেন (মূর্ত বা বিমূর্ত) সেই কৌতূহলের বিষয় ছাড়া শিল্পকর্মের অন্য গুরুত্ব তার সৌন্দর্য সৃষ্টিতে, যার দৃষ্টান্ত একটি শিল্প প্রদর্শনীতে দেখা যায়।
সপ্তদশ দ্বি-বার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত শিল্পকর্মে যেসব বিষয় বিভিন্ন কাজে দেখা গিয়েছে, দেশি এবং বিদেশি শিল্পী, এই দুই ভাগে বিভক্ত করে এখন তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া যেতে পারে। বিদেশি শিল্পীদের ক্ষেত্রে সংখ্যার দিক দিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে বিমূর্ত কাজই সবচেয়ে বেশি, যেখানে বিষয় সম্বন্ধে নির্দিষ্টভাবে কিছু বলা যায় না, একমাত্র শিল্পীর দেওয়া শিরোনামের উল্লেখ করা ছাড়া। এরপর রয়েছে শিল্পীদের প্রদর্শিত কাজে যে বিষয় তা সামাজিক ও পারিবারিক সমস্যা কেন্দ্র করে। এরপর সংখ্যার দিক দিয়ে এসেছে নাগরিক জীবনের দৃশ্য। প্রতিকৃতির ছবি পঞ্চম স্থান অধিকার করে আছে। ধর্ম ও মিথ সম্পর্কিত বিষয়ের কিছু কাজ দেখা যায় ষষ্ঠ স্থানে। বিদেশিদের শিল্পকর্মের বিষয় হিসেবে সংখ্যায় সবচেয়ে কম রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা। বিদেশি শিল্পীরা বিমূর্ত ভাবনার ভিত্তিতে শিল্প সৌন্দর্য সৃষ্টিতেই বেশি মনোযোগ দিয়েছেন। তাঁদের কাজে সামাজিক এবং পারিবারিক দৃশ্যের রেফারেন্স থাকলেও সেগুলি কোনো সমস্যার ইঙ্গিত দেয় না। বিদেশি শিল্পীদের কাজে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দারিদ্র্য, সন্ত্রাস, বৈষম্য, যুদ্ধ/গৃহযুদ্ধ, মিডিয়ার স্বাধীনতা, মাইগ্রেশন – এইসব সাম্প্রতিক বিষয় শিল্পকর্মে স্থান পায়নি, যার জন্য তাঁদের বেশিরভাগই ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ এই আদর্শে বিশ্বাসী বলে মনে করা যায়।
বাংলাদেশি শিল্পীদের শিল্পকর্মের বিষয়ে বৈচিত্র্য দেখা যায়। তাঁদের সামাজিক দায়বদ্ধতারও প্রকাশ ঘটেছে প্রদর্শিত কাজে। সংখ্যার দিক দিয়ে বিমূর্ত বিষয় প্রথম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশি শিল্পীদের ক্ষেত্রেও। অর্ধ-বিমূর্ত ছবিতে সমকালীন জীবনের মোটিফসহ কাজের সংখ্যা দ্বিতীয়। এই বিষয়ের কাছাকাছি রয়েছে সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের দৃশ্য। রাজনীতি এবং প্রকৃতিবিষয়ক কাজের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য। ডিজাইনধর্মী বিমূর্ত কাজ এবং পোর্ট্রেটের সংখ্যা প্রায় সমান সমান। লোককথা ও মিথ নিয়ে তৈরি হয়েছে চারটি কাজ। গ্রামীণ দৃশ্য দেখা যায় মাত্র একটি ছবিতে। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করেছেন দুজন বাংলাদেশি শিল্পী। যে বারোটি পারফরম্যান্স আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে সেগুলি প্রধানত সামাজিক বিষয়ভিত্তিক। কয়েকটিতে রাজনৈতিক বক্তব্যও রয়েছে। সব মিলিয়ে সমকালীন জীবনের সমস্যা বাংলাদেশি শিল্পীদের কাজে প্রাধান্য পেয়েছে। এদিক দিয়ে তাঁরা বিদেশি শিল্পীদের তুলনায় এগিয়ে।
পনেরো
জাতীয় পর্যায়ে শিল্প প্রদর্শনী আয়োজনের পেছনে শিল্পকর্মে উৎসাহ ও প্রণোদনা প্রদান এবং শিল্পীদের সঙ্গে দর্শকদের পরিচয় করানোর উদ্দেশ্যই থাকে প্রধান। বিয়েনিয়াল শ্রেণির আন্তর্জাতিক চিত্রকলা প্রদর্শনীর পেছনে এইসব উদ্দেশ্য কাজ করলেও সবচেয়ে প্রধান যে রাজনৈতিক, তার উল্লেখ এই লেখার প্রথমেই করা হয়েছে। একটি দেশের কর্তৃপক্ষ জাতীয় ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে স্বীকৃতি ও মর্যাদা লাভ করতে চায়। উন্নয়নশীল এবং সাবেক ঔপনিবেশিক দেশগুলিকে আন্তর্জাতিক শিল্পকলার ভুবনে প্রবেশ ও অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে পাশ্চাত্যের আর্ট এস্টাবলিশমেন্ট দূরে রাখার কারণে এই উদ্দেশ্য আরো গুরুত্ব পেয়েছে। বিয়েনিয়াল প্রদর্শনীর রাজনৈতিক সংস্কৃতি পাশ্চাত্যের আর্ট এস্টাবলিশমেন্টের আধিপত্যের অবসান ঘটিয়ে বিশ্ব সংস্কৃতির গণতন্ত্রায়ণের জন্য কাজ করছে। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশের দ্বি-বার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী বেশ সফল, একথা বলা যায়। তবে বিদেশি শিল্পী এবং তাঁদের কাজের সংখ্যা প্রদর্শনীতে আরো বাড়াতে হবে। সেইসঙ্গে দৃষ্টি দিতে হবে বাংলাদেশি শিল্পীদের প্রদর্শিত শিল্পকর্মের গুণগত মানের উৎকর্ষ এবং সামগ্রিকভাবে বৈচিত্র্য নিশ্চিত করার দিকে। প্রথমেই বলা হয়েছে, প্রচারণার অভাবে বাংলাদেশের দ্বি-বার্ষিক প্রদর্শনী বাইরের পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত সুপরিচিত হতে পারেনি। এর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। n
তথ্যসূত্র
১. কনটেম্পোরারি আর্ট : অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৪।
২. ডান্টো, আর্থার : ‘আফটার দি এন্ড অফ আর্ট, কনটেম্পোরারি অ্যান্ড দি পেইন অফ হিস্ট্রি’, ১৯৯৭।
৩. ভাবা, হোমি কে : লোকেশন অফ কালচার, ১৯৯৪।
৪. ‘অ্যান ইনভিটেশন টু সি’ দি মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্ট, নিউ ইয়র্ক, ১৯৯২।
৫. সালেক, সৌম্য : ‘দ্বি-বাষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী’, ত্রৈমাসিক পত্রিকা নতুন এক মাত্রা, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি সংখ্যা, ২০১৭।
৬. বেঞ্জামিন, ওয়াল্টার : ‘দি ওয়ার্ক অফ আর্ট ইন অ্যান এজ অফ মেকানিকাল রিপ্রডাকশন’, ১৯৩৬।
৭. ‘অ্যান ইনভিটেশন টু সি’, প্রাগুক্ত।
৮. সপ্তদশ দ্বি-বার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী (ব্রোশিয়োর), বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, ২০১৬।
৯. বেঞ্জামিন, ওয়ালটার : প্রাগুক্ত।
১০. হক, আজিজুল : সপ্তদশ দ্বি-বার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী (ব্রোশিয়োর), বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, ২০১৬।
১১. বেঞ্জামিন, ওয়াল্টার : প্রাগুক্ত।
১২. প্লেটো : দি রিপাবলিক।
১৩. গমব্রিখ ই এম : আর্ট অ্যান্ড ইল্যুশন, ১৯৬৯।
১৪. রিড, হার্বার্ট : দি ফিলসফি অফ মডার্ন আর্ট, ১৯৫৯।
১৫. কটিংটন, ডেভিড : মডার্ন আর্ট, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৫।
১৬. গ্রিনবার্গ, ক্লিমেন্ট : আভাঁ-গার্দ অ্যান্ড কিসচ্, ১৯৩৯।
১৭. অ্যাডর্নো, থিওডোর : কালচার ইন্ডাস্ট্রি, ১৯৯১।
১৮. ডান্টো, আর্থার : আফটার দি এন্ড অফ আর্ট, ১৯৯৭।