logo

চার্লস ড’য়লির প্রদর্শনী

মৌ মি তা  ব সা ক

ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস ক্ষমতাবদলের ইতিহাস। এই ক্ষমতার পরিবর্তন শুধুমাত্র বংশগত অনুক্রমে কিংবা কোনো একই পরম্পরায় সংঘটিত হয়নি। বরং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বহিরাগত জাতির আধিপত্য স্থাপনের সাক্ষী এই উপমহাদেশ। আর এভাবেই ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি অন্বিত হয়ে ঘটে গিয়েছে এই ভূমিভাগের বহু বিবর্তন। এমনই এক রাজনৈতিক তথা সামাজিক পালাবদলের সন্ধিক্ষণের ঐতিহাসিক নথি শিল্পী চার্লস ড’য়লি (Charles DÕoyly) (১৭৮১-১৮৪৫) অঙ্কিত চিত্রাবলি।

অবিভক্ত ভারতেই জন্ম হয় চার্লসের। পিতা ছিলেন মুর্শিদাবাদে তৎকালীন নবাবের সভায় অবস্থানকারী কোম্পানির প্রতিনিধি। চার বছর বয়সে চার্লস ইংল্যান্ড যান প্রাথমিক পাঠগ্রহণের জন্য। এরপর ১৭৯৮-তে কলকাতায় ফেরেন ব্রিটিশ সরকারের কোর্ট অফ অ্যাপিলের সহকারী নিবন্ধক হয়ে। ১৮০৮-এ কোম্পানির কর্মচারী হিসেবে ঢাকায় যান তিনি। আর পরবর্তী সময়ে বিহারের পাটনাসহ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ব্রিটিশ সরকারের অধীনে নানান পেশায় নিযুক্ত ছিলেন তিনি। জীবনের এই বিভিন্ন অভিজ্ঞতাকে সামনে রেখে তিনি একের পর এক এঁকেছেন ভারতীয় জীবনধারা আর প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি। ড’য়লির চিত্রাবলিতে ইংরেজ লাট, বড়লাটদের শাসনকালে কলকাতাসহ বিভিন্ন নগরের উন্নয়নের ছবিও ধরা পড়েছে। চার্লস ড’য়লির দেখা এই ভারতবর্ষের ছবি এখন কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের প্রদর্শনীতে উপস্থিত।

১৯২১-এ কলকাতার প্রায় কেন্দ্রস্থলে প্রতিষ্ঠিত হয় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল। মুঘল ও ব্রিটিশ স্থাপত্যশৈলীর সংমিশ্রণে নির্মিত রানি ভিক্টোরিয়ার নামে উৎসর্গীকৃত এই স্মৃতিসৌধে ভিক্টোরিয়া ও প্রিন্স অ্যালবার্টের বিভিন্ন প্রতিকৃতিসহ তাঁদের স্মৃতিবিজড়িত বহু দ্রব্য রক্ষিত আছে। এছাড়াও এখানে ব্রিটিশ-ভারতের বহু শিল্পীর কাজ সংরক্ষণ করা হয়েছে। এদের সংগ্রহে চার্লস ড’য়লির মোট একশো তিনটি ছবি আছে। তার মধ্যে সাতাশটি রঙিন ও সাদা-কালো লিথোগ্রাফ নিয়ে এই প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছে, যার শিরোনাম ‘ভিউজ অফ ক্যালকাটা অ্যান্ড ইটস এনভায়রনস’। এই নামাঙ্কিত লিথোগ্রাফের অ্যালবামটি ১৮৪৮-এ লন্ডনের ‘ডিকিনসন অ্যান্ড কোম্পানি’ থেকে ছাপা হয়। পরে শ্রীমতী জর্জ লিয়েল তাঁর স্বামীর স্মৃতি রক্ষার্থে এটি ১৯৩২-এ ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের সংগ্রহশালায় প্রদান করেন। এই চিত্র-মালিকা নিঃসন্দেহে মুঘল ও নবাবি ঘরানার অবসানে ভারত-ভূমিতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের গুরুত্বপূর্ণ চাক্ষুষ নথি।

১৭৫৭-তে পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গেই, ধীরে ধীরে মুর্শিদাবাদের নবাবি শাসনের সূর্য অস্তমিত হয়ে যায়। আর একই সঙ্গে লর্ড ক্লাইভের বিজয়, এদেশে ইংরেজদেরই প্রধানতম শক্তিরূপে প্রতিষ্ঠিত করে। মুঘলসহ নবাবি, সুবেদারি ক্ষমতার অবসান ঘটিয়ে এই উপমহাদেশে স্থাপিত হয় ব্রিটিশ আধিপত্যের ইতিহাস। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শক্তিকেন্দ্র রূপে ক্রমোন্নত হয়ে ওঠে কলকাতা শহর। আর কলকাতাকে কেন্দ্র করে ক্রমেই ব্যাপ্তি লাভ করে পশ্চিমি নাগরিক সভ্যতার প্রতিচ্ছায়া। আরো একবার এই ভূমিভাগে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত হয় আরো এক বহিরাগত জাতির ক্ষমতা স্থাপনের ইতিহাস। আর এর সঙ্গে সঙ্গেই আবার ঘটে সাংস্কৃতিক সংকরায়ণ। ড’য়লির ছবিতে অনেকখানিই ধরা পড়ে তৎকালীন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণের প্রাথমিক আভাস। একদিকে ড’য়লির চিত্রাবলি এদেশের ভূমিতে ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীর রাজকীয় গরিমান্বিত আত্মপ্রকাশের কাহিনি শোনায় যেমন – ‘গভর্নমেন্ট হাউস’, ‘সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল’, ‘চার্চ এনট্রান্স টু ধারমতোলা’ প্রভৃতি চিত্র, অপরদিকে এই শিল্পীর ছবি ভারতে কালা আদমিদের শহরে ‘নেটিভ’ জীবনযাত্রারও বর্ণনা দেয়।

এভাবেই ড’য়লির চিত্রবিন্যাস ইতিহাসের পালাবদলের এক সন্ধিক্ষণের ছবি আমাদের সামনে তুলে ধরে। আমাদের সম্মুখে বীক্ষমাণ হয় আমাদেরই পূর্বজরা। ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির প্রভাবে আমাদের বর্তমান আধুনিক জীবনধারা যে ক্রমিক পর্যায়ের মধ্য দিয়ে বিবর্তিত হচ্ছে তারই প্রাথমিক বিকাশকে আমরা অবলোকন করতে পারি চার্লস ড’য়লির ছবিগুলোতে। শুধুমাত্র ড’য়লি নন, সে-সময় ইউরোপ থেকে আগত আরো অনেক চিত্রকরের শিল্পকর্মেও তৎকালীন ভারতের ইতিহাস মুদ্রিত হয়ে আছে।

১৭৭৪ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস কোম্পানির বড়লাট নিযুক্ত হন। তাঁর উদ্যোগে কলকাতার বহুলাংশে শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। স্থাপিত হয় সুপ্রিম কোর্ট। এ সময় কলকাতা ভারতের তথা সমগ্র এশিয়ার সম্পন্ন শহর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। শোভন সোম রচিত ‘কলকাতা পটের চালচিত্তির’ থেকে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সে-সময় কলকাতা ‘পুঁজিবিকাশের শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। পুঁজিবিকাশের সঙ্গে সংস্কৃতি বিকাশের যে একটি ওতপ্রোত যোগ আছে তা আমরা ইতিহাসে নানা সময়েই লক্ষ্য করে থাকি। … কলকাতায় পুঁজির বিকাশও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্ন বৃত্তির মানুষকে আকর্ষণ করেছিল। … বাইরে থেকে বিভিন্ন বৃত্তির যে মানুষরা এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে চিত্রকররাও ছিলেন। … যেসব ইউরোপীয় চিত্রকর এদেশে ভাগ্যান্বেষণে এসেছিলেন তাঁরা কেউ নামীদামী না হলেও ক্যামেরাহীন যুগে এদেশের মানুষজনের দৃশ্যাবলী, রীতিরেওয়াজ ইত্যাদির ছবি এঁকে এদেশ সম্পর্কে স্বদেশের কৌতূহল চরিতার্থ করে দু-পয়সা কামাতে এসেছিলেন। এঁরা নিজেরাই আঁকতেন, এনগ্রেভিং বা লিথোতে ছবি ছাপতেন ও বেচতেন।’ সে-সময় ইউরোপ থেকে আসা চিত্রকরদের মধ্যে মূলত তিন ধরনের ছবি আঁকার প্রবণতা ছিল – ঐতিহাসিক চিত্র ((Historical), কথোপকথন সম্বন্ধীয় (Conversational) এবং প্রতিকৃতিচিত্র (Portraits)। এর  মধ্যে প্রতিকৃতিচিত্র ছিল ফরমায়েশি চিত্র আর বাকিগুলোর বিষয় এসব শিল্পী স্বাধীনভাবেই নির্বাচন করতেন, যার মধ্যে থাকত এখানকার জনজীবন, নানান আচার-অনুষ্ঠান যেমন – চড়ক, গাজন ইত্যাদি; আবার প্রাকৃতিক দৃশ্য, পশুপাখির চিত্র প্রভৃতি। এসব চিত্র এই সব শিল্পী আঁকতেন, চাকরিসূত্রে এদেশে বসবাসকারী নব্য-ধনী ইংরেজ খরিদ্দারদের চাহিদা পূরণ করতে আর পাশাপাশি নিজেদের দেশে এখানকার ভিন্ন পরিবেশের কৌতূহলোদ্দীপক বর্ণময় ছবি বিক্রি করে অর্থোপার্জন করতে। এদেশে প্রথম আসা ইংরেজ চিত্রকরদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নাম টিলি কেটল, যিনি ১৭৭১-এ এখানে আসেন। এছাড়াও সমসাময়িক শিল্পীদের মধ্যে বিখ্যাত নামগুলো হলো উইলিয়ম হজেস, জোহান জোফানি, থমাস ও উইলিয়ম ড্যানিয়েল, থমাস হিকি প্রমুখ।

টিলি কেটল লক্ষেèৗতে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন নবাব সুজা-উদ-দৌলার প্রতিকৃতি অঙ্কনের জন্য। জোফানিকৃত ওয়ারেন হেস্টিংস ও শ্রীমতী হেস্টিংসের প্রতিকৃতি সংরক্ষিত আছে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলে। আবার হিকি অঙ্কিত ‘জামদানী বিবি’ (১৭৮৭) প্রতিকৃতিচিত্রের মধ্যে বিশেষ উল্লেখ্য। ইউরোপীয় এই চিত্রকররা প্রতিকৃতি আঁকতেন তেলরঙে, বেশ বড়মাপে। সে-সময় এদেশে আগত উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ রাজকর্মচারী ছাড়াও দেশি ধনী ব্যক্তিদের মধ্যেও প্রতিকৃতি অঙ্কনের চাহিদা ব্যাপ্ত হয়েছিল।

চালর্স ড’য়লির আঁকা প্রদর্শনী  চলেছে ২৫ জুন থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত ভিক্টোরিয়া মিউজিয়ামে। কলকাতার দর্শকরা আগ্রহভরে দেখেছেন এ প্রদর্শনী।

বিষয়বস্তুর বিভিন্নতা ছাড়াও এই ইউরোপীয় শিল্পীদের চিত্রগুলো রূপলাভ করতো প্রধানত তিন প্রকার মাধ্যমে। প্রথমত, বড়মাপের ফ্রেমে বাঁধানো তৈলচিত্র; দ্বিতীয়ত, ইংল্যান্ড থেকে আনা কাগজে ব্রিটিশ শৈলীতে জলরঙের মাঝারি বা ছোট মাপের ছবি আর তৃতীয় প্রকারে ছিল এনগ্রেভিং, লিথোগ্রাফি বা এচিং মাধ্যমের ছাপচিত্র, যেগুলো কখনো প্রকাশ পেত মোনোক্রোমে, কখনো বা ছাপ নেওয়ার পর জলরঙে রঞ্জিত করা হতো। এ সমস্ত প্রকার ছবিই ছিল সাদৃশ্যনিষ্ঠ অর্থাৎ রিয়ালিস্টিক। সে-সময় ইউরোপে ইতালীয় রেনেসাঁস প্রবর্তিত চিত্ররীতির ধারাই প্রচলিত ছিল। ১৭৬৮-তে তৃতীয় জর্জ ‘রয়্যাল অ্যাকাডেমি অফ আর্ট’ স্থাপন করেন লন্ডনে। আর সেই অ্যাকাডেমির প্রথম সভাপতি হন শিল্পী স্যার জোশুয়া রেনল্ডস, যিনি ইতালীয় শিল্পধারার অনুরাগী ছিলেন। সেই সঙ্গে তৎকালীন ব্রিটিশ শিল্পীরাও রেনেসাঁস শিল্পীদের চিত্রশৈলীকেই আদর্শ করে নিয়েছিলেন। বলাই বাহুল্য, এই চিত্ররীতি ছিল সাদৃশ্যধর্মী, বাস্তবনিষ্ঠ এবং এর রূপায়ণে আলোছায়া বা চিয়ারস্কিউরো, পরিপ্রেক্ষিত রচনা, আনুপাতিক গঠনবিন্যাস ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপ থেকে এদেশে আসা শিল্পীরাও চিত্ররচনা করলেন পশ্চিমি ছবির নিয়মেই অর্থাৎ চিত্রপটে পুরোভূমি, মধ্যভূমি, পশ্চাৎভূমি নির্মাণ করে ছবির গভীরতা বা স্পেশাল ডেপথ্ সৃষ্টি করে, যা ভারতীয় বিভিন্ন ঘরানায় দেখা যেত না।

চার্লস ড’য়লির ছবিতেও লঙ্ঘিত হয়নি পশ্চিমি চিত্ররীতি। সে-সময় ইংল্যান্ড থেকে আসা যেসব শিল্পী এদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্তাব্যক্তি তথা দেশীয় অভিজাতবর্গের কাছে বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম উল্লেখ্য হলেন জর্জ চিনারি। ঢাকায় কর্মরত অবস্থায় (১৮০৮-১৮১২) ড’য়লি, শিল্পী চিনারির থেকেই ড্রইং ও পেইন্টিংয়ের শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ড’য়লি শুধুমাত্র সমাজের উচ্চবর্গীয় মানুষদের ফরমায়েশি ছবি অঙ্কনের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি। চিত্রবিন্যাসের বিষয়বস্তু হিসেবে তাঁকে আকর্ষণ করেছিল এই কালা আদমিদের দেশে সাধারণ মানুষদের জীবনযাত্রা, আচার-অনুষ্ঠান, পোশাক-পরিচ্ছদ, এদেশের ভিন্ন জলহাওয়ায় ব্রিটিশ রাজকর্মচারীদের পারিবারিক বিন্যাস, ফিরিঙ্গিদের কাজে নিযুক্ত এদেশীয় খানসামা, অনুচর, সহিস প্রভৃতি মানুষ; এছাড়াও সাহেবদের এস্টেট, বাগানবাড়ি, সরকারি অট্টালিকা ইত্যাদি। চাকরিসূত্রে ড’য়লিকে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে বসবাস করতে হয়েছে। বিভিন্ন স্থানের অধিবাসীবৃন্দ কিংবা প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলির খসড়া চিত্র তিনি একটি ডায়েরিতে করে রাখতেন। পরে সেখান থেকে ছাপচিত্রের অ্যালবাম বা জলরঙে অঙ্কিত চিত্রগুচ্ছ প্রকাশ পেয়েছিল, যা তৎকালীন সময়ের ঐতিহাসিক নথি হিসেবে আমাদের সামনে বিদ্যমান। তাঁর কাজ নিয়ে ১৮১৩-তে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয় দ্য ইউরোপিয়ান ইন ইন্ডিয়া, আবার ঢাকা থেকে ১৮১৬-তে মুদ্রিত হয় অ্যান্টিকুইটিস অফ ঢাকা।

পাশ্চাত্য রীতিতে চিত্রাভ্যাস করলেও ড’য়লির কাজের মধ্যে কিছুটা হলেও প্রভাব পড়েছিল তৎকালীন পাটনা-ঘরানার। মুঘল চিত্রকলার অবলুপ্তি থেকেই দরবারি চিত্রকররা উত্তর ও পূর্ব ভারতের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়েন। এভাবে পাটনা, মুর্শিদাবাদ প্রভৃতি অঞ্চলে চিত্রকরদের বসতি গড়ে ওঠে। এ সমস্ত শিল্পী নিজেদের জীবিকার প্রয়োজনে ক্রেতা ও পৃষ্ঠপোষকদের রুচির অনুকূলে নিজেদের শৈলী রূপান্তরিত করেছেন, আবার ছবির বিষয়ও নির্বাচন করেছেন তাঁদের চাহিদা অনুযায়ী। মুর্শিদাবাদী, পাটনাই শিল্পীরাও ক্রমেই কোম্পানির কাজে এদেশে আসা মানুষদের জন্য ছবি আঁকতে শুরু করেন, আর সেসব ছবির মূল বিষয় হয়ে ওঠে এদেশীয় পশুপাখি, বিভিন্ন যানবাহন যেমন – পালকি, এক্কা, হাতি প্রভৃতি, হাটবাজার, গ্রামের দৃশ্য কিংবা বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত মানুষ যেমন – দর্জি, ধোপা, ব্যবসায়ী ইত্যাদি। ড’য়লি কোম্পানির কাজে পাটনায় বসবাস শুরু করেন ১৮১৮-তে। সেখানে তাঁর উদ্যোগে স্থাপিত হয়

‘বিহার লিথোগ্রাফিক প্রেস’। এখান থেকেই প্রকাশিত হয় ড’য়লির দ্য কস্টিউমস অ্যান্ড কাস্টমস অফ মডার্ন ইন্ডিয়া। পাটনায় ড’য়লির কাজে সহকারী হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন স্থানীয় চিত্রকর জয়রাম দাস। আর বেশ কিছু লিথোগ্রাফি পাথরের ওপর ড’য়লির ড্রইং থেকে জয়রাম দাসই অঙ্কন করেছিলেন। ১৯৪৭-এ ‘দ্য রয়্যাল ইন্ডিয়া সোসাইটি’ থেকে প্রকাশিত মিলড্রেড আর্চারের ‘পাটনা-পেইন্টিং’ থেকে বলা যায়, যে-সময় পাটনাই চিত্রকররা ইউরোপীয় পৃষ্ঠপোষকদের চাহিদা মেটাতে সচেষ্ট সে-সময় ড’য়লির পশ্চিমি শৈলীর অঙ্কনরীতি তাদের বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। আবার ছবির বিষয়বস্তু নির্বাচনে যেমন – ব্রিটিশ ঘোড়সওয়ার, হাতির পিঠে মাহুতসহ ধনী অধিবাসীবৃন্দ, নাচের দৃশ্য এদেশের বিভিন্ন বর্গের মানুষদের ভিন্ন ভিন্ন পরিধেয় প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে চিত্রাঙ্কনে ড’য়লি হয়তো প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন এই চিত্রকরদের থেকে, নিজ দেশীয় পৃষ্ঠপোষকদের কৌতূহল নিবৃত্তির উদ্দেশ্যে। আবার ক্যাপ্টেন রবার্ট স্মিথ তাঁর ‘পিক্টোরিয়াল জার্নাল অফ ট্রাভেলস ইন হিন্দুস্তান ফ্রম ১৮২৮ থেকে ১৮৩৩’-এ লিখেছেন চার্লস ড’য়লির সবিশেষ উৎসাহে এবং তাঁর প্রেসে তাঁর সযতœলালিত তত্ত্বাবধানে ‘নেটিভ’ শিল্পীরাও অনেকাংশে উপকৃত এবং প্রভাবিত। এর থেকে উপলব্ধ হয় যে, ভারতীয় ছবির স্বভাবনিষ্ঠতা বা কারুকৌশল পশ্চিমি রীতি থেকে স্বতন্ত্র হলেও তৎকালীন ভারতীয় শিল্পীদের চিত্র অনুশীলনের সঙ্গে ড’য়লি বিশেষভাবেই পরিচিত ছিলেন।

চার্লস ড’য়লি ছাড়াও ১৭৯৪-তে ব্রিটিশ চিত্রকর সলভিনস বারো খণ্ডে ‘এ কালেকশন অফ টু হান্ড্রেড ফিফটি কলর্ড এচিংস, ডেসক্রিপটিভ অফ দ্য ম্যানার্স, কাস্টমস, ক্যারেক্টর, ড্রেস অ্যান্ড রিলিজিয়স সেরিমনিজ অফ দ্য হিন্দুস’ নামে এক অ্যালবাম ছেপেছিলেন। এক রঙে ছেপে ছবিগুলোতে হাতে রং করা হয়েছিল। হয়তো রং করার এই কাজ এদেশীয় শিল্পীদের দিয়েই করানো হয়েছিল। আবার থমাস ও ভাইপো উইলিয়ম ড্যানিয়েলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ১৭৮৬-তে অ্যাকোয়াটিন্ট মাধ্যমে ছাপ তোলা ‘দ্য টোয়েলভ ভিউজ অফ ক্যালকাটা’ নামক ফোলিও প্রকাশিত হয়। এরপর চিনারির অপর এক ছাত্র জেমস বেইলি ফ্রেজার এবং উইলিয়ম উডও ছাপচিত্রের অ্যালবাম প্রকাশ করেন। একদিকে ভারতীয় মুদ্রণের আদি যুগে এই ছাপচিত্র অ্যালবামের প্রকাশনা কারুকৌশলের দিক থেকেও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, আবার ক্যামেরাহীন যুগে এগুলোর ঐতিহাসিক গুরুত্বও অসামান্য। এইসব ইউরোপীয় শিল্পীর ছাপচিত্রের প্রতি আগ্রহের একটি বিশেষ কারণ হলো, এগুলো বৃহৎ মাপের তৈলচিত্রের মতো বহন করা দুঃসাধ্য নয়। সহজেই এই অ্যালবামগুলো এদেশের বিভিন্ন পৃষ্ঠপোষকের কাছে কিংবা নিজেদের দেশে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল। তাছাড়া এই নতুন দেশের প্রকৃতি ও মানুষজনের বিশেষ আগ্রহোদ্দীপক চিত্রাবলি অনেকের কাছে একই সঙ্গে পৌঁছে দেওয়া সহজ হতো।

ড্যানিয়েল শিল্পীদ্বয় কিংবা ফ্রেজার – এঁরা এদেশের দৃশ্যাবলি অঙ্কন করলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এদের আগ্রহের বিষয় ছিল ইউরোপীয় ভারত বা সাদা মানুষদের কলকাতা। অপরদিকে ড’য়লি কিন্তু ব্রিটিশ স্থাপত্য, ইংরেজ কর্মচারীদের পাশাপাশি এদেশের সাধারণ মানুষদের অর্থাৎ কালা আদমিদের জীবনযাত্রাকেও স্থান দিয়েছেন তাঁর চিত্রাঙ্কনের বিষয়বস্তু হিসেবে – যেমন হিন্দু টেম্পল্ নিয়ার দ্য স্ট্র্যান্ড রোড কিংবা মসক অ্যাট বোরানিপুর, ভিউ ইন দ্য ভিলেজ অফ শিবপুর নামাঙ্কিত ছবিতে দৃষ্ট হয়। ঊনবিংশ শতকের প্রথম দুই দশকে চার্লস ড’য়লির ছবিতে কালা আদমিদের প্রতি বিশেষ আগ্রহ পরবর্তীকালে ম্যাডাম বেলনসসহ উইলিয়ম টেলর, উইলিয়ম প্রিন্সেপ প্রমুখ ইউরোপীয় শিল্পীকেও অনুপ্রাণিত করেছিল।

মূলত কোম্পানির বিভিন্ন দপ্তরে চাকরি করলেও অ্যামেচার বা অপেশাদার শিল্পী হিসেবে ড’য়লির দক্ষতা প্রশ্নাতীত। অন্য পেশায় নিযুক্ত থেকেও এদেশের বিভিন্ন স্থান এবং মানুষজনের প্রতি তাঁর যে বিশেষ আগ্রহ তিনি তাঁর চিত্রভাষায় লিপিবদ্ধ করেছেন তা নিঃসন্দেহে অসামান্য প্রয়াস। তাঁর চিত্রাবলিতে এক ইউরোপীয়র দৃষ্টিতে তৎকালীন ভারতের ছবি ফুটে উঠলেও

প্রাক-ক্যামেরা যুগে এগুলো আমাদের অতীতকে চোখের সামনে মূর্ত করে তোলে। অবিভক্ত ভারতে ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির বিবর্তনের ধারার এক প্রাথমিক পর্যায়কে বর্তমান আধুনিক নাগরিকদের সামনে দৃশ্যমান করে চার্লস ড’য়লির এই চিত্রাবলি।

Leave a Reply