আ নি সু জ্জা মা ন
১৬ ও ১৭ মার্চ গুলশানের বেঙ্গল আর্ট লাউঞ্জে ভারতীয় শিল্পী শুভাপ্রসন্নের এক চিত্রপ্রদর্শনী হয়ে গেল। শুভাপ্রসন্ন এদেশে নবাগত নন। বেঙ্গল গ্যালারি-আয়োজিত আর্ট ক্যাম্প ও চিত্রপ্রদর্শনীতে যোগ দিতে এর আগেও তিনি বাংলাদেশে এসেছেন। তবে এদেশে তাঁর একক চিত্রপ্রদর্শনী এবারই প্রথম অনুষ্ঠিত হলো। প্রদর্শনীর নাম ছিল ‘নীলিমা ও নৈরাজ্য’। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার পংক্তি থেকে এই কথাগুলি নিয়ে শুভাপ্রসন্ন-পরিকল্পিত কবিতা ও ছবির একটি বইয়ের নাম দিয়েছিলেন আয়ান রশিদ খান। এখন এই নামটি হয়ে গেছে শুভাপ্রসন্নের শিল্পভাবনার প্রতীক। নীলিমার নিচে প্রশান্তি নেই আমাদের কালে, আছে নৈরাজ্য – মানুষ, প্রাণী ও বস্ত্তজগতের নানা সংঘাত, পারস্পরিক সম্পর্কের নানা টানাপোড়েন। শুভাপ্রসন্ন নৈরাজ্যকে তুলে ধরেন নীলিমার পটভূমিকায়। তিনি নীলিমা ছাড়তে পারেন না, নৈরাজ্য ভুলতে পারেন না। তাই দুইয়েরই পাশাপাশি অবস্থান তাঁর চিত্রকলায়।
চিত্রাঙ্কনের চার দশক অতিক্রম করেছেন শুভাপ্রসন্ন। দেশে-বিদেশে খ্যাতি ও সম্মান লাভ করেছেন প্রচুর। রাজনীতিতে জড়িয়ে কিছুটা বিতর্কিতও হয়েছেন হয়তো। কিন্তু তাঁর ছবিতে যে মৌলিক ভাবনা এবং অঙ্কনরীতির নিজস্বতা প্রকাশ পেয়েছে, তাকে সানন্দ অভ্যর্থনা জানিয়েছেন কলারসিকেরা। শুভাপ্রসন্ন ছবির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করেছেন চাইনিজ ইংক, কাঠকয়লা, তেলরং ও অ্যাক্রিলিক। তাঁর ছবিতে কালোর প্রাধান্য। কখনো কখনো তার সঙ্গে জুড়েছেন হলুদ বা নীল – প্রায়ই সেই হলুদ হয়েছে লালচে, নীল হয়ে গেছে ঘন কালো। মিশ্র মাধ্যমেও তিনি এঁকেছেন অনেক ছবি – কখনো ক্যানভাসে, কখনো কাগজে।
শুভাপ্রসন্নের ছবির বিষয় প্রধানত আবর্তিত হয়েছে তাঁর প্রিয় নগর কলকাতাকে ঘিরে। এ-নগর নিয়ে গর্ব করার যেমন অনেক কিছু আছে, তেমনি আছে শোকপ্রকাশের অনেক কারণ। প্রদর্শনীর কেন্দ্রে রবীন্দ্রনাথকে বসে থাকতে দেখা যায় স্বমহিমায়, তবে ঘনীভূত কালোর মধ্যে। অবশ্য তাঁর চুল-দাড়ি সাদা, দুহাতের নিচে সাদা কাপড় উঁকি দিচ্ছে, হাতে-ধরা বইয়ের সাদা পৃষ্ঠা দেখা দিচ্ছে, নীলিমায় প্রায় পূর্ণিমার চাঁদ। কিন্তু আরামকেদারায় আসীন কবির যে-ছায়া ছড়িয়েছে পশ্চাতে, তা নিয়েছে নিষ্পত্র বৃক্ষের রূপ। কবির সৃষ্টিশীলতার প্রভাব কি ব্যর্থ হয়ে গেল আমাদের জীবনে? শিল্পীর ছবিতে কলকাতার বাড়িঘর দেখি লেগে আছে গায়ে গায়ে, নেই সামান্য একটু ব্যবধানও। এই যোগ সহমর্মিতার নয়, একটার ওপর অন্যটার চেপে বসার। আরেক ছবিতে দেখি, প্রকান্ড বাড়িটা কেমন অাঁকাবাঁকা, তার গম্বুজের ওপর পাখা বিস্তার করে দাঁড়িয়ে আছে প্যাঁচা। কোথাও বাড়িঘর একটার ওপরে আরেকটা জুড়ে বসেছে এবং মানুষের আনুপাতিকভাবে অনেক বড়ো দুটি হাত ভূগর্ভ থেকে আকাশের দিকে উত্থিত, আর দূরে আকাশে তার ছায়াপাত। অন্যটায় উচ্চ আদালতগৃহের সামনে আইনজীবী দাঁড়িয়ে আছেন বিকৃত মুখভঙ্গি করে – ইনিই ‘আইকন’ – চিত্রার্পিত মহাপুরুষ। অন্য আইকনটিতেও বিকার আছে – অনুপাতে, অবয়বে, চাহনিতে।
শুভাপ্রসন্নের ছবিতে আছে ত্রিকালদর্শী প্যাঁচা, তীক্ষ্ণচঞ্চু পাখি, সকল প্রতিকূলতার মধ্যেও টিকে-থাকা কাক, সুযোগসন্ধানী বিড়াল, পথের ধারের কুকুর, বড়ো চোখওয়ালা মাছ, গলায় গলা-জড়ানো হাঁস, একরোখা ছাগল, ফুল, প্রজাপতি ও পতঙ্গ, কিন্তু কোনোটাই বস্ত্তধর্মিতার সীমার মধ্যে আবদ্ধ নয়, বরঞ্চ তাদের মধ্যে যে-অতিরঞ্জন আছে, যে-ভাঙন আছে, তা বিমূর্ততার আভাস দেয়। কবিতায় কবির প্রিয় প্রতীকের মতো শিল্পীর ছবিতে এসব প্রাণী ঘুরেফিরে আসে। এদের অবয়ব দেখলেই ধরা যায়, এরা বিশেষ করে শুভাপ্রসন্নেরই সৃষ্টি। বোঝা যায়, যে-পরিবেশে আমাদের বাস, তার ক্ষয় ও বিকারের দ্যোতক এরা।
শুভাপ্রসন্ন ভালো করেই জানেন যে, এই ক্ষয় ও বিকার কেবল তাঁর প্রিয় নগরের লক্ষণ নয়, সারা পৃথিবীতেই আজ তা ছড়িয়ে রয়েছে। তাঁর একটি ছবির তাৎপর্য আমার কাছে খুব স্পষ্ট নয়, তবে তিনি যে তাঁর দেশকালের সীমা অতিক্রম করে সেখানে দাঁড়িয়েছেন, তাতে সন্দেহ নেই। ছবিটিতে দেখি, মরুভূমিতে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে রয়েছেন নানা দেশের নানা কালের মনীষীরা : লেওনার্দো, শেকসপিয়র, মার্কস, লিংকন, আইনস্টাইন, মাও, রবীন্দ্রনাথ, গান্ধি, চার্লি চ্যাপলিন, মার্টিন লুথার কিং, মাদার টেরেসা, আরো অনেকে। আর সেই মরুপ্রান্তরে বাঁশিতে সুর তুলছে দুই
যুবক-যুবতী – পৃথিবীর প্রথম মানব-মানবীর মতো আপাদমস্তক নগ্ন। কিছু উপকরণ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে চারপাশে : সর্পিণী, লেখনী, অন্নপাত্র। এখানে আদিম কি হয়ে উঠেছে আধুনিক, বিগত হয়ে গেছে সাম্প্রতিক? কে বলতে পারে!
শুভাপ্রসন্ন দৃষ্টিনন্দন ছবি অাঁকার দায় স্বীকার করেননি। ক্ষোভের, প্রতিবাদের, ভিন্নমতের সুর ও স্বর শোনা যায় তাঁর কাজে। তিনি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চান ঘটমান বর্তমানের দিকে, চান মানুষের ভাগ্যপরিবর্তন করতে। পরিবর্তন করতে হলে সকলের সচেতনতা চাই। তাঁর ছবি আমাদের সচেতন করতে চায়। তার মধ্যে দিয়েই শিল্পী গড়ে তোলেন নিজের নন্দনতত্ত্ব। স্লোগান দিয়ে নয়, নান্দনিক বোধ নিয়েই পরিবর্তনের দিকে এগোতে চান তিনি। এই প্রদর্শনী তারই সাক্ষ্য বহন করে।
তবে রবীন্দ্রনাথের অনুকরণে বলা যায়, ছবি প্রকাশ করবে নিজেকে, ব্যাখ্যা করবে কেন? সেই অর্থে চিত্রের ব্যাখ্যাদানের চেষ্টা অনেকটাই বাহুল্য। ছবি এঁকেই শিল্পীর দায়িত্ব শেষ। দর্শক বা সমালোচক ব্যাখ্যা করতে চাইলে নিজের দায়িত্বেই তা করবেন। সে-ব্যাখ্যার সঙ্গে শিল্পীর অভিপ্রায়ের যে মিল থাকবে, এমন নাও হতে পারে।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ১৭ মার্চে বেঙ্গল গ্যালারি অব্ ফাইন আর্টস্-এ অশোককুমার মুখোপাধ্যায়-রচিত শুভাপ্রসন্ন : নীলিমা ও নৈরাজ্য বইটির মোড়ক উন্মোচন করা হয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, আলোচনা করেন এই লেখক এবং নিজের শিল্পভাবনা সম্পর্কে বিস্তৃত ও উপভোগ্য ব্যাখ্যা দেন শিল্পী স্বয়ং।
- ঠিকানা
- সপ্তম বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । আশ্বিন ১৪২৫ । October 2018
- পুরানো সংখ্যা
- সপ্তম বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । পৌষ ১৪২৪ । December 2017
- ষষ্ঠ বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । বৈশাখ ১৪২৩ । May 2017
- ষষ্ঠ বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । কার্তিক ১৪২৩ । November 2016
- পঞ্চম বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । বৈশাখ ১৪২৩ । May 2016
- পঞ্চম বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । অগ্রহায়ন ১৪২২ । November 2015
- চতুর্থ বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । আষাঢ় ১৪২২ । June 2015
- তৃতীয় বর্ষ । চতুর্থ সংখ্যা । কার্তিক১৪২১ । November 2014
- তৃতীয় বর্ষ । তৃতীয় সংখ্যা । আষাড় ১৪২১ । July 2014
- তৃতীয় বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । ফাল্গুন ১৪২০ । February 2014
- তৃতীয় বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । কার্তিক ১৪২০ । Novembeer 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । চতুর্থ সংখ্যা । শ্রাবণ ১৪২০ । July 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । তৃতীয় সংখ্যা । বৈশাখ ১৪২০ । April 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । পৌষ ১৪১৯ । January 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । আশ্বিন ১৪১৯ । September 2012
- প্রথম বর্ষ । চতুর্থ সংখ্যা । জ্যৈষ্ঠ ১৪১৯ । May 2012
- প্রথম বর্ষ । তৃতীয় সংখ্যা । ফাল্গুন ১৪১৮ । February 2012
- প্রথম বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । অগ্রহায়ন ১৪১৮ । November 2011
- প্রথম বর্ষ । প্রথম সংখ্যা। ভাদ্র ১৪১৮ । August 2011