সম্প্রতি শিল্প ও শিল্পী পড়লাম। সচরাচর দেখা যায় না – বলা চলে কিছুটা বেঢপ আকারের দৃষ্টিনন্দন ছাপা দেখেই বইয়ের দোকানে কাগজটি চোখে পড়ল। দেখলাম প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা। পত্রিকাটির সিংহভাগ জুড়ে আছে চিত্রকলা বিষয়ক নানা ধরনের লেখা। তবে আমার মনোযোগ কাড়ল চলচ্চিত্র বিষয়ক অংশটি। প্রথম সংখ্যাটি সম্পর্কে খোঁজ করে জানলাম, চিত্রকলার সঙ্গে চলচ্চিত্র এই পত্রিকার নিয়মিত একটি বিভাগ। দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকী পাতায় চলচ্চিত্র বিষয়ে লেখা প্রায় অনুপস্থিত। এর বাইরে চলচ্চিত্র নিয়ে সুচিন্তিত লেখার এই আকালের কালে শিল্প ও শিল্পীকে সাধুবাদ জানাই চলচ্চিত্রের নিয়মিত বিভাগ রাখার জন্যে।
চলচ্চিত্র বিভাগের লেখাগুলো এই অভাজন পাঠকের নজর কেড়েছে, বিশেষ করে চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্রকার বিষয়ে আলোচনা। জাকির হোসেন রাজু লিখেছেন সম্প্রতি প্রয়াত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের জীবন ও চলচ্চিত্র বিষয়ে। বেলায়াত হোসেন লিখেছেন তারেক মাসুদ-নির্মিত রানওয়ে নিয়ে। আর কাবেরী গায়েন লিখেছেন নাসিরউদ্দীন ইউসুফ-পরিচালিত গেরিলার আলোচনা। বিষয়সূচি দেখে ধারণা হয়, সম্পাদক মহোদয় চলচ্চিত্রের সাম্প্রতিক বিষয়-আশয় পাঠকের দরবারে পৌঁছে দিতে চান। ভালো লাগল এই চাওয়া।
তবে না বলে পারছি না যে, তিনটি লেখাই আমার মতন চলচ্চিত্রপ্রেমী পাঠককে হতাশ করেছে। জাকির হোসেন রাজুর লেখাটি চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদকে জানতে-বুঝতে খুব বেশি সহায়ক হয় কি? হয় না। লেখার শেষদিকে এক জায়গায় রাজু বলেছেন, ‘সিনেমার লড়াই করতে গিয়ে তিনি সাধারণ, আটপৌরে জীবনের সীমা ছাড়িয়ে এক অসাধারণ, অলৌকিক দ্বীপভূমিতে পৌঁছাতে পেরেছিলেন।’ আসলে সত্যি কথা বলতে কী – রাজুর লেখায় তারেকের অলৌকিক এই দ্বীপভূমির বিশেষ কোনো পরিচয় পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয় না। চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদকে জানার জন্যে তাঁর চলচ্চিত্রগুলোর যে নৈর্ব্যক্তিক ব্যাখ্যা-আলোচনা দরকার সেটা রাজুর লেখায় পাওয়া যায় না। শিরোনাম দেখে প্রত্যাশা ছিল, রাজুর লেখায় তারেক মাসুদ-নির্মিত সকল চলচ্চিত্রের নিবিড় আলোচনায় পাঠক-দর্শকের কাছে চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ আরো দীপ্যমান হবেন। এই খামতি রয়ে গেছে রানওয়ে নিয়ে লেখাটিতেও। বেলায়াত হোসেন মামুন পাঁচ পৃষ্ঠাজুড়ে রানওয়ের আলোচনা লিখেছেন। লম্বা এই লেখায় রানওয়ের বিষয়বস্তুর সবিস্তার বর্ণনা ছাড়া অন্য কিছু পাইনি। চলচ্চিত্র কি কেবল কাহিনির কাঠামোতে বিষয়বস্তুর উপস্থাপনা? রানওয়ের কি কোনো আঙ্গিক আছে? আছে কি তার কোনো চলচ্চিত্রিক ভাষা? বেলায়াতের লেখায় এর আঙ্গিক-চলচ্চিত্রিক রূপায়ণ নিয়ে কোনো কথা নেই কেন?
অন্যদিকে কাবেরী গায়েন গেরিলার আলোচনা লিখেছেন নারীবাদী তাত্ত্বিকের দৃষ্টিকোণ থেকে। শিল্পের বিভিন্ন মাধ্যমের আলোচনায় নারীবাদী দৃষ্টিকোণের ব্যবহার পশ্চিমে বেশ কিছুদিন ধরে প্রচলিত হলেও আমাদের দেশে এখনো তেমনভাবে শুরু হয়নি। কাবেরীকে ধন্যবাদ, গেরিলা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি মুক্তিযোদ্ধা নারীর স্বীকৃতির প্রসঙ্গটি পাঠকের কাছে উপস্থাপন করেছেন। মূল আলোচনায় ঢোকার আগে তিনি যুদ্ধ-চলচ্চিত্রের সবিস্তার বর্ণনা দেন। এই বর্ণনায় আছে তাত্ত্বিক ভিত্তি, আছে বিভিন্ন চলচ্চিত্রের উদাহরণ। একটি লেখা লেখার জন্য তাঁর এই পরিশ্রম প্রশংসার দাবিদার। তবে যে পাঠক এসব উদ্ধৃত চলচ্চিত্র এবং সেই চরিত্রগুলোর সঙ্গে পরিচিত নন, তাঁদের জন্য এই পাঠ খুব সুখপ্রদ নয় বলেই ধারণা করি। কাবেরী গেরিলার কাহিনি, আখ্যান, চরিত্র, চিত্রগুণ, সম্পাদনা ও সংগীত নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই আলোচনায় দ্বিমত থাকতে পারে অনেকেরই – আছে আমারও। বলতে দ্বিধা নেই, শিল্প নিয়ে আলোচনায় শিল্পগুণের অভাব বোধ না করে পারা যায় না।
প্রত্যাশা, আগামী দিনগুলোতে শিল্প ও শিল্পী বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের আলোচনায় নতুন মাত্রা সংযোজন করতে আরো যতœবান হবে।
শাহানা শারমীন
ধানমণ্ডি
ঢাকা