হা স না ত আ ব দু ল হা ই
রূপতত্ত্ব (ফর্মালিজম)
সাহিত্যের সমালোচনায় বস্ত্তগত ভিত্তির অনুসন্ধান রূপতত্ত্বের (ফর্মালিজম) জন্ম দেয়। বিংশ শতকের প্রথমদিকে রাশিয়ায় এর সূচনা। এর মাধ্যমে ক্লাসিকধর্মী সাহিত্যের যেমন রসোপলব্ধি সম্ভব হয় বলে ভাবা হয়েছে, একই সঙ্গে এর সাহায্যে সাহিত্যে আধুনিকতার ধারারও ব্যাখ্যা পাওয়া যায় বলে দাবি করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে এরই প্রতিধ্বনি বা ছায়া দেখতে পাওয়া যায় আমেরিকায় অনুসৃত ‘নিউ ক্রিটিসিজমে’ এবং ইউরোপে গঠনবাদ (স্ট্রাকচারালিজম) ও সেমিওটিকসের তত্ত্বে।
রূপতত্ত্ব সিনেমার সঙ্গে জড়িত হয় বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে সোভিয়েত রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার পর। ঝিগা ভার্টভ এবং সার্জেই আইজেনস্টাইন মতাদর্শের ক্ষেত্রে সিনেমার ভূমিকা নিয়ে যে মতামত ব্যক্ত করেন তার ভিত্তিতে সিনেমার নান্দনিকতা বেশ আগ্রহের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। শেষ পর্যন্ত এই আলোচনা রাজনৈতিক মতবাদের প্রভাবে আসে। এই সময় ভিক্টর পোকভস্কি এবং ইউরি টিনিইয়ালোভ সিনেমার চিত্রনাট্য লেখা এবং উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সোভিয়েত ইউনিয়নের নতুন সিনেমার তত্ত্বও তৈরি করেন। তখন পর্যন্ত রূপতত্ত্ব ছিল শিল্প-সাহিত্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার এবং এস্টাবলিশমেন্ট বিরোধিতার দৃষ্টান্ত। ১৯২০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে রাশিয়ার কর্তৃপক্ষ যখন ‘সমাজবাদী বাস্তবতা’কে সরকারি আদর্শ হিসেবে ঘোষণা করে, তারপর থেকে ‘রূপতত্ত্ব’ সমালোচনার মুখে পড়ে এবং সরকারিভাবে নিন্দিত হয়। এর ফলে রাশিয়ান ফর্মালিস্ট সমালোচকরা নিশ্চুপ হয়ে যান। ১৯৬০-এর দশকে যখন ইউরোপে সোভিয়েত রাশিয়ার প্রথম পর্বের ইতিহাসের প্রতি কৌতূহল ও আগ্রহ প্রকাশ করা হয় তারপর থেকেই বেশ কিছু প্রামাণিক ফর্মালিস্ট টেক্সট অনূদিত হয় এবং সাংস্কৃতিকভাবে প্রভাব বিস্তার করে। এই সময়েই রূপতত্ত্ব ও সিনেমার সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে আবার আলোচনা শুরু হয়। আভাঁ গার্দ সিনেমা নির্মাণে সোভিয়েত ফর্মালিস্ট মডেলের সাহায্য নেওয়া হয়। একই সঙ্গে সেমিওটিকসের ধারণা সিনেমার তত্ত্ব নির্মাণে নতুন ভিত্তি সৃষ্টি করে। বর্ণনার (ন্যারেটিভ) গঠন বিশ্লেষণে সিনেমাতাত্ত্বিকরা রূপতত্ত্বের বেশ কিছু ধারণা ব্যবহার করেন, যা ‘নিও-ফর্মালিজ’ অভিধায় পরিচিত হয়। সমালোচকরা এইসব ধারণার সাহায্যে মূল ধারার সিনেমা উপলব্ধির জন্য দর্শকদের সেই ধারার সিনেমার সঙ্গে দূরত্ব নির্ধারণ করে একটি বস্ত্তগত ভিত্তি প্রদান করেন।
ফর্মালিজমের সূত্রপাত হয় রাশিয়ায় ১৯১৭-এর বিপ্লবের আগে। এর ক্ষেত্র ছিল প্রথমদিকে কবিতা, যেখানে ভাষার ব্যবহারে অভ্যাসগত ধারণাকে তীক্ষ্ণ করা ছিল উদ্দেশ্য। ফর্মালিস্টদের কাছে বস্ত্তর বা সৃষ্ট ফর্মের চেয়ে শিল্পকে মনে করা হয়েছে একটি প্রক্রিয়া, যার দ্বারা উপলব্ধির গতিকে শ্লথ করা যায়। সুতরাং শিল্পের মূল্যায়নে ফর্ম এবং পদ্ধতিই গুরুত্বপূর্ণ। কথাসাহিত্যে প্রয়োগ করা হলে ফর্মালিজম ন্যারেটিভের ভেতর কাহিনি এবং প্লট বা ঘটনাপ্রবাহ, এই দুইয়ের ভেতর পার্থক্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কথাসাহিত্যের এই বৈশিষ্ট্য সিনেমাতেও প্রয়োগ করা হয়েছে। ফর্মালিস্টদের মতে, কবিতা ও গদ্যে যে ভাষা ব্যবহৃত হয়, একই ভাষা অন্য শিল্পেও প্রয়োগ করা যায়। তাঁদের কেউ কেউ মনে করেছেন যে, ঝিগা ভার্টভ তথ্যভিত্তিক ডকুমেন্টারির উপকরণ ব্যবহার করেছেন বলেই তথ্যভিত্তিক সিনেমা তৈরি করতে পেরেছেন, তা বলা যাবে না। তিনি উপন্যাসের ও নাটকের গঠন ব্যবহার না করার ফলে এমন হয়েছে বলে তাঁদের ধারণা। সমালোচকরা দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেছেন, ঝিগা ভার্টভের তথ্যচিত্রকে যদি বলা যায় কাব্যধর্মী, তাহলে চার্লি চ্যাপলিনের সিনেমা হলো ‘গদ্য’-ভিত্তিক, আর পুডোভকিন এই দুইয়ের মধ্যবর্তী একটি সংকর রূপের সৃষ্টি করেছেন। এই সংকর শ্রেণি সিনেমার আদিপর্বে যে কাব্যিক কৌশল ও গুণাবলি দেখা গিয়েছিল তার পূর্ণ ব্যবহার করেছে।
১৯২৭ সালে দি পোয়েটিকস অফ দি সিনেমা প্রবন্ধ সংকলনে বরিস আইকেনবসের লেখা গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ ‘দি প্রবলেম অফ ফিল্ম স্টাইলিসটিক্স’ ফিল্মের নন্দনতত্ত্বে প্রথম পর্বের উল্লেখযোগ্য অবদান বলে পরিগণিত। এই প্রবন্ধে তিনি সিনেমার দুটি মূল বৈশিষ্ট্যের আলোচনা করেন, যার সঙ্গে তুলনা করা যায় কথাসাহিত্যের কাহিনি ও প্লটের। ফটোগ্রাফি দ্বারা ইমেজ এবং ইমেজকে যুক্ত করার জন্য যে প্রক্রিয়া ‘মন্তাজ’ নামে পরিচিত তার ব্যবহার করে তিনি অলীক কিন্তু বিশ্বাসযোগ্যভাবে স্থান ও কালের নিরবচ্ছিন্নতা প্রদর্শন করেন। তাঁর মতে, এইভাবেই সিনেমার ভাষা নির্মিত হয়েছে (ফটোগ্রাফির ইমেজ বা বাক্য এবং সেসব মন্তাজের সাহায্যে যুক্ত করে সিনেমার বাক্যবন্ধ তৈরি)। ফিল্মে বাক্য কীভাবে গঠিত হয়? এ প্রশ্নের উত্তরে আইকেনবস বলেন যে, দর্শক নিজেরাই সংলাপের সাহায্যে বাক্যের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে ইমেজের পরম্পরায় যে বক্তব্য থাকে তাকে সম্পূর্ণতা দিয়ে পূর্ণভাবে ব্যক্ত করে। তিনি দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেন, আইজেনস্টাইনের অক্টোবর (১৯২৮) সিনেমায় লোকায়ত ধর্মের অন্তর্ভুক্ত ঈশ্বরের অনেকগুলি বিদঘুটে মূর্তি দেখানো হয়। এসবের উদ্দেশ্য রাশিয়ার সম্রাট কর্তৃক ঈশ্বরের সাহায্য নিয়ে যে ইমেজ তৈরি করা হয়েছে সে সব গৌণ বা অকার্যকর প্রমাণ করা। নির্বাক যুগের ছবিতে দর্শককে সংলাপ নিজেই তৈরি করে নিতে হয়, যার ফলে দৃশ্যকল্পের বক্তব্য স্পষ্টতর হয়, আইকেনবসের এই ধারণা ১৯৭৪-এর আগে খুব একটা মনোযোগ আকর্ষণ করেনি। দর্শকের এই ভূমিকা সবাক চলচ্চিত্রেও দূর হয় না, এটাও মনে করা যেতে পারে বলে পরবর্তী সময়ে উল্লেখ করা হয়েছে। মেৎজের সেমিওলজি ও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ যুক্ত করে সিনেমার নান্দনিক বিচারের অবতারণা করার পর সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতায় দর্শকের এই নিজস্ব চিন্তার (সংলাপের ক্ষেত্রে) ভূমিকা স্বীকৃতি পেয়েছে। এই চিন্তার প্রক্রিয়াকে মনে করা হয়েছে ফিল্ম টেক্সটের অবদান। তার নির্মাণে ব্যবহৃত উপকরণ অবচেতনে থেকে চিত্রনির্মাতা ও দর্শক, উভয়ের ওপরই প্রভাব বিস্তার করে।
সিনেমার নান্দনিক বিচারে ফর্মালিজমের ব্যবহার গঠনবাদেও দেখা যায়। লোককাহিনির চরিত্রদের বিশ্লেষণ ও ন্যারেটিভে তাদের ভূমিকা সনাক্ত করে ফর্মালিস্ট ধারার গবেষণা ১৯৬০-এর দশকে যেভাবে একটি নীতি বা সূত্রের সন্ধান পায়, ক্লদ লেভি স্ট্রস তাঁর অতিকথনের (মিথ) ধারণায় অনুরূপ সূত্রেরই ব্যবহার করেন। ফর্মালিজমকে তাই মনে করা হয়েছে গঠনবাদের ভিত্তি বা উৎস। কিন্তু সিনেমার বিচারে গঠনবাদ ব্যবহার করার সময় পিটার ওলেন বলেন যে, ফর্মালিস্টদের মতো সব টেক্সটই একটি নীতি বা সূত্রের রকমফের মনে করা সমীচীন নয়। টেক্সটকে (লোককথার চরিত্র ও ন্যারেটিভ বর্ণনা) ফর্মালিজমের একটিমাত্র সূত্র বা নীতির রকমফের মনে করা গেলেও একটি পদ্ধতির অন্তর্গত পার্থক্য ও বিরোধিতায় উপলব্ধির জন্য গঠনবাদের যে উদ্দেশ্য তার মধ্যে তিনি পার্থক্য টানেন। ওলেন এবং অন্যান্য গঠনবাদী ফিল্মতাত্ত্বিক বৃহৎ কোনো পদ্ধতি, যেখানে মোটিফের পৌনঃপুনিকতা রয়েছে অথবা বিরোধিতাও দেখা যায়, তার ভেতর ব্যতিক্রমী হলেও কোনো সিনেমা অন্তভুক্ত করতে পারা সাফল্যের পরিচায়ক মনে করেন। ফর্মালিস্টদের দৃষ্টিকোণ থেকে (সব একই নীতির রকমফের, এই ধারণা) এমন কিছু করা যায় না।
আধুনিককালে ফর্মালিজমের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও প্রভাবশালী ব্যবহার হয়েছে ডেভিড বোর্ডওয়েল এবং ক্রিস্টিন টমসন, এই দুইজনের চর্চায় ও গবেষণায়। ডেভিড বোর্ডওয়েল তাঁর লেখা ন্যারেশন ইন ফিকশন ফিল্ম (১৯৮৫) গ্রন্থে এবং টমসন ব্রেকিং দি গ্লাস আর্মার (১৯৮৮) প্রবন্ধ সংকলনে ফর্মালিজমের বিরুদ্ধে কেবলই ফর্মাল হওয়ার অভিযোগ খন্ডানোর যে চেষ্টা করেছেন তাকেই বলা হয়েছে নিও-ফর্মালিজম। তাঁরা দুজনেই থিওরিকে বিশদ টেক্সচুয়াল সমালোচনা অথবা সামাজিক ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা থেকে আলাদা করে নিয়ে বলেছেন যে, ফর্মালিজমের মূল পদ্ধতিগুলিই সিনেমার যথাযথ ঐতিহাসিক পোয়েটিকস নির্মাণে অবদান রাখতে পারে। তাঁরা মনে করেন, গঠনবাদ ও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ যা পারে না ফর্মালিজম একজন সক্রিয় দর্শককে কল্পনা করে এবং উপলব্ধি ও জ্ঞান লাভকে যুক্ত করার কনস্ট্রাকটিভিস্ট থিওরির প্রস্তাবনা করে। জ্ঞানার্জনভিত্তিক মনস্তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে বোর্ডওয়েল ব্যক্তিবিশেষের উপলব্ধি যে ওপর-নিচ স্তরের (হায়ারার্কি) পদ্ধতি অবলম্বনে সৃষ্টি হয়, সেটি সনাক্ত করেন। অনেক দৈনন্দিন জটিল কার্যক্রমের মতো একটি সিনেমার উপলব্ধিতেও ইতিমধ্যে জ্ঞাত বা অর্জিত আদর্শ বা টিপিকাল ওপর-নিচ পদ্ধতি ব্যবহার করতে হয়, যার ভিত্তিতে সিনেমার মূল প্লট, চরিত্র এবং ঘটনা সনাক্ত করা সম্ভব হয়। সিনেমার উপলব্ধির সঙ্গে এইভাবে বর্ণনা ও আঙ্গিকগত পদ্ধতির পর্যায়ে ওপর-নিচ (হায়ারার্কি) পদ্ধতি জানার সম্পর্ক স্থাপিত হয়। শিল্প, বিশেষ করে সিনেমা সম্পর্কিত এই পদ্ধতি ফর্মালিস্টরা বাস্তবতাভিত্তিক অথবা শৈল্পিক ধারণা বলতে যা বুঝেছেন তার সঙ্গে মিলে যায়। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে ফর্মালিজমের সম্প্রসারিত ও সুশৃঙ্খলিত রূপ সম্বন্ধে ওয়েল যেসব বিশদ উদাহরণ দিয়েছেন তার সাহায্যে দেখানো যায় কীভাবে রহস্য ও মেলোড্রামা বিশিষ্ট সিনেমাকে প্লটের বিভিন্ন শ্রেণি বা শৈলীগত বিন্যাসের ভিত্তিতে পৃথকীকরণ সম্ভব। এইভাবে বিভিন্ন সিনেমার দৃষ্টান্তের সাহায্যে ফর্মালিস্ট ধারার ঐতিহাসিক শ্রেণিবিভাগ করা যায়। যেমন ক্লাসিকাল হলিউড সিনেমাকে প্রচলিত রীতির তুলনায় আরো গতিশীলভাবে ব্যাখ্যা বা বর্ণনা করা যায়। এই বর্ণনায় কাহিনিকে বিভিন্নভাবে উপস্থাপনার সুযোগ এবং ঘটনা বা প্লটকে ইচ্ছেমতো সাজানোর সম্ভাবনার ওপর আলোকপাত করা যায়। অপরদিকে আর্ট সিনেমার ব্যাখ্যায় বা সংজ্ঞায় এমন এক পদ্ধতিগত কাঠামো ব্যবহৃত হতে পারে যার ভেতর বিভিন্ন ধরনের বর্ণনামূলক কৌশল অন্তর্ভুক্ত হয়।
টমসন এবং বোর্ডওয়েল, দুজনেই ‘প্যারামেট্রিক’ সিনেমা কথাটি ব্যবহার করে নব্য-ফর্মালিজম (নিও-ফর্মালিস্ট) সম্পর্কিত তাঁদের ব্যাখ্যাকে জটিল প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য ব্যবহার করেছেন। এই ধরনের সিনেমা বলতে তাঁরা বুঝিয়েছেন সুশৃঙ্খল ও বিন্যাসগত কাঠামোর ভেতর একটি শিল্পবোধকে প্রতিষ্ঠা করা। এইসব সিনেমায় আঙ্গিক বা শৈলী, প্লটের ওপর সর্ম্পূণভাবে কর্তৃত্ব করে এবং বর্ণনায় যা অবশিষ্ট থাকে সেটি নিরবচ্ছিন্ন ‘জুম’ চরিত্রের প্রদর্শনের অধীনস্থ হয়। এই শ্রেণিতে তারা রবার্ট ব্রেসঁ ও জাঁ লুক গদার সিনেমা অন্তর্ভুক্ত করেন।
রাশিয়ার বাইরে ফর্মালিজমের জনপ্রিয়তা ও প্রভাব অনুবাদও চলতি ফ্যাশনের ওপর নির্ভর করেছে, যা নিরবচ্ছিন্ন বা দীর্ঘকালীন ছিল না। যেমন ১৯৮০-র দশকের আগে প্রায় অজ্ঞাতে থাকা লেখক-তাত্ত্বিক বাখতিনের এবং তাঁর অনুসারীদের লেখা প্রথম অনূদিত হয়ে পাশ্চাত্যে আত্মপ্রকাশ করে। যদিও তাঁরা ১৯২০-এর দশকে ফর্মালিজমের বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখেছেন কিন্তু এর ইতিহাস-নিরপেক্ষতা ও গোঁড়ামির সমালোচনার জন্য তাঁদের লেখা ফর্মালিজম সম্বন্ধে ধারণা বিস্তৃতও করেছে। বাখতিনের সবচেয়ে প্রভাবশালী ধারণা ছিল ‘ডায়ালজিজম’, যার উৎস ছিল ডস্টয়ভস্কির উপন্যাসের ওপর তাঁর অনুশীলন ও মূল্যায়ন। এই ধারণায় একজন লেখকের প্রত্যক্ষ সংলাপ এবং তাঁর চরিত্রের সংলাপের মধ্যে পার্থক্য করা হয়, যার ভিত্তিতে দুই পক্ষের সম্পর্ককে একটি সংলাপের ভেতর ধারণ করা সম্ভব হয়। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বের এবং বিভিন্ন সংস্কৃতির উপন্যাস সম্বন্ধে বাখতিনের বিস্তৃত পরিসরে বিশ্লেষণ বহু স্বরের সমন্বয়ে একটি সাংগীতিক সৃষ্টির বিভিন্ন মাত্রার মতো অভিজ্ঞতা দান করে। এই সংলাপে যে জটিলতা ও প্রাচুর্য থাকে সেসবও প্রমাণিত হয়ে যায়। র্যাবেলেঁর রচনা বিশ্লেষণ করে বাখতিন ‘কার্নিভালিজম’ নামে একটি ধারণা তৈরি করেন, যার মাধ্যমে তিনি হাস্য-কৌতুকের জন্য যে লোকায়ত ঐতিহ্য, তার এবং কার্নিভালে যেমন দেখা যায়, সেই ধরনের প্যারোডি বা ব্যঙ্গাত্মক অনুকরণের টিকে থাকার বা স্থায়িত্বের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ফিল্মের আলোচনায় ও মূল্যায়নে ‘ডায়ালজিজম’ এবং ‘কার্নিভালিজম’, উভয়ই সাহিত্যের মতো সিনেমাতেও বহুল ব্যবহৃত। এছাড়াও বাখতিনের আরো দুটি ধারণা সিনেমার ক্ষেত্রে খুবই প্রাসঙ্গিক বলে মনে করা হয়েছে। দৈনন্দিন জীবনে এবং শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শ্রেণির মুখের ভাষার প্রসঙ্গে তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে এইসব ভাষা-শ্রেণি একটি শিল্পের শাখায় স্মৃতি হিসেবে কাজ করে এবং সেই শাখার সীমানা নির্ধারিত করে দেয়। এই ধারণার মতো বাখতিন ‘ক্রনোটাইপ’ নামক যে ধারণার উল্লেখ করেছেন সেটিও সিনেমার ক্ষেত্রে সরাসরি ব্যবহার করা যায় বলে মনে করেছেন অনেকে। বিভিন্ন ধরনের ন্যারেটিভে স্থান ও কালের যে বিশেষ পারস্পরিক সম্পর্ক, সেটি বোঝাবার জন্য এই ধারণাটি তিনি অঙ্কশাস্ত্র থেকে গ্রহণ করেন। উদাহরণস্বরূপ তিনি গ্রিক উপন্যাসে অ্যাডভেঞ্চার টাইম এবং রোমান্স টাইমের সনাক্ত করেছেন, যার ভিত্তিতে উপন্যাসের অন্তর্বর্তীকাল এবং সময় উল্লেখ করার বৈশিষ্ট্য বোঝানো যায়। একই ধরনের শ্রেণিবিভাগ সিনেমার প্রধান শাখার ভেতরও করা সম্ভব বলে মনে করা হয়।
বাখতিনের ধারণাগুলি সিনেমার আলোচনায় ব্যবহারের প্রাসঙ্গিকতা ও উপযোগিতা থাকা সত্ত্বেও রাশিয়ার বাইরে খুব কম ফিল্ম সমালোচকই তাঁর প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। ব্যতিক্রম হলো রবার্ট স্ট্যাম (সাবভার্সিব প্লেজারস, ১৯৮৯), যিনি বাখতিনীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যে কার্নিভাল বা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও সমালোচনার যে ঐতিহ্য (রিফ্লেকসিভ) তার সমীক্ষা করেছেন এবং পল উইলমেনের (রিফ্লেকশন অন কনসেপ্ট অফ ইনার স্পিড ইন দি সিনেমা, ১৯৭৪-১৯৭৫) যেখানে সামষ্টিক স্মৃতির অংশ হিসেবে বাখতিনের সংলাপ বিষয়ে ‘অপর বৈশিষ্ট্য’ (আদারনেস) এবং শিল্পের শাখা সম্বন্ধে ধারণাসমূহের ব্যবহার হয়েছে। থার্ড সিনেমার আলোচনায় তিনি এইসব ধারণার উল্লেখ ও ব্যাখ্যা করেন। রাশিয়ার মায়া তুরোভস্কা বাখতিনের ‘ক্রনোটাইপ’ ধারণা ব্যবহার করে ‘আলোকিত সময়’ বা ‘মুদ্রিত সময়’ এই ধারণার দ্বারা অাঁদ্রেই তারকোভস্কির সিনেমা সংক্রান্ত ধারণার ব্যাখ্যা দিয়েছেন (সিনেমা অ্যাজ পোয়েট্রি : তারকোভস্কি ১৯৮৯)। সাংস্কৃতিক জগতে সংকেত পদ্ধতি নিয়ে যুরি লোটম্যান ও তাঁর সঙ্গীরা যে আলোচনা করেছেন, সেখানে বাখতিনীয় প্রভাব রয়েছে। তাঁর এক সহকর্মী ও অনুসারী যুরি সিভিয়ানের সংজ্ঞায় সাংস্কৃতিক সংকেত পদ্ধতি হলো নর-নারীর দ্বারা প্রক্রিয়াজাত কৃত টেক্সটের অনুশীলন। এখানে ত্রুটিপূর্ণ প্রকাশ যেমন গুরুত্ব পায়, একইভাবে নিরবচ্ছিন্ন সফল যোগাযোগমাধ্যমও আলোচনার বিষয় হয়। প্রথমদিকে রাশিয়ায় তৈরি সিনেমা দর্শকরা যেভাবে গ্রহণ করে সে সম্বন্ধে সিভিয়ানের পথিকৃৎ সুলভ বিশ্লেষণে সিনেমার গঠন (আর্কিটেকচার) ও প্রক্ষেপণের পদ্ধতি থেকে শুরু করে প্রচলিত সাংস্কৃতিক ধ্যান-ধারণা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে সিনেমার সামাজিক স্বীকৃতি, সবই স্থান পেয়েছে। তিনি খুব জোর দিয়ে এবং অপ্রচলিতভাবে বক্তব্য রাখেন যে, সিনেমার টেক্সটের যে সীমানা তা স্বভাবতই অস্থির ও পরিবর্তনশীল, কেননা ফিল্মের বাইরের অনেক উপাদান খোদ সিনেমার তুলনায় দর্শকদের কাছে সাংস্কৃতিকভাবে বেশি প্রভাবশালী ও তাৎপর্যময় মনে হতে পারে। দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে তিনি সাংবাদিকতা, সাহিত্য ও আত্মজীবনীর সাহায্য নিয়েছেন, যা থেকে বোঝা যায় ১৯২০-এর দশকেই সিনেমার ফর্ম, কৌশল ও আঙ্গিক কতবিস্তৃত পরিধিতে সম্প্রসারিত হয়েছিল। এই সাংস্কৃতিক আবহই ফর্মালিজমের সূচনা করেছিল। সমসাময়িক অন্যান্য সাংস্কৃতিক পদ্ধতি তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও নব্য-ফর্মালিস্টদের অনুশীলনের ভিত্তিতে এটা স্পষ্ট যে ফর্মালিজমের অনুপ্রেরণা ও আদর্শ সিনেমাসহ শিল্প-সাহিত্যের অন্যান্য ক্ষেত্রে বহুমুখী বিশ্লেষণ পদ্ধতির উপায় হিসেবে এখনো সক্রিয়। (‘আর্লি সিনেমা ইন রাশিয়া অ্যান্ড ইটস কালচারাল রিসেপশন’, ১৯৯৪)।
প্রথম পর্বের ফিল্মতত্ত্ব : একটি সমীক্ষা
১৯৫০ সাল পর্যন্ত এমন ফিল্ম সমালোচকের অভাব ছিল না, যাঁরা মনে করেছেন যে ফিল্ম যেহেতু যান্ত্রিকভাবে যন্ত্রের সাহায্যে
বাস্তবকে পুনঃসৃষ্টি করে সেই জন্য একে আর্ট বলা যায় না। তাঁদের মতে বাস্তবের যখন পুনঃসৃষ্টি হয় সেখানে শিল্পের বৈশিষ্ট্য থাকে না। এই ধরনের বক্তব্যের পটভূমিতেই ফিল্ম সম্বন্ধে প্রথমদিকের তত্ত্ব গড়ে উঠেছে। ইংরেজিতে প্রথম ফিল্ম থিওরি লেখেন রাসেল লিল্ডসে তাঁর দি আর্ট অফ দি মুভিং পিকচারে (১৯১৫)। এই বইতে লিন্ডসে জোর দিয়ে বলেন যে, সিনেমা উঁচুদরের শিল্প। তাঁর বক্তব্যের লক্ষ্য ছিল আমেরিকার প্রধান আর্ট মিউজিয়ম, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের বিভাগ, নাটকের ইতিহাস ও চর্চা শিক্ষার প্রতিষ্ঠান, শিল্পের ইতিহাস ও চর্চার বিষয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ও প্রতিষ্ঠানে এবং শিল্প সমালোচনার সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের সিনেমার শিল্পগুণ সম্বন্ধে উপলব্ধি সৃষ্টি এবং অবহিত করা। এককথায় সিনেমার শিল্প পরিচিতি প্রতিষ্ঠা করাই ছিল প্রথমদিকের সব ফিল্ম থিওরির উদ্দেশ্য।
১৯১৪ সালে যখন ডি ডাব্লু গ্রিফিথের দি বার্থ অফ এ নেশন প্রদর্শিত হয়, সেই সময় বিনোদনের বিষয় হিসেবেই একে বিবেচনা করা হয়, শিল্প হিসেবে নয়। ১৯৩০ সালে লেখা দি ফিল্ম টিল নাউ বইতে পল রোথা সিনেমার বিনোদনমূলক ভূমিকার ওপর দৃষ্টি আকর্ষণ করে মন্তব্য করেন যে, যারা গভীরে গিয়ে চিন্তা করতে চায় তাদের জন্য সিনেমার প্রকাশক্ষমতা আকর্ষণীয় মনে হবে। বার্থ অফ এ নেশন সিনেমা তৈরির বিশ বছর পরও এর শিল্পগুণ গুরুত্ব পায়নি এবং এটি কেবল মুষ্টিমেয় চিন্তাশীল ব্যক্তির বিবেচনার বিষয় হতে পারে বলে মনে করা হয়েছে। ক্রমে ক্রমে এই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে এবং শিল্প হিসেবে সিনেমা স্বীকৃতি লাভের পথে অগ্রসর হয়েছে। এর জন্য ফিল্মতাত্ত্বিকদের প্রচেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে এবং একটু বেশি মাত্রাতেই, সিনেমানির্মাতাদের ভালো সিনেমা তৈরির সফলতা কৃতিত্ব দাবি করে। পঞ্চাশের দশকের শেষে ইঙ্গমার বার্গম্যান দি সেভেন সিল, এলেঁ রেনের হিরোশিমা মঁ আমুর এবং মাইকেল এঞ্জেলো এন্টোনিয়নির লা ভেঞ্চুরা চিত্রকলা, সংগীত ও সাহিত্যের মতোই সাংস্কৃতিক জগতে আলোচনার বিষয় হয়েছে। তখনো অবশ্য সিনেমা বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠিত বিষয় হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। কিন্তু ধীরে হলেও সংবাদমাধ্যমে, সেমিনারে এবং আর্কাইভ প্রতিষ্ঠার ফলে দর্শকদের আগ্রহ সৃষ্টি এবং সিনেমার শিল্পগুণ সম্বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির পথ উন্মুক্ত হয়ে যায়।
শিল্প হিসেবে সিনেমার গ্রহণযোগ্যতা ও স্বীকৃতি আদায়ের জন্য প্রথমদিকের এই ফিল্ম থিওরির ভূমিকাই ছিল প্রধান। সেই জন্য ব্যক্তিবিশেষের তৈরি সিনেমার তুলনায় বিপক্ষ শক্তির আক্রমণ ও সমালোচনা, এর বিরুদ্ধেই লেখা হয়েছে বেশি। এই পরিস্থিতিতে ফিল্ম থিওরি খুব স্বতঃস্ফূর্ত ও সামঞ্জস্যময়ভাবে বিবর্তিত হতে পারেনি। কখনো একে হতে হয়েছে নির্জলা গোঁড়ামির প্রকাশ, কখনো এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এমন সব নিয়মনীতি বা নির্দেশনা, যার ভেতর পরস্পর বিরোধিতা দেখা গিয়েছে এবং যা সিনেমার মূল্যায়নে অপ্রাসঙ্গিকও মনে হয়েছে।
ভি এফ পার্কিন্সের মতে, প্রথম পর্বে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য যে ফিল্ম থিওরি তৈরি হয়েছে তাকে অতিকথন (মিথ) বলা না গেলেও ফসিল বা অতীতের স্বাক্ষর বলা ছাড়া উপায় নেই। আদিপর্বের সিনেমার প্রসঙ্গেই এইসব তত্ত্বের প্রয়োগ যুক্তিযুক্ত। কিন্তু ফিল্ম থিওরির সামগ্রিক ভান্ডারে এইসব ধারণাও স্থান পেয়েছে এবং অন্ধ বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে (ডগ্মা)। ফিল্ম এপ্রিসিয়েশনের কোর্সে একটু রদবদল করে এদের পুনরাবৃত্তি করা হচ্ছে। একে বলা যায় প্রচলিত বা গোঁড়া ফিল্মতত্ত্ব। অন্ধ বিশ্বাসের ভিত্তিতে যে ফিল্মতত্ত্ব বা সমালোচনা, সেসব সিনেমার উপলব্ধিতে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হওয়ার জন্য বিঘ্ন ঘটায়। যেসব বিরুদ্ধ শক্তির মোকাবিলায় আদিপর্বের ফিল্মতত্ত্ব তৈরি হয়েছিল এবং যার অবশিষ্টাংশ তখন বিদ্যমান ও কার্যকর ছিল সেই পরিবেশ বিশ্লেষণ করা হলেই বর্তমানে ফিল্মতত্ত্বে সেসব মাত্রা গুরুত্বপূর্ণ বলে উপলব্ধি সম্ভব হবে।
আদিপর্বে ফিল্ম থিওরি নিয়ে যাঁরা চিন্তাভাবনা করেছেন এবং লিখেছেন তাঁরা সিনেমার ভূমিকা (স্ট্যাটাস) নিয়েই এত মগ্ন ছিলেন যে সিনেমার চরিত্র এবং সম্ভাবনা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তার অবকাশ পাননি। সমসাময়িক সাংস্কৃতিক পরিধিতে সংস্কৃতিবান ব্যক্তির কাছে সিনেমার আবেদন রাখতে পারাটাই তাঁদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। যেমন, লিন্ডসে ফিল্মতত্ত্ব সম্বন্ধে বলতে গিয়ে সাধারণভাবে শিল্পের জন্য প্রচলিত বিশ্বাস ও
ধ্যান-ধারণাকেই মানদন্ড বা পরিপ্রেক্ষিত হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এর ফলে যাঁরা এইসব মানদন্ডের সঙ্গে পরিচিত ও তাদের ব্যবহারে অভ্যস্ত তাঁদের কাছে সিনেমার গ্রহণযোগ্যতা সহজ হবে বলে তিনি মনে করেছেন। রুডোলফ আর্নহাইমও তাঁর ফিল্ম অ্যাজ আর্ট বইতে (১৯৩৩) বলেছেন যে, সিনেমা অন্যান্য শিল্পের মতো নিয়মকানুন ও সূত্র অনুসরণ করে, সুতরাং একে শিল্প হিসেবেই দেখা উচিত। তাঁরা দুজনেই সিনেমার সংজ্ঞা এইভাবে দিয়েছেন যেন তার সঙ্গে শিল্পের সাধারণ সংজ্ঞার মিল থাকে।
পার্কিন্সের মতে, এই প্রচেষ্টা সিনেমার ভালোর চেয়ে মন্দই করেছে বেশি। এই ধরনের প্রচেষ্টার পেছনে যে দুটি ধারণা বা বিশ্বাস কাজ করেছে তার জন্যই সিনেমার লাভ না হয়ে বরং ক্ষতি হয়েছে। প্রথম বিশ্বাসটি ছিল এই যে, শিল্পের বিস্তৃত পরিসর থেকে (নাটক, সংগীত, উপন্যাস, চিত্রকলা ইত্যাদি) শিল্পের বিশেষ কোনো ক্ষেত্রের জন্য মানদন্ড তৈরি করা সম্ভব অর্থাৎ সিনেমা অন্যান্য শিল্পের মতোই একইভাবে মূল্যায়িত হতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বাস ছিল এই যে, শিল্পের তত্ত্ব সম্বন্ধে কোনো অস্পষ্টতা বা সংশয়ের অবকাশ নেই, কেননা এর সংজ্ঞায় বেশ স্পষ্টতা ও সামঞ্জস্যময়তা এসে গিয়েছে, যার ভিত্তিতে সাধারণভাবে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে। সিনেমার জন্য অন্যান্য শিল্পের মতোই সংজ্ঞা তৈরি করছেন, এই ধারণা দিয়ে ফিল্মতাত্ত্বিকরা সমালোচকদের বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন, কেননা তাঁদের উন্নাসিকতায় সিনেমা তখনো শিল্প হিসেবে অপাঙ্ক্তেয়। সিনেমা যখন বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তির এক উদ্ভাবন থেকে জনপ্রিয় বিনোদনমাধ্যমে রূপান্তরিত হয়, সেই সময়ে সাধারণ শিল্প সম্বন্ধে চিন্তার ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন দেখা দেয় তার জন্যও সিনেমা শিল্প হিসেবে পরিগণিত হতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। যখন সেজানেরপোস্ট-ইমপ্রেশনিস্ট ছবির প্রদর্শনী হয় তখন সাধারণ দর্শকরা তাঁকে ভন্ডুলকারী এক শিল্পী এবং পোস্ট-ইমপ্রেশনিজম আন্দোলনকে খ্যাপামিপূর্ণ বলে মনে করেছিল। ১৯১২ সালে রজার ফ্রাই এই প্রতিক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন যে, শিল্পকর্মে বাস্তবের মায়া সৃষ্টি দেখতে চায় দর্শক। শিল্প যে প্রাকৃতিক বস্ত্তর বা রূপের (ফর্ম) বর্ণনামূলক অনুকরণ এই প্রচলিত বিশ্বাসের ভিত্তিতে দর্শকদের পক্ষে সিনেমার বাস্তবতা গ্রহণ করা কঠিন হয়েছিল। (ভিশন অ্যান্ড ডিজাইন; ১৯৮৭)। ১৯২০-এর মাঝামাঝি সময়ে এই প্রচলিত ধারণা বদলাতে শুরু করে যখন মনে করা হয় যে, বাস্তবের বর্ণনামূলক অনুকরণ কেবল প্রয়োজনহীন নয়, বেশ সন্দেহভাজনও। সংস্কৃতিবান জনসাধারণ এই সময়ে সম্পূর্ণ উল্টোভাবে ভাবতে অনুপ্রাণিত হয় এবং ক্লাইভ বেলের মতো বিশ্বাস করে যে, প্রতিনিধিত্বমূলক কোনো ফর্মে যদি তাৎপর্য থাকে তাহলে সেটি রূপ (ফর্ম) হিসেবেই, প্রতিনিধিত্বময়তার জন্য নয়। বেল বেশ জোরের সঙ্গেই বলেন যে, শিল্পকর্ম প্রতিনিধিত্বমূলক হলে শুধু অপ্রাসঙ্গিক নয়, ক্ষতিকরও হতে পারে (আর্ট, ১৯২৪)। ফটোগ্রাফির উদ্ভাবনের ফলে চিত্রশিল্পীদের যে আর বর্ণনামূলক অনুকরণের দায় থাকল না এবং তারা বিশুদ্ধ শিল্পের চর্চা করার সুযোগ পেয়ে গেল, বেলের এই মতও সাধারণভাবে স্বীকৃতি পেল। অর্থাৎ শিল্পীরা এখন থেকে তাদের বিষয় ও মাধ্যমের যে বিশেষ বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ রূপের (ফর্মের) উপস্থাপন, তার প্রতি মনোযোগ দিতে সক্ষম হলো।
ক্যামেরা, সিনেমা ও চিত্রশিল্পের মধ্যে যে জটিল সম্পর্ক সে সম্বন্ধে বিশদভাবে লিখেছেন আরন সার্ফ (আর্ট অ্যান্ড ফটোগ্রাফি, ১৯৬৮)। এই সম্পর্কে একধরনের পরিহাস দেখেছেন কেউ কেউ। ফটোগ্রাফি এবং তারপরই সিনেমার উদ্ভাবনের পর চিত্রশিল্পে যে প্রভাব পড়ে, তার ভিত্তিতে এমন দৃষ্টিভঙ্গি ও ধারণা সৃষ্টি হয়, যা ফিল্ম থিওরি কেবল নিজের বিষয়কে অস্বাভাবিকভাবে দেখিয়েই গ্রহণ করতে পারত অর্থাৎ বাস্তবতার অনুকরণ বিষয়ে প্রচলিত ধারণার বিপরীতে স্থান নিয়ে। ফিল্মের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে তার অন্যান্য বৈশিষ্ট্য ও উপকরণের প্রতি ফিল্মতাত্ত্বিকদের দৃষ্টি দিতে হয়েছে কিন্তু সেই সময়ে সৃষ্টি ও পুনঃসৃষ্টির মধ্যে যে বিভাজন দেখা দিয়েছিল তার ভিত্তিতে ক্যামেরা যে বাস্তবকে হুবহু ধারণ করে উপস্থাপন করে, সেই বিষয়টির প্রতি বেশি জোর দেওয়া যায়নি। ফিল্মতাত্ত্বিকদের তখন পুনঃসৃষ্টিতে ক্যামেরার যে অতিপ্রাকৃতিক বৈজ্ঞানিক ক্ষমতা, সেই বিষয়টিকে এড়িয়ে যেতে হয়েছে। অর্থাৎ ক্যামেরার অনন্য দক্ষতাই তার শিল্পকর্মের স্বীকৃতির পরিপন্থী হয়ে গিয়েছে। শিল্পবোদ্ধা আর সমালোচকরা তখন সিনেমার আদিপর্বে বাস্তবের বর্ণনামূলক অনুকরণের প্রতি আর আগের মতো আকর্ষিত হয়নি।
ক্যামেরার এই দক্ষতার ফলে ফিল্মতাত্ত্বিকদের এমনভাবে সিনেমাকে ব্যাখ্যা করতে হয়েছে যেখানে পুনঃসৃষ্টি বা অনুকরণ নয়, সিনেমা ‘সৃষ্টি’ করে, এটা দেখানো সম্ভব হয়। এই প্রচেষ্টায় এমন সব ফিল্ম তাত্ত্বিক/লেখক একসঙ্গে মিলিত হয়েছেন যাঁদের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির বেশ পার্থক্য ছিল। বেলা বালাজ তাঁর থিওরি অফ ফিল্মে (১৯৫২) সিনেমাকে শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যে প্রয়াস পান তার সঙ্গে অন্যরাও সিনেমা যে পুনঃসৃষ্টি করে না, সৃষ্টি করে, যার ফলে এটি স্বাধীন ও মৌলিকভাবে নতুন শিল্প হয়ে গিয়েছে, এই সত্য প্রমাণ করতে সচেষ্ট হন। এঁরা সবাই সোভিয়েত চিত্রনির্মাতা পুডোভকিনের মতো একই উপসংহারে পৌঁছে বলেন : ‘বাস্তবে যা ঘটে এবং সিনেমার পর্দায় যা দেখা যায়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থক্যের জন্যই সিনেমা একটি শিল্প। (পুডোভকিন : ফিল্ম টেকনিক অ্যান্ড ফিল্ম অ্যাকটিং, ১৯৫৮)।
সিনেমার সৃষ্টিশীল সারবত্তা হিসেবে বাস্তব থেকে পৃথক হওয়ার এই বৈশিষ্ট্য একটি মানদন্ডে পরিণত হয়। যেহেতু যেখানে যান্ত্রিক পুনঃসৃষ্টি শেষ হয় শিল্পের সেখানে শুরু, সেই জন্য ফিল্মতাত্ত্বিকরা বেশ গোঁড়ামির সঙ্গে বলেন যে, এই পার্থক্য যত বেশি, শিল্পের গুণের পরিমাণও সেই অনুযায়ী বৃদ্ধি পায়। রুডোলফ আর্নহাইম তাই বলেন : ‘ক্যামেরার মাধ্যমে সিনেমা কী ভূমিকা রাখে তা স্পষ্ট হতে হবে। দর্শক পুনঃসৃষ্টিকৃত কিছু দেখছে এমন মনে হলেই চলবে না। পুনঃসৃষ্টির মাধ্যমে যে বিষয় দেখানো হচ্ছে এবং মাধ্যমটির (ক্যামেরার কাজ) মধ্যে যে পারস্পরিক সম্পর্ক, সেটিও স্পষ্ট হতে হবে। এই মাধ্যম যত খেয়ালখুশিমাফিক কাজ করবে শিল্প হিসেবে সিনেমারও উৎকর্ষ বৃদ্ধি পাবে। সব শিল্প সম্বন্ধেই একই কথা বলা যায়। মার্শাল ম্যাকলুহান অনেক পরে টেলিভিশন সম্বন্ধে বলেছিলেন, ‘মিডিয়াম ইজ দি মেসেজ’, ১৯২৫ সালে আর্নহাইম যেন সেই কথাই বললেন সিনেমার প্রসঙ্গে।
একইভাবে লিন্ডসে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে তাঁরাই শ্রেষ্ঠ সিনেমা নির্মাতা হবেন, যাঁদের সিনেমায় ক্যামেরার কাজে থাকবে অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট্য। এই অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট্য বলতে তিনি বুঝেছেন পর্দায় প্রক্ষেপিত সেলুলয়েড স্ট্রিপের অন্তর্গত গুণ, যা বাস্তবের অনুকরণের ঊর্ধ্বে উঠে ক্যামেরা উপহার দেয়। এইভাবে শিল্পসম্পন্ন সিনেমায় গতির বিন্যাস (প্যাটার্ন ইন মোশন) দেখা যায়, যে প্যাটার্ন স্থান ও বস্ত্তর এমনভাবে প্রতিনিধিত্ব করে যার সঙ্গে বাস্তবে সেইসবের (স্থান ও বস্ত্ত) প্রত্যক্ষ ও তাৎক্ষণিক সম্পর্ক থাকে না। বাস্তবভিত্তিক হয়েও ক্যামেরার মাধ্যমে সিনেমা বাস্তবের অতিরিক্ত এক গতিশীল বিন্যাস (প্যাটার্ন ইন মোশন) সৃষ্টি করে। এই প্যাটার্নের তাৎপর্য এবং গুরুত্ব স্থান ও বস্ত্ত সম্বন্ধে ইঙ্গিত দেওয়ার ক্ষমতার জন্য। এই ইঙ্গিত সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্ককে বড় করে দেখায় না।
সিনেমা সম্বন্ধে ওপরে বর্ণিত তত্ত্ব সবচেয়ে বেশি প্রচারিত হয় ফ্রান্সে। প্রথম মহাযুদ্ধের আগে ফরাসি পরিচালক অ্যাবেল গ্যান্স সিনেমাকে অভিহিত করেন ‘আলোকের সংগীত’ বলে। তাঁর জার্মান সহকর্মী ওয়াল্টার রুটম্যান পরে বলেছিলেন, আলোর সংগীত হিসেবে সিনেমার এই পরিচিতিই সিনেমার মূল নির্যাস এবং ভবিষ্যতেও তাই থাকবে (হেনরি এগেল, এসথেটিক অফ সিনেমা, প্যারিস, ১৯৫৯)। ১৯২০-এর শেষের দিকে একদল ফরাসি চিত্রনির্মাতার অন্যতম সদস্য জার্মেই ডুলাক বিশুদ্ধ সিনেমার ধারণার ভিত্তিতে এবেল গ্যান্সের আলোর সংগীত অভিধা ব্যবহার করে বলেন যে, সিনেমা এবং সংগীতের মধ্যে এই স্থানে মিল রয়েছে যে, উভয় ক্ষেত্রে ছন্দ এবং গতির মাধ্যমে নড়াচড়াই (মুভমেন্ট) আবেগের সৃষ্টি করতে পারে। ডুলাক এরপর মন্তব্য করেছেন : ‘বিশুদ্ধ সংগীত আর সিমফনি থাকলে সিনেমার নিজস্ব সিমফনি থাকবে না কেন? (সিগফ্রিড ক্রাকারের থিওরি অফ ফিল্ম, ১৯৬৫ বইতে উদ্ধৃত)। তিনি যা বলতে চেয়েছেন তার সারমর্ম হলো এই যে, একটি রূপের (ফর্ম) বিন্যাস তার অংশগুলির মধ্যে একটিকে পৃথক করার মাধ্যমেই দেখা যায়। এই নির্যাসের (এসেন্স) বাইরে অন্য যেসব বৈশিষ্ট্য সেসব দ্বারা রূপ (ফর্ম) বিঘ্নিত বা অপসারিত হতে পারে। কিন্তু সংগীতে কেবল মুভমেন্টকে উপলব্ধি করা হয় না। এই মুভমেন্টের সঙ্গে জড়িত থাকে তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য যেমন, ভল্যুম, স্বরের উচ্চতা এবং অবয়ব (টিম্বর)। নির্যাসকে কার্যত বিশুদ্ধ পর্যায়ে দেখা বা উপলব্ধি করা যায় না। তার অন্তর্গত অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের সাহায্যেই প্রতিভাত হয়।
যেহেতু বৈশিষ্ট্যগুলি পৃথক করে দেখার প্রবণতা তাদের মধ্যে যোগসূত্র হিসেবে কাজ করেছে, সেজন্য বিশুদ্ধবাদী তাত্ত্বিকদের সিনেমা সম্বন্ধে ধারণা সনাতনপন্থী তাত্ত্বিকদের কাছে আবেদন রাখতে পেরেছে। আর্নহাইম এবং রোথা দুজনেই মনে করেছেন যে, বিশুদ্ধ সিনেমা হলো ফিল্মের শিল্পের শিখরস্পর্শী রূপ। আর্নহাইম এমন ভবিষ্যদ্বাণীও করেছেন যে, সিনেমা অন্যান্য শিল্পের একই পর্যায়ে পেঁŠছাতে পারবে যখন তা ফটোগ্রাফির পুনরুৎপাদন বা পুনঃসৃষ্টির প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারবে এবং মানুষের সৃষ্ট বিশুদ্ধ শিল্পকর্ম হবে। উদাহরণ দিয়েছেন তিনি সবাক কার্টুন এবং চিত্রকলার। ডিজনির তৈরি কাহিনিভিত্তিক কার্টুন এবং এম এফ হুসেনের গজগামিনী বা মীনাক্ষী সিনেমার দৃষ্টান্ত আর্নহাইমের বক্তব্যের সমর্থন করে। রোথা সিনেমাকে বর্ণনা করেন চলন্ত রূপের (ফর্ম) সাহায্যে আলোকের উদ্ভাসন বলে এবং ফর্মের ওপর-নিচ বিন্যাসকরণ হিসেবে, যেখানে মৌলিক (অ্যাবসলুট) সিনেমার বিমূর্ততা সিনেমার বিশুদ্ধ রূপের নিকটবর্তী। এর ভিত্তিতে অন্যান্য প্রকৃতির সিনেমা সনাক্ত করা যাবে, যে প্রক্রিয়ায় এপিক ও আর্ট ফিল্ম থেকে শুরু করে নিচের দিকে যাত্রা করে (ওপর-নিচের বিন্যাসে) সাধারণ বর্ণনাধর্মী সিনেমা এবং মিউজিকাল সিনেমার নান্দনিক বিচার সম্ভব হবে। (দি ফিল্ম টিল নাউ, ১৯৪১)।
ফর্ম সম্বন্ধে রোথা যে ওপর-নিচ বিন্যাসের (হায়ারর্কি) চিন্তা করেছেন সেটি খারিজ করা হলেও তাঁর এবং আর্নহাইমের ধারণার সপক্ষে এটুকু বলতেই হয় যে, বিশুদ্ধতার প্রতি তাদের কমিটমেন্ট প্রচলিত তত্ত্বের ভেতর সিনেমাকে স্বীকৃত মাধ্যম হিসেবে দেখার যে প্রবণতা বা প্রচেষ্টা, তারই যুক্তিসংগত সম্প্রসারণ হিসেবে দেখা যায়। ছবির নির্বাক যুগে এই প্রচেষ্টা দৃশ্য শিল্পের (ভিস্যুয়াল আর্টস) ভিত্তিতে নির্মিত মডেল উপস্থাপন করেছে। সিনেমার সচল বিন্যাস প্রমাণ করেছে যে, সিনেমা বিদ্যমান ভিস্যুয়াল আর্টসের ফর্মকে অনন্যসাধারণভাবে সম্প্রসারিত করতে সক্ষম এবং এর জন্য তাকে বাস্তবের পুনরুৎপাদন বা সৃষ্টির প্রয়োজন হয় না অথবা অন্যান্য শিল্প মাধামের নিকৃষ্ট অনুলিপি তৈরিও করতে হয় না। যদি সিনেমাকে এইভাবে দেখা না হয় তাহলে শিল্প হিসেবে সিনেমার প্রতি দ্বিধাদ্বন্দ্ব প্রকাশের ফাঁক থেকে যাবে। এই প্রসঙ্গে বালাজেরমন্তব্য স্মর্তব্য : ‘ছবি হবার আগে প্রথমেই সিনেমাকে বাস্তবানুগ হওয়ার ওপর চাপ ছিল। পর্দায় দেখা ছবিকে তাই ফটোগ্রাফির পুনরুৎপাদন হতে হয়েছে। কিংবা মঞ্চে অভিনয়ের অনুকরণ করতে হয়েছে।’ কিন্তু সমস্যা দাঁড়ায় এইখানে যে, সিনেমাকে যদি ভিস্যুয়াল আর্টসের মতো কল্পনার সহযোগে তৈরি কিছু হিসেবে না দেখানো যায়, তাহলে একে নাটকের বিকৃত রূপ ছাড়া অন্য কিছু মনে হবে না। একে বলতে হবে পূর্বনির্মিত আধারের ভেতর রাখা থিয়েটার, যেখানে নাটকের সংলাপের জোরালো ভঙ্গি বা ভূমিকা নেই। এই সমালোচনার মোকাবিলায় আর্নহাইম এবং অন্য তাত্ত্বিকরা মঞ্চে যা দেখানো সম্ভব তারই হুবহু অনুকরণ প্রত্যাখ্যান করলেন। তাঁদের ভাষায় ‘নাটকীয়’ বা ‘থিয়েট্রিকাল’ শব্দটি বিদ্রূপাত্মকভাবেই ব্যবহৃত হলো। এমন হলে যে সিনেমায় প্রদর্শিত দৃশ্যে নতুন কিছুই যুক্ত বা পরিবেশিত হয় না, এর ওপর গুরুত্ব দিলেন তাঁরা।
কিন্তু বিশুদ্ধবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গি ও ধারণা প্রচলিত তত্ত্বের মূল ধারায় গৃহীত হয়নি। রোথা এবং আর্নহাইমের মতো বিশুদ্ধবাদের ভিত্তিতে বিমূর্ত সিনেমার (কল্পনার সংমিশ্রণে তৈরি) শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করলেও তাদের সেই অবস্থান ছিল প্রান্তিক, এমনকি নস্টালজিয়া দ্বারা আক্রান্ত। এই ধারণা ও দৃষ্টিকোণ থেকেও তাঁরা স্বীকার করতে প্রস্ত্তত ছিলেন যে, যা সিনেমার পর্দায় দেখানো হয় তার উৎস ও ভিত্তি ইতিপূর্বে বিদ্যমান বাস্তবতা। চারুশিল্প (ভিস্যুয়াল আর্টস), যা ছিল তাদের মডেল, যেমন বলেছে সেই অনুযায়ী তাদেরও বক্তব্য ছিল প্রাকৃতিক দৃশ্য বা মানুষের দেহের দৃশ্যের কোনো শৈল্পিক প্রাসঙ্গিকতা নেই। বরং কীভাবে তাদের উপস্থাপন করা হলো, সেটিই গুরুত্বপূর্ণ। এই উপস্থাপনা রঙে এবং প্রস্তরখন্ডে যেমন হওয়া উচিত, সিনেমাতেও তাই হতে হবে। এইভাবে দেখার ও চিন্তার ফলে বিশুদ্ধবাদীরা ক্যামেরার সামনের বস্ত্তকে (মানুষসহ) দেখলেন কেবল বাস্তবতার রূপ হিসেবে। সুতরাং তাঁদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সিনেমাটোগ্রাফি কীভাবে এই বাস্তবতার রূপে তার নিজস্ব ভাষা বা বিন্যাস আরোপ করতে পারে, সেই বিষয়টি।
আর্নহাইম যখন কোনো ফিল্মের অংশকে সিনেমাটোগ্রাফিক বলে বর্ণনা করেন, তখন একটি ইফেক্ট সৃষ্টির জন্য সিনেমার আঙ্গিকের একটি বিশেষ গুণ বা বৈশিষ্ট্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। স্পষ্টতই সিনেমার টেকনিক বলতে তিনি মূলত মনে করেন ক্যামেরা, লেন্স এবং ফিল্ম স্টকের বৈশিষ্ট্যকে। এখানে বাস্তবকে রেকর্ডভুক্ত (সিনেমার ক্যামেরায়) করার ভঙ্গি ও আঙ্গিককে, যা রেকর্ড করা হয়েছে, তার ওপর ইচ্ছাকৃত ও কিছুটা কৃত্রিম করে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। সিনেমার প্রচলিত তত্ত্বেও তাই ঘটেছে। মাধ্যম হিসেবে সিনেমাকে গোঁড়া দৃষ্টিসম্পন্নরা দেখেছেন যা ক্যামেরার সৃষ্টি, আর সমালোচনার বিষয় হিসেবে প্রাধান্য পেয়েছে পর্দায় যা প্রদর্শিত হয়। এই দুই বিষয় বা দৃষ্টিভঙ্গি এক ও অভিন্ন নয়, বলতে চেয়েছেন বিশুদ্ধবাদীরা। প্রথমদিকে তাত্ত্বিকরা সিনেমার এই ভুল সংজ্ঞার জন্য অন্যান্য গুণ ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে ব্যাপৃত থেকেছেন, যা বেশ ভ্রান্ত। ফিল্ম থিওরি বলতে তখন বুঝিয়েছে দুই ধরনের রহস্যময় রূপ ও প্রক্রিয়া : (ক) দৃশ্যকল্প (ইমেজ) এবং (খ) মন্তাজ।
দৃশ্যকল্প বা ইমেজসংক্রান্ত রহস্যময়তার সূত্রপাত সিনেমার আবির্ভাবের আগেই ঘটেছে। ফটোগ্রাফারদের এমনভাবে ছবি তুলতে বলা হয়েছে যেন তার সঙ্গে চিত্রকলার সামঞ্জস্য থাকে। লিন্ডসে জোর দিয়ে বলেন, প্রথমে এসেছে ফটোগ্রাফি এবং তারপর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গতি। এই ক্রমের কথা মনে রেখেই সিনেমাকে বিচার করতে হবে। শিল্প হতে হলে সিনেমাকে প্রথমে হতে হবে ভালো স্থিরচিত্র এবং তারপর ভালো সচল ছবি। এই সচল ছবি নির্মাণে সবচেয়ে উপযুক্ত হলো চিত্রশিল্পী, ভাস্কর এবং স্থপতি, এই মনে করেছেন তিনি। সিনেমার ইমেজের অলংকারময় বৈশিষ্ট্য বা উপাদানের প্রতি লিন্ডসের যে গুরুত্ব আরোপ, সেটি সমসাময়িককালে অনুসৃত আদর্শের কারণে। তাঁর সময়ে এসথেটিকস নিয়ে সব আলোচনাই ছিল সৌন্দর্যকে কেন্দ্র করে। আর্নহাইম কিন্তু অলংকারের শর্ত পূরণের তুলনায় ইমেজকে অর্থময়ভাবে বিন্যস্ত করার প্রয়োজনের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। লিন্ডসের অনুসরণে ক্যামেরা সৌন্দর্য সৃষ্টি করবে, সমালোচকরা (তাত্ত্বিকরা) এই প্রত্যাশা করেছেন। কিন্তু একই সঙ্গে চিত্রশিল্পে, সমালোচনায় এবং ফিল্ম তৈরির ক্ষেত্রে (যার প্রভাব লিন্ডসের নজরে পড়েনি) যে উন্নতি হয়েছে, তার প্রতিও সমালোচকরা সাড়া দিয়েছেন এবং দাবি করেছেন যে ক্যামেরাকে অর্থময়তাও সৃষ্টি করতে হবে। ‘দি ক্রিয়েটিভ ক্যামেরা’ নামে একটি প্রবন্ধে বালাজ লিখেছেন যে, ক্যামেরার অ্যাঙ্গল হলো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সৃষ্টির সবচেয়ে শক্তিশালী উপায় বা পন্থা, যা ফিল্মের আয়ত্তে রয়েছে। এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি পুনরুৎপাদন নয়, প্রকৃত উৎপাদন অর্থাৎ মৌলিক সৃষ্টি। ইমেজ সংক্রান্ত যে রহস্যময়তা, তার ভিত্তিতে আশা করা হয় যে ক্যামেরা তার গুণাবলি ও ক্ষমতা সৃজনশীল ও প্রকাশময়তাকে ব্যবহার করবে। ফটোগ্রাফির পদ্ধতিতে নির্বাচন ও বিকৃতকরণের মাধ্যমে বস্ত্ত ও ঘটনার প্রতি যে মন্তব্য করার সুযোগ থাকে তার খেয়ালখুশি ব্যবহারের প্রতি ইমেজের এই রহস্যময়তা গুরুত্ব দেয়। কেবল বাস্তবকে রেকর্ড করার জন্য ক্যামেরা ব্যবহৃত হলে শিল্প মাধ্যম হিসেবে সিনেমাকে অবহেলা করা হয়।
চার্লি চ্যাপলিনের ছবির প্রশংসা করলেও আর্নহাইম সেসব সত্যিকার অর্থে ফিল্ম ছিল না বলে মনে করেছেন এই জন্য যে, সেখানে ক্যামেরা কেবল রেকর্ড করার যন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। অপরদিকে রবার্ট ওয়েলের এক্সপ্রেশনিস্ট ফিল্ম দি ক্যাবিনেট অফ ড. ক্যালিগরি সিনেমা দ্বারা রোথা এতই অভিভূত ও মুগ্ধ হন যে, একে সিনেমায় প্রথম এসথেটিক অগ্রগতি বলে গণ্য করেন এবং এই সিনেমায় কল্পনার ব্যবহারকে মৌলিক বলে ধারণা করেন। এই সিনেমা তাঁর কাছে মনে হয়েছে নতুন মাধ্যমে সৃজনশীল মনের প্রকাশে প্রথম প্রচেষ্টা হিসেবে। এরপর তিনি যে সব মঞ্চ (স্টেজ) খাঁটি মনে হয়েছে তার প্রতি আগ্রহ ও কৌতূহল হারিয়ে ফেলেন। বার্থ অফ এ নেশন সিনেমার প্রধান দুর্বলতা হিসেবে তিনি দেখেন আব্রাহাম লিংকনের পড়ার ঘরের এবং থিয়েটারের হুবহু অনুকরণ ব্যবহার।
সিনেমাকে ভিস্যুয়াল আর্টস হিসেবে দেখার ভেতর ইমেজের রহস্যময়তার উৎস চিত্রকলার ভিত্তিতে সিনেমাকে একটি মানদন্ডের শর্ত পূরণ করতে হবে, এমন কথা নেই। কিন্তু ভিস্যুয়াল আর্ট হিসেবে সিনেমাকে শ্রেণিভুক্ত করার ফলে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে, কেননা এখানে কেবল শিল্পসম্মত এবং সীমিতসংখ্যক সিনেমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এমন মানদন্ডের সার্বিক ব্যবহারের প্রতি ইঙ্গিত দেওয়া হয়। এর ফলে ছবির অলংকারমূলক ও প্রকাশময়তার প্রকৃতিতে স্পেসের বা নাটকীয় ব্যবহারের প্রাধান্য পায়। প্রচলিত তত্ত্ব ক্যামেরাকে সৃষ্টি (ক্রিয়েট) করতে বলে এবং তার অবলোকনের অধিকার অস্বীকার করে। ক্যামেরায় সুযোগ ও কৌশলসমূহ সিনেমা মাধ্যমের চাহিদা পূরণে ব্যবহৃত হবার সঙ্গে সঙ্গে ইমেজের রহস্যময়তা (মিস্টিক) গোড়া বা প্রচলিত বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বের ওপর প্রভাব বিস্তার করে।
ক্যামেরার এইসব দৃশ্যময়তা সৃষ্টির সম্ভাবনা ও ক্ষমতা সত্ত্বেও তার সৃজনশীলতার ভূমিকার তুলনায় যান্ত্রিক কৌশলই গুরুত্ব পেয়েছে, যার ফলে সিনেমার নির্মাণকে একটি যান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ঊর্ধ্বে বিবেচনা করা হয়নি। কমপোজিশন, আলোকসম্পাত ইত্যাদির সাহায্যে ক্যামেরা দৃশ্য বা অ্যাকশনের ধরনে যতই সংশোধনের আশ্রয় নিক না কেন, তার দ্বারা যেবাস্তবে (চিত্রনাট্য অনুযায়ী) সংঘটিত অ্যাকশনই ধারণ করা হচ্ছে, সেই ধারণাটির পরিবর্তন হয় না। সিনেমার নির্মাণে যে অন্যান্য শিল্পের মতো বাস্তবতার ওপর একই মাত্রায় নিয়ন্ত্রণ থাকে তার সপক্ষে প্রমাণ পেতে চেয়েছেন সমালোচকরা। ফিল্মের যে গোঁড়া (অর্থডক্স) তত্ত্ব এই প্রমাণ দেখতে পেয়েছে মন্তাজের রহস্যময়তায় (মিস্টিক)। বালাজের মতে, মন্তাজ সিনেমার দৃশ্যগত উপাদানের গতিময় স্থাপত্য (মোবাইল আর্কিটেকচার), যার ভিত্তিতে তিনি একে একটি বিশেষ সৃজনশীল শিল্পের মর্যাদা দিতে চেয়েছেন (থিওরি অফ দি ফিল্ম, ১৯৫২)। মন্তাজের সৃজনশীল ভূমিকার উৎস সম্পাদনার স্বাধীনতায়। যেহেতু সম্পাদনায় ফিল্ম স্ট্রিপের যে-কোনো অংশ কাটা এবং ইমেজের অংশ যোগ করা যায়, সেই কারণে স্থান ও সময়ের যে পরিপ্রেক্ষিতে ইমেজের শটগুলি ধারণ করা হয় চিত্র পরিচালক-সম্পাদক সেই বাস্তবতাকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখেন। তিনি পরস্পরবিচ্ছিন্ন ও দূরস্থিত ঘটনাকে কাছে আনতে বা পাশাপাশি ঘটে যাওয়া ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন করে স্থান ও সময়ের বাস্তবতার ওপর নিয়ন্ত্রণক্ষমতা প্রকাশ করেন। দৃশ্যের সিকোয়েন্সের ওপর ফিল্ম তৈরি ভিত্তি করে চিত্রনির্মাতা ঘটনার তাৎপর্যময় অংশের ওপর বিশেষভাবে আলোকপাত করতে পারেন এবং সিনেমার ভেতর যে ছন্দ (রিদম), তা নির্ধারণে সক্ষম হন। মন্তাজ বা সম্পাদনার এই ভূমিকা ও ক্ষমতা সম্বন্ধে নির্বাক যুগের আমেরিকান পরিচালক এডউইন এস পোর্টার ও ডি ডাব্লু গ্রিফিথ এবং রাশিয়ার পুডোভকিন এবং এস এম আইজেনস্টাইন বেশ সচেতন ছিলেন।
সম্পাদনার মাধ্যমে সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রাখা সম্বন্ধে আরো দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যখন উপলব্ধি জন্মে যে দুটি শট জোড়া দিলে দর্শকের সামনে এক নয়, একাধিক দৃশ্যের অবতারণা হয়, যার ফলে দুটি শটের বৈপরীত্য, সংঘর্ষময় অথবা পরিপূরক সম্পর্ক স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে। পুডোভকিনের দি এন্ড অফ সেন্ট পিটাসবুর্গ (১৯২৭) সিনেমার দৃষ্টান্ত দিয়ে বালাজ মন্তব্য করেছেন যে, দর্শকের পক্ষে দুটি শট যুক্ত হওয়ার পর যে নতুন অভিজ্ঞতা হয় তার ভিত্তিতে দর্শক দুটির মধ্যে তুলনা না করে পারে না এবং তাদের মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক খুঁজে পায়। পুঁজিবাদীরা যে যুদ্ধের সাহায্যে মুনাফা বৃদ্ধি করে, এই বক্তব্য সংশ্লিষ্ট দুটি শটের একটিকে পৃথকভাবে দেখলে বোঝা যাবে না। পুডোভকিন পুঁজিবাদ সম্বন্ধে এই ধারণা স্পষ্ট করেছেন যুদ্ধে রাশিয়ান সৈন্যরা মৃত্যুবরণ করছেন, এই দৃশ্যের পাশাপাশি স্টক এক্সচেঞ্জে শেয়ারের মূল্য বৃদ্ধির দৃশ্য দেখিয়ে। প্রথম শটের ভেতর প্রচ্ছন্ন অর্থের টান টান উত্তেজনা টের পাওয়া যায়, যা পরবর্তী শটের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর বিদ্যুৎ চমকের মতো প্রকাশ পায়, বালাজ এই মন্তব্য করেছেন। আইজেনস্টাইন আরো বেশি করে বলেছেন যে, ফিল্মের দুটি অংশ পরস্পর সন্নিবেশিত হলে অবশ্যম্ভাবী নতুন একটি ধারণার সৃষ্টি হয়। একটার পর একটা অবস্থান নিয়ে দুটি শট ক্যামেরার কাজে নতুন অর্থ এবং গুণ আরোপ করে (ফিল্ম ফর্ম অ্যান্ড দি ফিল্ম সেন্স, মেরিডিয়ান বুকস, ১৯৫৭)।
সম্পাদনা যে সৃজনশীল প্রক্রিয়া এই ধারণার ভিত্তিতে প্রথম পর্বের (যাকে অর্থডক্সি বলা হয়েছে) ফিল্মতত্ত্ব তৈরি হয়েছে। সিনেমায় সৃজনশীল ভাষার প্রধান পরিচয় হিসেবে সম্পাদনার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। ফিল্ম টেকনিক বইতে পুডোভকিন বলেছেন : সিনেমার প্রতিটি শটকে তুলনা করা যায় কবিতার শব্দের সঙ্গে। সম্পাদনাই চিত্রপরিচালকের ব্যবহৃত ভাষা। মুখের ভাষার মতোই দৃশ্যমান ফিল্ম স্ট্রিপে একটি ইমেজ বা রূপকল্প এবং তাদের সংমিশ্রণে একটি বাক্য নির্মিত হয়। অনেকেই অবশ্য সিনেমায় ইমেজের সঙ্গে মুখের ভাষার শব্দের এই তুলনাকে অতিরঞ্জিত মনে করেছেন, কেননা শব্দের চেয়ে সিনেমার একটি দৃশ্যে আরো অনেক বেশি জানা যায়। একটি শটের বিষয়বস্ত্ত যত জটিল হবে, মুখের ভাষার সঙ্গে তার তুলনার ভিত্তি ততই ক্ষীণ হয়ে আসবে। এই জন্য প্রথম পর্বে (অর্থডক্স ফিল্মতত্ত্বে) একটি ধারণকৃত ঘটনা বা দৃশ্যকে অনেকগুলি সহজ অংশে বিভক্ত হওয়ার প্রতি জোর দেওয়া হয়েছে। একটি ঘটনা (অ্যাকশন) বা দৃশ্যকে যদি নির্বাচিত অংশের মিশ্রণ হিসেবে ধারণ করা হয় তাহলে ‘মন্তাজ’ বা সম্পাদনা সমবেত সিকোয়েন্সে ‘অর্থের’ সক্রিয় এবং স্পষ্ট উৎস হিসেবে দেখা দেয়। এই কারণে বালাজ ক্লোজআপ শটসের প্রতি গুরুত্ব দেন, যার মাধ্যমে পরিচালকের কাব্যমনস্কতা বা কাব্যিক ভাবনা পরিস্ফুট হয় বলে তার ধারণা।
মন্তাজ কেবল ফিল্মের ভাষা নির্ধারণ বা নির্মাণের উপায় নয়, তার সাহায্যে সিনেমার শিল্পগত প্রকৃতির ব্যাখ্যা এবং সংজ্ঞাও পাওয়া যায়, এমন ভেবেছেন কেউ কেউ। রোথার ভাষায় মন্তাজ বা এডিটিং হলো সিনেমা নির্মাণের মূল এবং অন্তর্নিহিত নির্যাস। এই ধারণা প্রথম চালু হয় পুডোভকিন এবং তাঁর শিক্ষক লেভ কুলেশভের ফিল্ম সংক্রান্ত চিন্তা ও লেখায়। কুলেশভের মতে, সিনেমা নির্মাণে ফিল্মের স্ট্রিপ হলো কাঁচামাল, যা কম্পোজিশনের মাধ্যমে সৃজনশীল রূপে ব্যবহৃত এবং সংমিশ্রিত হয়। তাঁর মতে, অভিনেতাদের অভিনয় এবং ক্যামেরার বিভিন্ন দৃশ্যের শট হয় না। তাঁর কাছে এইসবই হলো উপাদান ব্যবহারের প্রস্ত্ততি। পরিচালক যখন ফিল্ম তৈরির সব উপাদান সংমিশ্রণ করতে শুরু করেন তখনই ফিল্ম আর্টের শুরু। পুডোভকিন তাঁর শিক্ষকের বক্তব্য সমর্থন করে বলেন যে, পর্দায় দর্শকদের যা দেখানো হয় সেসবই মৃত, প্রাণহীন, যদিও তারা ক্যামেরার সামনে দিয়ে যাওয়া-আসা করেছে অর্থাৎ অগ্রসর হয়েছে। কেবল বিভিন্ন ও পৃথক দৃশ্যকল্পের (ইমেজ) সমন্বিত রূপ হিসেবে উপস্থাপিত হলেই একটি বস্ত্ত প্রাণী বা প্রাকৃতিক দৃশ্য ফিল্মের ভেতর জীবন্ত হয়ে ওঠে।
সিনেমার নির্মাণে বিভিন্ন অংশের মধ্যে কোনো একটির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হলে যে অন্যগুলি যথোচিত বিবেচনা পায় না একথা বলেছেন অনেকেই। সৃজনশীল বলে কোনো অংশকে (যেমন, সম্পাদনা) চিহ্নিত করা হলে সিনেমা নির্মাণের অন্যান্য অংশকে এই ভূমিকা থেকে বাদ দেওয়া হয় এবং এর ফলে সিনেমার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ভারসাম্যতা হারায়। এর ফলে যে অংশের প্রতি সৃজনশীলতার নিরিখে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে তারও অবমূল্যায়ন ঘটে। যেমন, বাস্তব ও সৃজনশীল কল্পনা এই দুইয়ের ভেতর পার্থক্য টানার জন্য সম্পাদনার প্রকৃত গুরুত্ব হ্রাস পায়, কেননা এই পার্থক্যের ফলে সম্পাদনার মাধ্যমে চিত্রনির্মাতার নির্বাচনক্ষমতার সীমানা নির্দিষ্ট হয়ে তার সম্প্রসারণের সুযোগ রহিত করে দেয়। খেয়ালখুশিমাফিক দৃশ্যের সমন্বয়ে একটি বিন্যাস সৃষ্টির (প্যাটার্ন) সুযোগ দিয়ে এই বিভাজনের একটি অংশ, সম্পাদনা, কারিগরি উপায়কে টেকনিকাল (রিসোর্স) শিল্পের ভূমিকা পালনে বাধ্য করে। বিন্যাসের প্যাটার্ন নির্মাণে ডিটেইলসগুলিকে পৃথক করে নিয়ে তারপর ইচ্ছেমতো ব্যবহারের সুযোগ দিলেও সম্পাদনায় সৃজনশীল সংজ্ঞা পরিচালককে বিচ্ছিন্ন করা ডিটেইলস থেকেই বিন্যাস সৃষ্টি করতে বলে, তার বাইরে বা ঊর্ধ্বে গিয়ে নয়। যেমন, শটের স্থায়িত্বের সঙ্গে ছন্দের (রিদম) ধারণা যুক্ত করে ‘বাস্তবতা’ ও সৃজনশীল সম্পাদনার অনড় ও কৃত্রিম বিভাজন একটি স্থূল সূত্রের নির্মাণ করে, যার সাহায্যে রেনোয়াঁর রুল অফ দি গেমের মতো সিনেমার অন্তর্গত সূক্ষ্ম ছন্দময়তার উপলব্ধিতে সাহায্য করে না। এই ছবিতে এমন একটি সূক্ষ্ম ছন্দময় সুরের মিশ্রণ (কাউন্টার পয়েন্ট) ব্যবহৃত হয়েছে, যা সম্পাদনায় সাহায্য করেছে, কিন্তু এককভাবে সৃষ্টি করেনি। এজন্য বলা হয়েছে যে, যদি সম্পাদনাকে চিত্র নির্মাণের সার্বিক প্রক্রিয়া (অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নড়াচড়া, দৃশ্যসজ্জা, ক্যামেরার মুভমেন্ট, আলোকসম্পাত ইত্যাদি যা একটি শটের ভেতর এবং দুটি শটে পরিবর্তনশীল) থেকে পৃথক করে দেখা ও বিবেচনা করা হয় তাহলে প্রক্রিয়ার অন্তর্গত অংশগুলি যেমন সম্পূর্ণ উপলব্ধি করা যাবে না, সম্পাদনার প্রক্রিয়াও অস্পষ্ট থাকবে। কেননা এই অংশগুলি তাদের তাৎপর্যের জন্য একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। গোঁড়া (অর্থডক্স) বা প্রথম পর্বের ফিল্ম থিওরি অনুযায়ী ‘বাস্তব’ ও সৃজনশীল সম্পাদনার ভেতর যে কৃত্রিম বিভাজন দেখা দেয় তার ফলে কেবল সেইসব সিনেমাই বিবেচিত হবার যোগ্যতা রাখে, যেখানে এই বিভাজন প্রয়োগ করা সম্ভব।
আরনেস্ট লিন্ডগ্রেনের লেখা প্রচলিত (অর্থডক্স) তত্ত্বের সংকলন গ্রন্থে দি আর্ট অফ দি ফিল্ম (১৯৬৩) তিনি সম্পাদনাকেই ফিল্ম-আর্টের ভিত্তি বলে অভিহিত করে লিখেছেন : যদি সিনেমা ব্যবহার করে ঘটনাকে রূপ দেওয়া সম্ভব হয় এবং তার প্রতি একটি দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা যায় এবং ঘটনাটি শিল্পীর ওপর যে অভিঘাত সৃষ্টি করে সে সম্বন্ধে কিছুটা বর্ণনা করা যায়, কেবলমাত্র তাহলেই ফিল্ম একটি শিল্পের মর্যাদা পেতে পারে। এটা অবশ্য সত্যি যে, ক্যামেরার ব্যবহার একটি বিশেষ দৃষ্টিকোণ বেছে নিয়ে একটিমাত্র শটের সীমানায় বা ফ্রেমের সীমাবদ্ধতার তাৎপর্যময় কিছুর প্রতি ইঙ্গিত দেওয়া যায় কিন্তু এই পদ্ধতি বা উপায়ের সম্ভাবনা বেশ সীমিত। অপরদিকে সম্পাদনার সাহায্যে এই সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করা সম্ভব।
প্রথমদিকের তাত্ত্বিকরা (অর্থডক্স) এইভাবে সিঙ্গল শটের সীমাবদ্ধতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং ডিটেইলসের সংক্ষিপ্ত অংশের ওপর জোর দিয়ে সিঙ্গল শটের সম্ভাবনাকে সীমিত করে দেখতে বলেন। অরসন ওয়েলস, হিচককের মতো পরিচালকরা সিঙ্গল শটে যা দেখাতে পেরেছেন তার উপেক্ষা করে তাঁরা এইসব পরিচালকের সৃজনশীল সম্পাদনায় যে জটিলতা তা বিবেচনা করতে উৎসাহ বোধ করেন না। এইসব তাত্ত্বিকের মতে, ঘটনা বা দৃশ্যকে (ইভেন্ট) শুটিংয়ের মাধ্যমে বিভক্ত বা কাটাকুটি (ডিসেকট) করতে হবে এবং তারপর সম্পাদনার সময় (মন্তাজে) সেসব জোড়া দিয়ে পুনর্গঠিত করতে হবে। এইভাবে তাঁরা ঘটনা বা দৃশ্যের প্রতি কোনো গুরুত্ব বা তাৎপর্য দিতে অস্বীকার করেন। ঘটনা (ইভেন্ট) বা দৃশ্য তাঁদের মতে কেবল সম্পাদনার মাধ্যমেই রূপপরিগ্রহ করতে বা বদলাতে পারে। শিল্পীর (পরিচালক/সম্পাদক) ওপর এই ঘটনার অভিঘাত আছে, যার ফলে সে শুটিং এবং সম্পাদনা (কাটিং) সম্পন্ন করে। লিন্ডগ্রেনের এই ব্যাখ্যা শিল্পী যে স্বাধীনভাবে সৃষ্টি করতে পারে কেবল ঘটনার প্রতি শিল্পিতভাবে প্রতিক্রিয়া জানায় না, এই বিষয়টি অস্বীকার করে। যে ঘটনা বা অ্যাকশন ক্যামেরায় রেকর্ড করা হয়েছে তাকে যে রূপ দিয়ে পূর্ব আকৃতি বদলিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ করা হয়েছে সেই সম্ভাবনাও এই তাত্ত্বিকদের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয় না। লিন্ডসের ব্যাখ্যা থেকে প্রথমদিকের প্রচলিত তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা প্রমাণিত হয়, যেখানে অ্যাকশন মানেই বোঝা হয়েছে নিছক বাস্তবতা। বাস্তবের মতো এই অ্যাকশনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে। প্রথমদিকের তাত্ত্বিকরা (যার প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় লিন্ডসের লেখায়) বাস্তব ও কল্পনার ভেতরকার পার্থক্যকে বিবেচনায় আনার জন্য কোনো মানদন্ড তৈরি করতে পারেননি। সিনেমার বৈশিষ্ট্য ও উপকরণ-প্রকরণকে দৃশ্য-মাধ্যম হিসেবে গণ্য করে তাঁরা সিনেমার সঙ্গে অন্যান্য বর্ণনা মাধ্যম (ন্যারেটিভ ফর্ম) বিশেষ করে নাটকের যে সাদৃশ্য, সে সম্বন্ধে নিশ্চুপ থাকেন বা তার প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করেন। ফিল্মের আঙ্গিকে পর্দায় যা দেখানো তার ব্যাখ্যা দিতে না পেরে এইসব তাত্ত্বিক ন্যারেটিভকে একটি বহিরাগত বা বিচ্ছিন্ন রূপ হিসেবে বিবেচনা করেন এবং মনে করেন যে সিনেমা এই ন্যারেটিভকে অনুবাদ করতে বা তার সঙ্গে সংযুক্ত করতে পারে, কিন্তু তার সৃজনশীল প্রক্রিয়া বা পন্থার অংশ হিসেবে আত্মস্থ করতে পারে না।
কাহিনি বর্ণনা, অথবা কোনো কল্পিত ঘটনার প্রতিনিধিত্ব করা স্বশাসিত বা স্বনির্ভর কোনো প্রক্রিয়া নয়। এই বর্ণনায় (ন্যারেটিভে) যে মাধ্যম ব্যবহৃত হয় তার অন্তর্ভুক্ত চরিত্রগুলির ওপর কিছু নিয়ন্ত্রণ থাকে এবং তাদেরকে কল্পিত ভূমিকা দেওয়া যায়। এমন বর্ণনা কবিতা, উপন্যাস, কার্টুন বা থিয়েটারে যেমন আছে সিনেমার ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। সিনেমায় প্রকৃত বস্ত্ত যা বাস্তবে থাকে তাকে অথবা কল্পিত ঘটনাকে তার মাধ্যমে আত্মস্থ করে নেয়। ফটোগ্রাফির যে মূল শব্দভান্ডার, সেখানে এই স্বীকৃতি আছে। যেমন, কাঁচা ফিল্ম একটি নির্দিষ্ট বিষয় ধারণের জন্ম ব্যবহারের প্রথম পর্বে থাকে এক্সপোজার, যা যান্ত্রিক আর দ্বিতীয় পর্বে হয় ডেভেলপ করা, যখন সেই নির্দিষ্ট বিষয়ের বৈশিষ্ট্যগুলি ইমেজের আকারে স্পষ্ট হয়। ক্যামেরা কেবল রেকর্ড করা যন্ত্র হলেও এর ধারণকৃত ঘটনা বা দৃশ্য নির্বাচন এবং বিভিন্ন কোণ থেকে ধারণের মাধ্যমে বক্তব্য রাখা বা অর্থময়তা আরোপের সুযোগ থাকে। ক্যামেরা এইভাবে যা ধারণ করে সেই ধারণ করার ক্ষমতার জন্যই সেখানে নতুন কিছু যুক্ত হতে পারে। একজন সংগীত রচয়িতা বা সুরস্রষ্টা বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে যেভাবে সৃজনশীলতার পরিচয় দেন, সিনেমা নির্মাতাও ক্যামেরাকে তাঁর পরিকল্পিত উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারেন।
পর্দায় একটি কল্পিত ঘটনা সনাক্ত করার সঙ্গে সঙ্গে সিনেমার সঙ্গে উপন্যাস বা নাটকের বেশ কিছু সাদৃশ্য ধরা পড়ে, যা প্রতিনিধিত্ব করা হচ্ছে সেটি প্রতিনিধিত্ব করার পন্থার অংশ হয়ে যায়। পরিচালক যখন অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে কাজ করেন তার সঙ্গে নাট্য পরিচালকের পার্থক্য থাকে না। কিন্তু লিন্ডগ্রেনের মতে, একজন চিত্র পরিচালক হয় সম্পাদনার মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করেন অথবা তাঁকে নির্ভর করতে হবে ফিল্ম মেথড নয়, এমন সব পন্থার ওপর। যেমন অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অ্যাকশন ও সংলাপ এবং ক্যামেরা দিয়ে সেইসব ধারণ করা। লুই জ্যাকবস (দি রাইজ অফ আমেরিকান ফিল্ম, ১৯৫৬) তার প্রতিনিধিত্ব করে বলেন, ক্যামেরার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও এই ভূমিকা সম্পাদনার অধীনস্থ। অভিনেতা-অভিনেত্রী এবং অ্যাকশনকেবাস্তবতার একই পরিচয় ও পর্যায় দান করার ফলে ফিল্মের এই তত্ত্ব একটি টেকনিকাল বিশ্বাস/ধারণা (ডগমা) ব্যতীত অন্য কিছু দিতে পারে না, যার ফলে মাধ্যমের (মিডিয়াম) প্রয়োজন বা শর্ত তার সম্ভাবনার তুলনায় বেশি গুরুত্ব লাভ করে। দর্শকের জন্য শিল্পের মানদন্ড তৈরি করে দেয়, এই ধারণা দিলেও ফিল্মের এই তত্ত্ব আসলে সিনেমা নির্মাতার ওপর বিধি-নিয়ম চাপিয়ে দেয়। লিন্ডগ্রেন যখন প্রশ্ন করেন : এই ফিল্ম কি ফিল্মিক অর্থাৎ সিনেমার মানদন্ড অনুযায়ী তৈরি? তখন তিনি জানতে চান ফিল্মটি সম্পাদনার মাধ্যমে ইমেজগুলিকে এমনভাবে গ্রথিত (কম্পোজ) করতে পেরেছে কিনা যার ভিত্তিতে সামগ্রিক ইফেক্ট সৃষ্টি হয়েছে?
কারো মতে, ফিল্মিক মেথড (সম্পাদনার মাধ্যমে ভিস্যুয়াল ডিটেইলসকে কম্পোজ করা) মানদন্ড হিসেবে ব্যবহৃত হলে সিনেমার মাধ্যমে যে জটিলতা প্রকাশ সম্ভব তা ব্যবহৃত হয়। সূক্ষ্ম উপস্থাপন ও গূঢ় বক্তব্যের চেয়ে বর্ণনাভঙ্গি এবং তার উচ্চকিত রূপই প্রাধান্য পায়। এইভাবে প্রথম পর্বে গোঁড়া (অর্থোডক্স) তত্ত্ব প্রচারণামূলক অপরিশীলিত শিল্পরূপকেই সিনেমা নির্মাণের মডেল হিসেবে গ্রহণ করে। এই তত্ত্বের সাহায্যে ১৯৩৬ সালে নুরেমবার্গে নাৎসি সমাবেশের ওপর লেনি রেইফেনস্টালের তৈরি ট্রায়ামফ অফ দি উইল ডকুমেন্টারিতে যে স্থূল আঙ্গিক দেখা যায় তার বিচারে সাহায্য করে না। লিন্ডগ্রেন ফিল্মিক ছবির যে সংজ্ঞা দিয়েছেন সেই অনুযায়ীই এই সিনেমা তৈরি হলেও গোঁড়া বা অর্থোডক্স যে তত্ত্বের তিনি সমর্থক তার দ্বারা এর গুণগত বিশ্লেষণ সম্ভব হয় না। এই ফিল্মতত্ত্ব সিনেমার আরো অনেক গুণগত বিশ্লেষণে নেতিবাচক ভূমিকা রাখে, যা সেই তত্ত্বের অনুসারীদের প্রবক্তাদের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ মনে হবে। যেমন, লিন্ডগ্রেন বুনুয়েল এবং বার্গমানের সিনেমায় এমন সব গুণের ওপর তাঁদের ব্যক্তিগত আগ্রহ দেখেন এবং সেসবের প্রকাশ ঘটেছে বলে মনে করেন, যা তাঁদের পূর্বসূরিদের কাজে দেখা যায় না। অথচ তাঁদের দুজনই সিনেমা নির্মাণে এমন পদ্ধতির ব্যবহার করেছেন, যা লিন্ডগ্রেন নন-ফিল্মিক অর্থাৎ সিনেমার ভাষার বহির্ভূত মনে করেছেন। একইভাবে জন স্ট্রোহাইমের গ্রিড সিনেমাটিও গোঁড়া তাত্ত্বিকদের ধারণায় গ্রহণযোগ্য মনে হয় না, কেননা এই ছবিতে সম্পাদনার ভিত্তিতে ডিটেইলসের ব্যবহার করা হয়েছে খুবই কম। স্ট্রোহাইম ইমেজের নির্বাচনের তুলনায় সংকলনের প্রতিই বেশি মনোযোগ দিয়েছেন। গোঁড়া (অর্থোডক্স) তত্ত্বে এই পদ্ধতি ফিল্মিক নয়, তাই বিবেচনার অযোগ্য।
পার্কিন্সের মতে, তত্ত্বের যে মানদন্ড এবং সিনেমার দর্শকদের যে উৎসাহ, এর মধ্যে পার্থক্য দেখে এই উপসংহারে আসতে হয় যে, গোড়া অর্থোডক্স তত্ত্ব সিনেমা যেভাবে তৈরি ও প্রদর্শিত হয় তার ওপর ভিত্তি করে যেমন তত্ত্ব তৈরি হয়নি এবং একইভাবে সেই সিনেমার বিবেচনায়ও তেমন বিশেষ ভূমিকা রাখেনি। শিল্প হিসেবে সিনেমাকে একটি সম্পূর্ণ কাজ নয়, পদ্ধতি হিসেবেই দেখা হয়েছে আর ভাবা হয়েছে যে পদ্ধতির সঠিক ব্যবহার করা হলেই শিল্পগুণ নিশ্চিত করা যাবে। পার্কিন্সের মতে, সিনেমাকে বিবেচনা করতে হবে দর্শক যেভাবে দেখে তার ভিত্তিতে অর্থাৎ নির্মাণের স্তর থেকে উপলব্ধির স্তরের প্রতি দৃষ্টি দিয়ে। ফিল্মের সঠিক ও সার্বিক সংজ্ঞা দিতে হলে ভিউ ফাইন্ডার অথবা সম্পাদনার কাটিং বেঞ্চ নয়, স্ক্রিনের প্রতিই মনোযোগী হতে হবে বেশি, যা দর্শকের কাছে সিনেমা হিসেবে পরিচিতি পায়।