হা স না ত আ ব দু ল হা ই
১৯৭০-এর দশকে ফিল্ম স্টাডিজে যেসব সামাজিক-সাংস্কৃতিক আলোচনা (ডিসকোর্স) প্রাধান্য পায় তার মধ্যে নারীবাদী ধারণা অন্যতম। প্রতিনিধিত্ব (রিপ্রেজেন্টেশন), দর্শকের ভূমিকা (স্পেকটেটরশিপ) এবং লিঙ্গ পার্থক্য ইত্যাদি সম্পর্কিত জটিল তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের পাশাপাশি বিস্তৃত পরিধিতে ফিল্ম স্টাডিজের বিষয় বিবেচিত হয়। নারীবাদী তত্ত্বের প্রেক্ষিতে ‘ফিল্ম স্টাডিজকে’ একইসঙ্গে বলা যায় একটি সমালোচনাসূত্র এবং চিত্র নির্মাণের প্রকরণ।
সমালোচনার ধারা হিসেবে সিনেমা জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধানের সকল শ্রেণিতে লিঙ্গ ও লিঙ্গের নিচ থেকে উপরিতলের বিন্যাসকে (হায়ারার্কি) গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। নারীর প্রতিমা (ইমেজ) এবং ইমেজ হিসেবে নারী সিনেমায় কেন্দ্রীয় বিষয় বলে বিবেচিত হয়েছে। সিনেমার তত্ত্বে ও সমালোচনায় লিঙ্গকেন্দ্রিক আলোচনা ‘সিনেমায় নারী’, ‘নারীর জন্য সিনেমা’ এবং ‘নারী দ্বারা নির্মিত সিনেমা’, এইসব প্রসঙ্গে সিনেমার সার্বিক মূল্যায়ন করা হয়েছে। এর ফলে ফিল্ম স্টাডিজের রীতিনীতি ও নিয়মকানুনে ক্রমান্বয়ে পরিবর্তন এসেছে। রাজনৈতিক অর্থে (নারীর পক্ষে বলা বা তাকে বলার সুযোগ দেওয়া) এবং সিনেমায় নারীর প্রতিনিধিত্ব বিষয়ে ধ্যান-ধারণা, নারীবাদী ফিল্মের আলোচনায় তত্ত্ববিদ এবং আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী উভয় শ্রেণিকেই ঐক্যবদ্ধ করেছে। উপরন্তু জ্ঞানার্জনের উচ্চতম প্রতিষ্ঠানে (যেমন, বিশ্ববিদ্যালয়), গত তিন দশকে নারীবাদী অধ্যয়নের বিষয় (স্টাডিজ) এবং নারীবাদী রাজনীতির প্রেক্ষিতে নারীবাদী সিনেমার অনুশীলন (স্টাডিজ), লিঙ্গভিত্তিক আলোচনাকে সম্প্রসারিত করে সিনেমায় বর্ণ, শ্রেণি, যৌনতা ও জাতিগত বিষয়ের প্রতিনিধিত্ব প্রসঙ্গে প্রশ্ন তুলেছে। জনপ্রিয় সংস্কৃতির সঙ্গে ক্ষমতাহীন শ্রেণির সম্পর্ক নিয়ে নারীবাদীদের আগ্রহ ফিল্ম স্টাডিজে টেক্সটের বিশ্লেষণ ও বিস্তৃত পরিধিতে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও তার ভোক্তাদের দিকে দৃষ্টিপাত প্রসারিত করার ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে।
সত্তরের দশকে আমেরিকান সিনেমায় নারীর ভূমিকা বিষয়ে যেসব লেখালেখি হয় তার লক্ষ্য ছিল নারীর ভাবমূর্তি বা প্রতিমা (ইমেজ)। এর সঙ্গে কিছুটা মতপার্থক্য রেখে ব্রিটেনে ‘সিনে-ফেমিনিস্ট’ বলে পরিচিত নারীবাদী শ্রেণির সদস্যরা সিনেমায় নারীর প্রতিনিধিত্বের যে গঠন সে সম্বন্ধে তত্ত্ব নির্মাণে বেশি আগ্রহ দেখায়। আমেরিকান প্রবক্তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সমাজতাত্ত্বিক, অপরদিকে ব্রিটেনে সিনে-ফেমিনিস্টদের ধারণার ভিত্তি ছিল বাস্তবতার সমালোচনা। আমেরিকান তাত্ত্বিকদের মধ্যে মলি হ্যাসকেল ফ্রম রেভারেন্স টু রেপ : ট্রিটমেন্ট অফ উওমেন ইন দি মুভিজ (১৯৭৪ ও ১৯৮৭) এবং মারজোরি রোজেন (পপকর্ন ভেনাস : উওমেন, মুভিজ, অ্যান্ড দি আমেরিকান ড্রিম, ১৯৭৩) সিনেমায় এই বিষয়টি আলোচনার জন্য প্রতিফলন তত্ত্ব তৈরি করেন (রিফ্লেকশন থিওরি)। তাঁরা মনে করেন, সিনেমায় সামাজিক বাস্তব প্রতিফলিত হয় এবং সেই কারণে সমাজ নারীকে কোন ভূমিকা দেয় সিনেমা তার দর্পণ-বিশেষ। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা এ-ও বলেন যে, এই প্রতিফলন নারীর প্রকৃত চরিত্র ও সত্তার বিকৃতি ঘটায় এবং তারা কী চায়, তার অস্বীকৃতি ছাড়া বিশেষ কিছু করে না। নারীর ভূমিকা ও ক্ষমতার ক্ষেত্রে উন্নতি যে করা সম্ভব, সে সম্বন্ধেও এই প্রতিফলনে স্বীকৃতি নেই। মিডিয়ায়, পর্নোগ্রাফিতে এবং বিজ্ঞাপনে নারীর দেহ ব্যবহার, যৌনতার ভূমিকা এবং নারী নির্যাতনের বিষয়েও এইসব তাত্ত্বিকের সমালোচনা অন্বিষ্ট। নারীবাদী এই সমালোচনার ভিত্তিতে নারীর ইমেজ নির্মাণে তাদের নিজেদের হস্তক্ষেপের প্রয়োজনের প্রতি জোর দেওয়া হয়েছে। এই সমালোচনা নারী চরিত্রকে সিনেমায় যেসব শ্রেণিভুক্ত বা ভূমিকা বিশিষ্ট করে দেখানো হয় যেমন সৎ, ছলনাময়ী নষ্টা চরিত্র, শিকার (ভিকটিম), যন্ত্রণাবিদ্ধ মা, শিশু-নারী (‘লোলিতা’ উপসর্গ) এবং যৌন আবেদনের প্রতীক (যেমন ব্রিজিত বার্দো বা মার্লিন মনরো) তার বিরোধিতা করে। বর্তমানে লেসবিয়ান, আফ্রো-আমেরিকান এবং আফ্রো-এশিয়ান দৃষ্টিকোণ থেকে যে সিনেমা সমালোচনা গড়ে উঠেছে সেখানেও বিশেষ বিশেষ চরিত্রে ও ভূমিকায় নারীকে সীমাবদ্ধ বা চিহ্নিত করার অভ্যাস বা পদ্ধতিকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। যেমন, নারী চরিত্রকে সর্বনাশী সুন্দরী (ফাম্ ফাতাল), পুরুষকে ঘৃণাকারী লেসবিয়ান, আফ্রো-আমেরিকান ধাত্রী (মামি), সংকর বর্ণের দুর্ভাগা চরিত্র (মুলাটো) এবং এশিয়ান ড্রাগন লেডি, এইসব স্টেরিওটাইপ। এদের পরিবর্তে এই শ্রেণিভুক্ত নারীবাদী সিনেমা সমালোচক আরো বিস্তৃত চরিত্রের এবং জটিলতার অধিকারী নারী চরিত্রের প্রতিনিধিত্ব দাবি করেছেন। এখানে কেউ কেউ দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন যে, নারীর নির্দিষ্ট শ্রেণি ও ভূমিকা শনাক্তকরণ গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ইতিবাচক ইমেজ সৃষ্টি করে নারী চরিত্রের প্রতিনিধিত্ব করা হলেই আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় যে স্টেরিওটাইপের সৃষ্টি হয়েছে তা দূর হবে না।
হ্যাসকেল সিনেমার ইতিহাসে নারীর ভূমিকার বর্ণনায় এক প্রান্তে নির্বাক যুগের ‘শুদ্ধা’ (পিওর) চরিত্রের রূপ থেকে অন্য প্রান্তে হলিউডের সবাক যুগে বলাৎকারের দৃশ্যে নারী চরিত্র ব্যবহারের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। এই দুই প্রান্তের মধ্যবর্তী স্থানে ছিলেন ১৯৪০-৫০-এর দশকে সিনেমার নায়িকারা, যাঁদের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ক্যাথারিন হেপবার্ন, বেটি ডেভিস, মারলিন ডিয়েট্রিচ প্রমুখ অভিনেত্রী। তাঁর মতে, ‘নতুন হলিউডের’ সিনেমায় নারী নির্যাতনের কাহিনি এবং তাদের প্রান্তিকীকরণ নারীবাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া এবং নারীর স্বনির্ভরতার প্রতি অস্বীকৃতি জানানো হয়েছে। ষাটের দশক থেকে ইউরোপে যে ‘আর্ট’ সিনেমার সূত্রপাত হয়, সেখানে নারী চরিত্রকে কেন্দ্রীয় ভূমিকা দেওয়া হলেও এখানেও যে পুরুষ কল্পিত নারীর ধারণার নবায়ন রয়েছে, সে বিষয়ে হ্যাসকেলের সন্দেহ নেই।
হ্যাসকেল ও রোজেনের ধারণার পর্যালোচনা করে ক্লেয়ার জনস্টন (‘উওমেন’স সিনেমা অ্যাজ কাউন্টার সিনেমা’, ১৯৭৩) নারীর প্রতিমা (ইমেজ) সম্পর্কিত ধারণার অসম্পূর্ণতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। যদিও ইমেজভিত্তিক ধারণা সিনেমার রাজনৈতিক আদর্শবাদ (আইডিওলজি) সম্পর্কিত ভূমিকা উপলব্ধি করে, কিন্তু যে টেক্সট ও মানসিক গঠনের মাধ্যমে সিনেমা কাজ করে সেসব থেকে ইমেজকে যে বিচ্ছিন্ন করা হয়, সেকথাও উল্লেখ করা হয়। ইমেজকেন্দ্রিক ধারণা ঐতিহাসিক ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রেক্ষিত, যা ইমেজের রূপ (ফর্ম) ও কার্যকারিতা (ফাংশন) নির্ধারণ করে, তার থেকেও যে ইমেজকে বিচ্ছিন্ন করা হয় তিনি সেকথাও বলেন। সেমিওটিকসের ভাষার ব্যবহার করে জনস্টন বলেন যে, সিনেমাকে ভাষা হিসেবে দেখতে হবে যেখানে নারী একটি চিহ্ন, কেবল
বাস্তবতার স্বচ্ছ প্রতিনিধিত্ব নয়। ‘উওমেন’স সিনেমা অ্যাজ কাউন্টার সিনেমা’ (১৯৭৩) গ্রন্থে জনস্টন নিজের ধারণাকে ব্যক্ত করার জন্য রোনাল্ড বার্থসের মিথ সম্পর্কিত ধারণার সঙ্গে হলিউডি সিনেমায় নারীর ভূমিকার (চিহ্ন) অর্থোদ্ধারে (ডি-কোড) আদর্শবাদ (আইডিওলজি) আর তাঁর তত্ত্বের মিলনকে অস্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবে দেখান। এই বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ফিল্ম স্টাডিজ-পরবর্তী সময়ে হলিউডের বিভিন্ন শ্রেণির সিনেমা যেমন, রহস্য-রোমাঞ্চ (ফিল্ম-নোয়া), সংগীত-নৃত্য প্রধান (মিউজিকাল) এবং ওয়েস্টার্ন ইত্যাদি শ্রেণি যে নারী চরিত্রকে সিগনিফায়ার হিসেবে দেখিয়েছে তার উল্লেখ করা হয়েছে। সিগনিফায়ার হিসেবে নারী চরিত্র যে বিশেষ প্রতিমামূলক (আইকনোগ্রাফিক) এবং আদর্শবাদভিত্তিক ভূমিকা পালন করে সেই শ্রেণির সিনেমার আদর্শগত বা গঠনগত মাত্রা (যেমন, নারী ও গৃহস্থালি) অথবা তার অন্তর্গত আদর্শগত বিরোধিতা (রহস্য-রোমাঞ্চ, সিনেমায় সর্বনাশা রূপসী) তৈরি করে, তিনি সেকথাও বলেন। এই শেষোক্ত বিশ্লেষণে জনস্টন যে ফরাসি সিনে পত্রিকা কাহিয়ে দু সিনেমা পত্রিকার দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছেন, তার উল্লেখ করেছেন কেউ কেউ। প্রগতিশীল টেক্সট (প্রগ্রেসিভ টেক্সট) অথবা জনপ্রিয় সিনেমা সেই আদর্শবাদ প্রদর্শন করে যেখানে তার উৎস। নারীবাদী ফিল্ম স্টাডিজ একে সফল করেছে মার্ক্সীয় সাংস্কৃতিক ধারণা বা নন্দনতত্ত্ব ব্যবহার করে। এই মার্ক্সীয় নন্দনতত্ত্বে রয়েছে রাশিয়ান ফর্মালিজম, ব্রেখটীয় বিচ্ছিন্নতার ধারণা এবং আলথুসারের পরস্পর-বিরোধিতা (কনট্রাডিকশন)। এই প্রগ্রেসিভ টেক্সট বা জনপ্রিয় ফিল্মের ধারণাই নারীবাদীদের হলিউডি ফিল্মের প্রতি আগ্রহান্বিত করতে সহায়ক হয়। কাহিয়ে পত্রিকার মতাদর্শ ও ধারণাকে ব্রিটিশ সিনে পত্রিকা স্ক্রিনও গ্রহণ করে এবং গঠনবাদ, সংকেততত্ত্ব, মার্ক্সবাদ এবং মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
নারীবাদী ফিল্ম স্টাডিজে নব্য-ফ্রয়েডীয় মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের সবচেয়ে বিশদ ও স্পষ্ট ব্যবহার হয়েছে লরা মলভের লেখায়। মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ পর্বে তাঁর এই ধারণার বিশদ আলোচনা করা হয়েছে বিবেচনায় তার পুনরাবৃত্তি করা হবে না। এখানে শুধু উল্লেখ করা যায় যে মলভে ও তাঁর সমসাময়িক নারীবাদী সিনেমা সমালোচক, যাঁরা লাকাঁর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেছেন, তাঁদের কেউই এই বিশ্লেষণে লিঙ্গের সঙ্গে সঙ্গে বর্ণ, জাতিগত বৈশিষ্ট্য, শ্রেণি অথবা অন্য ধরনের পার্থক্যের যোগাযোগ শনাক্ত করেননি এবং সে সম্পর্কে তত্ত্ব তৈরি করেননি। সিনেমায় এইসব বিষয়, যেমন, ভিস্যুয়াল কোড, ন্যারেটিভ কোড অথবা দর্শক প্রতিক্রিয়া ব্যাখ্যার জন্য লাকাঁর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ বেশ অপর্যাপ্ত ও অপ্রস্ত্তত। যদিও দৃষ্টির (গেজ), অস্বীকার (ডিসএভাওয়াল) এবং বিশেষ ক্রিয়া বা অভিব্যক্তির বাতিকগ্রস্ততার (ফেটিশিজমের) ভিত্তিতে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ধারণা দিয়ে বর্ণগত (রেসিয়াল) ইমেজ ব্যাখ্যা করা হয়েছে, এই আলোচনা বেশ ইতিহাস-নিরপেক্ষ ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক। এর ফলে এই আলোচনার ভিত্তিতে বর্ণবিরোধী তত্ত্ব তৈরি বা বিদ্যমান তত্ত্বে তার ব্যবহারের সুযোগ বেশ সীমিত। দি অপোজিশনাল গেজ (১৯৯২) রচনায় বেল হুকস্ বলেছেন যে, যখন কৃষাঙ্গী দর্শক সিনেমার পর্দায় পুরুষের ফেটিশের (বাতিক) প্রতীক শ্বেত রমণীকে দেখে তখন তাকে বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই বিবেচনা করতে হয়। এই ত্রুটি দূর করার জন্য প্রেক্ষাগৃহে যে বিভিন্ন শ্রেণির ও বর্ণের দর্শক রয়েছে তাদের সঙ্গে সিনেমার পর্যায় নারীর প্রতিনিধিত্ব ব্যাখ্যার জন্য ঐতিহাসিক, সাম্প্রতিক অনুশীলন এবং নারীবাদী ও বর্ণবিরোধী রাজনীতির ভিত্তিতে নারীবাদী ফিল্ম স্টাডিজে নতুন পদ্ধতি ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।
‘মেয়েদের সিনেমার’ (উওমেন্স ফিল্ম) ধারণার সঙ্গে মেলোড্রামা বা অতি-নাটকীয়তার সম্পর্ক দেখতে পেয়েছেন অনেকেই। মলভে ‘দর্শকদের ভূমিকায় নারী’, এই ইস্যুর সঙ্গে মেলোড্রামার ইস্যুকে যুক্ত করে টেক্সট ও প্রেক্ষিতের যে মডেল তার ভেতর প্রতিযোগিতার সম্পর্ক দেখিয়েছেন। যদিও থিয়েটারের সঙ্গে, এমনকি রম্য উপন্যাসের সঙ্গে মেলোড্রামার সম্পর্ক রয়েছে, নারী-সম্পর্কে মেলোড্রামার ব্যবহার করা হলে সেখানে যেন কিছুটা নিন্দার ভঙ্গি প্রকাশ পায়। নির্বাক যুগের সিনেমায় মেলোড্রামা, ১৯৫০-এর হলিউড ফ্যামিলি মেলোড্রামা, টেলিভিশনের সোপ অপেরা এবং সবশেষে মেলোড্রামায় যে উপশাখা ‘মেয়েদের সিনেমা’ নামে পরিচিত তার ওপর ভিত্তি করে তৈরি ফিল্ম স্টাডিজে নারীবাদী জ্ঞানতত্ত্ব ও পদ্ধতির যে ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত এবং প্রকৃত দর্শকের সম্পর্ক, তার সঙ্গে টেক্সটভিত্তিক (সিনেমার ন্যারেটিভ) দর্শকের ভূমিকার তুলনা করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। নিচে সংক্ষেপে এই তুলনামূলক আলোচনা করা হলো।
হলিউডে মেলোড্রামাভিত্তিক মেয়েদের সিনেমা ১৯৩০, ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে বেশ এগিয়ে যায়। বর্তমানে টেলিভিশন সিরিজ হিসেবেই মেলোড্রামাভিত্তিক এইসব সিনেমা (উইপি : অর্থাৎ ছিঁচকাঁদুনে ধরনের) দেখানো হয়। সাধারণত এইসব সিনেমা নায়িকাপ্রধান এবং এর চিত্রনাট্য অথবা মূল উপন্যাসও মেয়েদেরই লেখা। এইসব ছবি খুব কম খরচে তৈরি ও বিপণন করা হয় এবং এর প্রধান দর্শক মেয়েরাই। সাধারণত নর-নারীর মধ্যে প্রেম-বিরহ-মিলন, গৃহস্থালির সমস্যা এবং মাতৃত্বের ইস্যু নিয়েই এইসব সিনেমার কাহিনি তৈরি হয়। পরিবারভিত্তিক ব্যবসা বা সম্পত্তি নিয়ে অন্তঃকলহও (যেমন ডালাস সিরিজে) এর বিষয় হতে পারে। নারীবাদীরা অনেকেই সমসাময়িক জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে এই ধরনের বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব না দিলেও তাঁদের কেউ কেউ এসবের মধ্যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর পরস্পরবিরোধী অভিজ্ঞতার প্রকাশ দেখতে পেয়েছেন। বিশেষ করে এইসব সিনেমায় মায়ের ভূমিকাকে যে আদর্শবাদের নিমাণ হিসেবে দেখে ‘ডিকোড’ করার সুযোগ রয়েছে, তার উল্লেখ করে প্রাক-নারীবাদী পর্বে মায়েদের অস্তিত্বের ব্যাখ্যায় সহায়ক বলে মনে করা হয়েছে। সিনেমার শ্রেণিভিত্তিক তত্ত্বের প্রেক্ষিতে এই ধরনের ‘মেয়েদের ছবি’ অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, স্বনির্ভরতা, বহুগামিতা, মাতৃত্বের আদর্শ এবং যৌনতার ভিত্তিতে মেয়েদের সংজ্ঞায়িত করার প্রক্রিয়ায় সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধের কাজ করে বলে মনে করা হয়। ‘মেয়েদের সিনেমা’ এইভাবে সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে মেয়েদের উপস্থাপনার ওপর যে মনোযোগ, তার সঙ্গে সিনে-ফেমিনিস্টদের নারীদেহকেন্দ্রিক সত্তা সম্পর্কিত ধারণাকে যুক্ত করে। এদের ভেতর অবশ্য পদ্ধতিগত এবং মূল্যায়নের পার্থক্য রয়েছে।
ম্যারি ভ্যান ডোয়ান তাঁর দি ডিসকোর্স অফ ডিজায়ার (১৯৮৭) গ্রন্থে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় হলিউডে তৈরি কিছু সিনেমার টেক্সটের (বিষয়ের) বিশ্লেষণের ভিত্তিতে নারী দর্শক সম্পর্কে একটি তত্ত্ব তৈরি করেন। এই তত্ত্বে তিনি মেয়েদের সিনেমার শ্রেণিতে ‘মাতৃত্ব’, ‘চিকিৎসা ও ভ্রান্তিজনিত মানসিক বিকার বিশেষ’, এইসব বিষয়ভিত্তিক সিনেমা শনাক্ত করে পরিবারকেন্দ্রিক রোমান্টিক সম্পর্ক এবং চিকিৎসক-রোগীর সম্পর্কের বর্ণনায় মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ব্যবহারে আতিশয্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তাঁর এই তত্ত্বে বর্ণিত সিনেমার দৃষ্টান্ত যেমন, আত্মনিপীড়ন (ম্যাসোকিজম) ও মানসিকভাবে অপ্রকৃতিস্থতার জন্য ঘন ঘন মূর্ছা যাওয়া বা উন্মাদের মতো ব্যবহার ইত্যাদি লাকাঁ ‘নারীত্ব’ বলতে যে অভাব বা রিক্ততা (ল্যাক) বুঝিয়েছেন, সেই মতের প্রতি সমর্থন জানায় এবং জোর দেয়। ‘মেয়েদের সিনেমা’, এই অভিধাকে ঠিকানা (অ্যাড্রেস) ও মালিকানা (পজেশন), এই উভয় অর্থে ব্যাখ্যা করে ডোয়ান উপসংহারে আসেন যে, মেয়েদের কেন্দ্র করে তৈরি এই ধরনের সিনেমা তাদেরকে কামনাসংক্রান্ত আলোচনার (ডিসকোর্স অফ ডিজায়ার) বিষয় (সাবজেক্ট) হিসেবে দেখানোর পরিবর্তে তার অধীনস্থ করেই দেখায়। এইসব সিনেমায় নারী চরিত্র (নায়িকা) যেমন ‘মালিকানাহীন নিঃস্ব ব্যক্তিত্ব’ নারী দর্শকরাও সিনেমার কাহিনিতে নিজস্ব বলে কিছু পায় না।
ম্যারি ভ্যান ডোয়ান ১৯৮২ সালে লেখা ফিল্ম অ্যান্ড দা মাসকারেড রচনায় বলেন যে, মেয়েদের সিনেমায় দৃশ্যরূপের (ইমেজ) মিতব্যয়ী ব্যবহার ও আবেগ আলোড়ন সৃষ্টিকারী কাহিনি নারী দর্শককে নারী চরিত্রের ইমেজের সঙ্গে শনাক্ত করতে উৎসাহিত করে। লিঙ্গভিত্তিক পার্থক্যের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা অনুযায়ী যে ফেটিশিজম ও কামনা এবং সমালোচনার ভিত্তি হিসেবে যে দূরত্ব থাকা উচিত এই নৈকট্যের জন্য নারী দর্শক তেমন অবস্থানে থাকে না। পর্দায় প্রদর্শিত ইমেজের ব্যাখ্যার জন্য যে দৃষ্টিপাত (গেজ) প্রয়োজন নারী দর্শক তার অধিকারী হয় না। এজন্য ডোয়ান প্রচলিত সিনেমায় ‘নারী-দর্শকের’ ধারণা খারিজ করতে চান। তাছাড়া ‘মেয়েদের সিনেমায়’ চরিত্র হিসেবেও মেয়েরা প্রাধান্য পায় না, তাদের ভূমিকা হয় পুরুষ লিঙ্গভিত্তিক প্রতিনিধিত্বশীলতায় একটি অসম্বন্ধ ও বিচ্ছিন্ন বিষয়, কেন্দ্রীয় নয়। ‘নারী দর্শকের’ ধারণার স্থানে ডোয়ান বিকল্প হিসেবে ‘ভান’ বা প্রতারণামূলক অভিনয় (মাসকোয়ারেড) এই ধারণার প্রস্তাবনা দেন। একে প্রকৃত নারীসুলভ ব্যক্তিত্ব বা বৈশিষ্ট্যের সমতুল্য মনে করার কারণ হিসেবে তিনি ফ্রয়েডীয় বিশ্লেষণের উল্লেখ করেন। এর দ্বারা মেয়েদের রিক্ততা বা (ল্যাক) অভাব বোধকে প্রদর্শন করা সম্ভব বলে তাঁর বিশ্বাস।
সিনেমা প্রথম থেকেই মেয়েদের সান্ত্বনা ও আনন্দ দিয়ে এসেছে বলে যাঁরা মনে করেন সেইসব নারীবাদী সিনেমাতাত্ত্বিকদের মতে সিনেমায় নার্সিসিজম এবং ম্যাসোকিজমের অতিরিক্ত বিষয়ও থাকে। তাঁদের মতে, নারী দর্শক সিনেমায় পরস্পরবিরোধী দৃষ্টিকোণ আবিষ্কার করতে পারে এবং একাধিক সত্তা বা ভূমিকায় নিজেদের শনাক্ত করার সুযোগও তারা পায়, যার ফলে তাদের পক্ষে সিনেমার সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়। কেবল আত্মবিসর্জনের গৌরব (মাতাহারি চরিত্রে গ্রেটা গার্বো) অথবা নিজের সৌন্দর্যে মুগ্ধ থাকা নয় (সানসেট বুলেভার্ডে গ্লোরিয়া সোয়ানসন), প্রতিবাদ এবং প্রত্যাখ্যানও তার পক্ষে সম্ভব হয়।
আলফ্রেড হিচককের রেবেকা সিনেমার উদাহরণ দিয়ে নারীবাদী সিনেমা তত্ত্বে এই পরস্পরবিরোধী ব্যাখ্যা আলোচনা করা যায়। ডাফনে দু মরিয়েরে একই নামের উপন্যাসে নাম চরিত্রের অনুপস্থিতিকে ডোয়ান ম্যারি ভ্যান দেখেন নারীর নির্বস্ত্তকতা বা মানসিক সত্তার (সাবজেকটিভিটি) প্রত্যাখ্যান হিসেবে। তার বিপরীতে টানিয়া মডেলস্কি (দি উওম্যান হু নিউ টু মাচ, ১৯৮৮) এই সিনেমায় দেখেন নারীর অডিপাল-প্রবণতায় প্রবল প্রকাশ, যেখানে কামনা ও শনাক্তকরণের বিষয় বা চরিত্র অন্য এক নারী (রেবেকা)। এই নাটকীয়তা মনোযোগ আকর্ষণ করে এই জন্য যে, রেবেকা চরিত্রটি নায়িকা ও দর্শকের ওপর যে প্রভাব বিস্তার করে সেটি ইমেজ নয়, দৃশ্যের বাইরে থেকেই করে। সনাতনী মেয়েদের উপন্যাস ও জনপ্রিয় টেলিভিশন সোপ অপেরা, রহস্য-রোমাঞ্চ বা ভীতিকর সিনেমা এবং রোমান্টিক উপন্যাসের সঙ্গে মেয়েদের সিনেমা যুক্ত করে টানিয়া মডেলস্কি সিনেমায় কোডযুক্ত বর্ণনাকে মেয়েদের সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক পরিস্থিতি, সর্বময় কর্তৃত্বের ফ্যান্টাসি এবং কামনা ও ক্রোধের মাধ্যম হিসেবে দেখেন। তাঁর মতে, নারীর জীবনে যেসব বিরোধ-সংঘাত, তার আদর্শ সমাধান মেয়েদের সিনেমার নান্দনিকতায় পাওয়া যায়।
ডোয়ান যেখানে সিনেমায় নারী চরিত্রকে ‘অসম্বন্ধ ও বিচ্ছিন্ন’ বিষয় হিসেবে দেখেন, যার সঙ্গে নারী দর্শকদের সম্মিলন ঘটানো যায় না, সেই স্থানে মডেলস্কি প্রকৃত নারী চরিত্রের অবস্থান ও বাসনাকে তত্তেবর কাঠামোতে ব্যাখ্যা করতে আগ্রহী। অন্যান্য নারীবাদী ফিল্ম চর্চাকারীরা ঐতিহাসিক ও দর্শকভিত্তিক অনুশীলনের ভিত্তিতে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণকে প্রশ্নের মুখোমুখি করেছেন (স্ট্যানিজ্যাকি, ডেসপারেটলি সিকিং ডিফারেন্স, ১৯৮৭/১৯৯০)। ফিল্ম স্টাডিজের বৃহত্তর পরিধিতে এই দৃষ্টিভঙ্গি একটি অংশ। অ্যাপারেটাস থিওরিতে প্রতিষ্ঠান হিসেবে সিনেমার যে সাধারণ চরিত্র (হোমোজেনেটি) এবং ফিল্মের টেক্সটের যে কেন্দ্রীয় ও নির্ধারক ভূমিকা, তার স্থানে কোডিং ও এনকোডিং পদ্ধতির বৈচিত্র্যের ওপর এখানে গুরুত্ব দেওয়া হয়। দর্শকের পরিস্থিতিতে একাধিক তাৎপর্যবহনকারী প্রক্রিয়া পরস্পরকে বিভক্ত করে এবং দর্শকদের অভিজ্ঞতায় থাকে বিচিত্র পরিচিতি (আইডেনটিটি), ইতিহাস, সাংস্কৃতিক যোগ্যতা, যার ভিত্তিতে তারা সিনেমার প্রতি সাড়া দেয়। প্রকৃত দর্শকদের ভেতর বহুত্ব ও তাদের সাড়া দেওয়ার এই বৈচিত্র্য এবং ‘নারী দর্শক’ অভিধায় যে একক তাত্ত্বিক ও টেক্সচুয়াল নির্মাণ এই দুটি বিষয়কে কেউ কেউ দেখেছে নারীবাদে কেন্দ্রীয় ও প্রয়োজনীয় পরস্পর-বিরোধিতার সঙ্গে সম্পর্কিত। এই পরস্পর-বিরোধিতার একদিকে রয়েছে দার্শনিক ও নান্দনিক ধারণা হিসেবে তৈরি নারী এবং অন্যদিকে রয়েছে বস্ত্তগত ও ঐতিহাসিকভাবে অবস্থিত মানুষ, যারা লিঙ্গের ভিত্তিতে নারী। ‘মেয়েদের সিনেমা’ সম্পর্কিত আলোচনা ও রচনা এই দুই ‘নারীর’ মধ্যে যে বিরোধ ও উত্তেজনা, তার নিরসন ঘটাতে চায় না। বরং এই বিরোধ ও উত্তেজনার ইতিবাচক, বিশেষ করে সৃজনশীল মাত্রা উপলব্ধিতে মেয়েদের সিনেমা আগ্রহী।
স্টার ও রিসেপশন থিওরি
‘মেয়েদের সিনেমা’র একটি মূল বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে জনপ্রিয় অভিনেত্রীকে বেদনাদীর্ণ অথবা মারমুখী চরিত্রে দেখানোর প্রবণতা রয়েছে। যদিও সিনেমায় নারী চরিত্র একটি নির্মিত ইমেজ, এই বিশ্বাস প্রবল তবু মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে সিনেমার বিশেষ কোনো প্রেক্ষিতে স্টার চরিত্রের তাৎপর্যবহনকারী, ইফেক্ট সম্বন্ধে নারীবাদী ব্যাখ্যা বা তত্ত্ব কিছুই বলে না। কীভাবে স্টার সম্বন্ধে পূর্ব ধারণা সিনেমার টেক্সট ও দর্শকের ভেতরকার আন্তসম্পর্ক নির্ধারণ করে, সে সম্বন্ধেও কিছু বলা হয় না। এই উপেক্ষার কারণ হিসেবে নারী চরিত্র ও স্টার সম্বন্ধে প্রচলিত সাংবাদিক প্রতিবেদন ও সমালোচনার পদ্ধতি আংশিক দায়ী বলে মনে করা হয়েছে। অন্য যে কারণ তা হলো, আদর্শবাদের সঙ্গে শনাক্তকরণ ও নারীকে পুরুষের ‘ফেটিশ’ হিসেবে দেখার ব্যাখ্যায় সম্প্রসারণ।
‘কালচারাল স্টাডিজ’ নামে পরিচিত শিক্ষার বিষয়ের জনপ্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গে সিনেমার বিশ্লেষণে টেক্সটের (ন্যারেটিভ) ঊর্ধ্বে সিনেমার সামাজিক অর্থ এবং সিনেমার ইতিহাসে প্রাতিষ্ঠানিক আলোচনা (ডিসকোর্স) ও রিসেপশন স্টাডিজও সিনেমায় স্টার হিসেবে ব্যবসা দেখার ও অনুশীলনের ভিত্তি সূদৃঢ় করেছে। প্রেক্ষিতের এই পরিবর্তনের ফল হয়েছে তাৎক্ষণিক : অভিনেত্রীকে স্টার হিসেবে দেখার ফলে অ্যাপারেটাস থিওরি অনুযায়ী প্রজেকশন প্রক্রিয়াতেই আনন্দপ্রাপ্তির ভিত্তিতে সিনেমার জনপ্রিয়তা, এই বিশ্বাস গ্রহণ কষ্টকর হয়। সিনেমার প্রতি এই দৃষ্টিভঙ্গি নারীবাদীদের কাছে বেশ আকর্ষণীয়, কেননা এখানে সিনেমাশিল্পে অভিনেত্রীদের মধ্যে যারা ‘স্টার’ তারাই প্রভাবশালী হলেও তাদেরকে আদর্শবাদের ভিত্তিতে নারীত্বের সবচেয়ে তাৎপর্যময় প্রকাশ হিসেবে দেখা হয় না। অন্যদিকে তাদের অনুরাগী (ফ্যান) হিসেবেই সাধারণ নারী দর্শককে বর্ণনা করা হয়। এর ফলে কামনার প্রকাশে এবং দর্শকের ভূমিকা থেকে মেয়েদের বাদ দেওয়া হয়েছে, এই ধারণাকে পরিত্যাগ অথবা পুনর্বিবেচনা করতে হয়। বিভিন্ন শ্রেণির (জার) সিনেমার মতোই ‘স্টার’ অভিনেত্রী মেয়েদের অচরিতার্থ বাসনার পূরণে কল্পিত সমাধান দেয়, অন্তত এই ব্যাখ্যা গ্রহণ করতে বলা হয়।
সমালোচকরা সিনেমার বিভিন্ন অংশে স্টার অভিনেত্রীর ইমেজকে বিভিন্ন ভঙ্গিতে দেখার সঙ্গে সঙ্গে ফিল্ম পোস্টার, বিলবোর্ড, ফিল্ম ম্যাগাজিন, এমনকি বিশেষ অনুষ্ঠানে দেখার সুযোগ পান। এঁদের মধ্যে কোনো কোনো স্টার অভিনেত্রী বেশ স্বাধীনচেতা এবং নিজের শর্তেই ইমেজ তৈরি করার জন্য ভূমিকা রাখেন। পুরনো স্টার অভিনেত্রীদের মধ্যে ক্যাথারিন হেপবার্ন, বেটি ডেভিস এবং নতুনদের মধ্যে সুসান সারানডন, জুডি ফস্টার, শ্যারন স্টোন এঁদের নাম করা যেতে পারে, যাঁরা নারী হিসেবেই ইমেজ তৈরি করে রুপালি পর্দায় এসেছেন। তাঁদের অভিনীত ভূমিকার পেছনে কখনো কাহিনি বা উপন্যাসের অবদান রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিনেত্রীর ব্যক্তিত্ব তাঁর অভিনয়ে এমন প্রভাব বিস্তার করে যে সেটি একটি বিশেষ স্টাইল হয়ে যায়। যেমন, বেটি লেভিসের অস্থিরচিত্ততা অথবা প্রাধান্য বিস্তারকারী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। সাম্প্রতিককালের অভিনেত্রী শ্যারন স্টোন সম্বন্ধেও তা-ই বলা চলে। অন্যদিকে গ্রেটা গার্বো ও মার্লিন ডিয়েট্রিচ রহস্যময়তার আবহ সৃষ্টিতে দক্ষতার জন্য তাঁদেরকে বিশেষ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী বলে মনে করা হয় এবং দর্শক তাঁদের অভিনীত চরিত্রে তেমনভাবেই দেখতে আশা করে। রিসেপশন থিওরি যা শিল্প (সিনেমা) সৃষ্টির প্রক্রিয়া নয়, শিল্প সৃষ্টির পরবর্তী সময়ে ফলাফলের ওপর দৃষ্টিপাত করে, স্টার অভিনেত্রীকে বিভিন্ন প্রেক্ষিতে দেখতে সাহায্য করে। অর্থাৎ স্টার অভিনেত্রীর এই ইমেজ রিসেপশন থিওরির অন্তর্ভুক্ত হয়। অন্যদিকে কেউ কেউ শক্তিশালী ও প্রভুত্ব বিস্তারকারী স্টার অভিনেত্রীর মধ্যে লেসবিয়ানিজমের ইঙ্গিতও পেয়েছেন। এর ফলে অজ্ঞাতনামা হলেও ১৯৩০-এর দশকেই যে লেসবিয়ানিজম সিনেমায় প্রতিনিধিত্ব পেয়েছে, এই দাবি করা হয় (মার্লিন ডিয়েট্রিচের ছবি দ্রষ্টব্য)। কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেত্রীদের স্টার ইমেজকে (লেনা হর্ন এবং অধুনা হেল বেরি) দুই বর্ণের অন্তর্গত যৌনতার অভিব্যক্তি হিসেবে দেখেছেন অনেকে। এইভাবে একটি বহুবর্ণের সমন্বয়ে তৈরি জাতি (যেমন, আমেরিকা) তার জাতীয় স্বরূপ চিহ্নিত করে বলে মনে করা হয়। এর মধ্যে বিরোধী অবস্থান নিয়ে কৃষ্ণাঙ্গ দর্শক শ্বেতবর্ণের পুরুষ চরিত্রকে দেখার সুযোগও পায়। যেমন মিট ডরোথি ড্যানড্রিজ বায়োপিকে হেল বেরির অভিনয়। সিনেমায় স্টার অভিনেত্রীর ইমেজে যে নিয়ম-সংকেত (কোড) আবিষ্কার করা যায় এবং তার ভিত্তিতে সিনেমার ভাষার বিশেষ অর্থ স্পষ্ট হয়, এই আলোচনা তার প্রতি দৃষ্টিপাত করে।
স্টার অভিনেত্রীর আলোচনায় মনস্তাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক উভয় বিবেচনাই অন্তর্ভুক্ত, যার জন্য এই বিষয়টি সাম্প্রতিক নারীবাদী ফিল্ম স্টাডিজের অংশ হিসেবে দেখা যায়। স্টার অভিনেত্রীর ইমেজ নারীবাদী সিনেমাতত্ত্বে যেসব ভিত্তিতে প্রাসঙ্গিক তার মধ্যে রয়েছে : (ক) ভোক্তার সংস্কৃতিতে সিনেমার ভূমিকা, (খ) সিনেমা প্রদর্শন এবং তার প্রতি প্রতিক্রিয়ার (রিসেপশন) ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা, (গ) প্রত্যক্ষ দর্শনের ভূমিকাকে নেগোসিয়েশনের প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা। ঐতিহাসিকভাবে সিনেমা ভোক্তা-সংস্কৃতির অংশ হিসেবে দেখা দেয়। দর্শক হিসেবে মেয়েদের এখানে প্রান্তিকীকরণের বিষয় বা ক্ষমতার সীমান্তে অবস্থিত বলে মনে করা হয় না, এমন বক্তব্য রেখেছেন কেউ কেউ। স্টার অভিনীত সিনেমায় নারীত্বকে পণ্যও মনে করা হয় না, যার ফলে অভিনেত্রী যেমন ক্ষমতাপ্রাপ্ত, তেমনই ক্ষমতাপ্রাপ্ত মনে হয় ভোক্তা হিসেবে নারী দর্শককে। এখানে ভোক্তা হলেও নারী দর্শক ক্ষমতার অধিকারীই থাকে, যে ক্ষমতা তারা পায় স্টার অভিনেত্রীর অভিনয় দেখে। এইভাবে দেখা হলে ‘মেয়েদের সিনেমায়’ ভোক্তা আলোচনা (কনজিউমারিস্ট ডিসকোর্স) কার্যকর হয়েও নারীর নিজেকে সংজ্ঞায়িত ও শনাক্ত করার শক্তিশালী প্রক্রিয়া মনে হবে। তার বাসনা চরিতার্থ করার উপায় হিসেবেও একে দেখা যাবে। ভোক্তা-সংস্কৃতির আলোচনার অধুনা জনপ্রিয় ভাষ্য, উত্তর-আধুনিকতার ভেতর লিঙ্গভিত্তিক প্রসঙ্গ অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। পোস্ট-মডার্ন সমাজের অনেক বৈশিষ্ট্যই (সমগ্রের বিপরীতে খন্ডাংশ, ইতিহাসের বিপরীতে শৈলী, গভীরতার বিপরীতে বহিরঙ্গ এবং উৎপাদনের বিপরীতে ভোগ) মেয়েদের অবস্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত মনে করা হয়েছে। আধুনিকতার যে দৃশ্যরূপ তার সঙ্গে শপিং মল, সিনেপ্লেক্স, হোম ভিডিও ইতাদি যুক্ত করা হলে এই তুলনা স্পষ্ট হবে। এইসব তুলনার কিছু ক্ষেত্রে মেয়েদের সপক্ষে শক্তি সঞ্চয় করা সম্ভব বলে কেউ কেউ মনে করেন। এর অর্থ হবে এই যে, উত্তর-আধুনিকতা পরিচিতির বিভিন্ন শ্রেণি অস্বীকার করলেও নারীবাদী আলোচনা অক্ষুণ্ণ রাখা সম্ভব।
সনাতনভাবে বাম রাজনীতি জনপ্রিয় রাজনীতিকে পুঁজিবাদের ষড়যন্ত্রমূলক নিয়ন্ত্রণ মনে করে ভোগের সঙ্গে নারীর নিষ্ক্রিয়তাকে সমান বলে ভাবে (ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল)। অন্যদিকে, নারীর আনন্দের ভিত্তিতে ভোগকে সন্দেহাতীতভাবে গ্রহণযোগ্য মনে করার মধ্যে কোনো বিরোধিতা (রেজিস্ট্যান্স) নেই। সাধারণভাবে বলতে গেলে নারীবাদী কালচার স্টাডিজ নারী দর্শককে মিথ্যা সচেতনতার শিকার মনে করে না, আবার তাদেরকে বিধ্বংসী ক্ষমতার অধিকারী বলেও ভাবে না। নারী দর্শক নেগোশিয়েট করে, এই কথার মধ্যে নারী দর্শক সিনেমায় যা দেখছে সেখানে কোড আবিষ্কার ও অর্থ উপলব্ধির ইঙ্গিত রয়েছে। এই নেগোসিয়েশন বিদ্যমান মুখ্য আদর্শবাদের ডোমিনান্ট আইডিওলজি সম্পূর্ণ মৈত্রীও নয়, আবার পরিপূর্ণ বৈরিতাও করে না। এই নিগোসিয়েশন নির্ভর করে দর্শকের সামাজিক-ঐতিহাসিক অবস্থান এবং যেসব আলোচনায় (ডিসকোর্স) সে অংশ নিতে পারে, তার ওপর।
গত তিন দশকের পর নারীবাদী ফিল্ম স্টাডিজ এখন একটি অ্যাকাডেমিক বিষয় হিসেবে পরিগণিত। এখানে মুখ্য সব মিডিয়াই (টেলিভিশন, সিনেমা) সমালোচনার মূল উপজীব্য কিন্তু ফিল্ম দেখে প্রতিক্রিয়া (রিসেপশন থিওরি) জানানোর তুলনায় মেয়েদের তৈরি সিনেমাকেই এখন মনে করা হয় স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে প্রধান বিরোধিতা এবং প্রতিহত করার কৌশল। সিনেমা নারীবাদকে দেখার একটি সমান্তরাল প্রক্রিয়া হিসেবে শুধু নয়, মেয়েদের তৈরি সিনেমাকে নারীবাদী তত্ত্বের অগ্রসরমাণতার ও রেফারেন্সের নির্ভরশীল উৎস বলেও বিবেচনা করা হয়।
মেয়েদের তৈরি সিনেমাকে মূলধারা ও বিকল্প ধারা অথবা জাতীয় সিনেমার সঙ্গে তুলনা করতে গেলে ফিল্ম তৈরির মালিকানা (অথরশিপ) এবং সিনেমার ইতিহাস লেখার মানদন্ড পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজন হয়। এই প্রসঙ্গে পদ্ধতিগত প্রশ্নও দেখা দেয় যেমন, নারীবাদী সিনেমার সংজ্ঞায় সমালোচকের ভূমিকা। এই সঙ্গে কিছু অনিবার্যতা (এসেনশিয়ালিজম) মেনে নিতে হয় যেমন, সব মেয়ে নির্মিত সিনেমাতেই অনিবার্য কিছু গুণ সাধারণ। মেয়েদের তৈরি সিনেমায় নারীবাদী ফিল্ম অনুশীলনের (স্টাডিজ) যেসব বিষয় এসেছে, তার সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা যেতে পারে।
মেয়েদের সিনেমা নিয়ে যখন চলচ্চিত্র উৎসবের শুরু হয় তখনই প্রথম জানা যায় এই কর্মসূচিতে (সিনেমা নির্মাণে) তাদের ভূমিকা ছিল কত পুরনো। এলিস গাই-ব্লাশকে মনে করা হয় প্রথম কাহিনি চলচ্চিত্রের নির্মাতা হিসেবে (১৮৯৬ সালে)। তিনি ফ্রান্সে কয়েকশ স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা তৈরি করেন এবং তারপর আমেরিকায় এসে বিশটির মতো পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবির কাজ শেষ করেন। লুই ওয়েবারও ছিলেন প্রথমদিকের নারী পরিচালক, চিত্রনাট্যকার এবং প্রযোজকদের একজন। তাঁর ব্যাপ্ত সৃষ্টি বিংশ শতকের প্রথম দিকের মধ্যবিত্ত নারীবাদী চিন্তার সঙ্গে সিনেমার বিবর্তনশীল সাংস্কৃতিক ভূমিকার সম্পর্কের ওপর আলোকপাত করে। মেলোড্রামার কাঠামোতে তিনি জন্মনিয়ন্ত্রণ ও জন্মনিরোধের মতো সামাজিক সমস্যা উপস্থাপন করেছেন। ব্লাশের মতো ওয়েবারও বিস্মৃতির ধূসরতায় হারিয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৭০-এর দশকে সিনেমার গুরুত্ব, রুচি ও শ্রেণির বিবেচনার প্রেক্ষিতে তার ভূমিকার ব্যাখ্যায় ওয়েবারের অবদান নারীবাদীদের দ্বারা পুনরাবিষ্কৃত হয়।
১৯৮০-এর দশকে পুরনো সিনেমা সংরক্ষণ এবং তাদের নতুন ব্যাখ্যা দেওয়ার যে সূত্রপাত হয় সেইসব উদ্যোগ নির্বাক যুগের সিনেমায় মেয়েদের অবদান বিশ্লেষণে নারীবাদীদের প্রচেষ্টাকে সহায়তা করেছে।
প্রচলিত ফিল্ম শাস্ত্রকে (ক্যানন) প্রশ্ন করে নারীবাদী ফিল্ম বিশ্লেষকরা নারীবাদী সাহিত্যের সমালোচনা থেকে স্রষ্টা (অথর) হিসেবে মেয়েদের এবং তাদের প্রভাব শনাক্ত করতে প্রয়াস পেয়েছেন। কিন্তু সাহিত্যের তুলনায় সিনেমার ইতিহাস যে কেবল স্বল্পকালের তা-ই নয়, এখানে স্রষ্টা (অথরশিপ) নির্ধারণও বেশ জটিল, কেননা সিনেমা অনেকের যৌথ প্রয়াস, বিশেষ করে হলিউডে। তাছাড়া পুঁজি ও প্রযুক্তির প্রাধান্য এবং বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যও এই ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে দেখা দেয়।
হলিউডের স্টুডিও পদ্ধতির আবির্ভাবের ফলে গত শতাব্দীর প্রথম দিকে মেয়েদের তৈরি সিনেমার স্রোতে ভাটা পড়ে। বাজারজাতকরণে এদের একচেটিয়া ভূমিকা মেয়েদের তৈরি সিনেমাকে গৌণ করে তোলে। হলিউডের সবাক সিনেমার যুগে যেসব মেয়ে চিত্রনাট্যকার অথবা স্টার হিসেবে অভিনেত্রী সৃজনশীল প্রভাব রাখে তাদের মাধ্যমে সিনেমার স্রষ্টা (অথরশিপ) ও পরিচালক, এই দুই ভূমিকার মিলনের ক্ষেত্রে একটি চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়ে যায়। হলিউডের স্বর্ণযুগে যেসব নারী পরিচালক (যেমন ডরোথি আরজনার ও ইভা লুপিনো), তাঁরা নারীবাদী সিনেমার ইতিহাস রচনায় ও সমালোচনায় কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেন। ক্লেয়ার জনস্টন দি ওয়ার্ক অফ ডরোথি আরজনার (১৯৭৫) বইতে তাঁর ‘উওমেন’স সিনেমা অ্যাজ কাউন্টার সিনেমা’ (১৯৭০) প্রবন্ধে সমালোচনা ও বিশ্লেষণের কাঠামোর (মডেল) ভিত্তিতে সিনেমার সামঞ্জস্যময় নারীবাদী অভিব্যক্তির পরিবর্তে মেয়েদের নিয়ে আলোচনা (ডিসকোর্স), এই বিষয়ের প্রতি বেশি মনোযোগ দেন। এইভাবে আরজনারের সিনেমায় (যেমন, ডান্স, গার্ল, ডান্স, ১৯৪০) নারী চরিত্র যেভাবে কামুক ও ফুর্তিবাজ দর্শকের দৃষ্টিকে একইভাবে ফেরত পাঠায় এবং তার ফলে যে পিতৃতান্ত্রিক আদর্শবাদে টেক্সচুয়াল ধারাবাহিকতা ছিন্ন হয়, সে-কথা উল্লেখ করেন। জুডিথ মেইন ১৯৯৪ সালে তাঁর লেখা ডাইরেক্টেড বাই ডরোথি আরজনার বইতে এই নারী সিনেমা নির্মাতার জীবনীভিত্তিক তথ্য দিয়েছেন এবং তাঁর সমকামিতার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন। এই ব্যাখ্যার ভিত্তিতে আরজনারের সিনেমা ‘পাঠ’ করা যায় এবং পরিচালক ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী হিসেবে ফিল্ম স্টাডিজে তাঁর ভূমিকা বিশ্লেষণ সম্ভব হয়। এই ধরনের নারীবাদী ফিল্ম সমালোচনার পাশাপাশি নিউ হলিউডে (অর্থাৎ সত্তরের দশক থেকে) মেয়ে পরিচালকরা কাজ করার সুযোগ একটু বেশি করেই পেতে শুরু করেন। স্টেফানি রথম্যান (স্টুডেন্ট নার্সেস, ১৯৭০) এবং অ্যামি হ্যাকারলিং (ফাস্ট টাইমস অ্যাট রিজেন্টস হাই, ১৯৮২ প্রচলিত) প্রথার বিরুদ্ধে গিয়ে নারীবাদী ছবি তৈরি করেন। একই সময়ে বেশকিছু নারী পরিচালক ডকুমেন্টারি তৈরি থেকে ফিচার ফিল্মের ক্ষেত্রে এসে কাজ শুরু করেন। এঁদের মধ্যে মীরা নায়ারকেও
অন্তর্ভুক্ত করা যায় (মিসিসিপি মসালা, ১৯৯২)। অনেকে মনে করতে শুরু করেন যে এঁদের আবির্ভাবের ফলে নারীবাদী সিনেমা হলিউডের মূলধারায় যুক্ত হবে। হলিউডে না হলেও ভারতবর্ষে অপর্ণা সেনের নারীবাদী সিনেমা যে আপস না করেই মূলধারার অংশ হয়ে গিয়েছে তা এখন বেশ জোর দিয়ে বলা যায়।
ইউরোপে আর্ট ফিল্ম তৈরির যে ধারা সৃষ্টি হয় সেখানে বেশকিছু মহিলা পরিচালকের উল্লেখ করা যায়। এই অঁতর পরিচালকরা বাণিজ্যিক সিনেমা বা জনপ্রিয় নিম্নমানের রুচির সঙ্গে আপস করতে চাননি, যেমন করেছেন মূলধারার অন্তর্ভুক্ত কোনো কোনো মেয়ে পরিচালক। কিন্তু এইসব অঁতর পরিচালকের সিনেমাকে ‘নারীবাদী’ অভিধায় বর্ণনা করা যায় না। অবশ্য এই জন্য তাঁদের কাজ যে নারীবাদী সমালোচকদের কাছে পছন্দের নয় তা বলা যাবে না। এই প্রসঙ্গে দৃষ্টান্ত হিসেবে লেনি রেইফেনস্টালের উল্লেখ করা হয়। তিনি নাৎসি জার্মানিতে থার্ড রাইখের ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি করেন। সুসান সনটাগ তাঁর ফ্যাসনেটিং ফ্যাসিজম (১৯৭২) রচনায় রেইফেনস্টালের ছবিতে অপরিবর্তনীয় এবং পূর্বাপর সামঞ্জস্যময়ভাবে ফ্যাসিবাদী নন্দনতত্ত্বের উপস্থিতি বিশ্লেষণ করেছেন। এই নান্দনিকতা তাঁর ট্রায়াম্প অফ দি উইল, (১৯৩৫) ডকুমেন্টারিতে যেমন রয়েছে, ১৯৬০-এর দশকে আফ্রিকার ওপর তোলা ছবির ক্ষেত্রেও দেখা যায় একইভাবে। সুসান সনটাগের লেখার ভিত্তিতে রেইফেনস্টালের ব্যক্তিত্বের পরিচয়ও বিশদ হয়ে ওঠে। ‘নারী শিল্পী’ হিসেবে রেইফেনস্টাল ইতিহাস ও রাজনীতির ঊর্ধ্বে এবং সিনেমায় নারীর প্রতিনিধিত্ব বিচারের জন্য যেসব কোড ব্যবহার করা হয় সেই একই মানদন্ড তাঁর ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা যায় বলে সনটাগ মনে করেন। আর্ট ফিল্মের শাখাতেই জনস্টন ফরাসি নিউওয়েভ ফিল্ম পরিচালিকা অ্যাগনেস ভার্দার সিনেমাকে এই জন্য সমালোচনা করেছেন যে, সেখানে নারী চরিত্রকে একইসঙ্গে রহস্যময়ী ও শিশুসুলভ চরিত্রের সমতুল্য করে দেখানো হয়েছে। পুরুষের কাছে যৌনতার প্রতীক হিসেবেও তাদের ভূমিকা সমালোচিত হয়েছে (জনস্টন, ক্লেয়ার, ‘উওমেন’স সিনেমা অ্যাজ কাউন্টার সিনেমা’, ১৯৭৩)। ইতালিয়ান পরিচালিকা লিলিয়ানা কাভানির ছবি নারীবাদীদের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে পুরুষ চরিত্রকেই প্রাধান্য দিলেও কাজা সিলভারম্যান দেখিয়েছেন যে সতর্ক হয়ে দেখলে (পাঠ করলে) এইসব ছবি যে পিতৃতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাকে ভেঙে দিয়ে স্রষ্টার (অথর) দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত প্রক্ষেপণ করে সে বিষয়টি স্পষ্ট হয় (সিলভারম্যান, কাজা, ‘দি ফিমেল অথরিয়াল ভয়েস’, ১৯৮৮)। হাঙ্গেরির পরিচালিকা মার্তা মেসথারোস একেবারে ভিন্ন শ্রেণিতে পড়েন। তাঁর ফিচার ফিল্মে অঁতর ফিল্মের স্বাধীন পরিচিতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পশ্চিম ইউরোপের নারীবাদী ধারণা ও ফিল্ম স্টাডিজের সূত্র। কারো কারো মতে অঁতর শ্রেণির মেয়ে পরিচালকদের কাজ ও সাফল্য সমসাময়িক রাজনীতি, ইতিহাস ও জাতীয় প্রেক্ষিতেই বিচার করতে হবে, ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত হিসেবে নয়।
মূলধারায় বাণিজ্যিক সিনেমা এবং অঁতর শাখার ‘স্বাধীন’ সৃষ্টি, যেখানে মেয়ে পরিচালকরা মোটামুটি সক্রিয় তার পাশাপাশি তৃতীয় ধারার সিনেমাও রয়েছে, যা এই দুই শ্রেণির কোনোটিরই অনুসরণ করে না। ওয়ান ওয়ে অর অ্যানাদার (১৯৭৭) নামে যে সিনেমা তৈরি হয় সেটি ব্রেখটের তত্ত্বের ভিত্তিতে উত্তর-ঔপনিবেশিক নারীবাদী সিনেমার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বলে মনে করা হয়। এই সিনেমায় রোমান্টিক সম্পর্কের বর্ণনায় দ্বন্দ্বমূলক গঠন রয়েছে আর অর্থনীতির বিশ্লেষণে এইখানে ব্যবহৃত হয়েছে ডকুমেন্টারি পদ্ধতি। যৌনতার ভিত্তিতে যে রাজনীতি এই প্রক্রিয়ায় তাকে সামাজিক পরিবর্তনের অপরিহার্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করে সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজনের প্রতি জোর দেয়। তৃতীয় ধারার ছবি বেশিরভাগ তৃতীয় বিশ্ব থেকেই এসেছে। কিন্তু এইসব ছবি, তাদের নির্মাতা ও চরিত্রদের বিশ্লেষণে ইউরোপকেন্দ্রিক ফিল্ম সমালোচনার মানদন্ড ব্যবহার করা হলেও যে বিশেষ প্রেক্ষিত থেকে বিশেষ করে মুক্তির সংগ্রামের ভিত্তিতে তাদের ধারণা ও নির্মাণ, তা ভুলে থাকবার উপায় নেই। নারীবাদী, মার্ক্সিস্ট ও ঔপনিবেশিকবিরোধী ফিল্ম সবসময়ই সমার্থক হয়নি বলে এই সাধারণীকরণের বিরুদ্ধে সচেতন থাকা প্রয়োজন।
আভাঁ গার্দ
আভাঁ গার্দ সিনেমা পুরুষ ও মেয়ে উভয় পরিচালকের জন্যই প্রচলিত সিনেমার অনেক নিয়মকানুন ও প্রথা ভাঙার সুযোগ ও স্বাধীনতা দিয়েছে। অঁতর সিনেমার প্রকৃষ্ট উদাহরণ আভাঁ গার্দ শ্রেণিতেই দেখা যায়। নারীবাদী দৃষ্টিকোণ বিবেচনা ছাড়াও নারীবাদী ফিল্ম ক্রিটিকসদের জন্য বিকল্প সিনেমার ভাষার সন্ধান দিয়েছে। ফরাসি দেশীয়া জামেই দুলাককে প্রথম নারীবাদী পরিচালিকা মনে করা হয়। তিনি ফরাসি দেশের আভাঁ গার্দ আন্দোলনে তাত্ত্বিক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর তৈরি বিমূর্ত বর্ণনামূলক বা কাহিনিভিত্তিক এবং ডকুমেন্টারি সিনেমা বেশ খ্যাতি লাভ করে। ছবিতে তিনি প্রথাগত বর্ণনার সঙ্গে নিরীক্ষামূলক আঙ্গিকও ব্যবহার করেন। স্যান্ডি ফ্লিটারম্যানের মতে, দুলাক তাঁর সিনেমায় মেয়েদের বাসনা প্রকাশের জন্য নতুন ভাষা উদ্ভাবনেরও চেষ্টা করেছিলেন। অপরদিকে রাশিয়ায় জন্মগ্রহণকারী মায়া ডেরেনকে আমেরিকান সিনেমায় আভাঁ গার্দ শাখার পথিকৃৎ মনে করা হয়। ১৯৭০-এর দশকে আমেরিকা ও কানাডায় মেয়েদের সিনেমায় নিরীক্ষাধর্মী সিনেমার যে নারীবাদী দৃষ্টিকোণ, তার পেছনে ডেরেনের প্রভাব দেখতে পেয়েছেন অনেকেই। কিন্তু আভাঁ গার্দ সিনেমা মেয়েদের সিনেমা তৈরির ক্ষেত্রে যথেষ্ট স্বাধীনতা এনে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এখানে ব্যক্তিগত চিন্তাচেতনার প্রাধান্য সবসময় সামাজিক-রাজনৈতিক সমালোচনার অনুকূল নাও হতে পারে বলে কেউ কেউ মনে করেন। এর ফলে দর্শকদের সঙ্গে তাৎপর্যপূর্ণ সম্পর্কও স্থাপিত হতে পারে না বলে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। এটা অবশ্য বলার অপেক্ষা রাখে না আভাঁ গার্দ যে-কোনো শিল্পে স্রষ্টার সৃজনশীল প্রবণতাই মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এই শ্রেণির সিনেমা যেমন খুব কম খরচে এবং স্বাধীনভাবে নারীবাদী চিন্তাচেতনার বাহন হতে পারে, একইসঙ্গে ‘শিল্পের জন্য শিল্প’, এই আদর্শের ভিত্তিতেও তৈরি হতে পারে।
নারীবাদী ফিল্ম থিওরিতে মেয়েদের তৈরি যেসব সিনেমা সবচেয়ে উল্লিখিত হয়েছে তাদেরকে ‘কাউন্টার সিনেমা’ বা বিপরীত ধারার সিনেমা নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এইসব সিনেমায় প্রতিনিধিত্ব করার পদ্ধতিতে নারীর ভাবমূর্তির (ইমেজ) যে কেন্দ্রীয় ভূমিকা, তার প্রসঙ্গে প্রশ্ন রাখা হয়েছে। যেমন, সম্পাদনায় সিনেমার তাৎপর্যময়তা প্রতিষ্ঠিত করা অথবা শব্দ ও দৃশ্যরূপের (ইমেজ) সম্মিলন ঘটানো, বর্ণনার যৌক্তিকতা তৈরি সিনেমা দেখার প্রক্রিয়া ও শনাক্তকরণ পদ্ধতি, এইসব সম্পর্কে প্রচলিত নিয়ম ও রীতি। ‘বিপরীত ধারার সিনেমা’ ফরাসি নারীবাদী লেখিকা যেমন, হেলেন সিক্সো-জুলিয়া ক্রিস্টেভা ও লুসি ইরিগেরের নারীবাদী চিন্তাচেতনা ও ধারণার সঙ্গে যুক্ত বলেও মনে করা হয় বিশেষ করে নারীর লেখা (‘ফেমিনিন রাইটিং – এক্রিচার ফেমিনিন’) সম্পর্কে তাঁদের ধারণার সঙ্গে। লরা মেলভে এবং পিটার উলেন ফ্রয়েড ও লাকাঁর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে সিনেমার যে মাতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণের অনুসন্ধান করেছেন, সেটিও বিপরীত সিনেমার শনাক্তকরণে সহায়ক বলে মনে করা হয়। বিপরীত সিনেমার সব মেয়ে পরিচালকই নারীদেহের বর্ণনায় বিশেষ বাক্য গঠন বা ভাষা নির্মাণে ও তার বিশদীকরণে নিবেদিত, এই কথার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। আমেরিকায় প্রকাশিত ক্যামেরা অবসকিউরা নামে নারীবাদী ফিল্ম জার্নালে সিনেমায় মেয়েদের জন্য উপযোগী ভাষা, বাসনা ও পরিচিতি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে।
ডকুমেন্টারি
আভাঁ গার্দের চেয়েও যে সিনেমা শ্রেণি (ক্যাটেগরি) মেয়েদের অংশগ্রহণে সবচেয়ে বেশি অনুকূল, প্রভাবশালী ও বিস্তৃত পরিসরসম্পন্ন, তা হলো ডকুমেন্টারি। এই শাখাতেই নারীবাদী সিনেমা নির্মাতারা প্রথম প্রবেশ করে এবং নারীসহ অন্যান্য শিক্ষানবিশি সিনেমানির্মাতা যেমন, সংখ্যালঘু গোষ্ঠী, কৃষ্ণাঙ্গ, এদের জন্য এই শ্রেণির সিনেমা বেশ সহজলভ্য হয়। ১৯৭৪ সালে ন্যাশনাল ফিল্ম বোর্ড অফ কানাডা ‘স্টুডিওডি’ নামে মেয়েদের ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরির ইউনিট প্রতিষ্ঠা করে। এই ইউনিট থেকে নারীদেহ নিয়ে বিজ্ঞাপনসহ যে ব্যবসা, তার বিরুদ্ধে অনেক ডকুমেন্টারি তৈরি করেছেন মেয়ে পরিচালকরা। এইসব সিনেমা তৈরি বাস্তবতার ভিত্তিতে ইন্টারভিউয়ের সাহায্যে মেয়েদের বক্তব্য রাখা ও ইতিহাস বর্ণনায় সুযোগ এনে দিয়েছে। এর ফলে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাই যে রাজনৈতিক মন্তব্য হয় বা হতে পারে, এই সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সচেতনতা সৃষ্টি করে সামাজিক পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে দর্শকদের কাছে বোধগম্য হওয়া এবং প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিতে সফল হওয়ার জন্য এই ধরনের ডকুমেন্টারি সিনেমার বক্তব্য সহজভাবে উপস্থাপনার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কোনো বিশেষ সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এই সিনেমার ভূমিকা অনস্বীকার্য। তবে এইসব ছবি তৈরি করতে গিয়ে এক ধরনের অতি সহজ বাস্তবতার ব্যবহার করা হয়, যা ছবি তোলা ও সম্পাদনার ক্ষেত্রে যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে থাকে সেসব কারিগরি দিক প্রচ্ছন্ন থেকে যায়। কিন্তু জুলিয়া লেমেনোর মতো ফিল্মতাত্ত্বিক মনে করেন নারীবাদী ডকুমেন্টারি ফিল্মে যে রাজনৈতিক-নান্দনিক মাত্রার যুগল প্রকাশ, তার ভিত্তিতে দৈনন্দিন জীবনে নারীর মূর্তিকে (আইকনোগ্রাফি) যেভাবে প্রতিনিধিত্ব করা হয়, মূলধারার সিনেমায় বা মিডিয়ায় তা অনুপস্থিত (‘দি পলিটিকাল এসথেটিকস অফ দি ফেমিনিন ডকুমেন্টারি ফিল্ম’, ১৯৯০)।
প্রগতিশীল সিনে পত্রিকা জাম্প কাটে মিশেল সিট্রোন ডটার রাইট ডকুমেন্টারি ফিল্মে যে তাৎক্ষণিকতার আবহ এবং দর্শকের শনাক্ত করার অনুকূল আবেদনসম্পন্নতার গুণ রয়েছে, তা উল্লেখ করার পর ফর্ম সম্বন্ধে প্রশ্ন তুলেছেন। এখানে ‘সিনেমা ভেরিতে’ পদ্ধতিতে ইন্টারভিউয়ের পাশাপাশি দুই ভগিনীর লেখা ডায়েরির অংশ এবং গৃহস্থালির দৃশ্য দেখিয়ে মা ও মেয়েদের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করার চেষ্টা রয়েছে। পরিচিতির (ক্রেডিট) অংশ পড়ার পরই দর্শক বুঝতে পারে যে ইন্টারভিউ স্বতঃস্ফূর্ত নয়, চিত্রনাট্যের ভিত্তিতে সেটি ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু সিনেমায় আত্মজৈবনিক বর্ণনায় এবং অভিন্ন অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে যে আবেগের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি শোনা যায় তার ফলাফল এতে করে ক্ষুণ্ণ হয় না। ডটার রাইটকে বলা হয়েছে সংকর শ্রেণির ডকুমেন্টারি (হাইব্রিড), কেননা এখানে রয়েছে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ, বিভিন্ন মাত্রার স্বর ও ফিল্মের ভাষা (ইডিয়ম)। এই বৈচিত্র্যময়তা নারীর তৈরি ডকুমেন্টারি, বিশেষ করে কৃষ্ণাঙ্গ বা এশিয়ান মেয়েদের প্রতিনিধিত্বের জন্য বেশ অনুকূল বলে বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে। এর ফলে এই শ্রেণির সিনেমার প্রতি সমালোচনার পদ্ধতি ও ধরনও বদলাচ্ছে। সনাতন দৃষ্টিতে অন্যের প্রতি (আদার) নৃ-গোষ্ঠী-সম্পর্কিত (এথনোগ্রাফি) সিনেমা যেভাবে দৃষ্টি দিয়েছে, সংকর শ্রেণির ডকুমেন্টারির ওপর ভিত্তি করে যেসব তত্ত্ব তৈরি হয়েছে সেখানে সেই দৃষ্টিভঙ্গির যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। ফলে সংকর শ্রেণির নির্মাতা ও নৃতাত্ত্বিকদের কাজে প্রচলিত পদ্ধতিতে যেভাবে অন্যকে (আদার) দেখা হয়েছে সেসব বিশ্বাস না করে তাদের ভিত্তি ও প্রমাণাদি সম্পর্কে প্রশ্ন রাখা হয়েছে। ফিল্ম স্টাডিজে এই ধরনের নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গি যোগ করার কৃতিত্ব ভিয়েতনামিজ-আমেরিকান সিনেমা নির্মাতা ও তাত্ত্বিক, ট্রিন মিন হা পেতে পারেন। তাঁর নির্মিত এসেমব্লেজ ডকুমেন্টারিতে ইমেজের উপস্থাপনা করা হয়েছে অপ্রচলিত ফ্রেমের ভেতর (যেমন পাশাপাশি কয়েকটি পরস্পরবিচ্ছিন্ন ফ্রেমে নারীর মূর্তি) এবং সম্পাদনাও নিরবচ্ছিন্ন নয় অর্থাৎ অসমান। কিন্তু এখানে তাঁর উদ্দেশ্য সেনেগালের মেয়েদের সম্বন্ধে বলা নয়, নিকট থেকে বলা (স্পিক নিয়ারবাই)।
ভিডিওর সহজলভ্যতা এবং স্বল্পমূল্যের জন্য মেয়ে পরিচালকদের পক্ষে এখন আন্দোলনভিত্তিক ডকুমেন্টারি তৈরি সহজ হয়েছে। কেবল শ্বেতাঙ্গ নয়, কৃষ্ণাঙ্গ ও লেসবিয়ান পরিচালকরা ১৯৮০-এর দশকের পরিচিতিমূলক রাজনীতি নিয়ে যে আলোচনা হয়েছে ডকুমেন্টারিতে তার প্রতিনিধিত্ব করতে পারছেন এবং বেশ স্বাধীনভাবে ও বিপুল সংখ্যায়। প্রযুক্তির এই অনুকূল পরিবর্তনে যৌন আবেদনমূলক ছবিও মেয়ে পরিচালকরা মেয়েদের জন্য তৈরি করেছেন, কিন্তু মেয়েদের তৈরি ডকুমেন্টারি সিনেমার পরিধি বিস্তৃত হওয়ার সঙ্গে ১৯৮০-এর দশকের শুরু থেকেই সিনেমার নারীবাদী তত্ত্ব এবং তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিশেষ ধরনের সিনেমা তৈরির মধ্যেকার পারস্পরিক সম্পর্ক শিথিল হতে শুরু করে। এর কারণ নারীবাদী ফিল্ম স্টাডিজের বহুমুখী হয়ে যাওয়া এবং তার বিভিন্ন পরিণতি লাভ করা। এর ফলে অবশ্য এই শ্রেণির সিনেমার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। কারো মতে সিনেমার ভাষার প্রসঙ্গে মহিলা সিনেমা পরিচালকদের ভূমিকা প্রাসঙ্গিক হয় ১৯৭০ এবং ১৯৮০-এর দশকের প্রথম দিকে টেক্সটের বিশ্লেষণের প্রতি সিনেমাতত্ত্বে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য। অর্থাৎ এই সময়ে প্রচলিত অথবা আধুনিকধর্মী সিনেমায় কাহিনিই প্রাধান্য পেয়েছে (টেক্সট)। কিন্তু এর পরবর্তী সময়ে উত্তর-আধুনিকতা, বহু-সংস্কৃতিবাদ ও কালচারাল স্টাডিজ জনপ্রিয় হওয়ার ফলে প্রেক্ষিত (কনটেক্সচুয়াল) এবং স্থানীয় পরিবেশের বিশ্লেষণে মূলধারা ও নিরীক্ষা বা আধুনিকধর্মী, বিরোধিতা ও আত্তীকরণ, নির্মাণ ও গ্রহণ-প্রতিক্রিয়া, এইসব ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার সীমারেখা পুনর্নির্ধারিত হয়েছে। দৃষ্টিভঙ্গির এই পরিবর্তনের ফলে ফিল্ম সমালোচনার কাঠামো পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এর ফলে নারীবাদী সিনেমা-সংস্কৃতির ভেতর তত্ত্ব ও চর্চার মধ্যে একটা আদর্শবাদভিত্তিক বিভক্তি এসে গিয়েছে মনে করা যেতে পারে। কিন্তু এটা নারীবাদী আন্দোলনে শক্তির কারণও হতে পারে, কেননা এর ফলে ‘মেয়েদের সিনেমা’ ও নান্দনিক রূপের (ফর্ম) বিষয় বা সমস্যার নির্দিষ্টতাকে পুনর্বিবেচনা করা সম্ভব হয়। এই পুনর্বিবেচনায় কে এবং কার জন্য সিনেমা তৈরি করছে, কে এই সিনেমা দেখছে এবং মন্তব্য করছে, কীভাবে, কোথায় এবং কার জন্য এইসব আলোচনা মেয়েদের সিনেমার নির্দিষ্ট রূপ ও নান্দনিক পরিচিতি সম্বন্ধে যে পুনর্বিবেচনার সূত্রপাত করে তার ভিত্তিতে নারীবাদী চিন্তা ও ধারণা শক্তি সঞ্চার করতে পারে।
উপসংহার
নারীবাদী আন্দোলন একইসঙ্গে সব ধরনের মিডিয়াকে নিজের পক্ষে আনতে চেয়েছে এবং তাদের প্রতি প্রশ্নও রেখেছে। এই উভয়বিধ কৌশল গ্রহণ করে নারীবাদী ফিল্ম স্টাডিজ ক্রমে অ্যাকাডেমিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। প্রথম দিকে যেসব বিষয় বা ব্যাখ্যা নিয়ে বিতর্ক হতো যেমন, মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের উপযোগিতা, হলিউডি ফিল্মের বিশেষ সুবিধাজনক অবস্থান এবং যৌনতার ভিত্তিতে পার্থক্য, সেসব এখন তেমন বিতর্কিত না হলেও তার ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছে নতুন বিতর্ক ও আলোচনা। জনপ্রিয় সিনেমায় যে নারীবাদী কালচারাল স্টাডিজ সেখানে প্রগতিশীল টেক্সটকে সামাজিক প্রেক্ষিতেই (কনটেক্সট) দেখার প্রয়াস থাকে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, ফ্যাটাল অ্যাট্রাকশন, (১৯৮৭) এবং থেলমা অ্যান্ড লুইস, (১৯৯১) অথবা মনস্টারের, (২০০৪) মতো সিনেমা বিশ্লেষণ করা হয়েছে নারীবাদ সম্পর্কে সামাজিক দুশ্চিন্তা, সিনেমার শাখার মিশ্রণ (জাঁর মিক্সিং), জনপ্রিয় সমালোচনা এবং মেয়ে দর্শকদের আত্তীকরণের (অ্যাপ্রোপ্রিয়েশন) ভিত্তিতে। সিনেমায় প্রতিনিধিত্বশীলতা ও দর্শকের সাড়া প্রসঙ্গে যেসব স্টাডিজ বা তাত্ত্বিক আলোচনা সেখানে লেসবিয়ান তত্ত্ব পুরুষ ও নারীর যৌনজীবনভিত্তিক পরিচিতিতে নতুন ধারণাযুক্ত করেছে। এটা করতে গিয়ে মেয়েদের যৌনতার পরিচিতিকে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেলষণের ভিত্তিতে ব্যবহার করে অনির্দিষ্ট বা অস্থির দেখানো হয়েছে এবং একইসঙ্গে স্বাভাবিক যৌনতার প্রতি অনড় বিশ্বাসকেও সমালোচনা করা হয়েছে। বিভিন্ন দেশে সিনেমা দেখার যে অভিজ্ঞতা তার ভিত্তিতে এটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে ফিল্মের টেক্সট কেবল একটি নির্দিষ্ট বিষয় এবং দর্শকরা একই শ্রেণির (শ্বেতাঙ্গ ও পুরুষ), এই ধারণা গ্রহণযোগ্য নয়। ঠিকানায় রাজনীতি অর্থাৎ কে, কখন, কোথায় সিনেমা দেখছে, এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই বক্তব্য রেখে সমালোচক-দর্শক এবং মিডিয়ার মানুষ নতুন যুক্তি ও কৌশল দিয়ে হলিউডি সিনেমার কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছে। কখনো আপাতবিরোধী হলেও এই বিভিন্নমুখী পদ্ধতি, বিষয় ও আনুগত্যবোধ সমসাময়িক নারীবাদী ফিল্ম-সংস্কৃতিতে সৃজনশীল বৈচিত্র্যের বিকাশ ঘটিয়েছে।