logo

চলচ্চিত্রের নান্দনিকতা : মনস্তত্ত্বের ভাষা

হা স না ত  আ ব দু ল  হা ই

সিনেমায় মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ব্যবহার পুরনো এবং বেশ জটিল। ফ্রয়েডের সময় থেকেই এর ব্যবহার শুরু। সিনেমা থেকে ফ্রয়েড তাঁর বেশ কিছু ধারণা লাভ করেছিলেন এবং তাদেরকে পরিণত রূপ দিয়েছিলেন। যেমন, তাঁর ক্যাস্ট্রেশন থিওরির ব্যাখ্যায় তিনি সিনেমার বিশেষ ইমেজের উল্লেখ করেছেন। ১৯৭০-এর পর থেকে মনস্তাত্ত্বিক ফিল্ম থিওরির ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের সঙ্গে আলথুসারের মতাদর্শের (আইডিওলজি) তত্ত্ব, সেমিওটিকস এবং নারীবাদী তত্ত্ব সংশ্লিষ্ট হয়ে একে আরো জটিল করেছে। সত্তরের দশক থেকেই মাধ্যম হিসেবে সিনেমার ভূমিকা, দর্শক ও সিনেমার সম্পর্ক, এই সব বিষয় ব্যাখ্যার জন্য মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে পড়ে। ১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের বিরুদ্ধে সমালোচনা বৃদ্ধি পেলেও এর প্রভাব এমন থাকে, যার জন্য ফিল্ম থিওরি এবং ফিল্মের সমালোচনায় তার ভূমিকা বেড়েছে বই কমেনি।

যে শিল্প আন্দোলনে প্রথমে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ব্যবহৃত হয় সেটি ছিল পরাবাস্তববাদ (স্যুররিয়ালিজম)। এর সূচনা হয় ১৯২০-এর দশকে এবং এটি অগ্রসর হয় ১৯৩০-এর দশক পর্যন্ত এবং এই সময়ের পরিধিতে আন্দোলনটি প্রভূত জনপ্রিয়তা লাভ করে। পরাবাস্তববাদীরা ফ্রয়েডের স্বপ্ন ও অবচেতনের ধারণা এবং তত্ত্ব দ্বারা বেশ প্রভাবান্বিত হন। তাঁদের কাছে সিনেমার ভাষার কিছু অংশ যেমন, ডিসলভ, স্লো মোশন, সুপারইম্পোজিশন ইত্যাদি স্বপ্নের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তুলনীয়। পরাবাস্তববাদের প্রতিষ্ঠাতা আদ্রে ব্রেতোঁ সিনেমাকে দেখেছেন ভালোবাসা এবং মুক্তির জগতে প্রবেশের দ্বার হিসেবে। সিনেমায় পরাবাস্তববাদের অন্যতম প্রধান ব্যাখ্যাতা ও প্রয়োগকারী ছিলেন ল্যুই বুনুয়েল, যাঁর ‘অাঁ সিঁয়ে আন্দালু’ সালভাদর দালির সঙ্গে যৌথভাবে নির্মিত।

মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে সবাই অবশ্য ফ্রয়েডকে অনুসরণ করেননি। অনেকে কার্ল ইয়ুংয়ের মনস্তাত্ত্বিক ধারণা, বিশেষ করে ‘আর্কিটাইপ’ অর্থাৎ মূল আদর্শ বা আদি রূপতত্ত্ব দ্বারা বেশ প্রভাবান্বিত হয়েছেন। ‘আর্কিটাইপ’ এমন একটি ধারণা বা ইমেজ, যা মানুষের অস্তিত্বের কেন্দ্রে অবস্থিত এবং বংশানুক্রমে মানসিকভাবে নর-নারী উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়ে থাকে। আর্কিটাইপের মধ্যে রয়েছে সচেতনতার উলটোপিঠে থাকা আলোছায়ার জগৎ, পুরুষের মধ্যে নারীর বৈশিষ্ট্য (এডিমা) এবং নারীর মধ্যে পুরুষের বৈশিষ্ট্য (অ্যানিমাস)। আলবার্ট বেন্ডারসন (১৯৭৯), রয়াল এস ব্রাউন (১৯৮০) এবং ডন ফ্রেডারিকসন (১৯৮০), তাঁদের কিছু লেখায় ফিল্মে আর্কিটাইপের ব্যবহার সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন। কিন্তু ১৯৭০-এর দশকে ফিল্ম-তাত্ত্বিকরা ফ্রয়েড এবং লাকাঁর দিকেই বেশি ঝুঁকেছেন।

ফ্রয়েডের অনেক তত্ত্ব সিনেমার নান্দনিকতা সৃষ্টিতে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন, অবচেতন ও অবদমিতের প্রত্যাবর্তন, অডিপাল প্রবণতা, নার্সিসিজম, ক্যাস্ট্রেশন এবং হিস্টিরিয়া বা উন্মাদের মতো আচরণ। ১৯৭০-এর দশকের শেষে উত্তর-গঠনবাদী তত্ত্বের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সময়ে সিনেমায় ফ্রয়েডের তত্ত্বের সুশৃঙ্খল ব্যবহার দেখা যায়। বিশেষ করে ফিল্ম-তাত্ত্বিকরা ফিল্মের টেক্সটের আলোচনায় অডিপাল প্রবণতার ব্যবহার করেন। তাঁদের মতে, সিনেমায় সব বর্ণনাই (ন্যারেটিভ) অডিপাল প্রবৃত্তির গতিপথ অনুসরণ করে। অর্থাৎ সংকটে পড়ে পুরুষ নায়ককে সামাজিক স্বীকৃতির জন্য এবং ঈপ্সিত নারীকে পাওয়ার উদ্দেশ্যে অন্য একজন পুরুষ চরিত্রের ওপর (প্রায়ই পিতৃসম ব্যক্তিত্ব) প্রভুত্ব করতে হয়। এইভাবে সিনেমাকে দেখা হয়েছে পিতৃতাত্ত্বিক আদর্শকে প্রতিনিধিত্ব করার অন্যতম উপায় বা পন্থা হিসেবে।

১৯৭০-এর আগে এবং পরে সিনেমায় মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে প্রধান পার্থক্য ছিল এই যে, সত্তরের দশকের পরে সিনেমাকে দেখা হয়েছে প্রতিষ্ঠান বা মাধ্যম হিসেবে। এর আগে সিনেমার টেক্সটের ভেতর উহ্য অথবা চেপে রাখা অর্থের প্রতিই মনোনিবেশ করা হয়েছে বেশি। এই পর্বে এসে জাঁ লুই বদ্রি, ক্রিশ্চিয়ান মেৎজ এবং লরা মুলভে সিনেমায় মাধ্যম বা যন্ত্র (অ্যাপারেটাস), মতাদর্শের তাৎপর্যময়তা প্রকাশ, দর্শক-সিনেমা সম্পর্ক, দর্শককে গঠন ও নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।

১.  বেন্ডারসন, আলবার্ট, ‘অ্যান আর্কিটাইপাল রিডিং অফ জুলিয়েট অফ দি স্পিরিটস’ কোয়ার্টার্লি রিভিউ অফ ফিল্ম স্টাডিজ (১৯৭৯)।

২.  ব্রাউন, রয়াল, এস হিচককস স্পেনবাউন্ড, ‘ইয়ুং ভার্সাস ফ্রয়েড ফিল্ম’ সাইকোলজি রিভিউ (১৯৮০)।

৩.  ফ্রেডারিকসন ডন, ‘ইয়ুং/সাইন/সিম্বল/ফিল্ম’ কোয়ার্টার্লি রিভিউ অফ ফিল্ম স্টাডিজ (১৯৮০)।

১৯৭০ থেকে ১৯৯০-এর দশকে সিনেমার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ চারভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, যার মধ্যে সাদৃশ্য রয়েছে। প্রথমত, বদ্রি এবং মেৎজের যন্ত্র বা কৌশল (অ্যাপারেটাস) তত্ত্ব প্রভাব বিস্তার করেছে। তাঁদের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রকে প্রসারিত করার জন্য তাঁরা মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ব্যবহার করেছেন। গঠনবাদে (স্ট্রাকচারালিজম) সবকিছুকে সামগ্রিকভাবে দেখার যে শর্ত, এইভাবে তাঁরা তা এড়াতে চেয়েছেন। দ্বিতীয় ধারায় যে বিশ্লেষণ রীতি, সেখানে নারীবাদী ফিল্ম-তাত্ত্বিক লরা মুলভের ভূমিকা প্রধান। তিনি ফিল্মে নায়ককে অডিপাল প্রবণতার ভূমিকায় দেখা এবং দর্শক ও সিনেমার সম্পর্ককে একপেশে করে ভাবার জন্য বদ্রি এবং মেৎজের বিরুদ্ধে আপত্তি তোলেন। তৃতীয় ধারার সূত্রপাত হয় লরা মুলভের ধারণা সম্পর্কে কিছু নারীবাদী বক্তব্য থেকে। এই সব বক্তব্যই একরকম ছিল না। সাধারণভাবে এসব ছিল পুরুষত্ব, আত্মনিপীড়ন প্রবণতা (ম্যাসোকিজম), কল্পনা প্রবণতা (ফ্যান্টাসি থিওরি) এবং অডিপাল প্রবণতা ইত্যাদি সম্পর্কে সমালোচনামূলক আলোচনা। চতুর্থ ধারার অন্তর্গত ছিল সিনেমায় দর্শকতত্ত্ব (স্পেকটেটরশিপ) এবং মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের সঙ্গে অন্যান্য বিষয়ের আলোচনা। যেমন, পোস্ট-কলোনিয়াল থিওরি, সমকামিতা ইত্যাদি।

১৯৭০-এর দশকে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের প্রয়োগে সিনেমাকে যন্ত্র বা প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখার প্রবণতাই কেন্দ্রীয় ছিল। অবশ্য বদ্রি, মেৎজ এবং মুলভে সিনেমাকে নিছক ‘যন্ত্র’ (অ্যাপারেটাস) হিসেবে দেখেননি। মেৎজের মতে, সিনেমা ছিল যন্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে একটি মানসিক প্রক্রিয়াও, যা দর্শকরা ঐতিহাসিকভাবে আত্মস্থ করে নিয়েছে এবং যা দর্শকদেরকে সিনেমা উপভোগে অভ্যস্ত করে তুলেছে। সিনেমা ‘অ্যাপারেটাস’ বলতে তাই বোঝানো হয়েছে একই সঙ্গে শিল্প-কারখানার যন্ত্র এবং মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিক মাধ্যম।

জাঁ লুই বদ্রিই প্রথম মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণকে ‘প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে সিনেমার ব্যাখ্যায় ব্যবহার করেন। পরবর্তী সময়ে তাঁর ধারণাকে মেৎজ সমর্থন জানান, যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাঁর দ্বিমত ছিল। বদ্রি তাঁর ‘আইডিওলজিক্যাল ইফেক্টস অফ সিনেমাটোগ্রাফিক অ্যাপারেটাস’ (১৯৭৬) প্রবন্ধে বলেন যে, সিনেমা একটি আদর্শ সৃষ্টি করতে পারে বলেই এখানে মতাদর্শের (আইডিওলজি) ভূমিকা রয়েছে। এই আদর্শ সীমা অতিক্রমকারী (ট্রানসেনডেন্টাল) দেখবার বিষয়। এর দ্বারা তিনি বলতে চেয়েছেন যে, সিনেমা দর্শককে দৃষ্টিপথের কেন্দ্রে স্থাপন করে (চক্ষুষ্মান বিষয়ে)। ক্যামেরা-প্রজেক্টর, ইমেজের নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ, ন্যারেটিভ (যা ভারসাম্য রক্ষা করে), এই সবই দর্শককে সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতায়  ঐক্যের এবং নিয়ন্ত্রণের বোধ দেয়। সিনেমার ‘যন্ত্র’ দর্শককে সক্রিয় কেনদ্র এবং অর্থের উৎস হিসেবে স্থাপন করে। যেভাবে বাস্তবতার ধারণা সৃষ্টি করা হয়, সেটি প্রচ্ছন্ন রেখে সিনেমা দর্শককে এমন মনে করতে দেয় যে, ঘটনাগুলি যেন তার চোখের সামনে সহজে এবং সোজাসুজি ঘটে যাচ্ছে। বাস্তবতার এই ইফেক্টও প্রতিনিধিত্বময়তার কেন্দ্রে অবস্থিত।

বদ্রি সিনেমা দেখার সময় যা দেখা হচ্ছে, তার সঙ্গে একাত্ম হওয়া বা তা শনাক্ত করার প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করার জন্য জ্যাক লাকাঁর তত্ত্বের ব্যবহার করেছেন। তিনি বলেছেন যে, ‘দর্শক-সিনেমার পর্দার’ যে সম্পর্ক, তা লাকাঁর ‘কল্পিত’ জগতে প্রবেশে সাহায্য করে। এই কল্পিত জগতেই শিশু আয়নায় নিজেকে দেখে নিজের ঐকিক সত্তা সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা অর্জন করে। সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতায় যেসব বিভিন্ন উপকরণ বা অংশ যেমন, প্রজেক্টর, অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহ, পর্দা ইত্যাদি প্লেটোর গুহায় মিজ অাঁ সিঁ বা দৃশ্যকল্পের পুনঃসৃষ্টি করা ছাড়াও লাকাঁ আবিষ্কৃত মিরর স্টেজ (আয়নায় নিজেকে দেখে শিশুর প্রথম অভিজ্ঞতা) সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় পরিস্থিতি পুনর্গঠন করে।

লাকাঁর মতে, মানুষের উন্নয়নের ইতিহাসে তিনটি ক্রম (অর্ডার) রয়েছে – (ক) কল্পিত, (খ) প্রতীকী এবং (গ) বাস্তব। লাকাঁর তত্ত্বে কল্পিত এবং প্রতীকী, এই দুই ধারণা ১৯৭০-এর ফিল্মতত্ত্বে কেন্দ্রীয় ভূমিকা নেয়। মিরর স্টেজে শিশু যেমন আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে নিজেকে পরিণত, নিখুঁত এবং প্রাপ্তবয়স্ক ভাবে (যা প্রকৃত অর্থে সে নয়), তেমনি সিনেমা দেখার সময়ও দর্শক পর্দায় বাস্তবের চেয়ে বড় (অলীক) অথবা আদর্শায়িত চরিত্র দেখে মুগ্ধ হয়। মুলভের মতে, একইভাবে দর্শক নিজেকে গ্ল্যামারপূর্ণ অভিনেতা-অভিনেত্রীর সঙ্গে শনাক্ত করে এবং নিজের সত্তা সম্বন্ধে একটা ধারণা গড়ে তোলে। কিন্তু লাকাঁ বলেছেন, শিশু পূর্ণ পরিণত এমন সত্তা নয়, যে কেবল প্রতিফলিত ইমেজের ভিত্তিতে নিজেকে আদর্শায়িতরূপে দেখে। তার এই দেখা ভুল শনাক্তকরণ মাত্র, কেননা নিজেকে শনাক্তকরণের প্রক্রিয়াটি স্বনির্ভর নয়, অন্য কিছুর (আয়নার) মধ্যস্থতায় তা নিষ্পন্ন হয়। একইভাবে দর্শকও মুহূর্তের জন্য সিনেমা দেখতে দেখতে এমন এক পরিস্থিতি ও সময়ে প্রবেশ করে যখন সে স্থান-কাল উত্তীর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দর্শক সিনেমায় প্রতিনিধিত্বের কেন্দ্রবিন্দু অথবা তার উৎস নয়। বদ্রির মতে, সিনেমা দেখার সময় নিজের ঐক্যবদ্ধ সত্তা সম্বন্ধে দর্শকের যে ধারণা হয় তার উৎস দর্শকের মনে নয়, বরং যন্ত্র হিসেবে সিনেমার নির্মাণে বা সৃষ্টিতে। এইভাবে সিনেমার প্রতিষ্ঠান মতাদর্শের সঙ্গে জড়িত হয়ে যায় এবং সেইসঙ্গে রাষ্ট্র ও ধর্মের সঙ্গেও। নর-নারী (সিনেমার দর্শক) নিজেকে স্থান-কাল অতিক্রমকারী সত্তা হিসেবে ভ্রান্ত ধারণা গ্রহণ করুক, রাষ্ট্র এবং ধর্মও তাই চায়। ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত ‘দি অ্যাপারেটাস’ প্রবন্ধে বদ্রি প্লেটোর গুহা আর সিনেমার অ্যাপারেটাসের মধ্যে আরো সমান্তরাল তুলনা করেন। দুই ক্ষেত্রেই দর্শক (গুহায় বন্দি এবং সিনেমার দর্শক) অনড় এবং অচল। একদল (গুহায় যারা বন্দি) বাস্তবের ছায়া ও ইমেজ দেখছে, আর অন্য শ্রেণি (সিনেমা দর্শক) সিনেমার পর্দার সঙ্গে শৃঙ্খলে বাঁধা। দুই দলই বাস্তব দেখছে বলে মনে করে, কিন্তু তারা যা দেখে তা বাস্তবের অনুকরণ মাত্র। বদ্রির মতে, গুহার বন্দি মানুষ এবং সিনেমার দর্শক, উভয়ই যা চায় এবং সিনেমা যা দেয়, তা হলো এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক ঐক্যে (সাইকিক ইউনিটি) প্রত্যাবর্তন, যেখানে বিষয় ও বিষয়ীর মধ্যে সীমানা অন্তর্হিত।

সিনেমা এবং স্বপ্নের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ের পর বদ্রি জানান যে, সিনেমার পেছনে আরো একটি ইচ্ছা কাজ করে, যা প্লেটোর গুহায় বন্দিদের ইচ্ছার সম্পূরক। সচেতন না হয়েও দর্শক সিনেমার মতো যন্ত্র তৈরি করে, যা তার নিজের ক্রিয়া-প্রক্রিয়ারই প্রতিনিধিত্ব করে। দর্শক কিন্তু জানতে পারে না যে, সে নিজের কাছে সেই অবচেতনের দৃশ্যই প্রতিনিধিত্ব করছে, যেখানে সে নিজেই (তার সত্তা) রয়েছে।

১৯৭৫ সালে ক্রিশ্চিয়ান মেৎজ তাঁর সাইকো-অ্যানালিসিস অ্যান্ড সিনেমা : দি ইমাজিনারি সিগনিফায়ার গ্রন্থ প্রকাশ করেন, যেখানে প্রথম মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণকে সিনেমায় প্রয়োগ করা হয়। বদ্রির মতো মেৎজও সিনেমার পর্দা ও আয়নার মধ্যে তুলনা সমর্থন করেন এবং বলেন যে, সিনেমার যন্ত্র দর্শককে এমনভাবে সময়ের পরিধিতে স্থাপিত করে, যার ফলে প্রাক-অডিপাল পর্বের শনাক্তকরণ হয়ে যায়। অর্থাৎ শিশু যে মুহূর্তে নিজের কল্পিত পূর্ণাবয়ব এবং ঐক্যবদ্ধ ও সম্পূর্ণ সত্তা সম্বন্ধে ধারণা লাভ করে, সিনেমা তেমন মুহূর্ত সৃষ্টি করে দর্শককে একই ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জনে উদ্বুদ্ধ বা বাধ্য করে। মেৎজ অবশ্য একথাও বলেছেন যে, সিনেমা আর আয়নার তুলনার মধ্যে ত্রুটি আছে। আয়না যেমন একজন দেখছে তার প্রতিকৃতি প্রতিফলিত করে, সিনেমা তা করে না। তিনি আরো বলেন, সিনেমা যেখানে প্রতীকী পদ্ধতি, দর্শক এবং বাইরের পৃথিবীর মধ্যস্থতাকারী একটি তাৎপর্যময়করণ (সিগনিফাইং) প্রক্রিয়া, আয়নায় পর্ব সম্পর্কিত তত্ত্বের ক্ষেত্রে তা হয় না। আয়নার পর্ব তত্ত্ব সেই সময়ের কথা বলে যখন প্রতীক ছিল না। অর্থাৎ যখন শিশুর কোনো ভাষাই জানা ছিল না।

এই সমালোচনা সত্ত্বেও মেৎজ সিনেমার জন্য লাকাঁর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ তত্ত্বের গুরুত্বের উল্লেখ করেছেন এবং দর্শক-সিনেমার পর্দা, এই সম্পর্কটিকে তত্ত্বের কাঠামোতে আনার প্রতি গুরুত্ব দেন। শুধু কল্পিতের (ইমাজিনারি) প্রেক্ষিতে না, প্রতীকীর প্রেক্ষিতেও এর প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেছেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি লুকিয়ে দেখা (ভয়েরিজম), এই ধারণার সূত্রপাত করেন। যেহেতু সিনেমা দেখতে গিয়ে একটা দূরত্ব রাখতে হয়, সেই জন্য তিনি এই দেখার প্রক্রিয়াকে ‘ভয়েরিস্টিক’ আখ্যায়িত করেছেন। পর্দায় যা আছে সেই দৃশ্য দর্শকের প্রতি সাড়া দিয়ে কিছু দেখায় না। তার অস্তিত্ব স্বনির্ভর, যে জন্য লুকিয়ে দেখতে হয়।

মেৎজ আরো একটি ধারণার সূত্রপাত করেন, যা তাঁর গ্রন্থের উপ-শিরোনাম হয়ে যায় : ‘কল্পিত তাৎপর্যময়কারী’ (ইমাজিনারি সিগনিফায়ার)। তাঁর মতে যা অনুপস্থিত, সিনেমা তাকে উপস্থিত করে। সিনেমার দৃশ্যে এমন ইমেজ দেখানো যেতে পারে, যা সম্পূর্ণ মনে হয় কিন্তু এ নিছকই কল্পনার সৃষ্টি। যেহেতু দর্শক জানে যে, পর্দায় ঐক্যের যে ধারণা দেওয়া হচ্ছে তা নিছক কাল্পনিক, সেই জন্য তাকে এক রিক্ততার (ল্যাক) অর্থাৎ যার অভাব রয়েছে, তার জন্য সক্রিয় হতে হয়। দেখাবার প্রক্রিয়ার অনিবার্য অংশ হয়ে যায় এই সক্রিয়তা। তিনি এই প্রসঙ্গে লাকাঁর ‘মিরর ইমেজের’ উদাহরণ দিয়েছেন। আয়নায় তাকিয়ে পুরুষশিশু নিজেকে পূর্ণ মানব জ্ঞান করলেও সঙ্গে সঙ্গে মায়ের সঙ্গে তার পার্থক্য বুঝতে পারে, সেই সময় তাকে মায়ের প্রতি আকর্ষণকে অবদমন করতে হয়, যার ফলে অবচেতনের সৃষ্টি হয়। (লাকাঁ এখানে ফ্রয়েডের ফ্যালাস এবং ক্যাস্ট্রেশন তত্ত্বকে পুনর্নির্মাণ করেছেন)। মায়ের প্রতি আকর্ষণের অবদমনের সঙ্গে সঙ্গে নতুন করে ইচ্ছা বা বাসনারও সৃষ্টি হয়। সামাজিক স্বীকৃতি লাভের জন্য শিশুকে (পুরুষ) যে অবদমন করতে হয়েছে তার অনুসন্ধান চলে আজীবন এবং এটা স্পষ্ট হয় যখন সে ভাষার জগতে প্রতীকী ব্যবস্থার অভিজ্ঞতা লাভ করে। কিন্তু তখন তাকে প্রতীকী ব্যবস্থায় যে সামাজিক রীতিনীতি (পিতৃতান্ত্রিক নিয়মকানুন) তার বশ্যতা স্বীকার করতে হয়। এইভাবে প্রতীকী ব্যবস্থায় প্রবেশের অর্থ দাঁড়ায় আইন, ভাষা, এইসব ধারণার মুখোমুখি হওয়া, যা পরস্পরের সঙ্গে জড়িত। প্রতীকী ব্যবস্থায় প্রবেশের সঙ্গে জড়িত থাকে যৌনতার ভিত্তিতে পার্থক্য এবং খন্ডিত সত্তা সম্বন্ধে সচেতনতা।

পুরুষশিশু মায়ের সঙ্গে লিঙ্গের ভিত্তিতে তার পার্থক্য দেখার পর হয় মার প্রতি মিলনের ইচ্ছাকে দমন করতে পারে অথবা মার সঙ্গে এই পার্থক্য অস্বীকার করে মার ভেতরও তার মতো একই লিঙ্গের (ফ্যালিক) অস্তিত্ব কল্পনা করে নিতে পারে। এই মানসিকতাকে বলা হয়েছে ফেটিশিজম, যার ভিত্তিতে মায়ের (যে-কোনো রমণীকে) শরীরের অথবা পরিচ্ছদের একটি অংশকে রিক্ততা পূরণের উপযোগী (ফ্যালিক) বলে সে কল্পনা করে। যেমন – পা, স্তন অথবা হাইহিল জুতোর হিল। ‘ফলিক উওম্যান’ এই তত্ত্ব তৈরি করে, ফিল্ম-তাত্ত্বিকরা পুরুষালিভাবে আক্রমণাত্মক (অ্যাগ্রেসিভ) যৌনতার অধিকারী সিনেমার নারী চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। দৃষ্টান্ত, ডাবল ইনডেমনিটির নায়িকা অথবা বেসিক ইনসটিঙ্কটের নায়িকা।

ওপরে যে অডিপাল প্রক্রিয়ার উল্লেখ করা হলো, মেৎজের ধারণায় তা সিনেমায় শুধু ন্যারেটিভে অডিপাল বৈশিষ্ট্যের প্রেক্ষিতে পুনঃসৃষ্টি করা হয় না। এই পুনঃসৃষ্টি হয় আরো গুরুত্বপূর্ণভাবে দর্শক-সিনেমা সম্পর্কের ভেতর। ন্যারেটিভ চরিত্রগতভাবে অডিপাল এই অর্থে যে, এখানে প্রায় ক্ষেত্রেই যে পুরুষ চরিত্র থাকে সে সংকট উত্তীর্ণ হবার পর তার শূন্যতা (লিঙ্গের ভিত্তিতে) নিয়ে পিতার আইনের (পিতৃতন্ত্রের) সঙ্গে নিজেকে শনাক্ত করে। একই সঙ্গে সে নারী চরিত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে সেই নারী চরিত্রের যে ভীতি প্রদর্শনকারী পরিচয় সেটি ভেঙে দেয় এবং তার সঙ্গে মিলিত হয়। তার ‘রিক্ততা’ (ল্যাক) এইভাবে পূরণ হয়ে যায়।

রিক্ততা বা না থাকার (ল্যাক) সঙ্গে ন্যারেটিভের সম্পর্ক আরো এক প্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়ান ফর্মালিস্ট টোডোরোভের মতে, সব ন্যারেটিভেরই উদ্দেশ্য একটি ধাঁধা বা সমস্যার সমাধান করা অর্থাৎ একটি ‘শূন্যতা’ পূরণ করা। সব কাহিনিই শুরু হয় যেখানে পূর্বের অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে এবং নায়ক অথবা নায়িকাকে সমস্যার সমাধান কিংবা ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা করতে হচ্ছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে ন্যারেটিভের গঠনকে চরিত্রের ‘রিক্ততা’ বা ‘না থাকার’ (লিঙ্গের অর্থে ল্যাকিং) বোধকে তার পক্ষে অতিক্রমণের বাসনা হিসেবে দেখা যায়।

এছাড়া মেৎজের মতে, অবিশ্বাস ও অস্বীকৃতি (ডিসঅ্যাভাউয়াল) এবং ফেটিশিজম, যা পুরুষ চরিত্রের অডিপাল সংকটে দেখা যায়, তা সিনেমাতেও পুনঃসৃষ্টি হয়। অস্বীকারের ভিত্তিতে যা পর্দায় দেখানো হয় দর্শক তা বিশ্বাস করা সত্ত্বেও জানে যে এর কোনো অস্তিত্ব নেই। যা অনুপস্থিত সিনেমা শুধু তাকেই তাৎপর্যময় (সিগনিফাই) করে, এই ধারণার ভিত্তিতে পুরুষ দর্শক বুঝতে পারে যে পর্দায় ইমেজের সঙ্গে তার নিজের তুলনা মায়া ছাড়া কিছুই না এবং নিজের সম্বন্ধে তার ধারণা আসলে ‘না থাকা’র (ল্যাক) ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছে। কাহিনি শুরুর আগে যা ঘটেছে সেসব ন্যারেটিভে অনুপস্থিত জেনেও দর্শক (পুরুষ) সিনেমার প্রতি আকর্ষণকেই ফেটিশিজমের লক্ষ্য বা বিষয় করে এই ‘না থাকার’ (এখানে লিঙ্গের সমার্থক নয়, যদিও সেই অর্থে) ক্ষতিপূরণ করে। অস্বীকার এবং ফেটিশিজমের এই গঠনকে (স্ট্রাকচার) মেৎজ সিনেমায় বাস্তবতার প্রতিনিধিত্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছেন।

সিনেমার যন্ত্র (অ্যাপারেটাস) বিষয়ক তত্ত্ব সিনেমা দেখতে গিয়ে দর্শক যা পায় না অর্থাৎ তার ‘যা থাকে না’ (কাহিনির আগের বর্ণনার অনুপস্থিতির জন্য) তার ক্ষতিপূরণে সিনেমার ভূমিকাকে ব্যাখ্যা করে ও গুরুত্ব দেয়। নির্বস্ত্তকতার (সাবজেকটিভিটি) কেন্দ্রে যে খন্ড-বিখন্ডতা (ফ্র্যাগমেন্টেশন) তার ক্ষতিপূরণে অথবা প্রশমনে বর্ণনার (ন্যারেটিভ) গঠন এইভাবে তৈরি হয়। কাহিনির ভেতর যে পুরুষ চরিত্র ‘হারিয়েছে’ সিনেমা তার জন্য কল্পিত এক ঐক্যের বিধান করে। পুরুষ চরিত্র ‘হারিয়েছে’, তার সেই হারানো (অর্থাৎ যা নেই) বিষয় যেমন, প্রেমাস্পদকে সে ফিরে পায়। কারো কারো মতে, মেৎজের এই কল্পিত তাৎপর্যময়কারী (ইমাজিনারি সিগনিফায়ার) ব্যাচেলর, অ্যাপারেটাস ছাড়া আর কিছুই না, যা পুরুষের বাসনাকে চরিতার্থ করার একটি গঠন (স্ট্রাকচার)।

সিনেমার আলোচনায় ইমাজিনারি সিগনিফায়ারের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমালোচনাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। প্রথমত, এই তত্ত্ব ইতিহাস সম্বন্ধে নিরপেক্ষ ও উদাসীন (অ্যাহিস্টরিকাল)। দ্বিতীয়ত, ইমেজের যে মূল্যায়ন সেখানে সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতায় যা দৃশ্যমান নয় (যেমন, শব্দ) তার প্রতি কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয় না। সবচেয়ে তীব্র সমালোচনা এসেছে নারীবাদীদের পক্ষ থেকে, যাদের মতে অ্যাপারেটাস তত্ত্বে লিঙ্গ সম্বন্ধে (বৈষম্য, নিপীড়ন, অন্যায় ব্যবহার) কিছুই বলা হয়নি।

নারীবাদী সিনেমাতাত্ত্বিক, যাঁরা মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ব্যবহার করতে চেয়েছেন, তাঁরা দর্শকের নির্মাণের (ব্যাখ্যার) সঙ্গে লিঙ্গ ও যৌনবাসনাকে সম্পৃক্ত করতে চেয়েছেন। দর্শক বলতেই পুরুষ মনে করে মেৎজ বাসনাকে পুরুষের অডিপাল প্রক্রিয়ার ভিত্তিতেই বিশ্লেষণ করেছেন। ১৯৭০ সালে লরা মুলভে ‘ভিস্যুয়াল প্লেজার অ্যান্ড ন্যারেটিভ সিনেমা’ নামে একটি প্রায় দুঃসাহসিক প্রবন্ধ লেখেন, যা সিনেমার নারী-দর্শকদের চিরস্থায়ীভাবে ফিল্মের আলোচনায় গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণের পথ প্রশস্ত করেছে। তিনি ইচ্ছা করেই প্রবন্ধটিকে বিতর্কিত করতে চেয়েছেন, যেন বিষয়টি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই প্রবন্ধ মেয়েদের দর্শক ভূমিকার নারীবাদী ব্যাখ্যায় মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ব্যবহারের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে। আসলে মুলভে যা করেছেন তা ছিল অস্বীকার (ডিসঅ্যাভাউয়াল) এবং ফেটিশিজমের প্রক্রিয়া হিসেবে মেৎজ সিনেমার যে ব্যাখ্যা দেন লিঙ্গের ভিত্তিতে তার পুনর্বর্ণনা। ফ্রয়েডের ক্যাস্ট্রেশন এবং ফেটিশিজম এবং নির্বস্ত্তকতা (সাবজেকটিভিটি) সম্পর্কে লাকাঁর তত্ত্ব ব্যবহার করে মুলভে অ্যাপারেটাস তত্ত্বে লিঙ্গ অন্তর্ভুক্ত করেন। মুলভে তাঁর প্রবন্ধে বলেন যে, লিঙ্গের বৈষম্যের ভিত্তিতে যে জগৎ সেখানে এবং সিনেমায় ঘটনা সৃষ্টির দায়িত্বে যারা থাকে, তারা পুরুষই হয়। আর মেয়েদের স্থান নির্ধারিত হয় নিষ্ক্রিয় ভূমিকায়, যেখানে তারা পুরুষের কামনা-বাসনার লক্ষ্য বা বিষয় হিসেবেই কাজ করে যায়। সিনেমায় নারী চরিত্র ইমেজকে ‘সিগনিফাই’ করে এবং তারা কামনার দৃষ্টিতে দেখার বিষয় হয়। যে দৃষ্টিতে তাদের দেখা হবে তা পুরুষরাই নিয়ন্ত্রণ করে। এইভাবে সিনেমায় দর্শক শ্রেণি বা দেখার প্রক্রিয়া লিঙ্গের ভিত্তিতে দ্বিখন্ডিত হয়েছে। সিনেমা একজন আদর্শ পুরুষ দর্শকের কথা ভেবেছে আর ইমেজ দেখার প্রক্রিয়াকে দ্বিখন্ডিত করে পুরুষের সক্রিয় দৃষ্টি এবং নারীর নিষ্ক্রিয় ইমেজকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

মুলভের বক্তব্য ছিল এই যে, যদিও নারীর দেহ এবং অঙ্গভঙ্গি পুরুষ নায়কের উপভোগের জন্য সিনেমায় দেখানো হয়েছে সেইসঙ্গে নারীদেহ ও অঙ্গভঙ্গি পুরুষ দর্শকের জন্য ভয়ের কারণও হয়েছে। কেননা, সেসবের মাধ্যমে লিঙ্গগত পার্থক্য ও ক্যাস্ট্রেশনের জন্য পুরুষের অবচেতনে যে দুশ্চিন্তা থাকে তার উদ্রেক হয়েছে। হিচককের ফিল্মে যেমন হয়েছে, পুরুষ নায়ক চরিত্র তার শাস্তি প্রদানকারী বা নিপীড়নমূলক দৃষ্টি দ্বারা নারী চরিত্রকে বিদ্ধ করে এবং পৃথক হওয়ার জন্য শাস্তি দিয়ে (ভোগ করে) এই বিপদের মোকাবেলা করতে পারে। অথবা নারীর এই ‘পার্থক্য’কে সে অস্বীকার করতে পারে এবং তার দেহের কোনো অংশকে (পা, স্তন) ফেটিশের রূপ দিয়ে মহার্ঘ করে তুলতে পারে। দর্শকের (পুরুষের) লুকিয়ে দেখার (ভয়েরিস্টিক) প্রবণতা সম্পর্কে মুলভের বক্তব্যকে জোর দেওয়া হয়েছে সিনেমার কাহিনি যেভাবে শেষ হয় সেখানে হুমকিস্বরূপ নারী চরিত্রকে অবধারিতভাবে শাস্তি দেওয়ার মাধ্যমে দর্শকের (পুরুষের) লুকিয়ে দেখার (ভয়েরিস্টিক) প্রবণতা সম্পর্কে বক্তব্যকে সত্য প্রমাণ করে। কামোদ্রেকের জন্য ক্লোজআপ শটে নারীদেহকে খন্ডিত করে দেখিয়ে ফেটিশ সৃষ্টি সম্বন্ধে তার (পুরুষ দর্শক) ধারণাও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

ফ্রয়েড এবং লাকাঁ যেখানে ক্যাস্ট্রেশন কমপ্লেক্স একটি বিশ্বজনীন ও চিরন্তন প্রক্রিয়া যার ভিত্তিতে পিতৃতান্ত্রিক পদ্ধতিও তার নিয়মকানুনের উৎস এবং স্থায়িত্ব ব্যাখ্যা করা যায় এই কথা বলেন, মুলভে বিশেষভাবে দেখান কীভাবে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের অবচেতনে তার নিজের তাৎপর্যময়করণ অভ্যাস (সিগনিফাইং প্র্যাকটিস) সংগঠিত হয় (যেমন, ফিল্ম)। নারী সম্পর্কে ‘মিথ’কে জোরালো এবং পুরুষের কামনার দৃষ্টিতে দেখার আনন্দ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে এমন হয়। এই ব্যবস্থায় নারীর ভূমিকা হয় নিষ্ক্রিয় বিষয়ের। তার সঙ্গে পুরুষের পার্থক্যই হলো ‘না থাকার বা ‘রিক্ততা’র (ল্যাক)’। কিন্তু মুলভে এই পদ্ধতি বা ব্যবস্থাকে ফ্রয়েড বা লাকাঁর মতো বিশ্বজনীন বা স্থায়ী মনে করেননি। তাঁর মতে, পুরুষের কামনা-বাসনার প্রকাশে নতুন ভাষা উদ্ভাবন করতে হলে চিত্রনির্মাতা যদি মনে করে যে আনন্দ (প্লেজার) বিসর্জন দিতে হবে, তাহলে তিনি তাই করবেন।

‘ভিস্যুয়াল প্লেজার অ্যান্ড ন্যারেটিভ সিনেমা’ (১৯৮১) এই নামে তাঁর দ্বিতীয় লেখায় মুলভে নারী দর্শকের বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। যেহেতু হলিউডের ক্লাসিক সিনেমা পুরুষের অডিপাল প্রবণতা এবং নারীর মাধ্যমে আনন্দপ্রাপ্তি সম্বন্ধে পুরুষের ধারণার ওপর ভিত্তি করে তৈরি, সেইজন্য মুলভে প্রশ্ন রেখেছেন : নারী দর্শক তাহলে কিসের ভিত্তিতে আনন্দ পায়? এর উত্তর পাওয়ার জন্য মুলভে ফ্রয়েডের ‘লিবিডো’ থিওরির কথা মনে করেছেন, যেখানে ফ্রয়েড বলেছেন যে, এক ধরনের লিবিডো আছে যা পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্য কার্যকর। পর্দায় যখন নারী চরিত্রকে দেখা যায় সাহসিনী, দৃঢ় চরিত্রের এবং পুরুষলিঙ্গের দ্যোতক (ফালিক) ভূমিকায় তখন তাকে প্রাক-অডিপাল পর্বে অবস্থিত হিসেবে দেখা যায়, যেখানে ‘রিক্ততা’ (ল্যাক) জনিত লিঙ্গ নেই। ফ্রয়েডের মতে, কোনো কোনো নারীর জীবনে পুরুষালি ও মেয়েলিপনার পর্ব ঘুরেফিরে আসে। এর থেকে মুলভে এই উপসংহারে আসেন যে, মেয়ে দর্শক হয় নিজেকে সিনেমার ন্যারেটিভে যেভাবে নারী চরিত্র দেখানো হয়েছে (পুরুষের বাসনার এবং তার কামুক দৃষ্টির বিষয় হিসেবে) সেইভাবে দেখে অথবা নিজেই পুরুষ দর্শকের ভূমিকা নিয়ে নেয়। কিন্তু নারী দর্শকের এই ভাবী পুরুষ-দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ কিছুটা হলেও তার নিজের সঙ্গে বিরোধের মুখোমুখি হয়। ট্রানসভেস্টইটাইটের পোশাক পরিহিতা হয়েও তাকে অস্থির দেখায়। অনেক সমালোচক মুলভের এই ব্যাখ্যা গ্রহণ করেননি। তাঁদের মতে, মুলভে পর্দায় নারী চরিত্র এবং দর্শক হিসেবে নারীর যে বিশ্লেষণ করেছেন, সেখানে নারীর বাসনাকে পুরুষ লিঙ্গকেন্দ্রিক পরিস্থিতির বা প্রেক্ষিতের বাইরে চরিতার্থ হওয়ার সম্ভাবনা স্বীকার করা হয়নি। বেশ কিছু উত্তর-গঠনবাদী নারীবাদীর (জোয়ান কোশজেক, ১৯৮২, জ্যাকুলিন রোজ ১৯৮০, কনস্ট্যান্স পেনলে, ১৯৮৫) মতে, সিনেমার ‘অ্যাপারেটাস থিওরি’ লিঙ্গকে বিষয় হিসেবে বিবেচনায় নিক আর নাই নিক, এটি পাশ্চাত্যের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার একটি অংশ, যেখানে পুরুষত্ব (ম্যাসকুলিনিটি) একটি আদর্শ হিসেবে স্থাপিত এবং যার ফলে নারীর জন্য কোনো ভূমিকা সেখানে নেই। তাঁদের মতে, অ্যাপারেটাসভিত্তিক সিনেমাতত্ত্বে নারী দর্শকের কোনো স্থান নেই। মুলভের নারী-দর্শক বিষয়ক বিশ্লেষণের বিপরীতে উত্তর-গঠনবাদী নারীবাদের এই প্রসঙ্গে যে ব্যাখ্যা সেটি চারটি ধারায় বিভক্ত। প্রথম ধারায় রয়েছে নারীর অডিপাল প্রবণতা ব্যাখ্যা, যেখানে ফ্রয়েডের লিবিডোর তত্ত্ব ব্যবহার করে উভয়লিঙ্গের জন্যই কার্যকর এমন দর্শকের দৃষ্টির উল্লেখ করা হয়েছে। এই ধারণা অনুযায়ী দর্শক ছবিতে তার লিঙ্গভিত্তিক কাউন্টারপার্টের সঙ্গে নিজেকে শনাক্ত নাও করতে পারে বরং সক্রিয় পুরুষ এবং নিষ্ক্রিয় নারী, এই দুই সত্তার মধ্যে আসা-যাওয়া করতে পারে। এই প্রক্রিয়ার কোনটি কার্যকর হবে তা নির্ভর করবে সিনেমার টেক্সটে শনাক্তকরণের কোন কোড রয়েছে। রেবেকা সিনেমায় নামহীন নায়িকা পুরুষের বাসনার উপযোগী হওয়ার জন্য চেষ্টা করতে গিয়ে হিমশিম খায়। কিন্তু যখন সে সফল হয়েছে বলে মনে করে, সেই সময় ন্যারেটিভে দেখা যায় যে, তার মায়ের প্রতিও সে অনুরক্ত। এইভাবে জেন ক্যাম্পিয়নের দি পিয়ানো সিনেমাতেও নারীর অডিপাল প্রবণতার পরিচয় পাওয়া যায়।

দ্বিতীয় ধারায় যে মত সেই অনুযায়ী কল্পনাবিলাস বা ফ্যান্টাসি কাজ করে, যেখানে ফ্রয়েডীয় উভয়লিঙ্গবিশিষ্ট দর্শক-দৃষ্টি সম্ভবপর হয়। ফ্যান্টাসি জাগ্রত এবং ঘুমন্ত অবস্থায় কার্যকর থাকে। এই ফ্যান্টাসি বাসনাকে মূর্ত করে এবং সিনেমার ভাষায় মিজঁ অাঁ সিঁর (দৃশ্যকল্প) সমতুল্য। দর্শকের অবস্থান এখানে নির্দিষ্ট নয় এবং লিঙ্গভিত্তিক শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া নমনীয়, যার জন্য যে দর্শক ফ্যান্টাসির অভিজ্ঞতা পায় তার পক্ষে বিভিন্ন স্থান, কাল এবং লিঙ্গের ভিত্তিতে বিভিন্ন অবস্থান নেওয়া সম্ভব হয়।

তৃতীয় ধারায় পুরুষত্বের আত্মনিপীড়নের (ম্যাসোকিজম) ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে যে, পুরুষের শরীরকে নারীর বাসনার বিষয় করা সম্ভবপর না। অনেকের মতে, এই ধারণা সঠিক না। এমন কিছু পরিস্থিতি আছে, যেখানে পুরুষের দেহকে যৌন আবেদনমূলক করে দেখানো যায় এবং যেখানে নারী দর্শকের পক্ষে সেই দেহের প্রতি বাসনার দৃষ্টিতে তাকানো সম্ভব। এমন একটি পরিস্থিতি হলো মুষ্টিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী পুরুষ চরিত্র, যেখানে নারী চরিত্রের পক্ষে কামনার বস্ত্ততে রূপান্তরিত পুরুষদেহকে ‘ভয়েরিজম’ এবং ‘ফেটিশিজম’ উভয়ের ভিত্তিতেই দেখা সম্ভব হয়।

চতুর্থ ধারায় রয়েছে ভীতিকর (হরর) সিনেমায় শক্তিশালী এবং ভয়ংকর চরিত্রের নারীকে দেখে নিষ্ক্রিয় নারী সম্বন্ধে বিদ্যমান ধারণার পতন। এটি জুলিয়া ক্রিস্টেভার শোচনীয় মাতৃসত্তা এবং ফ্রয়েডের ক্যাস্ট্রেশন তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে তৈরি।

সিনেমায় মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের প্রয়োগ ১৯৭০ এবং ১৯৮০ দশকে দর্শকতত্ত্বের সূচনা করে। এই অ্যাপারেটাস-স্পেকটেটর থিওরির প্রধান সমালোচনা ছিল, এখানে সব পরিস্থিতিতেই এক অবিভাজ্য এবং ঐকিক দর্শকের সৃষ্টি করা হয়। বদ্রির তত্ত্বে দর্শক পুরুষ ও নিষ্ক্রিয় থাকে। মুলভের তত্ত্বে দর্শক পুরুষ এবং সক্রিয়। সিনেমায় মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণকে পৌনঃপুনিক এবং সামগ্রিক (টোটালাইজিং)করণের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। এই বিশ্লেষণে ফিল্মের পর ফিল্মকে এমনভাবে দেখা হয়েছে, যেখানে পুরুষ দর্শকই ‘দৃষ্টির’ নিয়ন্ত্রণে এবং নারী তার দৃষ্টিপাতের বিষয় মাত্র। এর বিকল্প হিসেবে দর্শকের অর্জিত জ্ঞান ও ধারণার ভিত্তিতে সিনেমা ‘দেখার’ অভ্যাসের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। যুক্তিহীনতা ও অবচেতনের ওপর ভিত্তি না করে জ্ঞান ও ধারণার ভিত্তিতে সিনেমার সঙ্গে দর্শকের সম্পর্ক বিষয়টি বিশ্লেষণ করা সমীচীন বলে মনে করা হয়েছে। এইভাবে দেখা হলে ১৯৭০-এর দশকে দর্শককে যেভাবে মনে করা হয়েছে তার থেকে সম্পূর্ণ পৃথক মনে হবে। আগে যেখানে আদর্শ দর্শকের কথা ভাবা হয়েছে, পরবর্তী সময়ে এই ধারণা (জ্ঞানভিত্তিক) অনুযায়ী প্রকৃত দর্শকের কথা বলা হয়েছে।

মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণকে ইতিহাস নিরপেক্ষতার জন্যও সমালোচনা করা হয়েছে। সমালোচকদের মতে, সিনেমাকে বিশ্লেষণ করতে হবে ইতিহাস ও সমাজের প্রেক্ষিতে, নির্বস্ত্তকতা এবং অবচেতনের ভিত্তিতে নয়।

তৃতীয় সমালোচনায় বলা হয়েছে যে, ১৯৭০-এর দর্শক তত্ত্ব কেবল আদর্শ দর্শকের প্রতি মনোযোগ দিয়ে শ্রেণি, বর্ণ, জাতি, বয়স, অথবা লিঙ্গের বিষয়গুলি উপেক্ষা করেছে। কোনো কোনো দর্শক সিনেমায় মতাদর্শের প্রতিফলন গ্রহণে অস্বীকার জানাতে পারে, একথাও দর্শক তত্ত্বে মনে করা হয়নি।

এইসব সমস্যার সমাধানে কালচারাল স্টাডিজের সূচনা হয়েছে। এখানে অবচেতনের চেয়ে দর্শকের ইতিহাসের (শ্রেণি, বর্ণ, ধর্ম ছাড়া নিয়ন্ত্রিত) ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে এবং প্রভাবশালী মতাদর্শের বিরুদ্ধে দর্শক কীভাবে অবস্থান নেবে, সেকথাও মনে রাখা হয়েছে। কালচারাল স্টাডিজে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণকে জ্ঞান ও ধারণাভিত্তিক (কগনিটিভ) ধারায় যেভাবে পেছনে ফেলে রাখা হয়েছে, তেমন হয়নি। কালচারাল স্টাডিজের মতো পোস্ট-কলোনিয়াল থিওরিও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ব্যবহার করেছে এবং সিনেমার আলোচনায় এর প্রয়োগ করেছে। এই ব্যবহার ও প্রয়োগের উদ্দেশ্য সামাজিকের সঙ্গে আত্মিকের (সাইকিক) সাযুজ্য স্থাপন। সিনেমায় বর্ণবাদের সমালোচনার আগে যেখানে অপরিবর্তনীয় ছাঁচ (স্টেরিওটাইপ), বর্ণনার বিশ্বাসযোগ্যতা এবং ইতিবাচক ইমেজ, এইসব বিষয়ের উল্লেখ করা হতো, পোস্ট-কলোনিয়াল তত্ত্বে নির্বস্ত্তকীকরণের প্রক্রিয়া, অন্যের (আদার) প্রতিনিধিত্বকরণ, দর্শক-ভূমিকা এবং সিনেমার কোড ব্যবহারের ওপর বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। ত্রুটিপূর্ণ কিংবা নেতিবাচক ইমেজের স্থানে উপনিবেশ স্থাপনকারী ও উপনিবেশের অধিবাসীর মধ্যকার সম্পর্ক, তাদের ভেতর ক্ষমতার বণ্টন, লিঙ্গবৈষম্য ইত্যাদি বিষয়ে দর্শকের অবস্থান সম্পর্কে সিনেমার গঠন ও ন্যারেটিভ কী বলে, তা জানার প্রতি বেশি কৌতূহল প্রকাশ করা হয়েছে। এই বিশ্লেষণে পোস্ট-কলোনিয়াল তাত্ত্বিকরা প্রায়ই মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ওপর নির্ভর করেন।

হোমি ভাবা তাঁর ‘দি আদার কোয়েশ্চেন : দি স্টেরিওটাইপ অ্যান্ড দি কলোনিয়াল ডিসকোর্সে’ (১৯৯২) ফ্রয়েডের ক্যাস্ট্রেশন থিওরি এবং ফেটিশিজমের ব্যবহার করে সাদা ও কালো বর্ণের মানুষের ছকে বাঁধা অপরিবর্তনীয়তার বিশ্লেষণ করেছেন, যা কলোনিয়াল ডিসকোর্সে খুবই প্রাসঙ্গিক। তাঁর মতে, সিনেমা এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে ছকে বাঁধা চরিত্র, যা অন্তর্ভুক্তির বিষয় (ফেটিশ) হিসেবে দেখা হয়, তা উপনিবেশের অধিবাসীর কাছে আদর্শ ও পরিপূর্ণ সত্তা হিসেবে সাদা বর্ণের মানুষকে কল্পনায় দেখার অভ্যাস গড়ে তোলে। এইভাবে উপনিবেশের সংস্কৃতিকে ঔপনিবেশিক শক্তির সংস্কৃতি অনুকরণে উদ্বুদ্ধ করা হয়। কিন্তু এর একটা সীমা থাকে, কেননা দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য রাখাও ঔপনিবেশিক শক্তির উদ্দেশ্য।

পরিশেষে বলতে হয় যে, ১৯৭০-এর দশকের মতো সিনেমার সবকিছুই মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ দিয়ে ব্যাখ্যা করার প্রচেষ্টা এখন গ্রহণযোগ্য না হলেও এই দৃষ্টিভঙ্গি যে পরিত্যক্ত হয়েছে তাও বলা যাবে না। সিনেমার ব্যাখ্যায় মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ এখনো প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত, যদিও এখানে বিতর্কের শেষ নেই।

 

সূত্র :

১.   কোপজেক, জোয়ান দি অ্যাংজাইটি অফ দি ইনফ্লুয়েন্সিং মেসিন (১৯৮২)

২.   রোজ, জ্যাকুলিন দি সিনেমাটিক অ্যাপারেটাস : এক্লেমস ইন কারেন্ট থিওরি (১৯৮০)

৩.   পেনলে, কনস্ট্যান্স ফেমিনিজম, ফিল্ম থিওরি অ্যান্ড দি ব্যাচেলর মেসিন (১৯৮৫)

(অন্যান্য সূত্র মূল লেখায় উল্লিখিত)

 

Leave a Reply