logo

চলচ্চিত্রের নান্দনিকতা : সাংকেতিক ভাষা

হা স না ত  আ ব দু ল  হা ই

অনেকের আপত্তি সত্ত্বেও সিনেমাকে লিখিত ভাষার মতোই একটি যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে দেখা হয়েছে। এই জন্য ভাষা সম্বন্ধে যে বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৃ-তত্ত্ববিজ্ঞানভিত্তিক ধ্যান-ধারণা তৈরি হয়েছে, সেসব সিনেমার ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা হয়েছে। ‘সেমিওটিকস’ তত্ত্বের মাধ্যমে সকল যোগাযোগ (কম্যুনিকেশন) মাধ্যমের যিনি প্রথম বিশ্লেষণ করেন, ফার্দিনান্দ সস্যুর, তাঁর ভাষায় : ‘সমাজে ব্যবহৃত চিহ্ন বা সংকেত (সাইন) সম্বন্ধে বিজ্ঞানসম্মত তথ্য ও জ্ঞানের এলাকা গড়ে তোলা সম্ভব, যাকে গ্রীক ‘সেমিওন’ বা সংকেত থেকে ‘সেমিওলজি’ বলা যায়। সংকেত কিসের দ্বারা গঠিত, কোন সূত্র বা নিয়ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, সেমিওলজি তার ধারণা দেয়। যেহেতু এই বিজ্ঞান (সেমিওলজি) এখনো পরিপূর্ণ রূপ নেয়নি, তাই এখনই বলা যায় না এর স্বরূপ কী হবে। কিন্তু এর অস্তিত্ব স্বীকার না করে পারা যায় না (কোর্স ইন জেনারেল লিঙ্গুইস্টিকস, ১৯১৬)। এই মন্তব্যের পর অবশ্য সেমিওটিকের আলোচনা আরো বিস্তৃত ও গভীর হয়েছে। শুধু মুখের বা লেখার ভাষায় নয়, সিনেমায় এর প্রয়োগ হয়েছে, তার উল্লেখ করা হয়েছে পূর্ববর্তী অধ্যায়ে।
সেমিওলজিকেই ইংরেজিতে সেমিওটিকস বলা হয়েছে। সেমিওটিকসের ধারণা, শিল্প-সাহিত্য জৈবিক ঐক্যের ধারণাপ্রসূত এবং তার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে কল্পনার যে প্রকাশ, তাকে অসম্পূর্ণ ও ভ্রান্ত বলে দিলো। সনাতন এসথেটিকসের পদ্ধতির পরিবর্তে সেমিওটিকস জানাল যে, যোগাযোগের বা প্রকাশমাধ্যমের গঠন ও পদ্ধতি দিয়েই শিল্প-সাহিত্যের অর্থ ও নান্দনিকতার ব্যাখ্যা করা সম্ভব। এইভাবে ‘আর্ট’কে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের মুখাপেক্ষী হতে হলো। সিনেমার ক্ষেত্রে এর অর্থ হলো এই যে, কেবল ধারণার ওপর ভিত্তি করে সমালোচনা যথেষ্ট নয়। প্রকাশমাধ্যমের পদ্ধতিও গুরুত্বপূর্ণ।
সেমিওটিকস বা চিহ্নতত্ত্ব (আমেরিকান ভাষ্য সেমিওলজি বা চিহ্নবিজ্ঞান) বলতে ভাষায় বা শিল্পের ক্ষেত্রে চিহ্নের (সাইন) নির্মাণ, পদ্ধতিগত গঠন ও প্রয়োগের আলোচনা বোঝায়। সিগনিফায়ার (সূচক) ও সিগনিফায়েড (সূচিত), এই দুটির সাহায্যেই ‘চিহ্ন’ তৈরি হয়। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে ‘চিহ্ন’তত্ত্বের নানা প্রয়োগ হয়েছে, যা বেশ জটিল ও বিতর্কিত। সিনেমায় ‘চিহ্ন’ নানা ধরনের হতে পারে। একটি শব্দ বা চিত্র থেকে শুরু করে ছবি ও শট যেমন ‘চিহ্ন’ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারে, তেমনি সামগ্রিকভাবেও চলচ্চিত্র-ভাষা ‘চিহ্ন’ ব্যবহার করতে পারে। একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা এমন ‘চিহ্ন’ ব্যবহার করতে পারেন, যার কোনো প্রয়োগগত ইতিহাস নেই। এটা তিনি করেন যখন প্রথাগত ‘চিহ্ন’ দিয়ে কোনো বিষয় বা মানসিকতাকে ধারণ করা যাবে না বলে মনে করেন। যখন তাঁকে তৈরি করে নিতে হয় নতুন এক ‘চিহ্ন’, যা চলচ্চিত্রের ভাষা নীতিমালা বা পদ্ধতির (ল্যাঙ্গু) মধ্যেই সূচিত (সিগনিফায়েড) হয়। ব্যবহারের পর (প্যারোল) সেটি স্বীকৃত ‘চিহ্ন’ হয়ে যায়। ‘পিকু’ ছবিতে সত্যজিৎ এমন ‘চিহ্ন’ ব্যবহার করেছেন সাদা ফুলের ছবিকে কালো রঙে এঁকে, যার কোনো প্রয়োগগত ইতিহাস নেই। তিনি এমন একটি মানসিকতাকে ধরতে চেয়েছেন, যা প্রথাগত ‘চিহ্ন’ দিয়ে সূচিত করা সম্ভব নয়। নতুন করে তৈরি করা এই ‘চিহ্ন’ অবশ্য চলচ্চিত্রের ভাষারীতির মাধ্যমেই সূচিত করা সম্ভব। সিনেমাকে অর্থবহ চিহ্নের সমাহাররূপে বিচার করার এই পদ্ধতি চলচ্চিত্রের তাত্ত্বিক ক্ষেত্র আলোকিত করতে পারে এবং নান্দনিকতার বিচারে সহায়ক হয়।
অন্যান্য শিল্পের মতো সিনেমার ক্ষেত্রেও চিহ্নতত্ত্ব বা সেমিওটিকস এমন সব চিহ্নের উদ্ভব, প্রয়োগ ও গুরুত্বের আলোচনা করে, যা সিনেমার নিজস্ব। এদের সম্বন্ধে জানা থাকলে দর্শকের পক্ষে সিনেমার ‘ভাষা’ উপলব্ধি এবং তার সার্বিক নান্দনিক বিচার সহজ হয়। এই অনুশীলন কিছুটা জটিল এবং সেমিওটিকস সম্বন্ধে সাধারণ জ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল। খুব সহজ করে এখানে বলা যায় যে, চিহ্নগুলিকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। যেমন – (ক) প্রতিমা (আইকন), (খ) সূচক (ইনডেক্স), এবং (গ) প্রতীক (সিম্বল), যা পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। প্রতিটি চিহ্নেই এই তিনটি বৈশিষ্ট্য বা চরিত্র বর্তমান, যদিও যে-কোনো একটি প্রাধান্য পেতে পারে। সিনেমায় প্রতিরূপ (রিপ্রেজেন্টেশন) একই সঙ্গে প্রতিমা, সূচক ও প্রতীকের চরিত্রসম্পন্ন। এই তিন শ্রেণির যে-কোনো একটি বা দুইটিকে নিয়েই কোনো সিনেমার ভাষা তৈরি হতে পারে। দর্শক সিনেমা দেখার সময় ‘চিহ্ন’ ও তত্ত্ব এবং তার আন্তর্গত ‘চিহ্ন’ সমুদয়ের শ্রেণি সম্বন্ধে অবহিত থাকলে তার নিজের বিচার-বিবেচনা অনুযায়ী প্রতিরূপ থেকে প্রতিমা, সূচক ও প্রতীকী অর্থ উপলব্ধি করতে পারে। এই সংক্ষিপ্ত আলোচনার পর এখন বিশদভাবে সিনেমায় চিহ্নতত্ত্ব (সেমিওটিকস) নিয়ে যে আলোচনা হয়েছে এবং বিতর্ক দেখা দিয়েছে, সে সম্বন্ধে আলোচনা করা যায়।
‘চিহ্ন’কে প্রতিমা (আইকন) হতে হলে তার কিছু বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য বা গুণের সমাহার থাকতে হবে, যা চিহ্নের সঙ্গে সম্পর্কিত বস্তুর ভেতরও দেখা যায়। এই সাধারণ বৈশিষ্ট্য বা গুণের জন্যই তারা পরস্পর-সম্পর্কিত। সাদৃশ্যই ‘প্রতিমা’ হিসেবে চিহ্নিত হবার শর্ত। যেমন, পেইন্টিংয়ের রিপ্রডাকশন, মূর্তি, ফটোগ্রাফ ইত্যাদি। ‘চিহ্ন’ তখনই ‘সূচক’ হবে যখন যে বস্তুর বৈশিষ্ট্য বা গুণ দ্বারা একে শনাক্ত করা যায়, সেই বস্তুটির বর্তমানে তা সম্ভব হয় না। বস্তু ও সূচকের মধ্যে তাই কার্যকারণ সম্পর্ক রয়েছে, যার জন্য ‘চিহ্ন’কে বলা যায় বস্তুর ফলাফল (ইফেক্ট)। ব্যারোমিটার ও থার্মোমিটার যা পরিমাণ করে তারই সূচক, ঠিক যেমন ধোঁয়া আগুনের সূচক। অন্যদিকে প্রতীককে ধারণার ভিত্তিতে অথবা সাধারণ সম্পর্কের ভিত্তিতে খেয়ালখুশিমাফিক কোনো বস্তুর সঙ্গে যুক্ত করা হয়। এখানে বস্তু ও চিহ্নের মধ্যে সাদৃশ্য বা কার্যকারণ সম্পর্ক থাকে না, তার পরিবর্তে প্রচলিত প্রথা বা অভ্যাসের ভিত্তিতে তাৎপর্যময় সম্পর্ক নির্ধারিত হয়। এই জন্য স্বাভাবিক ভাষা ও তার ওপর নির্ভরশীল কৃত্রিম ভাষা (যেমন, মোর্স কোড) অঙ্গভঙ্গি ও পোশাকও প্রতীকসম্পন্ন। ‘চিহ্ন’ এই সব বৈশিষ্ট্য বা গুণাবলির যে-কোনো একটিতে সীমাবদ্ধ হতে পারে অথবা একাধিক গুণসম্পন্ন হতে পারে, যা আগেই বলা হয়েছে।
প্রতিমা, সূচক ও প্রতীকের আলোচনা সস্যুরের সমসাময়িক আমেরিকান তাত্ত্বিক চার্লস পিয়ার্স (কাজা সিলভারম্যানের ‘দি সাবজেক্ট অফ সেমিওটিকসে’ উদ্ধৃত) সূত্রপাত করেন, কিন্তু তিনি সস্যুরের মতো প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি। একমাত্র পিটার ওলেন তাঁর সাইনস অ্যান্ড মিনিংস ইন দি সিনেমা গ্রন্থে পিয়ার্সের শ্রেণিবিভাগ উল্লেখ করে বলেন, চিহ্নের এই তিন ব্যাখ্যাই সিনেমা ধারণ করে এবং সেইসব ভিত্তি করে নির্মিত হয়। যেমন, ‘সূচক’ (ইনডেক্স) প্রাসঙ্গিক হয় বাস্তবতাকে ফটোগ্রাফে প্রতিনিধিত্ব করার মাধ্যমে। ‘প্রতিমা’র প্রাসঙ্গিকতা আসে শব্দ ও ইমেজের ব্যবহারে। সংলাপ ও লেখার ব্যবহারে ‘প্রতীকে’র প্রকাশ ঘটে। কাজা সিলভারম্যান (দি সাবজেক্ট অফ সেমিওটিকস, ১৯৮৩) দেখিয়েছেন, পিয়ার্সের শ্রেণিবিভাগে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পার্থক্যকরণ করা যায়, যা সস্যুরের তত্ত্ব অনুযায়ী সম্ভব নয়। যেমন, ভাষাগত ‘সূচকে’র সিগনিফায়ারের সঙ্গে ‘সূচিতে’র (সিগনিফায়েড) সম্পর্ক মূলত প্রতীকী। কিন্তু সিনেমার প্রধান অংশ যেমন, ফিল্ম, সম্পাদনা, আলোকসম্পাত) সূচক (ইনডেক্স) ও প্রতিমার (আইকন) প্রতি একই গুরুত্ব প্রদান করে এবং তারা সমানভাবে সম্পর্কিত। সিনেমার সঙ্গে এসব উপকরণ-প্রকরণের নিবিড় ও প্রচুর সংযোগের ফলে ‘চিহ্ন’ এবং তার সম্পর্কিত বস্তুর মধ্যে যেমত দৃশ্যগত পার্থক্য নেই, যেমন রয়েছে প্রতীকের (সিম্বল) সঙ্গে। এই জন্য খুব সাধারণ দৃষ্টান্তকেও (স্টেরিওটাইপ) সিনেমা স্বাভাবিকভাবে ধারণ ও প্রদর্শন করতে পারে।
ওপরের বক্তব্য সত্ত্বেও স্বীকার না করে উপায় নেই যে, সিনেমায় সেমিওটিকস বা চিহ্নতত্ত্বের যে ব্যবহার ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে জনপ্রিয় হয় তার উৎস সস্যুরের চিন্তা ও ধারণাতেই। ভাষার মতোই সিনেমাকে সমাজের সৃষ্টি মনে করা এবং ভাষার সঙ্গে আদর্শ (আইডিওলজি) সম্পর্কিত, এই ধারণা সমর্থনের জন্য সস্যুর সিনেমার তাত্ত্বিকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক হয়েছিলেন। ব্যক্তি ও বাস্তব জীবনের মধ্যে ভাষাকে একটি মধ্যবর্তী সাংস্কৃতিক পদ্ধতি হিসেবে দেখার জন্য পরবর্তীকালে জ্যাক লাকাঁর দর্শন আরো শক্তি অর্জন করে।
ভাষা সম্পর্কে লাকাঁর দুটি ধারণা সিনেমার সঙ্গে যুক্ত। প্রথমটি অনুযায়ী শব্দ অথবা ইমেজ কোনোটাই ইতিপূর্বে বিদ্যমান বাস্তবতাকে নিরপেক্ষভাবে ব্যক্ত করে না, কেবল বাস্তবতা যেভাবে গঠিত, সেই পরিপ্রেক্ষিতটি পরিচিত করায়। এটি নীৎসীয় ধারণা, যাঁর মতে ভাষা শ্রেণিবিন্যাসের (ক্যাটেগরিজ) ভিত্তিতে চিন্তা করতে বাধ্য করায়। এইসব শ্রেণি সম্বন্ধে সচেতন ধারণা সবসময় তেমন একটা থাকে না। নীৎসের মতে, ভাষা মিথলজি সৃষ্টি করে। মিথলজিকে আইডিওলজি দিয়ে প্রতিস্থাপিত করে ফিল্ম-তাত্ত্বিকরা সস্যুরের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন লাকাঁ তার অনুসরণে এই উপসংহারে আসেন যে, সিনেমার ভাষা কেবল বাস্তবতাকে স্বচ্ছতার সঙ্গে ব্যাখ্যা করে বলে মনে হলেও আসলে একটি মতাদর্শকেই (আইডিওলজি) প্রচার করে। এর ফলে আগে (ভাষা ব্যবহারের আগে) যা ভাবা হয়নি, তাই যেন ভাবা যায় সেই জন্য উপযোগী নতুন ভাষা সৃষ্টির প্রয়োজন রয়েছে, একথা বলা হয়।
লাকাঁর দ্বিতীয় যে ধারণা সিনেমায় প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে তা হলো বিষয় ও সিগনিফায়ারসমূহের মধ্যে আদান-প্রদানের ফলে যে অর্থ সৃষ্টি হয়, সেই সম্পর্কিত। এখানে লাকাঁ সস্যুরের ভাষাতাত্ত্বিক ‘চিহ্ন’ (সাইন) সম্পর্কে ধারণা একটু বদলে নিয়ে সূচককে (সিগনিফায়ারকে) বেশি গুরুত্ব দেন এবং বলেন যে, সূচিত (সিগনিফায়েড) ক্রমেই গুরুত্বে কমে যায়, যতই তারা সূচকের সঙ্গে নতুন সম্পর্কে যুক্ত হতে থাকে। অর্থাৎ সস্যুর যেমন ভেবেছিলেন, সেইভাবে অর্থ সিগনিফায়ার ও সিগনিফায়েডের মধ্যে স্থির সম্পর্ক দ্বারা তৈরি হয় না। এই সম্পর্কের অবনতি বা ক্রম পরিবর্তন যা রোধ করে এবং সাময়িকভাবে অর্থ নির্দিষ্ট করে, তা হলো দুয়ের ভেতরকার সম্পর্কে বিষয়ের হস্তক্ষেপে ছেদ পড়া। লাকাঁর মতে, এই ছেদ টানার মাধ্যমেই বিষয় (সাবজেক্ট) অর্থ সৃষ্টি করে। আবার বিষয়ও এই দুয়ের ভেতরকার সম্পর্কের ভিত্তিতে যে অর্থ, তার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। লাকাঁ এইভাবে বিষয় ও অর্থের মধ্যে অন্তহীন দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক শনাক্ত করেছেন, যা সিনেমার তাত্ত্বিক আলোচনায় ঘুরেফিরে এসেছে।
সিনেমায় সেমিওটিকসের প্রয়োগে যেসব প্রশ্ন উঠেছে তার মধ্যে রয়েছে : সিনেমা কি একটি ভাষা? সবাই এ বিষয়ে একমত হয়েছেন যে, এর উত্তর নির্ভর করবে সিনেমা কি সরাসরি অনুকরণ করে অথবা বাস্তবের অনুরূপ কিংবা বাস্তবের সমান্তরাল, এই শ্রেণির প্রশ্নের উত্তরের ওপর। অন্য শ্রেণির প্রশ্নের মধ্যে রয়েছে, সিনেমা কি এক ধরনের লেখা, যা প্রথাগত বা অপ্রথাগত ‘চিহ্ন’ পদ্ধতির (সেমিওটিকস) ওপর নির্ভরশীল? আমরা ইতোমধ্যেই সিনেমার নিজস্ব ফটো (ইমেজ) আছে বলে মনে আস্থা নিয়েছি, সুতরাং এই আলোচনা কেবল তর্কের জন্যই।
ফিল্মে সেমিওটিকসের প্রয়োগে যিনি প্রায় পথিকৃৎ, ক্রিশ্চিয়ান মেৎজ, শেষোক্ত এই প্রশ্নের সঙ্গে তাঁর উত্তর ছিল, হ্যাঁ এবং না। তাঁর মতে, সিনেমা একটি ভাষা, কিন্তু লিখিত ভাষার মতো তার কোনো নিয়মকানুন বা পদ্ধতি নেই (ল্যাঙ্গু) অর্থাৎ সস্যুর যেমন বলেছিলেন অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের জন্য সেই রকম কোনো ‘চিহ্ন’ বা সংকেত পদ্ধতি নেই। সস্যুর স্বাভাবিক ভাষার ক্ষেত্রে যেমন করেছিলেন মেৎজও সিনেমা কীভাবে উপলব্ধি করা যায়, সে সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করতে বা অনুধাবন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এ-ও জানতেন যে, লিখিত ভাষা আর সিনেমার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে, যার জন্য সস্যুরের ভাষাভিত্তিক সব ধারণা  (সেমিওটিক) এ ক্ষেত্রে প্রয়োগ বা ব্যবহার করা যাবে না। তিনটি কারণে ভাষার নিয়ম-পদ্ধতি (ল্যাঙ্গু) সিনেমার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা সম্ভব না বলে তিনি মনে করেন। প্রথমত. সিনেমায় অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের (ইন্টার-কম্যুনিকেশন) সুযোগ নেই। যদি সিনেমা প্রকাশ পদ্ধতি না হয়ে যোগাযোগ পদ্ধতিই হয় তাহলে বড়জোর এটি একতরফা যোগাযোগ স্থাপন করে। দ্বিতীয়ত. সিনেমায় ইমেজ বলতে যা বোঝায় সেসব সস্যুরের ‘চিহ্ন’ বা সংকেত থেকে পৃথক। সূচক আর সূচিতের মধ্যে খেয়ালখুশিভিত্তিক (আরবিট্রেরি) সম্পর্ক রয়েছে, সিনেমার ইমেজের ভেতর সেই সম্পর্ক নেই। ধারণা বা অনুভবের প্রতিরূপ হিসেবে সিনেমাকে বাস্তবের অংশই বলতে হয়। ভাষার সূচক (সিগনিফায়ার) তার তাৎপর্য বা অর্থ (সিগনিফিকেশন) সংকেত বা চিহ্ন পদ্ধতিতে তার অবস্থানের ভিত্তিতে পেয়ে থাকে। ইমেজের তাৎপর্য বা অর্থ নির্ভর করে তার প্রতিরূপ সৃষ্টির ওপর। তাছাড়া সাদৃশ্য ছাড়াও ইমেজ ও বিষয়ের (অবজেক্ট) ভেতর বস্তুগত সম্পর্ক রয়েছে, যার ফলে ইমেজ একই সঙ্গে ‘সূচক’ (ইনডেক্স) ও ‘প্রতিমা’ (আইকন)। মেৎজ অবশ্য স্বীকার করেছেন, বিষয়ের প্রতিফলন হিসেবে ইমেজ কিছুটা বিকৃত হতে পারে। পরবর্তীকালে তিনি এই স্বীকৃতির ভিত্তিতে ইমেজের ভেতর কল্পনার শনাক্তকরণ করে বিষয়টি আরো স্পষ্ট করেন। এই ধরনের ব্যাখ্যা করা হলেও মেৎজের সাধারণ যুক্তি ছিল এই যে, সিনেমা বাস্তবের প্রতিরূপ সৃষ্টি করে (ডুপ্লিকেটস), বাস্তবকে প্রকাশ করে না।
তৃতীয় যে কারণে সিনেমাকে একটি ভাষার মতো নিয়মকানুন বা পদ্ধতির মর্যাদা দেওয়া হয়নি তা হলো, এর ভেতর স্বাভাবিক ভাষার মতো দ্বিগুণ প্রকাশের (ডাবল আর্টিকুলেশন) ক্ষমতা নেই। ভাষার সীমিত চিহ্ন বা অক্ষরভিত্তিক শব্দের মিতব্যয়ী ব্যবহারে সাধারণ ভাষা অনেক ছোট ছোট ইউনিটের (শব্দ) সাহায্যে সীমাহীনভাবে বাক্য উচ্চারণ করতে পারে। ‘শব্দ’ নিয়ে এই যোগ-বিয়োগের ক্ষমতা সিনেমায় নেই। কেবল ‘শট’কে এই ক্ষমতার নিকটতম দৃষ্টান্ত মনে করা যায়, কিন্তু অক্ষরের উচ্চারণে যেমন অর্থ নেই, সিনেমার ‘শটে’ অর্থ থাকে। কিন্তু তাই বলে ‘শট’ একটি শব্দের মতো, একথাও মনে করেন না মেৎজ। তাঁর মতে, শব্দের তুলনায় ‘শট’ বাক্যের মতো অসংখ্য হতে পারে। কিন্তু সাধারণ ভাষায় শব্দের মতো সিনেমার ভাষায় শটগুলি আগে থেকেই বিদ্যমান নয়। সিনেমা নির্মাতাকে ‘শট’ উদ্ভাবন বা তৈরি করে নিতে হয় (যেমন বক্তা বা লেখক বাক্য তৈরি করে নেন, তা আগে থেকে বিদ্যমান নয়)। এর ভিত্তিতে মেৎজ এই উপসংহারে আসেন যে সিনেমার শট, ভাষায় বাক্যের সমতুল্য, কিন্তু ভাষায় বাক্যের ক্ষেত্রে যা সম্ভব সেইভাবে শটকে অস্পষ্ট ছোট ছোট ইউনিটে ভাগ করা যায় না। শব্দ বা বাক্যের উচ্চারণ যার মাধ্যমে বা সূত্রে অর্থময়তা পায় (সস্যুরের ল্যাঙ্গু বা পদ্ধতি), সিনেমা তেমন একটি পদ্ধতি না হলেও তাকে একটি ভাষা বলা যায় এই জন্য যে, মুখের ভাষার মতো না হলেও সূচক (সিগনিফাইং) হিসেবে যেসব উপকরণ (এলিমেন্টস), সিনেমা তাদেরকে সুশৃঙ্খলভাবে বিন্যস্ত করে এবং এই উপকরণগুলি বাস্তবতার ধারণার ওপর নির্ভর করে না। সিনেমা জগৎ-সংসারকে আলোচনার বিষয় করে তোলে, কেবল তার প্রতিরূপ সৃষ্টি করে না। কিন্তু এও মনে রাখতে হয় যে, সিনেমার সেমিওটিকস কেবল ইমেজের পর্যায়ে কাজ করলেই চলে না, কেননা প্রতিটি ইমেজই অনন্য, নতুন ও বাস্তবের সদৃশ। সিনেমার অর্থ কোনো পদ্ধতির ভেতর অবস্থানের জন্য নির্ধারিত হয় না, যার প্রতিরূপ সৃষ্টি (ডুপ্লিকেটস) করে তার সাহায্যেই হয়। স্বাভাবিক ভাষা পদ্ধতিতে যেমন শব্দ নির্বাচন করা সম্ভব, সিনেমায় ইমেজ নির্বাচনের জন্য তেমন শব্দভাণ্ডার নেই।
আদর্শ বা তুলনীয় মানদণ্ডের (প্যারাডাইম) অভাবের জন্যই মেৎজ সিনেমার সেমিওটিকসের ব্যাখ্যা করেছেন সিনট্যাগম্যাটিক সম্পর্কের ভিত্তিতে। নির্বাচন (সিলেকশন) নয়, সম্মিলন বা একত্রে যোগকরণ (কম্বিনেশন) – সিনেমা এই সেমিওটিকসের সন্ধান দিতে পারে বলে তাঁর ধারণা। ইমেজ কোনো সংকেত-পদ্ধতি (কোড) দ্বারা চিহ্নিত না হলেও বর্ণনায় (ন্যারেটিভ) তার উপস্থিতি দেখা যেতে পারে। যেহেতু সিনেমা মূলত ন্যারেটিভ এবং ঐতিহাসিকভাবে এটি শনাক্ত করার মতো কয়েকটি বর্ণনামূলক গঠন (ন্যারেটিভ স্ট্রাকচার) তৈরি হয়েছে, সেই জন্য যুক্তিসংগতভাবেই সিনেমায় ন্যারেটিভের সেমিওটিকসকে স্থান-কালভিত্তিক লজিক বা যৌক্তিক পদ্ধতির ভিত্তিতে দেখা সমীচীন। সিনেমার সব ন্যারেটিভ পদ্ধতিকে বিশদভাবে শ্রেণিভুক্ত করার জন্য মেৎজের যে প্রয়াস তাকে বলা হয়েছে ‘গ্র্যান্ড সিনট্যাগম্যাটিক’। স্বনির্ভর শট (ক্ষুদ্রতম অংশ) থেকে শুরু করে ক্রমান্বয়ে ওপরের দিকে গিয়ে সিকোয়েন্স (বৃহত্তম অংশ) পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে তার শ্রেণিভুক্তকরণ প্রক্রিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ (এলিমেন্ট) হলো স্বনির্ভর খণ্ড (অটোনমাস সেগমেন্ট),  যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ সময়ের দিক দিয়ে নিরবচ্ছিন্ন দৃশ্য (সিন) দৈর্ঘ্য এবং জটিলতার ভিত্তিতে যে আরোহী (হায়ারার্কি) পদ্ধতি তার ওপরই গড়ে উঠেছে মেৎজের শ্রেণিবিভাগ। এই আরোহী পদ্ধতিতে আটটি স্তর রয়েছে এবং মেৎজ তার প্রতিটিকে পরস্পরবিরোধী দুটি সম্পর্ক দ্বারা (বাইনারি) আলোচনা করেছেন। সংক্ষেপে এখানে তার আলোচনা করা যায় এবং কিছুটা ভিন্নভাবে। যেমন ফিল্মের খণ্ডটি (সেগমেন্ট) কি একটি শট, না একাধিক শট নিয়ে গঠিত? এই প্রশ্ন করে। যদি একাধিক শট নিয়ে গঠিত হয়, তাহলে খণ্ড সেগমেন্টটি কি সময়ের ক্রম অনুসারে হয়েছে, না তার ব্যতিরেকে? যদি সময়ের ক্রমানুসারে হয়ে থাকে, তাহলে কি যুগপৎ না পরপর?
মেৎজের ‘গ্র্যান্ড সিনট্যাগম্যাটিক’ (বিশাল শ্রেণিভুক্তকরণ) যেমন প্রশংসিত তেমনি সমালোচিত হয়েছে। সমালোচনার মধ্যে রয়েছে : (ক) কোনো কোনো শ্রেণি যেমন, স্বনির্ভর শট, এত বিশদ যে তার ভেতর বিভিন্ন ধরনের সিনেমার ফর্ম এসে যেতে পারে, যার ফলে শ্রেণি বিভক্তিকরণ সম্ভব নাও হতে পারে। (খ) ফিল্মের একটি খণ্ড (সেগমেন্ট) কোন কোন শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করা যাবে (সিন, না সিকোয়েন্স?) সেই সম্বন্ধে অস্পষ্টতা। (গ) স্বনির্ভর খণ্ড বলতে কী বোঝায় সেই প্রশ্ন, যা কেবল সিনেমার বিশ্লেষণ (রিডিং) ও ব্যাখ্যা দিয়েই নিষ্পত্তি করা যায়। কিন্তু এর ফলে ‘ভাষার’ গঠনের (সিনট্যাক্স) পরিবর্তে বিভিন্ন ব্যাখ্যা (সিম্যানটিকস) এসে যায়। এইসব অসুবিধার কারণে অনেক ফিল্মতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের জন্য সিনেমাকে খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত করার সময় ‘গ্র্যান্ড সিনট্যাগম্যাটিকে’র পদ্ধতি পরিহার করে অন্যভাবে অগ্রসর হয়েছেন। এছাড়া মেৎজের গ্র্যান্ড সিনট্যাগম্যাটিকের বিরুদ্ধে বড় সমালোচনা ছিল এই যে, এটি এমন এক নিষ্প্রাণ প্রথাগত পদ্ধতি তৈরি করেছে, যেখানে নির্ধারিতভাবে তৈরি অথবা রাজনৈতিক আদর্শের পুনঃসৃষ্টির জন্য সিনেমার পদ্ধতির ব্যবহার স্পষ্ট করা হয়নি।
মেৎজ পরবর্তীকালে সিনেমার সেমিওটিকস সম্বন্ধে তাঁর ধারণা সংশোধন করে যে ব্যাখ্যা দেন সেটি আগের তুলনায় নমনীয় হলেও কিছুটা জটিলও। সিনেমাকে ভাষা হিসেবে গ্রহণ করলেও তিনি প্রতিটি সিনেম্যাটিক টেক্সট প্রকাশের পেছনে নির্দিষ্ট নীতিমালার অনুসন্ধান থেকে বিরত হন। এর পরিবর্তে তিনি সিনেমা ও সিনেমার টেক্সটকে তাৎপর্যময়তার (সিগনিফিকেশন) প্রকাশ বলে গ্রহণ করে সেখানে বিভিন্ন প্রকৃতির নিয়ম-সংকেত (কোড) রয়েছে, সেই কথা বলেন। এইসব নিয়ম-সংকেতের কিছু সিনেমার সঙ্গে সম্পর্কিত এবং কিছু সম্পর্কিত নয়। কিন্তু উভয় ধরনের নিয়ম-সংকেতই নির্দিষ্ট, সুশৃঙ্খলভাবে পরস্পরের সঙ্গে ক্রিয়া-প্রক্রিয়ায় লিপ্ত হয়ে সিনেমার কোনো কোনো আলোচনার ক্ষেত্রে (কোনো একটি ফিল্ম, কোনো ফিল্মের শ্রেণি) নিষ্পত্তিকর/নির্ধারক (ডিটারমিনেন্ট) হিসেবে অবস্থান নেয় এবং সেই হিসেবে বিশ্লেষণের নির্দিষ্ট পর্যায়েও নির্ধারক হয়। সিনেমার নিজস্ব সংকেত পদ্ধতির (কোডস) মধ্যে তিনি অন্তর্ভুক্ত করেন সম্পাদনা, ফ্রেমিং, আলোকসম্পাত, রঙের ব্যবহার, শব্দ ও মুভমেন্ট, কমপোজিশন ইত্যাদি। সিনেমার বাইরের কোডের মধ্যে তিনি অন্তর্ভুক্ত করেন পোশাক, অঙ্গভঙ্গি, সংলাপ, মুখের অভিব্যক্তি ইত্যাদি। সিনেম্যাটিক কোডের মধ্যে তিনি আবার সাব-কোডের শ্রেণিবিভাগ করেন। ‘কোড’ সেখানে সব ধরনের ফিল্মের জন্যই সমানভাবে প্রযোজ্য, এমনভাবে উপকরণকে সংগঠিত করে। যেমন, লাইটিং। সিনেম্যাটিক সাব-কোড সেই স্থানে একটি কোডের ভেতর একাধিক সম্ভাবনার উল্লেখ করে সিদ্ধান্ত নিতে বলে। যেমন, লো-কী, হাই-কী লাইটিং। কোডগুলির মধ্যে পরস্পর-বিরোধিতা আছে, তাদের দুটি (অথবা অধিক) সম্ভাবনাকেই একসঙ্গে প্রয়োগ করা যায় না। বিভিন্ন কোড এবং তাদের সাব-কোডের মধ্যে একত্রে যোগ হওয়ার ভিত্তিতে (কম্বিনেশন) সিনট্যাগম্যাটিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। অপরদিকে একই কোডের সাব-কোডগুলি তাদের একের পরিবর্তে অন্যটির ব্যবহারের ভিত্তিতে প্যারাডাইগম্যাটিক সম্পর্ক দেখা যায়। সিনেমার কোডকে প্রায়ই তার সাব-কোডের অর্থের ভিত্তিতে সংজ্ঞায়িত বা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। স্বাভাবিক ভাষায় কোডের যে নির্দিষ্টতা তার সঙ্গে এই সম্পর্কের (সাব-কোডকে গুরুত্ব দেওয়া) পার্থক্য রয়েছে। সিনেম্যাটিক কোডকে দেখা হয়েছে সিগনিফায়ার হিসেবে বা সাব-কোডের সম্মিলনের উৎপন্ন সিগনিফায়েডের প্রক্রিয়া হিসেবে। যেমন, লেখকের কোডের তাৎপর্য (সিগনিফিক্যান্স) নির্দিষ্ট সাব-কোড থেকে (পরিচালক জন ফোর্ড, হাওয়ার্ড হকস) আলাদা করে বোঝা যায় না।
চিত্রপরিচালক পাওলো পাসোলিনি ফিল্মের যে সেমিওটিকস তৈরি করেছেন সেটি মেৎজের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। তাঁর তত্ত্বে বুর্জোয়াবিরোধী বাস্তবতা প্রাধান্য পেয়েছে। তিনি মেৎজের মতো যদিও মনে করেছেন যে, সিনেমা কোনো সামাজিক ভাষাসদৃশ পদ্ধতি নয়, কিন্তু এর জন্য যে কারণ তিনি দিয়েছেন তা ভিন্ন। পাসোলিনির মতে, সিনেমা এমন একটি ভাষা যা বাস্তবতার সাহায্যেই বাস্তবতাকে প্রকাশ করে। সুতরাং প্রশ্ন হলো : সিনেমা আর বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য  কোথায়?  পাসোলিনি উত্তর দিয়েছেন : কার্যত কোনো পার্থক্যই নেই। মেৎজের সঙ্গে পাসোলিনির পার্থক্যের ভিত্তি ছিল সিনেমাকে এমন একটি ভাষা হিসেবে দেখা, যার দ্বি-স্তরবিশিষ্ট প্রকাশক্ষমতা (ডাবল আর্টিকুলেশন) বা ভূমিকা রয়েছে; যদিও এই প্রক্রিয়া স্বাভাবিক ভাষার মতো এক নয়। পাসোলিনির মতে, ভাষায় ধ্বনি বা ধ্বনিগুচ্ছের (ফোনেম) মতো সিনেমার হ্রস্বতম ইউনিট হলো বস্তু, অ্যাকশন, অথবা ঘটনা, যা সিনেমায় পুনঃসৃষ্ট হয়েও অপরিবর্তিত থাকে। এদেরকে তিনি বলেছেন ‘সিনেমস’ এবং এদের নিজস্ব অর্থ রয়েছে, যে অর্থ স্বাভাবিক, প্রথাগত নয়। এরা বড় ইউনিটেও যুক্ত হতে পারে, যেমন শট। এই শটই পাসোলিনির মতে সিনেমার মূল ও তাৎপর্যপূর্ণ ইউনিট। ভাষায় দ্বিধাবিভক্ত করা সম্ভব, শটের সঙ্গে এমন ক্ষুদ্রতম শব্দের (মোরফেম) মিল রয়েছে। বাস্তব জগৎ থেকে বস্তু ও ঘটনাকে বেছে নিয়ে যুক্ত করার এই দ্বিতীয় প্রকাশ স্তরেই সিনেমা বাস্তবকে প্রকাশ করে। শব্দগুচ্ছের (ফোনেম) তুলনায় ‘সিনেমস’ (বস্তু, অ্যাকশন, ঘটনা, যা সিনেমায় প্রতিরূপে অপরিবর্তিত থাকে) একই সঙ্গে সীমাহীন (অন্তত অসংখ্য) এবং তারা যে বাধ্যতামূলক, সেই বৈশিষ্ট্য থাকে। ‘সিনেমসে’র ভেতর যেসব বস্তু, অ্যাকশন, ফর্ম বা ঘটনা থাকে এবং যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, আমরা তার ভেতর থেকে পছন্দমতো বাছাই না করে পারি না।
উমবার্তো ইকো সিনেমার সেমিওটিকস সম্বন্ধে তাঁর যে মতপ্রকাশ করেছেন সেটিও উল্লেখযোগ্য। তিনি মেৎজ ও পাসোলিনি উভয়ের এই সম্পর্কে যে ধারণা তার সমালোচনা করেছেন। তিনি পাসোলিনির সমালোচনা করেন, (ক) বাস্তবতা সম্বন্ধে তার ধারণার জন্য এবং (খ) কোনো কালচারাল কোডের (সাংস্কৃতিক সংকেত-পদ্ধতির) বাইরেই বাস্তব জগতের বস্তু এবং ঘটনাবলি সিনেমার আলোচনায় প্রাথমিক উপকরণ, এই তত্ত্বের জন্য। সিনেমায় বাস্তবতা প্রতিফলিত হয়, ইকো এই ধারণার বিরোধিতা করে বলেন যে, সিনেমায় যেসব ‘সিগনিফায়ার’ কালচারাল কোডসের ভিত্তিতে ‘সিগনিফায়েড’ হিসেবে দেখা দেয়, সেইসব ‘সিগনিফায়ারই’ প্রতিফলিত হয়। পাসোলিনি যেখানে প্রকৃতির বাস্তবতাকে দেখেছেন বা উপলব্ধি করেছেন, ইকো সেখানে শনাক্ত করেছেন সংস্কৃতি। ঘটনা, অ্যাকশন, বস্তু ইত্যাদি মানুষের ভেতর পারস্পরিক আচার-আচরণের (ফর্ম) যে অঙ্গভঙ্গির রূপ গ্রহণ করে, সেইসব পাসোলিনি যেমন ভেবেছিলেন (অর্থাৎ সংস্কৃতির অতিরিক্ত – এক্সট্রা-কালচারাল, অমার্জিত রূপ) তার পরিবর্তে প্রথা, কোড (পদ্ধতি) এবং আদর্শের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তার মতে, পাসোলিনির ভুল ছিল এই যে, ‘সিগনিফায়ার’, ‘সিগনিফায়েড’ এবং যার সঙ্গে তুলনা বা সম্পর্কিত করা হচ্ছে সেসব কার্যত একত্রে মিশিয়ে ফেলা। পাসোলিনির বিরুদ্ধে তাঁর দ্বিতীয় সমালোচনা ছিল এই যে, ‘সিনেমস’ এবং ‘ফোনেমসে’র মধ্যে তুলনা, যা তার মতে ধোপে টেকে না, কেননা একমাত্র সংযুক্ত (কম্বিনেশন) অবস্থাতেই ফোনেমসের (শব্দ গুচ্ছের) অর্থ পাওয়া যায়, তাদের পৃথক অস্তিত্বের ভিত্তিতে নয়। কিন্তু ‘সিনেমস’ শনাক্তযোগ্য বস্তু হিসেবে তাদের নিজের ভিত্তিতেই অর্থময়। শট ও মোরফেমের (বিভক্তিকরণযোগ্য অর্থময় শব্দ) সমতুল্যতাও প্রশ্নাতীত নয়। মেৎজের মতো ইকোরও প্রস্তাবনা ছিল এই যে, শট একটি শব্দের চেয়ে একটি উচ্চারণের অনেক কাছাকাছি। যেমন সিলভেস্টার স্ট্যালোন যখন কোমর পর্যন্ত নগ্ন অবস্থায় রকেট ক্ষেপণ করে তখন ‘র‌্যাম্বো’কে বোঝানো (সিনিফাই) হয় না, বরং বলা হয় ‘এই যে র‌্যাম্বো এখানে’।
প্রায় একই কারণে ইকো মেৎজেরও সমালোচনা করেন। তাঁর মতে, মেৎজ বুঝতে পারেননি যে ইমেজ শুধু বাস্তবতার ডুপ্লিকেট বা সদৃশ রূপ নয় (এবং সেই জন্য খেয়ালখুশিহীন এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত) বরং কোডের আধারও হতে পারে। ইমেজের অলঙ্ঘনীয় এই প্রাধান্য বা অগ্রাধিকার (যা প্রায় বাস্তবতার সমতুল্য) সম্বন্ধে মেৎজের বিশ্বাস সিনেমাকে পদ্ধতি (ল্যাঙ্গু) ছাড়াই একটি ভাষা হিসেবে বিবেচনা করতে সমর্থন করেছে। এই বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করেই মেৎজ ইমেজ সিনট্যাগম্যাটিক গঠনের (স্ট্রাকচার) সঙ্গে সংযুক্ত হয়, এই কথা বলেছেন এবং তার প্রতি মনোনিবেশ করেছেন। ইকোর মতে, ইমেজ তার অস্তিত্বের জন্য সাংস্কৃতিক সংকেত পদ্ধতির (কালচারাল কোডস) ওপরই নির্ভর করে। ইমেজের প্রকাশে অন্তত দশটি কোড কার্যকর বলে তিনি শনাক্ত করেন : উপলব্ধির কোড, প্রেরণ করার কোড, স্বীকৃতির কোড, স্বরের কোড, প্রতিমার বা ইমেজের কোড, রুচি ও বোধের কোড, বক্তৃতা বা বাকভঙ্গির কোড, শৈলীর কোড, অবচেতনের কোড ও আইকনোগ্রাফিক (আদর্শমূর্তি) কোড।
সংস্কৃতির সীমাকে সংক্ষিপ্ত করে দেখবার জন্যই ইকো যে মেৎজ ও পাসোলিনির মত সমর্থন করেননি, এটি বেশ বোঝা যায়। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল প্রতিটি সিগনিফিকেশনই অন্তর্লীন উপকরণের যে কোড বা একাধিক কোডের সঙ্গে সম্পর্কিত, তার ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করা। প্রথা ও সংস্কৃতির ওপর তিনি যে জোর দেন সেই প্রবণতা ‘চিহ্ন’ (সাইন) সম্পর্কে তার ধারণাতেও প্রসারিত। ‘চিহ্ন’কে তিনি সংজ্ঞায়িত করেন সেইসব বলে, যা ইতিপূর্বে প্রতিষ্ঠিত সামাজিক প্রথার ভিত্তিতে অন্য কিছুর বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করা যায়। তাঁর বিশ্লেষণে প্রথা (কনভেনশন) সিগনিফিকেশনের জন্য প্রয়োজনীয় শর্ত। ইমেজ (যেমন, জেব্রার ড্রয়িংয়ে লম্বা দাগ) এবং বস্তু বা প্রাণীর ভেতর যেসব সাধারণ বৈশিষ্ট্য (যেমন, জেব্রার লম্বা দাগ) তার ভিত্তিতেই উপলব্ধি করা হয়। অর্থাৎ প্রথাগত ধারণার যে কোড তার সাহায্যই নেওয়া হয় ইমেজের সৃষ্টিতে।
সিনেমা এক স্তরবিশিষ্ট প্রকাশ (সিঙ্গল আর্টিকুলেশন) এবং সিনেমা দ্বিস্তরের প্রকাশ (ডাবল আর্টিকুলেশন), মেৎজের এই উভয় মতের সঙ্গেই ইকো দ্বিমত পোষণ করে সিনেমার ক্ষেত্রে সেমিওটিকস সম্বন্ধে তাঁর ধারণা আরো স্পষ্ট করেন। এদের পরিবর্তে তিনি বলেন যে সিনেমা প্রকাশ করে তিন স্তরে (ট্রিপল আর্টিকুলেশন)। প্রথম স্তরের প্রকাশে সিনেমার ইমেজ তিনটি অর্থময় ইউনিটে ভেঙে দেখানো যায়, যা শনাক্তযোগ্য এবং যাদের নাম দেওয়া যায় ‘সেমেস’। দৃষ্টান্তস্বরূপ অদ্ভুত নীল পোশাক এবং পেছনে কেপ করা লোক, এর সঙ্গে নিউইয়র্ক স্কাইলাইন, এই দুটিই সেমেস। এই দুটি মিলে সুপারম্যান নিউইয়র্কের আকাশে উড়ে যাচ্ছে, তা বোঝানো হয়। ‘সেমেজ’ দুটিকে আবার ছোট আকারে প্রতিমা চিহ্ন (আইকনিক সাইন) হিসেবে বিশ্লেষণ করা যায়, যেমন বদ্ধমুষ্টি, দৃঢ় থুতনি যা কেবল ‘সেমেসে’র পরিপ্রেক্ষিতেই উপলব্ধি এবং চেনা যায়, কেননা তারা একটি নিরবচ্ছিন্ন দৃশ্যের অংশ। এইভাবে ইকো সিনেমার দ্বিতীয় স্তরের প্রকাশ ব্যাখ্যা করেন। প্রতিমার চিহ্নকে (আইকনিক সাইন) উপলব্ধির তৃতীয় প্রকাশ স্তর হিসেবে বিশ্লেষণ করা যায় যেমন, কৌণিকতা, বক্রতা, টেক্সচার, আলোছায়ার খেলা ইত্যাদি। এসব অবস্থা বা রূপের নিজস্ব কোনো অর্থ নেই এবং সেই কারণে এরা ফোনেমসের (শব্দগুচ্ছের) সমতুল্য। তাদের মধ্যবর্তী বৈপরীত্য ও বিরোধিতাই তাদেরকে সংজ্ঞায়িত করে। কিন্তু অর্থ নির্মাণের জন্য তারা অত্যাবশ্যকীয়, কেননা ক্রমাগত পরিবর্তনের প্রক্রিয়াই একপর্যায়ে এসে পৃথক প্রতিমা চিহ্নের (আইকনিক সাইন) প্রকাশ ঘটাবে। সিনেমার কোডের ব্যাখ্যায় তৃতীয় স্তরবিশিষ্ট প্রকাশ গভীরতর পর্যায়ে বাস্তবতার পরিচয় দিতে পারে, যা অন্য কোনো প্রতিনিধিত্বমূলক পদ্ধতিতে সম্ভব নয় বলে ইকো মনে করেন।
মেৎজের মতো ইকোও পরবর্তী সময়ে তাঁর মতের সংশোধন করে অনড় ধারণা থেকে সরে এসে নমনীয় অবস্থান গ্রহণ করেন। চিহ্নকে নির্দিষ্ট মূল্য বিশিষ্ট বা তাৎপর্যপূর্ণ প্রাথমিক ইউনিট মনে না করে (তিন স্তরের প্রকাশকের ভিত্তি, যা পদ্ধতির তুলনায় গঠনকে প্রাধান্য দেয় বলে অনেকেই প্রত্যাখ্যান করে) ইকো বলেন যে, চিহ্ন (সাইন) কোডিং সংক্রান্ত নিয়মের অন্তর্বর্তীকালীন ফলাফল, যার মাধ্যমে উপকরণের ভেতর সাময়িকভাবে পারস্পরিক যোগাযোগ স্থাপিত হয়। এই উপকরণগুলির প্রতিটিই কোডের নির্ধারিত পরিপ্রেক্ষিতে অন্য একটি যোগাযোগ স্থাপনের অধিকারপ্রাপ্ত হয়, যার ফলে একটি নতুন চিহ্ন (সাইন) সৃষ্টি হয়। ইকো এইভাবে উপসংহারে আসেন যে, পরিপ্রেক্ষিতই ঠিক করবে একটি চিহ্নের কোনটি উপকরণ হিসেবে বিবেচিত হবে আর কোনটি হবে না। চিহ্ন এইভাবে পরিপ্রেক্ষিতের ওপর নির্ভরশীল এবং তার প্রতি স্পর্শকাতর। ইকোর সংশোধিত সেমিওটিকসে নির্দিষ্ট আন্তঃসম্পর্কের ভেতর নির্দিষ্টভাবে প্রকাশকে শনাক্ত করার ভূমিকা থাকে না। এর কারণ পরিপ্রেক্ষিত ও দৃষ্টিকোণের ওপর নির্ভর করে প্রথম স্তরের প্রকাশে ব্যবহৃত একটি উপকরণ দ্বিতীয় স্তরের প্রকাশে উপকরণ হয়ে যেতে পারে।
স্টিফেন হীথের মতে, সেমিওটিকসের প্রয়োগের আগে সিনেমা ও ভাষার মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে দুটি প্রচলিত চিন্তাধারা ছিল। প্রথমটিতে সিনেমাকে দেখা হয়েছে বিশুদ্ধ শিল্প হিসেবে এবং সেই দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষাকে মনে করা হয়েছে ক্ষতিকর অনুপূরক (সাপ্লিমেন্ট), যা প্রতিনিধিত্বের পাশাপাশি ভুল প্রতিনিধিত্বও করার ক্ষমতা রাখে এবং ইমেজের প্রত্যক্ষ সত্যকে আচ্ছন্ন করে ফেলতে পারে। ভাষার শব্দ ও ইমেজের মধ্যে এই জ্ঞানার্জনভিত্তিক (এপিস্টেমোলজিকাল) বিভেদের সঙ্গে নান্দনিকতার সূত্রে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত বিষয় হলো বাস্তবতা। অর্থাৎ ইমেজের মতো নান্দনিকতার বিচারে বাস্তবতা বিঘিœত হয় ভাষার জন্য। দ্বিতীয়
চিন্তাধারা অনুযায়ী সিনেমা প্রকৃতপক্ষেই একটি ভাষা এবং এই জন্য অন্যান্য শিল্পের সঙ্গে এর সাযুজ্য রয়েছে এবং তাদের সঙ্গে তুলনীয়। সাহিত্যিক কিংবা চিত্রকরের তুলনায় সিনেমা নির্মাতার হাতে অনেক বেশি সম্পদ (উপায়-উপকরণ) থাকার জন্য সিনেমা শিল্পীর (নির্মাতার) কল্পনার প্রকাশ হতে পারে বেশ স্বচ্ছন্দে। ক্যামেরা শুধু ইতিপূর্বে বিদ্যমান বাস্তবতাকে ধারণ করার জন্য যান্ত্রিক উপায় নয়, বরং সিনেমা নির্মাতার কলম ও ব্রাশ। এই জন্য সিনেমায় শিল্পীর (লেখকের) নান্দনিক প্রকাশ হতে পারে।
বাস্তবতার প্রসঙ্গে সিনেমার প্রতি চ্যালেঞ্জ আসে এর স্বচ্ছতার প্রশ্নে। সেমিওটিকসের মতে, সিনেমা বহির্জগতের বাস্তবতার প্রতিফলন নয় বরং এটি একটি ‘নির্মাণ’, যা সবসময়ই তাৎপর্যময় হবার (সিগনিফিকেশন) প্রক্রিয়ার মধ্যে রূপ নেয়। প্রচলিত কোনো মতাদর্শের (আইডিওলজি) নির্দেশিত বাস্তবতার রূপের সঙ্গে সামঞ্জস্যময় বলেই সিনেমায় যে বাস্তবতার নির্মাণ তা গ্রহণ করা হয়। বাস্তবতার এই মায়া বা ইফেক্ট মতাদর্শের অধীনস্থ কিছু সংকেত পদ্ধতি (কোডস) ছাড়া আর কিছু না। সিনেমা ইতিপূর্বে বিদ্যমান বাস্তবতার পুনর্নির্মাণ বা প্রতিফলন নয় বরং কল্পিত এক বাস্তবের নির্মাণ ও গঠন। টেক্সটের অন্তর্গত অর্থের উৎস হিসেবে লেখককে কৃতিত্ব বা স্বীকৃতি দেওয়ার প্রচলিত ধারণার বিরুদ্ধেও সেমিওটিকস একইভাবে আপত্তি জানায়। যেহেতু একটি টেক্সট তৈরির আগে কোনো ‘অর্থ’ থাকে না সেই জন্য লেখকের ইচ্ছা বা অর্থ প্রকাশের প্রশ্ন অবাস্তব। টেক্সটের ভেতর যেসব কোডস রয়েছে তার মাধ্যমে নির্মাণের ভিত্তিতেই লেখকের ভূমিকার কথা আসতে পারে। স্টিফেন স্পিয়েলবার্গের যে ইচ্ছাই থেকে থাকুক না কেন, তাঁর ছবি তৈরির বৈশিষ্ট্য ও গঠন তিনি যে ছবি পরিচালনা করেছেন তার ভেতরই আছে, বাইরে কোথাও নয়। এইভাবে সেমিওটিকস বাস্তবতা এবং লেখকের ভূমিকা (অথর), উভয় ক্ষেত্রেই প্রচলিত চিন্তাভাবনা ও ধারণাকে অসমর্থনযোগ্য করে তুলেছে।
স্টিফেন হীথের লেখা ও বক্তব্যই ফিল্মে সেমিওটিকসের প্রয়োগ ও অনুশীলনকে চূড়ান্ত দিক নির্দেশনা দিয়েছে, একথা বলা যায়। হীথ পূর্বসূরি ফিল্ম সেমিওটিকস তাত্ত্বিকদের প্রসঙ্গে মেৎজের প্রাথমিক ব্যাখ্যা এবং পাসোলিনির ধারণার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে ইকোর সঙ্গে যোগ দেন। তাঁর মতে, মেৎজের প্রাথমিক ভাষ্যে এবং পাসোলিনির ফিল্ম সেমিওটিকস সম্বন্ধে ধারণায় সিনেমার বিশেষ কার্যক্রম উপেক্ষা করে কেবল ইমেজ দিয়ে ডুপ্লিকেট তৈরি করা হয়, এর প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ইমেজের আপাত স্বাভাবিক (ন্যাচারাল) প্রকাশের অন্তরালে অনেক কোডের প্রক্রিয়া এবং প্রথা তৈরি কার্যকর, ইকোর এই মতের প্রতি তিনি সমর্থন জানান। কিন্তু এই মত পোষণ করলেও হীথ মনে করেন যে, মেৎজের প্রতিই মনোযোগ দিতে হবে, কেননা তিনি তাঁর সেমিওটিকস সংক্রান্ত সংশোধিত ভাষ্যে কোড ও প্রথার (কনভেনশন) মাধ্যমে সিনেমার সামাজিক ভিত্তির ওপর আলোকপাত করেছেন। তার আগে এই বিষয়টি প্রায় অপরিজ্ঞাতই ছিল। অন্য কোনো কিছুর চেয়ে সিনেমা ও দর্শকের ভেতরকার সম্পর্ক সম্বন্ধে হীথের চিন্তাভাবনাই ফিল্ম-সেমিওটিকসকে নতুন পথের দিকে নিয়ে যায়। এখানে তিনি ইকোর সঙ্গে সম্পর্কছেদ করেন, কেননা তিনি এ ধরনের অনুসন্ধান (সিনেমা ও দর্শকের সম্পর্ক) নিয়ে বেশি কৌতূহল দেখাননি। হীথ এই পর্যায়ে জুলিয়া ক্রিস্টেভার ধারণার প্রতি আকৃষ্ট হন, কেননা তিনি ভাষার অন্তর্গত বর্ণনাকারী বিষয় (স্পিকিং সাবজেক্ট) নিয়ে তত্ত্ব তৈরির জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। ক্রিস্টেভার মতে, এই তত্ত্ব তৈরি করতে হলে বিষয়ের সীমা অতিক্রমকারী (ট্রানসেনডেন্টাল) উপায় হিসেবে সুশৃঙ্খল অর্থ পদ্ধতির (ফর্মালাইজড মিনিং সিস্টেম) অনুশীলন ভুলে যেতে হবে অথবা তা পেছনে রেখে মনস্তত্ত্বের চিহ্নের অধীনে একটি পর্যায়ে বা পর্বে প্রবেশ করতে হবে, যেখানে তাৎপর্যময়তাকে (সিগনিফিকেশন) দেখা হয়েছে নির্বস্তুক ভাবনার নির্মাণ হিসেবে। টেক্সটের গঠন থেকে গঠনের প্রক্রিয়ার দিকে এই সরে আসার সংশ্লেষ সম্পর্কে হীথের চিন্তাভাবনা তাঁকে ইউরোপে সেমিওটিকসের একজন অভিজ্ঞ প্রবক্তা হিসেবে চিহ্নিত করে।
হীথের সেমিওটিক সম্পর্কিত ধারণা দুই পর্বে গড়ে উঠেছে। প্রথম পর্বে তার ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে লুই আলথুসার এবং দ্বিতীয় পর্বে জ্যাক লাকাঁ। প্রথম পর্বে হীথের চিন্তাধারায় সিনেমা একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দর্শককে তার অধীনস্থ সদস্যের (সাবজেক্টস) মতো বিবেচনা করে বলে মনে করা হয়েছে, ঠিক যেমন মতাদর্শবাদী কোনো রাষ্ট্র (মার্কসিস্ট) যন্ত্র করে থাকে। সিনেমার টেক্সট দ্বারা নির্দেশিত হয়ে যাকে যে পরিচিতি দেওয়া হয়, দর্শক তাই মেনে নেয় এবং এমন একটি অবস্থানে নির্দিষ্ট হয়ে যায় যেখানে একটি ধারণার আদল বা প্রবণতা এবং সচেতনতা তার কাছে স্বাভাবিক মনে হয়। দর্শক এইভাবে বাস্তবে তার সামাজিক অবস্থান প্রসঙ্গে একটি কল্পিত সম্পর্কে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। এই ধারণা অনুযায়ী টেক্সট যে আদর্শবাদী পরিপ্রেক্ষিত তাকে দেয়, সেটিই হয়ে যায় বাস্তবতার অভিব্যক্তি। হীথের ধারণার এই পর্বে মতাদর্শকে ধারণার ভিত্তিতে কোনো পদ্ধতি মনে করা হয় না, বরং প্রতিনিধিত্ব করার ব্যবহারিক প্রক্রিয়া মনে করা হয়। দর্শককে এমন স্থানে প্রতিষ্ঠিত করা হয়, যেখানে একটি বিশেষ অর্থই উপলব্ধি করা যায়। অর্থাৎ পাঠক যেমন টেক্সট দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়, দর্শকও ফিল্ম দ্বারা একই অভিজ্ঞতা লাভ করে। টেক্সট পাঠকের প্রতিক্রিয়া নির্ধারণ করে এবং একইভাবে সিনেমা দেখতে গিয়ে দর্শক টেক্সট দ্বারা তার জন্য নির্ধারিত ভূমিকাই গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।
হীথ তাঁর ফিল্ম-সেমিওটিকস সম্পর্কিত ধারণার দ্বিতীয় পর্বে আরো জটিল ও সূক্ষ্ম তত্ত্বের বিশদীকরণ করেন। এখানে তিনি আলথুসারের মতাদর্শ তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করে তাঁর প্রথম পর্বের মতামত সংশোধন করে নেন। লাকাঁর ধারণা ও চিন্তাভাবনা এই দ্বিতীয় পর্বে বেশ প্রভাব বিস্তার করে। এই পর্বে হীথ উপসংহারে আসেন যে, টেক্সটকে পদ্ধতি হিসেবে না দেখে প্রক্রিয়া হিসেবে দেখতে হবে। সিনেমাকে বস্তু বা প্রতিষ্ঠান হিসেবে না দেখে অপারেশন বা ক্রিয়াশীল হিসেবে দেখতে হবে। টেক্সটকে কতগুলি আনুষ্ঠানিক বৈশিষ্ট্য প্রদান করে সিনেমা অন্যান্য কার্যক্রমের (প্র্যাকটিস) এবং সিগনিফিকেশন (তাৎপর্যময়করণ), মতাদর্শ ও ইতিহাসের সাধারণ সম্পর্কগুলির উপলব্ধিতে বিঘœ ঘটানোর উপক্রম করে। টেক্সটের রাজনৈতিক কার্যক্রম বিশ্লেষণের উত্তম পন্থা হওয়ার পরিবর্তে সেমিওটিকস তখন একটি অন্তরায় হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। এই ঝুঁকি এড়াবার জন্য হীথ সিনেমার এমন একটি ধারণার বিশদীকরণ করেন, যা বিশেষ তাৎপর্যময়করণে (সিগনিফাইং) সহায়ক হয়। বিশেষ তাৎপর্যময়করণ ক্রিয়া হিসেবে পদ্ধতি (ল্যাঙ্গু) এবং সেই পদ্ধতির অন্তর্গত নিয়মকানুন (প্যারোল) নয়, বরং আলোচনা (ডিসকোর্স) হিসেবেই সিনেমাকে দেখা হয়, যেখানে একটি বিষয় মনস্তত্ত্বের ব্যাখ্যার ভিত্তিতে জড়িত হয়ে যায়। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে সিনেমা মতাদর্শ তৈরির অনেক পন্থার মধ্যে একটি হয়ে যায়। এই পন্থায় দর্শক বিষয় (সাবজেক্ট) হিসেবে অংশগ্রহণ করে এবং সেই অংশগ্রহণের বিষয় হিসেবে প্রক্রিয়াও ইমেজের সঙ্গে যুক্ত থাকে। সিনেমা এইভাবে সেমিওটিকসের সৃষ্টি হয়ে যায়, যেখানে অর্থ ও ধারণার ইফেক্ট তৈরি হয়, আত্মপ্রতিকৃতি এবং নির্মাতা ও দর্শক এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সকলের অবস্থান নির্ণীত হয়। হীথের এই পর্বের ধারণায় লাকাঁর চিন্তাভাবনা কেন্দ্রীয় প্রভাব বিস্তার করে। হীথ লাকাঁর সব ব্যাপারে একমত না হলেও তাঁর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ যে অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারে এমন ভেবেছিলেন।
১৯৬৮-এর পর থেকে ফিল্মের অনুশীলনে রাজনীতির ভূমিকা যেমন গুরুত্ব পায়, তার অনুষঙ্গ হিসেবে সেমিওটিকস ও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণও আলোচনায় সামনে চলে আসে। তখন সেমিওটিকসের আপাতদৃষ্টে যে বৈজ্ঞানিক মর্যাদা ও ভূমিকা পরিলক্ষিত হয় তার ভিত্তিতে ফিল্ম সম্বন্ধে অন্য সব আলোচনা ও বিশ্লেষণ প্রায় অপসারিত হয়ে যায় বা পেছনে সরে যায়। ফিল্ম স্টাডিতে অর্থপূর্ণ আলোচনা, বিশ্লেষণ ও অগ্রগতির জন্য সেমিওটিকসই হয়ে দাঁড়ায় একটি পূর্বশর্ত। গত শতাব্দীর আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে ফিল্মের ওপর সেমিওটিকসের এই প্রাধান্য হ্রাস পেতে থাকে। বর্ণনা (ন্যারেটিভ), দৃষ্টিকোণ (পয়েন্ট অফ ভিউ), সম্পাদনা ইত্যাদি বিষয়ে বিশেষ ও বিশদ অনুশীলনের ক্ষেত্র হিসেবেই সেমিওটিকস এখন প্রাসঙ্গিক। দর্শকের সঙ্গে সিনেমার সম্পর্ক নিয়ে সেমিওটিকস আগের মতো উচ্চকণ্ঠ নয়। ফিল্মের ভাষা লিখিত ভাষার মতোই চিহ্নের ব্যবহার করে, তবে তার উদ্দেশ্য দর্শককে নির্দিষ্ট অবস্থানে সীমাবদ্ধ করা নয়, তাকে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে (বর্ণনা, সম্পাদনা) চিহ্নের ব্যবহার সম্বন্ধে অবহিত করে সিনেমার উপলব্ধিতে সহায়তা করা। বলা যায়, এই উদ্দেশ্যেই লিখিত ভাষা এবং অনেক যোগাযোগ মাধ্যমের মতো সেমিওটিকস সিনেমাকেও তার অন্তর্ভুক্ত করেছে। এই অন্তর্ভুক্ত করার অর্থ অধীনস্থকরণ নয়, যা মতাদর্শকে (আইডিওলজি) প্রাধান্য দিলে অবশ্যম্ভাবী হয়ে যায়।
সিনেমা একটি যোগাযোগ স্থাপনকারী মাধ্যম। সিনেমার নিজের ভাষা আছে, এই ভাষা অন্য শিল্পের ভাষার ওপর নির্ভরশীল, সেই তর্কে এখন না গিয়েও বলা যায় যে, অক্ষরভিত্তিক (আক্ষরিক) ভাষার মতো সিনেমাও অনেক যোগাযোগ পদ্ধতির মধ্যে একটি। ভাষা হিসেবে সিনেমার পরিচয় ও ভূমিকা জানার জন্য এক্ষেত্রে প্রচলিত তত্ত্বের উল্লেখ করতে হয়। গত শতাব্দীর প্রথম দিকে ভাষাতাত্ত্বিক ফার্দিনান্দ সস্যুর এই মত প্রকাশ করেন যে, ভাষা-সংকেতের বিস্তৃত ও ব্যাপক পরিধির অন্যতম বিষয় আক্ষরিক ভাষা ছাড়াও অন্যান্য সংকেত চিহ্নের সাহায্যে ভাব প্রকাশ করে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়। সংকেতনির্ভর যোগাযোগ স্থাপনের এই বিস্তৃত প্রক্রিয়ার তিনি নাম দিয়েছিলেন ‘সেমিওটিকস’ বা ‘সেমিওলজি’। যদি একথা মেনে নেওয়াও হয় যে, সিনেমার ব্যাকরণ নেই (ভাষা হিসেবে) কিন্তু এর যে নিজস্ব সংকেত পদ্ধতি (কোডস) রয়েছে, সেটি না মেনে উপায় নেই। সিনেমার হয়তো নির্দিষ্ট শব্দের ভাণ্ডার (ভোকাবুলারি) নেই, কিন্তু এর নিজস্ব সংকেত-পদ্ধতি (কোড) আছে যার সাহায্যে যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হয়। একই সঙ্গে সিনেমা অন্যান্য শিল্পের যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত সংকেত বা পদ্ধতি (কোডস) ব্যবহার করে।
সংকেত (ভাষা) ও সংকেত-পদ্ধতির (কোড) সংজ্ঞার সাহায্যে সিনেমা শিল্পের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যার প্রক্রিয়ায় সিনেমাকে খণ্ডে খণ্ডে ভাগ করার (সংগীত, সংলাপ) ওপরই জোর দেওয়া হয়। কিন্তু সিনেমা অন্যান্য শিল্পের মতো, তার সামগ্রিক প্রকাশেই মূল্যায়িত হতে পারে। দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যায়, সংগীতে ছন্দ, সুর ও সামঞ্জস্য (হারমনি) প্রয়োজনীয় উপাদান বা গুণ। এই প্রতিটি পদ্ধতির (কোডস) মধ্যে রয়েছে বিভক্ত পদ্ধতি (সাব-কোডস) যেমন জাজ সংগীতে উঁচু-নিচু স্বরের তাল (সিনকোনেটেড বিট) একটি উপ-পদ্ধতি (সাব কোড)। কিন্তু থেলোনিয়াস মঙ্কের নিজস্ব, প্রায় খামখেয়ালিপূর্ণ সিনকোনেটেড বিট (তাল) প্রচলিত উপ-পদ্ধতিকে (সাব-কোডস) অতিক্রম করে অর্থাৎ সেটি হয় তার অতিরিক্ত কিছু। লরেন্স অলিভিয়ার যখন ‘রিচার্ড দি থার্ডে’ আংটি পরা হাত বাড়িয়ে দেন তখন সেই ভঙ্গিতে যে নিজস্বতা তা ভঙ্গির উপ-পদ্ধতি, সাব-কোডকে আরো মহিমান্বিত করে। একইভাবে একই কোড, সাব-কোড ব্যবহার করে একজন পরিচালক হন সত্যজিৎ, অন্যজন হন অখ্যাত গড়পড়তা একজন পরিচালক। সিনেমার নান্দনিকতা বিচারেও সিনেমার সংকেত (ভাষা), সংকেত-পদ্ধতি (কোড), উপ-পদ্ধতি (সাব-কোড) ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এদের ভিত্তিতে অর্থাৎ এসব ব্যবহার করে কোনো সিনেমা নান্দনিকতার বিচারে উত্তীর্ণ হবে কি হবে না তা অনেকটাই নির্ভর করবে কে বা কারা সিনেমার সমগ্রতাকে বাস্তবায়িত করছে তাদের দক্ষতা ও সৃজনশীল প্রতিভার ওপর। অন্যান্য শিল্পের মতো সিনেমাজগতেও দক্ষতা দিয়ে মোটামুটি ভালো সিনেমা তৈরি করা যেতে পারে, কিন্তু উঁচুমানের সৃষ্টির জন্য অবশ্যই চাই অভিজ্ঞতা ও জন্মগত প্রতিভা।
সিনেমার নান্দনিকতা বিচারে যেহেতু সাধারণ সংকেত (সেমিওটিকস বা সংকেতনির্ভর যোগাযোগ পদ্ধতি মাধ্যম), সংকেত পদ্ধতি (কোড) এবং উপ-পদ্ধতির (সাব-কোড) আলোচনা হয়ে থাকে, যা সব শ্রেণির (ভালো-মন্দ) ছবি এবং সব পরিচালকের (স্টুডিও নিয়োজিত এবং স্বাধীন) ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, সেই জন্য মূলধারার প্রযোজক-প্রধান এবং তাঁর বা স্বাধীন-পরিচালক নির্মিত, দুই শ্রেণিরই সিনেমার কথা মনে রাখা প্রয়োজন। নান্দনিকতার প্রয়োজনে সাধারণ সংকেত, সংকেত-পদ্ধতি আর উপ-পদ্ধতির ব্যবহার শেষোক্ত শ্রেণির (স্বাধীন পরিচালক) সিনেমার ক্ষেত্রেই বেশি হবার সুযোগ থাকে, এই কারণে অন্য শ্রেণির সিনেমার নান্দনিক বিচারে সেসব ব্যবহার করা হবে না অথবা করা হলেও নমনীয়ভাবে করা হবে, এমন ভাবার অবকাশ নেই। সেমিওলজির (ভাষা ও অন্যান্য সংকেতনির্ভর যোগাযোগ মাধ্যম) দৃষ্টিকোণ থেকে সিনেমা শিল্প একাধিক সংকেত-পদ্ধতি ও উপ-পদ্ধতির সমাহার। কিন্তু নান্দনিক বিচারে তার শিল্পগুণ নির্ভর করে সংকেত, পদ্ধতি ও উপ-পদ্ধতির অতিরিক্ত সৃজনশীলতায় Ñ একথা মনে রাখলেই বিষয়টির (নান্দনিকতা) প্রতি সুবিচার করা হবে। সিনেমার অন্তর্গত অন্যান্য শিল্পের সংকেত, সংকেত-পদ্ধতি ও উপ-পদ্ধতি ছাড়াও তার যে রয়েছে নিজস্ব পদ্ধতি ও উপ-পদ্ধতি (যা তার প্রযুক্তিনির্ভর) সেই বিষয়টি সিনেমার নান্দনিক বিচারকে কিছুটা জটিল করে তুলতে পারে, যদি না সমগ্রের (সম্পূর্ণ চিত্র) সঙ্গে অংশের (সংগীত, সংলাপ) সম্পর্কটি মনে থাকে। সেমিওটিকস সিনেমাকে একটি যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে বিশ্লেষণ করে একে পদ্ধতি ও নিয়মের কাঠামোতে স্থাপিত করে। প্রচলিত ভাষার মতো তখন সিনেমাকে শনাক্ত ও তার কার্যকারিতা বিচারের সুযোগ পাওয়া যায়। সিনেমার নান্দনিকতা বিচারে সেমিওটিক একটি অর্থময় মাত্রা যুক্ত করে, এখানে তার ওপর কিছুটা আলোকপাত করা হলো।

Leave a Reply