হা স না ত আ ব দু ল হা ই
সিনেমা বিভিন্ন শিল্পের ভিত্তিতে তৈরি। যেমন, ফটোগ্রাফি, সঙ্গীত, চিত্রকলা, সাহিত্য ইত্যাদি। সিনেমাকে যদি বলা হয় সচল শব্দসংবলিত দৃশ্যকল্প তাহলে এর সামগ্রিক ভাষা সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায়। ভূমিকায় বলা হয়েছে, এই সামগ্রিক ভাষা একসঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে সিনেমার নান্দনিকতার বিচার করা যায়। এটি বেশ জটিল এবং অনুশীলনসাপেক্ষ। অভিজ্ঞ সমালোচক কিংবা বোদ্ধা দর্শকের পক্ষে এটা বিচার করা সম্ভব। অনেক ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় পুরস্কার এমন সামগ্রিক নান্দনিকতার বিচারেই দেওয়া হয়ে থাকে। আবার হলিউডের অস্কার পুরস্কার সিনেমার সামগ্রিক উৎকর্ষের জন্য এবং সিনেমার অন্তর্গত বিভিন্ন শিল্প মাধ্যমের জন্যও দেওয়া হয়ে থাকে। বলা বাহুল্য, সিনেমার সামগ্রিক ভাষার নান্দনিকতার বিচারের তুলনায় তার অন্তর্গত প্রতিটি ভাষার পৃথক আলোচনা ও বিশ্লেষণ তুলনামূলকভাবে সহজ। এর ফলে যেসব উপকরণ-প্রকরণের ভিত্তিতে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তাদের প্রত্যেকটির মূল্যায়ন সম্ভব হয়। সিনেমায় ব্যবহারের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন শিল্প মাধ্যমের (সঙ্গীত, সংলাপ, মঞ্চসজ্জা ইত্যাদি) নান্দনিকতা অভিজ্ঞ বোদ্ধা দর্শকের পক্ষে উপলব্ধি করা সহজ হয়ে যায় এবং চিত্র-সমালোচকও স্বচ্ছন্দে ব্যাখ্যা করতে পারেন। প্রশ্ন হলো, এই নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গি বা মানদণ্ড কী? যেসব শিল্প মাধ্যম (ফটোগ্রাফি, সঙ্গীত, সংলাপ) ব্যবহার করে সিনেমা তৈরি হয়েছে তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে গুণগত উৎকর্ষের বিচারে নান্দনিক চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। সেই মানদণ্ড ব্যবহার করা হলে অরণ্যের বৃক্ষগুলিকেই প্রধান করে দেখা হবে, অরণ্যকে তার সমগ্রতায় জানা যাবে না। সিনেমার নান্দনিকতার আলোচনায় তা প্রাসঙ্গিক হতে পারে না এবং সেই কারণে এই কৌশল বা পদ্ধতি খুব সন্তোষজনক না যদিও পুরস্কার দেওয়ার ক্ষেত্রে এমনভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে অর্থাৎ এক একটি শিল্প মাধ্যমকে পৃথক করে দেখে। সব শিল্প মাধ্যম প্রত্যেকে নিজের দাবিতে এক একটি পৃথক ভাষা কিন্তু যখন তারা সিনেমা নির্মাণে ব্যবহৃত হয় তখন তাদের গুণাগুণ বা নান্দনিকতার বিচার সিনেমার ভাষার প্রেক্ষিতেই হতে হবে। সিনেমার নান্দনিকতার বিচার এখানে তার মৌলিক ভাষার মানদণ্ডের নিরিখে অধিক গুরুত্বের সঙ্গে করা হয়েছে। অন্য যে দুটি মানদণ্ড রয়েছে সিনেমার নান্দনিকতা বিচারের জন্য যথা, সার্বিক ও বিভিন্ন শিল্পভিত্তিক মূল্যায়ন, তাদের প্রাসঙ্গিকতা স্বীকার করা হলেও মূল আলোচনায় প্রতিপাদ্য বিষয় হিসেবে তা গ্রহণ করা হয়নি।
সিনেমার ভাষাকে দুই ভাবে দেখা যেতে পারে। এক. সচল শব্দসংবলিত রঙিন দৃশ্যকল্প। দুই. সিনেমার আদি বা মৌলিক ভাষা, সচল দৃশ্যকল্প যেখানে সংলাপ নেই, রং এবং সঙ্গীত অনুপস্থিত; আছে শুধু মুখভঙ্গি আর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঞ্চালন। আগেই বলা হয়েছে, সিনেমার মৌলিক আর আদি ভাষা সচল দৃশ্যকল্প অর্থাৎ ওপরের দুটি ব্যাখ্যার মধ্যে শেষেরটি। বাংলায় ‘চলচ্চিত্র’ কথাটি খুব সুন্দরভাবে এই ভাষার বর্ণনা করে যার জন্য ‘সচল দৃশ্যকল্প’ আর ‘চলচ্চিত্র’ একে অন্যের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হবে আলোচনায়। স্থিরচিত্র যখন সচল হলো তখনই চলচ্চিত্রের জন্ম। নির্বাক সচল চলচ্চিত্রই সিনেমার মৌলিক ভাষা। পরবর্তী সময়ে যখন অন্য সব শিল্প মাধ্যম আত্তীকৃত করা হলো তখন সিনেমার ভাষার সংজ্ঞা বিস্তৃত করে বলা হলো ‘সচল, সশব্দ, রঙিন দৃশ্যকল্প’। যদি অন্য সব শিল্প মাধ্যম সিনেমায় যুক্ত না হতো, আত্তীকরণের সুযোগ থাকতো না, তাহলে সিনেমার মৌলিক ভাষা (সচল দৃশ্যকল্প বা চলচ্চিত্র) দিয়েই সিনেমার পরিচিতি দেওয়া হতো। এই কারণে পরবর্তী সময়ে অন্য যেসব শিল্প সিনেমার নির্মাণে যুক্ত হয়েছে (সঙ্গীত, সংলাপ, রং) তাদের মূল্যায়ন করতে হবে সিনেমার মৌলিক ভাষার (সচল দৃশ্যকল্প অর্থাৎ চলচ্চিত্র) প্রেক্ষিতে। অন্য সব শিল্প তাদের নিজ নিজ ভাষা নিয়ে এই মৌলিক ভাষাকে (সচল দৃশ্যকল্প/ চলচ্চিত্র) কতটুকু সাহায্য করতে পেরেছে, তাদের অবদানে সিনেমা কতটা শক্তিশালী ও সফল হয়েছে সিনেমার নান্দনিকতার বিচারে তাই হবে প্রাসঙ্গিক। প্রত্যেকটি শিল্প মাধ্যমের নিজস্ব নান্দনিকতার পৃথক বিচার-বিশ্লেষণ এই কারণে গৌণ হয়ে যাবে, মুখ্য হবে সিনেমার মৌলিক ভাষাকে (চলচ্চিত্র/ সচল দৃশ্যকল্প) শক্তিশালী ও আরো সফল করার ক্ষেত্রে তাদের অবদান। সিনেমার মৌলিক ভাষার প্রতিনিধিত্ব করার জন্য ‘সচল দৃশ্যকল্প’/ ‘চলচ্চিত্র’ ব্যবহার করা হচ্ছে এই জন্য যে, এরই প্রেক্ষিতে চলচ্চিত্রের (সার্বিক অর্থে) নান্দনিকতার আলোচনা ও বিচার করা হবে।
সিনেমার মৌলিক ভাষাটি খুব সহজ ও সরল। সচল দৃশ্যকল্পের মাধ্যমে সংলাপ ছাড়াই একটা গল্প বলা হয়। এমন নির্বাক সিনেমায় পিয়ানোর মতো সঙ্গীত থাকতে পারে কিন্তু গল্প বলায় তার ভূমিকা স্বল্পই। বেশিরভাগই নির্বাক ছবির মনোটনি ভাঙার জন্য যন্ত্রসঙ্গীতের ব্যবহার করা হয়েছে। কখনো বা প্রজেক্টর মেশিনের শব্দ আড়াল করার উদ্দেশ্যেও যন্ত্রসঙ্গীত এসেছে। আবার কখনো গল্পের বিশেষ পরিস্থিতি বা চরিত্রের মানসিক অবস্থা হাইলাইট করার জন্য যন্ত্রসঙ্গীতের সাহায্য নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর কোনোটিই সিনেমার মৌলিক ভাষা ‘সচল দৃশ্যকল্প’কে (চলচ্চিত্রকে) ছাপিয়ে যায়নি, কিংবা তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি। সিনেমা তার মৌলিক ভাষায় চরিত্রের মুখের অভিব্যক্তি, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঞ্চালন, মুভমেন্ট এবং পরিপার্শ্বের দৃশ্যের সাহায্যেই কাহিনি বলেছে। যেমন, আইজেনস্টাইনের আইভান দি টেরিবল। মাঝে মাঝে দৃশ্যের মাঝখানে লিখিত কথা দেখানো হয়েছে ব্যাখ্যার জন্য। বিশেষ করে সময়ের পরিবর্তন জানাতে এই ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়েছে, যদিও ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টিয়েও সময়ের যাত্রা বোঝানো হয়েছে দৃশ্যকল্পের সাহায্যে। তবু সচল নির্বাক দৃশ্যকল্পই ছিল আদিতে সিনেমার গল্প বলার মাধ্যম। আমরা তাকেই সিনেমার মৌলিক ভাষা বলতে চাই। এরপর ভাষার সম্প্রসারণ যা কিছু হয়েছে (সঙ্গীত, সংলাপ ইত্যাদির ব্যবহার) সবই সেই মৌলিক ভাষার পরিপূরক হিসেবে। মৌলিক ভাষাকে আচ্ছন্ন করে, গৌণ করে কিংবা সমগোত্রীয় করে তোলে, এমনভাবে পরবর্তী সময়ে যেসব শিল্প মাধ্যম (সংলাপ, সঙ্গীত) যুক্ত হয়েছে সিনেমা নির্মাণে তাদের ভাষার প্রয়োগকে তাই বলতে হবে শুধু অকার্যকর বা অপ্রত্যাশিত নয়, সাবভার্সিভও অর্থাৎ বিধ্বংসী। এ কথা বলতে গিয়ে শিল্পের বা প্রযুক্তির অগ্রগতিকে অস্বীকার করা হচ্ছে না। সিনেমার মৌলিক ভাষার বিশুদ্ধতার প্রতি গুরুত্ব দেওয়ার উদ্দেশ্যেই এই বক্তব্য রাখা। এই বিশুদ্ধতা রক্ষার মাধ্যমেই সিনেমার নিজস্ব ভাষা সংরক্ষণ সম্ভব। এটা একটা বেশ বড় ধরনের দাবি ও অতিরিক্ত প্রত্যাশা। বাণিজ্যিকভাবে নির্মিত সিনেমা এই দাবি মানবে না, এই প্রত্যাশা পূরণ করবে না (এমনকি আর্ট ফিল্মও করবে না) জেনেও এর উল্লেখ করতে হবে। কেননা এটাই সিনেমার মৌলিক ভাষার আদর্শ, সিনেমার বিশুদ্ধ শিল্পরূপের বিচারে যা অপরিহার্য।
যে দাবি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানা যাবে না এবং যে প্রত্যাশা পূরণ করার সম্ভাবনা কম তার উল্লেখের প্রয়োজন কী? প্রয়োজন এই জন্য যে চলচ্চিত্রের নান্দনিকতার বিচারের প্রশ্ন যখন আসবে তখন এই বিশুদ্ধ শিল্পরূপের কথা মনে রাখতে হবে। একে মূল্যায়নের সঙ্কীর্ণতা বা রক্ষণশীলতা বলে উপেক্ষা করা হলে সিনেমা যে নিজ দাবিতেই একটি শিল্প তা অস্বীকার করা হবে। এভাবে এই আদর্শ সিনেমার বিশুদ্ধ শিল্পরূপ নাকচ হয়ে গেলে সিনেমা বাজারের অন্যান্য পণ্যের মতো আরো একটি পণ্যে পরিণত হবে, যেখানে তার ব্যবহারিক দিকই (বিনোদন) প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বলে মনে হবে। এমনকি আর্ট ফিল্মও এই আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে সংলাপপ্রধান কিংবা সঙ্গীতবহুল অথবা অতিরিক্ত রঙের ব্যবহারে পূর্ণ হলে তা চলচ্চিত্রের বিশুদ্ধ রূপ ত্যাগ করেছে অথবা গৌণ করে দিয়েছে, এই উপসংহারে আসতে হবে। অবশ্য মৌলিক ভাষার প্রতি অতিরিক্ত বিশ্বস্ততা ও তার আদর্শ ব্যবহারও উদ্দিষ্ট হতে পারে না, হলে তা অধিকাংশ দর্শকের কাছে বোধগম্য ও গ্রহণযোগ্য হবে না। যেমন, অ্যালেঁ রেনেঁর লাস্ট ইয়ার ইন ম্যারিয়েনবাদ। অতিসম্প্রতি সাদা-কালোয় সম্পূর্ণ নির্বাক যে সিনেমা দি আর্টিস্ট তৈরি করে হৈচৈ সৃষ্টি হয়েছে তা চমক দিতে সফল হলেও আদর্শ বলা যাবে না। এ ধরনের ছবি মূলধারা থেকে এতটাই দূরে যে এর পরিণতি কৌতুক আর কৌতূহল সৃষ্টিতেই পর্যবসিত হবে। মৌলিক ভাষা ব্যবহার করে যে সিনেমা মূলধারা থেকে তা খুব দূরে নয়, কিন্তু তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে পৃথক। নান্দনিকতা রক্ষার উদ্দেশ্যে বিশুদ্ধ শিল্পরূপের কথা বলে অবশ্য বাণিজ্যিকভাবে তৈরি মূল বিনোদনমূলক সিনেমা নির্মাণের ধারা বন্ধ করা যাবে না, কিন্তু অন্তত কিছু সিনেমা নির্মাতার কাছে এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনের কথা জানিয়ে দেওয়া যাবে। হয়তো তখন দেখা যাবে কিছু সিনেমা নির্মাতা তার বিশুদ্ধ শিল্পরূপ বা মৌলিক ভাষার কথা মনে রেখে ছবি তৈরি করছেন, যা মূলধারার অন্তর্ভুক্ত না হলেও তার ওপর কিছুটা প্রভাব ফেলছে। আর্ট ফিল্ম অথবা বিকল্প ধারার ছবি নির্মাণে যারা ব্রতী ও নিয়োজিত তাদের জন্যও বিশুদ্ধ শিল্পরূপ দিক নির্দেশকের ভূমিকা পালন করছে। অপরদিকে দর্শকের একটা অংশ চলচ্চিত্রের বিশুদ্ধ রূপের আলোকে উপলব্ধি ও উপভোগ করতে পারবে বিকল্প ধারার ছবির নান্দনিকতা। এর ফলে শুধু চলচ্চিত্র নির্মাণের অতীত ঐতিহ্য রক্ষা পাবে না, দর্শকের রুচিও তৈরি হবে। তারা বিকল্প ধারার সিনেমার পাশাপাশি বাণিজ্যিক ধারার সিনেমা দেখে ভিন্ন স্বাদের অধিকারী হবে। তাদেরকে বাণিজ্যিক ধারার বিনোদনমূলক ছবি বর্জন করতে বলা হবে না (যতক্ষণ না তা কুরুচিপূর্ণ হয়), কেবল সিনেমার বিশুদ্ধ রূপ সম্বন্ধে সচেতন করে তোলা হবে। তুলনা করে বলা যায় এটা হবে ধ্র“পদী সঙ্গীত শেখার পাশাপাশি পপ সঙ্গীতের অভিজ্ঞতা অর্জনের মতো।
ওপরের আলোচনার পর সিনেমার নান্দনিকতার বিচারে তার বিশুদ্ধ ও মৌলিক রূপ (সচল দৃশ্যকল্প) এবং এর অন্তর্গত অর্থাৎ আত্তীকৃত সকল শিল্প মাধ্যমের ভাষার বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। বিশ্লেষণে বিভিন্ন শিল্প মাধ্যম সিনেমার বিশুদ্ধ রূপ ও মৌলিক ভাষার (সচল দৃশ্যকল্প) সঙ্গে কীভাবে যুক্ত হয়েছে, তাদের ব্যবহার সেই বিশুদ্ধ রূপ বা মৌলিক ভাষার ওপর কী প্রভাব রেখেছে, তারা পরিপূরক হিসেবে কাজ করেছে না সমগোত্রের (প্রাধান্যের দিক দিয়ে) হওয়ার চেষ্টা করেছে, তাদের ব্যবহারে সিনেমার (চলচ্চিত্রের) নান্দনিকতা স্পষ্ট এবং শক্তিশালী হয়েছে কিনা, সেই সব প্রসঙ্গ আসবে। এই আলোচনা এক একটি পৃথক অধ্যায়ে করা হবে। চলচ্চিত্রের বিশুদ্ধ রূপের (দৃশ্যকল্পের প্রাধান্য) প্রেক্ষিতেই সিনেমায় ব্যবহৃত অন্যান্য শিল্পরূপের (সঙ্গীত, সংলাপ, চিত্রকলা ইত্যাদি) মূল্যায়ন করা হবে। কেবল ভিন্ন ভিন্ন শিল্প মাধ্যমের উৎকর্ষ বিচার করে (মৌলিক রূপের) নান্দনিকতার অনুসন্ধান করা হবে না, অস্কার বা এ ধরনের পুরস্কার প্রদানে যেমন করা হয়ে থাকে। চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত সকল শিল্প মাধ্যম ব্যবহারের কার্যকারিতা ও সফলতা নির্ভর করবে সেই সব মাধ্যমের নিজস্ব গুণের জন্য নয়, তারা চলচ্চিত্রের মৌলিক রূপকে (সচল দৃশ্যকল্প/চলচ্চিত্র) কতটা সমুন্নত রাখতে পেরেছে এবং অর্থময় করতে পেরেছে, তার ভিত্তিতে।
অনেকের কাছেই সিনেমার নান্দনিকতার বিষয় এমন কঠোর, সঙ্কীর্ণ ও রক্ষণশীলভাবে ব্যাখ্যা করা হলে গ্রহণযোগ্য হবে না। তারা সিনেমার নান্দনিকতার বিচারে সিনেমার আত্তীকৃত সকল শিল্প মাধ্যমের একসঙ্গে মূল্যায়ন করতে চাইবেন। অথবা পৃথকভাবে প্রতিটি শিল্প মাধ্যমের মূল্যায়ন করবেন কিংবা সিনেমার চূড়ান্তরূপে অর্থাৎ সামগ্রিকতায় তাদের অবদানের ওপর জোর দেবেন। সামগ্রিকভাবে সিনেমাকে সফল করতে এবং শিল্পসম্মত করে তুলতে এই সব শিল্প মাধ্যম কী ভূমিকা পালন করেছে সেই বিশ্লেষণের প্রতি তারা বিশেষভাবে মনোযোগী হবেন। নান্দনিকতার বিচারে এটাই বর্তমানে প্রচলিত জনপ্রিয় পদ্ধতি। এই আলোচনায় এর যাথার্থ মেনে নিয়েও সিনেমার মৌলিক ভাষার (সচল দৃশ্যকল্প) পরিচিতি ও গুরুত্ব সংরক্ষণের জন্য তার নিরিখেই ব্যবহৃত সব শিল্প মাধ্যমের ভূমিকার বিশ্লেষণের প্রতি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। নান্দনিকতার বিচারে সিনেমার আদর্শ শিল্পরূপ বা মৌলিক ভাষাকেই (সচল দৃশ্যকল্প) সূত্র বা রেফারেন্স হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। নান্দনিকতার এই মূল্যায়ন জনপ্রিয় বা প্রচলিত না হওয়ার জন্য বিতর্কিত হতে পারে কিন্তু তার জন্যই এর প্রাসঙ্গিকতা অপ্রয়োজনীয় বা অযৌক্তিক হয়ে যায় না।
সিনেমার নান্দনিকতার বিচারে তার মৌলিক ভাষা হিসেবে সচল দৃশ্যকল্প/চলচ্চিত্রকে মেনে নেওয়া হলে এর পরবর্তী আলোচনা ফলপ্রসূ হবে। যদি মেনে নেওয়া না হয় তাহলেও তর্ক হিসেবে, সিনেমার ডিসকোর্সে একটি যুক্তি হিসেবে একে গ্রহণ করতে আপত্তি থাকার কথা না। যে-কোনো ডিসকোর্সেই বিভিন্ন চিন্তা, ধারণা ও যুক্তির অবতারণা করা যায়। কোনো ডিসকোর্সকে নির্দিষ্ট গণ্ডিতে অনড়-অচল করে বেঁধে ফেললে তার প্রাণ শুকিয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। ‘চলচ্চিত্রে’র নান্দনিকতার বিচারে যে যুক্তি দেওয়া হয়েছে এবং হবে তার প্রাসঙ্গিকতা এটুকুই।
এতক্ষণ যে আলোচনা করা হলো তার সার-সংক্ষেপে বলতে হয়, সিনেমার নান্দনিকতার বিচারে তিনটি পদ্ধতি বা মানদণ্ড ব্যবহার করা যায়। প্রথমটি সিনেমাকে সার্বিকভাবে নিয়ে, যা বেশ প্রচলিত। দ্বিতীয়টি সিনেমায় ব্যবহৃত ভিন্ন ভিন্ন শিল্পভিত্তিক মূল্যায়ন, যার দৃষ্টান্ত অস্কারের মতো পুরস্কার বিতরণে দেখা যায়। অস্কার পুরস্কার সিনেমায় ব্যবহৃত বিভিন্ন শিল্প মাধ্যমের উৎকর্ষের জন্যও দেওয়া হয়। কান, বার্লিন, ভেনিস ইত্যাদি উৎসবে চলচ্চিত্র পুরস্কার, অভিনেতা, অভিনেত্রী এবং পরিচালকের পাশাপাশি সার্বিকভাবে সিনেমাকেও প্রধান পুরস্কার দিয়ে থাকে। কিন্তু সিনেমার নান্দনিকতা বিচারে তৃতীয় যে পদ্ধতি ও মানদণ্ড, যা এ আলোচনায় গুরুত্ব পাবে সেটি সিনেমার মৌলিক ভাষা অর্থাৎ সচল দৃশ্যকল্প/ চলচ্চিত্রের উৎকর্ষ বিচার। এই মানদণ্ডকে কেন্দ্র করেই মূলত আলোচিত হবে সিনেমার নান্দনিকতার বিচার অর্থাৎ অন্যান্য শিল্প মাধ্যমের ব্যবহার (কারিগরি মাধ্যমসহ) সিনেমার মৌলিক ভাষাকে গৌণ করেছে কিনা অথবা তার পরিপূরক হয়েছে, এটাই হবে মূল বিবেচনার বিষয়। সিনেমার নান্দনিকতা বিচারের তিনটি পদ্ধতিকে ছকের আকারে নিচে দেখানো হলো :
সিনেমার নান্দনিকতার বিচার
(১) সার্বিক উৎকর্ষ বিচারের পদ্ধতি
(২) সিনেমায় ব্যবহৃত বিভিন্ন শিল্পভিত্তিক নান্দনিকতা বিচার
(৩) সিনেমার মৌলিক ভাষা দৃশ্যকল্প/ চলচ্চিত্রের
মানদণ্ডে নান্দনিকতা বিচার
নোট : ক, খ, গ ইত্যাদি বিভিন্ন শিল্প মাধ্যমের (যেমন, সঙ্গীত, সংলাপ, চিত্রকলা ইত্যাদি) প্রতিনিধিত্ব করে। তালিকাটি সম্পূর্ণ নয়, কেবল ব্যাখ্যার জন্য দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় পদ্ধতিতেও (২) বিভিন্ন শিল্প মাধ্যমের নান্দনিকতার বিচার তাদেরকে স্বাধীনভাবে (অন্য শিল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত করে নয়) দেখেই করা হয়েছে বলে ওপরে-নিচে একই সঙ্কেত সূচক অক্ষর ব্যবহৃত।
পুরস্কার প্রদানের রীতি ও নিয়ম দেখে সিনেমার নন্দনতত্ত্ব বিচারে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ ও মানদণ্ড ব্যবহারের দৃষ্টান্তের পরিচয় পাওয়া যায়। অস্কার পুরস্কার সিনেমায় ব্যবহৃত সব শিল্প মাধ্যমের জন্য পৃথক পৃথক পুরস্কার দেওয়ার পাশাপাশি শ্রেষ্ঠ ছবির জন্যও পুরস্কার প্রদান করে। শ্রেষ্ঠ ছবি বলে যেটি বিবেচিত হয় তার অন্তর্গত সব শিল্প মাধ্যমই পুরস্কৃত নাও হতে পারে; অন্য সিনেমা যা শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পায় না সেখানে ব্যবহৃত কোনো কোনো শিল্প মাধ্যম অস্কার পুরস্কার পেয়ে যায়। কখনো শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ সকল শিল্প মাধ্যমের জন্য পুরস্কার একটি সিনেমা পেয়ে থাকে, এমন দৃষ্টান্ত হলিউডের ইতিহাসে অনেক। এ যেন আমেরিকার রাজনৈতিক নির্বাচনে ‘উইনার টেকস্ অলে’র মতো ব্যবস্থা!
কান, ভেনিস এবং বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে সব শিল্প মাধ্যম নয়, শ্রেষ্ঠ ছবি, পরিচালক, অভিনেতা এবং অভিনেত্রী পুরস্কার পেয়ে থাকে। এখানে সিনেমায় ব্যবহৃত বিভিন্ন শিল্প মাধ্যমগুলির জন্য পৃথক পৃথক পুরস্কার দেওয়া হয় না।
শুধুই দৃশ্যকল্প বা ইমেজের ওপর ভিত্তি করে বিখ্যাত হয়েছে এমন ছবির মধ্যে আইজেনস্টাইনের নির্বাক ছবি ব্যাটলশিপ পটেমকিন অগ্রগণ্য। ভিস্যুয়াল ইমেজ ব্যবহারের সঙ্গে ন্যূনতম সঙ্গীত ও সংলাপ ব্যবহারে সফল ছবি হিসেবে প্রশংসিত হয়েছে এমন সিনেমার মধ্যে অরসেন ওয়েলসের সিটিজেন কেইন উল্লেখযোগ্য। সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালীতে সব শিল্প মাধ্যমের উপস্থিতি থাকলেও ভিস্যুয়াল ইমেজই সেখানে কাহিনি বর্ণনায় প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। সিনেমার মৌলিক ভাষা, সবাক দৃশ্যকল্প অর্থাৎ স্বয়ংব্যাখ্যাত ‘চলচ্চিত্রে’র ওপর গুরুত্ব দিয়ে বিশেষভাবে চিহ্নিত ও আলোচিত হয়েছেন ফরাসি নিউ ওয়েভ চলচ্চিত্র নির্মাতা রবার্ট ব্রেসোঁ। দেখা যায়, তাঁর সিনেমা নির্মাণ যতই এগিয়েছে সংলাপের তুলনায়, এমনকি শব্দের বিপরীতে সচল দৃশ্যকল্পই (চলচ্চিত্র) মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। দি ডায়েরি অফ এ কান্ট্রি প্রিস্টে যা শুরু মানি ছবিতে এসে তার পূর্ণতা প্রাপ্তি হয়েছে। প্রথমটি ছিল সাদা-কালোয় তৈরি, দ্বিতীয়টিতে ব্যবহার করা হয়েছে রং। ব্রেসোঁ তাঁর তৈরি সিনেমায় শিল্প মাধ্যমের সংখ্যা বৃদ্ধি করেছেন (যেমন, রং) কিন্তু ক্রমান্বয়ে ভিস্যুয়াল ইমেজের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়ে সিনেমার নান্দনিকতা বোধ সম্পর্কে তাঁর ধারণাকেও স্পষ্ট করে তুলেছেন।
সচল দৃশ্যকল্পকে (‘চলচ্চিত্র’) প্রাধান্য দিয়ে ছবি তৈরির প্রথা ও নিয়ম যে সেকেলে হয়ে যায়নি এবং অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েনি তার সাম্প্রতিকতম দৃষ্টান্ত ফরাসি দেশে তৈরি নির্বাক সিনেমা দি আর্টিস্ট। ছবিটি গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ডে কমেডি শাখায় সর্বোচ্চ পুরস্কার লাভ করেছে। আসন্ন অস্কার পুরস্কারের জন্য শ্রেষ্ঠ ছবিসহ মোট দশটি ক্ষেত্রে পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে এই সিনেমা। সিনেমার উৎকর্ষ ও নান্দনিকতার মানদণ্ডে বিচারের জন্য তার মৌলিক ভাষা, সচল দৃশ্যকল্প (‘চলচ্চিত্র’) যে এখনো প্রাসঙ্গিক ও প্রশংসিত হবার যোগ্যতা রাখে দি আর্টিস্ট সিনেমা তার দৃষ্টান্ত। অবশ্য এ ধরনের সিনেমা কিংবা ষাটের দশকে তৈরি নিউ ওয়েভ সিনেমা নির্মাতা অ্যালেঁ রেনেঁর প্রায় নির্বাক সিনেমা লাস্ট ইয়ার ইন ম্যারিয়েনবাড ব্যতিক্রমীই হয়ে থাকবে এবং আর্ট ফিল্মের শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত হবে। সাধারণ দর্শকের জন্য তো নয়ই, অনেক বিদগ্ধ আধুনিকমনস্ক সিনেমা দর্শকের কাছেও এর মতো সিনেমার আবেদন হবে সীমিত।
সিনেমার নান্দনিকতা বিচারে যে মানদণ্ডের ওপর এই লেখায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তার ভিত্তিতে সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী, অরসন ওয়েলসের সিটিজেন কেইন এবং ব্রেসোঁর পরবর্তী পর্বের ছবিগুলিই প্রাসঙ্গিক। এই শ্রেণির আরো সিনেমার উল্লেখ করা যায় কিন্তু তার প্রয়োজন নেই।