logo

চট্টগ্রামে চারুকলা চর্চার চার দশক আধুনিকতা, স্বাতন্ত্র্য ও নান্দনিকতা

সৈ য় দ  আ ব দু ল  ও য়া জে দ
চট্টগ্রামে প্রাতিষ্ঠানিক চারুকলা চর্চার চার দশক পূর্তি একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। আধুনিক মননশীলতা, শিল্প সৃষ্টির চিৎপ্রকর্ষতা এবং সৃজনশীলতায় নব নব দিগন্ত আবিষ্কারের প্রয়াস চট্টগ্রামের শিল্পীদের প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ করে চলেছে। চট্টগ্রামের চারুকলা আজ তাই বাংলাদেশের শিল্পাঙ্গনে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
সমুদ্র, পাহাড়, নদী, সমতল আর সবুজ বন-বনানীসমৃদ্ধ প্রাচীন জনপদ এই চট্টগ্রাম। প্রাচীনত্বে আর ঐতিহ্যে এই চট্টগ্রামের সমৃদ্ধির কথা ইতিহাসে আজ স্বীকৃত। হাজার বছরের কালপরিক্রমায় আজ যে আধুনিক চট্টগ্রাম গড়ে উঠেছে, সেখানে চারুকলা চর্চার সূচনা হতে যেন একটু বেশি সময়ই লেগেছে। নন্দনতাত্ত্বিক বিবেচনায় ভারতে প্রাতিষ্ঠানিক চারুকলা চর্চা শুরু হওয়ার দীর্ঘ সময় পর অবিভক্ত ভারতের পূর্ববঙ্গে তার স্রোতধারা এসে পৌঁছে। অবিভক্ত ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় প্রান্তিক অঞ্চলই হচ্ছে চট্টগ্রাম। প্রাচীন সাহিত্য-শিল্পের অনেক নিদর্শনই এখানে আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রাগৈতিহাসিক কালের নব্যপ্রস্তর যুগীয় কুঠার সীতাকুণ্ড পাহাড়ে আবিস্কৃত হওয়ার পর গবেষক, ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিক আর পুরাতাত্ত্বিকরা স্বভাবতই তাঁদের মনোযোগকে আরো গভীর করেছেন এই অঞ্চলটির প্রতি। চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর, পরবর্তীকালের পোর্টেগ্রান্ডে এই চট্টগ্রামকে অতি প্রাচীনকাল থেকেই বৈশ্বিক আবহের সঙ্গে যুক্ত রেখেছে বলেই ঐতিহাসিকরা মনে করেন। স্বভাবতই এখানকার সংস্কৃতি ছিলো মিশ্র, অগ্রসর এবং পূর্ববঙ্গের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে স্বতন্ত্র মহিমায় মহিমান্বিত। তবে প্রাচীনকাল থেকে এখনো পর্যন্ত চট্টগ্রাম প্রসঙ্গের
বিভিন্ন দিকের মধ্যে এর বাণিজ্যিক গুরুত্বটি অগ্রাধিকার পেয়ে আসছে ঐতিহাসিক আলোচনায়। সবকিছু বিবেচনায় এখানেই পূর্ববঙ্গের প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক চারুকলা চর্চার সূচনা হতে পারতো, এরকম সম্ভাবনার কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে কিন্তু সেরকমটি ঘটেনি। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায় প্রাতিষ্ঠানিক চারুকলা চর্চা শুরু হওয়ার প্রায় বাইশ বছর বা দুদশক পর চট্টগ্রামে আধুনিক চারুকলা চর্চার প্রাতিষ্ঠানিক  কর্মকাণ্ডের সূত্রপাত ঘটে। আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক চালচিত্রে ব্রিটিশ-শাসিত অবিভক্ত ভারতে চট্টগ্রামই আলোচিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলন, স্বাধীনতার আকাক্সক্ষার ঘোষণা, সাংস্কৃতিক বিকাশ ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পুরোধা এই ভূমিতে এতো দেরিতে কেন শুরু হলো প্রাতিষ্ঠানিক চারুকলা চর্চা, এ নিয়ে হয়তো একটি স্বতন্ত্র গবেষণাকর্ম হতে পারে।
চট্টগ্রাম কখনই শিল্পকলা ও সংস্কৃতিবর্জিত অঞ্চল ছিলো না। এখানে আবিষ্কৃত প্রাচীনকালের পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনাবলি, প্রাচীন স্থাপত্য, শিলালিপি, তাম্রশাসন ইত্যাদি প্রমাণ করে এখানে প্রায় দেড় হাজার বছরের কাছাকাছি সময় ধরে শিল্প-সাহিত্য অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মতো বহমান রয়েছে। এই ইতিহাস অতি দীর্ঘ ও বিস্তৃত। ব্রহ্মদেশের প্রাচীন ইতিহাস থেকে জানা যায়, স্বয়ং গৌতম বুদ্ধ তাঁর শিষ্যদের নিয়ে চট্টগ্রাম এসেছিলেন। হাইতগাঁওয়ের (হস্তীগ্রাম) একটি বৌদ্ধ চৈত্য প্রাচীন চট্টগ্রামের বৌদ্ধ সংস্কৃতির স্মারক। মগধ থেকে ধর্ম প্রচারে বৌদ্ধ পণ্ডিতরা চট্টগ্রাম এসেছিলেন। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে চট্টগ্রামের অবদান প্রসঙ্গে পণ্ডিতরা সোচ্চার কণ্ঠেই বলেন, প্রাপ্ত নিদর্শন অনুসারে মধ্যযুগে চট্টগ্রামের সাহিত্যের পরিসর ও ভূমিকা দেখে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। বাংলা সাহিত্য চর্চায় মধ্যযুগে চট্টগ্রাম যেন সারা বাংলাদেশকে পথ দেখিয়েছে। এই ধারাবাহিকতা থেমে থাকেনি। আজ পর্যন্ত তা বহমান। তবে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো চট্টগ্রামের আবহমান শিল্প ও সাহিত্যে মননশীলতার পাশাপাশি অসাম্প্রদায়িকতার মানবিক সুর ধ্বনিত হয়েছে বারবার। প্রাচীনকাল থেকে এখানে যে যুদ্ধ-সংঘাতের অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে তা ছিলো মূলত এই সমৃদ্ধ জনপদের ওপর রাজন্যবর্গের আধিপত্য বিস্তারের আকাক্সক্ষাপ্রসূত। শিল্পকলার সঙ্গে প্রাচীন চট্টগ্রামের সম্পর্কের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে পটিয়ার ছনহরা থেকে প্রাপ্ত দশভুজা ধাতুমূর্তি। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে মিরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ থেকে পাওয়া পিতলে তৈরি তিনটি ছোট ভাস্কর্য এবং ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে
আনোয়ারার ঝিয়রি গ্রাম থেকে প্রাপ্ত একষট্টিটি বুদ্ধমূর্তি, মন্দিরের দুটি ক্ষুদ্র অনুকৃতি ইত্যাদি। ঝিয়রির আবিষ্কারকে চট্টগ্রামে আঞ্চলিক শিল্পকলা ও ভাস্কর্যের চমকপ্রদ নিদর্শন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় শিল্পকলার প্রসারে অনন্য সাক্ষ্য হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
চট্টগ্রামের প্রাচীন সংস্কৃতি, শিল্পকলা এবং কারুশিল্পময় কারিগরির ইতিহাসের আরো একটি উৎকর্ষমণ্ডিত সাক্ষ্য চট্টগ্রামের স্থানীয় কারিগরদের নির্মিত সমুদ্রগামী কাঠের জাহাজ নির্মাণ শিল্প। পাশাপাশি অবস্থানরত প্রাচীন বাংলার সমতট ও হরিকেল রাজ্য যুগে যুগে নানা রূপ ধারণ করলেও এর ভেতর শিক্ষা, সংস্কৃতি ও শিল্পকলার স্রোতধারা প্রাকৃতিক, মানবিক ও রাজনৈতিক প্রতিকূলতার মধ্যেও প্রবাহিত হয়েছে। বৌদ্ধ ঐতিহাসিক লামা তারানাথের (তারানাথ, জন্ম : ১৫৭৩ খ্রিষ্টাব্দ) বিবরণে চট্টগ্রাম উল্লিখিত হয়েছে।
চট্টগ্রামের প্রাচীন ও পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে বিপুল বৈভব। যেমন ত্রয়োদশ শতাব্দীতে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর চট্টগ্রামে গড়ে উঠেছিলো, ঠিক সেরকম জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র পণ্ডিতবিহার। কক্সবাজারের রামকোট প্রত্নক্ষেত্র প্রাচীন ইতিহাসের খনি। মধ্যযুগের প্রাকলগ্নে, ঐতিহাসিক অষ্টম শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে পোড়ামাটির শিল্পের টেরাকোটা ফলক, মূর্তিকলা, ভাস-পটারি, ইত্যাদি নিদর্শন নিয়ে গড়ে উঠেছিলো চট্টগ্রামের নিকটবর্তী সমতট রাজ্যের ময়নামতি বৌদ্ধবিহার। স্থাপত্যকলায় অনবদ্য বৃহত্তর চট্টগ্রামের মন্দিরসমূহ। সেগুলোর ফলকলিপি, স্থাপত্য নকশা চট্টগ্রামের শিল্পকলার চাক্ষুষ দৃষ্টান্ত। এইসব ইতিহাসের প্রতœফলকের সংক্ষিপ্ত আভাস প্রমাণ করে চট্টগ্রামে শিল্পকলার ক্ষেত্র প্রস্তুতির কাজটি চলছিলো অনেক প্রাচীনকাল থেকেই। তবে যুদ্ধবিগ্রহ, ঘন ঘন রাজনৈতিক-সামাজিক অস্থিরতা অনেক মহৎ উদ্যোগকে ব্যাহতও করেছে। এটা খুবই কঠিন সত্য যে, প্রায় চার দশক আগে পাহাড়প্রমাণ আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামে চারুকলা চর্চার সূচনা ঘটে। ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার তিন বছরের মধ্যে বাংলা বিভাগে শিল্পকলার ইতিহাস ও নন্দনতত্ত্বের তত্ত্বীয় জ্ঞান সাবসিডিয়ারি বিষয় হিসেবে অনুশীলনের সূত্র ধরে সম্মিলিত চারুকলা নামে এই অভিযাত্রা হয়তো ছিলো সময়েরই দাবি। এই অভিষেকের প্রাণপুরুষ হিসেবে ইতিহাসে ধ্রুবতারার মতো হয়ে রইলেন শিল্পী রশিদ চৌধুরী। এই ঘটনাটিকে সময়ের দাবি হিসেবে উল্লেখ করার আরো একটি ঐতিহাসিক কারণ হলো তৎকালীন উপনিবেশবাদী পাকিস্তানি শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সংগ্রামরত বাঙালির সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে এক অভূতপূর্ব গণজাগরণ ঘটেছিলো। কারো কারো মতে, সংগীত, শিল্পকলা, নাটক, সাহিত্য, সৃজনশীল প্রকাশনা ইত্যাদির ক্ষেত্রে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার স্বর্ণযুগ হচ্ছে গত শতাব্দীর ষাটের দশক। রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রগতিশীল বিজ্ঞানভিত্তিক জীবনবোধ ও আধুনিকতা ছিলো সেই সময়ের আলোকবর্তিকা। ওই সন্ধিক্ষণে চট্টগ্রামে চারুকলা চর্চার আকাশে সবেমাত্র দেখা দিয়েছিলো আলোর আভাস। কিন্তু তারও চেয়ে বেশি ছিলো অনিশ্চয়তার অন্ধকার। ১৯৭০ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা বিভাগ চালু, তাতে নাট্যকলার সংযুক্তি, তাতে দেশের প্রখ্যাত শিল্পীদের শিক্ষক হিসেবে যোগদান, চারুকলা বিষয়ে সম্মান কোর্স এবং এমএ কোর্স চালু ইত্যাদির মধ্য দিয়ে আলোকিত হয়ে উঠতে থাকে চট্টগ্রামে প্রাতিষ্ঠানিক চারুকলা চর্চা। এ প্রসঙ্গে ড. ফয়েজুল আজিম বলেন, ‘… সৃজনশীল শিল্পী তৈরি তথা চট্টগ্রামে আধুনিক শিল্পচর্চার একটি ক্ষেত্র নির্মাণ করাই ছিল শিল্পী রশিদ চৌধুরীর চূড়ান্ত লক্ষ্য।’ এই লক্ষ্য এখানে ফলপ্রসূ হয়ে উঠতে শুরু করে যখন ১৯৭০ সালে চারুকলা বিভাগে দেশের বরেণ্য শিল্পীদের মধ্যে মুর্তজা বশীর, দেবদাস চক্রবর্তী, মিজানুর রহিম, ১৯৭৪ সালে আবুল মনসুর, বিভাগের প্রথম দিককার ছাত্রদের মধ্যে ১৯৭৫-৭৬ সালে সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ, মনসুর উল করিম, আনসার আলী, নাসিম বানু, শফিকুল ইসলাম প্রমুখ শিল্পী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীকালে গত চার দশকে আরো অনেক মেধাবী শিল্পী এখানে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়ে চট্টগ্রামে প্রাতিষ্ঠানিক চারুকলা চর্চার বেগবান ধারায় আধুনিক সময়ের প্রাসঙ্গিক শিল্পীতে পরিণত হয়েছেন।
ইতিহাসের আরো কিছু দিক সম্পর্কে এখানে আলোকপাত করা যেতে পারে, যা চট্টগ্রামে প্রাতিষ্ঠানিক চারুকলা চর্চার বিকাশে, স্বকীয় মননশীলতাসম্পন্ন সৃজনশীল ও আধুনিক শিল্পী তৈরিতে ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে। এমনকি নতুন নতুন শিল্পী সত্তা তৈরিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকাও রেখেছে। এখানে এ কথাটি খুবই প্রাসঙ্গিক হবে যে, শিল্পী রশিদ চৌধুরী তাঁর গভীর দূরদৃষ্টির মাধ্যমে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন চট্টগ্রামের মাটি বহুকাল আগে থেকেই চারুকলা চর্চার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, মননশীলতা, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা আর ঐতিহ্যের বিপুল ঐশ্বর্যে গরীয়ান চট্টগ্রাম যেন ভেতরে ভেতরে তৈরি পাদপীঠ। যেখানে চারুকলা চর্চার সোনালি পিদিমে শিখা প্রজ্বলনের বাকি। শুধু প্রয়োজন সাংগঠনিক উদ্যোগ। সংগঠকের বিপুল দায় ও ত্যাগের কথা তাঁর নিশ্চয়ই জানা ছিলো। শৈশব থেকে সংগ্রাম আর পারিপার্শ্বিক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তিনি অর্জন করেছিলেন একটি অসাধারণ সব্যসাচী চরিত্র। যার একদিকে ছিলো নানা অভিজ্ঞতা দেশ-বিদেশে চারুকলা চর্চার সমৃদ্ধ নির্যাস, অন্যদিকে ছিলো শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনসহ অন্যান্য শিল্পগুরুর কাছ থেকে পাওয়া সাংগঠনিক অভিজ্ঞতা। কিন্তু সাংগঠনিক কাজ মানেই যূথবদ্ধ প্রয়াস। ঢাকা আর্ট কলেজে শিক্ষক জীবনে তিনি যেসব শিক্ষার্থীর মনে রেখাপাত করেছিলেন তাদের অধিকাংশই ছিলো গতানুগতিকতাবিরোধী আধুনিক শিল্প প্রয়াসী একদল তরুণ। তাঁরই আহ্বানে তৎকালীন সময়ে দেশের প্রথম এবং বিশ্ববিদ্যালয় মানের একমাত্র চারুকলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে এসে নতুন যুগের সূচনায় শিক্ষার্থী হিসেবে যুক্ত হন যেসব শিল্পী তাঁদের মধ্যে ছিলেন শাকুর শাহ, কাজী গিয়াস, সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ, আনসার আলী, মনসুর উল করিম, চন্দ্রশেখর দে, হাসি চক্রবর্তী, অলক রায়, কে এম এ কাইয়ুমসহ আরো অনেকে। এইসব শিল্পীই স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের চারুকলা চর্চায় স্ব-স্ব ক্ষেত্রে রাখেন সাফল্যের স্বাক্ষর। চট্টগ্রামে চারুকলা চর্চার স্রোতস্বিনী বেগবান হয়ে ওঠে। শুরু হয় নতুন ইতিহাস। শিল্পী রশিদ চৌধুরীর স্বপ্ন আর শিল্প-আকাক্সক্ষাগুলো ছড়িয়ে পড়ে একঝাঁক সৃষ্টিশীল নতুন সত্তার ভেতরে। (সূত্র : ড. ফয়েজুল আজিম, চট্টগ্রামে চারুকলা চর্চা, কালি ও কলম, পঞ্চম বর্ষ, তৃতীয় সংখ্যা, বৈশাখ ১৪১৫)।
এখানে একটি আকস্মিক যোগাযোগের বিষয় উল্লেখযোগ্য। অধ্যাপক ড. মাহমুদ শাহ কোরেশীর সঙ্গে শিল্পী রশিদ চৌধুরীর পরিচয় হয় ফ্রান্সের মাটিতে ষাটের দশকের গোড়ায়। অধ্যাপক কোরেশীর আমন্ত্রণে শিল্পী রশিদ চৌধুরী ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে সাবসিডিয়ারি চারুকলার শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তারও আগে ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রামে ঢাকার শিল্পী গ্রুপ ‘কারিকা’র একটি প্রদর্শনী হয়। প্রদর্শনীর পর চট্টগ্রাম ক্লাবসংলগ্ন একটি বাড়িতে ‘চিটাগাং আর্ট সোসাইটি’ নামে একটি গ্যালারি প্রতিষ্ঠিত হয়। গ্যালারির উদ্বোধন করেছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। এখানে শিল্পশিক্ষার সান্ধ্যকালীন কোর্সও চালু হয়েছিলো, এই প্রদর্শনীর আয়োজন ও গ্যালারির প্রতিষ্ঠায় শিল্পী রশিদ চৌধুরীর পরোক্ষ অবদান ছিলো (ফয়েজুল আজিম, রশিদ চৌধুরী : বাংলার স্বপ্ন বুনতেন যিনি, প্রসঙ্গ, সম্পাদক – আবুল মনসুর, পৃ ৪৩)। এই সমস্ত কর্মকাণ্ডই পরবর্তীকালে চট্টগ্রামে চারুকলা চর্চার প্রতিষ্ঠান গড়তে সহায়ক হয় (ড. আবু তাহের, বাংলাদেশের চিত্রকলা এবং তিনজন শিল্পী জয়নুল আবেদিন, এস এম সুলতান ও রশিদ চৌধুরী, পৃ ১১৭)। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুকাল আগে অনিবার্য প্রয়োজনে চট্টগ্রামে চারুকলা কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে শিল্পী রশিদ চৌধুরী, ড. মাহমুদ শাহ কোরেশী এবং শিল্পী সবিহ উল আলমের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হওয়ার কথাও জানা যায়।
১৯৭৩ সাল। স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রাম সফররত বিশ্ববিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক, লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আঁদ্রে মালরো শিল্পী রশিদ চৌধুরীর আমন্ত্রণে শহরের মোহাম্মদ আলী সড়কের কলাভবনে উদ্বোধন করেন একটি আর্ট গ্যালারি। এই অনুষ্ঠানে শিল্পী রশিদ চৌধুরী উপস্থিত শিল্পী ও সুধীজনদের কাছে চট্টগ্রামে আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন। এগিয়ে আসেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক অধ্যাপক আবুল ফজল। যুক্ত হন বিশিষ্টজনদের আরো অনেকে। চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজ বেসরকারি উদ্যোগে ১৯৭৩ সালের ৩ আগস্ট তিনজন শিক্ষক এবং একুশজন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে। বিশিষ্ট শিল্পী সবিহ উল আলম কলেজের প্রথম অধ্যক্ষের দায়িত্ব পান। সহ-অধ্যক্ষের পদে যোগ দেন আবুল মোমেন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত এই চারুকলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি অসংখ্য ঘটনা, ঘাত-প্রতিঘাত, আশা-নিরাশা, মিলন-বিরহ, নানা আঙ্গিকে রূপান্তরিতকরণ সর্বোপরি অস্তিত্ব রক্ষার কঠিন সংগ্রামকাল অতিক্রম করে। এই ইতিহাস সরলরৈখিক নয়। তারপরও সংকট কাটেনি। চারুকলা কলেজের তিন যুগেরও বেশি সময়ের ইতিহাস একটি পরিণতির জন্য অপেক্ষা করছিলো। আশির দশকে শিল্পী রশিদ চৌধুরী চট্টগ্রাম ছেড়ে যাওয়ার আগে যে ‘আর্ট ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেও তার বাস্তবায়ন দেখে যেতে পারেন নি, তা-ই বাস্তবে আত্মপ্রকাশ করলো ২০১০ সালের ২ আগস্ট। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ এবং চারুকলা কলেজ একীভূত হয়ে ইনস্টিটিউটে পরিণত হওয়ার প্রেক্ষাপটে এখানে চারুকলা চর্চার পুরো ইতিহাস চার দশকের একটি সমন্বিত ইতিহাসে পরিণত হয়েছে।
প্রচেষ্টা যে একেবারে ছিলো না তা নয়। ‘১৯৫৭ সালে সৌখিন শিল্পী মঈনুল আলম চিটাগাং আর্ট ইনস্টিটিউট নামে একটি প্রতিষ্ঠান করার চেষ্টা করেন। ১৯৬৪-তে সবিহ উল আলমও অনুরূপ একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেন। … প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতার অভাব এবং বিশেষভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক হওয়ায় অচিরেই এসব উদ্যোগের অপমৃত্যু ঘটে।’ (সূত্র : ড. ফয়েজুল আজিম, কালি ও কলম, বৈশাখ ১৪১৫, পৃ ১০৮)।
ইতিপূর্বে চারুশিল্পের হাওয়া চট্টগ্রামের ওপর বয়ে গিয়েছিলো ১৯৫১ সালে কলিম শরাফির নেতৃত্বে প্রগতি সংস্কৃতি সম্মেলন উপলক্ষে। এতে এসেছিলেন কলকাতার গণনাট্য সঙ্ঘের সলিল চৌধুরী, দেবব্রত বিশ্বাস (জর্জ বিশ্বাস), সুচিত্রা মিত্র, পরিচয় পত্রিকার শিল্পকলা সমালোচক রবীন্দ্র মজুমদারসহ আরো অনেকে। এতে প্রদর্শনীর জন্য আমন্ত্রিত হয় ঢাকা আর্ট গ্রুপ। খোলা মাঠে ত্রিপল টাঙিয়ে ছাত্র-শিক্ষক মিলিয়ে ৩২ জনের ১৩৩টি চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হয়েছিলো। (সূত্র : আমিনুল ইসলাম, বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলনের পঞ্চাশ বছর, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, পৃ ৪৩)।
চট্টগ্রামে  চার দশকের প্রাতিষ্ঠানিক চারুকলা চর্চায় আধুনিকতা একটি স্বীকৃত সত্য। বিগত শতাব্দী অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর শেষ তিন দশক এবং বর্তমান শতাব্দী অর্থাৎ একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক জুড়ে চারুকলা চর্চায় চট্টগ্রামের অর্জন গুণগত এবং গণনাগত উভয় দিক থেকে অনেক বেশি। চট্টগ্রামের চারুকলা কোনো আঞ্চলিক সংজ্ঞায় নয়, বরং তা বাংলাদেশের জাতীয় চারুকলাকেও প্রতিনিধিত্ব করে। বিপুলসংখ্যক শিল্পী এখান থেকেই আধুনিক সৃজন, মনন ও চিৎপ্রকর্ষ অর্জন করে ছড়িয়ে পড়েছেন দেশ-বিদেশের নানা প্রান্তে। তবে যেসব শিল্পীর শিকড় এখানে, তাঁদের প্রাণশক্তি অর্জন শিল্প নির্মাণের এক ধরনের স্বতন্ত্র আধুনিকতাও কিন্তু সত্তার ভেতরে অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মতো বহমান। স্থানিক বৈশিষ্ট্যের এই মৌলিক পার্থক্যকে সমাজবিজ্ঞান বলে সাংস্কৃতিক পরিচয় জ্ঞাপনে ভৌগোলিক প্রভাব। যাকে ইংরেজিতে বলা যায় : Defining cultural identity through geographical influence. পাহাড়, সমুদ্র, সমতল, সবুজ সজীব নিসর্গ নিঃসন্দেহে চট্টগ্রামের মানুষ এবং বিশেষত শিল্পীর মননশীলতায় বাড়তি প্রভাব বিস্তার করে থাকে।
চট্টগ্রামে চারুকলা চর্চার সূচনা ঘটেছিলো ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টের আধুনিকতার উত্তরাধিকারকে নিয়ে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর কলকাতা থেকে সে-সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসা শিল্পীদের মধ্যে জয়নুল আবেদিন, সফীউদ্দিন আহমেদ, কামরুল হাসান প্রমুখ শিল্পীর ছিলো পাশ্চাত্যের অ্যাকাডেমিক রীতি, দেশজ ঐতিহ্য ও নব্য বাঙালি শিল্পধারার ক্রমবিকাশের অভিজ্ঞতা। শিল্প সমালোচক ও শিল্পী আবুল মনসুর এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘একেবারে শূন্য থেকে আমাদের বাঙাল শিল্পীর শুরুটা আশ্চর্যরকম ভাল হয়েছিলো। … তাঁদের ছবিতে পশ্চিমের অনেক অনুষঙ্গ যুক্ত হয়েছিল, কিন্তু স্বদেশী প্রেক্ষাপট একেবারে বিলীন না হওয়াতে একই সঙ্গে একটি স্থানিক স্বাদও পাওয়া যেত। পঞ্চাশের দশকে এঁরা তাঁদের নবীন ছাত্রদের রেখাঙ্কন, জলরং ও তেলরঙে দক্ষ হয়ে উঠবার ভাল শিক্ষা দিয়েছেন।…পঞ্চাশের শিল্পীরা প্রাতিষ্ঠানিক পটুত্ব অর্জনের পর নিরীক্ষাপর্বে পশ্চিমের নানান সমকালীন শৈলীর দ্বারা প্রভাবিত হতে শুরু করেন।’ (আবুল মনসুর, বাঙাল শিল্পীর সৃজন-উদ্যম, রূপ-রূপান্তরের ছয় দশক, কালি ও কলম, এপ্রিল ২০০৮)।
শিল্পী রশিদ চৌধুরী পঞ্চাশের দশকের সেইসব আধুনিক শিল্পীর অন্যতম, যিনি চট্টগ্রামে প্রাতিষ্ঠানিক চারুকলা চর্চার প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম হয়ে চট্টগ্রামের মাটিতে আধুনিক চারুকলা চর্চার সূচনা করেছিলেন যুগপৎভাবে শিল্পী ও শিক্ষক হিসেবে। রশিদ চৌধুরীর আধুনিকতা ও তাঁর সৃজনশৈলী নিয়ে নানবিধ মূল্যায়ন আছে। চারুকলার নানা মাধ্যমসহ তার বিশেষায়িত আত্মপ্রকাশের মাধ্যম ট্যাপেস্ট্রি। তাঁর চিত্রকলাতে লোকজ, গ্রামীণ, প্রাকৃতিক রূপ, প্রাচীনত্ব, সংস্কার, রূপকথা ও পুঁথির প্রতীককে আধুনিক আঙ্গিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে বলে চিত্র সমালোচকদের অভিমত। কারো কারো মতে, ‘মার্ক শাগালের প্রভাব ও বৈদেশিক চিত্র আন্দোলনের আঙ্গিক ও তার মানসিকতার পরীক্ষা-নিরীক্ষা তিনি ব্যবহার করেছেন স্বদেশের গভীরে, মর্মে, মূলে পৌঁছাবার জন্য (বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, চিত্রশিল্প : বাংলাদেশের)।’ তিনি শিক্ষা অর্জন করেছিলেন ঢাকা, মাদ্রিদ ও প্যারিসে। কাজেই তাঁর বিশ্ববীক্ষা ও আধুনিক মনন যে শুরু থেকেই চট্টগ্রামের প্রাতিষ্ঠানিক আধুনিক চারুকলা চর্চায় প্রতিফলিত হয়েছে এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের উত্তাল সময়ে ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রামের রশিদ চৌধুরী, দেবদাস চক্রবর্তী, সবিহ উল আলম, মিজানুর রহিম, সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ এবং আনসার আলীর অঙ্কিত ‘বাংলায় বিদ্রোহ’ শীর্ষক ছটি চিত্র সংগ্রামী জনমানসে নতুন অভিব্যক্তির সঞ্চার করেছিলো। স্বাধীনতা-উত্তরকালে চট্টগ্রামে শিল্পী সবিহ উল আলমের নেতৃত্বে, শফিকুল ইসলাম, এনায়েত হোসেন, আবুল মনসুর, শওকত হায়দার, চন্দ্র শেখর দে ও তাজুল ইসলামের যৌথ চিত্র-প্রদর্শনী নতুন সত্তার আধুনিকতা-অভিমুখী অভিযাত্রার স্পষ্ট সংকেত ছিলো। এই প্রদর্শনীর শিরোনাম ছিলো ‘আবহমান বাঙলা, বাঙালী’।
নিয়ত সঞ্চারমান এবং শিল্প সৃষ্টিতে নতুন নতুন কক্ষপথে আবর্তিত পঞ্চাশের দশকের অন্যতম আধুনিক শিল্পী মুর্তজা বশীরও চট্টগ্রামের চারুকলা চর্চার সূচনালগ্নে এখানে আসেন শিল্পী ও শিক্ষক হিসেবে। চট্টগ্রামের চারুকলা চর্চার অঙ্গনে সবচেয়ে বাড়তি প্রাপ্তি ছিলো রশিদ চৌধুরী ও মুর্তজা বশীর উভয় শিল্পীর বহুমুখী প্রতিভা। মুর্তজা বশীর চারুকলার বিভিন্ন শাখায় দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষিত। দুর্দান্ত প্রাণশক্তির এই শিল্পী একাদিক্রমে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার। সাহিত্য ও শিল্পের ক্ষেত্রে তিনি সমান পারদর্শী। এই শিল্পীর রয়েছে বহুমাত্রিক বিশ্ববীক্ষা। বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনে প্রত্যক্ষ যোগদান, পরবর্তীকালের প্রগতিশীল ও স্বাধিকার আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাশ্রয়ী তাঁর শিল্পকর্ম বাংলাদেশের আধুনিক চারুকলায় চট্টগ্রামের প্রতিনিধিত্বকে সুসংহত করেছে। চট্টগ্রামের চারুকলা যে শুরুতেই বৃহত্তর জাতীয় বোধ ও বৈশ্বিক নান্দনিকতা অর্জন করেছে তার বোধহয় অন্যতম কারণ, এখানকার শিক্ষানবিশ শিল্পীরা এক ধরনের তৈরি মননশীলতা হাতে পেয়েছিলেন ঢাকায় দীক্ষিত পঞ্চাশের আধুনিক শিল্পী গুরুদের কাছ থেকে। ইতালি, ফ্রান্স, লন্ডন, লাহোর, করাচি, কলকাতাসহ বিশ্বের নানাপ্রান্তে শিল্প শিক্ষা ও চর্চায় বহু সময় অতিবাহিত করেছেন শিল্পী মুর্তজা বশীর। তাঁর শিল্পকর্মেও এসেছে নতুন নতুন মাত্রা, অভিনব পর্ব। আধুনিক শিল্পী হিসেবে গতানুগতিক বৃত্ত ভাঙা ও অচলায়তনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সব গুণই তাঁর রয়েছে।
প্রথম দিককার শিল্পী ও শিক্ষকদের মধ্যে দেবদাস চক্রবর্তী দেশের বাইরে যান সত্তরের দশকে। পঞ্চাশের অত্যন্ত শক্তিমান এই শিল্পীও চট্টগ্রামের আধুনিক প্রাতিষ্ঠানিক চারুকলা চর্চার সূচনায় অসামান্য অবদান রাখেন। পাশাপাশি চট্টগ্রামের অপর এক আধুনিক শিল্পী সবিহ উল আলমের কথা উল্লেখ করতে হয়। ষাটের দশকে যিনি এখানে ছিলেন নিঃসঙ্গ সব্যসাচীর মতো। মুদ্রণ মাধ্যমে, পুস্তকের প্রচ্ছদ, সংবাদপত্র-সাময়িকীতে ইলাস্ট্রেশন এবং অন্যান্য মুদ্রিত শিল্পকর্মের মাধ্যমে স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে আধুনিক শিল্পবোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর অবদানকে অনেক বড় করেই দেখা হয়ে থাকে।
চট্টগ্রামের চারুকলা চর্চার সূচনা যাদের হাতে হয়েছিলো সেইসব শিল্পী ও শিক্ষকরা পঞ্চাশের দশকের আধুনিক নান্দনিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ ছিলেন। পাকিস্তানি প্রতিকূল পরিবেশে এদের প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে শিল্প শিক্ষার জন্য গমন তাদের নান্দনিক জ্ঞানের পরিধিকে নিঃসন্দেহে বৃদ্ধি করেছিলো। তারা বিনা বাধায় এই সুযোগটি পাওয়ায় একথা বলা চলে পাকিস্তানি শাসকরা ওইসব বাঙালি শিল্পীর মনোরাজ্যে উপনিবেশ গড়তে পারেনি। অতএব বলা চলে চট্টগ্রামে চারুকলার প্রাতিষ্ঠানিক পাঠদানে রশিদ চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, দেবদাস চক্রবর্তী, মিজানুর রহিম প্রমুখ শিল্পী শিক্ষক প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সংশ্লেষণ বা মিথস্ক্রিয়ায় যে আধুনিক নন্দনতাত্ত্বিক জ্ঞান বয়ে এনেছিলেন ঢাকা ও বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে তা কালক্রমে নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যে যথাযথভাবে সঞ্চারিত হয়েছে। অতএব নন্দনতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকেই বলা চলে পূর্ববঙ্গ তথা ঢাকার শিল্পীরা ১৯৪৮ সালে কলকাতার নান্দনিক জ্ঞান নিয়ে নতুন প্রাতিষ্ঠানিক চারুকলা চর্চা শুরু করলেও একটা মৌলিক স্বাতন্ত্র্য ঢাকা-কলকাতার মাঝখানে তৈরি হয়েছিলো। ঠিক একইভাবে ঢাকা থেকে আসা শিল্পীরা চট্টগ্রামে ঢাকায় অর্জিত নান্দনিক জ্ঞান নিয়ে চট্টগ্রামে চারুকলা চর্চার সূত্রপাত ঘটালেও চট্টগ্রাম কালক্রমে একটি সূক্ষ্ম স্বাতন্ত্র্য অবশ্যই অর্জন করে। এই স্বাতন্ত্র্য নির্ণয়ে এযাবৎ দেশব্যাপী, এমনকি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খ্যাতি অর্জনকারী চট্টগ্রামের শিল্পীদের শিল্পকর্ম নিয়ে নন্দনতাত্ত্বিক আলোচনার সূত্রপাত করা একটি পৃথক দীর্ঘ অধ্যায়ের ব্যাপার। তবে সর্বশেষ প্রবণতা অনুসারে মোটা দাগের যে অভিধায় এই স্বাতন্ত্র্য ঘোষণা করা যায় তা হলো, ঢাকাকেন্দ্রিক চারুকলার সাম্প্রতিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সেখানকার শিল্প সতর্ক-রূপান্তরশীল বা মেটিকুলাস মেটামরফিক এবং চট্টগ্রামের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সতর্ক- গীতিবাদিতা বা মেটিকুলাস লিরিসিজম। গত শতাব্দীর শেষ দশক এবং বর্তমান শতাব্দীর প্রথম দশকের চারুকলায় ঢাকা ও চট্টগ্রামের স্বাতন্ত্র্য এই দুই ধারায় দুটি আধুনিক বৈশিষ্ট্যের পরিচয় জ্ঞাপন করছে।
ঢাকা-চট্টগ্রামের চারুকলার উৎস এক হলেও এতে স্বাতন্ত্র্য অর্জিত হয়েছে অনিবার্য কারণে। সেই সব কারণ আবার নানাবিধ। একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক : একই উৎস থেকে উৎসারিত চীন ও জাপানের চারুকলাকে পাশ্চাত্যের শিল্প-পণ্ডিতরা দুটি বিভাজনে স্বতন্ত্র করে দেখেছেন। আলাদা বৈশিষ্ট্যও আরোপ করেছেন। কাল বিচারে বৈশিষ্ট্যেরও রূপান্তর ঘটে। স্বাতন্ত্র্য বিচারের সহায়ক সূত্র হিসেবে চীন জাপান চারুকলার পার্থক্য নির্ণয়ে পশ্চিমা পণ্ডিতদের অভিমত তুলে ধরা যাক :
‘The Japanese, like the Chinese, are great lovers of nature, but their approach to it in art is more     sentimental. What in Chinese art is noble, broad, and restrained, tends in Japanese art to become formal, decorative and superficial. Though the technique is studied and meticulous, the Japanese artist often lacks deapth and slips easily in to mannerisms or playfulness ( Source : The Oxford Companion of Art, edited by Harold Osborne , page 606 ).’ নান্দনিক দৃষ্টিকোণ ও বিশ্লেষণে স্থানিক তারতম্যের কারণে সৃষ্ট চারুকলার স্বাতন্ত্র্য নির্ণয় সম্ভব। নান্দনিকতা ও স্বাতন্ত্র্যে চট্টগ্রামে চার দশকের চারুকলা চর্চা যে বৈভব অর্জন করেছে তাকে আরো বিশদ ও সূক্ষ্মভাবে উপস্থাপনের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। সামগ্রিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে নয়, বরং দেশ ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রাম একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ চারুকলা চর্চার কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। স্বাতন্ত্র্য আর নান্দনিকতার এই জরুরি বিষয়টি আজ আর উপেক্ষা করা যাবে না।
(লেখক : পিএইচডি গবেষক, চারুকলা ইনস্টিটিউট চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক ইত্তেফাক, চট্টগ্রাম অফিস।)

Leave a Reply