হুসেন ও সন্ত্রাস
মকবুল ফিদা হুসেন (১৯১৫-২০১১) ভারতবর্ষে চলিস্নশের দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম প্রধান একজন। ভারতের ঐতিহ্যগত শৈল্পিক ও সাংস্কৃতিক প্রজ্ঞাকে তিনি যেমন তাঁর ছবির মধ্য দিয়ে বিশ্বের কাছে উন্মোচিত করেছিলেন, তেমনি গড়ে তুলেছিলেন পাশ্চাত্যনিরপেক্ষ এক দেশীয় আত্মপরিচয়। একাধারে চিত্রী, কবি, চলচ্চিত্রকার এই শিল্পীর প্রাণশক্তি ছিল অদম্য, যা তাঁকে সারাজীবন অজস্র স্বতঃস্ফূর্ত সৃজনকর্মে ব্যাপৃত রেখেছে, তেমনি আত্মোন্মোচনেও পরাঙ্মুখ করেনি। এই জঙ্গমতার কারণেই তিনি স্বদেশে ও বিশ্বে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। এমন একটি চিত্রভাষা তিনি তৈরি করেছিলেন, যা ছিল একই সঙ্গে সংবৃত, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘মিনিমাল’ এবং আবিশ্ব উত্তরাধিকারকে সংহত করে গড়ে তোলা। প্রতিবাদী চেতনা ছিল তাঁর প্রকাশের প্রধান বৈশিষ্ট্য এবং সেই প্রতিবাদ ছিল ধ্রম্নপদি বোধে সম্পৃক্ত। ধ্রম্নপদি ও রোমান্টিক – এই দুই বিপ্রতীপ মূল্যবোধকে সমন্বিত করে তিনি গড়ে তুলেছিলেন তাঁর নিজস্ব রূপরীতি।
এহেন একজন শিল্পীকে শেষজীবনে নববই-অতিক্রান্ত বয়সে স্বদেশ থেকে বিতাড়িত হতে হলো। দেশ ছেড়ে যেতে হলো একটি বিশেষ ছবি আঁকার জন্য। অসামান্য নান্দনিক বৈভবে সমৃদ্ধ তাঁর আঁকা একটি সরস্বতীর ছবির বিরুদ্ধে অশস্নীলতার অভিযোগ তুলল কিছু হিন্দু মৌলবাদী শক্তি, যার কাছে পরাভূত হলো আমাদের দেশের সমস্ত গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক চেতনা। এই মৌলবাদী শক্তিই একসময় মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করেছে, বাবরি মসজিদ ধ্বংস করেছে, দেশের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি ভূলুণ্ঠিত করেছে। এই অপরিসীম লজ্জা থেকে ভারতীয় গণতন্ত্রের কোনো মুক্তি নেই।
এই শিল্পী হুসেনকে নিয়ে একটি বই লিখেছেন অমিতাভ কর। বইটির শিরোনাম – মকবুল ফিদা হুসেন : ঐতিহ্যের উত্তরসাধক। আজকের দিনে এ-বইটি খুবই প্রাসঙ্গিক, কেননা এ-বইয়ের মূল কেন্দ্র হচ্ছে ওই ‘সরস্বতী’ ছবি নিয়ে বিতর্ক, হুসেনের নিরুপায় দেশত্যাগ এবং বিদেশে মৃত্যু। এই ঘটনা এবং এই বিতর্কিত ছবিটিকে অত্যন্ত যুক্তিঋদ্ধভাবে বিশেস্নষণ করে লেখক দেখিয়েছেন হুসেনের শক্তির জায়গা এবং মৌলবাদের অজ্ঞতা ও যুক্তিহীন দম্ভের পরিসর। এটাই বইটির মূল প্রতিপাদ্য হলেও লেখক শিল্পী হিসেবে হুসেনের অবস্থান ও তাঁর বিবর্তনের রূপরেখাকেও তুলে ধরেছেন এ-বইতে। বাংলা ভাষায় হুসেনকে নিয়ে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা খুব বেশি নেই। সেজন্যে বেশ কিছু ছবিসংবলিত আর্ট পেপারে ছাপা ছিয়ানববই পৃষ্ঠার এই বইটি বাংলা ভাষায় শিল্প-আলোচনার ক্ষেত্রে একটি উল্লেযোগ্য সংযোজন। আজকে উচ্চশিক্ষিত তথাকথিত সংস্কৃতিবান মানুষের মধ্যেও এমন লোকের অভাব নেই, যাঁরা মনে করেন হুসেন হিন্দু দেবদেবীকে নগ্ন করে এঁকে খুবই গর্হিত কাজ করেছেন। এরকম প্রশ্ন করেন তাঁরা, কোথায় হুসেন তো ইসলামের কোনো নবী বা ধর্মগুরুকে নিয়ে এরকম লঘু ছবি আঁকেননি। তাহলে মুসলিম হয়ে হিন্দু দেবীকে এমন অবনমিত করলেন কেন তিনি? তাঁরা মনে করেন, হুসেন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এ-কাজ করেছেন দেশে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করার জন্য। লেখক অত্যন্ত তথ্যপূর্ণ যুক্তি সমাবেশ করে এসব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন।
বইটির আলোচ্য বিষয়ের গভীরে প্রবেশের আগে আমরা চেষ্টা করব ভারতের আধুনিক চিত্রকলার ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে হুসেনের অবস্থান বুঝে নিতে। হুসেন চলিস্নশের দশকের শুরু থেকে যখন নিজস্ব আঙ্গিক বা রূপরীতি গড়ে তোলার প্রয়াস করছেন, তখন ভারতের আধুনিক চিত্রকলায় দুটি রূপরীতি প্রাধান্য পাচ্ছে। একটি ব্রিটিশ-প্রভাবিত অ্যাকাডেমিক স্বাভাবিকতাবাদ। আর একটি নব্য-ভারতীয় ঘরানার ঐতিহ্য-অন্বিত স্বদেশচেতনা-আশ্রিত আঙ্গিক। তবে পূর্বাঞ্চলে বা বাংলার চিত্রকলায় নব্য-ভারতীয় ঘরানার প্রভাব যত ব্যাপক ছিল পশ্চিমাঞ্চলে বা মুম্বাইয়ে তা ছিল না। সেখানে কোনো নব্য-ভারতীয় ধারা অথবা সমতুল্য স্বদেশচেতনা-আশ্রিত কোনো আঙ্গিক গড়ে ওঠেনি। ১৮৫৬ সালে মুম্বাইতে স্যার জে.জে. স্কুল অব আর্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই থেকে ব্রিটিশ অ্যাকাডেমিক স্বাভাবিকতার ধারার চর্চাই প্রবল হয় সেখানে। এই ধারায় সুপ্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের মধ্যে অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিলেন মহাদেব বিশ্বনাথ ধুরন্ধর (১৮৭১-১৯৪৪), এস.এস. হলদানকর (১৮৮২-১৯৬৮), জে.এ. লালকাকা (১৮৮৪-১৯৬২) প্রমুখ। পাশাপাশি আরেক ধারার শিল্পীও অবশ্য ছিলেন, যাঁরা স্বাভাবিকতার ভিত্তি থেকে শুরু করলেও ভারতীয় প্রথাগত শিল্পের দ্বারা খানিকটা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে উল্লেযোগ্য আবালাল রহিমান (?-১৯৩১), রবিশঙ্কর রাভাল (১৮৯২-১৯৭৭), জে.এম. অহিবাসি, এন.এল. যোশি প্রমুখ। তখন বম্বে আর্ট সোসাইটির প্রদর্শনী ছিল সেখানকার শিল্পীদের প্রকাশের প্রধান পাদপীঠ। এই সোসাইটি ছিল একমাত্র স্বাভাবিকতার রীতিরই পৃষ্ঠপোষক।
চলিস্নশের দশকের উদীয়মান তরুণ শিল্পীরা উপরোক্ত দুটি ধারার কোনোটির সঙ্গেই নিজেদের মেলাতে পারছিলেন না। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি প্রতিবাদী ভাবনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল তরুণ শিল্পীদের। মুম্বাইতেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি, জে.জে. স্কুল অব আর্টের ছাত্রদের মধ্যেও একটা প্রতিবাদী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, যাকে বলা হয় ‘ইয়ংটার্ক মুভমেন্ট’ বা তরুণ তুর্কি আন্দোলন। এই দলের নেতা ছিলেন পি.টি. রেড্ডি (১৯১৫-৯৭)। এই ইয়ংটার্ক মুভমেন্টের অনুসরণেই কিছু পরে বম্বে প্রগ্রেসিভ গ্রম্নপের উদ্ভব হয়েছিল।
কলকাতায় ‘ক্যালকাটা গ্রম্নপ’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৪৩ সালে, দুর্ভিক্ষের বছর। মুম্বাইয়ে ক্যালকাটা গ্রম্নপের প্রদর্শনী হয়েছিল ১৯৪৪ ও ১৯৪৫ সালে। এই প্রদর্শনী সেখানকার তরুণ শিল্পীদের উদ্বুদ্ধ করেছিল। ১৯৪৭ সালে বম্বে আর্ট সোসাইটির প্রদর্শনীতে কে.এইচ. আরার (১৯১৩-৮৫) ‘ইনডিপেনডেন্স ডে প্রসেশন’ শিরোনামে একটি ছবি বাতিল হয়েছিল। ফ্রাঁসিস নিউটন সুজার (১৯২৪-২০০২) ছবি সম্পর্কে বলা হয়েছিল বড় বেশি ‘প্রোলেটারিয়ান’। এর প্রতিবাদে এই দুজন শিল্পী অর্থাৎ আরা ও সুজা এবং আরো দুজন সমমনোভাবাপন্ন শিল্পী ভাস্কর এস.কে. বাক্রে (১৯২০-২০০৭) ও সৈয়দ হায়দর রাজা (১৯২২-২০১৬) একসঙ্গে মিলে
দল তৈরি করলেন। এ-দলে অন্তর্ভুক্ত করা হলো এম.এফ. হুসেন ও এইচ.এ. গাডেকে (১৯১৭-২০০১)। এই কজন শিল্পীর সম্মিলনে ১৯৪৭-এ গড়ে উঠল ‘বম্বে প্রগেসিভ আর্টিস্টস গ্রম্নপ’। এ-দলের প্রথম প্রদর্শনী হয়েছিল মুম্বাইয়ে ১৯৪৯-এর জুলাইয়ে।
‘প্রগ্রেসিভ আর্টিস্টস গ্রম্নপে’র সঙ্গে থেকেও হুসেন ছিলেন অন্য সবার থেকে আলাদা। আঙ্গিকের নিজস্বতা ও অভিনবত্বের সন্ধান তাঁর ছিল। কিন্তু নিছক আঙ্গিকবাদী তিনি ছিলেন না। জীবনের সঙ্গে তাঁর যোগ ছিল নিবিড়। তৃণমূল স্তরের বাস্তবতাকে তিনি উপলব্ধি করেছেন দারিদ্রে্যর বিরুদ্ধে তাঁর জীবনসংগ্রামের মধ্য দিয়ে। গ্রামীণ ভারতের প্রতি যেমন তাঁর গভীর দায়বোধ ছিল, তেমনি ভারতের অধ্যাত্মসাধনা, পুরাণ ও ইতিহাসের বৈচিত্র্যকেও অত্যন্ত সম্ভ্রমের চোখে দেখেছেন। তাঁর ছবিতে বিষয় হিসেবে এসবই গুরুত্ব পেয়েছে।
বাংলার শিল্পীদের মতো চলিস্নশের দশকের মুম্বাইয়ের শিল্পীরা ১৯৪৩-এর মন্বন্তর দেখেননি। ১৯৪৬-এর সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস দেখেননি। ১৯৪৭-এ দেশভাগের পর উদ্বাস্ত্তর মিছিল দেখতে হয়নি তাঁদের। তাই সেখানে রামকিঙ্কর, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, চিত্তপ্রসাদ বা সোমনাথ হোড়ের মতো শিল্পী হননি। হুসেনেরও ছিল না এসব বিপর্যয়ের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। কিন্তু দারিদ্র্য তিনি দেখেছেন। জীবনধারণের সংকট দেখেছেন। এজন্যে গ্রামীণ ভারতের রিক্ততার প্রতি তাঁর সহানুভূতি ছিল। রিক্ততার ভেতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে যে আধ্যাত্মিকতার ফল্গুস্রোত – তার প্রতিও নিবিড় শ্রদ্ধা ছিল। এই সহানুভূতি ও শ্রদ্ধা থেকেই গড়ে উঠেছে তাঁর ছবির আঙ্গিক। এখানেই তাঁর ছবির সঙ্গে মুম্বাইয়ের সমসাময়িক ও অন্যান্য শিল্পীর পার্থক্য।
তাঁর শিল্পের বিষয় হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন বিসত্মীর্ণ গ্রামীণ ভারতকে। এরপর এসেছে রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদি পৌরাণিক বিষয়। ভারতের ইতিহাস, দর্শন, ধর্মগ্রন্থ ও পুরাণ সম্পর্কে তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল। সেসবের প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর ছবিতে। স্বাধীনতাসংগ্রাম এসেছে। এসেছে সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের নানা দিক, সত্যজিৎ রায়, পথের পাঁচালী ইত্যাদি। মাদার তেরেসাকে নিয়ে চিত্রমালা করেছেন। ঘোড়া অনেক সময় হয়ে উঠেছে তাঁর প্রিয় বিষয়। ছাতার আত্মকথা নিয়ে ছবি করেছেন, যার ভেতর দিয়ে ধরেছেন গ্রামীণ ভারতের সংবিৎকে। এছাড়া এসেছে অজস্র বিষয় – পোস্টার, ট্যাপেস্ট্রি ইত্যাদি। চলিস্নশের দশকে ভারতীয় আধুনিকতাবাদের যে মূল বৈশিষ্ট্য – পাশ্চাত্য আধুনিকতাবাদী আঙ্গিককে আত্তীকৃত করে ভারতীয় সংবিতের গভীর প্রজ্ঞার সঙ্গে তাকে সমন্বিত করে তুলে আত্মপরিচয়ের এক স্বতন্ত্র নিরিখ নির্মাণ করা, যাতে আন্তর্জাতিকতার ভেতর প্রতিফলিত হয় প্রবহমান পরম্পরার অনিবার্য প্রতিবিম্ব – হুসেন সেটা অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে করে গেছেন। ভারতের জীবন ও সংস্কৃতিকে, এর অতীত ও বর্তমানকে তিনি আলোকিত বিভায় উপস্থাপন করেছেন তাঁর বিভিন্ন চিত্রমালার মধ্য দিয়ে। অত্যন্ত পরিমিত বাচনে সংক্ষিপ্ততার মধ্য দিয়ে সাংকেতিক চিত্রভাষা তিনি তৈরি করেছেন তাঁর বিষয়ের প্রয়োজন অনুসারে। এই সংক্ষিপ্ততা ও সাংকেতিকতার মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে তাঁর প্রকাশের স্বাতন্ত্র্য। দু-একটি ছবিতে বিমূর্তের সামান্য আভাস থাকলেও হুসেনের ছবি প্রায় সব সময়ই অবয়বী। বিমূর্ততার দিকে তিনি প্রায় কখনোই যেতে চাননি। বলেছেন, ভারতে যে শতাধিক কোটি মানুষের জীবন, এর সবটাই প্রখর বাস্তব। এখানে বিমূর্ত কিছু নেই।
এই হুসেনকে নিয়েই অমিতাভ করের আলোচ্য বই। বইটির আলোচনার অংশ মূলত আটটি অধ্যায়ে বিভক্ত। সেগুলো হলো : ১. ভারতীয় আধ্যাত্মিকতায় নগ্নতা ও যৌনতার দর্শন, ২. হুসেন ও তাঁর চিত্রকলার ওপর আক্রমণ, ৩. অজ্ঞতাপ্রসূত এক ভুল অভিযোগ, ৪. মকবুল ফিদা হুসেন : ঐতিহ্যের উত্তরসাধক, ৫. প্রতীক ও হুসেনের চিত্রকলা, ৬. হুসেনের সরস্বতী, ৭. হুসেনের সরস্বতী – আরো দু-চারটি কথা, ৮. গজগামিনী – চিরন্তন নারীত্বের প্রতি হুসেনীয় এক্সপ্রেশনিস্ট শ্রদ্ধার্ঘ্য। এরপর রয়েছে তাঁর গদ্য-ভাষা ও কবিতার দৃষ্টান্ত, জীবন ও গ্রন্থপঞ্জি।
প্রধানত যে-ছবিটি নিয়ে এত বিতর্ক, যে-মৌলবাদী হিংসাত্মক আক্রমণের জেরে হুসেনকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হলো, সত্তরের দশকে আঁকা সেই নগ্নিকা সরস্বতী নিয়ে যে প্রজ্ঞাদীপ্ত আলোচনা করেছেন লেখক, তা থেকে বোঝা যায় সরস্বতীর পুরাণকল্প, ইতিহাস, মূর্তিতত্ত্ব সম্পর্কে কী গভীর জ্ঞান রাখতেন হুসেন। এবং সেই প্রজ্ঞাকে কত সংক্ষিপ্ততার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করার ক্ষমতা তাঁর ছিল। বোঝা যায়, এই যে বাগ্দেবী সরস্বতী, বিপুলা ও প্রকৃতিরই যিনি অবিচ্ছেদ্য অংশ, প্রকৃতির মতোই তিনি মুক্ত ও আবরণহীন। সেই সৌন্দর্যকে বস্ত্রাবৃত করলে এর উদাত্ততা ব্যাহত হয়। ড. কানাই লাল ভট্টাচার্যের সরস্বতী, আ স্টাডি অন হার কনসেপ্ট অ্যান্ড আইকনোগ্রাফি (১৯৮৩) ও এম.আই. খানের সরস্বতী ইন স্যান্সক্রিট লিটারেচার গ্রন্থদুটির সাহায্য নিয়ে লেখক
এ-ছবিটির পরিপূর্ণ বিশেস্নষণ করেছেন। দেখিয়েছেন কেমন করে ‘ঋগ্বেদের যুগের (সরস্বতী) নদীটি পরবর্তীকালে পুরাণে সংস্কৃত ‘বাগ্দেবী’তে (বাক+দেবী) রূপান্তরিত হয়।’ এই সরস্বতী নদীর সঙ্গে দেবী সরস্বতীকে একাত্ম করতে শিল্পী মাত্র তিনটি আন্দোলিত রেখায় নদীর প্রতিমাকল্প পরিস্ফুট করেছেন। আর সেই জল ভেদ করে একটি মাছের সন্তরণের উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে সেই নদীকে আরো প্রাণবন্ত করেছেন। কেন এই ছবিতে ময়ূর হয়েছে সরস্বতীর বাহন, তার ব্যাখ্যায় লেখক দেখিয়েছেন, ‘এটা বলা যেতে পারে অগ্নির তিনটি শিখা সরস্বতীর (বাক্য) তিনটি রূপকে ব্যক্ত করে। বোধহয় অগ্নির সঙ্গে তাঁর মনস্তাত্ত্বিক ও দার্শনিক সম্পর্ক প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্যই তিনি বাহন হিসেবে ময়ূরের ওপর অধিষ্ঠান করেন।’
এই যে নদী সরস্বতীর দেবী সরস্বতীতে উত্তরণ, সেখানে প্রাকৃতিক কারণেই দেবীর মুক্তবক্ষা হওয়ার প্রয়োজন ছিল। লেখক বলেছেন – ‘এই ঋষিগণ সরস্বতী নদীর পবিত্র জলরাশিকে মাতার স্তনদুগ্ধের সঙ্গে তুলনা করেছেন। শিশুর কাছে মায়ের স্তনদুগ্ধ যেমন প্রাণদায়িনী, তেমনি সরস্বতী নদীর পবিত্র জলরাশি তার দুই তীরবর্তী জনপদের জীবনদায়িনী। তাই এই স্তনদুগ্ধস্বরূপ জীবনদায়িনী জলপান করার জন্য শিশুর মতোই মায়ের কাছে স্তন উন্মুক্ত করার জন্য আবেদন করেছেন। এই ঋগ্বেদ শেস্নাকের অনুপ্রেরণাই যুগে যুগে ভাস্করদের দেবীকে উন্মুক্ত পীনোন্নত বক্ষা করে খোদিত করতে উদ্বুদ্ধ করেছে।’ (পৃ ৭৫)
ভারতের শিল্পী ও শিল্পানুরাগী মানুষ একসময় মানব-মানবীর শরীরী সৌন্দর্য সম্পর্কে কোনো সংস্কার পোষণ করতেন না। নিরাবরণই যেমন প্রকৃতির স্বাভাবিক সৌন্দর্য তেমনি মানুষেরও। এই দৃঢ় প্রতীতির জন্যই ভারতীয় শিল্পে নগ্নতা এত আদর্শায়িত হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীকালে ধর্মীয় কুসংস্কারের দাপটে এই উদারতা ও উদাত্ততা থেকে দূরে সরে গেছে মানুষের শিল্পচেতনা ও রুচিবোধ। তারই প্রকাশ আমরা দেখি হুসেনের সরস্বতী নিয়ে এই বিতর্কে। এটুকুই শুধু নয়; এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ধর্মীয় মৌলবাদ, যার কোনো শুদ্ধ ও স্বচ্ছ দৃষ্টি নেই, যা সবসময়ই ধ্বংসাত্মক। শিল্পী হিসেবে হুসেনের অবস্থান যেহেতু বহুব্যাপ্ত ও আন্তর্জাতিক, তাই তাঁকে আক্রমণ করলে হিন্দু মৌলবাদও সারাবিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে, এই উদ্দেশ্যেই অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এই আক্রমণ করা হয়েছে।
যে-অভিযোগ অনেক সময়ই করা হয় যে, হুসেন কখনো ইসলামের ধর্মীয় বিষয় নিয়ে ছবি আঁকেননি, তারও উত্তর দিয়েছেন লেখক এই বইয়ের তৃতীয় অধ্যায়ে। ১৯৬৫ সালে হুসেন এঁকেছিলেন দুটি ছবি – ‘মুলস্না ও মরিয়ম’ এবং ‘মুলস্না’ শিরোনামে। এই দুটি ছবিতেও হুসেন ‘ইসলাম ধর্মে আলস্নাহ সম্পর্কিত মূল তত্ত্ব হাজির’ করেছেন। ছবি দুটি ষাটের দশকে আঁকা। তখন আমাদের দেশে ধর্মীয় মৌলবাদ এত তীব্র আকার ধারণ করেনি। এই ছবি নিয়ে তাই সে-সময়ে কোনো অভিযোগ ওঠেনি। কিন্তু নববইয়ের দশকে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বাতাবরণ অনেকটাই পালটে গেছে।
হুসেনের শিল্পীজীবনে একটি ঘটনা নিয়ে কিছু বিতর্ক আছে। সেজন্য তিনি সমালোচিতও হয়েছেন। ১৯৭৫-এ তিনি ছবি এঁকেছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার সমর্থনে। সেই ছবির সঙ্গে লেখা ছিল এরকম কবিতা : ‘One huge burning flower being carried on a monstrous tank. Peace is eternal but history sometimes has to ride on an armoured vehicle to assert peace.’ হয়তো নেহরু পরিবারের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব ও ঘনিষ্ঠতাই তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল জরুরি অবস্থার সমর্থনে। কিন্তু এটা ছিল তাঁর শিল্পীজীবনে একটা বড় রকমের ভুল। তবু অজস্র সৃষ্টিপ্রবাহে মাঝেমধ্যেই তাঁকে আমরা জ্বলে উঠতে দেখেছি। কলকাতার ‘সিমা’ গ্যালারিতে ২০০২ সালে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যে-প্রদর্শনী করেছিলেন, তাতে তিনি দেখিয়েছেন, কত গভীরভাবে তিনি জীবনমনস্ক, একই সঙ্গে আধুনিকতার শেষতম পরিস্থিতি সম্পর্কে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কত সতেজ।
চলচ্চিত্রকার হিসেবেও হুসেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। এই বইয়ে লেখক হুসেনের গজগামিনী ফিল্মটি সম্পর্কে বিসত্মীর্ণ আলোচনা করেছেন। প্রকৃত চলচ্চিত্রের ভাষার উদ্ভাবন সম্পর্কে বলেছেন। কিন্তু হুসেনের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে গণ্য হতে পারে ১৯৬৭-তে নির্মিত থ্রু দ্য আইজ অব এ পেইন্টার, যেটি বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভালে ‘গোল্ডেন বিয়ার’ পেয়েছিল। এই ফিল্মটি আমাদের বুঝিয়ে দেয় চিত্রের ভাষা ও চলচ্চিত্রের ভাষা কত একাত্ম হতে পারে। এই ফিল্মটির উল্লে আছে এ-বইতে, কিন্তু বিসত্মৃত আলোচনা নেই। থাকলে ভালো হতো।
ছোট পরিসরে হলেও অমিতাভ করের এ-বইটি শিল্পী হুসেন সম্পর্কে অনেক জরুরি তথ্য উদ্ঘাটন করেছে, সব সংস্কৃতিসচেতন মানুষেরই যা জানা দরকার। এজন্যে বইটির প্রচার প্রয়োজন।
– মৃণাল ঘোষ