logo

গ্র ন্থ প রি চি তি

তারেক মাসুদ : জীবন ও স্বপ্ন এলিজি নয়, স্বপ্নগাথা
সম্পাদক : ক্যাথরিন মাসুদ
প্রকাশক : প্রথমা
মূল্য : ১০০০ টাকা

ছবিটা কখন তোলা? মৃত্যুর ঠিক কঘণ্টা আগে? লেখা নেই। তবে ছবিটা ১৩ আগস্টের। হ্যাঁ, অভিশপ্ত, অনেক কান্নার ২০১১ সালের ১৩ আগস্টের, যেদিন দেশের দুই অমূল্য সম্পদ তারেক মাসুদ আর মিশুক মুনীর একসঙ্গে চলে গেলেন অনন্ত জগতে, বাংলাদেশের মানুষকে আরেকটি ১৪ ডিসেম্বর ’৭১-এর ভয়াল অন্ধকারে নিমজ্জনের হাহাকারে ডুবিয়ে। ছবিটাতে নৌকায় হাঁটু মুড়ে বসে এক হাত ওপরে তুলে, এক হাত নিচে মিশুক মুনীর কী কথায় তন্ময়, সেদিকে তাকিয়ে আছেন তারেক মাসুদ, না, আর কেউ নয়, না ঢালী আল মামুন না দিলারা জলি বা মনিশ রফিক কেউ, সবাই তাকিয়ে আছেন একদিকে ক্যামেরামুখী, শুধু তারেক মাসুদই – নৌকায় দাঁড়িয়ে থাকা মাথায় ক্যাপ, দুহাত জোড়, কেবল তারেক মাসুদই একা গভীরভাবে শুনছেন মিশুক মুনীরের কথা, যেন ক্যামেরা আর নির্দেশনার যে যুগল অমিত রসায়ন, তা প্রতিটি স্পন্দন পর্যন্ত একাত্ম থাকতে চাইছে, যেন তা মৃত্যুতেও শেষ হবার নয় – চোখে বাষ্প জমে ওঠে, ব্যাকগ্রাউন্ডের নদীর জল, কোন নদী এটা, যেন আমাদের সবার বোধের নদী আমাদের সমস্ত কান্না রেখেছে ধরে।
ছবিটা ছাপা হয়েছে তারেক মাসুদ : জীবন ও স্বপ্ন tareque masud : life & dreams বইটির শেষ পাতার আগের পাতায়, পুরো পৃষ্ঠাজুড়ে। এমন অনেক ছবিই আছে, যা অতলান্ত হাহাকার তৈরি করে মনে। শেষ পাতার ছবিটার কথাই যদি বলি, ক্যাথরিন মাসুদ, তারেক মাসুদ আর তাঁদের ভালোবাসার অর্ঘ্য নিষাদের ক্লোজআপ, তারেক আর ক্যাথরিনের হাসিমুখের মাঝখানে অবোধ শিশু নিষাদের মুখখানি কতটা প্রাজ্ঞ হয়ে উঠেছে! আরেকটি ছবি, ১৯৯৬ সালের, যখন রিলিজ হবে মুক্তির গান, ক্যাথরিন আর তারেকের চোখভরা কী যে স্বপ্ন, কত যে স্বপ্ন – তার তো প্রায় সবই অসমাপ্ত থেকে গেল, কত স্বপ্নই তো ছিল মূর্ত হওয়ার বাকি! হলো না! সুদূরপ্রসারী সেই স্বপ্নগুলো দূরই থেকে গেল! বড় অসময়েই চলে গেলেন তারেক মাসুদ-মিশুক মুনীরেরা! সেই ক্ষতি আর কোনোভাবেই পূরণ হওয়ার নয়। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সেই কথাটাই বলেছেন তারেক মাসুদের বন্ধুরা – স্বজনেরা – যাঁরা তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন, তাঁর সান্নিধ্যে পৌঁছেছেন, তাঁকে দেখেছেন কাছ থেকে, দূর থেকে। বলেছেন, তারেক মাসুদের চলে যাবার ঠিক তেরো দিন পরই, ২৬ আগস্ট। আর, সেই শোকগাথা আর স্মৃতিচারণা দিয়েই সাজানো হয়েছে তারেক মাসুদ : জীবন ও স্বপ্ন নামের অ্যালবামধর্মী বইটি। চমৎকার কাগজ, সুদৃশ্য অঙ্গসজ্জার এই বইটি ব্রিটিশ কাউন্সিল এবং তারেক মাসুদ মেমোরিয়াল ট্রাস্টের সহায়তায় প্রকাশ করেছে প্রথমা।
মুক্তির গান, মুক্তির কথা, আদম সুরত, মাটির ময়না, অন্তর্যাত্রা এবং রানওয়ের নির্মাতা তারেক মাসুদের ব্যক্তিগত এবং বিভিন্ন কর্মময় মুহূর্তগুলো যাঁদের ক্যামেরায় ধরা পড়েছে এ-অ্যালবামে, তাঁরা হলেন – অ্যাডাম হিউম, ক্যাথরিন মাসুদ, হাসান বিপুল, খান ফাতিম হাসান, লিয়ান লেভিন, মিশুক মুনীর, মুনিরা মোরশেদ, নাসির আলী মামুন, সাঈদ আসিফ মাহমুদ, তানজিলুর রহমান ও তারেক মাসুদের নিজের।
স্মৃতিচারণা ও কর্মের মূল্যায়ন করেছেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ, তাহমিনা রাব্বানী, দেলোয়ার হোসেন চৌধুরী, শরীফুর রহমান, সুলতানা শাহীদ, পিয়াস করিম, শামীম আখতার, সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকি, মোরশেদুল ইসলাম, জুনায়েদ হালিম, জাহিদুর রহিম, ক্যাথরিন মাসুদ, মইনুল হুদা, মুনিরা মোরশেদ, আলফ্রেডা সেপিয়ার, আলফ্রেড সেপিয়ার, আলম খোরশেদ, সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়, নায়লা খান, সাঈদ মিল্কী, মৌসুমী ভৌমিক, খুশী কবির, নাহিদ মাসুদ, হামিদা হোসেন, রোকেয়া প্রাচী, নুরুল ইসলাম, মমতাজ, মাহফুজ আনাম, সারা যাকের, আনুশেহ আনাদিল, মো. মাহমুদ হাসান, প্রসূন রহমান, কামার আহমাদ, মুস্তাফা মনোয়ার ও ক্যাথরিন মাসুদ। বইটির মূল্যবান ভূমিকা লিখেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান চলচ্চিত্রব্যক্তিত্ব জেমস লিহি।
লেখাগুলোতে সদ্য হারানোর চাপাকান্না যেমন রয়েছে, টাটকা স্মৃতিতে উঠে এসেছে একজন তারেক মাসুদের সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে ওঠার আখ্যান। যেমন তারেক মাসুদের এক স্বজন দেলোয়ার হোসেন চৌধুরী লিখেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হলো, তখন আমি ওদের বাড়িতে রয়ে গেলাম।… সেখানে আমারই বন্ধুবান্ধব মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্র“প ছিল। তখন তারেক আমাকে বলল, ‘মামা, আমি ওদের সঙ্গে থাকব। আমাকে একটা রাইফেল দিতে বলো।…’ তখন তারেক রাইফেল কাঁধে নিয়ে ওদের সঙ্গে ঘোরাফেরা শুরু করল। সেই সময় তারেক আমাকে বলল, ‘মামা, আমি তো মাদ্রাসা লাইনে পড়ব না। আমি জেনারেল লাইনে পড়ব।’
স্বজন সুলতানা শহীদ লিখেছেন, ‘দীর্ঘ আড়াই বছর ও আমার কাছে ছিল। আদমজী কলেজ থেকে ও আইএ পাস করে গ্র্যাজুয়েশন করার জন্য নটর ডেম কলেজে ভর্তি হলো, সেখান থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া। এরপর আরেক জীবন। এর মধ্যে সুস্থ চলচ্চিত্র নির্মাণের তাগিদে কখন যেন সে আলমগীর কবিরের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ল। কিন্তু সেই প্রথম পাঠ গ্রহণ করা তারেকের পক্ষে আর সম্ভব হলো না। তারেক মাসুদের জীবন থেকে হারিয়ে গেলেন আলমগীর কবির। তবু তারেক মাসুদ থেমে থাকেনি। ঠিক এই সময়েই ক্যাথরিন এলো ওর জীবনে। ওর ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা প্রতিভা, ওর ইচ্ছেগুলো ক্যাথারিনের হাত ধরে এগিয়ে চলল।’
বন্ধু পিয়াস করিমের লেখায় এসেছে, ‘তারেক আর আমি দিনের পর দিন একটা সিঙ্গেল খাট শেয়ার করেছি।…জ্যাঁ পল সার্ত্র নিয়ে তর্ক করেছি, কামু নিয়ে তর্ক করেছি, তারও আগে ফ্রানজ কাফকা নিয়ে তর্ক করেছি। তারেক কোথা থেকে যেন একটা ক্রিটিক অব ডায়ালেটিক্যাল রিজনের কপি নিয়ে এসেছিল। পুরনো ছেঁড়া একটা কপি।’ শামীম আখতার জানাচ্ছেন, ‘তারেক বিশ্বাস করত, সাংস্কৃতিক বিপ্লব অনিবার্য এবং এটা করতেই হবে।’ সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকি তারেক মাসুদের কাজের মূল্যায়ন শেষে বলেছেন, ‘ক্যাথরিন, আমি তোমাকে বলব, মানুষ কিন্তু কোনো নিঃসঙ্গ দ্বীপ নয়। পাখিরা উড়ে এসে বসে। মাছ কিংবা কিছু না থাকলেও ঢেউ তো থাকেই। নিষাদ আছে। আমার মনে হয়, তারেক আবার যে ইনিশিয়েট করে দিয়ে গেছে, তা থেকে শক্তি অর্জন করে আমরা বলতে পারব, ইমেজ তৈরি করতে পারব, যা সাফিশিয়েন্টলি পাওয়ারফুল টু ডিনাই অর নাথিং দিজ নেই নেই নেই। এটা থেকে আমরা বেরিয়ে এসে বলতে পারব, আছে আছে আছে।’ মোরশেদ ইসলাম জানাচ্ছেন, ‘আমি বলব, এই শর্ট ফিল্ম ফোরামের পুরো ধারণাটাই কিন্তু তারেক মাসুদের কাছ থেকে এসেছে।’
জুনায়েদ হালিলের লেখা থেকে জানা যায় কতটা স্ট্রাগল করে তারেক মাসুদের মতো একজন পরিচালককে উঠে আসতে হয়েছে, ‘সে সময় তারেক ভাই আদম সুরত ছবির জন্য বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন জায়গা থেকে টাকা জোগাড় করছেন। আবার প্রায় উন্মাতাল-বাউণ্ডুলে জীবনও যাপন করছিলেন। কিছুদিন থেকেছেন আসাদ গেটের একটা বাসায়, পরে বেকারিতে, তারপর মগবাজারে, এরপর এলিফ্যান্ট রোডের বাসায়, কিছুদিন মিরপুর, তারপর তেজকুনিপাড়া, আবার উত্তরায়। এমন নানা জায়গায় যাযাবরের মতো ঘুরছিলেন, থাকছিলেন। রুজি-রোজগারের তেমন অবস্থা ছিল না। তিনি মূলত আদম সুরতের কাজই করছিলেন।’ এ সময় তারেক ভাই প্রায়ই বলতেন, ‘টাকা জোগাড় করার চেষ্টা করছি, কিন্তু আমার যে ভাঙা রেকর্ড বাজাই, তা সবসময় কাজ করে না।’
সবশেষে বলেছেন, তারেক মাসুদ যাঁকে ছাড়া ছিলেন সম্পূর্ণই অসম্পূর্ণ – সেই ক্যাথরিন মাসুদ, ‘আমাদের দুজনের কখনই সংসার নিয়ে চিন্তাভাবনা ছিল না। সংসার যে করব আমাদের সেই অর্থ কোথায়, জায়গা কোথায়? আমাদের কোনো বাড়িঘর নেই, কিচ্ছু নেই। কীভাবে আমরা সংসার করব! সেজন্য আমরা ধরে নিলাম ছবিই আমাদের সংসার।’ ক্যাথরিন, যিনি সেদিন নিজেও মারা যেতে পারতেন, সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনায়, তিনি শেষ পর্যন্ত বড় একজন শিল্পীর মতো আমাদের শোকের কথা শোনাননি, আশার কথাই শুনিয়েছেন, স্বপ্ন দেখাতেই উদ্বুদ্ধ করেছেন, ‘আপনারা যাঁরা আছেন, তাঁরা তারেক, মিশুক এদের ভালোবাসতেন। আমি আশা করি, আমরা তাদের স্বপ্ন যেভাবেই হোক পূরণ করতে পারব। আপনাদের সাহায্য, অনুপ্রেরণায় আমাদের স্বপ্ন যদি ভাগ করে নিতে পারি, তাহলেই আমরা এগিয়ে যেতে পারব। সে আশায় আমি এখনো বেঁচে আছি। আমি মনে করি, তারেক এখনো মরেনি। ও আমাদের মধ্যে বেঁচে আছে এবং তাঁর স্বপ্নপূরণের জন্য আমরা রয়েছি।’
তারেক মাসুদের মৃত্যুকে মেনে নিতে পারেননি কেউ, তাঁর স্বজনরা তো বটেই, এমনকি আপামর মানুষ, যাঁরা ভালোবাসেন দেশকে, হৃদয়ে ধারণ করেন মুক্তিযুদ্ধ, ভালোবাসেন সিনেমা কিংবা কবিতা অথবা অন্য যে-কোনো শিল্প। কারণ, আমাদের সর্বস্তরে, বিশেষ করে চলচ্চিত্র জগৎটিতে প্রতিভার বড় আকাল চলছে, জহির রায়হান, আলমগীর কবির, খান আতা, সুভাষ দত্ত, আমজাদ হোসেনদের যোগ্য উত্তরসূরিরা কোথায়?
তারেক মাসুদ শুধু এঁদের যোগ্য উত্তরসূরিই ছিলেন না, হারিয়ে যাওয়া চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগকে ফিরিয়ে আনতে তিনি সর্বসত্তায় সক্রিয় ছিলেন। তাঁর অভীপ্সা ছিল দেশের সিনেমা হলগুলো যেভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তা রোধ করা, মুক্তিযুদ্ধের মর্মমূলকে দেশের মানুষের গভীরে ঢুকিয়ে দেওয়া, যে চেতনায় তিনি নিজেই হয়েছিলেন নির্মিত। তাঁর স্বপ্নগুলো চেনাতে তারেক মাসুদ : জীবন ও স্বপ্ন বইটি আমাদের জন্য খুবই দরকারি হয়ে থাকবে।
– হামিদুর রহমান

Leave a Reply