সা ই ম ন জা কা রি য়া
বাংলাদেশের স্বশিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিত গ্রামীণ জনতা প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর এবং তাঁদের জীবনের প্রতিপর্বে শিল্প সৃজনের স্বাভাবিকতা প্রবহমান রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ শহুরে শিক্ষিত জনতা গ্রামের মানুষের সেই সৃজনশীল প্রাণশক্তি ও শিল্পজীবনকে উপেক্ষা করে থাকেন। শুধু তাই নয়, কেউ কেউ আবার গ্রামীণ মানুষের
জীবন-বৈভবকে বৈচিত্র্যহীন এবং শিল্প সৃজনে অসৃষ্টিশীল তথা মার্গীয় শিল্প সৃজনে একেবারে অদক্ষ বলেই অভিসিক্ত করেন। অথচ একটু গভীরভাবে দৃষ্টি দিলেই গ্রামীণ মানুষের জীবনের সঙ্গে শিল্প সৃজনের স্বাভাবিকতা প্রত্যক্ষ করা যায়।
গ্রামীণ জীবনের শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ, গৃহস্থ নারী, বিচিত্র পেশাজীবী নর ও নপুংসক – সবাই দৈনন্দিন কর্মযজ্ঞের ভেতর ব্যস্ত থেকেও নিজেদের প্রাণশক্তি ও সৃজনশীলতার ভিন্নতর প্রকাশের নিমিত্তে প্রায় সমগ্র জীবনব্যাপী শিল্প সৃজনের স্বাভাবিকতায় দিবস-রাত্রি অতিক্রম করে চলেন।
এক
গ্রামীণ জীবনে যে শিশু ক্রীড়ালগ্ন তথা খেলাধুলায় দিন পার করছে – কেউ যদি একটু খোলা চোখে তাদের ক্রীড়ার অন্তর্গত ক্রীড়া-নৈপুণ্য এবং তা সম্পাদনের জন্য রচিত ছড়া, গান, কথা ও ক্রীড়া-কৌশলের কাঠামো, ছক, পদক্ষেপ, দেহসঞ্চালন, কণ্ঠস্বর ব্যবহার ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করেন – তাহলে নির্দ্বিধায় গ্রামীণ শিশুর সৃজনশীলতাকে প্রত্যক্ষ করতে পারেন। কেননা গ্রামীণ শিশুরা ক্রীড়া সম্পাদনের মুহূর্তে পূর্বে শ্র“ত ছড়া, গান ও কলাকৌশলের সঙ্গে মিল রেখে তাঁদের ক্রীড়ার প্রয়োজন অনুসারে নতুন করে অনেক ছড়া, গান, কথা ও কৌশল তাৎক্ষণিক সৃজন করে থাকেন। গ্রামীণ শিশুর জীবনের এই সৃজনশীলতা নিয়ন্ত্রিত হয় কিন্তু সমকালীন সমাজ, সংস্কৃতি, প্রকৃতি ও মূল্যবোধের সচেতন উপস্থিতিতে।
দুই
গ্রামীণ শিশুর চেয়ে তাদের জন্মদাত্রী মাতা তথা গ্রামীণ গৃহস্থ নারীর জীবন আরো বেশি সৃজনমুখর। তাঁরা তাঁদের গৃহস্থ কর্মব্যস্ততা ও কর্মময় জীবনের ফাঁকে ফাঁকে শিল্প সৃজনের আনন্দ ও দক্ষতা প্রদর্শন করে এসেছেন প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে, এখনো গ্রামের প্রায় প্রত্যেক নারী তাঁদের গৃহস্থকর্ম যথা রাঁধন-বাড়ন, গৃহপালিত জীবের সেবাযতœ, কৃষিকর্মে সহায়তা বিধান, গৃহ ও গৃহস্থ সকল মানুষের ব্যবহারিক পোশাক-আশাক তৈরি ও তার পয়পরিষ্কারকরণ, শিশুর জন্ম ও লালন-পালন ইত্যাদি তথা ঘরকন্নার সকল করণ বাস্তবায়নের ভাঁজে ভাঁজে ছড়িয়ে দেন তাঁদের
শিল্প-নৈপুণ্যের বিচিত্র কর্মযজ্ঞ। কেননা বাংলাদেশের লোকায়ত শিল্পকর্মের সবচেয়ে বিস্ময়কর ও সমৃদ্ধ ধারা নকশিকাঁথা তো এদেশের গৃহস্থ নারীদের সম্পাদিত সৃজনশীল শিল্পকর্ম। নকশিকাঁথার পাশাপাশি গৃহস্থ বাড়ির ঘরে টানানো সূচিকর্মের কথাও উল্লেখ করতে হয়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন, নকশিকাঁথার সরাসরি ব্যবহারিক চাহিদা রয়েছে লোকায়ত মানুষের জীবনে, কিন্তু ঘরে টানানো প্রদর্শনী উপকরণ হিসেবে একখণ্ড আয়তাকার বা বর্গাকার কাপড়ের ওপর সুচ-সুতা দিয়ে সৃজিত শিল্পকর্মের সরাসরি কোনো ব্যবহারিক চাহিদা না থাকলেও তা গৃহসজ্জার উপাদান হিসেবে গৃহস্থ নারীর শিল্পদক্ষতা, রুচি ও অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসেবে পাড়া-প্রতিবেশী ও
আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে আলাদা এক ধরনের সম্মানজনক অবস্থান তৈরি করে। তাই হয়তো গ্রামের অধিকাংশ নারী সরাসরি ব্যবহারিক চাহিদা না থাকলেও এ ধরনের শিল্পকর্ম সৃজনে আনন্দ পেয়ে থাকেন। সাধারণত বিবাহের আগে এবং পরে উভয় ক্ষেত্রেই নারীরা তাঁদের শিল্পদক্ষতার পরিচয়বাহী এ ধরনের সূচিশিল্প চর্চা করে থাকেন।
সমাজতাত্ত্বিকের দৃষ্টিভঙ্গিতে গ্রামীণ নারীদের করা নকশিকাঁথার বুনন শিল্পের দৃশ্যের রূপের ব্যাখ্যা যেমন করা চলে, তেমনি দৃশ্যরূপের ফাঁকে ফাঁকে স্থান পাওয়া বিভিন্ন বাণীর ভেতর দিয়ে নারীর সামাজিক জীবনব্যবস্থা, জীবনদর্শন ও মূল্যবোধকে অসাধারণভাবে ব্যাখ্যা করা চলে। যেমন – ১৩৫৯ বঙ্গাব্দে জনৈক্য পারুলের করা নকশিকাঁথায় যখন আমরা দেখতে পাই এমন একটি যেখানে লেখা আছে –
‘গয়া কাশী বৃন্দাবন
সকলি অসার।
রমণী জীবনে
শুধু স্বামী
পদ সার।’
পারুলের সৃজিত এই নকশিকাঁথার বাণীর ভেতর দিয়ে সামাজিক জীবনের যে চিত্রটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তা হলো সামাজিক জীবনে ধর্মের আচার যত বড়ই হোক, নারীর কাছে স্বামীর পদসেবা-ভিন্ন সেই ধর্মাচার সম্পূর্ণরূপে অসার। এখানে পুরুষশাসিত সমাজে নারীর ধর্ম হয়ে উঠেছে তীর্থস্থান দর্শন বা ভ্রমণ নয়, গৃহে থেকে স্বামীর সেবা করাই হোক তাঁদের মুখ্য পরিচয়। যদিও নকশিকাঁথার এই বাণীটি নারী কর্তৃক রচিত ও বর্ণিত হয়েছে, কিন্তু এই বাণীর ভেতর দিয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর পুরুষনির্ভর অবস্থানকে প্রতিষ্ঠা করেছে।
একইভাবে নারী কর্তৃক সুই-সুতার বুননে যে রুমাল পুরুষ প্রেমিক-বন্ধু বা স্বামীর জন্য সৃজিত হয়, সে রুমালে যখন ফুল, প্রজাপতি বা অন্য কোনো নকশার সঙ্গে সমন্বয় তৈরি করে লেখা থাকে ‘ভুলো না আমায়’, তখন সেখানেও তো একটি সমাজতাত্ত্বিক ও মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা সুপ্ত থাকে। পুরুষ প্রেমিক, বন্ধু বা পতির জন্য নারী কেন সুই-সুতা দিয়ে রুমালে এমন বাণী লিপিবদ্ধ করেন? তার অর্থ কী – আমাদের সমাজ জীবনে পুরুষের চরিত্রই এমন প্রিয় নারীটিকে কোনো না কোনো কারণে ভুলে যাওয়া? আর নারীর মনস্তত্ত্বের গভীরে সেই ব্যাপারটি এসে ধাক্কা মারে, তাই নারী অচেতন বা অবচেতন মনে প্রিয়তমের জন্য সৃজিত রুমালে লিপিবদ্ধ করেন ‘ভুলো না আমায়’।
নকশিকাঁথা ও রুমালের ভেতরেই শুধু সীমাবদ্ধ থাকে না নারীর
সুই-সুতার শিল্পভুবন, তার পাশাপাশি তাঁরা ঘরের নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী বালিশের কভার, বসার আসন ইত্যাদিতেও বাণীবদ্ধ অলংকরণ করেন। এর বাইরে ঘরে টানিয়ে রাখার জন্য কাপড়ের ওপর বাণীবদ্ধ কিছু শিল্প সৃজন করেন, যা বাঁধাই করে ঘরে টানিয়ে রাখা হয়। এ ধরনের শিল্পকর্মেও সামাজিক রীতিনীতি, ধর্মীয় ভাবাদর্শ, মানবিক সম্পর্ক ও মূল্যবোধের কথা সাধারণত গাছ, ফুল, পাখি, প্রজাপতি, অন্যান্য প্রাণী ও প্রকৃতির প্রতীকী নকশায় ছন্দোবদ্ধ বাণীতে প্রকাশিত হয়ে থাকে। যেমন – একটি সূর্যমুখী গাছের মাথায় ফোটা ফুলের পাশে যখন এই বাণীটি লিপিবদ্ধ করা – ‘খাও পাখি গাও গান/ সদাই বলো আল্লার নাম’ – তখন আপনা থেকেই সামাজিক জীবনে ধর্মপ্রেমী মানুষের পরিচয় স্পষ্টই প্রকাশ পায়।
সাধারণত গ্রামীণ নারীরা কিশোর বয়স থেকে এ ধরনের শিল্প রচনার সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করেন, তারপর যৌবন ও সংসারজীবনে তার
বিস্তারের পথ পাড়ি দিয়ে যখন গ্রামীণ নারীরা বৃদ্ধ হয়ে যান তখন এই শিল্পবোধ নিজের আত্মজা, পুত্রবধূ, নাতনি বা প্রতিবেশী নতুন প্রজন্মের নারীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে তৎপর থাকেন, গ্রামীণ নারীদের শিল্প সৃজনের এটা একটা অন্তর্গত স্বভাব। আসলে অধিকাংশ সময় গ্রামীণ নারীরা তাঁদের নিজের শিল্পজীবন সমাপ্ত হবার আগেই নিজের শিল্পদক্ষতা অন্যের ভেতর ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন।
গ্রামীণ জীবনে সূচিশিল্পকর্মের আরো বহুবিধ গুরুত্ব আছে, এ ধরনের শিল্পকর্ম সৃজনের আরেকটি মাহাত্ম্য হচ্ছে – এ শুধু নিজের প্রয়োজনে বা নিজের ঘরের শোভা বৃদ্ধির জন্য তৈরি করা হয় না, বরং তা উপহার দেওয়ার জন্যই বেশি তৈরি হয়, বিশেষ করে বিবাহের সময় কন্যার পক্ষ থেকে কন্যার মাতা এবং বরের পক্ষ থেকে বরের মাতা তাঁদের নিজেদের করা সূচিকর্ম অদ্যাবধি উপহার প্রদান করেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের গ্রামীণ বিবাহ হতে এই রেওয়াজ আজো উঠে যায়নি।
তিন
সূচিশিল্পের দক্ষতাই গ্রামীণ নারীদের শিল্প সৃজনের একমাত্র পরিচয় নয়, এর বাইরে বিভিন্ন সামাজিক ও পারিবারিক বিশেষ করে বিবাহ, সুন্নতে খতনা ইত্যাদি আনন্দানুষ্ঠানে গ্রামীণ নারীদের শিল্প প্রকাশের প্রাণময় আরেকটি সত্তা ও স্বরূপ প্রত্যক্ষ করা যায়। গ্রামের বাড়ির উঠানে বা ঘরের মেঝেতে, বারান্দায় বসে গ্রামীণ নারীরা যখন গীত পরিবেশন করেন তখন তাঁরা শুধু পূর্বে শ্র“ত গীত-বাণীকে অন্ধ-অনুকরণকারীদের মতো আসরে উপস্থাপন করেন না, বরং প্রতিটি মুহূর্তে প্রায় প্রতিটি গীতের বাণীর সঙ্গে তাৎক্ষণিক কিছু কথা যুক্ত করেন এবং অনেক ক্ষেত্রে পূর্বে শ্র“ত গীতে বর্ণিত চরিত্রের নাম তাঁরা বদলে দিয়ে যে বাড়িতে অনুষ্ঠান হয় – সে বাড়ির কারো নাম বা তাঁর প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনের নাম যুক্ত করে থাকেন। অনেক নারী এরও অধিক নিজেই গীত রচনায় পারদর্শী থাকেন এবং তা তাৎক্ষণিক মুখে মুখে রচনার মাধ্যমে আসরে উপস্থাপন করেন। এ ধরনের গীতকে সাধারণত মেয়েলি গীত হিসেবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। এই মেয়েলি গীতের বাহক বা মূল গায়িকাদের অধিকাংশ এখন পর্যন্ত নিরক্ষর। সুতরাং এই গীতগুলোকে মৌখিক সৃষ্টি বলে শনাক্ত করা যায়। এবারে কয়েকটি মেয়েলি গীত এবং তার অন্তর্গত অর্থ ও পরিবেশনারীতি সম্পর্কে কিছু কথা বলা যেতে পারে। এখানে উদ্ধৃত প্রথম মেয়েলি গীতটি দিনাজপুর জেলার বোচাগঞ্জ থানার গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত, গীতটি হলো –
‘সোনার চালন বাতি নিয়ে
বাহিরাইল ময়দান
হামার ভাইয়ের সাতও বহিন
মুছায় নিবে ঘাম
বাচ্ছা মেরিজান
বয়সগোরিটাই কেহয় নাহি
চুয়ে পোড়ক ঘাম
বাচ্ছা মেরিজান॥’
এটা বরকে হলুদ মাখানোর গান। যখন বরকে হলুদ মাখানোর জন্য ভগ্নি বা বোনেরা ঘর থেকে তাকে বাইরে বের করে আনেন তখনই সম্মিলিতভাবে এই গীতটি গাওয়া হয়। এ গীতের ভাবার্থ হলো – ‘সোনার চালন বাতি নিয়ে বাইরে এলাম। আমরা ভাইয়ের সাতটি বোন। আদর করে ভাইয়ের ঘাম মুছিয়ে দেব। কেননা ভাই আমাদের প্রাণের সমান। তার (ভাইয়ের) জন্য কোনো বউ (বয়সগোরি) নেই, তাই তো তার শরীর থেকে ঘাম ঝরে পড়বে।’এ ধরনের গীতের ভেতর দিয়ে ভাইয়ের প্রতি বোনের অকৃত্রিম মমতার কথা প্রকাশ পেয়েছে। পুরুষশাসিত সমাজে নারীরা ভাইয়ের প্রতি কতটা সহানুভূতিশীল সে কথা গীতটিতে প্রকাশিত হয়েছে। সেদিক দিয়ে এই গীতটির সুর, ছন্দ ও ভাষা বা শব্দের মাধুর্যের সঙ্গে এর সমাজতাত্ত্বিক গুরুত্বও কম নয়। এ তো গেল বরকে কেন্দ্র করে গীত সংগীতের কথা, এবার বলা যাক বিবাহের কন্যাকে কেন্দ্র করে গীত গানের কথা। একই অঞ্চলে কন্যার বাড়িতেও কন্যাকে কেন্দ্র করে মেয়েলি গীত গাওয়া হয়, যেমন –
‘উচ্চল করে বান্ধো হে ডিঘি
ও আমি জল ভরনে যাবো আরে কি
এত সুন্দর কন্যা হে তুমি
ও তোমার গলা কেন খালি আরে কি
আমার সাথে চল হে তুমি
ও তোমার গলায় মালা আর কি॥’
এই গানটির ভাবার্থ হলো – ‘উঁচু করে দিঘির পাড় বেঁধে দাও, আমি জল ভরতে যাবো, এত সুন্দর কন্যা তুমি, কিন্তু তোমার গলা খালি কেন, তুমি আমার সঙ্গে চলো, আমিই তোমার গলায় মালা পরিয়ে দেব।’ এই গীতের মধ্যে বিবাহের জন্য প্রস্তুত কন্যার মনে স্বামীর প্রতি প্রীতি জাগানোর অনুপ্রেরণা লুকিয়ে আছে। এ ধরনের বিয়ের গীতের ভেতর দিয়ে সামাজিক রীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল নারীদের মনোভাব প্রকাশিত হয়ে থাকে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলার বিয়ের আচার সম্পর্কে ‘ছেলে ভুলানো ছড়া’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন – ‘আমাদের বাংলাদেশের এক কঠিন
অন্তর্বেদনা আছে মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠানো। অপ্রাপ্তবয়স্ক অনভিজ্ঞ মূঢ় কন্যাকে পরের ঘরে যাইতে হয়, সেই জন্য বাঙালি কন্যার মুখে সমস্ত বঙ্গদেশের একটি করুণ দৃষ্টি নিপতিত রহিয়াছে।’ আমাদের ধারণা, সেই করুণ দৃষ্টিতেই সম্ভবত এদেশের মেয়েলি গীতে রবীন্দ্রনাথ কথিত বাংলাদেশের সেই অন্তর্বেদনা দারুণভাবে প্রকাশ পেয়েছে। যেমন – রাজশাহী অঞ্চলের একটি মেয়েলি গীতে বলা হয়েছে –
‘বাপে ডাকে ময়না রে
মোর ময়না নাইক ঘরে
মায়ে ডাকে ময়না রে
মোর ময়না নাইক ঘরে
কোনবা আজোর বাবরি-আলারে
মোর ময়নাক করল চুরি রে।’
বিয়ের পর বাংলার গ্রামজীবনের নারীরা অনেক ক্ষেত্রে অভাবী ও ভাগ্যবিড়ম্বিত স্বামীর প্রতি সার্বক্ষণিক প্রীতি ও সহানুভূতি প্রকাশ করে থাকে, যা খুবই নিখুঁতভাবে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশের মেয়েলি গীতে। যেমন Ñ ঝিনাইদহ অঞ্চলের একটি মেয়েলি গীতে বলা হয়েছে –
‘সকলির জাইলে ধরে মাছ
নই আর নওলা রে।
জাইলে কি আমার।
আমার জা’লে ধরে মাছ
শুধুই ইচের গুড়ো রে।
জাইলে কি আমার।
না হোক সে ইচের গুড়ো
উওই আমার ভাল রে।
জাইলে কি আমার॥’
এই গীতের ভাবার্থ হলো – ‘মৎস্যজীবী সমাজে সকল নারীর স্বামী
রুই-নলা (বড় প্রকৃতির) মাছ, কিন্তু এক দুঃখিনী নারীর স্বামী শুধু ছোট ছোট ইচা মাছ ধরে, তাই সে নারী তার স্বামীর প্রতি প্রীতি দেখাতে নিজেকেই নিজে প্রবোধ দিচ্ছে এ কথা বলে যে, আমার স্বামী যাই করুক, ওটাই আমার জন্য ভালো।’পক্ষান্তরে পুরুষশাসিত সমাজে নারী হয়ে বোনেরা ভাইয়ের পক্ষে থেকেছে কিন্তু ভাইয়ের বউয়ের পক্ষে যে যায়নি তার প্রমাণ রয়েছে দিনাজপুর অঞ্চলের একটি মেয়েলি গীতে, সেখানে বলা হয়েছে –
‘পানি পড়ে রিনি ঝিনি
পানি পড়ে সরু ধারে
হামার ভাইয়ের সাতও বহিন
তুলিয়া ধরিবে মোমের ছাতা
বয়সগোরিটার কেহই নাহি গো
ভিজোক ভিজোক সারারাতি।’
অর্থাৎ বৃষ্টি পড়ছে রিনঝিন শব্দে এবং সরু ধারায়, আমরা ভাইয়ের সাতটি বোন রয়েছি, আমরা তার মাথার ওপর ছাতা ধরে রাখব, কিন্তু বউয়ের (বয়সগোরির) তো কেউ নেই, সে সারা রাত বৃষ্টিতেই ভিজতে থাক।
এই গীতের ভেতর দিয়ে একদিকে যেমন ভ্রাতৃপ্রেমী ভগ্নিদের মনের কথা ফুটে উঠছে অকৃত্রিমভাবে, অন্যদিকে তেমনি বিবাহিত নারী হয়ে স্বামীর সংসারে বন্দি নারীর অসহায়তা খুবই নির্মমতার সঙ্গে চিত্রিত হয়েছে। আসলে এ ধরনের গীতের ভেতর দিয়ে পুরুষশাসিত সমাজের মধ্যে নারীর জীবনচিত্র করুণ ও প্রহসনে মূর্ত হয়ে ওঠে।
চার
কেবলমাত্র গীত পরিবেশনার ভেতরেই গ্রামীণ আনন্দানুষ্ঠানে নারীরা থেমে থাকেন না, তাঁরা বিভিন্ন সাজ-পোশাক ধারণ করে নানা ধরনের চরিত্রের সঙ সেজে তাৎক্ষণিক অভিনয় করে থাকেন। এসবের ভেতর দিয়ে গ্রামীণ গৃহস্থ নারীদের শিল্পদক্ষতা ও সৃজনশীলতার যে পরিচয় পাওয়া যায় – তা সত্যি সত্যি গৃহস্থ বাড়িতে উপস্থিত সকলকে বিস্ময়ে ফেলে দেয়, কেননা তাদের প্রতিদিনের চেনা-জানা নারীটি নতুনরূপে আবির্ভূত হয়েছেন সামান্য নির্ধারিত আনন্দানুষ্ঠানের সকল পরিকল্পনা ও অনুষ্ঠানসূচির বাইরে। গ্রামীণ নারীদের এ রকম সৃজনশীলতা বিবাহ, খতনা ইত্যাদি আনন্দানুষ্ঠানে উপস্থিত
পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনকে বিস্ময়ে ফেলে দিলেও তাঁদের সৃজনশীলতা আজো শহুরে শিক্ষিতদের জানার বাইরেই রয়ে গেছে।
এছাড়া গ্রামীণ নারীদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের কথাবার্তার ভেতর তাঁদের শিল্পচেতনার আরেক ধরনের নীরব উপস্থিতির কথা জানা যায় – তাঁদের মুখে উচ্চারিত শ্লোক, প্রবাদ, ধাঁধা, ছড়া বা লোকসৃজিত
বাণী-বাক্যের ভেতর দিয়ে। প্রকৃতির দুর্যোগ এলো, হঠাৎ গ্রামীণ নারী তাকে নিয়ে একটা শ্লোক উচ্চারণ করল; কাক্সিক্ষত সময়ে বৃষ্টি এলো, অমনি তার সঙ্গে মিলিয়ে গ্রামীণ নারী আরেকটি শ্লোক বলে উঠল। এমনটা যে শুধু তারা প্রকৃতিদৃষ্টে বলে তা নয়, তাদের জীবনের যে-কোনো আনন্দ-সুখ, মানবিক ও অমানবিক সম্পর্ক ইত্যাদি প্রায় সকল ক্ষেত্রে গ্রামীণ নারীরা তাঁদের জীবনকে শ্লোক, গান, ধাঁধা, ছড়া, প্রবাদ ইত্যাদি লোকায়ত শিল্পের ভেতর দিয়ে প্রকাশ করে থাকেন।
এ তো গেল গ্রামীণ শিশু ও নারীর জীবন এবং তার শিল্পসংশ্লিষ্ট আখ্যান। এবার গ্রামীণ নর তথা পুরুষের জীবনসংশ্লিষ্ট শিল্পের কথা বলা যাক।
পাঁচ
গ্রামীণ সমাজে পুরুষের শিল্পদক্ষতার মর্মমূলে রয়েছে বিচিত্র পেশা তথা কর্মপদ্ধতির ভূমিকা। কৃষক থেকে শুরু করে জেলে, মাঝি, কামার, কুমার, নরসুন্দর, মাটিয়াল, গৃহনির্মাতা, গায়ক, বাদক, ব্যবসায়ী ইত্যাদি সকল পেশার নর তাঁদের স্ব স্ব কর্মদক্ষতার সঙ্গে তাঁদের শিল্প সৃজনের আনন্দকে যুক্ত করতে সিদ্ধহস্ত। পেশাগত জীবনে কৃষকের প্রয়োজন পড়ে বিচিত্র ধরনের কৃষি উপকরণ তৈরি। বিশেষ করে কৃষিকাজের প্রধান অবলম্বন গরু বা মহিষের জন্য গৃহস্থ ও মাঠে ব্যবহৃত কিছু উপকরণ তৈরি করতে হয়, যেমন – গরু বা মহিষের জন্য গোহালে বা বাড়ির কোনো খোলা স্থানে ঘাস, খড়-বিচালি ইত্যাদি খাদ্য পরিবেশনের জন্য বাঁশের তৈরি এক ধরনের ‘গোড়া’ ব্যবহার করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কৃষকেরা নিজেদের ঝাড়ের বাঁশ কেটে চটা তুলে শিল্পিত সুষমায় এ ধরনের ‘গোড়া’তৈরি করে থাকেন। আজকাল অবশ্য এ ধরনের কৃষি উপকরণ কোথাও কোথাও বাজারে কিনতেও পাওয়া যায়। গরু বা মহিষকে যখন মাঠে নিয়ে যাওয়া হয় তখন অন্যের ক্ষেতের পাশ দিয়ে যাবার সময় অন্যের ক্ষেতের ফসল যেন
গরু-মহিষে খেয়ে নষ্ট না করতে পারে সেজন্য তাদের মুখে বাঁশের চটার তৈরি এক ধরনের ‘টোনা’ব্যবহার করা হয়। এ ধরনের ‘টোনা’ তৈরির কাজ সাধারণত কৃষকেরা নিজেই করে থাকেন। এমনকি রোদ-বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কৃষকেরা তাঁদের শিল্পিত মনের মাধুরী মিশিয়ে মাথাল তৈরি করেন।
কৃষিকাজের সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ করে ধান রোপণ, ধান নিড়ানি, ধান কাটা ইত্যাদি উৎপাদনমুখী আনন্দময় কাজের মধ্যে কৃষকের কণ্ঠে যে গান ধ্বনিত হয়ে ওঠে, তা তো শিল্পের স্বাভাবিকতারই প্রমাণ।
এছাড়া কৃষিকাজের অবসরে কৃষক যখন গাছতলায় বসে বিশ্রাম করেন তখন তাঁর হাতে যদি কোনো খেজুরপাতা, তালপাতা, কাঁঠালপাতা ইত্যাদি এসে জোটে, অবলীলায় কোনো কোনো অভিজ্ঞ ও শিল্প রসজ্ঞ কৃষক সে পাতা নিয়ে মুহূর্তের মধ্যে একটি চরকা রচনা করে সন্তানের হাতে তুলে দেন,
সন্তানের হাতে এসে সে চরকাটি বাতাসের প্রবহমানতায় ঘূর্ণিত হতে থাকে নিজস্ব শিল্পিত মহিমায়। কখনো কখনো পাতার প্রাণময় শরীরে ফুঁ দিয়ে কৃষকেরা সুর সৃজনের আনন্দটাও হাতছাড়া করেন না, যার নাম দেওয়া যায় ‘পাতার বাঁশি’। গ্রামীণ জীবনে পাতার বাঁশির ধ্বনি শোনেননি এমন মানুষ খুব কমই আছেন।
কৃষকের মতো জেলে ও মাঝিরাও তাঁদের পেশাগত জীবনের ব্যবহৃত উপকরণ নিজেরাই তৈরি করেন। কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের দুই ধরনের উত্তর হতে পারে – এক. নিজের পেশাগত জীবনের উপকরণ তৈরি উপাদান ও অভিজ্ঞতা দুটোই তাঁর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া, দুই. অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয় করা। আসলে এই দুটি কারণই গ্রামীণ জীবনের সাধারণ মানুষের মধ্যে শিল্প সৃজনের স্বাভাবিকতা সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে বংশগত পেশার সঙ্গে অনেকের শিল্পচর্চার স্বাভাবিকতা রয়েছে সময়ের চাহিদার সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক। বিশেষ করে তাঁতি, কামার, কুমার, ছুতোর ইত্যাদি পেশার মানুষ কোনো ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই সময়ের সঙ্গে অভিনবত্ব তথা শিল্পিত দৃষ্টিভঙ্গি আরোপ করে তাঁদের পেশাগত কর্মকে টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে লিপ্ত, সে আরেক গল্প। এখানে আমরা সে আলোচনায় যাচ্ছি না।
ছয়
গ্রামীণ নাট্যগীত পরিবেশনার আসরে গেলে দেখা যায়, গ্রামের প্রত্যেক
নর-ই যেন শিল্পদক্ষ নাট্যকুশলী, বাদ্য-গীতে পারদর্শী, নৃত্যচঞ্চল ও তাৎক্ষণিক কথা, সংলাপ, গীত রচনায় অভিজ্ঞ। কোনো প্রশিক্ষণ বা পরিকল্পিত চর্চা ভিন্নই তাঁরা স্বাভাবিক জীবনের মতোই গীতি-নৃত্য-নাট্য ইত্যাদি শিল্পধারাকে গ্রহণ করে থাকেন। সে গাজীর গানের আসরে হোক, কিচ্ছাগানের আসরে হোক বা কীর্তন, রামলীলা, অষ্টকগানের আসরে হোক, সকল ধরনের পরিবেশনা শিল্পেই মূল কলাকুশলীদের পাশাপাশি আসরে উপস্থিত অনেক গ্রামীণ সাধারণকেই হঠাৎ করে দোহার দলে ঢুকে গানের ধুয়া গীত পরিবেশন করতে দেখা যায় বা বাদক দলে ঢুকে মন্দিরা-করতাল বা প্রেমজুড়িতে তাল ঠুকতে দেখা যায়; এখানে মূল পরিবেশনাকারী শিল্পীদের পক্ষ থেকেও কোনো বাধা আসে না। এ যেন শিল্পের সঙ্গে গ্রামীণ জীবনের অভেদাত্মক একাত্মতা। গ্রামীণ জীবন ও শিল্প মাধুর্যের এই অপূর্ব সমন্বয় প্রত্যক্ষ করার চোখ উন্মোচিত হোক – এই রচনার ভেতর দিয়ে সেই কামনা ব্যক্ত করি।