মো বা শ্বি র আ ল ম ম জু ম দা র
মিছিল আর সম্মিলন
শাহাবুদ্দিন আহমেদের ছবির ভাষা সরল। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে মানুষের মিছিলে তিনিও শামিল হয়েছিলেন। রণাঙ্গনে অস্ত্রহাতে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করে ছিনিয়ে এনেছেন স্বাধীনতা। তাঁর ছবির বিষয় যোদ্ধা মানুষের অবয়ব। মানবশরীরের টানটান পেশি তিনি শক্তিমত্তার সঙ্গে আঁকেন।
প্রিয় অাঁকার মাধ্যম ক্যানভাসে তেলরং। মানুষ কী করে শুধু সাহসের সঙ্গে নিজেকে বলশালী করে তোলে সে বোধ শাহাবুদ্দিন রপ্ত করেছেন মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় থেকে। গণহত্যা, পাকবাহিনীর নিষ্ঠুর আচরণ, বাড়ির পর বাড়ি, গ্রামের পর গ্রামে আগুনের লেলিহান শিখা, শত্রুসেনার সঙ্গে সখ্য করে এদেশীয় দোসরদের হিংস্র থাবার আক্রমণ, শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া মানুষের হাহাকার শিল্পীর হৃৎপিন্ডে বাসা বেঁধেছে। মানুষের প্রসারিত হাত-পায়ের দুরন্ত গতি দেখা যায় ক্যানভাসে। চিত্রতলে দ্যুতি ছড়ায়, তাতে রয়েছে কিছুটা ঐক্য আর দ্রোহ। শাহাবুদ্দিন চিত্রতলের পরিমিত ব্যবস্থাপনায় দক্ষ। ছবির জমিনে এতটা সাদা বা শূন্য স্পেস রেখে দিয়ে বিষয়কে উপস্থাপন করেন যে কখনো ছবিকে অসামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হয় না। শিল্পী শাহাবুদ্দিন হয়ে ওঠার পেছনে যে সংগ্রাম আর মুক্তিযুদ্ধ তাঁকে পূর্ণতা দিয়েছে তা অল্পবিস্তর উল্লেখ করা যেতে পারে। ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের যে সামাজিক বঞ্চনা, অর্থনৈতিক শোষণের ইতিহাস তা শাহাবুদ্দিন প্রত্যক্ষ করেন। বয়সে তরুণ শাহাবুদ্দিনের বাবা মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় সংগঠক, যোদ্ধা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ। শাহাবুদ্দিন মুক্তিযুদ্ধে প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। শিল্পীজীবনের শুরুতে তিনি দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশ নিয়ে দ্রোহ আর অগ্নিপরীক্ষার স্মৃতি ক্যানভাসে প্রকাশ করেন। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদের) অঙ্কন ও চিত্রায়ণ বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৭ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের শ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পী হিসেবে প্রেসিডেন্টের স্বর্ণপদক প্রাপ্তি তাঁকে ছবি আঁকার প্রতি আরো আগ্রহী করে তোলে। শিল্পীজীবনের প্রথমদিকের কাজে নগরজীবন, গ্রামবাংলার কৃষক-কিষানি, পশু-পাখি, পুরনো শহর, ব্যক্তিগত স্মৃতি, শোক, নারী, শিশু – এরকম অসংখ্য বিষয় ক্যানভাসে উঠে এসেছে। সত্তরের দশকে শাহাবুদ্দিন প্যারিসে পাড়ি জমান। তারপর বিশ্বের বিভিন্ন শিল্পীর শিল্পকর্মের সঙ্গে নিজের শিল্পকর্মের অবস্থান জেনে নেন। এ সময়ে প্যারিস তথা বিশ্বের শিল্পীসমাজের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন। মুক্তিযুদ্ধ আর শাহাবুদ্দিনের আত্মবিশ্বাস তাঁর বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জনে সহায়তা করল। বিজয়ী যোদ্ধার স্মৃতি থেকেই আঁকা এবারের প্রদর্শনীর শিরোনাম যোদ্ধা। মোট ঊনত্রিশটি চিত্রকর্মের প্রতিটি ক্যানভাসের বৈশিষ্ট্য বিশাল অংশজুড়ে রঙের স্ফুরণ। সবুজ, সাদা, স্নিগ্ধ রং লেপনের প্রক্রিয়া শাহাবুদ্দিন রপ্ত করেন ফ্রান্সিস বেকন থেকে। ইউরোপীয় ধারার শিল্পীদের অনুকরণ বা অনুসরণ তাঁর কাজে সরাসরি নেই। একসময় তাঁকে প্যারিসে ‘লিটল বেকন’ বলে অভিহিত করা হতো। তাঁর ক্যানভাসে বেকনের চিত্রনির্মাণ পদ্ধতির ছায়া উপস্থিত হতো। বেকনের ঝোঁক ছিল প্রতিকৃতি চিত্রের দিকে। শাহাবুদ্দিন প্রতিকৃতি, মানুষ, প্রকৃতি নিয়ে মগ্ন থাকেন। ‘বিজয় নেশা’ ছবির একপাশ সবুজ রঙে রঞ্জিত। একটি মানুষের ফিগার, সঙ্গে লাল-সবুজ পতাকা। ক্ষিপ্রগতিতে ক্যানভাসের বাইরে ছুটছে। মানুষ হারিয়ে যায় উজ্জ্বল রঙের প্রপাতে। মস্তকের নিশানা দেখা যায় না। এতটাই বাঁধাহীন মানুষ শাহাবুদ্দিন আঁকেন। গেরিলা ছবির চরিত্র একটি শায়িত মানুষ, তার মধ্যে একরকম লক্ষ্যে পৌঁছার অভিব্যক্তি খুঁজে পাওয়া যায়। ছবির জমিনের সঙ্গে ধূসর নীল ব্যবহার দ্রোহ আর শান্তির কথা বলে দেয়। এ-প্রদর্শনীতে বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ ও মহাত্মা গান্ধীর তিনটি প্রতিকৃতি রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর এ ছবিতে লাল-সবুজ রঙের রেখা প্রয়োগে বাংলাদেশের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে এক করে দেখেছেন। রবীন্দ্রনাথের সৌম্য-শান্ত প্রতিকৃতির মাঝে শুভ্র আভা ছড়িয়ে দেন রঙের প্রলেপে। মহাত্মা গান্ধীর শান্তি অন্বেষণের বাণী প্রচার করছে যেন তাঁরই প্রতিকৃতি। লাল-সবুজ রঙের প্রপাত আর উজ্জ্বল সাদা রঙের ক্যানভাসে শাহাবুদ্দিন সবুজ-শ্যামল শান্তির বাংলার কথা বারবার আমাদের বলেন, যেটি আমাদের প্রাণের বাংলাদেশ। ‘গ্যালারি ২১’-এ প্রদর্শনীটি শেষ হয়েছে ১১ অক্টোবর ২০১৩।
গতির কারিগর
তাঁর ছবিতে কখনো দর্শক স্থিরতা পাবেন না। ছুটে চলা মানুষ অথবা প্রাণীর অবয়ব, এমনকি প্রতিকৃতিতেও এক অদম্য গতির উপস্থিতি পাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে তিনি অসীম সাহস সঞ্চয় করেছেন। তাঁর আঁকা ছবিতে সে সাহসের ছাপ দেখা দেয়। গত ২৮ সেপ্টেম্বর গ্যালারি চিত্রকে শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদের সম্প্রতি অাঁকা ত্রিশটি ছবির প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। প্যারিস প্রবাসী শিল্পী শাহাবুদ্দিন দেশের মায়া কখনো ভুলতে পারেন না, স্মৃতিতে সবসময়ই দেশের মানুষ, প্রকৃতি, মহামানবের প্রতিকৃতি দোলা দেয়। এ-প্রদর্শনীর ছবিগুলোকে পৌনঃপুনিক উপস্থাপন মনে হলেও কিছু কাজে নতুন চিন্তার প্রকাশ স্পষ্ট। শিল্পকরণ রীতি, দর্শকদের সঙ্গে শিল্পকর্মের সেতুবন্ধ তৈরি হয়েছে শাহাবুদ্দিনের সহজবোধ্য ছবির বিষয়ের জন্য। জয়নুল আবেদিন, এস এম সুলতানের মানব দেহাবয়ব নিয়ে শিল্প-সৃষ্টির প্রেরণাকে শাহাবুদ্দিন ধারণ করেন। শারীরবিদ্যার অভ্যন্তরীণ শক্তির উৎসসমূহের খোঁজে তিনি ছাত্রাবস্থায়ই পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। লাল-সবুজ আর বান্ট সিয়েনা রঙের প্রতি মোহ তৈরি হয় মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের কাজে। চারকোলের বেশ কিছু প্রতিকৃতি ও ফিগার ড্রইং ওই সময়ের কাজে দর্শক দেখতে পেয়েছিলেন। গ্যালারি চিত্রকের এ-প্রদর্শনীতে বঙ্গবন্ধুর একাধিক প্রতিকৃতির সঙ্গে রয়েছে জনতার উত্তাল সভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, ৭ই মার্চ ১৯৭১।জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যে ভাষণ দিয়েছিলেন তাতে যোগ দিয়েছিলেন শিল্পী শাহাবুদ্দিন নিজেই। স্বাধীনতার সেই অমর কবির কবিতা বুকে ধারণ করে তিনি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সেই চেতনা থেকে উৎকীর্ণ হয়েছে ৭ই মার্চ ’৭১ ছবিটি। অগণিত মানুষের সমাবেশে আঙুল উঁচিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সঙ্গে যোগ করেছেন লাল-সবুজ পতাকা। ইউরোপীয় শিল্পী দ্য কুনিংয়ের গতিময় ফিগার আর পিকাসোর জ্যামিতিনির্ভর দেহাবয়বের ছায়া শাহাবুদ্দিনের কাজে মিলে গেলেও নিজস্ব ঢঙে রং লেপন ও রেখা প্রয়োগ তাঁর কাজকে দিয়েছে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য। উজ্জ্বল বর্ণ প্রয়োগ মানবদেহ থেকে বিচ্ছুরিত আলোর প্রতীক সাদা বা হালকা কোনো রং। শিল্পী মানবদেহের মাঝে এক বার্তা দেখতে পান, যেটি বাংলার শ্যামল সবুজ মাঠ আর উজ্জ্বল আভায় আলোকিত। মিকেলেঞ্জেলোর সিসটিন চ্যাপেলের ছাদে অাঁকা শেষ বিচারের দিনে ছবির মানুষের দেহের শক্তিমত্তা আর এক মানুষ থেকে অন্য মানুষের দেহে সঞ্চারিত শক্তির প্রভাব শাহাবুদ্দিনের কাজে খোঁজ মেলে। রেখা ছুটে চলে, সঙ্গে রংও। চিত্রতলে শূন্য স্থান রেখে দিয়ে কৌণিক বা একপাশে বিষয়ের উপস্থাপন তিনি সাহসের সঙ্গে করেন। এ-প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সাহসের সঙ্গে কম্পোজিশন করি বিশাল অংশজুড়ে শুধু রঙের ছোপ আর অন্য অংশে ছবির বিষয় একটির সঙ্গে অন্যটি যুক্ত হয়। এটি খুব পরিকল্পনা করে সম্পন্ন করতে হয়।’ মহাত্মা গান্ধীর পূর্ণ অবয়ব অাঁকায় মুখের আকৃতিতে শান্ত-স্থির ও দ্যুতি ছড়িয়েছেন। গান্ধীর সাদা রঙের পোশাকের উজ্জ্বলতা মুখাবয়বের সঙ্গে মিলেমিশে আছে। এ-প্রদর্শনীর ব্যতিক্রমী কিছু কাজ হলো ষাঁড়, ঘোড়া ও অন্য কয়েকটি প্রাণীর গতিময় ভঙ্গির উপস্থাপনা। ঘোড়ার দুরন্ত গতি ক্যানভাসের কৌণিক বিভাজন দৃষ্টিতে গতির খোঁজ দেয়। একাত্তরের ভয়াবহ দুঃসময়ে আশ্রয়ের খোঁজে মানুষের যাত্রা শাহাবুদ্দিন খুব কাছ থেকে দেখেছেন। সারি সারি মানুষের মিছিলে একরৈখিক শূন্যতা ছবিতে তুলে এনেছেন। ‘রিফিউজি’-১, ২ ছবি দুটি এক্ষেত্রে উলে�খ্য। মানবশরীরের অদম্য গতি, মানুষের মিছিলে শূন্যতা হাহাকার, কখনো বিজয়োল্লাসে চিৎকার করা মানুষ শাহাবুদ্দিন আঁকেন। এমন সহজপাঠ্য বিষয় দর্শকদের সামনে এনে দেন যেটি দর্শককে একসঙ্গে ভাবায় এবং দ্রোহের মন্ত্রে উজ্জীবিত করে। চিত্রকের এ-প্রদর্শনীটি শেষ হয়েছে ১২ অক্টোবর ২০১৩।