কা বে রী গা য়ে ন
‘তবুও শ্মশান থেকে দেখেছি চকিত রৌদ্রে
কেমন জেগেছে শালিধান’
(জীবনানন্দ দাশ, অন্ধকার থেকে,
বেলা অবেলা কালবেলা)
হ্যাঁ, পুরোপুরি চল্লিশ বছর লেগে গেল একজন নারীকে সরাসরি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সেলুলয়েডের ফিতায় দেখতে। শেষতক কাজটি করলেন নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু তাঁর গেরিলা চলচ্চিত্রে। চলচ্চিত্রটি সম্পর্কে কোনো আলোচনার আগে তাই প্রথমে তাঁকে অভিবাদন জানাই, অভিনন্দন জানাই। মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান বহুমাত্রিক হলেও বাংলাদেশের মূলধারার ইতিহাসে নারীর মুক্তিযোদ্ধা ইমেজের পরিবর্তে তাঁর ধর্ষিত ইমেজটিকেই কেবল প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। একই ঘটনা ঘটেছে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রেও। গেরিলাই ছেদ ঘটাল সেই চিরাচরিত ইমেজ নির্মাণের একচেটিয়া অভ্যস্ততায়।
যে-কারণে গেরিলা নির্মাণ গুরুত্বপূর্ণ
কেবল বাংলাদেশেই নয়, ইতিহাসজুড়ে, সারা পৃথিবীতে, আমাদের সামষ্টিক চেতনায় যোদ্ধার ভূমিকা পুরুষের জন্যই তুলে রাখা। সার্বিকভাবে গণমাধ্যমে যুদ্ধ উপস্থাপনবিষয়ক তাত্ত্বিক কাঠামো (del Zotto, 2002; Fröhlich, 2002; Stabile and Kumar, 2005)এই মর্মে সাক্ষ্য দেয় যে, যুদ্ধকে বৈধতা দেওয়ার জন্য সেনাবাহিনী এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব নারীর শান্তিকামী অথচ দুর্বল ও অসহায় এবং পুরুষের শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান ইমেজকে ব্যবহার করে। উদ্দেশ্য, এসব অসহায় নারী, শিশু ও বৃদ্ধকে সাহায্য করার জন্যই ক্ষমতাবান পুরুষের যুদ্ধে যাওয়া প্রয়োজন – এই আবহ তৈরি করা। ফলে যুদ্ধের চিরায়ত জেন্ডার কাভারেজে নারীর ভূমিকা তার অসহায়, আক্রান্ত অস্তিত্বের প্রতি সহানুভূতি তৈরিতেই সীমাবদ্ধ রাখে প্রচলিত গণমাধ্যম। চলচ্চিত্রও এদিক থেকে ব্যতিক্রম নয়। কেননা, যুদ্ধে যাওয়ার যৌক্তিকতা প্রতিটি দেশের সরকারকেই প্রস্তুত রাখতে হয়। গণমাধ্যমের অন্যান্য শাখার মতো চলচ্চিত্রও অনেক ক্ষেত্রেই জনগণের সম্মতি উৎপাদনের জন্য আলথুজার (১৯৭০) কথিত রাষ্ট্রের মতাদর্শিক হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। ফলে অবধারিতভাবে যুদ্ধ-চলচ্চিত্রে নারীর শান্তিকামী, অসহায়, আক্রান্ত অস্তিত্বকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়ে থাকে।
যুদ্ধ-চলচ্চিত্র এমন একটি জঁরার প্রতিনিধিত্ব করে, যেখানে নারী খুব কমই প্রধান ভূমিকায় থাকেন। বৈশ্বিক যুদ্ধ-চলচ্চিত্রের ফ্রেমওয়ার্কেও মূলত যেসব চরিত্রে তাঁদের দেখা যায়, সেসব হলো – নার্স, মা, স্ত্রী, প্রেমিকা-বান্ধবী, প্রতিরোধ যোদ্ধা, সৈনিক, কদাচিৎ অফিসার এবং অবশ্যই অসহায় শিকার। সবচেয়ে বেশি দেখা যায় নার্সের ভূমিকায়। The Lighthorsemen (1987), In Love and War (1996), The English Patient (1996) কিংবা হালের Pearl Harbor (২০০১)-এ নার্স হিসেবেই নারীর অংশগ্রহণকে রোমান্টিকভাবে উপস্থাপিত হতে দেখি। ১৯৪০ সালে মার্কিন চলচ্চিত্রকার John H. Auer নির্মাণ করেন Women in War,যার বিষয়বস্তুই ছিল ব্রিটেনের যুদ্ধে যেসব নার্স কাজ করেছেন তাঁরা। কোনো কোনো চলচ্চিত্রের একবারে শুরুতে মা, স্ত্রী, প্রেমিকা-বাগদত্তাদের দেখা যায়, বিশেষ করে সৈন্যরা যখন যুদ্ধে যাওয়ার জন্য বাড়ি ছাড়েন, যেমনটি আমরা দেখি Dark Blue World (২০০১) কিংবা রাশিয়ার চলচ্চিত্র The Ballad of a Soldier (১৯৫৯)-এ। তাঁদের আমরা আবার দেখতে পাই, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আসা চিঠি পড়তে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, The Thin Red Line (১৯৯৮)-এর কথা। এসব চরিত্র প্রায়ই যুদ্ধক্ষেত্রে থাকা যোদ্ধাদের সঙ্গে যাঁরা যুদ্ধ করছেন না তাঁদের জীবন-যাপনের ফারাকটি বোঝানোর ব্যাপারে ব্যবহৃত হয়। তারপর, আরো একবার তাঁদের দেখা মিলতে পারে, একেবারে শেষে, সৈন্যরা যখন বাড়ি ফেরেন। অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী এমন একজন স্ত্রী হলেন We Were Soldiers (২০০২)-এ ম্যাডেলিন স্টাউ। কাহিনি ও ক্যামেরা ঘুরতে থাকে যুদ্ধক্ষেত্র ও বাড়ির মধ্যে। বিশেষ করে টেলিগ্রামে যখন সৈনিকটির মৃত্যুর খবর আসে, তখন তাঁর স্ত্রীর যন্ত্রণাকে ফুটিয়ে তোলার জন্য। কিংবা সোভিয়েত যুদ্ধ-চলচ্চিত্র Cranes are Flying-এর শেষ দৃশ্যের কথা মনে করা যায় যখন সকল প্রেমিকা-স্ত্রী-মা জড়ো হয়েছেন রেলস্টেশনে যুদ্ধফেরত তাঁদের প্রেমিক-স্বামী-বাবাকে অভ্যর্থনা জানাতে। নার্সরা প্রায়শই সৈন্যদের প্রেমিকার ভূমিকাতেও থাকেন; ফলে দুটি চরিত্র একাকার হয়ে যায়, তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ওপর নির্মিত অনেক চলচ্চিত্রেই সৈনিকরা যেসব দেশে যুদ্ধে যান, সেসব দেশের মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন। The Pacific (২০১০)-এ আমেরিকান সৈন্যদের দেখা যায় অস্ট্রেলিয়ান বান্ধবী জুটিয়ে নিতে কিংবা Captain Correli’s Mandoline (২০০১)-এ ইতালিয়ান সৈন্যরা এসে প্রেম করেন স্পেনের মেয়ের সঙ্গে।
যদিও সংখ্যায় কম, তবুও কিছু চলচ্চিত্রে নারীকে প্রতিরোধ যোদ্ধার ভূমিকায় দেখা যায়, যেমন Charlotte Gray (2001), Uprising (2001), Sophie School (2005), Black Book (২০০৬)। যোদ্ধা হিসেবে নারীর উপস্থিতি খুবই কম। Full Metal Jacket (১৯৮৭)-এ ভিয়েতনামী নারী গেরিলা যোদ্ধা বা G.I. Jane (১৯৯৭)-এ নারী সৈনিকবেশী ডেমি মুরকে অনেকেই হয়তো মনে রেখেছেন। অফিসার হিসেবে নারীর চিত্রায়ণ আরো কম। ডেমি মুর অভিনীত A Few Good Men (১৯৯২) কিংবা পাইলট ক্যাপ্টেন ক্যারেন ওয়ালডেন হিসেবে মেগ রায়ান-অভিনীত Courage Under Fire (১৯৯৬) সেই ব্যতিক্রমী কয়েকটি চলচ্চিত্রের মধ্যে অন্যতম।
তবে অসংখ্য চলচ্চিত্রে নারী যুদ্ধের অসহায় শিকার হিসেবে চিত্রায়িত। বিশেষ করে ভিয়েতনাম যুদ্ধের ওপর নির্মিত চলচ্চিত্রে যেসব নারীকে দেখানো হয়েছে সেগুলো সবচেয়ে করুণ। এক্ষেত্রে Platoon (১৯৮৬) কিংবা Casualties of War (১৯৮৯)-এর কথা উল্লেখ করতেই হয়। যুদ্ধ-চলচ্চিত্রে ধর্ষিত নারী বললেই Two Women-এর সোফিয়া লরেনের মুখ ভেসে ওঠে।
যদিও প্রধান চরিত্রে নয়, তবে যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের কিছু কিছু চলচ্চিত্রে নারীকে যথেষ্ট শক্তিশালী চরিত্রেও দেখা গেছে। এমন তিনটি ক্ল্যাসিক যুদ্ধ ছবি হলো : The Cruel Sea (1953), The Bismarck (1940) Ges Ice Cold in Alex (1958)| G QvovI Odette (1950), Carve Her Name with Pride (1958), Charlotte Gray (২০০১) – এসব চলচ্চিত্রে বিশেষ এজেন্ট হিসেবে নারী চরিত্র অত্যন্ত শক্তিশালী এবং প্রধান ভূমিকায়ও দেখা গেছে।
হলিউডের অবস্থান অবশ্য এক্ষেত্রে বেশ ভিন্ন। পুরুষই সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। যুদ্ধকালে কোনো নারী মূল দায়িত্ব পালন করেছেন – এ-মর্মে কোনো ছবির হদিস পাওয়া যায় না। তবে উল্লেখ করা যেতে পারে, নারী সৈনিকদের ওপর নির্মিত মার্কিন চলচ্চিত্র Keep Your Powder Dry (১৯৪৫)-এর কথা। যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ-চলচ্চিত্রে নারীকে আরেকভাবে উপস্থাপিত হতে দেখা যায় – যৌনকর্মী। এক্ষেত্রে একমাত্র উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম বোধহয় Cross of Iron (১৯৭৭)।
সোভিয়েত যুদ্ধ-চলচ্চিত্রের কথা বলতে গেলে, ১৯৪৩ সালে মুক্তি পায় ফ্রেডরিখ এরমলারের Ona zashchishchaet rodinu, (She Defends the Motherland, ১৯৪৩), যা আমেরিকাতে মুক্তি পায় No Greater Love নামে। নায়িকাপ্রধান চলচ্চিত্রের চিরায়ত ধারায় একটি শান্ত মনোরম দিন অনন্ত দুঃখে পরিণত হয় যখন জার্মান সৈন্যরা প্রাসকোভিয়া দুকিয়ানোভা (পাশা) নামের একজন সাধারণ মা-স্ত্রী-প্রেমিকার ভূমিকায় সুখী নারীর স্বামী-সন্তান-মাতাপিতাকে হত্যা করার পর, তাঁকে ধর্ষণ করে। এই ঘটনার পর কীভাবে এই শান্ত-সুখী ট্রাক্টর-ড্রাইভার রাতারাতি পাথর-কঠিন মুখের কমরেড পি নামের যোদ্ধায় পরিণত হন এবং ‘The Motherland Calls You’ শিরোনামের পোস্টারের জনপ্রিয় মুখ হয়ে ওঠেন, এই চলচ্চিত্র সেই রূপান্তরকেই ধারণ করেছে। কমরেড পির অনুসরণে এরপর দেখা যায় মার্ক ডনসকোইর The Rainbow (১৯৪৩) চলচ্চিত্রে ওলেনা কস্টিউখ, লিও আর্নসটামের Zoia তড়রধ (১৯৪৪) ছবিতে জোইয়া কসমোডেমিআস্কাইয়াকে। দুঃখের বিষয়, ১৯৪৪ সালের মাঝামাঝি নারী যোদ্ধাদের চরিত্রগুলো পুরুষ সৈনিক, নাবিক, পাইলট চরিত্র দিয়ে প্রতিস্থাপিত হতে থাকে। ইভান পাভরেভের Six o’Clock in the Evening After the War (১৯৪৪), ইগর সাভচেঙ্কোর Ivan Nikulin : Russian Sailor (১৯৪৪) – এসব লঘু চলচ্চিত্র প্রাধান্য বিস্তার করতে থাকে। এভাবেই সোভিয়েত যুদ্ধ-চলচ্চিত্রে নারীর যে শৈল্পিক মুক্তির সূচনা হয়েছিল, যুদ্ধ শেষ হতে হতে তা মিলিয়ে যায়।
একইভাবে জার্মানিতে নির্মিত হয় Annelie (Josefvon Bákyn, ১৯৪৫), যার উপজীব্য ছিল যুদ্ধের সময় এক সাহসী মা। গ্রিক প্রতিরোধের ওপর ১৯৫৩ সালে আমেরিকায় নির্মিত হয় Guerrilla Girl (১৯৫৩), পরিচালক John Christian। ফিলিপাইনে জাপানি আগ্রাসনের সময় ফিলিপিনো সেবাদাসীর জীবন নিয়ে চলচ্চিত্র Comfort Women : A Cry for Justice (১৯৮৯), পরিচালক Celso Ad. Castillo । তবে অসংখ্য যুদ্ধ-চলচ্চিত্রের মধ্যে নারীযোদ্ধাপ্রধান চলচ্চিত্র খুবই কম, বলতে গেলে একেবারেই হাতে গোনা যায়। এসব যুদ্ধ-চলচ্চিত্র থেকে কতগুলো স্বাভাবিক প্রবণতা বের হয়ে আসে।
প্রথমত, সারা পৃথিবীতেই নারীপ্রধান যুদ্ধ-চলচ্চিত্র সংখ্যায় খুবই কম;
দ্বিতীয়ত, নারীকে যোদ্ধার ভূমিকায় দেখা হয়েছে মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি চলচ্চিত্রে;
তৃতীয়ত, যেসব চলচ্চিত্রে নারীর যোদ্ধা ভূমিকা রয়েছে, সেসব ক্ষেত্রেও প্রায়শই প্রতিরোধ যোদ্ধার ভূমিকায় দেখা যায়;
চতুর্থত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ওপর বা সময়কালে নির্মিত অনেক চলচ্চিত্রেই নারীকে প্রতিরোধ যোদ্ধার ভূমিকায় দেখানো হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেগুলো প্রায়শই ছিল প্রোপাগান্ডা চলচ্চিত্রের অংশবিশেষ। বিশেষ করে মিত্রবাহিনীর দেশগুলোর মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় যুদ্ধকালে এবং স্ব-স্ব দেশের সরকারি স্কিমের অংশ হিসেবেই নারীর অংশগ্রহণমূলক চলচ্চিত্র নির্মাণ হতে থাকে। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে আগেই বা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নারীকে ফের দেখানো হয় গৌণ চরিত্রে, যুদ্ধফেরত পুরুষ সৈনিকরাই হয়ে ওঠেন ফের যুদ্ধ-চলচ্চিত্রের মূল ফোকাসবিন্দু।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোর ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় (গায়েন, ২০১১) প্রাক-স্বাধীনতাপর্ব, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এবং যুদ্ধ-পরবর্তী কাহিনি নিয়ে নির্মিত প্রত্যেকটি নারী চরিত্র বিশ্লেষণ শেষে দেখা যায়, গেরিলার আগে কোনো চলচ্চিত্রেই নারীকে সরাসরি মুক্তিযোদ্ধা চরিত্রে দেখানো হয়নি। মূল মুক্তিযোদ্ধা চরিত্রে তো অনেক দূরের কথা। স্বাধীনতা-পরবর্তী যুদ্ধ-চলচ্চিত্রের প্রথম তরঙ্গে (১৯৭২-১৯৭৫) নারী কেবলই ধর্ষিত এবং অনেক ক্ষেত্রেই এই ধর্ষণকে বাণিজ্যিক প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয়েছে। দ্বিতীয় তরঙ্গে (১৯৮৩-১৯৯৪) মূলত বিকল্প ধারার চলচ্চিত্রের যুগ, যার প্রধান উপজীব্য মুক্তিযুদ্ধ Ñ সেখানেও নারী নিষ্ক্রিয় বা ধর্ষিত, তৃতীয় এবং চতুর্থ তরঙ্গে (১৯৯৪-২০১০) যখন বিকল্প ধারার নির্মাতারা শূন্য দশকে ফিরলেন মূলধারার যুদ্ধ-চলচ্চিত্র নিয়ে তখন নারীর যুদ্ধ অভিজ্ঞতা অস্পষ্ট হয়ে পড়েছে। তরঙ্গ পাঁচে (২০০০-এ পর্যন্ত) এসে বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রে যুদ্ধ অভিজ্ঞতায় নারীর অক্ষয় সতীত্ব প্রতিষ্ঠার এক প্রয়াস দেখা যায়। নারী নির্মাতা, নারী কাহিনিকারদের চলচ্চিত্রে যুদ্ধশিশু বা নারীর পরোক্ষ অবদানের প্রসঙ্গটি এলেও নারীকে ঠিক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দেখা যায়নি। এসব চলচ্চিত্রে ধর্ষিত নারীকে হয় মরে যেতে হয়েছে নয়তো পাগল হতে হয়েছে। এমনকি আমাদের প্রামাণ্যচিত্রগুলোতেও নারী মুক্তিযোদ্ধাকে সরাসরি পাওয়া যায়নি, তাঁর বীরত্ব নয় তাঁর ওপর নির্যাতনকেই দেখানো হয়েছে। গেরিলা সেদিক থেকে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। ঐতিহাসিক এই অবদানকে বিবেচনায় না রেখে গেরিলা চলচ্চিত্রের আলোচনা কিংবা সমালোচনা খণ্ডিত হবে বলেই মনে হয়।
আখ্যানভাগ
ছবির শুরুতেই কাহিনি সম্পর্কে বলা হয়েছে, একজন মুক্তিযোদ্ধার
অভিজ্ঞতা ও প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হকের নিষিদ্ধ লোবান উপন্যাস
অবলম্বনে এই চলচ্চিত্রটির কাহিনি গড়ে উঠেছে। কাহিনিতে ২৫ মার্চের রাতে সাংবাদিক স্বামী নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পর পুরনো ঢাকার বিলকিস বানু নামের একজন বাঙালি নারী ক্রমশ মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন একজন গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে। বিলকিস বানুর ঢাকার গেরিলা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া এবং এক পর্যায়ে ঢাকা ছেড়ে নিজ গ্রামের দিকে যাত্রা করার মধ্য দিয়ে ছবির কাহিনি এগোতে থাকে। বিলকিস বানু এবং তাঁর অন্য সহযোদ্ধাদের নানান সাহসী কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে উন্মোচিত হতে থাকে ঢাকার গেরিলা যুদ্ধে ছাত্র-তরুণ-শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের অংশগ্রহণের স্বরূপ। সংগীতজ্ঞ শহীদ আলতাফ মাহমুদ এবং তাঁর পরিবারকেন্দ্রিক মুক্তিযুদ্ধকালীন নানা তৎপরতা, পাক হানাদারবাহিনী আলতাফ মাহমুদকে ধরে নিয়ে যাওয়া – ইতিহাসের এইসব গুরুত্বপূর্ণ সংঘটন উপস্থাপিত হতে থাকে। কিন্তু এই গেরিলা বাহিনীর একজন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে অত্যাচারের মুখে গেরিলা বাহিনীর সব সদস্যের নামধাম জানিয়ে দিলে বিলকিস বানুর ঢাকার পাট তাৎক্ষণিকভাবেই তুলে ফেলতে হয়। তিনি কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ট্রেন ধরে যাত্রা করেন রংপুরে, নিজগ্রাম জলেশ্বরীর দিকে। তাঁর এই যাত্রাপথে পাকিস্তানি বাহিনী এবং রাজাকারদের বর্বরতা, আর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ যুদ্ধের একটি চেহারা বিলকিস বানুর মাধ্যমে দর্শকের চোখের সামনে হাজির হয়। শহরের মুক্তিযুদ্ধ এবং গ্রামের মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে একমাত্র সংযোজক সূত্র হয়ে ওঠে তাঁর এই অভিযাত্রা। যেন বা একটি একক অভিযাত্রা। শেষে জলেশ্বরীতেই পাকিস্তানি সেনাক্যাম্পে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে কাহিনি শেষ হয়। শেকড়ে ফিরে শেকড় থেকে শত্র“সেনাকে সমূলে উৎপাটন করে জীবন উৎসর্গ করার বীরোচিত ঘটনার মধ্য দিয়ে শেষ হয় কাহিনি। বর্ণনা খুব সরলরৈখিক এবং মুক্তিযুদ্ধের সরলপাঠ ধরেই আগানো।
আলোচনা-সমালোচনার চাপান-উতোর
চলচ্চিত্রটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাওয়ার আগেই জন-প্রত্যাশায় স্থান করে নেয় মূলত তিন কারণে : মুক্তিযুদ্ধের ছবি, নাসিরউদ্দীন ইউসুফের ছবি এবং সৈয়দ শামসুল হকের কাহিনি। বলে নেওয়া ভালো, ছবিটি দর্শকদের জন্য করমুক্ত করেছে সরকার। কিন্তু ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর মূলধারার গণমাধ্যমে সেই অর্থে রিভিউ চোখে পড়েনি, তবে ব্লগে বেশ কিছু উত্তপ্ত আলোচনা দেখা গেছে। ব্লগে বেশ কড়া সমালোচনাও দেখা গেছে ছবিটি নির্মাণে নানা ধরনের অসংগতি নিয়ে। আমি প্রথমে অসংগতি আলোচনার চেয়ে বরং ছবিটিতে কয়েকটি চ্যালেঞ্জ যেভাবে মোকাবিলা করা হয়েছে সেসব নিয়েই আলোচনা করতে চাই।
প্রথম চ্যালেঞ্জ : বিলকিসের গেরিলা হয়ে ওঠার বিশ্বস্ততা নির্মাণ কাহিনিতে কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রই নয় শুধু, মূল চরিত্র বিলকিস বানু। ঢাকায় যে গেরিলা দলটি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বিভিন্ন জায়গায় অপারেশন চালিয়েছে, বিলকিস সেই দলের সদস্য হিসেবে বেশ কয়েকটি সফল অপারেশন চালান এবং শেষ পর্যন্ত নিজের মুক্তিযোদ্ধা ভাইকে জবাইকারী পাকিস্তানের মেজর জামশেদ এবং তার আস্তানা আত্মঘাতী বোমা মেরে উড়িয়ে দেন। একজন মধ্যবিত্ত চাকরিজীবী নারী, যিনি তাঁর স্বামীকে বিপদের ভয়ে এমনকি পত্রিকার কাজে বাইরে যেতে বাধা দিচ্ছিলেন তিনি যে-প্রক্রিয়ায় স্বামী নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পরে একটু একটু করে গেরিলা হয়ে উঠলেন, তার কাহিনি কিছু অসংগতিসহ উপস্থিত এই চলচ্চিত্রে। এটিই ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তার পারিপার্শ্বিকতায় যুদ্ধে ব্যাপৃত হওয়ার এক আবহ নির্মাণ করা অবশ্য সম্ভব হয়েছে। ঠিক কোন প্রক্রিয়ায় বিলকিস গেরিলা পত্রিকার কাজে যোগ দেন, সেটি বোঝা না গেলেও স্বামী নিখোঁজ হওয়ার পর গেরিলায় কাজ করতে থাকার দৃশ্য, আলতাফ মাহমুদদের পরিবারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা, যুদ্ধের আগেই এই গেরিলা বাহিনীর অধিকাংশ সদস্যের সঙ্গে বন্ধুত্ব (যা পরে আমরা ফ্ল্যাশব্যাকে দেখতে পাই) বিলকিসের গেরিলা হয়ে ওঠার কাহিনিকে মোটামুটি বিশ্বস্ততা দেয়। বিলকিস কিংবা বিলকিসের অন্যান্য সহযোদ্ধা যেমন মিসেস খান, শাহাদাত, টাকা সরবরাহকারী ব্যক্তি, বাচ্চাসহ যে নারী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে পৌঁছানোর জন্য গানের স্পুল বহন করেন, মিষ্টির দোকানদার, গাড়িতে-মোটরসাইকেলে চড়ে বোমা হামলার তরুণদের রাজনৈতিক আকাক্সক্ষা এবং প্রক্রিয়ার গঠনটি স্পষ্ট না হলেও এই সার্বিক যুদ্ধ এবং অংশগ্রহণের আবহের মধ্যে একজন নারীর গেরিলা হয়ে ওঠাটা খুব অস্বাভাবিক নয়। তবে রাতারাতি ঘর থেকে বেরিয়ে বিশাল যোদ্ধা হয়েছেন বিলকিস, এমনও নয়। প্রেসের ছোটখাটো কাজ দিয়েই তাঁর যাত্রা শুরু। এই গেরিলা কাজের পাশাপাশি তিনি ব্যাংকের চাকরি এবং সংসারে অসুস্থ শাশুড়ির দেখাশোনা করাসহ সংসারের দায়িত্বও চালিয়ে গেছেন ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত। মুক্তিযুদ্ধ যতটা না যুদ্ধক্ষেত্রের যুদ্ধ তার চেয়ে ঢের বেশি ছিল জনযুদ্ধ এবং অনেক মানুষই স্বাভাবিক জীবনের ছদ্মবেশে গেরিলাযুদ্ধ চালিয়েছেন। সেদিক থেকে বিলকিসের গেরিলা হয়ে ওঠাটা খুব অলীক নয়। এমনকি যুদ্ধের আগেই, স্বামীর সঙ্গে বন্ধুদের নিয়ে বিলকিসদের গ্রামের বাড়িতে নৌকা ভ্রমণের সময়ও আলোচনা ঘুরেফিরে দেশের রাজনীতি নিয়েই আবর্তিত হয়েছে।
দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ : শহর ও গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের উপস্থাপন
মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত প্রতিনিধিত্বশীল বেশিরভাগ ছবির কাহিনিই গ্রামভিত্তিক। ঢাকা শহরের থমথমে আবহটি আমরা খানিকটা পাই প্রথম হুমায়ূন আহমেদের আগুনের পরশমণি (১৯৯৪) ছবিতে। কিন্তু ওই সময় ঢাকাসহ সারাদেশে পাকিস্তানি বাহিনী এবং রাজাকারদের হত্যা-ধর্ষণ-লুট-অগ্নিসংযোগের যে সমন্বিত তাণ্ডব, সে বিষয়ের প্রতিনিধিত্বশীল কোনো ছবি আজো আমরা পাইনি। সেদিক থেকে সারাদেশে ঘটে যাওয়া অসংখ্য ঘটনার একটি প্রতিনিধিত্বশীল অংশকে উপস্থাপন করেছেন পরিচালক। মুক্তিযুদ্ধকালীন বাস্তবতার এমন কিছু দৃশ্যায়ন এই ছবিতে রয়েছে, যা আগের কোনো চলচ্চিত্রে সেভাবে বা বলা ভালো এত মাত্রায় দেখা যায়নি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পুরান ঢাকার তসলিম সর্দারের সঙ্গে রাজাকার-আলবদর বাহিনীর বিরোধ এবং পরিণতিতে জবাই হয়ে যাওয়া। যে তসলিম সর্দার একদিন এতিমখানা থেকে তুলে এনেছিলেন এক শিশুকে সে-ই এখন তসলিম সর্দারকে জবাই করছে। এর মাধ্যমে রাজাকারের চারিত্র্যও ফুটিয়ে তোলা গেছে। যুদ্ধকালে পুরান ঢাকার মহল্লায়-মহল্লায় যে টেনশন, শহীদুল জহিরের জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতার গল্পকে বাদ দিলে তেমনভাবে পাওয়া যায় না, এমনকি সাহিত্যেও। সেদিক থেকে মহল্লার সর্দারের সঙ্গে রাজাকার-আলবদর বাহিনীর বিরোধ ছাড়াও রাজাকার-আলবদর বাহিনীর ‘নারায়ে তাকবীর’ স্লোগান তুলে জঙ্গি মিছিল, ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পার্টির দৃশ্য ও সেখানে বিলকিসের বোমা রেখে আসার ঘটনা, বিলকিস এবং মিসেস খানের গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ, বাড়িতে ঢুকে পাকিস্তানি জান্তা সরফরাজের ধর্ষণ শেষে ট্রাউজারের জিপার আটকাতে আটকাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা এবং ব্যাকগ্রাউন্ডে নারীকণ্ঠের কান্না, রাস্তায় পড়ে থাকা লাশ, গোয়ালা ছেলেটির হিন্দু পরিচয় ফাঁস এবং তার ওপর অত্যাচার, রাজাকার-আলবদর বাহিনীর ক্ষমতাবান হয়ে উঠতে থাকা – এই খণ্ড দৃশ্যগুলো বিভিন্নজনের মুখে শোনা মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতার বয়ানের সঙ্গে মিলে যায়। যুদ্ধ কীভাবে মানবিক সম্পর্ককে ধূলিসাৎ করেছে তার একটি ক্রুর উদাহরণ হলো বিলকিসের কাজের মেয়ের সঙ্গে আজাদ আবুল কালামের সম্পর্ক, অথচ মেয়েটি যখন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় আজাদ আবুল কালামের মধ্যে তখন কোনো বেদনাবোধ কাজ করে না। মীরা নায়ারের আর্থ ছবিতে যেমন আমরা দেখেছি কীভাবে প্রেমিক আইস ক্যান্ডিম্যান দিল নওয়াজ প্রেমিকা শান্তাকে ধরিয়ে দেয় উত্তেজিত জঙ্গি মুসলিম জনতার কাছে ১৯৪৭-এর দাঙ্গার সময়ে, লাহোরে। অবরুদ্ধ ঢাকায় যে সাধারণ মানুষকে পরিচয়পত্র নিয়ে চলাচল করতে হয়েছে, এই তথ্যটিও প্রথমবারের মতো পাওয়া গেল গেরিলায়।
দ্বিতীয় অংশে, ট্রেনে করে বিলকিসের ঢাকা ছেড়ে জলেশ্বরী যাত্রা। ট্রেনের ছন্দে ফ্ল্যাশব্যাকে বিলকিসের বিয়ের পরে স্বামীর সঙ্গে ট্রেনে করে ফেরার স্মৃতি, বিয়ের পর বিলকিসের বন্ধুদের সঙ্গে তাঁর স্বামীর নৌকা ভ্রমণের স্মৃতি, নৌকায় বসে মৃত মানুষের লাশের গন্ধে তাঁর বমি অথচ পরে সেই নৌকায় শিশুর সঙ্গে তাঁর খাবার ভাগাভাগি করে খাওয়া, পথে পথে রাজাকারদের বীভৎসতা, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া, নির্বিচারে হিন্দু হত্যা এবং হিন্দু নারীদের ধর্ষণ, মুসলিম নামের কারণে রাজাকারদের বিশেষ সুবিধালাভ এ সবকিছু আমরা দেখতে থাকি বিলকিসের চোখে। ট্রেনে বোরখাহীন নারীর অপমানের প্রতিবাদে বোরখা খুলে ট্রেনের জানালায় নিঃশ্বাস নেওয়া, সবার চোখের সামনে অমুসলিম নারীকে ট্রেন থেকে নামিয়ে নেওয়া, ছোট ভাই খোকনের সঙ্গে নৌকায় ঘুরে বেড়ানোর ফ্ল্যাশব্যাক এবং ফ্ল্যাশব্যাক থেকে শিশু খোকনের নৌকার বর্তমানের খোকন কমান্ডারের নৌকায় রূপান্তর, পাকিস্তানি সেনাদের হাতে প্রিয় খোকনের জবাইয়ের খবর শোনার পর শুঁটকির গুদামে লুকিয়ে থাকা বিলকিসের বিভ্রম, লাটিম হাতে শিশু খোকনের তাঁকে খোঁজার আকুলতা – এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে মুক্তিসংগ্রামে আত্মত্যাগ, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব, পাকিস্তানি এবং আলবদরদের বর্বরতা, মুক্তিযুদ্ধের সময় নানা মানসিক সংকটের আবেগী ও জরুরি উপস্থাপন দেখি, যার ধারক-বাহক বিলকিস। তাঁর সঙ্গে কেউ নেই, যারা তাঁর কাছের – সবাই স্মৃতি। ফলে দ্বিতীয় অংশের গোটা কাহিনিটি হয়ে পড়ে বিলকিসের একক অভিযাত্রা, কোথাওবা তাঁর মনভ্রমণ। শহরের যুদ্ধ যতটা সরব, গ্রামের যুদ্ধকে ততটাই নির্জনতা আক্রান্ত মনে হয়েছে। আর জলেশ্বরীতে পৌঁছানোর পরে রেললাইনের ওপর দিয়ে তাঁর একাকী হেঁটে যাওয়া এবং পরে তাঁকে অনুসরণ করতে থাকা খোকন কমান্ডারের সহযোদ্ধা সিরাজ ভিন্ন আর কোনো জনপ্রাণীর খোঁজ পাওয়া যায় না। বাকি দৃশ্যগুলো সেটে করা।
প্রথম অংশের বিলকিস ঘটনার মধ্যে একজন অর্থাৎ যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী, দ্বিতীয় অংশের বিলকিস, শেষ দৃশ্যটি ছাড়া, একজন দর্শক – যাঁর চোখ দিয়ে আমরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন বাস্তবতার সঙ্গে পরিচিত হই।
যেহেতু অনেক বিষয়কে একসঙ্গে আনা হয়েছে, এর সুবিধা-অসুবিধা দুই-ই আছে। সুবিধা হলো, মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা এবং এর বহুমাত্রিক উপাদানগুলোকে দেখানো হয়েছে, ফলে যে-প্রজন্ম সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি বা সেই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যায়নি তারা ইতিহাসের এসব উপাদানকে প্রথমবারের মতো দেখার সুযোগ পাবে। অসুবিধা হলো, এত বিষয় উপস্থাপন করতে গিয়ে অনেক সময়েই কাহিনির খেই হারিয়ে গেছে; চরিত্রগুলোর উপস্থিতির ধারাবাহিকতা থাকেনি, ফলে চিত্রনাট্যের ভারসাম্য ব্যাহত হয়েছে। এই বিষয়গুলো নিয়েও আলোচনা হওয়া খুবই জরুরি, কারণ চলচ্চিত্র শেষ পর্যন্ত কেবল কিছু বক্তব্য নয়, চলচ্চিত্রের ভাষাটিও খুব জরুরি।
গেরিলায় বক্তব্যের চাপে নির্মাতা শিল্পরূপের সঙ্গে আপস করেছেন বললে বোধহয় খুব বাড়িয়ে বলা হয় না। ফলে চিত্রনাট্যে নানা ধরনের অসংগতি চোখ এড়ায় না।
অসংগতি এক : সৈয়দ শামসুল হকের নিষিদ্ধ লোবান উপন্যাস অবলম্বনে এই চলচ্চিত্রটি নির্মিত হলেও চলচ্চিত্রের ভাষার কথা বলতে গেলে ছবিটিকে সোজাসাপটা দুটি অংশে ভাগ করা যায়। প্রথম অংশ নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুর এবং দ্বিতীয় অংশ সৈয়দ হকের। ঢাকা থেকে বিলকিস জলেশ্বরীতে গেছেন, এর বাইরে এই ছবির অন্য কোনো উপাদানই নেই, যা এই দুটি চলচ্চিত্রকে জোড়া লাগিয়ে এক চলচ্চিত্র বানাতে পারে। সময় ডিস্ট্রিবিউশনও সমানই হবে। প্রশ্ন হলো, কেন দুটি আলাদা ছবি না বানিয়ে একটি ছবি বানানো হলো? বা অন্যভাবে বলা যেতে পারে কেন দুটি কাহিনি দিয়ে একটি ছবি বানানো হলো? জলেশ্বরীতে ঢোকার সময় যে দীর্ঘ সময় দেওয়া হলো বিলকিসের হাঁটা দেখানোর মধ্য দিয়ে – একজন অভিজ্ঞ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং চলচ্চিত্রকারের কাছে এর ব্যাখ্যা চাওয়া যেতেই পারে।
অসংগতি দুই : প্রথম অংশে অনেক চরিত্র, যাদের মধ্যে প্রায় প্রত্যেক চরিত্রই স্বাতন্ত্র্য নিয়ে জ্বলে উঠতে পারত কিন্তু সেসব চরিত্রের অনেকেই পর্দায় এসে মিলিয়ে যায়। বিশেষ করে অনেক বেশি চরিত্র একই সঙ্গে কাজ করার জন্য অনেক সম্ভাবনাময় চরিত্রকে আপস করতে হয়েছে। কয়েকটি সিকোয়েন্স নিয়ে এবার তাই আলাপ করতে হচ্ছে। উল্লেখ করা যায় পাকিস্তানি সেনা অফিসারদের ক্লাবে মিসেস খানের দৃশ্যটির কথা। অতর্কিত গেরিলা আক্রমণ এবং বিপুল বোমা বিস্ফোরণের পরে প্রায় সবাই মারা গেলেন অথচ বেঁচে রইলেন মিসেস খান! তখন ধারণা করতে হয় যে, এই বাঁচিয়ে রাখাটা হয়তো কাহিনিতে চরিত্রটির বিশেষ কোনো প্রয়োজনে। কিন্তু না, সেই চরিত্রটির আর কোনো প্রাসঙ্গিকতা পাওয়া যায় না। কিন্তু তারও আগে প্রশ্ন, কে এই মিসেস খান? পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাঁর এই দহরম-মহরমের উৎস কী? একটি দৃশ্যে তাঁর বাড়ি থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের জিপ বের হতে দেখা যায়, বিলকিস জিপটি দেখে নিজেকে লুকিয়ে রাখেন। কেন তাঁর বাড়ি থেকে পাকিস্তানি সৈন্যবোঝাই জিপ বের হতে দেখা যায়? জিপটি বেরিয়ে গেলে বিলকিস বাড়িতে ঢুকে মিসেস খানের কাছে একটি গাড়ি চান। যে নারীর বাড়িতে পাকিস্তানি সৈন্যদের এই আনাগোনা, সেই নারীর কাছে একজন গেরিলা যোদ্ধা কতখানি নিরাপদ? মিসেস খান কি কেবল ব্যবহৃত হলেন একটি সংযোগসূত্র হিসেবে?
অসংগতি তিন : ছবির শুরুতেই আমরা দেখি বিলকিস বানু এবং বিলকিসের স্বামী হাসানকে যিনি পেশায় একজন সাংবাদিক। পরে আমরা দেখি পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হয়তো তাঁকে গুম করে ফেলে এবং বিলকিসকে তখন দেখা যায় গেরিলা নামের পত্রিকায় কাজ করতে। এরপরে আর বিলকিসকে আমরা সাংবাদিক হিসেবে পাই না, তাঁকে পাওয়া যায় ব্যাংকার চরিত্রে এবং ব্যাংকে চাকরির পাশাপাশি তিনি তখন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তহবিল গঠন করেন এবং এরপরেই দেখা যায় বিলকিসকে নানা গেরিলা অপারেশনে সাহায্য করতে। আবার শাশুড়ির বিলাপ থেকে মনে হয়, বিলকিস আগে শুধু ঘরসংসারই করতেন, হাসানের মৃত্যুর পরে বুঝি কাজে ঢুকেছেন। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, বিলকিসের পেশা কী ছিল তাহলে? সাংবাদিকতা, ব্যাংকিং না স্রেফ গৃহবধূ? এমনকি কাহিনির একেবারে শেষে জানা যায় যে, তিনি রেডিওতে গানও করেন।
ফটোগ্রাফি : চলচ্চিত্রের ভিজ্যুয়ালাইজেশন নিয়ে বলার তেমন কিছু নেই। বোমা নিক্ষেপ, গুলি, ব্রিজ ওড়ানো, হেলিকপ্টারের দৃশ্যসহ বেশিরভাগ দৃশ্যায়ন গতানুগতিক, ক্ষেত্রবিশেষে সেকেলে। রিমান্ডের দৃশ্যগুলো অবশ্য বেশ বাস্তবসম্মত। গেরিলা দলের ছেলেদের বোমা মেরে পালিয়ে যাওয়ার দু-একটি দৃশ্য এমনকি শুধু যে অস্পষ্ট বা ঝাপসা হয়েছে তাই নয়, ক্যামেরা কেঁপে পর্যন্ত গেছে। আনাড়ি চোখেও মনে হয় ট্রাইপড কি ব্যবহার করা হয়নি? অথচ ছবির চিত্রগ্রহণের কাজ করেছেন ভারতের সমীরণ দত্ত। মজার ব্যাপার হলো, নানা অ্যাঙ্গেলে চিত্রধারণের কাজটি করা হলেও এডিটিংয়ের দুর্বলতার জন্যই হয়তো হাই অ্যাঙ্গেল, লো অ্যাঙ্গেল, লংশট, মিড শট, ক্লোজআপ – সবকিছুই আলাদা একেকটি শট হয়ে ওঠে। দৃশ্যটি ভালো কী মন্দ লাগার চাইতে বরং মনে হয় ‘উহা একটি লং শট’। ফ্ল্যাশব্যাকের যথেচ্ছ ব্যবহার ক্লান্তিকর। জলেশ্বরীতে রাতের দৃশ্যায়নে আলোর ব্যবহার সেটটিকে হাতে বানানো সেট বুঝিয়ে দেয়। আরেকটি বিষয় না বললেই নয়, আলোর ব্যবহার হয় চড়া নয়তো অন্ধকার। শুরুতেই মৃতদেহের প্রদর্শনে থিয়েটারের যে ঢংটি নেওয়া হয়েছে, সেটিই বরং একমাত্র এক্সপেরিমেন্ট যা মোটামুটি উতরে যেতে পারত, কিন্তু গানের ব্যবহার শুধু এই দৃশ্যগুলোকেই নয়, ছবির আবহের সঙ্গে খাপ খায়নি।
সংগীত পরিচালনা প্রসঙ্গে : এই ছবির সবচেয়ে দুর্বল অংশটি সম্ভবত এর সংগীত পরিচালনা। এত দিক খেয়াল করে যে-চলচ্চিত্রটি বানানো হয়েছে, তার কোনো সংগীত পরিকল্পনা ছিল না বা এত খাপছাড়া সাংগীতিক প্রয়োগের ঝুঁকি পরিচালক কেন নিলেন বোঝা গেল না। শুরুতেই, ছবির শিরোনাম দেখানোর সময়ই, যে জগঝম্প দিয়ে সাংগীতিক প্রয়োগ শুরু হলো, মনে হলো মুক্তিযুদ্ধের সিনেমাটিক উপস্থাপন নয় বরং মঞ্চনাটকের ছাঁচটিই ঢং ঢং করে বাজিয়ে দেওয়া হলো বুঝি দর্শককে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য। ভয় পেলাম। আবার ছবির মাঝখানে, আলতাফ মাহমুদের বাড়িতে যে মেয়েটি হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করে (সম্ভবত শিমূল ইউসুফের চরিত্র এটি, কারণ শাওন মাহমুদের তখনো এতটা বড় হওয়ার কথা নয়), তার ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজে পিয়ানোর সুর। হতবাক হয়ে যাই যখন আলতাফ মাহমুদকে ধরতে এলে তিনি উঠে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ‘বলো বীর, চির উন্নত মম শির’ নামের গানটি বিকট স্বরে বেজে ওঠে হলজুড়ে। তবে লজ্জায় অধোবদন হয়ে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করে ছবির শেষ অংশে এসে যখন ক্যাপ্টেন জামশেদ বিলকিসকে ধর্ষণে উদ্যত হলে ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজে বাঁশির রোমান্টিক সুর, চড়া স্বরে। ভীতিকর এবং ভয়াবহ এই সংগীত যোজনা।
অভিনয়, সম্পাদনা এবং অন্যান্য : অভিনয় নিয়ে বলার তেমন কিছু নেই। স্ব-স্ব ভূমিকায় কমবেশি সবাই মানানসই, ফেরদৌস ছাড়া। তাঁকে বাণিজ্যিক প্রয়োজনে আনা হয়েছে ধারণা করি, কিন্তু ছবিতে তাঁর অভিনয় দেখে মনে হয় সম্ভবত কমিক রিলিফের জন্যই তাঁর উপস্থিতি। শিল্প-নির্দেশক অনিমেষ আইচ। বিলকিসরূপী জয়া আহসানের শাড়ি পরার ধরনটা যে একেবারেই হালের, এমনকি ২০১০-২০১১-র দিককার, খেয়াল করেননি হয়তো। পাকিস্তানি সেনাদের পার্টিতে অংশগ্রহণের সুযোগে বিলকিসকে দিয়ে বাণিজ্যিক প্রয়োজন উসুল উপযোগী সাজগোজ অস্বস্তি তৈরি করে। গোটা ছবিতে অ্যামেচারের লক্ষণ দৃশ্যমান।
নাসিরউদ্দীন ইউসুফ এবং শিমূল ইউসুফের কাছে বাংলাদেশের মঞ্চনাটক ঋণী – সে-বিষয়ে সন্দেহের লেশমাত্র নেই। কিন্তু তাঁদের মঞ্চনাটক-সাধনা ক্ষেত্রবিশেষে বাদ সেধেছে সম্ভাবনাময় চলচ্চিত্রটিকে একটি উচ্চ স্তরের শিল্পমানে পৌঁছাতে। ফলে ছবি দেখার শেষে মনে সিনেম্যাটিক রেশ আর থাকে না। বেদনা তৈরি হয় না সত্তার গভীরে, ভাবনায় নিমজ্জন ঘটায় না। ছবিটা হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধকালীন অনেক ঘটনার বাস্তবোচিত খণ্ডচিত্রের সমাহার, দুর্বল সম্পাদনা এসব বাস্তবোচিত খণ্ডচিত্রকে একটি টোনে দাঁড় করিয়ে ছবিটিকে উত্তীর্ণ করাতে পারে না। মঞ্চনাটক আর চলচ্চিত্রের ভাষা যে ভিন্ন, সেটা বোঝানোর জন্য এই ছবিটি উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। চলচ্চিত্রের ভাষা ধরতে না পারার কারণে অনেক ইতিহাসঘনিষ্ঠ এবং বাস্তবোচিত দৃশ্যায়নের পরেও ছবিটি চলচ্চিত্র দেখার কাক্সিক্ষত অনুভূতি দিতে পারে না। তবে এই আলোচনা আর না বাড়াই গুরুতর আরেকটি বিষয়ে একটু বলার জন্য।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ১৯৭১-কে ঘিরে দুটি পরিভাষা দাঁড়িয়ে গেছে, যা দুটি মতাদর্শ বহন করে। মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীনতার যুদ্ধ। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ হলো ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরে পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রটি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর যে কলোনিয়াল অত্যাচার চাপিয়ে দেয়, তার বিপরীতে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক মুক্তির লড়াই। দীর্ঘ ২৪ বছর বাঙালি জাতি এদেশের অন্যান্য জাতিসত্তার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে এই লড়াই চালিয়েছে ধাপে ধাপে, যার চূড়ান্ত পরিণতি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। এটি কেবল বিদেশি সৈন্য আক্রমণ করল, বীর বাঙালি অস্ত্র ধরে তাদের হটিয়ে দিলো – এমন নয়। বরং এই মুক্তির স্বপ্ন ’৪৭-এরও আগে এদেশের মানুষের ব্রিটিশবিরোধী এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সাধারণ মানুষের নানা আন্দোলন ও মুক্তির আকাক্সক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরে যে-শক্তি ক্ষমতায় আসে, তারা মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে স্বাধীনতার যুদ্ধ প্রত্যয়টিকে বড় করে তোলে। তাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হয় পাকিস্তানি সেনারা ২৫ মার্চের রাতে ঘুমন্ত জাতির ওপর ট্যাংক চাপিয়ে দিলে, ‘হানাদার’ বাহিনীর বিরুদ্ধে রাতারাতি যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জনের মধ্যে, যা মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যয়টিকে খণ্ডিত করে। মুক্তিযোদ্ধা নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুর গেরিলায় বাঙালির এই স্বাধীনতাযুদ্ধটি পাওয়া যায়, মুক্তিযুদ্ধ পাওয়া যায় না।
তবু এ-কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, এযাবৎকালে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত ছবিগুলোর মধ্যে গেরিলাই সবচেয়ে বেশি প্রতিনিধিত্বশীল। তাই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ঘটনাকে আধেয়গতভাবে ধারণ করলেও মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটের সঙ্গে, মানুষের মুক্তির আকাক্সক্ষার সঙ্গে এই ঘটনাবলির যোগসূত্র স্থাপিত হয় না বলে কিছুটা অস্বস্তি থেকেই যায়। এবং অপেক্ষা করতে থাকি মুক্তিযুদ্ধের ছবিটির জন্য।
[সম্প্রতি কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে গেরিলা পুরস্কার অর্জন করেছে। আমরা এ চলচ্চিত্রের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিত ও অর্জন নিয়ে যে-কোনো আলোচনা পত্রস্থ করব।
-সম্পাদক : শিল্প ও শিল্পী]
তথ্যসূত্র
Althusser (1970-71). ‘Ideology and Ideological State Apparatuses’, in Lenin and Philosophy and Other Essays.
Del Zotto, Augusta C. (2002) ‘Weeping Women, Wringing Hands : How the Mainstream Media Stereotyped Women’s Experiences in Kosovo’, Journal of Gender Studies 11(2) : 141-50.
Fröhlich, Romy (2002). ‘The Medial Perception of Women in War : Female War Correspondents and War Coverage from the Perspective of Communication Science’, pp. 182–93 in U. Albrecht and J. Becker (eds) Medien zwischen Krieg und Frieden [The Media between War and Peace]. Baden-Baden : Nomos.
Stabile, Carol A. and Kumar, Deepa (2005) ‘Unveiling Imperialism : Media, Gender and the War on Afghanistan’, Media Culture Society 27(5) : 765–82.
গায়েন, কাবেরী (২০১১)। মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে নারী-নির্মাণ। গবেষণাপত্র, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ, ঢাকা, বাংলাদেশ।