ম ধু ম য় পা ল
বসন্ত কেবিন : আমাদের নালন্দা
চপারের ভাষায় কথা বলছে শাসকযুবকেরা। কেটে ফেলবে, চিরে ফেলবে, খসিয়ে দেবে। রাষ্ট্রলালিত এই ঘাতকতার সময়ে গণেশ পাইনের সঙ্গে আমার পরিচয়। সালটা সম্ভবত ১৯৭৫-এর শেষদিক কিংবা ১৯৭৬-এর গোড়া।
কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের ভেতরে কসমেটিকসের দোকান পেরিয়ে, বিখ্যাত ‘সুবোধের চা’ ডানদিকে রেখে, নানাবিধ বস্ত্রালয় আর গ্রন্থালয়ের মধ্যবর্তী পথ দিয়ে একেবারে শেষ সারিতে রুগ্ণ ভগ্ন একটা কেবিন। ‘বসন্ত কেবিন’। প্রায়-পরিত্যক্ত মন্দিরের মতো। যতেœর হাত তাকে উজ্জ্বল করে তুলতে পারত, কিন্তু সে হাত যেন হারিয়ে গেছে। দুপাশে ‘বিভূতি কেবিন’ আর ‘জগন্নাথ কেবিন’ ভাত-মাছ-মাংসের পেশাদারি আয়োজনে হোটেল হয়ে গেছে। মাঝখানে অর্থাভাব বা অন্য কোনো জটিলতায় বসন্ত-অপগত ক্লিষ্ট রেস্তোরাঁ – ভাঙা শ্বেতপাথরের টেবিল, নড়বড়ে চেয়ার, নির্জীব আলো, গরিব ক্যাশবাক্স, সেঁকা পাউরুটি আর চায়ের নিরীহ আয়োজন, চারদিকে কালো মেঘের মতো ঝুল, পায়ের কাছে ঘুরে বেড়ায় বেড়াল, ছানিপড়া আয়না, ঘরের মধ্যপথে আটকে থাকে পৃথিবীর আলো, চা বানায় ও সরবরাহ করে যে বাহাদুর তার করোটি ও অস্থিপঞ্জরে অন্ধকারের প্রলেপ কোনো অজীবিতের ইশারা দেয় যেন, যেন এই ঘরে অলক্ষ্যে কেউ মারা যাচ্ছে এমন ভারী হয়ে আছে বাতাস। এইখানে, প্রায় প্রতিদিন বিকেলে আসেন গণেশ পাইন। থাকেন সন্ধে গড়িয়ে রাত পর্যন্ত। আসেন তাঁর বন্ধুরা, অনুরাগীরা, ছবির ও ছবির বাইরের। আসেন কবিবন্ধু ইন্দ্রনীল চট্টোপাধ্যায়, শিল্পীবন্ধু দেবীপ্রসাদ সাহা, প্রাজ্ঞ সুহৃদ বীরেন চক্রবর্তী, সাংবাদিক বন্ধু যিশু চৌধুরী, তরুণ আঁকিয়ে-লিখিয়ে সমীর ঘোষ। জুটে যাই আমিও। দীনের হতে দীন এই ‘বসন্ত কেবিন’-ই আমাদের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়।
পাঁজরের ভেতর আলো
পথে পথে এশিয়ার মুক্তিসূর্যের ব্যানার-হোর্ডিং, মধ্য কলকাতার কোনো মধ্যমণির জয়ধ্বনি, জেলগরাদের প্রলম্বিত ছায়া, লকআপে মৃত্যুকালীন চিৎকার, পাড়ায় পাড়ায় লাশ, পালাতে পালাতে স্বজনহীন সমাজ – এরকম গণতন্ত্রে নতুন করে ভরসার জায়গা পেয়েছিলাম গণেশ পাইনের ছায়ায়। আমার অনুভবে, গণেশ পাইন শুধু শিল্পী ছিলেন না, তিনি একটা দর্শন, প্রান্তিক মানুষের বেঁচে থাকার দর্শন, পরাজয়ের মধ্যে অপরাজিতের দর্শন। বিশ্বাস থেকে বিশ্বাস খসে গেলে, বাণী থেকে অর্থ উবে গেলে, স্লোগান নিছক চিৎকারে পরিণত হলে দূরতম নক্ষত্র পর্যন্ত একটা অন্ধকার ঝুলে থাকে। সেই সময় পাঁজরের ভেতর, হাড়ের ভেতর ক্ষীণ কিন্তু অক্ষয় আলো জাগিয়ে বসে থাকেন গণেশ পাইন। আমাদের গণেশদা।
আমিও ওইরকম একটা আলো খুঁজছি তখন। ১৯৬৮-৬৯ থেকে সত্তরের মাঝামাঝি পর্যন্ত বিপ্লবের স্বপ্ন, বন্দুকের নল, ক্ষমতার জন্ম, মাও-সে তুংয়ের টেনসিল, রাত জেগে দেয়ালের পর দেয়াল কালো কালিতে শ্রীকাকুলাম-ভোজপুরে কৃষিবিপ্লবের আগুন জ্বলে ওঠার প্রচার লেখা, জেলে বা প্রকাশ্যে প্রায় প্রতিদিন বন্ধুদের খুন হওয়া, শহীদের মৃত্যু পাহাড়ের মতো ভারী, আমি যে পাহাড়ের চেয়ে ভারী হয়ে যাই, ধ্বংসস্তূপের মতো, নিজেকে নিয়ে নিজের থেকে পালানোর প্রাণপণ চেষ্টার তমসাচ্ছন্ন সেই সময়ে, চেনা সব মুখ সন্দেহে-সংশয়ে ঝাপসা হয়ে গেছে। পরিচয়ের প্রথম দিন গণেশদা বসেছিলেন কেবিনের ভেতর দিকের টেবিলে, প্রাক-অন্ধকারের ছায়ায়, হাতে সিগারেট। চোখ তুলে তাকালেন। ওই চোখ আমি কখনো দেখেছি কি প্রাত্যহিকের বাস্তবে বা বিপ্লবের অবাস্তবে? রূপকথার কৌটোর মতো সে-চোখ খুলে গেলে আলোকণা ছড়ায়, মায়াভূমি জাগে, হৃদিভাষ বৃষ্টির মতো ঝরে। গণেশদা বলেছিলেন, বসুন। তার পর থেকে প্রায় রোজ যাওয়া। যেন প্রকৃত বিপ্লবের, নতুন দিগন্তের অভ্যুদয় অনুভব করি। ধীরে ধীরে মুছে যায় বারুদের গন্ধ, জেলের গারদ…। স্লোগান অর্থহীন হয়ে গেলে বিশ্বাসের বুকে যে রক্তক্ষরণ হয়, তার থেকেও রেহাই পেলাম গণেশ পাইনের কাছে এসে।
আমার গণেশ পাইন আবহমান রাষ্ট্রীয় ও দলীয় ঘাতকতার ক্রূর কুটিল সময়ের এক নিষ্পলক দ্রষ্টা, যিনি সমকালের চিহ্ন থেকে বেরিয়ে পুরাণভাবনায় জারিত করে সৃষ্টি করেন নিজের দেখাকে, অনুভবকে, অভিজ্ঞতাকে।
পুরাণপ্রণীত
পুরাণ তাঁর আশৈশব ভালোবাসা। এক সাক্ষাৎকারে (১৬ ডিসেম্বর ১৯৯০) এই প্রতিবেদককে তিনি বলেছিলেন, একটা স্লেটে পুরাণের মক্শো শুরু। অবশ্য না বুঝেই। আমার ছেলেবেলার স্লেট। শিশু বয়সের পক্ষে একটু বড়। দেয়ালে গাঁথা পেরেকে ঝুলিয়ে রাখা হতো। একটা শিশুর ইচ্ছেগুলো সাদা রেখায় ফুটিয়ে তোলার ক্ষমতা ছিল তার। ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে মুছে নিলেই আবার কালো। স্লেটটাকে অসম্ভব ভালোবেসেছিল শিশুটি। তার খেলা নেই, হইহই নেই, বায়না নেই। রেখায় রেখায় উজাড় করে দেয় তার সব খেয়াল। কাঠকয়লা দিয়ে ঘষে নেয় খেয়ালখেলার জায়গাটা। জমি যত কালো হয়, সাদা তত ফোটে ভালো। অভিভাবকরা ভাবলেন, এ কেমন ছেলে খেলতে যায় না! আসলে আমি তো নিজের খেলা পেয়ে গেছি। সব অর্থ হয়তো বুঝিনি, অর্থ ছিল, যা আমার ভেতরের চাওয়ার অক্ষরমালা। আমার ঠাকুমা গল্প বলতেন চলমান ছবির মতো। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, রূপকথা, উপকথা তাঁর সীমাহীন সাম্রাজ্য। কথকতার গুণে সেই গল্পকথার দেশের পাখি, ফুল, লতা, পাতা, বনের মধ্যে কুঁড়েঘর, রাজধানীতে সান্ত্রীঘেরা প্রাসাদ থেকে শুরু করে রাম, রাবণ, হনুমান, ভীম, ধৃতরাষ্ট্র সবই আমার খুব চেনাজানা চরিত্র হয়ে গিয়েছিল। এরা কখনই আমার কাছে অবাস্তব ছিল না। আমি এদের দেখতে পাই। এদের কথা ভাবতে পারি। স্লেটের ওপর এদের এঁকেছি আমার মতো করে। সারা দুপুর, সারা বিকেল।
পুরাণে আপনার সেই কি প্রবেশ?
গণেশদা বললেন, আমার আত্মীয়তা। পুরাণ মানুষের অন্যধরনের ইতিহাস। মানুষের সাধনা, ব্যর্থতা ও মৌলিক অভিজ্ঞতার কথা ধরা থাকে এখানে। কতগুলো স্থায়ী বোধ, মূল অনুভব, যেমন অনিশ্চয়তা, আশঙ্কা, প্রত্যাশা ইত্যাদি। ছবিতে সেই বোধগুলোকেই চিত্রিত করতে চেয়েছি। জড়জগতের সঙ্গে তাদের আপাত কোনো সম্পর্ক নেই, তবে অনবরত কথোপকথন চলে। পুরাণের কাল মানুষের স্মৃতির ওপারের, স্মৃতিতে ধরা ইতিহাসের পূর্ববর্তী। আমার ছবিতে কালের সীমানা নেই।
ছেচল্লিশের দাঙ্গার সেই ভয়াবহ দৃশ্য কি কোনোভাবে আসে না আপনার ছবিতে? আপনি তখন নয় বছরের। ঠেলাগাড়ি বোঝাই লাশ। লাশের ওপর লাশ। আততায়ীদের ছুরিতে আঘাতে নিহত। প্রতিটি শরীরে নৃশংসতার চিহ্ন। প্রায় সবই বিবস্ত্র। শুধু একটি দেহের গলায় ছিল লকেট। এত মৃত্যুর মধ্যে পৃথিবীর আলোয় চিকচিক করছিল। কিংবা সত্তরের দশকের রাজনৈতিক হিংসা, বোমা গুলি তাণ্ডব খুনোখুনি।
তিনি বলেছিলেন, আসে। কালের চিহ্নে চেনা যায় না। পুরাণের নানাবিধ আখ্যানে-উপাখ্যানে চরিত্রে সব ধরা আছে। যেমন কুরুক্ষেত্র। ধ্বংসের এই সুদূরপ্রসারী পরিপ্রেক্ষিত কোথায় আছে? তিনি বললেন, একটা কথা মাঝে মাঝে মনে হয়, গ্রিক ট্র্যাজেডি অন্ধকার দেয়ালের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। আর মহাভারত সেই দেয়াল খোঁড়ার চেষ্টা করে। জীবনের মধ্যপর্বে ভারবি প্রকাশনার মহাভারতের সচিত্রকরণের সময় সম্ভবত এই বোধে উপনীত হন তিনি।
জীবনের প্রান্তে এসে মহাভারতের ছবি এঁকে সেই দেয়াল খোঁড়ার চেষ্টার আলোটা ধরতে চেয়েছিলেন। ছবি হিসেবে সেসব কতটা উতরেছে, সে তর্ক আপাতত মুলতবি রেখে বলতেই হয়, পুরাণকাঠামোর মনোগঠন তিনি আমৃত্যু ধারণ করেছেন।
মন্দার : বিষাদ অববাহিকা
গণেশ পাইন আসতেন কবিরাজ রো থেকে সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ পেরিয়ে ট্রপিকালের পাশ দিয়ে একটু এগিয়ে বাঁ দিকে মোড় নিয়ে প্যারী সরকার স্ট্রিট ধরে কলেজ স্ট্রিটে উঠে প্রেসিডেন্সি কলেজ পার হয়ে গ্লোব নার্সারির ফুটপাথের ছায়ায় ছায়ায় উত্তরদিকে। গেরুয়া পাঞ্জাবি, সাদা ধুতি। সদ্য পাটভাঙা যেন। ঠনঠনে কালীবাড়ি পেরিয়ে, সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ পেরিয়ে ২০৯ বিধান সরণি। মন্দার মল্লিকের স্টুডিয়োর ঠিকানা। এইখানে পলেস্তারা-খসা ইট-পাঁজুরে সিঁড়ির বাড়ি। স্টুডিয়োটা নেই আর। আসবাবও নেই। ঢের উঁচু সিলিংয়ের শূন্যতায় ঝুলন্ত পাখা বড় একা। বিষাদ অববাহিকা যেন। এইখানে গণেশ পাইনের টেবিল-চেয়ার, ছবি আঁকার লাজুক সরঞ্জাম, জানালার কাছে টুলের ওপর কুঁজো। মন্দার মল্লিক তাঁকে এই ঘরে বসবার, ছবি আঁকবার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। অ্যানিমেশন ফিল্মের কাজ শিখেছিলেন তরুণ গণেশ পাইন; যদিও তাতে আর্থিক সুসার তেমন হয়নি। ঘনিষ্ঠ বন্ধু সৌরেন মিত্রকে লিখেছেন, ‘বড়ো শ্রমসাধ্য, সময়সাপেক্ষ আর ক্লান্তিকর কাজ এই animation!এত বছর ধরে প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা working desk-এর কাঁচের নীচে আলো রেখে কাজ করে আমার চোখ দুটোর ক্ষতিই হোয়েছে, পেট কিংবা মন কিছুই ভরেনি। এখন animation করতে হবে ভাবলেই গায়ে জ্বর আসে।’ পূর্ণেন্দু পত্রী প্রস্তাব দিয়েছিলেন মহাভারতের অ্যানিমেশন করার। রাজি হননি গণেশ পাইন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা শ্রমের কথা ভেবেই। মন্দারবাবু নেই। স্টুডিয়ো নেই। কয়েকজন পুরনো বন্ধু, যাঁদের গণেশ পাইন শ্রদ্ধা করতেন, ভালোবাসতেন, তাঁদের একজন সৌরেন মিত্রকে লিখছেন, ‘ভেবেছিলাম মন্দারবাবুর সঙ্গে সঙ্গেই আমাকে এখান থেকে পাততাড়ি গোটাতে হবে। আপাততঃ সেটা পারা গেল না। ওঁদের ইচ্ছেয় আরো কিছুদিন আমাকে আসতে হোচ্ছে নিয়মিত। স্টুডিয়োর ভবিষ্যৎ নির্ধারিত না হওয়া পর্য্যন্ত আমার ছুটি নেই।’ (৭ জুলাই ১৯৭৮) এখানে থাকেন বর্ষীয়সী ছায়াদি। মন্দারবাবুর আত্মীয়া। বিষাদ অববাহিকায় বসে শিল্পী রচনা করেন ইতিহাসের অতীত চিরকালীন ইতিহাসের প্রতিমা। রেখায় রেখায় জন্ম নেয় মিথের পৃথিবী, দৈনন্দিনের সঙ্গে আপাত সম্পর্কহীন নিত্যসত্যের পৃথিবী, গণেশ পাইনের পৃথিবী। বাঁ দিকের জানালায় উলটোদিকের ফুটপাথে বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্রাবাস। বাস-ট্রামের শব্দ আসে। জানালা দিয়ে আলো আসে। প্রভূত আলো। ঘরের মাঝামাঝি গিয়ে সেই আলো থেমে যায়। তারপর, ঠিক অন্ধকার নয়, ছায়া ছায়া, অন্ধকারের প্রচ্ছদ যেন, গূঢ় আঁধারভূমির ছায়াকপাট যেন।
এই ঘরে একদিন ব্যস্ততা ছিল, সৃজনের ব্যস্ততা, মুখরতা ছিল, নতুন নতুন ভাবনার মুখরতা, উত্তেজনা ছিল অ্যানিমেশন ফিল্ম নিয়ে উচ্চাশী পরিকল্পনার। এখন সে-সবই বিগত, প্রস্থিত। ছায়াদি যেন তার ভাঙাচোরা ছায়া। তিনি স্টোভে চা করেন। কেরোসিন তেলের গন্ধ আসে। জানালার আলো যেখানে কিঞ্চিৎ যায়, সেইখানে বিবর্ণ গেরস্তালির আগুন জ্বলে, চামচের শব্দ ম্লান হাসির মতো জেগেই মিলিয়ে যায়। ৯ জুলাই ১৯৮৬-তে বন্ধু সৌরেনকে লেখা চিঠিতে জানাচ্ছেন, ‘মন্দার স্টুডিয়োর পাট হঠাৎই উঠে গেল। জায়গাটার সঙ্গে গত পঁচিশ বছরের পরিচয়। সে সবে জলাঞ্জলি দিয়ে এখন একান্তই গৃহবাসী। গুহাবাসীও বলতে পারো।’ পাট উঠেছিল এক অপ্রীতিকর ঘটনায়, যা গণেশ পাইনকে ভীষণভাবে আহত করেছিল।
চাকরি : প্রত্যাশা ও প্রত্যাখ্যান
গণেশ পাইনের পাঞ্জাবির ভাঁজ নষ্ট হয় না কেন? চাকরি করতে হয় না বলে। গণেশ পাইনের পাঞ্জাবি ঘামে ভেজে না কেন? বাসে উঠতে হয় না বলে। কেন চাকরি করতে হয় না, বাসে উঠতে হয় না? আরে, যোগ্যতা না থাকলে চাকরি হবে কী করে? হাওড়া জেলা স্কুলে, বারাসতের একটি স্কুলে এবং আরো কয়েকটিতে ড্রয়িং টিচারের শূন্যপদে অ্যাপ্লাই করেছেন। চাকরি হয়নি। উহভার্স সার্ভিস সেন্টার, স্টেটসম্যানের পাবলিসিটি ডিপার্টমেন্টেও চাকরির আবেদন করেছেন। হয়নি। গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের অ্যাসিস্টান্ট লেকচারার পদে, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার পদে ইন্টারভিউ দিয়েছেন। হয়নি। অযোগ্য প্রমাণিত হয়ে ফিরে এসেছেন সব দরজা থেকে। অনেক জায়গায়ই ফিরে আসার পেছনে কারচুপি ছিল। সে-ব্যাপারে কোনো বিরূপ মন্তব্য কখনো করবেন না আপনি। তবে সেই সব কারচুপি মিথের আশ্রয়ে ছবি হয়ে যায় মানুষের অন্তর্নিহিত মৌলিক রিপুপ্রবণতার। শ্যামল দত্তরায় ঠোঁটকাটা মানুষ। ফট করে বলে দেবেন, ‘একবার গণেশ (পাইন), সনৎ (কর), রবীন (মণ্ডল) ও আমি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদের জন্য ইন্টারভিউ দিতে গেছি। ইন্টারভিউ বোর্ডে ছিলেন ধীরেন মিত্র, রমা চৌধুরী এবং বিশেষজ্ঞ হিসেবে পূর্ণ চক্রবর্তী। নিচে দেখি পোস্টার : ‘ইন্টারভিউয়ের নামে প্রহসন কেন?’ একজনকে নাকি কর্তৃপক্ষ আগেই ঠিক করে রেখেছে। ইন্টারভিউ নিয়ে দেখানো হবে আমরা অযোগ্য। আমি তো পূর্ণবাবুকে বলেই ফেললাম, কী দরকার খামোকা জিজ্ঞাসা করে? ক্যান্ডিডেট তো ঠিক হয়েই আছে। সেদিন আমরা ব্যাপারটা সেলিব্রেট করেছিলাম চিৎপুরের রয়্যাল-এ চাঁপ খেয়ে। কারচুপি ও তজ্জনিত ব্যর্থতার সেলিব্রেশন!’ তো চাকরি না হলে পাঞ্জাবির ভাঁজ নষ্ট হয় কীভাবে? অবশ্য, গণেশদা পরে রবীন্দ্রভারতীর চাকরির প্রস্তাবটা ফিরিয়ে দেন কোমল দৃঢ়তায়। বলেছিলেন, একটা রিগ্রেট লেটার লিখে দেবে? কোনোদিন লিখিনি তো। চালু বয়ানটা একটু কর্কশ। নরম হতে পারে না কি? তখন গণেশদা পায়ের তলায় মাটি পেয়ে গেছেন। ক্যারমের ঘুঁটির লেবেল, সাবানের মোড়কের লেবেল, কন্টেইনারের ওপর ডিজাইন, হিন্দি ম্যাগাজিনে ইলাস্ট্রেশন, বইয়ের জ্যাকেট, বুক ইলাস্ট্রেশন ইত্যাদি খুচরো কাজের বিনিময়ে অনিশ্চয়তাপূর্ণ জীবনধারণ পর্বটা কাটিয়ে এসেছেন। কেশোরাম রেয়নে টেক্সটাইল ডিজাইনারের চাকরিটা কিন্তু পাকা হয়ে গিয়েছিল। এক কর্তা তাঁকে বললেন, মিলের চাকরি যামিনী রায়দের জন্য নয়। সেই কর্তা তাঁকে চিনেছিলেন। অথচ যাঁরা শিক্ষা-সংস্কৃতি নিয়ে কারবার করেন, স্কুল-কলেজ থেকে প্রকাশনা, যে-ধরনের কাজে যুক্ত থাকার সুবাদে বাঙালি মধ্যবিত্ত পারফিউমড অহমিকা নিয়ে বাঁচে, তাঁরা কী অন্ধতায় বাতিল জনগোষ্ঠীতে তাঁকে ফেলে দিয়েছিলেন! ইলাস্ট্রেশনের পারিশ্রমিক আনতে গিয়ে ‘আজ নয়, আর-একদিন আসুন’ শুনে চলে আসতে হয়েছে। এ তো ‘মাপ করো’ বা ‘আগে দেখো’ বলে ভিখিরি তাড়ানোর মতো। অথচ এঁরাই তাঁর ইলাস্ট্রেশন কোনোদিন যদি কাজে লাগে বুঝে বা না বুঝে জমিয়ে রেখে পরে নিলামে পাঠিয়ে প্রচুর অর্থাগম ঘটিয়েছেন।
কিশোরপ্রতিমা
তাকে কি আর কোনোদিন দেখেছেন, যে আপনাকে কারুবাসনায় বাঁচতে প্রবুদ্ধ করেছিল? শিল্পের জন্য বাঁচার পথনির্দেশ দিয়েছিল নিজের অজান্তে। জিজ্ঞেস করেছিলাম একদিন কথায় কথায়। ঘটনাটা বোধ হয় আগে বলা দরকার।
একরত্তি ছেলে। কুলিকামিনের ঘরের হয়তো। বাসে ওদের সঙ্গে চলেছিল কোথাও। হয়তো কাজের খোঁজে। গণেশ পাইনও চলেছেন কাজের খোঁজে। তাঁর কাজটাকে বলা হবে চাকরি। আর ওদেরটাকে কুলিগিরি বা রোজ খাটা। বা অন্য কোনো চিহ্ন। গণেশদার ব্যাগে ডিপ্লোমা, অ্যাকাডেমিক কাগজপত্র। কেশোরাম রেয়নে টেক্সটাইল ডিজাইনারের চাকরিটা পাকা হবার পথে। কাগজপত্র দেখালেই নিয়োগপত্র এসে যাবে। চাকরি চেয়ে দরজায় দরজায় ঘোরা ও ফিরে আসার দিন শেষ হবে। মাস গেলে একটা নিশ্চিন্ত আয়।
সব কিছু ভণ্ডুল করে দিল সেই পুঁচকে ছেলেটা। গণেশ পাইন লক্ষ করলেন, ছেলেটা হাত দিয়ে বুকপকেট চেপে বসে আছে। মাঝে মাঝে দেখে নিচ্ছে পকেটে রক্ষিত বস্তুটি। কিন্তু হাত নামাচ্ছে না। বাস থেকে নামার সময় তিনি কৌতূহলবশত ঝুঁকে দেখেন ওর পকেটে একটা শিঙাড়া। বোধোদয় ঘটিয়ে দিল সেই ছেলে। সে বাস থেকে নেমে, একটু একান্ত হলে, ধীরেসুস্থে শিঙাড়া খাবে। সেই সময়ের জন্য আগলে বসে আছে। গণেশ পাইন ভাবলেন, এই কিশোর নিজের জগৎ আগলে রাখতে পারে। আর আমি কিনা সেটা বিসর্জন দিতে চলেছি। আমার ছবি আঁকার আগ্রহ এভাবে আগলে রাখতে পারি না! আমার নিজের জগৎ আমার হাতে রাখতে পারি না! ছিঁড়ে ফেললাম সমস্ত ডিপ্লোমা, সার্টিফিকেট।
গণেশদা হাসেন। জবাব দেন না। জবাবটা পেয়ে যাই হাসিতে। সেই কিশোরকে আর খুঁজতে হয় না। পুরাণপ্রতিমা হয়ে গেছে।
পলাকাটা হিরে
এক রাতে প্যারী সরকার স্ট্রিট ধরে ফেরার পথে গণেশ পাইন বলেছিলেন। তারিখটা মনে নেই। নোটবইয়ে ভরসা রেখে বলতে পারি।
আপনি হাঁটতে হাঁটতে সেদিন বললেন, ১৯৬৭ সাল নাগাদ। ওই যখন নকশালবাড়ি আন্দোলন ঝড় তুলতে চাইছে, আমার মধ্যেও নিজের কাজ নিয়ে সংশয় তৈরি হচ্ছে। জীবনের জন্য শিল্প, নিপীড়িত মানুষের জন্য শিল্প ইত্যাদি সংজ্ঞা ভাবাচ্ছে। কয়েকজন তরুণ এলেন কথা বলতে। ওঁরা আমাকে বোঝালেন শিল্পের সামাজিক উপযোগিতা। বললেন, একদিন চলুন এক দাদার সঙ্গে আলোচনা করবেন। গেলাম। খানিকটা গোপনে, এ পথ সে পথ ঘুরে। ‘দাদা’ ভদ্রলোককে বোধ হয় পুলিশ খুঁজছে। ভদ্রলোক যা বললেন, তাতে নতুন তেমন কিছু ছিল না। ফলে সংশয় থেকেই যায়। এমন সময় হাতে পেলাম ‘নেসেসিটি অব আর্ট’। সব প্রশ্ন সংশয় সমাধান পেয়ে গেল। সেখানে অনেক বিশদভাবেই বলা আছে, শিল্পীর কাজ কী? আমি শুধু এই উদাহরণটাই তোমাকে দেব, শিল্পী তাঁর মনটাকে পলাকাটা হিরের মতো প্রস্তুত করবেন। যা পৃথিবীর সমস্ত কোণ থেকে আলো গ্রহণ করে নিজের অভ্যন্তরের কেন্দ্রীয় বিন্দু থেকে তা বিকিরিত করতে থাকে।
আর-একটা ঘটনা বললেন সম্ভবত কবিরাজ রো-র বাড়িতে। নীরদ মজুমদার আপনাকে ভীষণ ভালোবাসতেন, আবার সমালোচনাও করতেন। একটি প্রদর্শনী দেখতে গিয়েছেন নীরদবাবুর। ‘সমাজসচেতন ছবি’ যাকে বলে তেমন কিছু – ডাস্টবিনে কাকেদের চিৎকার, ফুটপাথে ভিখিরির দল এইসব। ছবি দেখে বেরিয়ে আসার সময় দরজা আগলে দাঁড়ালেন নীরদ মজুমদার। চোখ লাল। বললেন, ভালো লাগেনি নিশ্চয়? আপনি বলেছিলেন, এই ছবি আঁকার জন্য অনেকে আছেন। নীরদদাকে কেন আঁকতে হয়? একটু হেসে নীরদবাবু বললেন, দিলাম এঁকে। ‘নীরদদা, জীবন নিয়ে ছবি আঁকুন’ বলে অনেক দিন ধরে জ্বালাচ্ছিল!
প্যারী সরকার স্ট্রিট যেখানে কলেজ স্ট্রিটে পড়েছে, সেই মোহনায়, একদিকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যদিকে হেয়ার স্কুল একদল তেজী যুবা সমাজ বদলে দেবেন বলে লিটল ম্যাগাজিনের স্টল খুলেছিলেন। তাঁদের চলা, কথা বলার মধ্যে গরাণহাটার ফুল পঞ্জিকার পাতা যেন উড়তে থাকে। যেন বলা হয়, আর তো মাত্র কটা দিন, পচাগলা সমাজটা ধসে পড়বে অমুক তারিখ। মানুষের দুঃখকষ্ট যাদের ছবিতে ছাপ ফেলে না, বড়লোকের ড্রয়িংরুম সাজানোর জন্য যারা মায়াবী ছবি বানায়, তাদের সময় ঘনিয়ে এসেছে। ওই পথ দিয়ে আসতেন গণেশ পাইন। তাঁরা টার্গেট করেছিলেন এই মানুষটিকে। মুখ ঘুরিয়ে আওয়াজ দিতেন, ‘অ্যাই গন্শা!’ মুখোমুখি হওয়ার সাহস ছিল না তাঁদের, তেজী যুবাদের।
পরিপার্শ্ব : গণেশ ও বিকাশ
কবিরাজ রো থেকে বিধান সরণির মন্দার মল্লিকের স্টুডিয়ো পর্যন্ত মধ্য কলকাতার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষের জীবন ছিল তাঁর আশৈশব পড়শি। সে অঞ্চল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ধর্মতলার আশপাশেও। দেখেছেন দুস্থ জীর্ণ অসহায় মানুষের জীবনধারণ। বস্তিতে, ফুটপাথে, মেডিকেলের আকাশের নিচে পৃথিবীতে। প্রতিকারহীন বঞ্চনা আর অন্তহীন প্রতারণা যেন তাদের নিয়তি। তাদের জীবনচর্যার প্রান্তিকতাই কি তাঁর ছবিতে এত অন্ধকার মেলে ধরে? তাদের প্রাত্যহিকে নিহিত স্বাভাবিক কিন্তু অস্পষ্ট সংগ্রামই কি তাঁর ছবিতে একাধিক অনির্দিষ্ট আলোর উৎসব হয়ে ওঠে? লোকজ উপাদানই তাঁর পুরাণভাবনার স্পর্শে ধ্র“পদী রূপ পায়? ঘনিষ্ঠ বন্ধু সৌরেন মিত্রকে বলেছেন, রোজের এই আমি, পথ চলতে চলতে যখন যা কুড়িয়ে পেয়েছি, তাকেই আপন চেতনার রঙে রাঙিয়েছি। বিষাদ নয়, মায়াবী ভাবনায়। আবার, এই প্রতিবেদকের সঙ্গে এক কথোপকথনে তিনি নরেন্দ্রনাথ মিত্রের গল্প উদ্ধৃত করে বলেন, আমাদের হাতে একটাই শাবল, দুঃখের শাবল। অবক্ষয়ের সৌন্দর্যে আমরা কি মোহিত হয়ে থাকি? আমরা কি দুঃখবাদী? প্রশ্নটা আমাদেরও। গণেশ পাইনের চারপাশে নিরালোক নির্বিণœ শত শত মুখ ও কথা, শত শত প্রান্তিক দিনাতিপাত। তাঁর ছবি কি এতটা নিরপেক্ষ উদাসীন থাকতে পারে পরিপার্শ্ব থেকে? বেশ কিছু ছবি দেখতে দেখতে এসব কথা মনে এলো। এভাবে কি তাঁর ছবি নিয়ে ভাবা যেতে পারে? বিশেষজ্ঞরা তাঁর ছবির টেকনিক নিয়ে অনেক কথা বলেছেন, বলবেন। বিষয়ভাবনার দিক থেকে তাঁর প্রান্তিক পরিপার্শ্বের গ্লানিমা কি কোনো জায়গা দাবি করে না? পরিপার্শ্বই কি তাঁর চেতনার রঙে হয়ে ওঠে না পুরাণ? ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৮৩ তিনি সৌরেন মিত্রকে যে চিঠি লেখেন, সেটা আমরা কীভাবে ব্যাখ্যা করব? তিনি লিখেছেন, ‘ভেবে চিন্তে মনে হোয়েছে প্রথম বয়সের সেই গুহাবাস, নিজের মনগড়া জগতে অনবরত পদচারণা আমাকে অধিকার করে রাখতে চেয়েছে বরাবর। নির্জন করে রেখেছে আমায়। আজ, এখন জনারণ্যে লোপাট হয়ে যেতে যেতে বুঝতে পারছি নির্জনতা এক নীলবর্ণ পতঙ্গ, সোনালী পাখনা তার। সে সুনয়ন কিন্তু দৃষ্টিহীন। চীৎকারের আগুনে তার পাখা পোড়ে। যতো পোড়ে ততোই সে দেখতে পায়, চক্ষুষ্মান হয়, আর নিরীক্ষণের যন্ত্রণা ভোগ করে আমৃত্যু।’ বিকাশ ভট্টাচার্যের সঙ্গে গণেশ পাইনের এইখানটায় মিল ছিল। প্রথমজন উত্তর কলকাতার প্রান্তিক জীবন ছবিতে ধরেছেন বলতে গেলে পরিবেশের পোস্টাল অ্যাড্রেস সমেত, চরিত্রদের রেশন কার্ড ও পেশাপরিচিতি সমেত। এর বাইরেও বেশ কিছু ছবি থাকলেও বিকাশ ভট্টাচার্য প্রধানত উত্তর কলকাতার শিল্পী-রূপকার হয়ে আছেন। গণেশ পাইন কি মধ্য কলকাতার? যদিও তাঁর ছবি সেভাবে শনাক্ত করা যাবে না করণকৌশল থেকে। গণেশ হালুই বলেছেন, গণেশ পাইনের ছবি সম্মোহিত করে। ঠিক কথা। তাঁর নির্মিতির সূক্ষ্মতা, আলোক-অনালোকের বয়ন, চিহ্নহীন কালের ধূসরতা এবং একটা আচ্ছন্ন গল্পের কুহক আমাদের আপ্লুত করে, আবিষ্ট করে। তুলনায় বিকাশ ভট্টাচার্য প্রত্যক্ষ, সাল-তারিখ-ঠিকানা চিহ্নিত প্রতিবেদনের মতো। বিকাশের ছবিতেও মরবিডিটি আছে। তার প্রভাব বুদ্ধির এলাকায়। গণেশের মরবিডিটি বুকের ভেতরটা কেবলই মুচড়ে দেয়। দুজনেরই আহরণ পরিপার্শ্ব থেকে, দুজনে দুরকম মনোভঙ্গির ভিন্নতায়।
২৭ অক্টোবর, ১৯৯৫, শুক্রবার, আমার নোটবইয়ে তারিখটা লেখা আছে, গণেশ পাইনের বাড়িতে (সম্ভবত ‘দক্ষিণী’র বারান্দায়) লম্বা কথোপকথন হয়েছিল। তিনি একটি ঘটনার কথা বলেছিলেন। পরিচিত কারো অভিজ্ঞতা। একটা ইঁদুর ধরা পড়েছে। ধেড়ে ইুঁদুর। সেটাকে খাঁচা থেকে ছেড়ে দিয়ে একদল ছেলে প্রচণ্ড আক্রোশে ইট মারছে। আর চিৎকার করছে। তারা উন্মাদ হয়ে গেছে। ইঁদুরটা ছুটে পালাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। আহত রক্তাক্ত হয়ে ছটফট করতে থাকে। ছেলের দলের উল্লাস মাত্রাছাড়া হয়। যেন বিজয় উৎসব! হঠাৎ এক বৃদ্ধ ছুটে এসে ছেলের দলের মাঝখানে বসে পড়লেন। বললেন, আমাকে মারো। আমার আরো বেশি যন্ত্রণা হবে। আমার রক্ত আরো বেশি। তোমাদের আরো বেশি আনন্দ হবে।
আজ মনে নেই, কোন প্রসঙ্গে বলেছিলেন। নোটবইয়ে কিছু লেখা নেই। হয়তো সাধারণ মানুষের স্বভাববর্তী হিংসা-জিঘাংসা, ক্রূরতা-নিষ্ঠুরতা, দুর্বলের প্রতি অত্যাচারস্পৃহা এবং বিবেকের অভাবের কথা বলতে চেয়েছিলেন। বালকের দলের রক্তে নৃশংসতার উত্তরাধিকারের দিকে আঙুল তুলতে চেয়েছিলেন। স্পষ্ট বুঝিনি। নোটবই খুলে পড়তে পড়তে মধ্যবর্তী ফাঁকা লাইনে মধ্য কলকাতার কোনো গলিতে এই উল্লাস, এই নৃশংসতার ছবি যেন দেখে ফেলি। যেসব গলিতে সারারাত ইঁদুরেরা রাস্তা পারাপার করে, খেলা করে, লীলা করে, যেসব গলিতে নির্জন দুপুরে নর্দমার পাইপ বেয়ে চারতলা/পাঁচতলার সংসারে হানা দেয়, যেসব গলির ইঁদুরেরা বেশ হিংস্র আক্রমণাত্মক এবং অতিকায়, বেড়ালও ভয় পায়, মধ্যকলকাতা জুড়ে আছে এই অলিগলি। গণেশ পাইন এই অপরিচ্ছন্ন অবহেলিত অবক্ষয়িত অঞ্চলের প্রত্যহের পদাতিক।
চিঠি, জবাব
একটা চিঠি লিখেছিলাম গণেশ পাইনকে – জীবনের সত্য, শিল্পের সত্য ইত্যাদি নিয়ে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘চাঁদের অমাবস্যা’ থেকে একটি খুনের দৃশ্য উদ্ধৃত করে। যুবক শিক্ষক খুনটা দেখেছিল, কিন্তু সে প্রাণপণে নিজের কাছেই সেই দেখাটা অস্বীকার করতে চাইছে। কারণ দেখাটা ঠিক হলে যুবকের অস্তিত্ব গভীর সংকটে পড়বে।
আমার চিঠিটা এই : যুবক শিক্ষক জ্যান্ত মুরগি-মুখে তামাটে রঙের শেয়াল দেখেছে, বুনো বেড়ালের রক্তাক্ত মুখ দেখেছে, মানুষের দুঃখকষ্ট মহামারী দেখেছে, কিন্তু কখনো বিজন রাতে বাঁশঝাড়ের মধ্যে যুবতী নারীর মৃতদেহ দেখে নাই। হত্যাকারী দেখে নাই। সে ছুটতেই থাকে।
শ্রদ্ধেয় গণেশদা,
চিঠিটা শুরু করলাম প্রবন্ধের মতো। দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিয়ে। কেউ না বললেও আমি চিঠিই বলব। কারণ আমরা, এই সময়ের আমরা যারা কিছু সত্য কথা বলতে চাই, শুধু চিঠিই লিখতে পারি। আর কিছুই পারি না। যদি পারি তা যে লেখা নয়, সত্য নয়। একজন লেখক হয়তো সারা জীবন একটাই চিঠি লিখে যান। আমি অবশ্যই তাঁদের শত যোজনের মধ্যে নিজেকে হাজির করার দাবি করি না। অতিদূর থেকে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধায় মুগ্ধতায় আপ্লুত হতে থাকি। এইরকম একজন লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। তাঁর বইগুলো আমার কাছে লেখা চিঠি বলে মনে হয়। … ‘হত্যাকারী না-দেখা’ যে যুবক শিক্ষক ছুটছে, তার গতি অবিকলভাবে আমার পায়েও। পলায়নেরও একটা গতি থাকে। সে গতির নামও বোধ হয় জীবন। একদিন বিশ্বাস করেছিলাম মানুষই শেষ কথা। মানুষের হাতেই সব সমস্যার সমাধান। প্রান্ত-যৌবনে বিশ্বাস ভাঙতে থাকে। বুঝি মানুষ কিছুই নয়। মানুষ শুধুই কষ্ট দুঃখ লাঞ্ছনা পাওয়ার জন্য। বড় অসহায়। যারা পালাতে পারে, তারা দাপটে বাঁচে। পালানোটা দু রকম : মানুষকে মানুষ জ্ঞান না করে তার ঘাড়ে কায়েম হওয়া। আর, মানুষ থেকে দূরে সরে যাওয়া। প্রথম পালানোটা সবার হয় না। দ্বিতীয়টা অনেকে পারে। আমিও পারি। তবু কেন দাপটে বাঁচা যায় না? তবু কেন মানুষের মুন্ডু নিয়ে কিছু মন্ত্রসিদ্ধ পুরুষের গেণ্ডুলীলা তাকে বিব্রত করে? পলায়নের গতির মধ্যে জীবনের আস্বাদ কেন সে পায় না? অথচ তার যে অন্য কোনো উপায় নেই। …
এলোমেলো অনেক কথা লিখে হয়ত বিরক্ত করলাম। একটু ভাবতে গেলেই এরকম হয়ে যায়। আধা-খ্যাচড়া যা লিখছি, তাতেও এসব ভাবনা।
অপেক্ষা করব, আপনার কাজের সময় থেকে দু-একটা কুচি বের করে জবাব আসবে।
ইতি মধুময়
২.১২.৯৪
পুনশ্চ : অফিসের ঠিকানাটাই দিলাম। ভদ্রেশ্বরের বাড়িতে পৌঁছতে কখনো একমাস লেগে যায়।
গণেশ পাইন জবাব দিলেন ১৬ ডিসেম্বর ৯৪।
প্রিয় মধুময়,
চিঠি পেয়েছি। যে ডাকঘর ভদ্রেশ্বরে সে ডাকঘরের ওপর তোমার একটুও আস্থা নেই দেখছি। তাই ঠিকানা : আজকাল। কোন কাগজে যেন খবর পড়েছিলুম – জেরুজালেমের ডাকঘরগুলোয় হাজার হাজার চিঠি পড়ে রয়েছে, বিলি করা যাচ্ছে না। চিঠিগুলো নাকি ভগবানকে লেখা। চিঠিগুলো ছাপা হলে বেশ হত, মানুষের সদর অন্দরের অনেক সত্যি কথা জানা যেত। তোমার সারা জীবন একটাই চিঠি লিখে যাওয়ার ধারণাটা ভালো লাগল। ওয়ালীউল্লাহ সাহেবের ‘চাঁদের অমাবস্যা’ আদতে হয়ত চিঠিই। আর একটা গুরুতর কথা লিখেছ – চিঠি ছাড়া আর যা লেখালেখি তা সত্য নয়। গোলমাল তো এখানেই। শিল্পের শতেক শর্তের চাপে সত্য তখন দুমড়ে মুচড়ে যায়। সেদিক থেকে শিল্পকে সত্যের হাত ছাড়িয়ে পালানোর ফিকির হিসেবে ধরা যেতে পারে, কী বলো? পালানোর কথাও লিখেছ, দুরন্ত গতিতে পালানোর কথা! অবিকল ওই যুবক শিক্ষকের মত। লিখেছ ‘পলায়নেরও একটা গতি থাকে, সে গতির নামও জীবন।’ কিন্তু পালিয়ে দাপটে বাঁচা। তার কোনো নমুনা দেখেছ কি? তন্ন তন্ন করে দেখেছ? যদি দেখে থাকো, জানিয়ো। জীবন কখনো জীবিতকে তুলোর বাক্সে শুইয়ে রাখে না, মারে আর কতটা আঘাতসহ হয়েছে তা পরখ করে দেখে নেয় প্রত্যহ। ব্যস – আর না। এর পর আপ্তবাক্যের ফোয়ারা ছোটার সম্ভাবনা। আসলে চিঠি যত ঘরোয়া হয় ততই মঙ্গল, না হলে চিঠির জাত থাকে না। মনে পড়ে সেই Soda Fountain-এর যুগে অসাধারণ এক বন্ধু পেয়েছিলুম, ইন্দ্রজিৎ বসু। তাকে যত লিখতুম ‘কেমন আছেন’ ইত্যাদি, ততই জবাবে কখনো সে বিবৃত করত সরস্বতী নদীর ইতিহাস, কখনো Quantum Mechanics-এর গূঢ় তত্ত্ব। এ হেন লোকেদের দয়াধর্ম কিছু থাকে না! তুমি নিশ্চয় তেমন নও। অতএব চিঠি দিয়ো।
শুভার্থী
গণেশ