মৃ ণা ল ঘো ষ
গণেশ পাইন প্রয়াত হয়েছেন ১২ মার্চ ২০১৩ তারিখে। এর চার-পাঁচ মাস পরে একদিন হঠাৎই তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়ে গেল। আমি কল্পনায় তাঁর উপস্থিতি খুব অনুভব করলাম। ঘটনাটি ঘটেছিল একটি সিনেমার সূত্রে। নন্দনের পাশ দিয়ে যাচ্ছি, তখন বিকেল চারটে বাজতে মিনিট দশেক বাকি। একটি ছোট বিজ্ঞপ্তি দেখলাম, ফেলিনির লা দোলচে ভিটা সিনেমাটি দেখানো হবে নন্দন-২ প্রেক্ষাগৃহে সেদিনই বিকেল চারটেয়। ছবিটি আমার দেখা হয়ে ওঠেনি আগে। সেজন্য মনে মনে একটু লজ্জিতই ছিলাম। অন্য কাজ ছিল সেদিন। সেটা বাতিল করে সিনেমাটিই দেখব ঠিক করলাম। হলে ঢুকে পড়লাম। হল তখন অন্ধকার হয়ে গেছে। একটা আসন নিয়ে বসে গেলাম। ছবি শুরু হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গেই।
লা দোলচে ভিটার সঙ্গে গণেশ পাইনের কিছু অনুষঙ্গ জড়িয়ে ছিল আমার মনে। ১৯৬০-এর দশকে তিনি এই ছবিটি দেখেছিলেন। এর একটি দৃশ্য তাঁকে একটি ছবি আঁকতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। দৃশ্যটি হচ্ছে ফোয়ারার দৃশ্য। ফোয়ারার জলে ছবির নায়িকা ম্লান করছেন। এরকম একটি দৃশ্য অনেকক্ষণ ধরে দেখানো হয়েছে। এই দৃশ্য থেকে তাঁর মনে একটি প্রতিমাকল্পের জন্ম হয়েছিল। তা থেকে তিনি অন্তত দুটি ছবি এঁকেছিলেন। দুটি ছবির কথা আমার জানা আছে। হয়তো আরো দু-একটি থাকতে পারে। পুরাণকল্প বা মিথ অনেক সময়ই তাঁর ছবির প্রধান এক অবলম্বন বা ভিত্তি হয়ে ওঠে। লা দোলচে ভিটার সেই ফোয়ারায় স্নানের দৃশ্যটিতে সে অর্থে কোনো পৌরাণিক ঘটনা বা চরিত্র নেই। অথচ এই প্রতিমাকল্পেই তিনি যেভাবে পুরাণকল্প আরোপ করলেন, তাতে অতীত ও বর্তমান, কল্পনা ও বাস্তবের সঙ্গে তাঁর নিজের তৈরি করা এক সম্পর্কের আভাস পাওয়া যায়। তাঁর ছবির এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য উদ্ভাসিত হয়।
আমরা তাঁর ‘ফাউনটেন’ বা ফোয়ারা-ভিত্তিক দুটি ছবি প্রথমে একটু দেখার চেষ্টা করব। প্রথম ছবিটি ১৯৬৭ সালে আঁকা কালি ও ওয়াশ মাধ্যমে। শিরোনাম : ‘দ্য ফাউনটেন’। একটি ফোয়ারা থেকে জল উৎক্ষিপ্ত হচ্ছে। চারপাশের পরিসরে সঞ্চিত হচ্ছে সেই জল। সেই সঞ্চিত জলই আবার হয়ে উঠছে ফোয়ারার জলধারা উৎক্ষেপণের উৎস। সেই সঞ্চিত জলে কোমর অব্দি ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক সালংকারা মানবী। তাঁর চেহারায় দেবী ও মানবী এই দুই রূপের সমাহার। অর্থাৎ বাস্তবের মধ্যেই পুরাণকল্প আরোপিত হয়েছে এখানে। ছবিটির ডান পাশে ওপরের কোণে পূর্ণ চাঁদের আভাস। সেই চাঁদকে ঘিরেও রয়েছে অন্ধকারের আবরণ। আলো-ছায়ার এই রহস্যময় দ্বৈত আবৃত করেছে ছবির সমগ্র পরিমণ্ডল। এই রহস্যময়তা গণেশ পাইনের ছবির একটি বৈশিষ্ট্য।
দ্বিতীয় ছবিটির শিরোনাম ‘বিফোর দ্য ফাউনটেন’। ১৯৯১ সালে আঁকা ক্যানভাসের ওপরে টেম্পারা মাধ্যমে। ছবিটি বহুমাত্রিক। চিত্রক্ষেত্রের মাঝখানে অবস্থান করছে ফোয়ারাটি। সেটি যেন বিভিন্ন অস্থির সমন্বয়ে গড়া। উৎক্ষিপ্ত জলের সামান্য আভাস আছে। ফোয়ারার পাশে পক্ষীরূপী এক মনুষ্য মূর্তির অবস্থান দেখি আমরা। তার ডানাদুটি উত্তোলিত। শরীরের অভ্যন্তরে পঞ্জরাস্থি স্পষ্ট প্রতীয়মান। পক্ষীরূপী মানুষটি ফোয়ারার দণ্ডের দিকে তাকিয়ে আছে বিষণœ নয়নে। অতীত থেকে সে বর্তমানে এসেছে। যেন এক হারানো অস্তিত্ব বা স্বদেশ খুঁজছে। মৃত্যু-অতিক্রান্ত জীবনের অভীপ্সা সমগ্র ছবিটি জুড়ে। শিল্পীর রহস্যময় মনের প্রতিফলন স্পষ্ট অনুভব করা যায় ছবিটিতে।
এই ছবি ও তাতে পুরাণকল্পের আরোপ সম্পর্কে গণেশ পাইন বলেছিলেন পরবর্তী সময়ে বর্তমান লেখকের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে :
‘ফাউনটেন-এর ধারণাটা, ফাউনটেনকে একটা সিম্বল হিসেবে ভেবে নেওয়া, এটা খানিকটা আমি পেয়েছি ফেলিনির লা দোলচে ভিটা ছবিতে। এবং সেটা মনে হয়েছে ফাউনটেন-এ জলের যে সোর্স একটাই এবং সেই জলটাই উৎক্ষিপ্ত হয়, হয়ে ফিরে আসে, আবার জমা হয়, সেই জল আবার ওপরে ওঠে। এই সাইক্লিক অর্ডারটা – মেঘ থেকে বৃষ্টি, বৃষ্টি থেকে জল, জল থেকে বাষ্প এই অর্ডারটার কথা মনে হয়েছিল। এবং নারীকে মনে হয়েছিল এই সাইক্ল-এর পাশাপাশি রাখার উপযুক্ত। এবং ফিল্মটাতে ফেলিনি তাই করেছিলেন, যদিও তার সঙ্গে কাহিনীর যোগ ছিল। অর্থাৎ এই সিম্বলটা আমি একটা ফিল্ম থেকে আবিষ্কার করি, যদি এটাকে সিম্বল হিসেবে তাত্ত্বিকরা মেনে নেন।’
এই ফিল্ম সম্বন্ধে গণেশ পাইনের যে মুগ্ধতা ছিল একসময়, পরবর্তীকালে সেটা কেটে যায়। এটাও একটা রহস্য। তাঁর নিজের সৃজনশীলতা সম্পর্কে যেমন, তেমনি সামগ্রিকভাবে যে-কোনো শিল্পের প্রাথমিক উৎস সম্পর্কেও। এই ঘটনা থেকে আমরা তাঁর মনের কিছুটা আভাস পেতে পারি। ১৯৯৪-এর ২৪ ফেব্র“য়ারি আমাকে একটি চিঠিতে তিনি সে বছর ফিল্মোৎসবে দেখা নানা ফিল্ম সম্পর্কে কিছু কথা বলেছিলেন। তাতে এক জায়গায় লিখেছেন তিনি :
‘যে লা দোলচে ভিটা দু-আড়াই দশক আগে দেখে ধন্য হয়েছিলুম সেই ছবি আবার দেখলুম তীর্থদর্শনের মন নিয়ে। পুণ্যফল শূন্য। জানলুম ছবিটা আমি মনের মতো করে মনে মনে গড়ে রেখেছিলুম, সেটি এই লা দোলচে ভিটা নয়। অর্থাৎ ‘মন্দিরে তোর নাই যে মাধব, শাঁখ বাজিয়ে করলি গোল’। বয়সই বোধ হয় চেয়ারকে চেয়ার বলতে শেখায়। সুতরাং শিখছি।’
এই উক্তির মধ্যে আমরা গণেশ পাইনের নন্দনভাবনার একটা আভাস পাই। শিল্পের উৎস বাইরের জগৎ নয়। শিল্পীর চেতনা থেকেই উৎসারিত হয় প্রতিমাকল্প। বাস্তব সেখানে হয়তো একটি প্রস্থানবিন্দু হিসেবে কাজ করে।
এই ভাবনাটাই আরো অনুপুঙ্খভাবে পেয়েছিলাম তাঁর আর একটি চিঠিতে। শিল্পের সঙ্গে বাস্তবের বা প্রকৃতির সম্পর্ক ঠিক কেমন, তার কিছু আভাস উঠে এসেছিল। গণেশ পাইনের ছবির গভীরে প্রবেশ করতে হলে তাঁর এই ভাবনাটিকে বোঝা জরুরি। ৭ মে ১৯৯৫ তারিখের এক চিঠিতে তিনি আমাকে লিখেছিলেন :
‘মহামতি টার্নার নাকি একদা সায়াহ্নকালে সূর্যাস্তের ছবি আঁকছিলেন। ছবি সারা হতে দেখেন এক কৃষক নিবিষ্ট মনে তাঁর শিল্প দেখছেন। টার্নার শুধোলেন, ‘কেমন হয়েছে?’ কৃষক বললেন : ‘কিস্যু হয়নি। তোমার পটে ওই আশ্চর্য আলো নেই, নেই অমন পাগল করা রঙ।’ বিষণ্ন টার্নার বললেন, ‘ওই স্বর্গীয় প্যালেট আমায় দিতে পারো? যদি পারো তবে তোমাকে এঁকে দেখাই।’ আঁকা যায় না, তাই বোধ হয় প্রকৃতির সমান্তরালে অন্য এক প্রকৃতির প্রতিষ্ঠা আপনিই ঘটে যায়, যার নাম শিল্প। কৃত্রিম কিন্তু স্বনিয়ন্ত্রিত। প্রকৃতির সঙ্গে তার সম্পর্ক যুগপৎ প্রেমের এবং দ্বেষের।’
এই সূত্রেই এসেছে মানুষের দ্বৈতসত্তা, শিল্পে ‘ফ্যান্টাসি’ ও ‘অ্যাবসার্ডিটি’র কথা। চিঠির পরের অংশে তিনি লিখছেন :
‘রহস্যের যে কথা লিখেছেন অবশ্যই তা ঠিক। তবে মানুষ তো নিজেই মূর্তিমান রহস্য। আপনাকে জানার চেষ্টা তার শেষ হচ্ছে কই? সে হ’ল এক অভিশপ্ত প্রজাতি। সেদিন একটা তত্ত্ব নজরে পড়ল। বলা হচ্ছে সব মানুষই Schizophrenic! কেন? না – শিশু যখন ভাষার জগতে প্রবেশ করে, তখনই তার ব্যক্তিত্ব দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। নাম দিয়ে সে দুনিয়াকে চিনতে শেখে, শব্দ দিয়ে বাক্য দিয়ে ভাবনা, অনুভবকে প্রকাশ করতে শেখে তখন তার অভিজ্ঞতায় এতদিন যে নামহীন অথচ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, অনুভববেদ্য জগৎ বিরাজ করছিল তা বদলে যায়। বদলে যায় কিন্তু হারিয়ে যায় না। দুটো দুনিয়াই তার চেতনায় পাশাপাশি বেড়ে উঠতে থাকে। এখানেও সেই সমান্তরালের কথা এসে পড়ে। মানুষকে এই দ্বিস্তর অস্তিত্ব নিয়ে আমৃত্যু বাঁচতে হয়। তার কাজে ইচ্ছায় কল্পনায় স্বপ্নে ওই দুটি স্তরই ক্রিয়াশীল থাকে। ফ্যান্টাসি কিংবা অ্যাবসার্ডিটি-র সূচনা বোধহয় এখান থেকেই। মনোবিদরা অবশ্য বলেন ওই দুটি দুনিয়ার মাঝখানকার বেড়াটি ভেঙে গেলেই পাগলা গারদের দরজা খুলে যায়।’
এই উক্তি থেকে গণেশ পাইনের ধারণায় শিল্পের স্বরূপ ও উৎস সম্পর্কে তাৎপর্যপূর্ণ কিছু তথ্য পাওয়া যায়। ব্যক্তি গণেশ পাইন ও শিল্পী গণেশ পাইন – এই দুইয়ের মধ্যে সেতুস্বরূপ কাজ করে এই চিন্তা।
এই ভাবনার সমর্থন পাই তাঁর অন্য দু-একটি লেখাতেও। শিল্পচিন্তা নামে তাঁর চিঠির সংকলনমূলক একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ‘আনন্দ পাবলিশার্স’ থেকে। তাতে এক জায়গায় লিখছেন :
‘শিল্প বোধহয় জীবনসত্যের সমান্তরাল অন্যতর কোনো সত্যের ধারকভূমি। পলায়ন নয়, প্রতিফলনও নয়। প্রকৃতির দেওয়া ছ’টি যে ইন্দ্রিয় আমাদের, তাদের অতিক্রম করে আরও একটি ইন্দ্রিয় উদ্গত হয়, শিল্প বোধহয় সেই সপ্তম ইন্দ্রিয়ের নাম। জীবনের সঙ্গে জীবনাতীতের, সত্যের সঙ্গে মিথ্যার, আপাতের প্রত্যক্ষের সংঘর্ষে ও দ্বন্দ্বে বিধাতা যে বাস্তব সৃষ্টি করেছেন, শিল্প সে বাস্তবের ব্যাখ্যাকার নয়। শিল্প আরেক সম্ভবমাত্র।’ (পৃ ১৫৭)
সুতরাং তাঁর কাছে শিল্প স্বতন্ত্র এক বাস্তব। স্বতন্ত্র এক সত্য। যা প্রকৃতির প্রতিরূপ নয়। নিজেই এক স্বতন্ত্র সত্তা। লা দোলচে ভিটা দিয়ে শুরু করে আমরা তাঁর শিল্পভাবনার এই জগৎটিকে ছুঁতে চেষ্টা করলাম।
এই ভাবনার মধ্যেই তাঁর অন্তর্মুখীনতার পরিচয় আছে। মানুষের দ্বৈতসত্তার কথা তিনি বলেছেন। একটু আগে একটি চিঠিতে তা আমরা দেখেছি। এই দ্বৈতসত্তা তাঁর মধ্যে প্রবলভাবে সক্রিয় ছিল। একদিকে অত্যন্ত ভদ্র ও বিনয়ী। বন্ধুবৎসল। আড্ডা দিতে খুব ভালোবাসতেন। কলেজ স্ট্রিটের ‘বসন্ত কেবিন’ ও ধর্মতলার ‘সোডা ফাউনটেন’ তাঁর নিয়মিত আড্ডার জায়গা ছিল। বহু শিল্পী, সাহিত্য ও শিল্পপ্রেমী মানুষ সেখানে তাঁকে ঘিরে জড়ো হতেন। বেশিরভাগ সময়েই তাঁর ভূমিকা ছিল মূলত শ্রোতার। সকলের কথা থেকেই জানতে বা বুঝতে চাইতেন। খুবই গুরুত্ব দিতেন প্রত্যেকের কথাকে। নিজের ভাবনাটাকে রেখে দিতেন নেপথ্যে। খুব প্রয়োজন না হলে মুখ খুলতেন না। যদি বলতেই হতো কখনো, বলতেন অত্যন্ত আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে। দীপ্ত বোধের পরিচয় থাকত তাতে। বাইরের জগৎ, তাঁর পরিচিত বন্ধুজন তাঁকে একভাবে পেত। কিন্তু তাঁর একান্ত যে আত্মগত সত্তা সেখানে কেউই তাঁকে প্রায় ছুঁতে পারত না। সেখানে তিনি ছিলেন ভীষণ একাকী। নির্জন। এই নির্জনতার ভিতর থেকেই উন্মীলিত হতো তাঁর সৃজনের জগৎ। তিনি ছবি আঁকতেন গভীর রাতে। বিশ্ব থেকে আলাদা করে নিতেন তখন নিজেকে। অথবা সেই নির্জনতার মধ্যেই বিশ্বের সঙ্গে তাঁর একাত্মতা গড়ে উঠত। তিনি বিশ্বকে আবিষ্কার করতেন তাঁর নিজের মতো করে। সেই বিশ্বে পরিচিত প্রকৃতি বা মানুষের আভাস হয়তো কিছু থাকে। কিন্তু তা রূপান্তরিত হয়ে গিয়ে এক স্বতন্ত্র বাস্তব তৈরি করে। অতীত ও বর্তমানের মধ্যে এক সংশ্লেষ চলতে থাকে। এই সংশ্লেষ থেকে পুরাণকল্পের বিশেষ আদল তৈরি হয়। লা দোলচে ভিটার ফোয়ারার উপমায় যখন তিনি গড়ে তোলেন নিজের ছবি, তখন এই রূপান্তরণ প্রক্রিয়া আমরা অনুধাবন করতে পারি।
গণেশ পাইনের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয়ের অনেক আগে থেকেই তাঁর ছবির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। সেটা মোটামুটি ১৯৭০-এর দশকের গোড়া থেকে। দুটি জিনিস লক্ষ করতাম তাঁর ছবিতে, যেটা আমাকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করত। তাঁর নির্জনতার বোধ, বাস্তব-অতিক্রান্ত বাস্তবতা। অন্তর্গূঢ় গভীরের অনুরণন, যা তাঁর সমসাময়িক কম শিল্পীর ছবিতেই দেখা যায়। দ্বিতীয় বিষয়টি ছিল – ছবিতে একদেশীয় আইডেন্টিটি গড়ে তোলা। আধুনিক বা আধুনিকতাবাদী চিত্রকলার ক্ষেত্রে এই দেশীয় আইডেন্টিটির কোনো প্রাসঙ্গিকতা আছে কিনা, এই নিয়ে বিতর্কের কোনো শেষ নেই। অনেকেই মনে করেন, চিত্রকলার ভাষা আন্তর্জাতিক। কখনই তা কোনো বিশেষ অঞ্চল বা দেশের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকে না। অতিরিক্ত ঐতিহ্যনির্ভরতা বা পুরনো দিনের দেশীয় আঙ্গিকে লিপ্ত থাকা – ছবিকে সীমিত গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ করে দেয়। মুক্তির ইঙ্গিত আনে না। এই যেমন একটি দিক, তেমনি আর একটি দিক হচ্ছে নিজস্ব আত্মপরিচয়ে ভাস্বর হলে
আন্তর্জাতিকতারও মুক্তি ঘটে না। তথাকথিত আন্তর্জাতিকতা অনেক সময়ই হয়ে ওঠে পাশ্চাত্যের প্রশ্নহীন অনুকরণ। পাশ্চাত্য সেখানে আমাদের ছবিকে নিয়ন্ত্রণ করে। আমাদের কোনো স্বাতন্ত্র্য থাকে না। গণেশ পাইন এ সম্পর্কে খুব সচেতন ছিলেন। পূর্বোক্ত শিল্পচিন্তা গ্রন্থের একটি চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন :
‘পশ্চিম আর কতকাল আমাদের আচ্ছন্ন করে থাকবে? কবে আমাদের সেই আত্মবিশ্বাস আসবে যাতে ওরা কী বলল না বলল তাতে এসে যাবে না কিছুই।’ (পৃ ৩৭)।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি তাঁর ছবিতে অন্তর্মুখীনতার মধ্যেও পাশ্চাত্যনিরপেক্ষ একদেশীয় আত্মপরিচয় গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সেটা তথাকথিত ভারতীয়তা কখনই ছিল না। পাশ্চাত্য আধুনিকতাবাদী আঙ্গিকের সারাৎসারকে তিনি তাঁর ছবির রূপকল্পে মিশিয়ে দিতেন। কিন্তু সেটা করতেন ঐতিহ্যগত ভিত্তির ওপর। এই সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে যে ‘আইডেন্টিটি’ তিনি তৈরি করেছেন, সেটাই আজকের চিত্রকলায় তাঁর প্রধান অবদান।
তাঁর ছবির এই বৈশিষ্ট্যটিকে আমি একটু গভীরভাবে অনুধাবন করতে চেয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, তাঁর ছবি নিয়ে যদি আমি লেখার সুযোগ পাই, তাহলে এই অনুধাবন সহজতর হবে। এজন্য একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচনার প্রয়াসেই আমি তাঁর সঙ্গে পরিচিত হতে চাই। বসন্ত কেবিনে, তাঁকে দেখতাম। কেউ একজন আলাপও করিয়ে দিয়েছিল। দু-একদিন ওখানকার আড্ডায় আমিও শামিল হয়েছি। কিন্তু তাতে পরিচয় খুব গভীর হয়নি। তাঁর ছবি নিয়ে প্রথম প্রবন্ধটি আমি লিখেছিলাম, তাঁর সঙ্গে কোনো আলোচনা না করেই। পরিচয় পত্রিকায় সেটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। একটি সংখ্যা তাঁকে পড়ার জন্য দিয়েছিলাম। পরে যখন একদিন দেখা হলো তাঁর সঙ্গে অ্যাকাডেমিতে, বললেন – ভালো লেগেছে লেখাটি, শুধু মিথের ব্যাপারটা আমি ‘মিস’ করেছি। আমি তখন বলেছিলাম, আমি যদি একটি পূর্ণাঙ্গ বইয়ের জন্য কাজ করতে চাই তাঁর ছবি নিয়ে, তাহলে তাঁর সহায়তা পাওয়া যাবে কিনা। তিনি সানন্দে রাজি হয়েছিলেন। খানিকটা নিবিড় যোগাযোগের সূত্রপাত সেখান থেকেই।
সেটা মূলত কাজের সঙ্গেই সম্পর্কিত ছিল। বইয়ের জন্য তাঁর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তখন তাঁর কাছে যেতে হয়েছে। যোগাযোগটা কাজের বাইরেও কিছুটা প্রসারিত হয়েছে। কিন্তু ততটা নয়, যাকে খুব ব্যক্তিগত স্তরের নিবিড় বন্ধুত্ব বলা যেতে পারে। বয়স ও প্রতিষ্ঠার ব্যবধান তো ছিলই। আমি নিজেও খুব স্বতঃস্ফূর্ত সামাজিক নই। তিনিও ব্যক্তিগত পরিসরকে কিছুটা গণ্ডিবদ্ধ রাখতে পছন্দ করতেন। কাজের প্রয়োজনেই বেশ কিছু চিঠির আদান-প্রদান হয়েছিল। সেগুলি আমার বড় প্রাপ্তি।
আমি যখন কাজটা শুরু করি ১৯৮৯ সাল নাগাদ তখন গণেশ পাইন থাকতেন কবিরাজ রোতে। মেডিক্যাল কলেজের উলটোদিকে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ থেকে বেরিয়েছে রাস্তাটি। ওখানে প্রথম দিন গিয়েছিলাম আমার অফিসের এক সহকর্মী নিহারেন্দু দত্তের সঙ্গে। নিহারেন্দু শিল্পী। গণেশ পাইনের বন্ধু ছিলেন। আর্ট কলেজে তাঁরা একসঙ্গে পড়েছেন। কবিরাজ রো সরু রাস্তা। ডান পাশে পর পর অনেকগুলি আয়না তৈরির কারখানা। ডান পাশে সারি সারি বাড়ি। পুরনো। অধিকাংশই দোতলা। রাস্তাটা কিছুটা গিয়ে ডানদিকে ঘুরেছে। তারপর ফিয়ার্স লেনের সঙ্গে মিশেছে। বাঁকের মুখটায় একটা রাধাকৃষ্ণের মন্দির। সামনে খানিকটা ফাঁকা জমি। তারই বিপরীতে বাঁ পাশে যে লাল রঙের বাড়িটা, সেটাই গণেশ পাইনের বাড়ি। বাড়িটি তিনতলা। একতলায় দরজা খুললেই একটা বসার ঘর। দোতলায় থাকেন পরিবারের লোকজন। তিনতলায় যে ছোট ঘর, সেটা গণেশ পাইনের। ওখানেই তাঁর স্টুডিও। আমি সাধারণত বিকেল চারটে নাগাদ যেতাম। নিচে বন্ধ দরজার ওপরে বেল বাজালে তিনতলার সামনের জানলাটি খুলে যেত। সেখান থেকে মুখ বাড়াতেন গণেশ পাইন। চোখের ইঙ্গিতে থাকত একটু অপেক্ষা করার অনুরোধ। তারপর শোনা যেত সিঁড়িতে চটির নেমে আসার আওয়াজ। দরজা খুলে হাসিমুখে দাঁড়াতেন গণেশ পাইন। ভিতরে গিয়ে দুটো সোফায় মুখোমুখি বসতাম আমরা। কথা শুরু হতো তারপরে। একটু পরে ওপর থেকে আওয়াজ আসত। গণেশ পাইন উঠে যেতেন। দুহাতে দুকাপ চা নিয়ে ফিরে আসতেন।
তখন তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন তাঁর মা। তাঁর দাদা কার্তিক পাইন মারা গিয়েছিলেন ১৯৮০ সালে। খুবই প্রিয় ছিলেন তাঁর এই দাদা। ছেলেবেলা থেকে বন্ধুর মতো দুজনে বড় হয়েছেন। দাদার অকালপ্রয়াণ তাঁকে একেবারে আমূল নাড়িয়ে দিয়েছিল। ছবিতেও এর প্রভাব পড়েছে। সেই দাদার স্ত্রী ও কন্যা ছিলেন পরিবারের অন্য সদস্যা। আর ছিলেন ছোট ভাই বিজয়। তাঁরও অকালপ্রয়াণ ঘটেছে গণেশ পাইনের অনেক আগেই। এই পরিবারের সম্পূর্ণ দায়িত্ব ছিল গণেশ পাইনের ওপর। ১৯৮৯-৯০ সালে তিনি তখনো অবিবাহিত হলেও একজন পরিপূর্ণ সংসারী মানুষ। কিন্তু ভিতরে ভিতরে একান্ত আত্মগত। নির্জন। এবং অন্তর্মুখী। তাঁর জন্ম কলকাতাতেই, উত্তর-কলকাতায় তাঁর মাতুলালয়ে ১৯৩৭ সালের ১১ জুন। কবিরাজ রোর বাড়িতেই তাঁর বায়ান্ন বছর বয়স পর্যন্ত কেটেছে। কিন্তু তাঁর যে অন্তর্জগৎ সেখানে একদিকে ছিল পুরাণকল্পের আলো-আঁধারি, অন্যদিকে কৃষিভিত্তিক গ্রামীণজীবনের কৌমচেতনার আবহ। এই দুই উত্তরাধিকারেরই প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর ছবিতে।
তাঁর এই যে অন্তর্মুখীনতা, পুরাণকল্পের অতীতের প্রতি নিবিড় উন্মুখতা, আজন্ম শহরে মানুষ হয়েও গ্রামীণজীবনের প্রতি টান, এইসব বৈশিষ্ট্যের উৎস কী? এই প্রশ্ন করেছিলাম তাঁকে সেই সাক্ষাৎকারে। উত্তরে তিনি বলেছিলেন এরকম :
‘একটি সাধারণ ছেলে, তার আইকিউ সাধারণ, কিন্তু প্রচণ্ড কল্পনাশক্তিসম্পন্ন, বা শক্তিও বলব না, কল্পনা থেকে উদ্ভূত
যে-কোনো কিছু সম্পর্কে একটা উদগ্র নেশার মতো, তাতে ছেলেটাকে দুটো ভাগে ভাগ করে দিয়েছিল। একটা দিক তার বাইরের স্বাভাবিক মুখ, যেখানে সে সাধারণ ছেলেদের মতো খেলা করছে, দুষ্টুমি করছে, হুটোপুটিও করছে, মারও খাচ্ছে। সেখানে আর পাঁচটা ছেলের সঙ্গে তার কোনো তফাৎ ছিল না। কিন্তু এই ছেলেটিই তার দিনযাপনের মধ্যে একটা বড় অংশ, সম্পূর্ণ একা পৃথকভাবে নিজের জন্য বাঁচত। এখন এই দ্বৈত ব্যাপারটা এটা ছেলে বয়স থেকেই ছিল।… সাধারণ বাঙালি মধ্যবিত্ত অসচ্ছল নয় এমন একটি পরিবারে যে মানুষ, যেখানে স্নেহের অভাব নেই এবং বড় যৌথ পরিবারে যে ধরনের মনোমালিন্য, বিবাদ, বিষাদ, থেকেই থাকে, সেটাও সে দেখেছে। কিন্তু এটাই তাঁকে দ্বিধাবিভক্ত করেছিল বলে আমার মনে হয়।… পাশের বাড়ির ছাদের ওপর ছিল একটি গরুড় মূর্তি, মন্দিরে চৈতন্যদেবের যে কাঠের মূর্তি ছিল, কিম্বা ধরুন, পাশের বাড়ির ঠাকুর দালানে অর্জুনের বিশ্বরূপ দর্শনের যে ছবি, বিশ্বরূপ দর্শন আমি পরে জেনেছি, ছবিটার ভয়াবহতা আমাকে সম্মোহিত করে রাখত। এই রকম কিছু কিছু তুচ্ছ জিনিস চারপাশে ছড়ানো, সেগুলোই শৈশবে আমাকে ভীষণভাবে পেয়ে বসত। তার আকার, আকৃতি, সবচেয়ে বড় তাদের সঙ্গে যে একটা অপরিচয়ের ভাব, এই যে আমাদের হাতের ছোঁয়ার মধ্যে থেকেও, এদের একটা অন্য অস্তিত্ব আছে, যে অস্তিত্বের সঙ্গে আমাদের প্রতিদিনের অস্তিত্বের একটা তফাৎ আছে।’
তাঁর ছবির ভিতর উঠে আসে পুরাণকল্পের অতীত। সেই পুরাণকল্প উৎসারিত হয় জাতিগত কৌমচেতনা থেকে। গ্রামীণজীবনে প্রবাহিত থাকে সেই কৌমচেতনা। আধুনিক শহর অনেক নবীন সময়ের সৃষ্টি। তার ভিতর রয়েছে জীবনযাপনের জটিলতা, প্রবল সংঘাত। গ্রামীণ পুরাণকল্পের সঙ্গে নাগরিক জটিলতার সংশ্লেষে নির্ধারিত হয়েছে তাঁর ছবির চরিত্র। এই গ্রামীণ উৎস সম্পর্কে তিনি বলেছেন :
‘এইটা একটা গোলমেলে জায়গা, জানেন। আমার, বোধ হয়, মনের ভিতরটা অনেকটা গ্রামীণ, যেখানে কৃষিটা একটা বিষয়। সত্যি কথা বলতে কি, এটা স্বীকারোক্তিই বলুন, Confession-ই বলুন, যে নগর জীবনের এবং আধুনিক জীবনের যে কেজো দিকটা তার মধ্যে কৃষিভিত্তিক জীবনের মহত্ত্ব, আমি পাই না। আজো পাই না। এটা বলছি যে, এখানকার পোষাক-আষাক, এখানকার দিন যাপনের Motif force যেটা, সেটার সঙ্গে ঐ জীবনের বিরাট তফাৎ। হয়তো সেই জীবন অলস, কিন্তু তার সঙ্গে একটা বীজ বোনা থেকে, অঙ্কুরোদ্গম থেকে, ফসলে পরিণত হওয়ার যে Process তার সঙ্গে যে আত্মীয়তা রাখার ব্যাপারটা, তার মধ্যে যে সৌন্দর্য আছে, তার মধ্যে যে বেদনাও আছে, এই সব নিয়ে একটা পরিপূর্ণ জীবন, মানুষের জীবনকে বোধ করার ইচ্ছে বোধহয় এখনও হয় আমার। কাজেই নগরে থেকেও নাগরিক কাঠামোর মধ্যে থেকেও, হয়তো বহুলাংশে নাগরিক মানসিকতার অধিকারী হয়েও, নিজের সৃষ্টিকর্মের ক্ষেত্রে (নগরকে) আমি ঠিক সেভাবে প্রাধান্য দিতে পারি না।’
গ্রাম ও নগর, অতীত ও বর্তমানের সংশ্লেষ থেকে গড়ে ওঠে তাঁর ছবি। নগরকে তিনি গ্রামীণ অনুভব দিয়ে রূপান্তরিত করে নেন। লা দোলচে ভিটার যে ফোয়ারায় স্নানের দৃশ্য, সেটা যথেষ্টই পরিশীলিত নাগরিক মননের। সেই উৎস থেকেই গণেশ পাইন যখন ছবি করেন তখন তার মধ্যে পুরাণকল্পের প্রতিমা এসে যায়। মানুষ পাখিতে রূপান্তরিত হয়। সেই পাখি ফোয়ারার জলের উৎসের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
চিরদিনের অন্তর্মুখীন এই মানুষটি একটা সময়ে জীবনের কাছ থেকে আঘাত পেয়েছেন। আর্ট কলেজ থেকে পাশ করে বেরিয়েছেন ১৯৫৯ সালে। কিন্তু শিল্পী হিসেবে স্বীকৃতি পেতে সময় লেগেছে অনেক। অনেক চেষ্টা করেও একটা সম্মানজনক জীবিকার উৎস পাননি। কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ায় ঘুরে ঘুরে বুক ইলাস্ট্রেশন করেছেন। তারপর কলেজ স্ট্রিটের শ্রীমানি মার্কেটে মন্দার মল্লিকের স্টুডিওতে অ্যানিমেশন ফিল্মের জন্য ছবি এঁকেছেন। কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে শিক্ষক পদের জন্য ইন্টারভিউ দিয়েছেন। কিন্তু তাঁকে বাতিল করে নির্বাচকমণ্ডলী ওই পদের জন্য নির্বাচন করেছেন এক মহিলা শিল্পীকে। একদিকে বাস্তব জীবনের এইসব ব্যর্থতা, অন্যদিকে সমাজজীবনে হিংসা ও সংঘাত তাঁর মনন ও বিশ্বদৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। ১৯৪৬-এর দাঙ্গায় মৃত্যুর মিছিল দেখেছেন। মেডিক্যাল কলেজে গাড়ি করে আসত মৃতদেহের স্তূপ। সেইখানে টকটকে ফর্সা প্রৌঢ়া এক মানবীর মৃতদেহ দেখেছিলেন। বুকের ওপর রক্তাক্ত আঘাতের চিহ্ন। এই দৃশ্য তিনি কখনো ভোলেননি।
এসব উৎস থেকে এক মৃত্যুচেতনা সঞ্চারিত হয়েছিল তাঁর মনের গভীরে। এই মৃত্যুচেতনা নিয়ন্ত্রণ করেছে তাঁর ছবির দর্শন। এই ধ্বংস ও মৃত্যুর ভিতরই এক উজ্জীবনের আলো খুঁজেছেন তিনি সারাজীবন। ১৯৬০-এর দশকে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের স্বকণ্ঠে আবৃত্তি শুনেছিলেন : ‘তীরে কি প্রচণ্ড কলরব/জলে ভেসে যায় কার শব/কোথা ছিল বাড়ি/রাতের কল্লোল শুধু বলে যায়/আমি স্বেচ্ছাচারী’। এই কবিতা থেকে তিনি পেয়েছিলেন মৃত্যুসম্পৃক্ত এক জলযানের প্রতিমাকল্প। ১৯৭১-এর ‘হারবার’, ১৯৭২-এর ‘ফিশারম্যান’ থেকে ১৯৯৯-এর ‘দ্য ভয়েজ (বহুলা)’ পর্যন্ত মৃত্যুসম্পৃক্ত এই জলযানের প্রতিমাকল্প এসেছে তাঁর ছবিতে। এই মৃত্যুর কেন্দ্র থেকেই উঠে এসেছে এক উজ্জীবনের আলোও। তিনি মনে করতেন দুঃখই হচ্ছে একজন শিল্পীর সৃজনের উৎস। এই দুঃখ ভিতরে ভিতরে কঠিনও করেছিল তাঁকে। আত্মবিশ্বাস দিয়েছিল। আত্মরক্ষার বর্ম তৈরি করেছিল।
১৯৯২ সালে তিনি বিবাহ করেন। আর্ট কলেজ থেকে যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল মীরা দেবীর সঙ্গে সেটা পরিণতি পেতে এতটা সময় লাগল। বিয়ের পর কবিরাজ রো ছেড়ে তিনি দক্ষিণ কলকাতার সাদার্ন অ্যাভিনিউ সংলগ্ন যতীন বাগচি রোডের ফ্ল্যাটে চলে গেলেন। ১২ ফেব্র“য়ারি ১৯৯২ তারিখে আমাকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন :
‘সামনের মাসের প্রথম সপ্তাহে ও বাড়িতে যাবো মনস্থ করেছি। আপাততঃ আঁকাজোঁকার সরঞ্জাম ওখানে মজুত করছি। কাজেই হাত নিশপিশ করলেও ছবি আঁকতে পারছি না।’
ওখানে গিয়ে গণেশ পাইনের ব্যক্তিগত জীবনে অনেকটাই পরিবর্তন এলো। নাগরিক পরিশীলনে সহজ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলো। যোগাযোগটা ছিল তখন শুধু ছবির মধ্য দিয়ে।