logo

গণেশ পাইন : অস্তি ও নাস্তির দ্বৈততা

আ বু ল  ম ন সু র
পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতিমান চিত্রকর গণেশ পাইন প্রয়াত হয়েছেন। শুধু পশ্চিমবঙ্গের অবশ্য তিনি ছিলেন না, সারা ভারতের দৃশ্যকলাজগতেই তিনি খ্যাতি ও সম্মানের পাত্র ছিলেন। তাঁর প্রস্থান আধুনিক ভারতীয় চিত্রকলার একটি বিশিষ্ট ধারার নেতৃস্থানীয় শিল্পীটির অবস্থাটিকে শূন্য করে দিয়েছে। গণেশ পাইনের মৃত্যুর ক্ষতি তখনই যথাযথ উপলব্ধ হবে, যখন আমরা তাঁর স্বকীয়তাকে পরিপূর্ণ মাত্রায় অনুধাবন করতে পারব।
অন্যতর অবশ্য তিনি এমনিতেই ছিলেন খানিকটা। ভোগবাদী বিশ্বে যখন চিত্র-ভাস্কর্যও পণ্য বিনা অন্য কিছু নয়, তখন তিনি শিল্পবাজারের ইঁদুরদৌড় আর পাদপ্রদীপের আলো থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলেন। তথাকথিত আর্ট ক্যাম্প বা ওয়ার্কশপের ডামাডোলেও তিনি খুব অংশগ্রহণ করতেন বলে জানা নেই। শিল্পীর ব্যক্তিগত জীবন যতটা যথেচ্ছ ও নিয়মরহিত হয় বলে প্রচলিত ধারণা, তাঁর দৈনন্দিন দিনযাপন বোধ হয় ছিল তার একেবারেই বিপরীত। যৌথ পরিবারের ঐতিহ্যিক নিয়মানুবর্তিতার মধ্যেই কেটেছে তাঁর প্রায় সারাটি জীবন। ব্যক্তিগতভাবে থেকেছেন অনুচ্চ, নিভৃতচারী, নির্জনতার পরিমণ্ডল-প্রত্যাশী। অন্য অনেক সৃজনশীল স্র্র্রষ্টার মতো তাঁর শিল্পও হয়তো অনেকটাই আত্মজৈবনিক কিংবা আত্মানুসন্ধানের নানান স্তর।
আধুনিক ভারতশিল্পের শুরুটা কোথায়? সে কী অবনীন্দ্রনাথে না কী গগনেন্দ্রনাথে, না কী সে নন্দলালে, অথবা আরো পরে রবীন্দ্রনাথে? হয়তো এঁদের প্রত্যেকের খণ্ড খণ্ড অবদানেই নির্মিত হয়েছে এর পূর্ণাঙ্গ অবয়ব। তবে অবনীন্দ্রনাথের একটি ধারা তৈরি হয়েছিল তথাকথিত ‘বেঙ্গল স্কুলে’র মাধ্যমে, শান্তিনিকেতনচারী নন্দলালের কিছু অনুসারীর সূচনা দেখা যায় বিনোদবিহারী-রামকিঙ্করে। রবীন্দ্রনাথ ও গগনেন্দ্রনাথের কোনো অনুসারী তৈরি হয়নি। সে বিবেচনায় অবনীন্দ্রনাথ ঔপনিবেশিক ভারতের  শিল্প-দৃশ্যপট পালটে দিতে পেরেছিলেন স্বদেশিয়ানার আবেগী জোয়ারের অনুকূল হাওয়া পেয়ে, হয়ে উঠেছিলেন সমগ্র ভারতবর্ষের আধুনিক শিল্পের পিতৃপুরুষ। চল্লিশের ক্যালকাটা গ্র“প বা অনতিপরের বম্বে প্রগ্রেসিভ গ্র“প অবশ্য অবনীন্দ্রনাথ-নন্দলালের পেলব ভারতীয় উত্তরাধিকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে পশ্চিমের আধুনিকতার অনুসরণকেই সমসাময়িকতায় উত্তরণের উপায় হিসেবে ভেবেছিল। অবনীন্দ্রনাথ-নন্দলালের প্রাসঙ্গিকতাকে তাঁরা ধরতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথের ছবি তাঁদের কাছে ছিল প্রহেলিকাময়, তাঁকে এড়িয়ে যাওয়াটাই ছিল সুবিধাজনক। যদিও চল্লিশের দশকেই জয়নুল আবেদিন, চিত্তপ্রসাদ ভট্টাচার্য, সোমনাথ হোর, গোবর্দ্ধন আশ প্রমুখ সমাজ ও কালচেতনাধর্মী চিত্রের একটি ধরন চর্চা করছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চাশ-ষাটের দশকের শিল্পীরা পশ্চিমের আধুনিকতাকেই প্রধান অবলম্বন হিসেবে বেছে নিলেন (যেমনটি ঘটেছিল সমসাময়িক পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পধারায়ও)। তাঁদের অনুপ্রেরণার প্রধান আঙ্গিকগত কাঠামো হলো ‘ক্যুবিজম’, যদিও ক্যুবিজমের সূচনা আরো প্রায় চল্লিশ বছর আগে বিংশ শতকের প্রথম দশকে। এর সঙ্গে কিছু ভারতীয় উপাদান মিশিয়ে চলল আধুনিক ভারতশিল্পের অবয়ব নির্মাণের কাজ।
এখানে গণেশ পাইন নিজের জন্য ভিন্ন পথের অনুসন্ধান করেছেন। মূলত ষাটের দশকে আবির্ভূত শিল্পী তাঁর শিল্পজগৎকেও সমসাময়িক শিল্প-সতীর্থদের থেকে বেশ পরিষ্কারভাবে আলাদা করে নেন, কী রচনশৈলীতে, কী মাধ্যমের ব্যবহারে। ক্যুবিজমের বলিষ্ঠ জ্যামিতিকতা ও রূপের নানান অতিশায়নের সুযোগ তাঁকেও আকর্ষিত করেছে এবং নানা পরিবর্তনময়তার মধ্য দিয়ে যাওয়া তাঁর চিত্রমালায় শেষ পর্যন্তও ক্যুবিজমের ছায়াপাত রয়ে যায়। কিন্তু একই সঙ্গে প্রবল অবনীন্দ্র-অনীহার কালে অবনীন্দ্রনাথের চিত্রধারার এক একনিষ্ঠ অনুরাগী হিসেবেও দেখা যায় তাঁকে। তাই ক্যুবিজমের পাশাপাশি প্রায় অব্যাহতভাবে অবনীন্দ্রনাথের মায়াবী আলোআঁধারির জগৎও হানা দেয় তাঁর চিত্রকর্মে। রবীন্দ্রনাথকেও কি নতুন করে আবিষ্কার করেন গণেশ পাইন? তাঁর আলুলায়িত নারীর অবয়বে রাবীন্দ্রিক নারীচিত্রণের রহস্যময়তার প্রতিভাস যেন প্রজন্মান্তরে পুনরপি দেখা দেয়। গণেশ পাইন নির্বস্তুকতার দূরযায়ী লোকে যেমন নিজেকে স্থাপন করেন না আবার সমসাময়িকতার দুঃসহ তাপও তাঁর চিত্রের অবয়বে অশ্র“-ঘামসহ উপস্থিত নয়। তিনি থাকেন মাঝামাঝি, এক স্বল্প-আভাসিত ঐন্দ্রজালিক রহস্যালোকের পরিসরে। তাঁর জগৎ জীবন-অধ্যুষিত, তবে মানুষ ও পশুর আদলকে তিনি বিনির্মাণ করেন অভিব্যক্তি ও আবেগকে অপসৃত করে আলো ও আঁধারের প্রহেলিকাময় পটভূমে। কঙ্কাল, করোটি, দাঁত ও দেহাস্থির অতিশায়ন চিত্রপটজুড়ে নির্মাণ করে হতাশা, নির্জনতা, বিষাদ ও মৃত্যু-আভাসিত অনুভূতির এক অজানা বেদনা। তাঁর আত্মসৃষ্ট এক ধরনের একাকিত্বের বোধও সম্ভবত তাঁকে নিরন্তর চালিত করেছে জীবনের বিষাদময়তার প্রতি।
এই মরমি রহস্যালোকের ভেতর দিয়ে স্থান ও কালকে অবলোকনের মাধ্যমে শিল্পী যে বার্তাটি জানান দেন তার ব্যবচ্ছেদ সহজ নয়। শিল্পীর চারপাশে বহমান জগৎপ্রবাহের সঞ্চলন তাঁকে তো আন্দোলিত করেই, তার বাইরে মৃত্যুর অবশ্যম্ভাবিতা স্বাভাবিকভাবেই শিল্পীর সংবেদকে তাড়িত করে চলে। এর বাইরে জীবনের সার্বিক তাৎপর্য বিষয়ে ব্যাকুলতা তাঁকে টেনে নিয়ে যায় স্বপ্নময়তা ও বিষাদচেতনার আলো-আঁধারির এক দ্বান্দ্বিকতায়। জীবনের সীমাচিহ্নিত অমোঘতার বিপরীতে আনন্দ ও সুন্দরের নিরর্থকতা তাঁকে আচ্ছন্ন করে, কিন্তু সঙ্গে এই আশ্বাসটিও হয়তো ধারণ করতে চান যে জীবনের বিপুলতার মধ্যে তার চরিতার্থতার সন্ধানই মানবের অভিযাত্রা। এটি তাঁর আত্মানুসন্ধানেরও অংশ বৈকি।
তাঁর সামনে আরো ছিল কাল ও স্থানের সঙ্গে নিজের শিল্পকর্মকে সম্পৃক্ত করবার সংগ্রাম, যাকে অন্য কথায় বলতে পারি আত্মানুসন্ধান বা সমকালীন যুগশিল্পী হয়ে ওঠার নিরীক্ষা। চল্লিশ-পঞ্চাশের পশ্চিমমুখী আধুনিকতার প্রবণতা ষাটে কিছুটা কমে এসে এর সঙ্গে দেশীয় উপাদান জুড়বার প্রয়াস দেখা যায়, যাতে মূলত লোকায়ত শৈলী বা ধর্মীয় চিহ্ন ও প্রতীকের উপস্থাপন প্রধান হয়ে ওঠে। গণেশ পাইন এসবের বাইরে খুঁজে পেলেন তাঁর অনুপ্রেরণাস্থল, মূলত অবনীন্দ্রনাথে, কিছুটা বা রবীন্দ্রনাথে। তাঁর ছবিতে রেমব্রান্টের প্রেরণার কথা বলা হলেও সেটি তেমন বাস্তবসম্মত মনে হলো না, বরং কিছুটা কি নন্দলাল, আর কিছুটা বিনোদবিহারী? তবে গণেশ পাইনের সেরা সৃষ্টিগুলো অতি অবশ্যই এঁদের কারো শিল্পধারার বিবর্তিত আধুনিকায়ন নয়। সমকালীন তমসা-পরিকীর্ণ জীবনের বিক্ষত পরিণামহীন নাস্তির বিরুদ্ধে জীবনের অর্থময়তার অস্তিবাচক প্রত্যাশার যে দ্বন্দ্ব নিরন্তর রক্তাক্ত করছে এই চিত্রশিল্পীর সৃজনজগৎকে আগের শিল্পীদের অনুভবের বলয়ে এ সংকটটি অতটা প্রবল ছিল না। ফলে গণেশ পাইন বা তাঁর সমকালীন সংবেদনশীল অন্যান্য চিত্রশিল্পীর কাজে সময়ের যে অভিঘাত সেটি পূর্ববর্তী প্রজন্মের সঙ্গে সে অর্থে তুলনীয় নয়।
তবে যেমনটি আগে বলা হয়েছে, গণেশ পাইনের চিত্রকর্ম তাঁর সমকালের অন্যদের চেয়ে বেশ লক্ষণীয়ভাবে ভিন্নতর। মনে হয় স্থানিক শিল্প-ঐতিহ্যের সঙ্গে কালিক সময়চেতনার সমন্বয় ঘটিয়ে একটি শক্তিমান চিত্রভাষা নির্মাণের ক্ষেত্রে শুধু বাংলায় নয়, সমগ্র ভারতবর্ষেই তিনি একালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী। তাঁর ছবি একদিকে ব্যক্তিগত নির্জনতা ও বিচ্ছিন্নতাবোধের এক কল্পরূপ, অন্যদিকে বিষাদবোধ বনাম স্বপ্নচারিতার, আলো বনাম অন্ধকারের এক দ্বৈততার দ্বান্দ্বিক কিন্তু ধ্যানমগ্ন চিত্ররূপ। বলা বাহুল্য, গণেশ পাইনের ছবি দূরবর্তী লোকায়ত জীবনের চিহ্ন-সংকেত-প্রতীক ও রূপকের সঙ্গে আজকের পরিচয়-অনির্দিষ্ট মানব ও জীবজগতের সমন্বয় আর কূহেলিকাময় আলো-আঁধারির যে কল্পরূপাত্মক প্রেক্ষাপট উপস্থাপন করে তাকে সুনির্দিষ্ট অর্থময়তার গণ্ডিতে ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। কোনো শ্রেষ্ঠ সৃজনকর্মই সহজ ব্যবচ্ছেদের অবকাশ রাখে না। গণেশ পাইনের চিত্রকর্ম জীবনের সার্থকতা ও অনিবার্য নিরর্থকতার মধ্যখানের দ্বৈততাকে ধারণ করে এক মরমি প্রহেলিকাময় আলো-আঁধারির নিজস্ব ভাষ্য রচনার মাধ্যমে। তাঁর শিল্প দর্শককেও টেনে নিয়ে যায় অনির্দিষ্ট কিন্তু অনিবার্য সেই বোধের জগতে। এই সংবেদ-সূক্ষ্ম জগতের স্রষ্টা যিনি তাঁর প্রস্থান তো অবশ্যই বেদনার, তবে তাঁর স্থান তো নির্দিষ্ট হয়ে গেছে চিরায়তের আসনে।

Leave a Reply