logo

গণেশ পাইনের শিল্প : অতিপ্রাকৃতের ঘ্রাণ

ম ঈ নু দ্দী ন  খা লে দ
মধ্যদুপুরের অতর্কিত অত্যুজ্জ্বল মাহেন্দ্রক্ষণের ধাঁধানো মুহূর্ত অথবা মধ্যরাতের নিঃসীম হিম নীরবতা, এমন কোনো সম্মোহনী আবেশের জাল ছড়িয়ে আছে গণেশ পাইনের ছবিতে। কখনো বা এও মনে হয়, বিজন সন্ধ্যায় আঁধার ঘনিয়ে এলে যে কুহকে বন্দি হয় আমাদের অস্তিত্ব তাকে চিত্ররূপ দেওয়ার বর্ণমালা আবিষ্কার করেছেন কলকাতাকেন্দ্রিক শিল্পচর্চার এই শিল্পী। তাঁর ছবি দেখে এমন মনে হওয়াটাকে গুপ্তার্থপুষ্ট কাব্যের শামিল করে দেওয়ার বৈজ্ঞানিক কোনো কারণ হয়তো নেই। কিন্তু চোখ দিয়ে পাঠ করে মস্তিষ্কে কয়েক মুহূর্ত বিরাজ করে আমাদের ভাবনাটা শেষাবধি মনেই ঠাঁই নেয়। কেমন যেন একটা প্রতীতি ফণীমনসার মতো মাথা তুলে বলে, তুমি যা ভাবছ তাই গূঢ়; তাছাড়া এর বাইরে তো তোমার কোনো জগৎও নেই। আমার দৃঢ় আস্থা, অনেকক্ষণ নিরীক্ষণের পর মনের চাবি দিয়েই গণেশ পাইনের ছবির নিহিতার্থের পাপড়ি মেলে ধরতে হয়। মন এমনই পাঠপ্রবণ হয় কবিতা বুঝতে গিয়ে। মৃত্যুর ছায়া রাহুগ্রাসের মতো রেখায় রেখায় বেষ্টনী তৈরি করেছে তাঁর ছবিতে। সেই মৃত্যু নামক অমোঘ নক্ষত্র শিল্পীকেও নিয়ে গেল তাঁর ছবির মতোই লোকান্তরে। লৌকিক দেখাটার মধ্যে অলৌকিকতার, অতীন্দ্রিয়তার সংকেত রেখাজর্জর করে প্রকাশ করার এক বিশেষ পারমিতা তাঁকে তাঁর যুগের অন্য কয়েকজন শিল্পীর মতোই প্রথম পঙ্ক্তিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
মানুষ তার আয়ুষ্কালে যাপন করে জীবন। কিন্তু তার বেঁচে থাকাটা শুধু বর্তমানে বলয়িত নয়। এই অনিবার্য বর্তমানে তার যোগসূত্র প্রাক-পুরাণিক জগতের সঙ্গে এবং আগত স্বপ্ন-দুঃস্বপ্নের সঙ্গেও। একজন ভারতীয় বা কলকাতাকেন্দ্রিক শিল্পীর শিল্পী হওয়ার বিশেষ ক্ষেত্র ও প্রেক্ষিত আছে। ভারতের ইতিহাস তাঁর শিল্পকলায় বিধৃত। যদি শুধু চারুকলা বিবেচনায় নিই তাহলেও প্রায় সব যুগেরই শৈল্পিক নিদর্শনে আঢ্য ভারতশিল্প বিশ্ব। গুহাযুগ, বৈদিক, বৌদ্ধ, হিন্দু, মুসলিম, পারসিক, মোগল, ইংরেজ কত না শৈল্পিক মহাযজ্ঞের আয়োজন ভারতশিল্পের মহাপৃথিবীতে। অনেক দেবী ও সাধারণ মানুষ পরস্পরের অভিব্যক্তি অদলবদল করে কেমন রহস্যময় হয়ে তাকিয়ে আছে কিংবা মগ্নতায় ডুবে আছে গণেশ পাইনের ছবিতে। দেবী মানুষ হয়ে গেল, নাকি মানুষ দেবীর কোনো এক অভিব্যক্তি নিয়ে হাজির হলো; – এমন সব বোধে আক্রান্ত হয় দর্শকের মন। ভারতে বসে শিল্পচর্চা করলে হাজার হাজার যুগের বিবিধ পৌরাণিক মূর্তিলোক ও শিল্পকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শিল্পসাধনা এক দুরূহ কাজ এবং তা বোধহয় স্বাভাবিকও নয়। একদিকে সমষ্টির পুরাণ আর অন্যদিকে একা মানুষের শিল্পযাত্রা, দুইয়ে মিলে কী ঘটে তা না বুঝলে কলকাতার শিল্পচর্চা অনুধাবন করা যায় না। আমার মনে হয়, ব্যক্তিমনের সংক্ষুব্ধজাত যে শিল্প-অভিব্যক্তি রয়েছে তা এ-অঞ্চলে প্রকাশ পেতে কিছুটা বিলম্বিত হয়েছে। এর বড় একটা কারণ অতীতচারিতা ও পুরাণমুখিনতা। এ-কথা অনেক তাত্ত্বিকই প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন। যুদ্ধ, দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ, ঔপনিবেশিক চক্রান্ত ও পীড়নের চূড়ান্ত আঘাত, বিপ্লব, দেশভাগ, স্বপ্ন, স্বপ্নভগ্নতার উথালি-পাথালিকালে খাবি খেয়ে শিল্পীসত্তা বুঝতে পারল, যে মানুষ আমার পরিচিত সে মানুষ আর সত্য নয়। সত্য বহুমাত্রিক, সত্যের বহুতল, নানা কৌণিক আলো ফেলে তা অংশত জানা যায় – অংশত অনুমান করতে হয়। কিন্তু পূর্ববর্তীকালের মূর্তি, ভাস্কর্য, ইমেজ নিরীক্ষণে যে অভিজ্ঞতা হয় তা তো আর উপেক্ষা করা চলে না, বরং তাকেই নির্ভর করে নিজেকে উজিয়ে দিতে হয় অথবা তার পেছনেই বিশেষ নিয়মের আড়াল খুঁজতে হয়। দুঃসহ বর্তমান চিত্রিত করার উজ্জ্বল আয়োজন কলকাতায় শুরু হয় চল্লিশের দশকে। কিন্তু বিপ্লব ও দেশভাগ সুফল না নিয়ে এলে তখন কী হয় মনের অবস্থা! শত্র“ যদি চিহ্নিত থাকে, তাকে আক্রমণ করা যায়। কিন্তু শত্র“ যখন দুষ্টকাল, আর এ-কালের কুশীলবরা যখন ভোল পালটে ফেলে বিপ্লবীর লক্ষ্য ভ্রষ্ট করে দিয়ে সদর্পে দাপিয়ে বেড়ায় আর বিপ্লববিচ্ছিন্ন হয়ে মানুষ একা হয়ে যায়, তখন কী শিল্প রচনা করে অস্তিত্বের জানান দেন শিল্পীরা তা না বুঝলে কলকাতার সমকালের শিল্প পাঠ করা যায় না। গত শতকের চল্লিশের দশক পেরিয়ে পঞ্চাশের শুরুতে বোধহয় ওই ব্যক্তিমনের দিশেহারা বেদনার্ত নিঃসঙ্গ অবস্থা থেকে নতুন শিল্প জন্ম নিতে শুরু করে। আমি এ-সময় থেকে শুরু হওয়া কালখণ্ডকেই সমকালীন ভারতশিল্প বলছি। ক্যালকাটা গ্র“প আর বোম্বের প্রোগ্রেসিভ গ্র“পের কথা স্মরণে রেখেও বলতে চাই যে, আসলে পঞ্চাশের ও ষাটের দশকেই ব্যক্তিমানসের জটিল আবর্তঋদ্ধ নতুন শিল্পভাষার জন্ম নিয়েছে। এ-সময়ের তাপ হয়তো একজন রবীন মণ্ডল বা আর কেউ একটু আগে অনুভব করেছেন। কিন্তু প্রকাশ কর্মকার, বিকাশ ভট্টাচার্য, সুনীল দাস, শ্যামল দত্ত রায়, যোগেন চৌধুরী, গণেশ পাইন প্রমুখ একান্ত জাগতিক পৃথিবীর ওপর, অতিজাগতিক তন্দ্রাচ্ছন্ন মনটা অনূদিত করলেন তাঁদের শিল্পে। কাজটা করলেন তাঁরা অতীত ভারত ও সমকালের ভারত বিবেচনা করেই। তবে নব্যবঙ্গীয় শিল্পধারার মতো অতীতচারী হয়ে নয়। অবশ্য এ-ধারার শিল্পীদের শৈল্পিক অর্জন অগ্রাহ্য করে নয়। যেখানে পাথুরে অতীতের মূর্তিতে নিবিষ্ট থেকে অগ্রজ নন্দলাল নিজস্ব স্বরে সরব হয়েছেন, যেখানে ভারতীয় ও মোগল মিনিয়েচারে নিজের মন উপচিয়ে দিয়েছেন অবনীন্দ্র তা তাঁরা বরং খুঁটিয়ে পাঠ করেছেন। আর চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ যে তাঁদের নিয়মের শিল্পসাধনারই আদিপিতা তা তো প্রমাণিত এবং অনেকেই তা মেনে নিয়েছেন। যদিও রবীন্দ্রনাথ ভারতপুরাণ নিরীক্ষণ করে চিত্রকর জন্মলাভ করেননি।
গণেশ পাইনের ছবি দেখলে একজন ঘনিষ্ঠ পাঠকের মনে হবে, যেন পৌরাণিক পৃথিবী দেখছেন। এ-শিল্পী অবিনাশী পৌরাণিক ইমেজের মতোই তাঁর ইমেজগুলোর মধ্যে ব্যঞ্জনাসমৃদ্ধ অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলতে সমর্থ হয়েছেন। তাঁর যুগের সহযাত্রীদের মতো তিনিও স্বকালের তাপদগ্ধ ও নিজমনের ভাবনার রেণু-রংলিপ্ত এক বিশেষ নবপুরাণপ্রতিম শিল্প রচনা করেছেন। গণেশ পাইনই বোধহয় তাঁর শিল্পকর্মে সবচেয়ে জটিল জালে পৌরাণিক প্রপঞ্চের ভাষায় নিজের অস্তিত্বের ও স্বকালের সংবেদ সম্প্রচারিত করেছেন। তাঁর ছবির মানুষ, কীট-পতঙ্গ, পশু-পাখি, নৈসর্গিক অনুষঙ্গ, ঘর, জানালা, কপাট, ছাদ, ভিতর-বাহির, আসবাবপত্র কেউই যেন এ পৃথিবীর নয়। তারা এ পৃথিবীর হলেও যেন কোনো গভীর গোপন দেশ থেকে সহসা আবির্ভূত হয়েছে। আবার এমনও মনে হয়, উপরিতলের আবরণ অতর্কিতে তুলে নিয়ে তিনি অবচেতনকে উন্মুক্ত করে দিলেন। আমাদের কাছে যা ছিল সামান্য অনুমেয়, তাই তিনি বিকীর্ণ রেখায় ও গড়নের ভারে কেমন থমথমে অবিশ্বাস্য করে তুলে ধরলেন।
ছবির বিষয় ধরে বিশ্লেষণ করলেও তাঁর ছবিতে যে বিস্ময়-পরিধি রয়েছে তাকে গাণিতিক হিসেবের মতো স্বচ্ছ করে বুঝে ওঠা যায় না। তাঁর ছবিতে অনেক বালক আছে, পাখি ও ঘোড়া আছে, নারী আছে আর আছে অনেক মৃত্যুদৃশ্য। প্রাকৃতিক প্রেক্ষাপট ও গৃহাভ্যন্তরের পরিসরেও ছবির বিষয় চিত্রিত হয়েছে। তবে গণেশ পাইন ওইসব প্রেক্ষাপট বাদ দিয়ে যখন শুধু কালো বা সাদা অথবা জাল-জালিকাময় একটা টাইম ও স্পেসে বিষয়কে চেনা-অচেনার দ্বান্দ্বিক বিস্ময়ে প্রকাশ করেন তখনই তাঁর ছবিতে স্বাতন্ত্র্যের মাহাত্ম্য পরিস্ফুট হয়। কিন্তু দর্শকমনে প্রশ্ন জাগে, তারা কি বাস্তব? এই সময়ের? অথবা কেনই-বা তার অচেনা! শিল্প তো অচেনা আমিকেই আবিষ্কার করে। তবু কেন গণেশ পাইনের ছবি অপেক্ষাকৃত বেশি সময় ধরে মগ্নপাঠের দাবি করে। চোখ কেবলই খুঁজতে থাকে অর্থ, ইমেজের সঙ্গে পরিপ্রেক্ষিতের সমন্বয়। দৃষ্টি বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয় ঠিকই, কিন্তু শিল্পীর কাজ দেখতে দেখতে কৃচ্ছ্রসাধনের ক্লান্তি আসে না।
বিদগ্ধ দর্শক ছবির গল্প পাঠ করতে চান না। তিনি ছবির অনুষঙ্গের অবস্থিতির মধ্যে শিল্পীর মন ও মস্তিষ্ক কতটা অভিনবত্ব অর্জন করেছে তা প্রমাণ করতে চান। এ মনোভঙ্গির দর্শক হলে বরং বেশি বোঝা যাবে গণেশ পাইনকে। জাল-জালিকা আর বর্ণছটায় তৈরি যে টেক্সচার এ-শিল্পীর প্রধান মনোমুদ্রা তা আণুবীক্ষণিক পর্যবেক্ষণে পাঠ করতে হয় তাঁর ছবিকে অনুভবে স্পষ্ট করে তোলার জন্য। দুষ্পাঠ হিরোগ্লাফিক বর্ণমালার মতো করে তোলেন তিনি তাঁর মানুষী, পশু-কীট-পতঙ্গ ও নৈসর্গিক উপাদানের খণ্ডিত রূপায়ণে। প্রকাশের চেয়ে, অপ্রকাশেই যেন তাঁর বেশি স্বস্তি। পৃথিবী আসলে খুব বেশি প্রকাশিত, তাকে অনেকটা আড়াল না করলে ঠিক বুঝে ওঠা যায় না, শিল্পের এই স্বতঃসিদ্ধতা হয়তো গণেশ পাইন বুঝতে সহায়তা দেবে। চোখের পাতা নামিয়ে দৃষ্টিকে শানিত না করলে যেমন দূরকে বা গভীরকে পাঠ করা যায় না, তেমনি মনোযোগ ছাড়া এই শিল্পীর অন্ধকারে ডুবানো অথবা রেখায় আকীর্ণ ইমেজের মর্মার্থ মন বুঝে উঠতে পারে না।
মায়ার আবেশ রচনাই গণেশ পাইনের চিত্রানুশীলনের একটি প্রধান বিষয়। তিনি যখন ‘মা ও শিশু’র মতো অবিনাশী সম্পর্কটা আঁকেন তাতেও প্রাত্যহিক বাস্তবতা থেকে বিষয়কে এত দূরে নিয়ে যান যে আমাদের মনে হয় কোনো মায়াপুরী রচিত হয়েছে। ‘মা ও শিশু’ ঘিরে নিসর্গ – পাখিও ডাকছে গাছের ডালে বসে – কিন্তু দ্বিমাত্রিক স্পেসে সাঁটা মা ও শিশুর ইমেজ অনেক কাপড়ের পুতুলের মতো। ইমেজকে ওরকম একটা নিসর্গরাজ্যে স্থাপন করায় শিশুর হর্ষ আর মায়ের আনন্দের অনাবিলতা প্রকাশ পেয়েছে।
ডাকিনী-পরিবেশ রচনা গণেশ পাইনের আরো একটি অন্বিষ্ট। ‘দেবী’, ‘রানী’, ‘বাঘিনী’ নামে তিনি যে ছবিগুলো এঁকেছেন তাতে আমরা অনুভব করি প্রকৃতিলীন অশরীরী, ভয়ংকরতাকে তিনি শরীর দিয়েছেন। তাঁর ছবিতে অতিপ্রাকৃতের দ্যোতক সৃষ্টি হয় চিত্রগত কয়েকটি পরিমার্জনায়। রেখার জটা ও জাল, ঘন ও হালকা বর্ণপর্দার যোগসাজশ, মাত্রাতিরিক্ত দ্বিমাত্রিকতার জ্যামিতি, চোখের মণি মার্বেলের মতো গোল জ্বলজ্বলে অথবা চোখে মণি নেই, চোখ অন্ধকার আর চতুর্দিকে খোঁড়ল, ফোঁপরা, পলেস্তারাখসা, ভেঙেপড়া দালান গলিয়ে আলো-অন্ধকার এসবের আয়োজনে মন সেই জাদুকরী আবেশে আটকে থাকে।
ছবি আসলে পরিণামে রং ও রঙের পর্দা আর রেখা ও রেখার জ্যামিতি। এ দুটি উপাদানের প্রয়োগে এমন নিষ্ঠাবান শিল্পী খুব কমই আছেন। রেখার অবিশ্রাম বিচিত্র প্রয়োগে ইমেজগড়া আর বর্ণতলের এত রূপও আমরা অবনীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে আর কোনো শিল্পীর কাজে এমন মাহাত্ম্যে যোজিত হতে দেখিনি। এই বর্ণতলের বিচিত্র সংস্থাপনের কারণেই তিনি উপরিতলের ঢাকনাটা খুলে অবচেতনের রাজ্য অবারিত করে দেন। আর তখনই আমাদের শুভকল্প ও অশুভকল্প ইমেজগুলো স্বয়ংচালে ভেসে আসে অথবা মাটি খুঁড়ে পুরাতাত্ত্বিক যেমন পেয়ে যান অনেক আগের নক্ষত্রকালে মরে যাওয়া কোনো সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের মধ্যে মানুষী প্রতিমা, হাতিয়ার, তৈজসপত্র তেমন ইমেজ আমরা দেখতে পাই শিল্পীর জমিনে।
আমার মনে হয়, কোনো কোনো শিল্পীর কাজ চোখের পাঠে বা হাতের স্পর্শেই শুধু অনুভব করা যায় না। কখনো বুঝি চিত্রশিল্প পাঠের জন্য ঘ্রাণেন্দ্রিয়েরও প্রয়োজন হয়। হয়তো শ্রবণেন্দ্রিয়েরও সহায়তা লাগে। গণেশ পাইনের ছবি দেখলে মনে হয়, এসব মানুষী প্রতিমা ও অন্যান্য বিষয় যেন পুরাতাত্ত্বিকেরা সদ্য পৃথিবী খুঁড়ে উদ্ধার করেছেন। তাদের গায়ে এখনো বসুন্ধরার গর্ভের রক্ত লেগে আছে। প্রতœগন্ধা গণেশ পাইনের ছবি দেখতে গেলে তাই ঘ্রাণেন্দ্রিয় সচল হয়ে ওঠে। ঘ্রাণেন্দ্রিয় কি কখনো চোখের চেয়েও বেশি সংবেদী হয়ে ওঠে না? সেই দূর সময়ের মিশরের রানী যেন কফিন ভেঙে উঠে বসেছেন এই মাত্র – এরকম অলৌকিক শৈল্পিক জাদুকরী চাল আছে গণেশ পাইনের শিল্পে। অবচেতনের রসায়নশোধিত তাঁর ছবি অতিপ্রাকৃত, নাকি পরাবাস্তব, তা না জানলেও এ-শিল্পীর ছবির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকতে হয়। তা হয়তো কখনো আমাদের রূপকথা পাঠ করায়, কখনো তা সুন্দরের সঙ্গে ভয় যোগ করে ট্র্যাজেডিরসে তৃপ্ত করে দেয়। কিন্তু গণেশ পাইনের ছবিতে মৃত্যু আছে। তাঁর ছবি মৃত্যুগন্ধী। সেই গন্ধ আমরা দূরাতীত কাল থেকে পেয়ে আসছি। আমাদের রক্তের বীজেই মৃত্যুর বার্তা। অনেক আগে মরে যাওয়া মৃতদের পাশে আমিও নবীন চোখে ও ঘ্রাণশক্তিতে সময়ের মধ্যে মৃত্যুর ছায়া দেখছি। ঘ্রাণ পাচ্ছি।
গণেশ পাইনের বিখ্যাত ছবি ‘আততায়ী’কে দেখে মন যে ভয়ে বিস্মিত হয়ে থাকে তার কারণ আততায়ীর মুখ নয়, খাপ থেকে অংশত বেরিয়ে আসা তলোয়ারও নয়, বরং এই দুই বিষয় ঘিরে যে টেক্সচার ও টুকরো-টাকরা গড়ন রয়েছে তার মধ্যেই প্রকাশ পাচ্ছে সন্ত্রাস, সন্ত্রস্ত মুহূর্ত, আততায়ীর হিংস্রতা। তাঁর ছবির ক্রূরতার পুরাতত্ত্বে মানুষের ইতিহাস পাঠ – অনেক ছবিই তাঁর এ সত্য জানাতে চায়।

Leave a Reply