logo

খালেদদার সঙ্গে

দে বা শী ষ  দে ব

খালেদদার সঙ্গে আমার আলাপ হয় দীর্ঘদিনের বন্ধু ও সহকর্মী সুদেষ্ণার মাধ্যমে। আমি অবশ্য আগে থেকেই ওঁকে চিনতাম, প্যান্ট-শার্টপরা, ঝোলা কাঁধে, সাদাসিধে চেহারার মানুষটিকে বহুবার দেখেছি নিজের মনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বিভিন্ন প্রদর্শনীতে কিংবা গানের অনুষ্ঠানে। প্রথম প্রথম ওঁর কাছে যেতাম যখন উনি পার্ক সার্কাসে একটা বাড়িতে একাই থাকতেন। গেলেই নিজের হাতে তৈরি special কফি খাওয়াতেন, সেই সঙ্গে দীর্ঘ আড্ডা চলত। ধীরে ধীরে ওঁর সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে পারলাম। সম্পর্কে গুরুসদয় দত্তর নাতি উনি – original নাম ছিল চিররঞ্জন চৌধুরী, জন্মেছিলেন আসামের করিমগঞ্জে ১৯১৯ সালের ২০ ডিসেম্বর। নয় বছর বয়সে মায়ের মৃত্যুর পর বাবার অত্যাচারে শেষ পর্যন্ত বাড়ি ছেড়ে চলে আসেন সিলেট শহরে, বয়স তখন সতেরো। আশ্রয় নেন এক মুসলমান পরিবারে, যেখানে থাকার সময়ে নিজের নাম পাল্টে করে নেন ‘খালেদ’ – মানে চিরস্থায়ী।

নিজে ছবি আঁকি, তাই আমার খুব ইচ্ছে ছিল খালেদদার শিল্পীজীবন সম্পর্কে ভালোভাবে জানার। এমনিতে self taught উনি – ছোটবেলা থেকেই lettering-এর হাত ভালো, তাই IPTA-র poster লেখার ভার পড়ত তাঁর ওপর। একবার অযান্ত্রিক সিনেমাটা করার সময় পরিচালক ঋত্বিক ঘটক poster-এ শিল্পীদের নামগুলো খুব ছোট হরফে লিখতে বলেছিলেন। সেই জন্য অভিনেতা কালী ব্যানার্জি খালেদদার ওপর ভীষণ চটে যান – ‘অথচ কালী আমার বাড়ির মেঝেতে দিনের পর দিন গড়াগড়ি খেয়েছে’ – হাসতে হাসতে গল্পটা শুনিয়েছিলেন খালেদদা।

একবার ছবি অাঁকার প্রসঙ্গেই আমার outdoor study-র কথা উঠল, হঠাৎ উনি উঠে গিয়ে বেশ কিছু বিলিতি তুলি নিয়ে এসে আমাকে বললেন – ‘এগুলো আমি কোনোদিন ব্যবহার করিনি, সৌমিত্র (চট্টোপাধ্যায়) বহুদিন আগে বিলেত থেকে আমার জন্য নিয়ে এসেছিল, এগুলো তোমাকে দিলাম’ – আমি তো হতবাক। পরে অবশ্য দেখলাম, পড়ে থেকে থেকে একটাও আর ব্যবহারযোগ্য অবস্থায় নেই। তবু খালেদদা নিজের হাতে দিয়েছেন, কাজেই আমার কাছে এর মূল্যই আলাদা।

এরপর খালেদদার বয়স বেড়েছে, সেই সঙ্গে গুরুতর অসুখ বাধিয়ে বসেছেন, ফলে পার্ক সার্কাসের পাট চুকিয়ে চলে এসেছেন গড়িয়াহাট অঞ্চলে বহুকালের সঙ্গী অমিতাদির বাড়ি। প্রায় সাত বছর হলো এটাই তাঁর স্থায়ী ঠিকানা। বাড়ির কাছে হওয়াতে আমার পক্ষেও খালেদদার খোঁজখবর নেওয়াটা বেশি সুবিধের হয়ে গেল। ইতোমধ্যে ২০০৯ সালে উনি নববই বছরে পা রেখেছেন, আর তখনই আমার মনে হয়েছিল ভালো করে ওঁর একটা interview নেওয়া দরকার। এতদিন ধরে বহু আড্ডা হয়েছে কিন্তু কোনো কিছুই তো record করা হয়নি। ফলে ২০১০-এর জানুয়ারি মাসের এক সন্ধ্যায় গিয়ে বসলাম ওঁর মুখোমুখি। ইদানীং সপ্তাহে তিনদিন ওঁকে ডায়ালিসিস নিতে হচ্ছে। এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি, নাটক দেখা এসব প্রায় বন্ধ – গাড়ি করে কেউ নিয়ে গেলে তবেই যান, সেও কালেভদ্রে। তবে বাড়িতে উনি খোশমেজাজেই থাকেন – স্মৃতিশক্তি এখনো যথেষ্ট অটুট – গুছিয়ে কথা বলতে বিশেষ আটকায় না। ফলে প্রায় নববই মিনিট ধরে নেওয়া ইন্টারভিউতে ওঁর শিল্পীজীবনের বহু অজানা তথ্য খুব সুন্দরভাবে বেরিয়ে এলো। এর পরের চিন্তা এটা কোথায় ছাপানো যায় তাই নিয়ে। কলকাতায় দু-একটা কাগজের সঙ্গে কথা বলেছিলাম বটে, কিন্তু পুরোপুরি সবুজ সংকেত আসছিল না। এই অবস্থায় হঠাৎ-ই সুশীল সাহা মশাই প্রস্তাব দিলেন – এটা শিল্প ও শিল্পীতে দেওয়ার জন্য। হাজার হোক বাংলাদেশের সঙ্গে ওঁর একটা সম্পর্ক তো রয়েছেই। বলতে গেলে ওঁর ছবি অাঁকার হাতেখড়ি তো ওখানেই – তাই এককথায় রাজি হয়ে গেলাম। আমার বিশ্বাস, এই ইন্টারভিউ সবার ভালো লাগবে – আর সব থেকে খুশি হব আমি যদি ছাপার পর শিল্প ও শিল্পীর একটা কপি নিজে গিয়ে খালেদদার হাতে তুলে দিতে পারি।

Leave a Reply