মৃ ণা ল ঘো ষ
কে জি সুব্রহ্মণ্যন্কে (১৯২৪-২০১৬) বলা যেতে পারে শামিত্মনিকেতনে রাবীন্দ্রিক উত্তরাধিকারের অন্যতম শেষ প্রতিনিধি। অমত্মত শিল্পকলার ক্ষেত্রে। মানুষের ভিতর মনন ও সৃজনময় মানবতার বহুমুখী উন্মেষের যে স্বপ্ন দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, শিল্পকলার ক্ষেত্রে তার সার্থক রূপ পরিস্ফুট হয়েছে নন্দলাল বসু, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, রামকিঙ্কর প্রমুখ শিল্পীর মধ্যে। সেই ধারাবাহিকতারই উজ্জ্বল এক প্রতিনিধি ছিলেন সুব্রহ্মণ্যন্। সকলের একামত্ম প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় মানিদা। তাঁর প্রয়াণের (২৯ জুন ২০১৬) পর এরকম বহুমুখী প্রতিভা আর খুব বেশি অবশিষ্ট রইল না।
বহুমুখী কথাটি তাঁর ক্ষেত্রে প্রকৃত অর্থেই প্রযোজ্য। একাধারে তিনি ছিলেন চিত্রকর, ভাস্কর, ভিত্তিচিত্রকর (ম্যুরালিস্ট), ছাপচিত্রী, স্বতঃস্ফূর্ত লেখক, কবি, শিল্পতাত্ত্বিক ও শিক্ষক। ছোটদের জন্য লিখেছেন, গ্রন্থচিত্রণ করেছেন, ছোটদের খেলনার নকশা তৈরি করেছেন, গড়েছেনও সেসব কৌতুকদীপ্ত খেলনা। বস্ত্রবয়ন শিল্পের নকশা প্রস্ত্ততেও তাঁর অবদান স্মরণীয়। নাটকের জন্য মঞ্চ ও পোশাক পরিকল্পনাতেও রেখেছেন নিজস্ব ভাবনার পরিচয়। শিল্পসৃষ্টির ক্ষেত্রেও তাঁর প্রকরণ-চর্চা ছিল অনেক বিসত্মৃত। নানা মাধ্যমে কাজ করেছেন। জলরং – স্বচ্ছ ও অস্বচ্ছ, তেলরং, অ্যাক্রিলিক – এসব তো আছেই। কাচের ওপর বা অ্যাক্রিলিক শিটের ওপর বিপরীতক্রমে অাঁকাতেও নিজস্ব ঘরানা তৈরি করেছেন তিনি। টেরাকোটার রিলিফ-ভাস্কর্যে বিশেষ এক রূপ এনেছেন। যেখানে লৌকিকের স্মৃতি আধুনিকতায় উন্মীলিত হয়েছে। নবজাগরণের ব্যক্তিত্ব বা রেনেসাঁস পার্সোনালিটি বলতে যা বোঝায়, তার কিছু আভাস থাকে তাঁর সৃজনময়তায়।
তাঁর সমসত্ম কাজেই কবিসত্তার প্রচ্ছন্ন উপস্থিতি ছিল। ১৯৮৩ সালে কলকাতার বিড়লা অ্যাকাডেমিতে অনুষ্ঠিত তাঁর পূর্বাপর প্রদর্শনী উপলক্ষে প্রকাশিত এক স্মারকপত্রের সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন তাঁর শিল্পপ্রয়াসে বাসত্মবের অমত্মর্নিহিত কাব্যময়তার কথা। ‘We were seeking a kind of poetry of the real.’ কবিত্বচেতনার বাইরের আবরণ বা বাতাবরণই শুধু নয়, তাঁর ছবির নির্মাণ-পদ্ধতির ভিতর ছিল আপাত-অসংলগ্ন যে মমত্মাজধর্মী দৃশ্যাবলির সমাহার, প্রতিটি একক প্রতিমাকল্পের কৌতুকদীপ্ত ছন্দোময়তাকে তিনি যেমন সমগ্রের ছন্দে একাত্ম ও স্পন্দিত করে তুলতেন, তার ভিতর থেকেই কবিতার এক অমত্মর্দীপ্তি উদ্ভাসিত হতো। তাঁর ছবিতে অনেক সময়ই আখ্যানের আবেশ থাকে। কিন্তু সে আখ্যানে কখনোই তিনি বৃত্তীয় সম্পূর্ণতা আনেন না। প্রতিমার এককগুলি নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যে পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। সেই বিচ্ছিন্নতার মধ্য দিয়ে ‘কনসেপ্ট’ বা ভাবনাবৃত্তের এক পূর্ণতার বোধ জাগে। এর মধ্যেই অনুভব করা যায় আজকের আধুনিক কবিতার অনুরণন।
দৃশ্যতা যখন স্বাভাবিকতার বন্ধন থেকে মুক্ত হয়, তখনই তার ভিতর কাব্যের আত্মার সঞ্চার ঘটে। সেই সঞ্চারই তার ভিতর বাসত্মবের নিহিত সত্যের স্পন্দন আনে। তাঁর ছবিতে তিনি বলেছেন ‘বিকল্প উপস্থিতি’র কথা। তাঁর ভাষায়, ‘Existence of alternative presences.’ (১৯৯৪ সালে কলকাতার সিমা গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত প্রদর্শনীর স্মারকপত্রে শিল্পীর লেখা ভূমিকা – Bahurupee : A Polymorphic Vision) এই বিকল্পের এক প্রামেত্ম রয়েছে পরিচিত বা অনুভবগম্য বাসত্মবের প্রতিফলন, অন্য প্রামেত্ম মগ্নচেতনা উৎসারিত ও পুরাণকল্প উদ্ঘাটিত এক কল্পপ্রতিমা। এই দুইয়ের সংশেস্নষ থেকে জেগে ওঠে যে দৃশ্যমান চিত্রকল্প, তা নৈসর্গিককে অনৈসর্গিকের আলোয় উদ্ভাসিত করে। এভাবেই তাঁর দৃশ্যতা কবিতা-প্রাণিত হয়ে ওঠে।
ছবিতে তিনি যেমন কবিতার অনুভব জাগান, তেমনি তাঁর কবিতাতেও থাকে চিত্রময়তা। আমরা জানি, সুব্রহ্মণ্যন্ একজন বিদগ্ধ লেখকও। তাঁর শিল্পকলা বিষয়ক লেখাগুলি অত্যমত্ম মননদীপ্ত এবং প্রাঞ্জল। তাঁর চিমত্মার স্বচ্ছতা ছবিতে যেমন পরিস্ফুট হয়, তেমনি লেখাতেও। কাব্যধর্মী অনেক ব্যক্তিগত লেখা তিনি লিখেছেন। পরিহাসদীপ্ত মননোজ্জ্বল সেই লেখা পড়লে এই জীবন ও বিশ্বপ্রবাহের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের আদলটি বোঝা যায়। এই লেখাগুলি খুবই ‘চিত্ররূপময়’। কিন্তু সেই ছবি চিত্রপটে অাঁকা যায় না। তা এতটাই চিত্রপ্রতিমা-নিরপেক্ষ। ছবির ভিতর এই যে ছবির বিলয়, যা আমরা তাঁর কবিতাতে দেখি, তাঁর ছবিতেও এর এক সমামত্মরলতা বা সমধর্মী প্রতিফলন আছে। তাঁর ছবিকবিতার মতোই ছন্দিত। আধুনিক কবিতার মতোই মমত্মাজধর্মী। আপাত-অসংলগ্ন দৃশ্যপ্রতিমার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা। কাব্যের সমসত্ম গুণাবলিকে আত্মস্থ করে, তা কাব্যের বিমূর্ততাকে বিসর্জিত করে। উত্তীর্ণ হয়ে যায়।
আমরা তাঁর কবিতা থেকে দুটি দৃষ্টামত্ম উদ্ধৃত করে বুঝতে চেষ্টা করব তাঁর কাব্যচেতনার স্বরূপ। প্রথমটি একটি গ্রীষ্মের বর্ণনা। দিলিস্নর আর্ট হেরিটেজে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯১-৯২ সালে।
It is like a forest of many suns
This summer noon.
Every side one’s shadow falls
It is nibbled away
By a Counter-shining sun
At once
I wonder whether there can be
Substance without shadow.
ছায়াহীন, প্রতিফলনহীন কোনো বস্ত্ত কি সম্ভব? মূর্তের এই অমূর্ততা এই কবি বা শিল্পীকে বিস্মিত করে। এই বিস্ময় তাঁর ছবিরও অমত্মর্নিহিত বাণী। ছবিতে কখনো বিমূর্তের দিকে যাননি সুব্রহ্মণ্যন্। কিন্তু মূর্তকে প্রতিনিয়তই অমূর্তে উদ্ভাসিত করেছেন। এখানেই তাঁর ছবির কাব্য-প্রাণতা।
কবিতার দ্বিতীয় দৃষ্টামত্মটির দিকে এবার দৃষ্টিপাত করব আমরা। এটিও প্রকাশিত হয়েছিল ‘আর্ট হেরিটেজে’ই ১৯৯৮ সালে। যে ‘নোটবুকে’র অমত্মর্গত এই কবিতাংশ সেখানে তিনি মু চি (Mu Chi) নামে এক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সংলাপে মগ্ন ছিলেন। সংলাপ-অমেত্ম কবিতার এ শব্দমালা উৎসারিত হয়েছে। এই সংলাপ চকিতে আমাদের বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের ‘কত্তামশাই’-এর অনুষঙ্গ মনে পড়ায়। রূপ থেকে এই কল্পরূপের দিকে যাওয়া কত্তামশাইয়ের একটি বৈশিষ্ট্য, যদিও বিনোদবিহারীর ছবিতে তা ততটা নেই। কিন্তু সুব্রহ্মণ্যনের ছবিতে আছে। কবিতার এই অংশটিতে দেখব সেই কল্পরূপেরই আরেকটি ধরন।
You sit at the window
And see the sunsets glow
Tinting the shiny roofs that slope towards
the sea
And breaking the sombre shadows that lurk
below
With sudden streaks of foam
Changing from pallid pink to deep incarnadine
Then the eye turns in
And the mind starts moving in a time-lost land,
Once known, now nameless, real but
undefined.
With trees of forlorn visage, wind-blown plants
And pains that open forward and close behind
Step to unforeseen step.
সময়-হারানো দেশে মনের এই পরিভ্রমণ, যে দেশ একদিন চেনার কূলে ছিল কিন্তু এখন অপরিচয়ে বিলীন, অসিত্মময় অথচ সংজ্ঞাহীন, ‘Once known, now nameless, real but undefined’, যেখানে বেদনা উন্মোচিত হয় এবং মিলিয়ে যায় দৃশ্যাতীত পদচিহ্নে, শিল্পী তাঁর রূপকে সেই অরূপের দিকেই নিয়ে যেতে চান। কবিতায় এটা যত সহজে করা যায়, ছবিতে তা ততটা সহজ নয়। ছবিতে দৃশ্যের ভার লেগে থাকে। দৃশ্যহীনতা বা বিমূর্ততাকে প্রশ্রয় দেন না শিল্পী। রূপের ভিতর দিয়েই অরূপকে ছুঁতে চান। এইখানে তাঁর কবি-প্রজ্ঞা তাঁকে সাহায্য করে।
কেমন করে ছবিতে এটা তিনি করেন, কেমন করে বাসত্মবকে বাসত্মবাতীতে, নৈসর্গিককে অনৈসর্গিকে নিয়ে যান তিনি, সেটা আমরা বোঝার চেষ্টা করব তাঁর বিশেষ একটি ছবি দেখার অনুষঙ্গে। ১৯৮১ সালে অাঁকা সেই ছবিটির শিরোনাম ‘Reverie of An Armyman’s wife’. অ্যাক্রিলিক শিটের ওপরজলরং ও তেলরঙে অাঁকা এই ছবিটিতে শিল্পী তাঁর এক বাসত্মব অভিজ্ঞতাকে বর্ণনা করেছেন। একটি ট্রেনযাত্রার সময় একজন সেনা-আধিকারিকের উচ্ছ্বাসময় ও গর্বোদ্ধত কথাবার্তা তিনি শুনেছিলেন। সেই স্মৃতি থেকেই গড়ে উঠেছে ছবিটি। এখানে একটি আখ্যানের আভাস আছে। সেই আখ্যান আবার ভেঙেও যায় ব্যাপ্ততর দৃশ্যাবলির বিসত্মারে। ছবিটি দ্বিমাত্রিকভাবে অাঁকা। তাঁর প্রায় সব ছবিই তাই। মাত্রা-বিন্যাসে ও বর্ণপরিকল্পনায় মাতিসীয় পরিম-ল থাকে। এখানেও আছে। নিম্নাংশে মধ্যবর্তী অংশে এক উপবিষ্ট মহিলার আবক্ষ প্রতিমাকল্প দেখা যাচ্ছে। এই মহিলাই নিজেকে জাহির করছেন তার উচ্ছ্বাসময় কথাবার্তায়। বাঁ-পাশে রঙিন চশমা পরা এক পুরম্নষের মুখের পার্শ্বচিত্র। দুটি মুখেই উচ্চকোটির সামাজিক অবস্থানের আবহম-ল। এর ওপরে রয়েছে আরেকটি যুগলের ছবি। ট্রেনের কামরায় যেরকম হয়।
ছবিটির চিত্রক্ষেত্র, পিকটোরিয়াল স্পেস যাকে বলে, ছটি আয়তাকার পরিসরে বিভাজিত। এর প্রথম তিনটি পরিসর আমরা দেখলাম। একে বলা যেতে পারে নাগরিক পরিসর বা আর্বান স্পেস। আধুনিক নাগরিক সভ্যতা মানুষকে যা করেছে, তারই প্রকাশ এখানে। এখানে মানুষ গর্বোদ্ধত। আপন মহিমা প্রতিষ্ঠায় ব্যাপৃত। বাইরের পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আত্মপ্রচারে মগ্ন। বাকি যে তিনটি পরিসর, সেখানে আমরা পাই অন্য এক আবহ। সেখানে প্রকৃতি আছে, ফুল আছে, আকাশ আছে। পাখি ওড়ে। মানুষের সঙ্গে পাখির সংলাপ চলে। প্রথম তিনটি পরিসরে দেখলাম মানুষের বদ্ধতা। আর শেষোক্ত এই তিনটি পরিসরে শিল্পী এঁকেছেন মানুষের চেতনার মুক্তির আলেখ্য।
ডানপাশে নিম্নাংশে একঝাঁক সূর্যমুখী ফুটে আছে। তার ওপরে এক গ্রামীণ মানবীর মুখ। পেছনে একটি গৃহপালিত গাভী আনন্দে ডাকছে। একেবারে ওপরের দুটি বর্গাকার ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই নিবিড় নীল আকাশ। ডানপাশের পরিসরে উড়মত্ম দুটি পাখি পারস্পরিক প্রেমে মগ্ন। বাঁ-পাশের পরিসরে আরেকটি উড়মত্ম পাখি। এক মানবীর সঙ্গে যেন তার সংলাপ চলছে। শিল্পী আজকের জীবনের দুই বিপরীত প্রামত্মকে একসঙ্গে গ্রথিত করেছেন এই ছবিতে। এভাবে এক সামাজিক দায় বা প্রতিবাদী চেতনা পরিস্ফুট করেন তিনি।
এই ছটি ফ্রেমে রয়েছে ছন্দোময়তা বা লিরিসিজমের দুটি বিশেষ ধরন। প্রথম তিনটিতে তা সংঘাতময়। শেষোক্ত তিনটিতে তা সাবলীল, অনির্বচনীয়তায় অন্বিত। তার দ্বিমাত্রিক রূপকল্পগুলি ঐতিহ্যগত লৌকিকের পরম্পরা থেকে আহৃত। কখনোবা
পপ-আর্টের সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রতিটি ফ্রেম একটি স্বতন্ত্র আখ্যান। মমত্মাজ-পদ্ধতিতে গ্রথিত হয়ে সামগ্রিক এক ভাবনাবৃত্ত বা কনসেপ্ট তৈরি করেছে। এই ‘লিরিসিজম’ এবং আপাত-বিচ্ছিন্ন রূপকল্পকে সামগ্রিক এক চিত্রপ্রতিমা গড়ে তোলার যে প্রয়াস, এর মধ্য দিয়েই পরিস্ফুট হয় কাব্যলোক বা কবিতার আবহ। এভাবে তাঁর কাব্যচেতনা ও চিত্রচেতনার মধ্যে অসংজ্ঞায়িত এক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। বিপরীতের যে অবস্থান জীবনজুড়ে, ভাঙা এবং গড়া, ঔদ্ধত্য এবং বিনতি, ধ্বংস এবং সৃষ্টি – এরই কৌতুকদীপ্ত প্রজ্ঞাময় সংশেস্নষ থেকে গড়ে উঠেছে তাঁর বিশ্বদৃষ্টি।
দুই
যে ছবিটিকে একটু নিবিষ্টভাবে দেখার চেষ্টা করলাম আমরা, তার সেই নিজস্ব আঙ্গিক বা ভাবনাবিশ্বে পৌঁছেছেন কে জি সুব্রহ্মণ্যন্ ১৯৮০-র দশকে। তার আগে অনেক নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাঁকে। রূপজগতের অনেক পথপরিক্রমা করতে হয়েছে। ১৯৪০-এর দশক তাঁর শিক্ষানবিশির কাল। শামিত্মনিকেতনে অর্জিত শিল্পবোধ নিয়ে তিনি অনুশীলন করে গেছেন পঞ্চাশের দশকজুড়ে। এই দশকেরই মাঝামাঝি তিনি লন্ডনে গেছেন। পাশ্চাত্য রূপরীতিকে আত্মস্থ করেছেন পঞ্চাশের দশকের দ্বিতীয়ার্ধজুড়ে। ষাটের দশকজুড়ে চলেছে দেশীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে পাশ্চাত্য-আধুনিকতার সংশেস্নষের প্রয়াস। সেই সংশেস্নষ সম্পূর্ণ হতে সময় লেগেছে প্রায় ১৯৭০-এর দশক পর্যমত্ম। কাজেই সুব্রহ্মণ্যনের নিজস্বতায় পৌঁছানোর পথটা একটু দীর্ঘ।
আমাদের দেশের আধুনিক বা আধুনিকতাবাদী আন্দোলনগুলির কোনোটির সঙ্গেই তাঁর রূপচেতনাকে ঠিক
মিলিয়ে নেওয়া যায় না। ১৯৪০-এর দশকের যে শিল্প-আন্দোলন, যার দুটি ধারার প্রতিনিধি হিসেবে আমরা গণ্য করতে পারি একদিকে চিত্তপ্রসাদ, সোমনাথ হোর; অন্যদিকে গোপাল ঘোষ, নীরদ মজুমদার, পরিতোষ সেন বা পশ্চিমাঞ্চলের হুসেন,
হেববার, রাজা, সুজা প্রমুখ, এর কোনোটির সঙ্গেই তাঁর ছবি মেলানো যায় না। অথচ চলিস্নশের যে মূল প্রত্যয় বা ‘কনসেপ্ট’, দেশীয় লৌকিকের সঙ্গে পাশ্চাত্য আধুনিকতার সংশেস্নষ, সেটা তাঁর ছবিতেও ঘটেছে। আবার পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের যে তত্ত্ববিশ্ব, সংঘবদ্ধ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে যার রূপরীতি, প্রত্যেক শিল্পীর ব্যক্তিগত প্রকাশভঙ্গিকে মিলিয়ে নিয়েই, যার প্রধান প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য হতে পারেন ভূপেন খক্কর, গণেশ পাইন, বিকাশ ভট্টাচার্য, সুনীল দাস, যোগেন চৌধুরী প্রমুখ – সেই ধারার সঙ্গেও মিলিয়ে নেওয়া যায় না সুব্রহ্মণ্যন্কে। অথচ এরও কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য তাঁর প্রকাশে রয়ে গেছে।
এই দুটি প্রজন্মের কাছাকাছি থেকেও এর কোনোটির সঙ্গেই তাঁকে ঠিক মেলানো যায় না। যেমন বিনোদবিহারী ও রামকিঙ্করের নিবিড় সান্নিধ্যে থেকেও, তাঁদের প্রভাব থেকেও তিনি সচেষ্টভাবেই বেরিয়ে গেছেন। শেষ পর্যমত্ম যে রূপবিশ্ব তিনি তৈরি করলেন, সেখানে কিন্তু তিনি দেশীয় ঐতিহ্যকে খুবই গুরম্নত্ব দেন। ‘লোকাল’ আর ‘গেস্নাবালে’র দ্বৈতে ‘লোকাল’কে যথেষ্ট সম্মানের আসনেই বসান তিনি। ‘গেস্নাবাল’ যে হতেই হবে শিল্পকে এরকম মনে করেন না। ১৯৯৪ সালে ‘The Local and the Global’ শীর্ষক এক বক্তৃতায় বলেছিলেন : ‘I cannot see any special reason why as an artist I should have a global perspective. Many of the art forms and objects I admire, in my surroundings or in museums have not needed that perspective.’ (The magic of making গ্রন্থে অমত্মর্ভুক্ত, পৃ ১৩৬) এখানেও চলিস্নশের ভাবনাবৃত্তেই তাঁর অবস্থান। কীভাবে তিনি পৌঁছলেন তাঁর এই নিজস্ব তত্ত্ববিশ্বে, সেটা বুঝতে হলে তাঁর জীবনপথ তথা শিল্পপথটিকে আমাদের অনুসরণ করতে হয়।
কে জি সুব্রহ্মণ্যন্ জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৪ সালের ১৫ ফেব্রম্নয়ারি উত্তর কেরালার কুথুপরম্বুতে। তাঁর পরিবার ছিল তামিল ব্রাহ্মণ। তাঁর বাবা গণপতি আয়ার রেভিনিউ বিভাগে সার্ভেয়ারের চাকরি করতেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল আলামেলস্নু। তিনি ছিলেন মা-বাবার অষ্টম এবং সর্বকনিষ্ঠ সমত্মান। আটজনের মধ্যে চারজনের অকাল-প্রয়াণ ঘটেছিল। তাঁর মার ছিল সংগীত ও নাট্যকলার প্রতি আগ্রহ। তাঁর সবচেয়ে বড় দাদা ছিলেন তাঁর চেয়ে ৩০ বছরের বড়। তিনিই ছিলেন তাঁর অভিভাবক। বইয়ের প্রতি আগ্রহ জাগিয়েছিলেন তিনি সুব্রহ্মণ্যনের মধ্যে। তাঁর যখন আট বছর বয়স তখন তাঁর দাদা স্কুল-শিক্ষকতার চাকরি পান মাহেতে। কেরালার পালঘাট অঞ্চল, যেখানে তাঁরা ছিলেন, সেখান থেকে তাঁরা চলে যান কেরালারই সমুদ্র তীরবর্তী ছোট্ট শহর মাহেতে। এই মাহে ছিল ফরাসিদের অধীন। ফরাসি সংস্কৃতির পরিম-ল ছিল সেখানে।
এখানেই একটি পুরনো মন্দিরে প্রথাগত শিল্পের যে কারম্নকাজ দেখেন তিনি শৈশবে, সেটাই তাঁর মধ্যে পরম্পরাগত শিল্প সম্পর্কে বোধ প্রোথিত করেছিল। সেই ঐতিহ্যের বীজই পরবর্তীকালে ক্রমান্বয়ে অঙ্কুরিত হয়েছিল তাঁর মধ্যে। পরিণত পর্বে তাঁর নিজস্ব রূপরীতির প্রধান অবলম্বন হয়েছেদক্ষিণ-ভারতীয় পরম্পরাগত শিল্পের বিশেষ প্রকাশভঙ্গি। এই ভিত্তির ওপরই অন্যান্য উত্তরাধিকার থেকে আহৃত উপাদানকে তিনি সমন্বিত করেছেন। সেখানে পৌঁছতে অবশ্য তাঁর সময় লেগেছে অনেকটাই।
ছেলেবেলায় অসুস্থ ছিলেন বলে তাঁর স্কুলে ভর্তি হতে একটু দেরি হয়েছে। একবারে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছেন। পড়াশোনায় যথেষ্ট মেধাবী ছিলেন। সেই মেধার পরিচয় ছিল তাঁর সারাজীবনের লেখালেখি, কথাবার্তা ও অধ্যাপনায়। ১৯৪২-এ তিনি মাদ্রাজের প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন অর্থনীতিকে সাম্মানিক বিষয় নিয়ে। ১৯৪৩-এ স্নাতক হন। কলেজজীবনের গোড়া থেকেই বামপন্থী রাজনীতি ও সমাজতত্ত্বের প্রতি আকৃষ্ট হন। মার্কসবাদ নিয়ে পড়াশোনাও করেন। মহাত্মা গান্ধীর আদর্শের প্রতিও তাঁর আকর্ষণ ছিল। বিয়ালিস্নশের আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। গ্রেপ্তার হন। ছ’মাস কারাবরণও করতে হয়। কারাবরণের ফলে কোনো সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। শৈশব থেকেই তাঁর ছবি অাঁকার প্রতি ঝোঁক ছিল। কলেজে পড়ার সময় এক শুভানুধ্যায়ী তাঁর কিছু ছবি মাদ্রাজ আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরীকে দেখান। দেবীপ্রসাদ ছবি দেখে খুশি হন। বলেন, সময় নষ্ট না করে আর্ট স্কুলে ভর্তি হওয়াই তার আশু কর্তব্য।
সুব্রহ্মণ্যন্ চেয়েছিলেন ছবি অাঁকা যদি শিখতেই হয়, তাহলে শিখবেন শামিত্মনিকেতনেই। শামিত্মনিকেতনের আবহম-ল ও শিল্পীদের সম্বন্ধে ততদিনে তিনি অনেকটাই জেনেছিলেন। ওদিকে রাজনৈতিক সংযোগের কারণে তিনি পুলিশের নজরে ছিলেন। প্রয়োজন ছিল – তাঁর ওই জায়গা থেকে সরে যাওয়া। তাঁর মেজদা, যিনি পুলিশ বিভাগে চাকরি করতেন, শামিত্মনিকেতনে নন্দলাল বসুকে চিঠি লেখেন, তাঁর ভাইকে যাতে কলাভবনে তিনি ভর্তি করে নেন। নন্দলাল রাজি হলেন। ১৯৪৪ সালের ফেব্রম্নয়ারি মাসে সুব্রহ্মণ্যন্ শামিত্মনিকেতনে এলেন।
নন্দলাল তাঁকে বিনোদবিহারীর অধীনে থাকতে বললেন। বিনোদবিহারী ও রামকিঙ্কর হয়ে উঠলেন তাঁর শিক্ষক ও অগ্রজপ্রতিম বন্ধুও। তাঁদের ছত্রচ্ছায়াতেই তিনি কাজ শিখেছেন। শামিত্মনিকেতনে রবীন্দ্রনাথকে তিনি দেখেননি। তিনি আসার তিন বছর আগেই তো রবীন্দ্রনাথ প্রয়াত হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথকে তিনি যে দেখেননি এটাকে তিনি সৌভাগ্য বলেই মনে করেন। বলেছিলেন একটি সাক্ষাৎকারে – ‘কিন্তু কী ভাগ্যি যে, রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকতে আমি শামিত্মনিকেতনে যাইনি, তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি আমার। যদি দেখা হতো, তাহলে আমিও বোধ হয় ওইসব মানুষের মতো শুধু ওঁর ব্যক্তিত্ব নিয়েই কথা বলে যেতাম। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ মানে তো একটা আইডিয়া।’ (সাক্ষাৎকার কে জি সুব্রহ্মণ্যন্। দেবভাষা। কলকাতা ৭০০০৪০, ২০১৫)
এই ‘রাবীন্দ্রিক আইডিয়া’র মধ্যেই শামিত্মনিকেতনে সমৃদ্ধ হয়েছিল তাঁর শিল্পচেতনা। সেখানে তিন শিল্পী তাঁর প্রস্ত্ততিকে সমৃদ্ধ করেছিলেন – নন্দলাল, বিনোদবিহারী আর রামকিঙ্কর। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘একই সঙ্গে তিন তিনজন গ্রেট মাস্টারের সান্নিধ্য পাওয়া তো কম কথা নয়।… এঁদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে কত যে উপদেশ পেয়েছি, বলে শেষ করা যাবে না।’ (সাক্ষাৎকার : কে জি সুব্রহ্মণ্যন্। সৌরভ দে ও দেবজ্যোতি মুখোপাধ্যায়। দেবভাষা। কলকাতা-৪০। ২০১৫। পৃ ৩২-৩৩)। বিনোদবিহারীর সঙ্গে তিনি হিন্দি ভবনের ম্যুরালে কাজ করেছেন। রামকিঙ্করের পাশে বসে শামিত্মনিকেতনের মুক্তাঙ্গনে স্কেচ করেছেন। কিন্তু নিজের ছবিতে এদের প্রভাবকে তিনি উত্তীর্ণ হয়ে গেছেন। প্রথমদিকে কিছু কিছু প্রভাব অবশ্য এসেছিল। কিন্তু অতিক্রম করতে দেরি হয়নি। দেশাত্মবোধ ও জাতীয়চেতনা স্কুলজীবন থেকেই তাঁর মধ্যে উন্মীলিত হয়েছিল। কিন্তু ছবিতে নব্য-ভারতীয় ঘরানার দেশাত্মবোধকে তিনি প্রশ্রয় দেননি। শামিত্মনিকেতনেই তিনি উন্মীলিত হয়েছিলেন আবিশ্ব উত্তরাধিকারের সামনে। সেখান থেকে গ্রহণ করে নিজের ছবি গড়ে তুলতে সময় লেগেছে তাঁর।
বাংলায় চলিস্নশের শিল্পীদের সামনে বাসত্মবের যে আক্রমণ ও আহবান ছিল, তাঁর সামনে তা ছিল না। তেতালিস্নশের মন্বমত্মর সম্পর্কে তাঁর প্রত্যক্ষ কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। তাই চিত্তপ্রসাদ ও সোমনাথ হোরের আবেগ তাঁকে ছুঁতে পারেনি। রামকিঙ্করের ভিতরও এই আবেগের বিপুল আহবান ছিল। তাই তিনি অাঁকতে পেরেছিলেন ‘কৃষ্ণের জন্ম’র মতো ছবি। দুর্ভিক্ষক্লিষ্ট মানুষও এসেছে তাঁর ছবিতে। ১৯৪৬-এর সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস, সাতচলিস্নশের খ–ত স্বাধীনতা, উদ্বাস্ত্তর মিছিল সুব্রহ্মণ্যন্ অবশ্য দেখেছেন। কিন্তু তাঁর আবেগকে তা ততটা নাড়া দেয়নি, যার প্রতিফলন ঘটতে পারে ছবিতে। বিনোদবিহারীর ম্যুরাল ‘মেডিয়েভাল সেইন্টসে’ ছেচলিস্নশের সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতার বিরম্নদ্ধে একটা বার্তা তো ছিলই। সুব্রহ্মণ্যন্ কখনো আবেগতাড়িত হতে চাননি। মেধাই ছিল তাঁর শিল্পচেতনার নিয়ন্ত্রক। এজন্য নিজের ছবিতে পৌঁছতে তাঁর একটু সময় লেগেছে।
১৯৪৮-এ শামিত্মনিকেতনের শিক্ষাক্রম শেষ করে সুব্রহ্মণ্যন্ বছরতিনেক বিভিন্ন স্থানে নানা কাজে ব্যাপৃত ছিলেন। ১৯৫১ সালে বরোদার এমএস বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি অব ফাইন আর্টসে শিক্ষকতায় যোগ দেন। এন এস বেন্দ্রে ও শঙ্খ চৌধুরী সেখানে কাজ করছিলেন সেখানকার শিক্ষাধারাকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে। এই কাজে তাঁদের সঙ্গে সুব্রহ্মণ্যন্ও যুক্ত হলেন। বরোদায় তিনি ছিলেন ১৯৮০ পর্যমত্ম। ইতোমধ্যে ১৯৫৫ সালে ব্রিটিশ কাউন্সিল স্কলারশিপ পেয়ে তিনি ইংল্যান্ডে যান। লন্ডনের সেস্নড স্কুলে দুবছর (১৯৫৫-৫৬) অধ্যয়ন করেন। লন্ডন যাওয়ার আগে দিলিস্ন শিল্পী চক্রের উদ্যোগে তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। বিগত ছবছরে করা কাজ থেকে নির্বাচিত ছবি তিনি সেখানে দেখান। সেসব ছবিতে বিনোদবিহারী ও রামকিঙ্করের প্রভাব কিছু ছিল। ১৯৪৯ সালে করা তেলরঙের ক্যানভাস ‘উওম্যান অ্যাট ট্যাপ’, রাসত্মার কল থেকে জল তুলছে এক নারী বা একই বছরের ‘থ্রি উইমেন’ ছবিতে (জলরং) তুলি চালনায় রামকিঙ্করের প্রভাব ছিল। ১৯৫২ সালে তিনটি জলরং ‘গার্ল উইথ সানফ্লাওয়ার’ বা ‘সিটেড ফিগার’ বা ‘গার্লস ইন ইনটেরিয়রে’ বিনোদবিহারীর ছন্দিত কমনীয়তার প্রভাব সুস্পষ্ট।
সেস্নড স্কুলে তিনি ছাপচিত্র বা গ্রাফিক আর্টকেই নির্বাচন করেছিলেন তাঁর প্রশিক্ষণের বিষয় হিসেবে। ব্রিটিশ শিল্পী বেন নিকলসনের একটি প্রদর্শনী দেখেন সেখানে। নিকলসনের ছবি তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল খুব। কিউবিস্ট ভাঙনের সঙ্গে অলংকরণময়তাকে যেভাবে মিলিয়েছিলেন নিকলসন, সুব্রহ্মণ্যন্ সেটাকে প্রয়োগ করতে চেষ্টা করেন তাঁর নিজের ছবিতে। পিকাসো সম্পর্কেও খুবই আগ্রহী ছিলেন তিনি। পিকাসো ছিলেন তাঁর প্রিয় শিল্পীদের মধ্যে প্রধান। পিকাসো সম্পর্কে তিনি পূর্বোক্ত সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আদিম শিল্পের থেকে তিনি এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আত্তীকরণ করে নিতে পেরেছিলেন, যেটা তাঁর হাতে গিয়ে অনন্যসাধারণ হয়ে উঠল। পিকাসো একই সঙ্গে আদিম ও আধুনিক’ (পৃ ৫৪)। ইংলন্ড অধ্যায়ের পর থেকে সুব্রহ্মণ্যনের ছবিতে কিউবিজমের কিছু বৈশিষ্ট্য আত্তীকৃত হতে লাগল। তিনি অবশ্য পছন্দ করতেন সিনথেটিক কিউবিজমের সমন্বয়ী প্রক্রিয়া, কৌণিক বিশেস্নষণাত্মক অ্যানালিটিক্যাল কিউবিজম ততটা নয়।
১৯৫৫ সালে করা ‘ন্যুড অন চেয়ার’ ছবিতে (লিনোকাট) অবশ্য বিশেস্নষণাত্মক বা অ্যানালিটিক্যাল কিউবিজমের স্বাক্ষর অনেকটা রয়েছে। ওই বছরেরই লিনোকাটে করা ‘টু উইমেন’, ‘মেন উইথ ফ্রুটকার্ট’ ছবিতে সেই কৌণিকতা অমত্মর্হিত হয়ে সমন্বয় প্রক্রিয়াই প্রাধান্য পায়। ১৯৬০-এর দশকের গোড়ায় তিনি করতে থাকেন কিছু স্টিল লাইফধর্মী ছবি, যেখানে সিনথেটিক কিউবিজমের বৈশিষ্ট্যই আত্তীকৃত হতে থাকে। ছবির বিষয় হয়ে ওঠে উপলক্ষ মাত্র। আঙ্গিক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষাই ষাটের দশকে তাঁর আত্মানুসন্ধানের প্রধান অভিমুখ হয়ে ওঠে।
তিন
১৯৫৬ সালে লন্ডনে সেস্নড স্কুলের শিক্ষা শেষ করে তিনি আবার বরোদার শিক্ষকতায় যোগ দেন। ১৯৫৯-এ হ্যান্ডলুম বোর্ডের ডেপুটি ডিরেক্টর-ডিজাইন হিসেবে তাদের বম্বে অফিসে নিযুক্ত হন। এই চাকরিতে সারাদেশের বস্ত্রবয়ন শিল্পের নানা দিকের সঙ্গে তাঁর সংযোগ ঘটে। এই সূত্রে ভারতের লৌলিক প্রজ্ঞার নানাদিক উদ্ভাসিত হয় তাঁর সামনে। এছাড়া বরোদা
কলাভবনের উদ্যোগে যেসব শিল্পমেলা হতো, তাতেও নানা শিল্পদ্রব্য নির্মাণের পরিকল্পনা নিতে হয়েছে তাঁকে। শামিত্মনিকেতনে তো সেই ঐতিহ্য ছিলই। এসব মিলিয়ে লৌকিক বিশ্বকে তিনি নিজের মতো করে স্বতন্ত্র মাত্রায় আবিষ্কার করেন। দক্ষিণ-ভারতীয় আদিম-লৌকিকের অনুভব তো তাঁর মধ্যে শৈশব থেকে সমত্মর্পণে কাজ করেছে।
১৯৬১ সালে যখন রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উদ্যাপিত হচ্ছে সারাদেশে, তখন লখনৌয়ের রবীন্দ্রালয় প্রেক্ষাগৃহের সামনে বাইরের দেয়ালে তিনি একটি ম্যুরাল নির্মাণের দায়িত্ব পেলেন। রবীন্দ্রনাথ রাজা নাটক অবলম্বনে, ইংরেজিতে যেটা ‘কিং অব দ্য ডার্ক চেম্বার’ ম্যুরাল করার পরিকল্পনা করলেন। ৮১ ফুট দীর্ঘ, চার ফুট চওড়া এই ম্যুরালটি তিনি করেছিলেন গেস্নজড টাইল জুড়ে জুড়ে। সমগ্র বিষয়টি ছোট ছোট অংশে ভাগ করে নিয়েছিলেন। সে অনুযায়ী টাইলস তৈরি করিয়েছিলেন। ছোট ও বড় আকারের প্রায় ১৩ হাজার টাইলস থেকে প্রয়োজনমতো নির্বাচন করে তিনি তৈরি করেছিলেন এই ম্যুরাল। ১৯৬২ সালে শুরম্ন করে শেষ করেছিলেন ১৯৬৩ সালে। একই সময়ে ছবিতে তিনি করে যাচ্ছিলেন পোস্ট কিউবিস্ট আঙ্গিকে স্টিল লাইফ নিয়ে কাজগুলি। কিন্তু এই ম্যুরালে তিনি একেবারে বিপরীতধর্মী রূপরীতির অনুধ্যান করলেন। লৌকিকের সারল্যের সঙ্গে ধ্রম্নপদী অনুভবের অমত্মরগূঢ় মগ্নতাকে মিলিয়ে নিলেন। তাঁর পরবর্তী বিবর্তনের একটি সূত্র উঠে এলো এখান থেকে।
এই যে ছোট ছোট একককে মিলিয়ে পূর্ণ ছবির মগ্নতার দিকে যাওয়া, তার সূচনা হয়েছিল সম্ভবত এই ম্যুরালের অভিজ্ঞতা থেকে। এই ম্যুরালে যে ছোট ছোট গেস্নজড টাইলসের এককগুলি, তারা প্রত্যেকেই আপনি আপনাতে সম্পূর্ণ। অথচ এদের পারস্পরিক সহাবস্থান অন্য এক অবয়ব ও আখ্যানের সঞ্চার ঘটাচ্ছে। ছবিতে ক্রমে ক্রমে এই নির্মাণ-পদ্ধতিই তিনি প্রয়োগ করেন।
১৯৬০-এর দশকে তিনি যে ছবিগুলি অাঁকছেন, তাতে লৌকিকের এই অভিজ্ঞতার সঙ্গে পাশ্চাত্যের পোস্ট-কিউবিস্ট অভিজ্ঞতার নানারকম বোঝাপড়া চলছে। ১৯৬৪-এর একটি ছবি আছে, যার শিরোনাম ‘আর্টিস্ট অ্যান্ড মডেল’। ক্যানভাসের ওপরে তেলরঙে অাঁকা। ছবিটিতে এক মানবী মূর্তি রয়েছে। দুহাত প্রসারিত করা। এর বিপরীতে উপবিষ্ট এক পুরম্নষ মূর্তিও রয়েছে। সম্ভবত অঙ্কনে উদ্যোগী শিল্পী। মাঝখানে একটি টেবিল। তাতে স্টিল লাইফ ধরনে নানা বস্ত্তর উপস্থিতি। এটুকু যে আখ্যানের উপস্থাপনা, সেটা খুব বেশি প্রাধান্য পায়নি। অবয়ব-নিরপেক্ষ অলংকরণধর্মী জ্যামিতিক নির্মাণ-সৌকর্যই ছবিটির মূল উপজীব্য। বিষয় ও আঙ্গিকেও পিকাসোর একটা পর্যায়ের রূপপদ্ধতি আত্তীকৃত করার প্রয়াস এখানে।
এখন নির্মাণ-পদ্ধতি নিয়েই তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষা। চিত্রীয় পরিসরের সঠিক বিন্যাস নিয়ে ভাবছেন। নিরাবেগ মেধার ওপরই জোর পড়ছে বেশি। ১৯৬৮-র একটি ছবি ‘উইন্ডোজ-২’। পস্নাইবোর্ডের ওপর তেলরঙে অাঁকা। বেশ বড়মাপের ছবি, ১৩৭.৫x১৩৭ সেমি আকারের। ওপরে-নিচে তিনটি সারি ও কলামে ৩x৩ বর্গাকার পরিসরে বিভাজিত এখানে চিত্রক্ষেত্র। প্রতিটি বর্গক্ষেত্রও আবার একাধিক আয়তাকার ক্ষেত্রে বিভাজিত। বস্ত্ত বা প্রাণীর অবয়ব কিছু নেই। তবু কোনো কোনো প্রতিমাকল্পে সামান্য অবয়বের আভাসও আসে, যদিও তা সঠিকভাবে শনাক্ত করা যায় না। ঋজু রেখা ও জ্যামিতিক ক্ষেত্রের সুষম ডিজাইন হিসেবে ছবিটি মনোগ্রাহী। আমরা আগে বলেছিলাম, তাঁর ছবিতে পূর্ণ বিমূর্তের উপস্থিতি বেশি নেই। কিন্তু এই ছবিটির দৃষ্টামেত্ম বলা যায়, ষাটের দশকে যখন তিনি পরিসর ও রূপ বা স্পেস ও ফর্মের সম্পর্ক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন, তখন এরকম কিছু কিছু নিরবয়ব ছবি এসেছে। কিন্তু এগুলিকে বলা যায় তাঁর অনুশীলনধর্মী কাজ। নিজস্ব তত্ত্ববিশ্বের ইঙ্গিতবাহী নয়।
ষাটের দশকের শেষে সত্তরের শুরম্নতে তিনি যখন টেরাকোটা টাইলসে কাজ করছেন, তখন এই বর্গাকার পরিসর বিভাজনের মধ্যেও অবয়বী, সরলীকৃত লৌকিক রূপ স্বতঃস্ফূর্তভাবে উৎসারিত হচ্ছে। ১৯৭১-এর ‘হান্টার’ শীর্ষক রচনাটিতে ওপরের মাঝখানের একটি ফ্রেমে শুধু রয়েছে শিকারির উপস্থিতি। বাকি ফ্রেমগুলি শিকারিরই নানা আসবাব ও অন্য মুখের আদল দিয়ে সাজানো। এখানে শিকারি শুধু নিষ্পাপ শিকারজীবী নয়। সম্ভবত একজন হমত্মারকের প্রতীকও। একই বছরে করা ‘জেনারেলস অ্যান্ড ট্রফি’ শীর্ষক টেরাকোটা প্যানেলটিতেও এই যুদ্ধ ও নরহত্যার প্রতীক এসেছে। শিল্পী ক্রমশ যেন সামাজিক বিপর্যয় ও হিংসার উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন হচ্ছেন। তাঁর শিল্পভাষাকে সেই প্রতিবাদী চেতনার দিকে প্রসারিত করার চেষ্টা করছেন। এই টেরাকোটাগুলির মধ্য দিয়ে দেশীয় ঐতিহ্য যেমন প্রতিফলিত হচ্ছে, তেমনি সমীকৃত হচ্ছে পাশ্চাত্য উত্তরাধিকারও।
১৯৮০-র দশকের দিকে যতই এগোচ্ছেন সুব্রহ্মণ্যন্ ততই তাঁর ছবি হয়ে উঠছে সহজ ও মন্ময়। অবয়বের প্রাধান্য বাড়ছে। আঙ্গিকে ও বিষয়ে লৌকিক উৎস প্রাধান্য পাচ্ছে। পৌরাণিক বিষয় আসছে। পৌরাণিক বিষয়ের সঙ্গে দৈনন্দিন জীবনের সংযোগ স্থাপিত হচ্ছে। আখ্যান আসছে। কিন্তু সরলরৈখিক হচ্ছে না সেই আখ্যানের বিন্যাস। ষাটের দশক পর্যমত্ম তাঁর ছবিতে যে গাঠনিকতা বা স্ট্রাকচারাল বৈশিষ্ট্যের ওপর জোর ছিল, পোস্ট-কিউবিস্ট আঙ্গিকের প্রাধান্যে মেধাগত উৎকর্ষ বা সেরিব্রাল এলিমেন্টসের ওপর জোর পড়ছিল, সেই মেধার সঙ্গে মননের সুষম সমন্বয় ঘটতে লাগল। ছবি হয়ে উঠতে থাকল অনেক সহজ, কৌতুকদীপ্ত। কিন্তু এতদিন পর্যমত্ম প্রচলিত ধারা থেকে একেবারেই আলাদা। সমসত্ম কিছুকেই তিনি গ্রহণ করছেন। সমসত্ম কিছুকেই মিলিয়ে নিচ্ছেন। বলেছেন, ‘In my universe everything exists; one does not aripe out the other’, ‘Bahurupee : A polymorphic Vision’ নামে এক প্রবন্ধে যখন তিনি এই কথা লিখছেন, সেখানেই উপস্থাপিত
করছেন তাঁর দৃশ্যতার দর্শনও। যার নাম দিয়েছেন ‘বহুরূপী’। সেখানে তিনি বলেছেন, আমরা জেনেছি আগে, ‘বিকল্প উপস্থিতি’র কথা। বাসত্মব ও কল্পরূপ একসঙ্গে মিলেমিশে থাকে। এক রূপকথার জগৎকে উন্মোচিত করেন তিনি। বাসত্মব ও রূপকথার সমন্বয় ঘটে।
১৯৫১ সালে তিনি বরোদার কলাভবনে শিক্ষকতায় যোগ দিয়েছিলেন। সেই শিক্ষকতা চলেছে ১৯৮০ সাল পর্যমত্ম। প্রফেসর, তারপর ডিন অব দ্য ফ্যাকাল্টি হয়েছেন সেখানে। ইতোমধ্যে ১৯৭৭-৭৮-এ বিশ্বভারতী কলাভবনে এসেছেন ভিজিটিং ফেলো হিসেবে। তারপর ১৯৮০ সালে স্থায়ীভাবে যোগ দিয়েছেন বিশ্বভারতীতে কলাভবনে চিত্রকলার অধ্যাপক রূপে। ১৯৮৯ সালে অবসর নেওয়ার আগে পর্যমত্ম সেই পদেই ছিলেন। অবসর নেওয়ার পরও সেখানে যুক্ত থেকেছেন ‘প্রফেসর এমেরিটাস’ হিসেবে। শামিত্মনিকেতনে ফিরে আসা যেন তাঁর নিজস্ব আলয়েই প্রত্যাবর্তন। পূর্বপলস্নীতে বাড়ি করেছেন। একাত্ম হয়েছেন এই পরিবেশ ও উত্তরাধিকারের সঙ্গে।
শামিত্মনিকেতনে আসার পর তাঁর ছবিতে মন্ময়তা যেন অনেক বৃদ্ধি পেল। জীবনের রূপ-রস-সুবাস অনেক বেশি করে উন্মীলিত হলো। বাংলার আবহের সঙ্গে দক্ষিণ-ভারতের পরম্পরার সুষম সমন্বয় ঘটল। আশির দশকের গোড়া থেকেই তিনি শুরম্ন করলেন একটি নতুন মাধ্যম ও আঙ্গিক-পদ্ধতি নিয়ে চর্চা। তা হলো গস্নাস পেইন্টিং। কাচের ওপর বিপরীত ক্রমে অাঁকা। ছবিটি যেদিকে অাঁকা হয়, তার উলটোদিক থেকে দেখতে হয়। এটা একটা লৌকিক আঙ্গিক। দক্ষিণ-ভারতের পরম্পরাগত চিত্রে এর চর্চা রয়েছে। এই আঙ্গিকে সুব্রহ্মণ্যন্ অনেক দিন কাজ করেছেন।
সেরকমই একটি ছবি আমরা দেখে নিই শামিত্মনিকেতন-পরবর্তী জীবনে তাঁর চিত্রচর্চার স্বরূপ বুঝতে। ১৯৮০ সালে কাচের ওপর জলরং ও তেলরঙে অাঁকা ছবিটির শিরোনাম ‘রাধা ও কৃষ্ণ’। পূর্ণ অবয়বের সহজ উপস্থাপনা রাধা এক গ্রামীণ মানবী। চিত্রক্ষেত্রের বৃহত্তর অংশজুড়ে ঘরের মেঝের ওপর বসে আছে সে। পশ্চাৎপটে কৃষ্ণ যেন উপবৃত্তাকার ফ্রেমে দেয়ালে সংবদ্ধ এক মানব-প্রতিমা। তার মাথায় পাগড়ি, চোখে সবুজ চশমা। তার মুখম-লের বর্ণ নীল। সেটুকুই কৃষ্ণের স্মারক। তার দুদিকে প্রসারিত চওড়া কালো গোঁফটি এবং গায়ে সবুজ গলাবন্ধ জামা তার মধ্যে মিলিটারি-সুলভ ব্যক্তিত্বের আদল আনে। পৌরাণিক বিষয়ের এই সাম্প্রতিক পাঠ ছবিটিকে বিশেষ এক মাত্রায় অন্বিত করে। প্রতিবাদী অনুষঙ্গ আনে।
১৯৮১-র একটি ছবি, শিরোনাম ‘কফি অ্যান্ড সেস্নাগানস’। এটিও পূর্বোক্ত আঙ্গিকেরই, অ্যাক্রিলিক শিটের ওপর জলরং ও তেলরঙে অাঁকা। চিত্রক্ষেত্র অনুভূমিক দুই ও আলম্ব তিনটি – মোট ছটি আয়তাকার বা বর্গাকার ফ্রেমে বিভাজিত। ছটি ফ্রেমে রয়েছে ছজন নারী ও পুরম্নষের মুখাবয়ব, যারা কফি খাচ্ছে, চুরুটের ধোঁয়া ছাড়ছে আর চিৎকার করে বক্তৃতা দিচ্ছে। আজকে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের বাকসর্বস্ব ও ভঙ্গিসর্বস্ব আত্মম্ভরিতাকে কশাঘাত করেছেন শিল্পী।
এই পর্যায়ে ১৯৮০-র দশকে সাধারণ জীবনের সৌন্দর্য নিয়ে ছবি অাঁকছেন ১৯৮০-র ‘বাওল অব ফুটস অ্যান্ড বস্নাইন্ড মাদার’, ‘গার্ল উইথ ক্যাট’, ‘ফেরারিটেলস ফ্রম পূর্বপলস্নী’ এরকম ছবি যেমন আছে, তেমনি আছে ১৯৮৬-র ‘বেহুলা স্টোরি’ রামায়ণ, মহাভারত, দেবী দুর্গার আখ্যান নিয়ে অনেক ছবিও। ‘বেহুলা’ ছবিটিতে বেহুলার আখ্যান সত্ত্বেও তিনি এনেছেন সামাজিক পরিস্থিতিতে একজন মানবীর অবস্থান ও অন্যান্য মানুষের ক্রিয়াকলাপ ও প্রতিক্রিয়ার সমালোচনাও।
১৯৯০-এর দশকে পৌঁছে সুব্রহ্মণ্যনের ছবি আরো নির্ভার, আরো আনন্দ-নন্দিত হয়েছে। পৌরাণিক বিষয় এসেছে বেশি করে। সাধারণ জীবন ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এসেছে। এর মধ্য দিয়েই প্রচ্ছন্নভাবে নানা সামাজিক সংকটের বিরম্নদ্ধে প্রতিবাদও ব্যক্ত হয়েছে। আপন ঐতিহ্যকে আত্মস্থ করে তাঁর ছবি আবিশ্ব চৈতন্যে প্রসারিত হয়েছে। জীবনকে নিয়ে তাঁর এই আনন্দের বার্তা তিনি সঞ্চালিত করেছিলেন ১৯৯০-এ করা তাঁর একটি ম্যুরালে। শামিত্মনিকেতন কলাভবনে শিল্প-ইতিহাস বিভাগের বাড়িটির চারদিকের দেয়ালে সাদা-কালোয় তিনি এঁকেছিলেন এই ভিত্তিচিত্র। এটিকেই আমরা ধরতে পারি জীবনের প্রতি তাঁর আনন্দিত অভিনন্দন-বাণী হিসেবে। কালো প্রেক্ষাপটে শুভ্র পাখিরা উড়ছে। গাছে গাছে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে হনুমান। গাছের তলায় মুখোমুখি বসে আছে ময়ূর-ময়ূরী। এরকম সব চিত্রকল্পে মুখরিত করে দিয়েছেন কলাভবন প্রাঙ্গণ। এখানে অনেক শিল্পীরই ভিত্তিচিত্র বা ভাস্কর্য আছে। নন্দলাল বসু, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, রামকিঙ্কর, সোমনাথ হোর প্রমুখ অনেক শিল্পীর ছবিও ভাস্কর্যে সৌন্দর্যের এক তীর্থ এই প্রাঙ্গণ। তার মধ্যে সুব্রহ্মণ্যনের এই কাজটি একেবারে স্বতন্ত্র এক আবহ তৈরি করে উজ্জ্বল হয়ে আছে।
১৯৯১-এর ‘প্যাস্টোরাল উইথ ওয়াইল্ড ক্যাটস’-এর পাশে একই বছরের ‘ছিন্নমসত্মা’ ছবিটি যখন দেখি তখন বুঝতে পারি সৌন্দর্য ও সংঘাতের দ্বন্দ্ব কেমন করে তাঁর চেতনাকে ছেয়ে যাচ্ছে। এইখানে যেন রামকিঙ্করের মননই বেশি করে প্রতিফলিত হয়। কেবল সময়ের প্রবাহে বিপুল পরিবর্তন এসেছে ভাবনায়, মননে ও প্রকাশভঙ্গিতে। ২০১২ সালে তাঁর ৮৮ বছর পূর্ণ হলো যখন, তখন একে উদ্যাপন করতে কলকাতার গ্যালারি-৮৮ তাঁর ‘মিথলজি’ চিত্রমালার ছবি নিয়ে একটি প্রদর্শনী করেছিল। ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত সেই প্রদর্শনীর ছবিগুলো ২০১২-১৩ জুড়েই সম্ভবত এঁকেছিলেন শিল্পী। এই ছবিগুলোতে পুরাণকল্পের মধ্য দিয়ে আজকের জীবনের হিংসা ও সন্ত্রাসকেও তিনি নানাভাবে রূপায়িত বা প্রতীকায়িত করেছেন। রাম-রাবণের যুদ্ধবিষয়ক ছবিটিই আমরা একটু নিবিষ্টভাবে দেখতে পারি। সমগ্র ছবিটিতে রয়েছে হলুদাভ বা গেরম্নয়া রঙের সমতল প্রেক্ষাপট। সমসত্ম ছবিটি রেখার প্রাধান্যে অাঁকা। কোথাও কোথাও রেখাধৃত পরিসর সমতল বর্ণে ভরাট করা। বাঁ-পাশে দশমু- রাবণ যুদ্ধ করছে। দুহাতে তাঁর রক্তবর্ণ তরবারি। তাঁর দশটি মাথা পিরামিডের মতো ত্রিকোনাকারে সাজানো। একেবারে ওপরের মাথাটির ওপর একটি টুপি চাপানো রয়েছে। এই আপাত-কৌতুকের ভিতর ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসের যেন প্রতীকী সংকেত থাকে। ডানপাশে তীর নিক্ষেপে উদ্যত শ্যামলবরণ শ্রীরামচন্দ্র। তার পেছনে লক্ষ্মণ। তাদের মাঝখানে বিশালকায় হনুমান লেজ তুলে দুবাহু প্রসারিত করে রাবণের দিকে ধেয়ে যাচ্ছে। নিমণণাংশে একটি গাছের তলায় বসে আছেলোহিত-বর্ণা সীতা। যুদ্ধের এই আস্ফালনের মধ্যে একাকী নারীর অসহায়তাই হয়তো হতে পারে ছবিটির কেন্দ্রীয় ভাবনা। গণপতির ছবিটিতেও কৌতুকের আভাস আসে যখন তাঁর বাহন দুটি ইঁদুর গাছে চড়ে তাকে নিরীক্ষণ করে। গণেশ তার সাদা কান ও সাদা শুঁড়টি প্রসারিত করে প্রশামত্ম ও মগ্ন উপস্থিতিকে বাঙ্ময় করে।
এই প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌঁছে সুব্রহ্মণ্যনের ছবি অনেক সহজ, অনেক ছন্দিত, অনেক কাব্যময় হয়েছে। ‘লিরিসিজম’ তাঁর ছবির একটি বৈশিষ্ট্য। সেই ছন্দিত সুষমাই তাঁর ছবিতে কবিতার আবহ তৈরি করে। এই কবিতা-প্রাণতা তাঁর ছবির একটি অনিবার্য মাত্রা।
সুব্রহ্মণ্যন্ তাঁর একটি প্রবন্ধে আধুনিকতার অমত্মর্নিহিত সমস্যা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, আজকের বিশ্বায়িত শিল্প-পরিস্থিতিতে শিল্পীর আত্মস্বরূপের সঙ্গে সামগ্রিক মূল্যবোধের কোনো সংযোগ ঘটছে না। একে উত্তীর্ণ হতে গেলে প্রয়োজন ব্যক্তির সঙ্গে সমগ্রের বন্ধন। ‘So it falls to every modern artist to work out a reconedliation’ (‘Models of Modern Art’. ‘The Creative Circuit’, Seagull, Calcutta 1992, p 22-23). আত্মবোধ ও আত্মগত ঐতিহ্যের সঙ্গে বিশ্ববোধের সমন্বয়ের মধ্য দিয়েই শামিত্মনিকেতনের শিল্পকলা, রবীন্দ্রনাথ থেকে সোমনাথ হোর পর্যমত্ম, আধুনিকতাবাদের এক আলোকিত অভিমুখ তৈরি করেছে। সেই ধারাবাহিকতায় কে জি সুব্রহ্মণ্যন্ই ছিলেন সম্ভবত শেষ প্রতিনিধি। তাঁর প্রয়াণ সেই ধারাটিকেই হয়তো সমাপ্ত করল। এখন যে তরম্নণ শিল্পীরা কাজ করছেন তাঁদের মূল্যবোধ ও বিশ্বদৃষ্টি স্বতন্ত্র। শিল্পের এক স্বতন্ত্র বিশ্ব উন্মোচিত করছেন তাঁরা। সুব্রহ্মণ্যন্ পাশ্চাত্য আধুনিকতার চেতনাকে পরিপূর্ণ আত্মস্থ করেও তাকে অতিক্রম করে গিয়ে নিজস্ব এক তত্ত্ববিশ্ব তৈরি করেছেন, যেখানে তাঁর দক্ষিণ-ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে উত্তর-ভারতীয় তথা শামিত্মনিকেতনের সংস্কৃতির সুষম সমন্বয় ঘটেছে।