logo

কে জি সুব্রহ্মণ্যনের একটি অনন্য কীর্তি

সু শী ল  সা হা

শান্তিনিকেতনের কলাভবন চত্বরের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে বিরাজমান দৃষ্টিনন্দন অসাধারণ বেশ কয়েকটি শিল্পবস্ত্তর কথা সর্বজনবিদিত। সেখানে রামকিঙ্কর বেইজের অসামান্য শিল্পকৃতির পাশে দৃশ্যমান নন্দলাল বসু, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় প্রমুখের অমর কীর্তিসমূহ। অদূরে সাঁওতাল দম্পতি, ধ্যানরত বুদ্ধদেব, পায়েস হাতে ধীরপায়ে অগ্রসরমাণ সুজাতা। আর রয়েছে অনন্য কালো বাড়ি। নিকষ কালো রিলিফ ভাস্কর্যের এক চমৎকার নিদর্শন। বিশ্বমানের এইসব শিল্প-সৌকর্যময় পরিবেশে সবকিছু ছাপিয়ে চোখে পড়বে ছোট্ট একটি দ্বিতল বাড়ি। চোখে পড়বে তার গায়ে উৎকীর্ণ কিছু ছবি। ছবি দিয়ে মোড়া এমন বাড়ি পৃথিবীতে আর কটাইবা আছে!
সাদা-কালোর অনন্য মিশ্রণে বরেণ্য শিল্পী কে জি সুব্রহ্মণ্যনের এটি একটি অসামান্য সাম্প্রতিক কীর্তি।

শিল্পীর প্রকৃত নাম কল্পতি গণপতি সুব্রহ্মণ্যন্। জন্মেছিলেন উত্তর কেরালার এক অখ্যাত গ্রামে ১৯২৪ সালে। মাদ্রাজের প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতি নিয়ে পড়ার সময় তিনি ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামের আন্দোলনে যোগ দেন। সেসময় তাঁকে কলেজ থেকে বিতাড়িত হয়ে কারাবরণও করতে হয়। তবে তাঁর জীবনের এক সন্ধিক্ষণ তৈরি হয় যখন তিনি বিশ্বভারতীর কলাভবনে ছাত্র হয়ে আসেন। মাত্র তিন বছর আগে রবীন্দ্রনাথ প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর কবোষ্ণ প্রভাব তখনো শান্তিনিকেতনের কোণে কোণে ছুঁয়ে আছে। এখানে ১৯৪৮ অবধি চলে তাঁর ছাত্রজীবন। এখানকার এই চার বছর সত্যিই তাঁর জীবনের এক অনন্য অধ্যায়।

১৯৫১ থেকে ’৫৯ সাল অবধি বরোদা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি চিত্রকলা বিষয়ে শিক্ষকতা করেন। এর মধ্যে এক বছর (১৯৫৫-৫৬) তিনি লন্ডনের সেস্নড স্কুল অব আর্টে ব্রিটিশ কাউন্সিল নির্বাচিত রিসার্চ স্কলার হিসেবে শিক্ষাগ্রহণ করেন। তারপর ১৯৫৯ থেকে ’৬১ সাল পর্যন্ত তিনি বম্বের অল ইন্ডিয়া হ্যান্ডলুম বোর্ডের ডেপুটি ডিরেক্টর (ডিজাইন) হিসেবে কাজ করেন। তারপর দীর্ঘকাল বরোদাতেই অধ্যাপনা করেন। এর মধ্যে (১৯৬৬-৬৭) তিনি নিউইয়র্কে যান জে ডি রকফেলার ফেলো হয়ে। ১৯৭৬-এ কানাডার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং লেকচারার হিসেবে কাজ করেন। অবশেষে ১৯৮০ সালে তিনি শান্তিনিকেতনে এসে কলাভবনে যোগ দেন। সারাজীবনের অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা, মনন ও দক্ষতা উজাড় করে দিয়ে তৈরি করেন অসংখ্য ছাত্র। অবসরগ্রহণের পর বিশ্বভারতী তাঁর সারাজীবনের কর্মকৃতিকে স্বীকৃতি দেয় কলাভবনের এমেরিটাস প্রফেসরের পদ দিয়ে। ইতোমধ্যে তিনি পান পদ্মশ্রী (১৯৭৫), কালিদাস সম্মান (১৯৮১), রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত ডি.লিট উপাধি, নির্বাচিত হন ললিতকলা একাডেমির ফেলো (১৯৯৩)। ১৯৯৭ সালে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডি.লিট উপাধি প্রদান করে। অবশেষে তিনি পান পদ্মভূষণ ২০০৬ সালে। পান বিশ্বভারতীর দেশিকোত্তম সম্মানও।

শিল্পীর দীর্ঘ জীবনের বিচিত্র এই কর্মকৃতির পরিচয় তুলে ধরার অন্যতম কারণ সাতাশি বছরের এই মানুষটির একজন প্রকৃত শিল্পী হয়ে ওঠার দিকে আলোকপাত করা। শিল্পে আজীবন নিবেদিতপ্রাণ এ মানুষটি প্রকৃতপক্ষে রামকিঙ্করের উত্তরসূরি। শিল্পী হিসেবে কেবল চিত্রকলাই নয়; তিনি ভাস্কর্য, দেয়ালচিত্র এবং ছাপাই ছবিতেও সমান দক্ষ। আমার এই প্রতিবেদনে যে অনন্য গৃহের কথা বলতে চাই সেটির চতুষ্পাশর্ব আসলে দেয়ালচিত্র-রীতিতে নির্মিত। সমগ্র গৃহখানির বহিরঙ্গ এই শিল্পীর দক্ষ হাতের কোমল পরশে এক অভূতপূর্ব রূপ পরিগ্রহ করেছে।

আগেই বলেছি, ছোট্ট এই গৃহটির বহিরঙ্গ সাদা-কালো চিত্ররীতিতে ঠাসা। কিন্তু এই একটি কথায় কিন্তু সব কথা বলা হলো না। আসলে আগাপাশতলা এর দুধসাদা সারফেসে গাঢ় কালো রঙের লাইন ড্রয়িংয়ে সুব্রহ্মণ্যন্জি এক অসামান্য ভিজ্যুয়াল ইমেজ তৈরি করেছেন। শান্তিনিকেতনের বৃক্ষশোভিত প্রাকৃতিক পরিবেশে বহুদূর থেকেও এই গৃহখানি উদ্ভাসিত হয় স্বমহিমায়, দৃষ্টি আকর্ষণ করে সবার। চিত্রকলার তিনটি অঙ্গ রেখা, আকার ও রঙের ওপরে সুব্রহ্মণ্যনের ছবির প্রধান ভর হলেও এখানে প্রধানত রেখাই বেশি গুরুতব পেয়েছে। আসলে এই ছোট্ট গৃহটি কলাভবনের কারু বিভাগীয় স্টুডিও। এই গৃহের অভ্যন্তরে শিল্পী অনেক কাজ করেছেন, অনেক ছাত্রকে হাতে-কলমে শিক্ষা দিয়েছেন। শিল্পীর বহু স্মৃতিবিজড়িত এই গৃহের বহিরঙে আটের দশকে অন্য একটি কাজের নমুনা ছিল। কালের পরিক্রমায় সেটি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সুব্রহ্মণ্যন্জি নিজে উদ্যোগী হয়ে ২০০৯ সালে, যখন তাঁর বয়স পঁচাশি, তখন দীর্ঘ তিন মাস ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে এই গৃহের বর্তমান রূপ দেন। ভাবলে অবাক হতে হয় বাঁশের ভারা বেঁধে কীভাবে তার ওপরে উঠে অসাধারণ মেধা ও প্রচেষ্টায় এই কাজটি সম্পন্ন করেছেন!

কাজগুলোর বর্ণনা করতে যাওয়া একধরনের ধৃষ্টতা। আদ্যন্ত ভারতীয় ঐতিহ্যের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ এই শিল্পীর কথাতেই বিধৃত তাঁর নিজস্ব শিল্পরীতি – ‘আমি নানা মাধ্যমেই কাজ করি। প্রতিটির নিজ নিজ চিন্তার ও যোগাযোগ ক্ষমতা আছে। আমি দৃশ্যজগতের বহুতর তথ্য নিয়ে কাজ করি – কখনোবা বিবৃতিমূলক, কখনোবা ভঙ্গিভিত্তিক, কখনোবা স্পষ্ট, কখনোবা অস্পষ্ট। আমি কখনো বিন্যস্ত করি নানা বিষয় যা সমসাময়িক, কখনো সেইসব বিষয়পুঞ্জ যা শাশ্বত। দৃষ্টি তখন প্রথমে সেইসব পাখির মতো উড়ে বেড়ায় সামনে ও পেছনে, আজকের ঘটনার থেকে চকিতে সুদূর অতীতের স্মৃতিতে। বাস্তব থেকে কিংবদন্তি ও পরাবাস্তবে, আনন্দ থেকে গভীর দুঃখের মধ্যে।’

এই গূঢ় অথচ সংবেদী আত্মকথনের মধ্যে পাঠক কি খুঁজে পেলেন এই বিশ্বনন্দিত শিল্পীর মনোজাগতিক বৈশিষ্ট্য? তাঁর হৃদয়মথিত সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার বহিঃপ্রকাশের ধরন! ঐতিহ্য ও পরম্পরায় নিবেদিত শিল্পীর রং ও রেখার এ এক অনন্য প্রকাশ। এই লেখার সঙ্গে মুদ্রিত কয়েকটি ছবি যদি পাঠকের অন্তরে আরো জানার আগ্রহকে উসকে দেয় তাহলে তো তাঁকে যেতেই হবে শান্তিনিকেতনে। কলাভবনের বিসত্মীর্ণ শিল্পচতবরে মুখোমুখি হতেই হবে এই গৃহের, যা বহন করছে বিশ্বমানের এক শিল্পীর মনন ও জীবনচর্যার এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তিকে।

ছাত্রপ্রিয়, বন্ধুবৎসল এই কর্মিষ্ঠ মানুষটি তাঁর পরিচিত মহলে ‘মানিদা’ নামেই সমধিক পরিচিত। তাঁর অমায়িক ব্যবহার, কর্মনিষ্ঠা তথা সৃষ্টিমুখর জীবনাচরণের জন্য তিনি সবার ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার পাত্র। আমরা এই দেশবরেণ্য শিল্পীর শতায়ু কামনা করি। গৌরব করার মতো এমন মানুষ যতদিন আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন ততই মঙ্গল। এঁদের অভাব যে কোনোদিন পূরণ হওয়ার নয়। n

 

Leave a Reply