না সি মু ল হা সা ন
I film normal-life subjects in natural settings that some people would consider uncinematic. But what I want to show is nature itself, as the truth of life. – Abbas Kiarostami
চল্লিশের দশকে জন্ম নেওয়া আববাস কিয়ারোস্তামি ছোটবেলা থেকেই আর্ট ফর্ম নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। আর এই আগ্রহী হওয়ার পেছনে কিয়ারোস্তামির বাবার ভূমিকাই ছিল প্রধান। বাবা পেইন্টার ও ডেকোরেটর হওয়ায় কিয়ারোস্তামির মাঝেও আগ্রহের জায়গাটা তৈরি হয়। সম্ভবত এই ব্যাপারটাও কিয়ারোস্তামির মননে ঢুকে যায় যে আর্ট শুধু একটা ফলাফল নয়, আউটপুটও নয়; আর্টের ভেতর এর নির্মাণপ্রক্রিয়া ও নির্মাতার পরিশ্রমও আছে। কিয়ারোস্তামির দীর্ঘ সিনেমাজীবনে এই প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই। জীবনের প্রায় বিশটি বছর কিয়ারোস্তামি কাটিয়েছেন শিশুদের মেধা বিকাশের সংগঠন কানুনের (Kanun – the Centre for the Intellectual Development of Children and Young Adults) জন্য কাজ করে। এই সময়ে কিয়ারোস্তামি নির্মাণ করেন অসংখ্য ডকুমেন্টারি, শর্ট ফিল্ম, এমনকি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রও। কানুনের কাজগুলোতে অপেশাদার শিশুদের দিয়ে, শিশুদের জন্যই বুদ্ধিদীপ্ত কিছু ফিকশন আমাদের উপহার দিয়েছেন কিয়ারোস্তামি। শুধু অপেশাদার শিল্পীই নন, কিয়ারোস্তামির দর্শন, চিমত্মার পাশাপাশি এসব সিনেমার নির্মাণপদ্ধতি তথা ক্যামেরা-সাউন্ড-লাইটের কম্পোজিশন যেন আমাদের চেনাজানা ফিকশন সিনেমার কনভেনশনাল স্টাইলের একদম বাইরের। কিয়ারোস্তামির উদ্দেশ্যই যেন যে-কোনোভাবে সবচেয়ে সত্যিকার চিত্রটা তুলে ধরা। কানুনে থাকা অবস্থাতেই বা ওখান থেকে বের হয়ে এসে নিজের ফিকশনাল সিনেমায় এই ধারা অক্ষুণ্ণ রেখেছেন কিয়ারোস্তামি।
১৯৯০ সালে আববাস কিয়ারোস্তামি ক্লোজ-আপ সিনেমাটি তৈরি করলেন সমসাময়িক ইরানি পরিচালক মোহসেন মাখমালবাফের জীবনে ঘটে যাওয়া একটি অদ্ভুতুড়ে ঘটনা নিয়ে। ঘটনাটাকে যথাসম্ভব বাসত্মবে ঘটে যাওয়া ঘটনার মতো দেখাতে কিয়ারোস্তামি ব্যবহার করলেন বাসত্মব জীবনের সেই চরিত্রদের, যারা সেই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল। যে যার মতো চরিত্রে রূপদান করেছে, নিজেদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো এবার ক্যামেরার সামনে ঘটিয়েছে। পুরো পৃথিবীর ফিল্ম ক্রিটিকরা অবাক হয়ে গেলেন, ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হলেন সিনেমাটি আদৌ ফিকশন সিনেমা নাকি ননফিকশন ডকুমেন্টারি। ক্লোজ-আপ সিনেমার আগে ও পরের তিনটি সিনেমায় প্রায় একই রকম ঘটনা আবারো দেখান কিয়ারোস্তামি। এই তিনটি সিনেমা তাঁর বিখ্যাত ‘কোকার ট্রিলজি’ হিসেবে পরিচিত। ট্রিলজির প্রথম হোয়ার’স দ্য ফ্রেন্ডস হোম (১৯৮৭) সিনেমাটিতে গল্প বলা হয় এমন এক কিশোরের, যে পাশের গ্রামে যায় স্কুল থেকে ছাঁটাই হয়ে যাওয়া বন্ধুকে তার নোটবুক ফেরত দিতে। সিনেমাটির ফিকশন ও ননফিকশনের মিশ্রণ নিয়ে খুব বেশি কথা ওঠেনি। তবে পরের দুটো সিনেমায় রীতিমতো চমকে দিয়েছেন কিয়ারোস্তামি। হোয়ার’স দ্য ফ্রেন্ডস হোম মুক্তির প্রায় তিন বছর পর সিনেমাটির শুটিং স্পট কোকার অঞ্চলে ভয়ংকর এক ভূমিকম্প হয়। ঠিক তার পরপরই কিয়ারোস্তামি তাঁর ছেলেকে নিয়ে ভূমিকম্পবিধ্বসত্ম কোকার অঞ্চলে আসেন। খুঁজে পেতে চান হোয়ার’স দ্য ফ্রেন্ডস হোম সিনেমায় অভিনয় করা সেইসব শিশুসহ আরো অনেককে। কিয়ারোস্তামির এই জার্নিটার ওপরই তাঁর পরবর্তী ফিল্ম অ্যান্ড লাইফ গোজ অন (১৯৯২)। কিয়ারোস্তামি যেন ক্লোজ-আপ সিনেমার মতোই তাঁর পুরো জার্নিটাকে রিপিট করছেন। তাঁর পরের ছবি থ্রম্ন দি অলিভ ট্রিজের (১৯৯৪) গল্পটা অ্যান্ড লাইফ গোজ অনের মেকিংয়ের গল্প নিয়েই।
কিয়ারোস্তামির বিখ্যাত টেস্ট অব চেরি (১৯৯৭), দ্য উইন্ড উইল ক্যারি আস (১৯৯৯) ও টেন (২০০২) সিনেমাগুলির গুরম্নত্বপূর্ণ চরিত্রের জন্যও কিয়ারোস্তামি রেখেছেন অপেশাদার অভিনেতাকে। স্ক্রিপ্টের কথা না ভেবে নিজেদের মতো স্বাভাবিক অভিনয় করে যাওয়ার জায়গাটাও ছেড়েছেন তিনি। ফিকশন না ননফিকশন, ফিচার না ডকুমেন্টারি, এইসব প্রশ্ন ছাপিয়ে কিয়ারোস্তামির উদ্দেশ্য – কতটা বাসত্মব, কতটা সত্য সে তুলে ধরতে পারে দর্শকের সামনে। এবিসি আফ্রিকা (২০০১) নামক প্রজেক্টটিতে কাজ করতে যাওয়ার আগে কিয়ারোস্তামির মূল ভাবনা ছিল নিখুঁতভাবে সেই সত্যিটাকেই প্রতিষ্ঠিত করা। আর তা করতে গিয়ে কিয়ারোস্তামিকে যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তা আসলে তাঁর সার্বিক সিনেমা তৈরির পদ্ধতি ও সিনেমা নিয়ে তাঁর ভালোবাসা ও সততাকেই তুলে ধরে।
আববাস কিয়ারোস্তামির কাছে ডিজিটাল ক্যামেরা সবসময়ই একটা বিস্ময়ের নাম। প্রথম দিকে টের না পেলেও কিয়ারোস্তামি ধীরে ধীরে টের পেলেন যে, এটি তাঁর কাজ করার প্যাটার্নকেই পুরোপুরি চেঞ্জ করে দিতে পারে। যেখানে একটা ৩৫ মিমি ক্যামেরাকে নিয়ে কাজ করা খরচের, তা পরিচালনার জন্যও আলাদা ক্রু দরকার; সেখানে ডিজিটাল ক্যামেরা সহজেই ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে যাওয়ার পাশাপাশি খরচ ও ব্যবস্থাপনা কমিয়ে আনে শূন্যের কোঠায়। কিয়ারোস্তামির বিখ্যাত কাজ টেস্ট অব চেরির একদম শেষ দৃশ্যে আমরা দেখি ৩৫ মিমি থেকে বের হয়ে এসে ডিজিটাল ক্যামেরা ব্যবহার করছেন পরিচালক। সেখানে দেখা যায়, মাত্র এক দৃশ্য আগেই যে অভিনেতা আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে কবরে নেমে পড়েছিল, তারই সঙ্গে সিগারেট খাচ্ছেন আর শুটিং প্যাকআপ করছেন কিয়ারোস্তামি। ফিকশনের পরেই যেন ডকুমেন্টারি স্টাইলে বলার চেষ্টা – এতক্ষণ ধরে যা দেখা হলো তা পুরোপুরিই অবাসত্মব, নিছক সিনেমার বেশি কিছু না। কিয়ারোস্তামির ২০০২ সালে আরেকটি চলচ্চিত্র টেনে আমরা এক নারীকে তার গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে তেহরানের রাস্তায় ঘুরতে দেখি। গাড়িতে ফিক্স করা দুটি ডিজিটাল ক্যামেরায় পুরো সিনেমাটা রেকর্ড করা হয়। টেন সিনেমাটির প্রস্ত্ততি কিয়ারোস্তামি নিয়েছিলেন সেই এবিসি আফ্রিকা সিনেমাতেই।
এবিসি আফ্রিকা নিয়ে বিস্তারিত বলতে গেলে আগে বলতে হবে সিনেমাটির প্রেক্ষাপট উগান্ডা নিয়ে। খ্যাতনামা সিনেমা দ্য লাস্ট কিং অব স্কটল্যান্ড (২০০৬) যাঁরা দেখেছেন তাঁদের কমবেশি পরিচিতি আছে উগান্ডার স্বৈরশাসক ইদি আমিন আর তাঁর আট বছরের ভয়ংকর আমল সম্পর্কে। তাঁর সময়ে দেশটিতে গৃহযুদ্ধেই মারা যায় প্রায় পাঁচ লাখ লোক। সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক কাঠামোগুলো বিপর্যসত্ম হয়ে ওঠে। ভেঙে পড়ে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার খাতগুলো। বিপর্যয় চরম মাত্রায় পৌঁছে যখন দেখা যায় আশির দশকে প্রায় ত্রিশ ভাগ উগান্ডান এইচআইভি সংক্রমিত হয়ে গেছে। ১৯৮৫ সালে রাজনীতিবিদ ইয়োয়েরি মুসেভানি উগান্ডার ক্ষমতায় আসার পর থেকে এইডস সংক্রমণের হার নিচের দিকে ধাবিত হতে থাকে। জাতীয়ভাবে বিভিন্ন সংগঠন যেমন কাজ করতে থাকে এইডস প্রতিরোধে, তেমনি বিদেশি সেবা সংস্থাগুলোকেও আহবান করা হয় সাহায্যে এগিয়ে আসতে। জাতিসংঘও তার কার্যক্রম শুরম্ন করে দেশটিতে। ২০০০ সালে উগান্ডার এইডস পরিস্থিতির শিকার এতিম শিশুদের জন্য ফান্ডিং খুঁজে পেতে একটি সিনেমা তৈরির কথা ভাবে সংস্থাটির অঙ্গ সংগঠন IFAD (International Fund for Agricultural Development)। এমন একজন পরিচালকের খোঁজ করা হয় যার এক্সটেনসিভ কাজ আছে শিশুদের নিয়ে। খুব বেশিদূর ভাবতে হয় না। আববাস কিয়ারোস্তামির নাম উঠে আসে। কিন্তু প্রস্তাব দেওয়া হলে সহজেই রাজি করানো যায় না কিয়ারোস্তামিকে। প্রায় এক বছর কিয়ারোস্তামির পেছনে লেগে থাকে সংস্থাটি। এরপরও সন্দিহান কিয়ারোস্তামি ফিল্ম করতে রাজি হন না। জানান তিনি আগে লোকেশন স্কাউটিং করে দেখতে চান। একাধিক মিনি ডিভি ক্যামেরা নিয়ে উগান্ডার উদ্দেশে রওনা দেন আববাস কিয়ারোস্তামি ও তাঁর টিম।
উগান্ডায় কিয়ারোস্তামি ও তাঁর টিম ল্যান্ড করার আগে, সিনেমার একদম শুরম্নতে চলে আসা যাক। কিয়ারোস্তামির অন্য সিনেমার মতো এবিসি আফ্রিকাতেও টাইটেল ক্রেডিটেই চমক। লাল অক্ষরে ABC AFRICA টাইটেলটা উঠে আসার আগেই আমরা শুনতে পাই একটা ফোনকল। পরে ফ্যাক্স মেশিনের বিরক্তিকর যান্ত্রিক শব্দের সঙ্গে আমরা দেখি একটা চিঠি। জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা IFAD থেকে কিয়ারোস্তামির উদ্দেশে ছবি বানানোর প্রস্তাব সম্পর্কিত চিঠি। উদ্দেশ্য সিনেমাটা সারাবিশ্বে দেখিয়ে উগান্ডার অগণিত অসহায় এতিম বাচ্চাদের জন্য সারাবিশ্ব থেকে ফান্ডিং আহবান। নারী কণ্ঠে অর্ধেকটা চিঠির ভয়েস ওভার শেষ হওয়ার আগেই একটা বিমান ল্যান্ডিং হতে দেখা যায় উগান্ডার রাজধানী কাম্পালা এয়ারপোর্টে। উগান্ডায় নামার পরপরই কিয়ারোস্তামি ও তাঁর টিমের হাতের ক্যামেরাগুলো সচল হয়ে যায়। অনুন্নত কাম্পালা শহরের মধ্য দিয়ে চলতে থাকে তাঁদের গাড়ি। ড্রাইভারকে অনুরোধ করা হয় লোকাল কোনো মিউজিক ছেড়ে দেওয়ার জন্য। আফ্রিকান ফোক রকের ছন্দে এগোতে থাকে গাড়ি। গাড়ি থেকে ডিজিটাল ক্যামেরায় এক এক করে উঠে আসে ক্লদ মনের ছবির মতো মেঘ, মাতাল করা সবুজ, জনবিহীন দীর্ঘ সড়ক। আফ্রিকার অবারিত ল্যান্ডস্কেপের সঙ্গে উঠে আসে অনুন্নত রাজধানী কাম্পালার চিত্রও। দেখা যায়, জন্ম নিয়ন্ত্রণের বড় বিলবোর্ডও। জন্ম নিয়ন্ত্রণের চেয়ে এইডস প্রতিরোধের উদ্দেশ্য থেকেই বিলবোর্ডটি ঝোলানো, টের পান কিয়ারোস্তামিরা। শহরের বেশ কয়েকটি গুরম্নত্বপূর্ণ মোড় পেরিয়ে কিয়ারোস্তামিদের গাড়ি এসে ঢোকে হোটেলে।
সিনেমার এইটুকু দেখার পরই টের পাওয়া যায় কিয়ারোস্তামির সিনেমার ধার। যেভাবে সিনেমার সত্যটুকু নিয়ে কিয়ারোস্তামি ডিল করেন তা এমনকি ডকুমেন্টারি সিনেমার ক্ষেত্রেও দুর্লভ। এই সত্যটাকে একই সঙ্গে ফিকশনাল ও রিয়ালিস্টিক মনে হতে থাকে। কিয়ারোস্তামির বিখ্যাত ছবি ক্লোজ-আপ বা অ্যান্ড লাইফ গোজ অনের মতো করেই যে ফ্যাক্স মেশিনে চিঠি আসার ব্যাপারটা পুনরায় রিক্রিয়েট করা হয়েছে তা আন্দাজ করা যায়। কিয়ারোস্তামি সহজেই পারতেন তাঁর গাড়ির ট্রিপটিকে একটা উগান্ডান ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে লেপে দিতে। কিন্তু কিয়ারোস্তামি আমাদের নিয়ে গেছেন গানের একেবারে উৎসতে, দেখিয়েছেন কীভাবে গানটা ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজতে শুরম্ন করেছে, কে গানটা পেস্ন করেছে সেই গল্পও। কিয়ারোস্তামি তাঁর পুরো ছবিতেই এই অ্যাপ্রোচ ধরে রেখেছেন।
হোটেল হয়ে কিয়ারোস্তামি ছুটেছেন সিনেমার আসল প্রোটাগনিস্ট, UWESO (Uganda Women’s Effort to Save Orphans) নামক সংগঠনটির নারী সদস্যদের ধারণ করতে। যারা সেই ১৯৮৬ সাল থেকে উগান্ডার অগণিত এতিম বাচ্চার সেবায় এগিয়ে এসেছে। সিনেমাতেই আমরা বলতে শুনি ২০০১ সালে UWESO-এর প্রায় চার হাজার পরিবার দেখাশোনা করছে প্রায় ছত্রিশ হাজার এতিম শিশুর। এসব শিশু দেশটির গৃহযুদ্ধের ভুক্তভোগী যেমন, তেমনি তাদের বেশিরভাগের অভিভাবকই এইডসে আক্রামত্ম হয়ে মারা পড়েছে। আর এই এতিম শিশুদের দেখাশোনার দায়িত্ব পালনের জন্য একধরনের ফান্ডিং দেওয়া হয়, যা থেকে শিশুদের পেছনে খরচ করার পাশাপাশি নিজস্ব আত্মসংস্থানেরও সুযোগ দেওয়া হয় নারী সদস্যদের। কিয়ারোস্তামির ডিজিটাল ক্যামেরা এই নারীদের মিটিং এবং তাদের স্বাভাবিক অংশগ্রহণ ফলো করে। ৩৫ মিমি ক্যামেরার আড়ম্বর না থাকায় নারীদের মাঝেও কোনো জড়তা নেই কিয়ারোস্তামি ও তাঁর টিমের উপস্থিতি নিয়ে।
ঠিক উল্টোটা ঘটে যখন কিয়ারোস্তামি ও তাঁর টিম আশপাশের গৃহস্থালিগুলোতে ভ্রমণের জন্য যায়। ছোট ক্যামেরা সত্ত্বেও বাচ্চারা এসে ভিড় করে টিমকে ঘিরে। উচ্ছল সেসব শিশুর মুখ দেখে বলার উপায় নেই তাদের বেশিরভাগেরই বাবা-মা কেউ নেই। তারা ক্যামেরার সামনে মুখ দেখানোর জন্য বেপরোয়া হয়, আবার হাসিমুখে গানের তালে তালে নাচেও। তার প্রমাণ পাওয়া যায় যখন একটা দোকানে সাউথ আফ্রিকার রক ব্যান্ড ডক্টর ভিক্টরের গান বেজে ওঠে – We are going south, we going west, we going north, we going east. গানের কথা যেন উগান্ডার এই শিশুদের স্পিরিটের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। একজন বৃদ্ধার ইন্টারভিউ নিতে গেলে জানতে পারা যায় তাঁর বয়স প্রায় বাহাত্তর বছর। তাঁর এগারো সমত্মানই মারা গেছে এইডসের কারণে। এখন সে পঁয়ত্রিশজন শিশুর দেখাশোনা করছে, যাদের বেশিরভাগই তার আত্মীয়। কিয়ারোস্তামিদের ক্যামেরায় একের পর এক উঠে আসে এরকম নারীর মুখ, পুরম্নষশূন্য গ্রামের বাড়ি, বাজার আর রাস্তার চিত্র।
কিয়ারোস্তামি ও তাঁর টিম বিদেশি অর্থায়নে চলা একটি এইডস সাপোর্ট অর্গানাইজেশনে এসে উগান্ডায় এইডসের ভয়াবহ রূপটা দেখতে পায় এবং যতটুকু বাসত্মবসম্মতভাবে সম্ভব তা ক্যামেরায় তুলে নেয়। পুষ্টিহীন জরাজীর্ণ স্বাস্থ্যের শিশুর পাশাপাশি দেখা যায় এইডসে আক্রামত্ম বয়স্ক রোগীদেরও। দর্শক ধাক্কা খায় যখন কিয়ারোস্তামি হাসপাতালের একটা বিশেষ ঘরের পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে আটকে যান। কাপড় দিয়ে পেঁচানো একটা ছোট শিশুর লাশ দেখা যায় টেবিলের ওপর পড়ে থাকতে। একজন বিকারহীন সেবিকাকে দর্শক দেখে একটা বড় কার্টন পেপার ছিঁড়তে, লাশটাকে উপযুক্তভাবে ঢাকার জন্য কার্টন পেপারটা কাজে লাগবে। লাশটাকে কোনোমতে পেঁচিয়ে একটা সাইকেলের পেছনের স্ট্যান্ডে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য। এই ভয়ংকর দৃশ্যটাকে সহজভাবে উপস্থাপন করা হলেও দর্শকের শরীর হিম করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। দৃশ্যটা নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলে আফ্রিকায় মৃত্যু কত সহজ এবং প্রতিক্রিয়াহীন। কিয়ারোস্তামিকে আমরা একাধিকবার দেখি ক্যামেরা হাতে লাশটিকে আবিষ্কার করা ও নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যগুলো ধারণ করতে। সিনেমার ঠিক এই সময়টায় কিয়ারোস্তামিকে ক্যামেরা হাতে দেখতে পেয়ে মনে হয় যেন সৃষ্টিকর্তার পয়েন্ট অব ভিউয়ের একটা অস্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছেন তিনি। মনে করিয়ে দিচ্ছেন মৃত্যুর স্বর্গীয় ব্যাপারটা। মৃত্যু আগেও বারবার এসেছে কিয়ারোস্তামির সিনেমায়। কিয়ারোস্তামির থ্রম্ন দি অলিভ ট্রিজ, টেস্ট অব চেরি ও দ্য উইন্ড উইল ক্যারি আস সিনেমাগুলি অনেক বেশি মৃত্যু নিয়ে চিমিত্মত।
এবিসি আফ্রিকা সিনেমার পরের অংশটুকুতে কিয়ারোস্তামি দর্শককে চমকে দেন যখন তারা পুরো টিম মিলে রাজধানী কাম্পালার দক্ষিণ-পশ্চিমের মাসাকা অঞ্চলে আসে এবং একটা হোটেলে ওঠে। সেখানে রাত কাটাতে গিয়ে আড্ডায় বসে কিয়ারোস্তামিরা। তাঁদের আড্ডার একদম শুরম্নতেই লোডশেডিং দেখা দেয়, স্ক্রিন পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে যায় এবং এর মাঝেই টিমের কথোপকথন চলতে থাকে। ছয়-সাত মিনিট জুড়ে স্ক্রিন পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে থাকে। এর মাঝেই শোনা যায় কিয়ারোস্তামি ও অন্যদের কথা, দরজা খোলার শব্দ ও বিদ্যুচ্চমক। তারপর বৃষ্টিস্নাত ভোরের আলো ফোটে অাঁধার কেটে। এমন ট্রিটমেন্ট কিয়ারোস্তামির ছবি দ্য উইন্ড উইল ক্যারি আস-এও দেখা যায়। এবিসি আফ্রিকার মাঝেও অন্ধকারটাকে ব্যবহার করা হয়েছে সেতুর মতো। বিপদসংকুল পথ পেরিয়ে নতুন আশার অঞ্চলে যাওয়ার সেতু। অন্ধকার শেষে ভোর হলে কিয়ারোস্তামিরা আবার বের হয়ে পড়েন। সিনেমাও যেন মোড় নেয় সমাধান খোঁজার দিকে।
কিয়ারোস্তামির টিমকে আমরা এবার একটা স্কুলে যেতে দেখি। দেখি সেখানে শিশুরা গাছের তলায় পড়াশোনার পাশাপাশি পরীক্ষাও দিচ্ছে মনোযোগ দিয়ে। পরিচিত হই অস্ট্রিয়ান এক পরিবারের সঙ্গে, যারা উগান্ডার এক শিশুকে দত্তক নিয়েছে, যে শিশুটি সেইসব হাজারো এতিম শিশুদের একজন যাদের অভিভাবকদের একজন বা দুজনই এইডসে আক্রামত্ম হয়ে মারা গেছে। কিন্তু এরকম আরো হাজার শিশুর ভবিষ্যৎ এই শিশুটির মতো হবে না। আর সেজন্যই আমরা সিনেমায় সাহায্যের আবেদন শুনি। UWESO-এর গরিব নারীরা যত বেশি সাহায্য পাবে তত বেশি এগিয়ে আসতে পারবে এতিম শিশুদের রক্ষা করতে। কারণ এসব নারী নিজেদের সংসারের পাশাপাশি এক প্রকার দেশ গঠনের দায়িত্বও হাতে নিয়েছে। সিনেমার শেষটায় আমরা দেখি উগান্ডার নারীদের সম্মিলিত নৃত্য, আফ্রিকান সুর ও ছন্দে তারা গেয়ে উঠছে ‘সাম্বালো’ শিরোনামের এক সংগীত। একেবারে শেষ দৃশ্যে আমরা দেখি কিয়ারোস্তামি ও তাঁর টিম বিমানে উঠে যাচ্ছে। বিমানের জানালায় তুলোর মতো মেঘের দঙ্গল। আর মেঘের আড়ালে উগান্ডার সেইসব শিশুর ঝাপসা মুখ।
ইরানে ফিরে গিয়ে যখন কিয়ারোস্তামি তাঁর স্কাউটিং ফুটেজগুলো ফিরে দেখেন। নিজের ঢঙে পুরোটা এডিট করেন তিনি। তখনো তাঁর উদ্দেশ্য ফাইনাল কাট দেখার পর মূল সিনেমার শুটিং করবেন তাঁরা। ফাইনাল কাট দেখে কিয়ারোস্তামি ও তাঁর এবিসি আফ্রিকা টিম রিয়ালাইজ করে যে তারা যে ফিল্মটা তৈরি করতে চাইছিল তা অলরেডি প্রস্ত্তত হয়ে আছে। কিন্তু কিয়ারোস্তামি তারপরও সন্তুষ্ট ছিল না। দীর্ঘ আট মাস, প্রায় দুশো ঘণ্টার স্কাউটিং ফুটেজ থেকে এডিট করার পর এই সিনেমার কাজ শেষ হয়।
এবিসি আফ্রিকা সিনেমার কারিগরি দিক নিয়ে প্রশ্ন করতে পারে অনেকে। কিন্তু সিনেমা দেখার পর আবার সে প্রশ্ন ফিরিয়েও নিতে পারে। কারণ পঁয়ত্রিশ মিমির মতো দামি ক্যামেরায় গস্ন্যামারাইজড আফ্রিকাকে খুব বেমানান লাগত বলে তারা বোধ করত। কিয়ারোস্তামি একটা ইন্টারভিউতে এ প্রসঙ্গে বলেন –
আমার মনে হলো পঁয়ত্রিশ মিমি ক্যামেরা হয়তো আমাদের ক্রুদের সঙ্গে উগান্ডার মানুষদের পারস্পরিক যোগাযোগটাকে সীমিত করে দিত, যেখানে কিনা ডিজিটাল ক্যামেরা প্রতিটি অ্যাঙ্গেল থেকেই সত্যিটাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে। আর সেই সত্যিটা কোনো সাজানো সত্যি নয়। আমার জন্য এই ক্যামেরাটা একটা দারম্নণ আবিষ্কার। ঈশ্বরের মতো এই ক্যামেরাটাও সর্বত্র সদা বিদ্যমান থাকতে পারে।
আববাস কিয়ারোস্তামির অন্যান্য সিনেমার মতো এবিসি আফ্রিকাও পোয়েটিক সিনেমা কি না তা নিয়ে বিতর্ক আছে। অনেকেই বলছে, এটি কিয়ারোস্তামির নতুন পথে যাত্রা, আবার অনেকেই এই সিনেমায়ও ট্রেডমার্ক পোয়েটিক সিনেমার খোঁজ পেয়েছে। টাইটেল ক্রেডিটের পরপর সাউন্ডের খেলা, বারবার উগান্ডার প্রকৃতির কাছে ফিরে আসা, আলো অন্ধকারের কারসাজি, মেঘের ওপর উগান্ডার শিশুদের মুখ ভেসে ওঠা, সর্বোপরি দুঃখ আর আনন্দের পারস্পরিক সহাবস্থানসহ বেশকিছু পোয়েটিক মুহূর্ত আমরা পাই এই সিনেমায়।
ডকুমেন্টারিটি হয়ে ওঠার গল্প জানা থাকলে কেউই এটাকে একটা পরিকল্পিত সিনেমা বলতে রাজি হবে না। কিয়ারোস্তামি বেঁচে থাকা অবস্থায়ও হয়তো সেরকম ভাবত না। কিন্তু সিনেমাটার দিকে আরেকবার তাকালে দেখা যাবে পরিকল্পনা না থাকলেও সিনেমাটা তৈরি করার সময় একটা অদ্ভুত স্বতঃস্ফূর্ততা কাজ করেছে কিয়ারোস্তামির মাঝে। IFAD-এর কর্মকর্তাদের মুখ থেকে জানা যায় কিয়ারোস্তামি উগান্ডায় ফুটেজ নিতে নিতে মাঝে মাঝেই একা হয়ে যেতেন। নিজের ভাবনায় ডুবে যেতেন। বোঝা যায়, ফুটেজ সংগ্রহের সময়ও কিয়ারোস্তামির মাথা ও মনন দুটোই কাজ করছে। যার প্রমাণ আমরা পাই এবিসি আফ্রিকাতেই। এবিসি আফ্রিকার ABC-র আলাদা অর্থ আছে। এইডস থেকে বাঁচার তিনটি উপায়ের দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে তিনটি আলাদা অক্ষর দিয়ে। কিন্তু কিয়ারোস্তামির সিনেমার টাইটেলে ABC যেন একটা নতুন মাত্রা পায়। এটি যেন ছোটবেলার সহজ পাঠের ABC হয়ে ওঠে। এবিসি আফ্রিকা সিনেমার মধ্য দিয়ে আববাস কিয়ারোস্তামির কাছ থেকে আসলে দর্শকরা আফ্রিকার একটা সহজ পাঠই পায়।
আববাস কিয়ারোস্তামি এমন একজন পরিচালক যিনি তাঁর সিনেমা নিয়ে একজন সত্যিকারের শিল্পীর মতো ভাবতে ভালোবাসেন। কিয়ারোস্তামি কখনোই মেসেজ বা আদর্শের কথা বলতে সিনেমা বানান না। কিয়ারোস্তামির কাছে উত্তরের চেয়ে প্রশ্নটাই বেশি জরম্নরি। কারণ প্রশ্ন ভাবনার জন্ম দেয়। তাই তাঁর সিনেমায় বিভিন্ন পয়েন্ট অব ভিউ থেকে প্রশ্ন উঠতে দেখা যায়। আর সেসব প্রশ্ন প্রোটাগনিস্টের ভাবনা ও বিশ্বাসকেই যেন বারবার ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো করে দেয়। বিচলিত করে দর্শককেও। দর্শক সিনেমা দেখার পরও ভাবনায় ডুবে থাকে সিনেমাটা নিয়ে, তাদের মতো করে সিনেমাটাকে সংজ্ঞায়িত করতে চায়। কিয়ারোস্তামির একটা সিনেমা একশ দর্শকের কাছে একশ রকমের সিনেমায় রূপামত্মরিত হয়। n