logo

কিঙ্করদার স্মৃতি

সু শো ভ ন  অ ধি কা রী

 

রামকিঙ্করের কথা মনে পড়লেই স্রোতের বিরুদ্ধে চলা এক বেপরোয়া শিল্পীর কথা মনে পড়ে। আমরা জানি, দাগাবুলোনো পথের বিরুদ্ধে চলা রামকিঙ্করের পরম ধর্ম। এবং এই বিরুদ্ধতা কেবল মাটি-পাথর আর ক্যানভাসেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ছবির ফ্রেম ছাপিয়ে, ভাস্কর্যের উঠোন পেরিয়ে সে মিশেছিল তাঁর প্রতিদিনের জীবনযাপনের সঙ্গে। আজ পেছন ফিরে ভাবলে অবাক লাগে, বাঁকুড়ার নিতান্ত সাধারণ গ্রামের সেই কিশোর ছেলেটি কীভাবে পার হয়ে এসেছিল এতটা কঠিন রাস্তা? সারল্যমাখা কিশোর কিঙ্করের সে অমলিন গ্রাম্যতা কখনো কি হোঁচট খায়নি কবির আশ্রমের অভিজাত চৌকাঠে? কীভাবে ভেঙেচুরে নিজেকে নির্মাণ করেছিলেন প্রতি মুহূর্তে? সহজ পথের বাইরে ছিটকে এসে ব্যক্তিজীবনের এ কোন বি-নির্মাণ!

তাঁর প্রতি আশ্রম-আচার্যের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় ছিল – একথা আমরা শুনতে পাই। শুধু কি সেইটুকুই অবলম্বন, নিশ্চয় তা নয়। আধুনিকতার নিরিখে তাঁর সঙ্গে শিল্পভাবনার সঙ্গে অনেক সময় বিরোধ ঘটলেও নন্দলাল কখনো বাধা দেননি রামিকঙ্করকে – যা রামকিঙ্কর নিজ মুখেই স্বীকার করেছেন। কিন্তু পারিপার্শ্ব কীভাবে গ্রহণ করেছিল এই ‘পাগলপারা’ মানুষটিকে? রং-তুলি, ছেনি-হাতুড়ি বা সিমেন্ট-মোড়ামের পাশাপাশি শান্তিনিকেতনের মাটিতে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের জ্যামিতি কীভাবে অাঁকা হয়ে চলেছিল, তা জানা নেই আমাদের। বাইরে থেকে আমরা কতটুকুই বা তাঁকে জানি! নিস্তব্ধ নির্জন দুপুরে আশ্রমের রাঙা রাস্তায় চলতে চলতে মনে হয় – এই কাঁকুড়ে মাটিতে, শালের বনে পাতার মর্মরে, আম্রকুঞ্জের আলোছায়ায় বুঝি অাঁকা আছে তাঁর দগদগে জীবন-জেহাদের প্রগাঢ় জলছবি।

পেছন ফিরে তাকিয়ে মনে হয়, নিজের প্রতিষ্ঠানে কখনো কি বিরোধিতার মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়নি এই মানুষটিকে? প্রায় একই সময়ের প্রেক্ষাপটে কাজ করে চলেছেন অপর দুই প্রবল প্রতিভাধর শিল্পী। একজন গুরু নন্দলাল ও অন্যজন সহশিক্ষক বিনোদবিহারী। নন্দলালের মানস-অভিমুখ সর্বদাই ছিল ভারতীয় জাতীয়তাবাদের দিকে। বিনোদবিহারীর বিদগ্ধ মন দূরপ্রাচ্যের শিল্পধারা থেকে অনুপ্রাণনা নিয়ে তাকে নিজের মতো আত্তীকরণ করেছে। অন্যদিকে রামকিঙ্করের দৃষ্টি প্রাচ্যের সীমানা পেরিয়ে প্রত্যক্ষভাবে পশ্চিমের আধুনিক শিল্প-আন্দোলনের দিকে। ‘গুরু’র মতো পূর্ব-পশ্চিমের দোলাচল তাঁর মনকে কখনো বিভ্রান্ত করে দিতে পারেনি। তাঁর কাছে তুলির সূক্ষ্ম নিপুণ টানের পাশে প্রধান হয়ে উঠেছে শিল্পীর অন্তরের তীব্র অভিব্যক্তি। শুধু তাই নয়, প্রথাবদ্ধ উপকরণের অভাবে থেমে যায়নি তাঁর দুর্মর চিত্রীসত্তা, হাতের কাছে পাওয়া এলোমেলো রঙের কৌটো অকৃপণভাবে উপুড় করে দিয়েছেন ক্যানভাসের গায়ে। শিল্পের স্থায়িত্ব নিয়ে মায়াবী পিছুটান কোনোদিনই তাঁর ছিল না। খেয়াল করলে দেখা যাবে, প্যালেটের অভাবে রং তৈরি করতে নির্দ্বিধায় টেনে নিয়েছেন ফেলে দেওয়া মাটির সরা, পড়ে থাকা নারকোলের মালাই, পরিত্যক্ত ভাঙা টিনের ঢাকনা – এসব আরো কত কী! এমনকি ক্যানভাসের অনুপস্থিতিতে চটের ওপর ছবি অাঁকতেও তাঁর কিছুমাত্র অনীহা ছিল না। বিস্ময়ে হতবাক হই যখন দেখি, শৈল্পিক উপকরণের বিশেষ কায়দা-কৌশল বা শৌখিন টেকনিক তিনি দুপায়ে মাড়িয়ে গিয়েছেন তাঁর সৃষ্টির মুহূর্তমালায়। এদিক থেকে রামকিঙ্করের এই সৃষ্টির তাগিদ, ইনার-আর্জ অনেকটা আশ্রমপিতা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মিলে যায়। যথাযথ উপকরণের জন্য অপেক্ষা করার ধৈর্য তাঁরও কোনোদিন ছিল না। ছেঁড়া কাগজ, ফেলে দেওয়া বাতিল খাম, খবরের কাগজের টুকরো ইত্যাদি ওয়েস্টপেপার বাস্কেটের নানা জিনিস অবলীলায় জড়ো হয়েছে কবির চিত্রপট হিসেবে। তাঁর তুলি ঝাঁপিয়ে পড়েছে কাঠের আলমারির গায়ে। রঙের অভাবে গাছের পাতা, ফুলের পাপড়ি ঘষে দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা ছিল না ‘ছবি-অাঁকিয়ে’ রবি ঠাকুরের।

আবার রামকিঙ্করের কথায় ফিরে আসি। প্রথমদিকে ভাস্কর্যের জন্য প্রয়োজনীয় ম্যাটেরিয়ল তেমন পাওয়া যেত না, বিশ্বভারতীর আর্থিক সংকটে স্কাল্পচার বিভাগ দীর্ঘদিন ভালো করে গড়ে উঠতে পারেনি – এ কথা আমরা জানি। আবার নন্দলালের প্রধান ঝোঁক ছিল চিত্রকলার দিকে। তাই গোড়ার দিকে রামকিঙ্কর যখন বড় আকারের ভাস্কর্য গড়তে চেয়েছেন, তখন অনেক ক্ষেত্রে তা নির্মাণের সময় যথাযথ লোহার কাঠামোও তৈরি করা যায়নি কেবল পয়সার অভাবে। কিন্তু তবুও থেমে থাকেনি শিল্পীর হাত, নিদারুণ সীমাবদ্ধতার মধ্যেও দুর্বার কাজ করে চলেছেন রামকিঙ্কর। ফলে খোলা আকাশের তলায় রক্ষিত তাঁর একাধিক কাজ আজকে কিছুটা বিপন্ন হয়ে পড়েছে; যদিও এর দায় শিল্পীর ওপর বর্তায় না। এই অসামান্য শিল্পকাজ রক্ষা করতে আমরাই দায়বদ্ধ। এহেন শিল্পীর সামনে আমাদের মাথা আপনিই নত হয়ে আসে। ছাত্রজীবনে তাঁর অমৃত-সান্নিধ্যের দুয়েক টুকরো সোনার স্মৃতি এখানে নিবেদন করি।

সেবারে নন্দন মেলার সময়। থাকতে না-পেরে বিকেলের বেশ আগেই পৌঁছে গিয়েছি কলাভবনের চত্বরে। পেইন্টিং, গ্রাফিক্স আর ক্রাফটের স্টল পেরিয়ে স্কাল্পচারের দিকে আসতেই বনপুলকের গাছের তলায় নজরে পড়ল একটা নিচু টেবিলে সাজানো আছে এক সারি ভাস্কর্য : মুখে মাছ নিয়ে বিড়াল। কালীঘাটের পটে যেমন দেখা যায় ঠিক তেমনটা নয়, আবার একটু মিলও রয়েছে। কালীঘাটের পটে বিন্যাসের পুরো ব্যাপারটা একটা ওভ্যাল সেপের মধ্যে ধরা আছে। সেখানে পটুয়ার তুলির টানে বক্ররেখার প্রাধান্য। আর এখানে বিড়ালের ফর্মটা ভূমি থেকে উঠেছে কতকটা সমদ্বিবাহু ত্রিভুজের মতো, আর মুখের মাছটা ধরা আছে ভূমির সঙ্গে সমান্তরালভাবে। কাজগুলো আমাকে কী এক অদৃশ্য শক্তিতে কাছে টেনে আনলে। কাঁচা মাটি দিয়ে গড়া, বুঝি সদ্য তৈরি হয়েছে সেই কাজগুলো। টেবিলের ওপর খবরের কাগজ পেতে সেগুলো সার দিয়ে রাখা আছে আর নিচে মোটা মোটা অক্ষরে লেখা ‘রামকিঙ্কর-কৃত/প্রতিটির দাম পাঁচ টাকা’। এক সারি ভাস্কর্য হলেও তার কোনোটাই ছাঁচে গড়া নয়, প্রত্যেকটি আলাদাভাবে তৈরি। সেদিন কিঙ্করদাকে অবশ্য দেখতে পাইনি, কিন্তু তাঁর কাজ আমাকে সে জায়গা ছেড়ে নড়তে দিলে না। অথচ আজ বসে ভাবি, ওই অতগুলো কাজের থেকে একখানাও সেদিন কিনে রাখবার মতো বুদ্ধি আমার মাথায় কিছুতেই কেন এলো না! অমন একজন কিংবদন্তি স্রষ্টার একেবারে কাছে যাবার সুযোগ এসে গেল হঠাৎ। বোলপুরের বিশু পাল, আমাদের বিশুদা – সে তখন শান্তিনিকেতনে আমাদের সেরা ফটোগ্রাফার। আমাদের কাছে তার জায়গা রঘু রাই বা সুনীল জানার চেয়ে অনেক উঁচুতে। একদিন দুপুরে হোস্টেলে এসে বললে, ‘চল, একজনের বাড়ি নিয়ে যাব।’ এর চেয়ে সে ভালো করে ভাঙলে না কথাটা, সাইকেলে চড়িয়ে নিয়ে গেল অবনপল্লীর দিকে। কিছুদূর গিয়ে একটা ছড়ানো-ছিটোনো মাটির বাড়ির সামনে এসে বললে, ‘এখানে কিঙ্করদা থাকে, ভেতরে চল।’ দুদিকে দুটো খরের চাল দেওয়া মাটির ছোট বাড়ি, অনেকদিন ছাওয়া হয়নি সে ঘরের চাল। আর তার আগাছা ভরা উঠোনে পড়ে আছে কিছু পাথরের টুকরো, অসমাপ্ত কয়েকটা কাজ। বোধকরি মাটির দাওয়াতেই বসে ছিলেন শিল্পী, বিশুদা ডাক দিতেই এগিয়ে এলেন। আমি একেবারে থতমতো খেয়ে ঢিপ করে প্রণাম করলাম। বিশুদা বললে, ‘কৃষ্ণনগর থেকে এসেছে, সবে ফার্স্ট-ইয়ার।’ কিঙ্করদা হাসতে হাসতে বললেন, ‘বাঃ বাঃ বেশ, কেষ্টনগরের পুতুল আর চন্দননগরের কলা তো বিখ্যাত, কি বলো।’ একথার কী জবাব দেব বুঝতে পারছি না। কিঙ্করদাই ঘুরিয়ে দিলেন প্রসঙ্গ, এগিয়ে এসে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন এক অসমাপ্ত কাজের দিকে। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন, ‘ওই দেখো, আমি একটা ভূত বানিয়েছি।’ সেদিকে তাকিয়ে দেখি, কিঙ্করদার সেটা হলো সেই বিখ্যাত কাজ ‘স্পিড’-এর একটা ভার্সান, বেশ বড় আকারের কাজ। দীর্ঘ দুই পা ফেলে কেউ যেন ঝড়ের গতিতে এগিয়ে চলেছে। তখনো শেষ হয়নি কাজ – সিমেন্টের আস্তরণ ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে লোহার শিক।

সেদিন আর বেশি কথা হলো না, তবে বিশুদা বেশ কয়েকটা ফটো তুলল। তার মধ্যে একটা ছবিতে কিঙ্করদা আমার হাত শক্ত করে ধরে আছেন, আর সামনের দিকে তাকিয়ে কী একটা যেন বোঝাচ্ছেন আমাকে। জ্বলন্ত আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আমার সে অসহায় ছবিখানা আজো আলমারির বিশেষ তাকে বাদামি খামের মধ্যে সযত্নে রক্ষিত আছে। পরের বার তাঁর কাছে গেলাম একাই। সেদিন গেলাম কলাভবনের ক্লাসের শেষে। দেখি, তাঁর ঘরের লাগোয়া মাটির দাওয়ায়, প্রায় মাঝামাঝি তৈরি হয়েছে একটা আলগোছে পার্টিশান। আর সেটা করা হয়েছে তাঁরই চিত্রিত ক্যানভাস দিয়ে। তার একদিকে ইতস্তত রান্নার আয়োজন, আর অন্যদিকে কয়েকটা ভাঙা মোড়া ছড়ানো। যেগুলো কাজে লাগে তাঁর এই অবারিত দ্বার অতিথিদের স্বাগত সম্ভাষণে। আশেপাশেই পড়ে আছে কয়েকটা মাটির সরা আর নারকেলের শুকনো মালা – যা ব্যবহৃত হয় ভুবনজোড়া এই শিল্পীর রঙের প্যালেট হিসেবে। এগুলোর কোনোটা ঘন নীল বা কোনোটায় উজ্জ্বল হলুদ রং মাখানো। সেদিনেও কিঙ্করদার মুড বেশ ভালো। কী এঁকেছি জানতে চাইলেন, আমার স্কেচ খাতাখানা উল্টেপাল্টে দেখলেন। এবং আমাকে স্তম্ভিত করে আমার খাতায় দু-একটা অাঁচড় কেটে দেখিয়ে দিলেন কীভাবে কোনো অবজেক্টের ভেতরের মূল কাঠামোকে ধরতে হয়। আমার মতো সাধারণ ছাত্রের খাতায় পড়ল স্বয়ং বিশ্বকর্মার হাতের আঁচড়, আমি তো সেদিন হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে হোস্টেলে ফিরে এলাম। এরপর অনেকবার তাঁর কাছে গিয়েছি, প্রত্যেকবারই যে সাদর অভ্যর্থনা জুটেছে তা নয়। বেশি পরিমাণে কাজ করা হয়নি বলে ধমকও খেয়েছি। তা সত্ত্বেও পিছপা হইনি, দূর থেকে বা কাছ থেকে ওঁকে লক্ষ করতে চেয়েছি।

সেবারে নন্দন মেলার শেষে নন্দলালের জন্মদিনে গোয়ালপাড়ায় কলাভবনের পিকনিক। পুরনো ও নতুন সকলে মিলে সে একেবারে জমজমাট ব্যাপার। এক পাশে গাছের তলায় রান্নার আয়োজন হয়েছে। এক পাশে নন্দলালের দুই সোনার মেয়ে গৌরীদি আর যমুনাদি বসে বসে শরের কাঠি, শুকনো ঘাস এইসব দিয়ে গয়না বানাচ্ছেন, মেয়েরা সবাই হাঁ করে তাকিয়ে দেখছে। আর ওদিকে কিঙ্করদা আপনমনে রয়েছেন একটু দূরে। তিনি সঙ্গে এনেছেন একগোছা সাদা কার্ড আর তার ওপরে পেনসিলে অনর্গল স্কেচ করে চলেছেন। কোথাও বা কার্ডের এক কোণে লিখে রাখছেন ‘গোয়ালপাড়া’। আমরা দুয়েকজন পেছন দিকে দাঁড়িয়ে তাঁকে বিরক্ত না-করে তাঁর রেখার টান লক্ষ করছি। দূরে গাছের ছায়ায় শতরঞ্জি পেতে গোল করে নাচগানের আসর জমে উঠেছে। কৌশিকদা ও অন্য শিক্ষকেরা রয়েছেন সেখানে। একটি ছাত্র কথাকলির অনুসরণে নাচ করছিল। কিঙ্করদা কিছুক্ষণ দেখে বললেন, ‘ও ঠিক কথাকলি হচ্ছে না, নাচতে নাচতে জাম্প করে এখান থেকে ওখানে চলে যেতে হবে’ বলে হাত দিয়ে দূরত্ব দেখিয়ে বললেন, ‘সে নাচতো বটে কেলু নায়ার’।

এমন সময় আগরতলা থেকে আসা এক ছাত্রী হুড়মুড় করে এসে কিঙ্করদার সামনে মেলে ধরলে তার সিক্ত অসমাপ্ত একখানা জলরঙের ছবি। ম্যাসোনাইট বোর্ডে ক্লিপ দিয়ে সাঁটা সে ছবির গায়ে কোথাও কোথাও রং পড়েছে, তবে কাগজের বেশিরভাগ অংশই ফাঁকা, সাদা অবস্থায় পড়ে আছে। কিঙ্করদা একটু বিরক্ত হলেন, কিন্তু মেয়েটি দমবার পাত্রী নয়। সে প্রায় জোর করে সেই মুহূর্তে তার ছবি নিয়ে কিঙ্করদার মতামত আদায় করতে চায়। কিঙ্করদা তাকে বললেন আগে ছবিটা শেষ করে তারপরে নিয়ে আসতে। কিন্তু মেয়েটি তা শুনতে রাজি নয়। অগত্যা তার সেই অসমাপ্ত ছবির দিকে আঙুল দিয়ে রামকিঙ্কর জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখানে কী’, মেয়েটি বললে ‘আকাশ’। পরের প্রশ্ন ‘এটা কী’, উত্তর ‘মাটি’। ‘আর এই জায়গায় কী’! মেয়েটি পুনরায় উত্তর দিলে ‘জল’। এইবার কিঙ্করদা বেশ ধমকের সুরে বলে উঠলেন, ‘না, না। মুখে বললে হবে না। তোমার ছবি বলবে আমি আকাশ, আমি জল, আমি মাটি। যাও যাও নিয়ে যাও, ছবি শেষ করো।’ এবারে মেয়েটি তাঁর সামনে থেকে সরে গেল। আর মুহূর্তে আমার চোখের সামনে থেকে যেন সরে গেল একটা পর্দা, বুঝতে পারলাম, ছবিকে তার নিজের ভাষায় কথা বলতে হবে – মুখের ভাষায় নয়। আমার কাছে ফুটে উঠল ভিসুয়াল আর্টের নিজস্ব তাৎপর্য। ছবির মধ্যেই তো নিহিত আছে চিত্রীর ভাব, ভাষা আর অভিব্যক্তি, তবে তাকে বোঝাতে কেনই বা আলাদা করে শব্দের জোগান দিতে হবে শিল্পীকে? পরে মনে মনে ভেবেছি, সেদিন এক লহমায়, ওই একটা ছোট্ট কথার আঁচড়ে ছবির সত্যিকারের অর্থটুকু চকিতে আমাদের মনে তিনি গেঁথে দিয়েছিলেন। এখনো তাঁর সেদিনের সেই গলার স্বর, তাঁর বলার ভঙ্গি চলচ্ছবির মতো আমার স্মৃতিতে আঁকা হয়ে আছে।

ক্রমে অবনপল্লীর ওই মাটির বাড়ি থেকে কিঙ্করদাকে প্রায় জোর করেই নিয়ে আসা হলো শান্তিনিকেতন আর শ্রীনিকেতনের মাঝামাঝি অবস্থিত বিশ্বভারতীর কোয়ার্টারে। চারপাশে রয়েছে অন্য শিক্ষকদের কোয়ার্টার, তার মাঝখানে থাকলে তাঁকে দেখাশুনোরও সুবিধে হবে এমনটাই সকলে ভাবলেন। আর সবচেয়ে বড় কথা, প্রায় পাশেই রয়েছেন ভাস্কর শর্বরী রায়চৌধুরী। তিন-চারটে কামরার এই খোলামেলা পাকা বাড়িতে তাঁর স্বাস্থ্যও ভালো থাকবে – এইটেই মনে করলেন সকলে। আমার মনে আছে কিঙ্করদার সে কোয়ার্টারের নম্বর ছিল কুড়ি। বাইরের বারান্দার সামনে ছোট নীল রঙের বোর্ডে সাদা রঙে লেখা ছিল সেই সংখ্যা। ও বাড়িতে গিয়েছি অনেকবার, কথা হয়েছে তাঁর সঙ্গিনী রাধারাণীর সঙ্গেও।

একদিন কলাভবনে গিয়ে খবর পেলাম, কিঙ্করদা বিশ্বভারতীর পিয়র্সন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন জ্বর নিয়ে। বিকেলে গিয়ে দেখি, প্রায় ফাঁকা ঘরের এক পাশে জানলার ধারের একখানা জেনারেল বেডে খালি গায়ে স্থির হয়ে বসে আছেন তিনি, কাছে উদ্বিগ্ন মুখে রাধারাণী। কিঙ্করদা স্থির, মুখে কোনো কথা নেই। দেখে মনে হলো, লিভিং লেজেন্ড রামকিঙ্কর যেন স্বয়ং এক ধ্যানগম্ভীর নিশ্চল ভাস্কর্য। কে জানে শিল্পীর মনের গভীরে তখন কোন ভাঙা-গড়া, কোন নির্মাণ আর সৃষ্টির খেলা চলেছে। শুনেছি, শিল্পীর জীবনে এমন এক পর্ব আসে – যখন মনের পটে আপনিই তৈরি হয় রূপের বিচিত্র আকার। তাকে আর কাগজ-ক্যানভাসে, ব্রোঞ্জ বা পাথরে নির্মাণ করতে হয় না, অন্তরের চিত্রশালাতেই সে সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে। আবার তা সরে গিয়ে হাজির হয় ভিন্নতর ‘আকারের মহাযাত্রা’। কিঙ্করদার চিত্তপটে কি তবে সেই খেলা শুরু হয়েছে, কী জানি! সেই অবসরে আমি চুপিচুপি আমার স্কেচ খাতাটা ব্যাগ থেকে বার করে, একটু দূর থেকে তাঁর পোর্ট্রেট করার চেষ্টা করলাম। হসপিটালের ঘরের ভেতরে আলোটা বেশ কম, তাঁর মুখের রেখাগুলো বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে। কোনো রকমে অাঁকা শেষ করে আমি খাতা বন্ধ করেছি – অমনি অকস্মাৎ যেন বজ্রপাত হলো আমার শিয়রে। কিঙ্করদা হাত বাড়িয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘কেমন হলো দেখি’। তখন আমার ভেতরে বুঝি রামায়ণের সেই সীতার পাতাল প্রবেশের পর্ব শুরু হয়েছে। মনে হচ্ছে এক দৌড়ে পালিয়ে যাই। কিন্তু সূর্যের আদেশ অমান্য করে কার সাধ্যি! রবি ঠাকুরের কবিতার মতো ‘দুরু দুরু বুকে’ খাতাটা তাঁর হাতে সমর্পণ করতেই পুনরায় ‘নামিল আঘাত’ এবং সত্যি সত্যিই আমার ‘পাঁজর উঠিল কেঁপে’। ধমকের সুরে কিঙ্করদা বলে উঠলেন ‘একি, ছবির নিচে আর্টিস্টের সই কোথায়? ছবি অাঁকার পর সবসময় নাম সই করে রাখবে’ – এই বলে তিনি নিজেও ওই পাতার এক পাশে খসখস করে তাঁর অটোগ্রাফ লিখে দিলেন, আমার অনুরোধের অপেক্ষা না করেই। কিঙ্করদার সেই বকুনি মাখানো নির্দেশে এর পরে আর সহজে ভুল হয় না।

আর একদিনের কথা। সকালের দিকে তাঁর ফর্টি-ফাইভের কোয়ার্টারে গিয়েছি। সেদিন দেখি তাঁর মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল প্রায় উধাও। ছোট করে ছাঁটা চুলে সাবান মেখে স্নান-টান সেরে পরিপাটি হয়ে ‘সুবোধ বালক’ সেজে বসে আছেন। অন্য দিন যেমন অগোছালো দেখি, কিন্তু আজ দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে সাদা ফতুয়ায় রামকিঙ্কর যেন একেবারে ‘বাবুটি’। আমি যেতেই এক গাল হেসে সাদর সম্ভাষণ। বললেন, সকালবেলা রামু এসে তাঁর চুল-দাড়ি সব সাফ করে দিয়ে গিয়েছে। রামু এই এলাকার এক বিহারি ছেলে। ছুটির দিনে, বিশেষ করে বুধবারে সবার বাড়ি গিয়ে চুল কেটে বেড়ায়। শুধু তাই নয়, আমরা অর্থাৎ হোস্টেলের ছেলেরা অনেকেই তার পাকা খদ্দের। সেদিন কিঙ্করদার বিশেষ খুশির একটা কারণ বোধ হয়, তাঁর কাছে সদ্য পৌঁছানো একটা চিঠি। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মান জানাতে চায় – এই মর্মে সেখান থেকে চিঠি এসেছে। আমার স্পষ্ট মনে আছে, বাইরের ঘরের তাকে একটা বইয়ের ভেতর রাখা চিঠিখানা প্রায় তিনবার জোরে জোরে পড়তে হলো আমাকে। আর প্রতিবারই তাঁর মুখমন্ডলে কেমন শিশুর মতো খুশি উপচে উঠছিল।

সব্যসাচী রামকিঙ্কর বেইজ। তাঁর আশ্চর্য জীবনযাপন, অলকসামান্য ছবি আর ভাস্কর্যমালাকে কি কোনো পুরস্কারের নিগড়ে বাঁধা যায়? এর আগেও একাধিক পুরস্কারে ভরে উঠেছে ডালা। তবু একথা স্বীকার করতেই হবে, তাঁর কাজের পাশে এসব পুরস্কারের মালা নেহাতই ম্লান হয়ে এসেছে। আমাদের দেশে রামকিঙ্করই তো সেই শিল্পী – যিনি মন্দিরের দেওয়াল থেকে, পাহাড়ের গা থেকে ছিঁড়ে ভাস্কর্যকলাকে উপড়ে এনেছিলেন – মানুষের মাঝে। প্রোথিত করেছিলেন আমাদের চোখের সামনে প্রকৃতির খোলা দরবারে। প্রতিমা তৈরির শিল্প আর স্কাল্পচারের তফাৎটুকু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের। ভাস্কর্যকে স্টুডিয়োর অন্দর ছেড়ে বাইরে এনে তার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই আলো-বাতাস-মাটি ঘেরা উন্মুক্ত ভুবনে ভাস্কর্যকে দেখবার চোখ, তাকে অনুভব করবার বোধ সযত্নে নির্মাণ করে দিয়েছেন। সে কি একদিনে ঘটেছে? এ অসাধ্য সাধন করতে কত সীমাবদ্ধতা, কত কঠিন চ্যালেঞ্জ, কত দুর্বার হার্ডলের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছিল তাঁকে – তার কতটুকুই বা আমরা জানি?

কিঙ্করদা সেদিন বেশ মুডে থাকায় নিজে থেকেই আমার কাজ দেখতে চাইলেন। আমার লেআউটের খাতাটা মন দিয়ে দেখে বললেন, আমার বাকি ছবিগুলো হোস্টেল থেকে নিয়ে এসে যেন তাঁকে দেখাই। আরো বললেন, ‘আমার এই ঘরেই তোমার একটা একজিবিশন করে ফ্যালো, হাঃ হাঃ হাঃ।’ কিন্তু সে অলৌকিক সুযোগ আমার জীবনে আর আসেনি। এর কিছুদিন পরে তাঁকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেদিন ওই মাহেন্দ্রক্ষণে আমি কিঙ্করদার কাছ থেকে তাঁর স্নেহের দান হিসেবে পেয়েছিলাম দুয়েকটা ছবি। আমার খাতার পাতায় এঁকে দিয়েছিলেন একটা সূর্যমুখী ফুল, যা ছিল তাঁর বিশেষ প্রিয়। শুনেছি কেউ ছবি এঁকে দিতে বললে তিনি অাঁকতেন সূর্যমুখীর গুচ্ছ। আর সে তো ওঁকেই মানায়। পাশাপাশি আমাদের মনে পড়ে সাত সাগর পারের তাঁরই মতো আর এক পাগল শিল্পীর কথা। বারংবার যাঁর ক্যানভাস ঝলসে উঠেছে জ্বলন্ত সূর্যমুখীর আগুনে। সে শিল্পী আর কেউ নন, তিনি ভ্যানগগ। এবং মুহূর্তে ভ্যানগগ আর রামকিঙ্কর যেন আমাদের কাছে একাকার হয়ে আসে।

Leave a Reply