অ লো ক ব সু
মিলনায়তনে ঢুকতেই প্রশান্তির পরশ মিলল। মিলনায়তনের ভেতরে কোনো মঞ্চ নেই, আছে বর্গাকৃতি একটি স্থান। সেখানে কার্পেট বিছানো। কার্পেটের রং উজ্জ্বল ধূসর, যা খুব সহজেই মরুভূমির কথা মনে করিয়ে দেয়। আর কার্পেটের ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছে ৩০-৩৫ জন তরুণ-তরুণী। তারা পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে বসা। তাদের পরনে আরবদেশীয় ধরনের সাদা রঙের পোশাক। প্রত্যেকের হাতে জ্বলন্ত মোমবাতি। কণ্ঠে ‘ইয়া নবী সালা মালাইয়াকা’-এর হামিং। এবার নিশ্চয়ই বুঝতে আর অসুবিধা হওয়ার কথা নয় নাটকের বিষয়বস্ত্ত কী। হ্যাঁ, বলছিলাম কারবালার কাহিনির কথা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রথম বর্ষের প্রযোজনা কারবালার জারি নাটকের মঞ্চায়ন হয়ে গেল সম্প্রতি শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে। কারবালার এই করুণ মর্মস্পর্শী কাহিনির কথা আমাদের সবারই জানা। বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে এ কাহিনি বিস্তার লাভ করেছে নানা রকম লোকসাংস্কৃতিক আঙ্গিকে। শিক্ষিত মানুষের কাছে এ কাহিনি পরিচিতি লাভ করেছে মীর মশাররফ হোসেনের কালজয়ী সাহিত্য বিষাদসিন্ধুর মাধ্যমে।
‘দর্শক শ্রোতৃমন্ডলী, বিষাদসিন্ধুতে হাসি রহস্যের কোন স্থান নাই। আমোদ কৌতুকেরও কোন স্থান নাই। অথচ কাঁদিবার অনেক স্থান আছে। বুক চাপড়াইয়া হায় হাসান হায় হোসেন রব তুলিবার কোন স্থানাভাব নাই।’ কারবালার জারি নাটকে সূত্রধারের এ-কথন যে কত সত্য তা আমরা যুগ যুগ ধরে অবগত। তাজিয়া মিছিলে ‘হায় হোসেন হায় হাসান’ মাতমে, কিংবা গ্রাম্যকথকের বিষাদসিন্ধুর গল্পকথনে কার না চোখ সিক্ত হয়ে ওঠে? তাই বিষাদসিন্ধু কালজয়ী, ধ্রুপদী।
কালজয়ী, ধ্রুপদী আখ্যান নিয়ে সৃজনশীল মানুষের আগ্রহেরও কমতি থাকে না। তাই যুগ যুগ ধরে চলে নানা রকম নিরীক্ষা। বিগত শতাব্দীর নববইয়ের দশকের শুরুতে ঢাকা পদাতিক বিষাদসিন্ধু নামে দুই পর্বে দুটি নাটক মঞ্চায়ন করে। সৈয়দ জামিল আহমেদের নির্দেশনায় সে নাটক ঢাকার নাট্যামোদী মহলে ব্যাপক আলোচিত হয়েছিল। গত বছর তরুণ নির্দেশক জসীম উদ্দিনের নির্দেশনায় বিষাদসিন্ধুর মঞ্চে পাঠাভিনয় শুরু হয়েছে। সেটিও মঞ্চনাটক হিসেবে শিগগিরই আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন জসীম উদ্দিন। এর পরে মঞ্চে এলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের প্রযোজনা কারবালার জারি। মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদসিন্ধুর মহরম পর্ব অবলম্বনে এ নাটকের পান্ডুলিপি রচনা করেছেন ড. আফসার আহমদ এবং নির্দেশনা দিয়েছেন তরুণ নাট্যশিক্ষক রেজা আরিফ। নূরনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দুই দৌহিত্র হজরত হাসান ও হজরত হোসেনের জীবনের বিষাদগাথা নিয়ে এ নাটকের আখ্যান গড়ে উঠেছে।
প্রায় দেড় ঘণ্টার নাটক কারবালার জারি। এই দেড় ঘণ্টা দর্শকদের কারবালার প্রান্তে দাঁড় (দর্শক আসনে বসে থাকলেও চিত্ত বসিয়ে রাখা ছিল অসম্ভব) করিয়ে রাখতে সমর্থ হয়েছেন নির্দেশক ও তাঁর অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। আর এ ব্যাপারটি সহজ হয়েছে প্রযোজনাটির ডিজাইনের কারণে। দর্শকদের কাছাকাছি থেকে গল্প বলে যাওয়া প্রয়োজনমতো চরিত্রে সন্নিবেশিত হওয়ার যে জাদুকরী গুণ বর্ণনাত্মক নাটকের, তাকে সফলভাবে এ নাটকে প্রয়োগ করেছেন নির্দেশক। যুদ্ধের ময়দানে দর্শকও যেমন অবচেতনভাবে কোনো একপক্ষ অবলম্বন করেন, এ নাটকের দর্শকের অবস্থাও তাই। তাকে ঢুকে পড়তে হয় ন্যায়ের পক্ষে, সত্যের পক্ষে, মানবতার পক্ষে।
কারবালার জারি মুহূর্তেই দর্শকদের নিয়ে যায় দামেস্ক শহরে, ফোরাত নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে। জীবন্ত হয়ে ওঠেন হাসান ও হোসেন। এজিদ কিংবা সীমারের ভয়ংকর নৃশংসতা আমাদের ভীতসন্ত্রস্ত করে রাখে। বিষাদসিন্ধুর এ কাহিনি আমাদের সবারই জানা। সুতরাং কাহিনি বর্ণনা নিষ্প্রয়োজন।
নাটকটির প্রযোজনাসূত্র দাবি করে, ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাট্যাঙ্গিক জারি গানের পরিবেশনারীতিকে আশ্রয় করে প্রযোজনাটির প্রয়োগকৌশল বিনির্মিত হয়েছে। কিন্তু আদৌ কতখানি জারি গানের আঙ্গিক ব্যবহৃত হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করা যেতেই পারে। তবে সে প্রশ্ন অমূলক। প্রযোজনাটি কতটা দর্শকগ্রাহ্য হলো, কতটা সফল হলো, সেটাই বড় কথা। আঙ্গিক কিংবা রীতি তো নাটকের প্রয়োজনে। গল্পটি কীভাবে বললে দর্শক গ্রহণ করবেন, গল্পের সারাৎসার অনুধাবন করতে পারবেন, সেটাই বিবেচ্য। সে বিবেচনায় কারবালার জারি সার্থক হয়েছে।
তরুণ নির্দেশক ও নাট্যশিক্ষক রেজা আরিফ তাঁর কাজে সবসময়ই মেধার স্বাক্ষর রাখতে সমর্থ। তাঁর নির্দেশিত রুহু চন্ডালের হাড় কিংবা সে রাত ছিল পূর্ণিমা প্রভৃতি নাটকে যেমন টোটাল টিমওয়ার্কের ব্যাপারটি অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে লক্ষ করা যায়, কারবালার জারিতেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। বিপুলসংখ্যক অভিনয়শিল্পী নিয়ে একসঙ্গে মঞ্চে কাজ করার চ্যালেঞ্জটা রেজা আরিফ যে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সামাল দিতে পারেন, অনেক বড় ক্যানভাসে সফলভাবে নাটক প্রযোজনা করতে পারেন – তার প্রমাণ তিনি এবারো দিতে সমর্থ হলেন। অল্পবয়সী তরুণ-তরুণী, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রী, তারাই অভিনয় করেছে এ নাটকে। নাটকে অভিনয় করার জন্য যে বছরের পর বছরের প্রস্ত্ততি ও অনুশীলন থাকতে হয়, তা হয়তো তাদের অনেকেরই ছিল না। সে ঘাটতিটা কিন্তু খুব বড় করে চোখে পড়েনি। বরং বলতে হয় দু-চারজন তো অসাধারণ অভিনয় করেছে। নবীন শিক্ষার্থীদের দিয়ে নির্দেশক চমৎকার অভিনয় বের করিয়ে নিতে সমর্থ হয়েছেন। নির্দেশকের একটি প্রবণতা লক্ষ করা গেছে, তিনি একসঙ্গে অনেক কাজ দেখাতে চান। নান্দনিক মাধুর্যের প্রয়োজনে অনেক কিছু পরিহার করারও দরকার পড়ে কখনো কখনো। প্রাথমিক স্তরের দু-একটি থিয়েটার গেমের ব্যবহার না করলেই মনে হয় আরো পরিশীলিত হতো প্রযোজনাটি।
কারবালার জারি নাটকের মঞ্চ, প্রপস, আলো – সবকিছুই মানানসই। তবে পোশাক ও সংগীতের কথা আলাদাভাবে উল্লেখ না করলে অন্যায় হবে। সত্যিই চমৎকার পোশাক পরিকল্পনা ও সংগীত সৃষ্টি করেছেন এর নেপথ্যের কুশীলবরা। পোশাক পরিকল্পনার জন্য যেমন ধন্যবাদ জানাতে হয় কাশফিয়া সিনথি, তৃষা, শামীমকে, তেমনি মঞ্চের জন্য মো. সোহেল, আলোর জন্য সিদ্দিকুর রহমানকে। মিউজিক টিমে যারা কাজ করেছে যেমন অন্তর, নিপু, বর্ণা, সাধনা, হৃদয়, আবীর, শুভ, তৃষা, সিনথি, বৈজয়ন্তী, দীপাবলী, তরিক, সমু, এশা, সনেট, স্বাতী এদেরও সাধুবাদ জানাই। তারা চমৎকারভাবে সংগীতায়োজন করেছে। তাদের সৃজিত সংগীত এ নাটকে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছে। এ নাটকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে কোরিওগ্রাফি। আর এ কাজটি সুন্দরভাবে করেছেন আজামা শানুহু ও শারমিন রূপা। নাটকে ব্যবহৃত জারি গানের সুর ও কথা গ্রহণ করা হয়েছে মানিকগঞ্জের দুলাল বয়াতীর কাছ থেকে। দুলাল বয়াতীর মতো মানুষেরা আজো হাজার বছরের বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তুলে ধরছেন মানুষের কাছে। এই সাংস্কৃতিক বদান্যতার কারণে অবনতচিত্তে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি তাঁদের প্রতি।
সবশেষে ধন্যবাদ জানাই এ নাটকে যারা অভিনয় করেছে, তাদের সকলকে। তারা বয়সে এবং থিয়েটারে নবীন হয়েও অনেক পরিশ্রম করে তাদের অভিনয়-কুশলতা দেখাতে সমর্থ হয়েছে। তাদের নাম উল্লেখ করতে না পারায় ক্ষমাপ্রার্থী।
কারবালার জারির মতো একটি প্রযোজনা তাদের নাট্যজীবনকে সমৃদ্ধ করবে, আরো সাফল্যের দিকে ধাবিত করবে – এ প্রত্যাশা আমাদের সকলের।
[প্রবন্ধে ব্যবহৃত ছবিগুলো কারবালার জারি নাটকের বিভিন্ন দৃশ্যের]