logo

কামরুল হাসানের চিত্রকল্প : রেখার শক্তি ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব

মোস্তফা জামান

১৯৭৯ সালের নভেম্বর মাসে লন্ডনের বিশ্বখ্যাত হোয়াইট চ্যাপেল গ্যালারিতে ‘বঙ্গীয় শিল্পকলা প্রদর্শনী : বাংলাদেশ ও পূর্ব-ভারতের ঐতিহ্য’ শিরোনামে এক প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়াম ছিল এর আরেক অংশীদার। বাংলা শিরোনামটি মূল ক্যাটালগে ইংলিশ নামের পাশাপাশি ব্যবহার করা হয়। যদিও আশি পৃষ্ঠার এই পুস্তিকায় অপর কোনো বাংলা বাক্যের সন্ধান মেলে না। এই প্রদর্শনীতে যা প্রামাণ্য ছিল তা দুটি শাখায় বিভক্ত বললে সত্যের অপলাপ হয় না। একদিকে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম ক্লাসিক ধারার ভাস্কর্য, বস্ত্র, অলংকার, অপরদিকে সাঁওতাল পট, মনসা পট, কালীঘাট পট, আর কয়েক পদের ক্যালিগ্রাফি (বিশেষত ঢাকাই গুলজার রীতির সুরা), সঙ্গে গুটিকয়েক আধুনিক চিত্রের নমুনা। আধুনিক শিল্পের ভুক্তিতে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গগন ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যামিনী রায় ও গোপাল ঘোষের বেশ কিছু চিত্রের পাশাপাশি জয়নুলের একটি দুর্ভিক্ষের স্কেচ (১৯৪৩), কামরুলের জলরং ‘পিপিং’ বা ‘উঁকি’ (১৯৪৩) ও সফিউদ্দীনের ‘হোমওয়াক’ বা ‘বাড়ির পথে’ (১৯৪৪) শিরোনামের কাঠ এনগ্রেভিং স্থান পায়। জয়নুলের কাজটি বেগম জয়নুলের সংগ্রহ থেকে ধার করা, সফিউদ্দীনেরটি শিল্পকলার সংগ্রহ থেকে, আর কামরুল হাসানের অতি পরিচিত ওয়াশ বা ধৌত পদ্ধতিতে আঁকা ছবিটি ড. এনামুল হকের কাছ থেকে নেওয়া বলে উল্লেখ করা হয়। এই সারণি হাজির করার পেছনে দুটি উদ্দেশ্য লুকানো আছে : এক. বাংলাদেশের প্রধান শিল্পীদের ছবির সত্যিকার কোনো শোকেসিং দেশে ও বিদেশে আজো সম্ভব করে তোলা যায়নি। দুই. কামরুল হাসানের শিল্পীজীবনের শুরুর ধাপে আঁকা ‘উঁকি’ বরাবরই ভুল সালসহকারে পত্র-পত্রিকা ও বইতে ছাপা হয়েছে। শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃক আর্ট অব বাংলাদেশ সিরিজ-৩ : কামরুল হাসান শিরোনামের বইটির ৫৩ নম্বর পৃষ্ঠায় ঠাঁই পাওয়া এই কাজটিকে ১৯৬৭ সালের উল্লেখ করা হয়েছে। এই ত্রুটির সূচনা কোথায় তা আবিষ্কার করা কঠিন, তবে নিরন্তরের ষষ্ঠ সংখ্যায় (২০০৫) শোভন সোম এই ছবির আঙ্গিক বিচারে এটিকে প্রথম দিকের শৈলী হিসেবেই চিহ্নিত করেন, এমনকি সুনির্দিষ্টভাবে তেতাল্লিশ থেকে সাতচল্লিশের মধ্যে কোনো সময়ের আঁকা বলে দাবি করেন।

দ্বিতীয় বিষয়টি যদি হয় নেহাত শিল্পের ক্রমবিকাশের ধারা বর্ণনায় সাধারণ ব্যত্যয়, প্রথম বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভাববার অবকাশ প্রয়োজন। শিল্পের ক্রমপ্রসারমাণ বাজারে বাংলাদেশের প্রথম প্রজন্মের শিল্পীদের কাজের হদিস সামান্য। সরকারি কিংবা বেসরকারি কোনো পর্যায়েই এদের মানসম্মত শোকেসিং বা উপস্থাপনা সম্ভবপর হয়নি। যে বিশেষ সিরিজের মধ্য দিয়ে শিল্পকলা একাডেমি বিশিষ্ট শিল্পীদের অর্জনের একটা সামগ্রিক রূপ তুলে ধরতে চেয়েছে, তার মধ্যে সম্ভবত কামরুলের বইটিই সবচেয়ে বিক্ষিপ্ত চরিত্রের। এটি নানা স্কেচ, জলরং, তেলরং ও ছাপছবিতে সাজানো। এর বিক্ষিপ্ততা স্টাইলের অর্জন ধর্তব্যে না নিয়ে বিনা লজিকে ছবি সাজানোর কারণে সৃষ্ট। এর টেক্সট বা বয়ান রচয়িতা সৈয়দ আজিজুল হক তাঁর ‘কামরুল হাসানের শিল্প ও শিল্পচেতনা’ শীর্ষক লেখায় শিল্পীর জীবন ও বিষয়ের সূত্রে গড়ে ওঠা স্টাইল বা স্বভাবের ওপর আলোকপাত করেছেন, পরিচয়ের রাজনীতির উত্থানে তাঁর অবদান চিহ্নিত করে শিল্পীর পটচিত্রীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও আধুনিক স্পেস বিভাজনের প্রক্রিয়ার মাঝে পটচিত্রের রেখার সংশ্লেষে গড়ে ওঠা স্বতঃস্ফূর্ত ঐতিহ্যমুখী নির্মাণের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু কামরুলের শত শত ড্রইংয়ের মধ্য দিয়ে তাঁর ভাষার বিকাশ যে অব্যাহত ছিল তেমন কোনো কালি-তুলির শক্তিশালী নমুনা ও তার উল্লেখ বইতে নেই। আরো যা বাদ পড়েছে তা তাঁর রাজনৈতিক চিত্রকল্প গঠনে পিকাসোর বিমানবিকীকরণ প্রক্রিয়া ও লোকশিল্পের, বিশেষ করে সরাচিত্রের সহজ অথচ শৈল্পিক শক্তিমত্তা প্রকাশকারী আকস্মিক সৃষ্ট রেখানির্ভর অঙ্কনের মিশ্রণে আঁকা তেলচিত্রগুলো। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের সংগ্রহে এরকম বেশ কয়েকটি ক্যানভাস ২০০৮ সালে আয়োজিত বিশেষ একটি প্রদর্শনীতে দর্শকের সামনে হাজির করা হয়। এই আয়োজনের মধ্য দিয়ে জাদুঘরে রাখা এই মাস্টারপিসগুলো বৃহত্তর সমাজমানসে নাড়া দেওয়ার সুযোগ পায়। এই আয়োজন দুই বাংলার আধুনিক শিল্পের স্থানিক মাত্রা অর্জনের সঙ্গে সম্পর্কিত শিল্পীদের একটি যৌথ প্রদর্শনী। যামিনী রায় থেকে শুরু করে জয়নুল, এস এম সুলতান ও রশিদ চৌধুরীর কিছু অসাধারণ কাজও এই ‘বিশেষ প্রদর্শনী’র অংশ ছিল। প্রদর্শনী উপলক্ষে যে ক্যাটালগটি ছাপা হয়, তাতে শিল্প-সমালোচক অধ্যাপক মনজুরুল ইসলাম কামরুল হাসানকে ‘সহজাত ও সার্থক শিল্পী’ আখ্যা দেন। কামরুলকে লেখক ‘আবিষ্কার উদ্ভাবনার তাড়না’র সূত্রেও মূল্যায়ন করেছেন। তাৎক্ষণিকতা ও অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ততা চিহ্নিত করে শিল্পীর ‘আনন্দ-উচ্ছ্বাস ও জীবনের গূঢ় তাগিদে’র পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরেছেন। এর মধ্য দিয়ে ব্যক্তি ও শিল্পীর একটি সুরাহা হয়। যা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে তা হলো শিল্পী হিসেবে কামরুল হাসানের লীলাময়তা।

 

দুই

 

কামরুল হাসানের কাজ আপাতদৃষ্টিতে বিষয়নির্ভর মনে হয়। গ্রামীণ পটভূমিতে বৃহত্তর সমাজের প্রতিনিধিদের তিনি চাক্ষুষ করে তুলেছেন। জয়নুলের মতো তিনিও জ্যামিতিক বিন্যাসের কাছাকাছি গিয়েও, কোনো সুনির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে থিতু হননি। যদি ১৯৪০-এর দশকে অবয়ব হ্রষকরণে মন দেন, তা ছিল তাঁর পূর্ববর্তী শিল্পীদের পরম্পরানির্ভর। এমনকি যে পুতুল তৈরির কারখানায় তিনি দুই বছর চোখ এঁকে হাত পাকিয়েছেন, তেমন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে পাওয়া পথ তিনি চিত্রকল্প নির্মাণে ব্যয় করেছেন। ১৯৫০-এ আঁকা মাছ ধরা ইলাস্ট্রেশনের ভঙ্গিতে যে দুই গ্রামীণ বালক উপস্থাপন করতে দেখা যায়, তার মধ্যে এক প্রকারের শিল্পজ দস্তখত স্পষ্ট হয়। সোজা রেখায়, সমান আঙুল এঁকে হাত-পা-দেহ বাস্তব থেকে দূরে নিয়ে গিয়েও বাস্তব দৃশ্যের খোঁজ দেওয়ার পদ্ধতিটা নতুন। তরুণ কামরুলের কাজে এই ম্যানার বা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রচনার প্রয়াস তাঁর পূর্ববর্তী চেষ্টা থেকে আলাদা বলে চিহ্নিত করা চলে। তাঁর ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই একরৈখিক জীবনাচরণ সম্ভবপর হয়নি। জালাল উদ্দিন আহমেদ তাঁর আর্ট ইন পাকিস্তান বইতে (করাচি ১৯৫৪) শিল্পীর যে পরিচিতি লিখেছেন সেখানে তাঁর শিক্ষায় ছেদ পড়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। ১৯৩৮-এ কলকাতা আর্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়ে দুবছরের মাথায় কামরুল পড়াশোনা বাদ দিয়ে রোজগারে মন দিতে বাধ্য হন। তিন বছর এভাবে কেটে যায়, কিন্তু এই সময়কাল নতুনতর অভিজ্ঞতা অর্জনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তরুণ কামরুল পুতুল বানানোর কারখানায় চায়নিজ লেকার ব্যবহার করে পুতুলের চোখের মণি, পাপড়ি ও ঠোঁট এঁকে হাত পাকান। জালাল উদ্দিনের বইয়ে শিল্পীর বয়ান অনুবাদ করলে এমনটা দাঁড়ায় : পোড়া মাটির দলা যখন আমার তুলির ছোঁয়ায় জীবন্ত হয়ে উঠল, তখনই আমার শিল্পের অসীম শক্তি বিষয়ে চৈতন্য হলো।

শিক্ষানবিশিকালীন কামরুলের অর্জন প্রণিধানযোগ্য। ছাত্রাবস্থায় তাঁর ৩০টি জলরং, পেনসিল স্কেচ এবং লাইন ড্রইং সর্বভারতীয় অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের প্রদর্শনীতে গৃহীত হওয়ার পেছনে তাঁর অ্যাকাডেমিক মুনশিয়ানা ও রেখার দৃঢ়তা হয়তো বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। রেখা যে একটি প্রধান চিত্রজ উপাদানরূপে কামরুলের শিল্পভাষাকে স্বতন্ত্র করে তুলবে তার আলামত শিল্পীর পঞ্চাশের শুরুর কিছু গ্রামীণ নারীর উপস্থাপনায় স্পষ্ট। পরবর্তী সময়ে রেখার যে গতিশীলতা কামরুলের কাজে ধরা দিয়েছে, এমনকি বিমানবিকীকরণের যে বিশেষ পদ্ধতি তিনি পিকাসোর সূত্রে অর্জন করেছেন, এই দুইয়ের অনুপস্থিতি হয়তো তাঁর প্রাথমিক নিরীক্ষাধর্মিতা সোজাসাপ্টা মনে হতে পারে। কিন্তু গ্রামীণ পরিপ্রেক্ষিত ও রেখার প্রয়োগ এই দুই – অর্থাৎ বিষয় ও উপস্থাপনের নিজস্ব ডৌল নির্মাণে তিনি এ সময় থেকেই সজাগ হয়ে ওঠেন। তাঁর লোকজ চরিত্র পুনর্গঠনের বাসনা ‘গসিপ’ শিরোনামের একটি তেলচিত্রে অনেক বেশি পুতুলনির্ভর হয়ে ওঠে। অন্যদিকে ‘মোরগ-মুরগি’ জাতীয় এক কম্পোজিশনে লঘুচালে পাখির ফর্ম তুলে ধরবার ধরন শিল্পীর বহুবিধ নিশানা খোঁজার বাসনারই প্রকাশ। নানা পথে তিনি তাঁর তৎপরতা অব্যাহত রাখেন। যদিও একথা অনস্বীকার্য যে কামরুলের সার্থক অর্জন রেখার অসাধারণ সাবলীলতা ও দৃশ্যবস্তুতে ছন্দ দেখতে পাওয়ার মধ্যে নিহিত। তিনি মূলত সরাচিত্রের অনুপ্রেরণায় সার্থক শিল্পীর পরিচয় নির্মাণ করে অনাধুনিক মৌলিকত্বের সঙ্গে আধুনিক বিন্যাসের সমন্বয় ঘটান। এটি কামরুলের মূল অর্জন। এই অর্জনের সূত্রেই বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর তাঁকে স্থানিক আধুনিকতার একজন পুরোধা হিসেবে দেখেছেন।

বোরহানউদ্দিন তাঁর কামরুল হাসান শিরোনামের বইতে কামরুলের গ্রামপ্রীতির ব্যাখ্যা দিয়েছেন। প্রশ্ন তোলার ভঙ্গিতে তিনি এই বিষয়ের সুরাহা করেছেন। শিল্পী কি ঐতিহ্যের সন্ধানে গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন, নাকি ওটা তাঁর সংগ্রামের অংশবিশেষ : তিনি কি রিট্রিটের মধ্য দিয়ে শক্তি সঞ্চয় করেন? সত্যিকার অর্থেই নাগরিক সমাজের মধ্যে যে মানবদেহ ও আত্মার বিনাশ কামরুল সেই মানবদেহ ও আত্মার পুনরুজ্জীবনের পথে দৃঢ়চিত্ত সৈনিক বিশেষ। তাঁর সৈনিকতায় ললিত ভাব, দ্রোহ, প্রেমতৃষা ও মানবমুক্তির আশা সমভাবে বিরাজ করেছে।

কামরুলের শিল্পের সূত্রে শ্রেণি, সমাজ বিনির্মাণ ও শিল্পের নব্য সমীকরণ তৈরির প্রেক্ষিতে আরো বহুবিধ প্রশ্নের উত্থান সম্ভব হতে পারে। কেন শিল্পী কামরুল হাসান নাগরিক হয়ে নাইওর আঁকেন, গ্রাম্যবধূর লাস্যময় উপস্থিতি তুলে ধরেন? বলা বাহুল্য যে ‘উঁকি’র পেলবতা, কিংবা সিরাজউদ্দৌলার রাজসিক নির্মাণে তিনি আর মন বসাতে পারেন নাই। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও হ্যাভেল অনুপ্রাণিত ভারত শিল্পের কোমল অথচ আর্কিটেকটনিক চিত্রভাষার পুনরাবৃত্তি তাঁর জীবনে আর লক্ষ করা যায় না। এই উঁচু মার্গ ত্যাগ করে তিনি ভিন্ন মার্গ আবিষ্কারে মন দিয়েছেন।

ঠিক কোন সাল নাগাদ কামরুলের মতি ভিন্ন দিকে ধাবিত তার খোঁজ দেওয়া তেমন কষ্টসাধ্য নয়। পট থেকে গ্রহণের সময়কাল আমরা ঠিক করে নিতে পারি শোভন সোমের বরাত দিয়ে। নিরন্তর ছোটকাগজের ষষ্ঠ ইস্যুতে (২০০৫) লেখক সাক্ষ্য দিচ্ছেন : ‘চল্লিশের মাঝামাঝি বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তির একটি প্রবণতা প্রবল হয়ে ওঠে। ছেচল্লিশের শেষে কেবল মুসলমান শিল্পীদের ছবির প্রদর্শনী হল তৎকালীন ইসলামিয়া ও বর্তমান মাওলানা আজাদ কলেজে।’ কামরুল ওই প্রদর্শনীতে প্রথম তাঁর পটশৈলীর ছবি প্রদর্শন করেন এবং তাঁর কথায় ওই ছবির ভেতর দিয়েই তিনি আর্ট স্কুলের নকলনবিশি ভিক্টোরিয়ান একাডেমিজম থেকে বেরিয়ে এলেন। অর্থাৎ কামরুল মুসলিম ঘরের সন্তান হিসেবে কেবল সম্প্রদায়কেন্দ্রিক প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করেছেন; শিল্পী হিসেবে তাঁর চরিত্র এতে সম্প্রদায়মুখী হয়ে ওঠে নাই। শিল্পশৈলী বিষয়ে তিনি যা সুরাহা করেছেন তাতে ধর্মপরিচয়ের কোনো প্রভাব লক্ষণীয় হয়ে ওঠে না। এভাবেই কামরুল পটশৈলীর শিল্পী হিসেবে আবির্ভূত হলেন ১৯৪৬ সালের শেষ দিকে। শিল্পশিক্ষার কাঠামো থেকে তিনি প্রথম নিজস্ব রীতির প্রয়োগে প্রশংসিত হলেন। সৈয়দ আজিজুল হক কামরুল হাসান : জীবন ও কর্ম (১৯৯৮) বইতে শিল্পীর ভাষা তৈরির প্রথম পর্বের খোঁজ দিচ্ছেন।

পাকিস্তান আন্দোলনসহ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালের আরো নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে কামরুল জড়িত হয়েছেন। রাজনৈতিক আদর্শের বা ইডিওলজির চাইতে জয়নুলের মতো কামরুলও মানবমুক্তির সম্ভাবনা সম্পর্কে ছিলেন সজাগ। ফলে ভারতবর্ষে মুসলিমকে ‘অপর’ হিসেবে দেখার যে চর্চা এবং হিন্দু মেলাসহ আরো নানা ভারতীয়ত্বের পরিচয় নির্মাণের প্রপঞ্চের মধ্য দিয়ে যে ভেদাভেদ জ্ঞান সমাজে ছড়াল, তার বিরুদ্ধে পাকিস্তানের প্রতি তাঁর সাময়িক পক্ষপাত লক্ষ করা গেছে। এই পক্ষপাত ছিল বাস্তবতার নিরিখে জীবনসংগ্রামের অংশবিশেষ। আজিজুল হক কামরুলের দাঙ্গাগ্রস্ত কলকাতার নিরীহ জনতার রক্ষাকল্পে নিয়োজিত থাকার কথা উল্লেখ করেছেন। জানিয়েছেন, বেনিয়াপুকুর লেনের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাসিন্দাদের বাঁচানোর জন্য রাত জেগে পাহারায় থাকার কথা। আরো একটি ঘটনা কামরুলের সাহসিকতার পরিচয় দেয় : নবদ্বীপে বোনের শ্বশুরবাড়িতে উগ্রপন্থীদের আক্রমণের আশঙ্কা দেখা দিলে তিনি বাড়ির গেটে তলোয়ার নিয়ে প্রস্তুত থাকেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এমত বিপর্যয় থেকে যদি ধরে নেওয়া হয় যে ব্রিটিশ ভারত দুটি ভাগে যথাক্রমে ভারত ও পাকিস্তান নামে আবির্ভূত হয়, কামরুল মুসলিমদের জন্য লড়ে পাওয়া অংশের শাসকশ্রেণির চরিত্রও খুব দ্রুত অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। যে শিল্পী দৈনিক আজাদের মুকুলের মহফিল-এর নেতৃত্ব দিয়েছেন, কুচকাওয়াজ করতে করতে ১৯৪৪ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর কলকাতার গড়ের মাঠে ছাত্রসমাবেশে যোগ দিয়েছেন, সেই কামরুলই পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতাকে নিয়ে ব্যঙ্গচিত্র আঁকেন ১৯৪৮ সালে, যাতে খাজা নাজিমুদ্দিন স্টেজে দাঁড়িয়ে বলছে – উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা…। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পেছন থেকে প্রম্পট করছেন (সৈয়দ আজিজুল হক, কামরুল হাসান, আর্ট অফ বাংলাদেশ সিরিজ ৩, শিল্পকলা একাডেমি)।

কামরুলের রাজনৈতিক অবস্থান ও সাংস্কৃতিক তৎপরতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলাপের আগে মূল পাঠে ফিরে যাওয়া যাক। শিল্পী সামাজিক বিপর্যয়ের কালে নানামুখী তৎপরতায় জড়িত থেকে পটচিত্রীর আদলে নিজের শিল্পশৈলী গড়ে তোলার প্রথম প্রয়াস পেলেন ১৯৪৬-এর শেষ দিকে। এর পেছনের ইতিহাসটি তেমন জটিল নয়। তবে যে-কোনো শিল্পীকে তার আপন পথ করে নিতে কাঠখড় পোড়াতে হয়। কিছু আত্মগত ও বস্তুগত বিষয়ের সুরাহা করেই কামরুলকে কৌলীন্যের আশা নেই এমন শৈলীর সঙ্গে সন্ধি করতে দেখা গেল। কলকাতায় শিল্পের জগতের ডিসকোর্স দুটি ধারা চর্চার তোড়জোড় কেন্দ্র করে এগিয়েছিল : এক. অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চর্চিত জলরঙের ওয়াশ পদ্ধতিতে রেখার ছন্দময়তার মুঘল-কাংড়া রীতির আদলে ছবি গড়া। দুই. ব্রিটিশ ভিক্টোরীয় কায়দায় বাস্তবানুগ চিত্র গড়া। এই দুই শিবিরকে পরস্পর মারমুখী গোষ্ঠী হিসেবেও একদা ধারণা করা হতো। বিদ্যালয়ের ব্রিটিশ ঘরানা মুঘল-পরবর্তী ভারতীয় শিল্পকলার শৈলী হিসেবে দাঁড়ায়, অপরদিকে এর বিপরীতে হ্যাভেলের চিন্তাপ্রসূত এবং অবনীন্দ্রনাথের চিত্রচর্চাকেন্দ্রিক ওয়াশ পদ্ধতি ভারতীয় রীতি, যা নব্য বঙ্গীয় ধারা হিসেবে গৃহীত হয় – এই দুইয়েরই বিলাতি পৃষ্ঠপোষক ছিল। বাস্তবে এই দুই ঘরানাই দোআঁশলা বা হাইব্রিড পদ্ধতিতে চিত্র রচনার উপায় মাত্র। যেমন ব্রিটিশ একাডেমিক রীতি হেমেন মজুমদারের হাতে একপ্রকার এরোটিক শিল্পধারার সূচনা করে, যা পুরোপুরি ইংরেজি শিক্ষালব্ধ নয়, তবে নেচারালিজম-নির্ভর। অন্যদিকে নেচারালিজম থেকে শিক্ষা নিয়ে যে শিল্পী প্রতিকৃতি থেকে সূচনা করে হিন্দু মিথ ও পোস্টারসুলভ সহজতায় ধর্মীয় চরিত্রের সেক্যুলার উপস্থাপনায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন, তিনি রবি বর্মা। ইংরেজের বিদ্যা আত্মস্থ করে তিনি ভারতীয় প্রয়োগের মাত্রা আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন। অর্থাৎ ইংরেজ একাডেমির শিক্ষা গ্রহণকারীরাও বিষয় ও উপস্থাপনায় ভারতীয় মনোকাঠামো সম্পূর্ণ ত্যাগ করে উঠতে পারেন নাই। অন্যদিকে শক্তিমান শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুঘল শৈলী সম্পূর্ণ মুঘল ছিল না। কোনো পর্যায়ের কাজেই আসলে নিখাদ কোনো শৈলী লক্ষণীয় হয়ে ওঠে না – যাতে ওরিয়েন্টাল সোসাইটির আদর্শ শতভাগ প্রতিফলিত হয়েছে। এমন পিউরিস্ট অবস্থান থেকে আদৌ শিল্প সম্ভব কিনা, এমনটাও ভেবে দেখা জরুরি। অবনীন্দ্রনাথের হাইব্রিড বা দোআঁশলা শৈলী বা যৌগিক অঙ্কন পদ্ধতি এমন এক সার্বিক দৃষ্টিকল্প ও পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে, এমনকি চৈতন্যের মধ্য দিয়ে চর্চিত হয়েছে যে তার ফল ছিল তৎকালীন আধুনিক শিল্পীর কাজের চেয়ে উৎকৃষ্ট। কলকাতা গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে ভাইস প্রিন্সিপাল ইতালীয় শিল্পী গিলার্ডির কাছে অবনীন্দ্রনাথ গাছপালা, ডাল-পাতা থেকে শুরু করে মানুষের প্রকৃতি অঙ্কনের পদ্ধতি শিখেছেন (সুধা বসু : ২০১৩)। অন্যদিকে তিনি জাপান থেকে আসা দুই শিল্পীর সূত্রে অথবা নিজস্ব উপায়ে জাপানি ওয়াশ পদ্ধতিও রপ্ত করেন। ‘ভারত মাতার’ পেলবতা থেকে শুরু করে ভূদৃশ্যে অবনীন্দ্রনাথের অর্জন আসলে ইংরেজ এবং মুঘল তথা ভারতীয়-ইরানি রীতি ও জাপানি ধারার সংমিশ্রণ ছাড়া অর্জিত হয় নাই। অর্থাৎ তিনি সুনির্দিষ্ট কিছু মাত্রা অর্জনে বহুবিধ শিক্ষা কাজে লাগিয়েছেন।

ভারতীয় বনাম ইংরেজ কলমের দ্বন্দ্ব ছাড়াও অপর এক সমরের প্রস্তুতি চলছিল গত শতকের বিশ দশক থেকেই। ১৯২২ সালে বাওহাউস শিল্পীদের একটি প্রদর্শনী কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয়। এর প্রভাব ঠাকুর পরিবারের অপর এক ইংরেজ শৈলীতে দীক্ষাপ্রাপ্ত সদস্যের কাজে নতুন মাত্রা যোগ করে। ইনি গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঠাকুর পরিবারের আরেক নক্ষত্র। ঘনবাদী চিত্রতলে বিভাজিত ক্ষেত্র ও ওভারল্যাপিং ফর্ম উপস্থাপনার নিজস্ব যে ধরন গগনেন্দ্রনাথের পরবর্তী সময়ের কাজে লক্ষ করা যায়, তা ইয়োরোপীয় ধারার নকল নয়। বরং ভারতীয় ও ইয়োরোপীয় বিদ্যা থেকে তৃতীয় স্তরে উন্নীত হওয়ার পথ মাত্র। আঙ্গিকের এই রকমফের দুই নম্বর যুদ্ধের সূচনার ক্ষেত্র তৈরি করে। এই সমর আধুনিক বনাম ভারতীয় – এই ফ্রেমের মধ্য দিয়ে তিরিশের শিল্পীদের উত্ত্যক্ত করে, ভাবায়, এমনকি নিজস্ব অর্জনের পথ তৈরিতে সাহায্যও করে।

স্বদেশি আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এই দুই প্রস্থ সমরের বৃহত্তর ক্ষেত্রের জন্ম। ব্রিটিশ গবেষক নাতাশা এটনের মতে, অবনীন্দ্রনাথ রবি বর্মার রঙের বিপরীতে ধৌত বা ওয়াশ পদ্ধতি ব্যবহার করেন – যা উজ্জ্বলতানির্ভর, স্প্যাকট্রামকে রহস্যময় করে তোলে এবং অনুমাননির্ভর জায়গায় নিয়ে যায়। অর্থাৎ ধরাবাঁধা প্রক্রিয়ার ব্যত্যয় ঘটানোর মধ্য দিয়ে তাঁর শিল্পে ‘অরা’ বা মহত্ত্বের মাত্রা যুক্ত হয়। এই সূত্রে অবনীন্দ্রনাথ তাঁর ভারতচিত্রে ষড়ঙ্গ অনুসারী। তিনি এবং তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গ এই ষড়ঙ্গের ভিত্তিতেই একপর্যায়ে মুঘল চিত্রের সমালোচনা দাঁড় করান, তাতে ভাবের অভাব চিহ্নিত করেন (নাতাশা ২০১৩)। অন্যদিকে বর্মার ছবি একপ্রকার পোস্টারশিল্পের সর্বজনগ্রাহ্য স্পষ্টতানির্ভর। দেশীয় মাত্রা অর্জনে তিনি বিষয় উপস্থাপন করেছেন পৌরাণিক, কিন্তু ভাষা-ভঙ্গি এমনকি মডেলের ভঙ্গি নির্মাণে তিনি অনায়াসে গ্রহণ করেছেন বিদেশি আলোকচিত্র ও জার্মান পপুলার পেইন্টিংয়ের অনুলিপি। দুই শিল্পী দুই ভিন্ন উপায়ে ভারতীয় চরিত্র তৈরি করেছেন – একজন ভালো ড্রাফটসম্যান হওয়ার উদ্দেশ্যে, অপরজন তুরীয় কোনো ভাব প্রকাশ করার জন্য। এই বৈপরীত্যের বাইরে নতুনতর যে বৈপরীত্য সৃষ্টির আয়োজন গগনেন্দ্রনাথে দেখা যায়, সেখানে আধুনিক চিত্রের তলবিভাজনের মধ্য দিয়ে নতুন জমিন তৈরি হলো, কিন্তু ভাবের জায়গায় উচ্চতর বা মহত্ত্বর প্রকাশের বা ‘অরা’র প্রশ্নটিও অটুট রইল। অথচ আধুনিক শিল্প তো অরা বা মহত্ত্বর অনুভূতির মাত্রা থেকে স্বেচ্ছায় ভূমিতে পতিত হওয়ার আয়োজন। কলকাতা শহরে যদি পপুলার চিত্র হিসেবে আধুনিক মুদ্রণযন্ত্র ও গণমানসের সূত্রে গড়া ক্যালেন্ডার অথবা পোস্টারের চিত্রভাষা উচ্চমার্গী চিত্রভাষার বিপরীত বলে মেনে নেওয়া হয়, নতুন আরেক পথে কামরুল সেই একই শহরে সহজীয়া মার্গের পক্ষে ছবি রচনা শুরু করেন। পটশৈলীর প্রতি পক্ষপাতের মধ্য দিয়ে এই নতুনের কেতন ওড়ানো সম্ভব হয়।

পটশৈলী হঠাৎ করে কামরুলের খেয়ালে আসে নাই। কলকাতায় এর নাতিদীর্ঘ পরম্পরা বিদ্যমান। প্রথম যে শিল্পী দরবারি ও ক্লাসিকধর্মিতার পাশাপাশি গ্রামীণ বা লোকজ চিত্রের শৈলীর আভাস দেন, তিনি নন্দলাল বসু। তাঁর হরিপুরা পোস্টার প্রথম দেশজ চরিত্র নির্মাণের নমুনা নয়, কিন্তু এমনতর দেশজ চরিত্র উচ্চতামুখীনতার বদলে আনুভূমিক দিকে যাত্রার প্রথম লক্ষণ দেখা যায়। অর্থাৎ হরিপুরা পোস্টার, যা কংগ্রেস দলের হরিপুরায় অনুষ্ঠিতব্য সম্মেলন উপলক্ষে গান্ধীর অনুরোধে শিল্পী সৃষ্টি করেন, ভারতবর্ষের ইতিহাসে নাগরিক সমাজ কর্তৃক বা নি¤œবর্গের শিল্পের প্রথম স্বীকৃতি। ১৯৪৮-এর রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আত্মানুসন্ধানের পাঠ হিসেবে গান্ধী নন্দলালকে গুজরাটের হরিপুরার আর্টিসানদের মধ্য থেকে দেশজ অর্জনের সালতামামির দায়িত্ব দেন। গান্ধী ও সুভাষ বসুর মতদ্বৈধতা প্রথম প্রকট হয়ে ধরা পড়ার পাশাপাশি স্থানসজ্জার উদ্দেশ্যে তৈরি প্যানেলসমূহে প্রথম লোকজ রেখা ছন্দ ও গতিময়তার প্রয়োগ ঘটার সূত্রে এই সম্মেলন স্মরণীয়। ৪০০ প্যানেলের মধ্যে মোট ১০০টি আঁকেন তৎকালীন শান্তিনিকেতন, কলাভবনের অধ্যক্ষ, শিল্পী নন্দলাল (সুব্রামানিয়ান : ১৯৮৩)।

আনন্দ কুমারস্বামী কিংবা ই বি হ্যাভেল, উভয়েই আর্টিসানিক জগতের পুনরুদ্ধারের কথা বলেছেন। কুমারস্বামী গ্রামীণকে পুনরায় তাঁর ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রেহাই দেবার কথা বলেছেন। কারুকলার উৎপত্তিস্থল হিসেবে বিবেচনা না করে, তার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক ও আবেগের গভীরতর শেকড়ের সূত্রে তিনি পল্লির নতুন ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন – যা হিন্দু কসমস বা মহাবিশ্বের মাঝে প্রোথিত, যার আলামত ভক্তির মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত। (নাতাশা : ২০১৩), কিন্তু অন্ত্যজ শ্রেণি বা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রচলিত শৈলী তাঁদের দুজনের কাছে তেমন গুরুত্ব বহন করেনি। কুমারস্বামী তাঁর জাতীয়তা বোধ বা বাদ অর্জনে প্রথমে মুঘল ও পরে কাংড়া ধারায় – অর্থাৎ রাজসিক শৈলীতে ভারতীয়ত্ব ও ভাব আবিষ্কার করতে প্রয়াস পেয়েছেন।

এই পরিপ্রেক্ষিতেই মনে করা প্রয়োজন যে, যামিনী রায় ও অবন ঠাকুর তাঁদের স্ব স্ব পদ্ধতিতে ভারতীয়ত্বের ও ভাবের সুরাহা করছিলেন। আরো খেয়াল রাখা জরুরি যে, কামরুল আপন বা সেলফ নির্মাণে যে বৃহত্তর জগতের প্রতিনিধির সঙ্গে একাত্ম ঘোষণা করে নিজেকে পটুয়া দাবি করেন, তারও আগে যামিনী রায়কে কলকাতায় শিল্প জাগরণের কালে ‘পটুয়া’ হিসেবে সুধীসমাজে হাজির করেন মুকুল দে। লেখক সত্যশ্রী তাঁর লেখার শিরোনাম দেন ‘নাগরিক পটুয়া : যামিনী রায়ের শিল্প’, যা মার্গ জার্নালে ছাপা হয় (সত্যশ্রী উকিল : ২০১০)।

আত্মপরিচয়ের সন্ধানের যে দিকটি বরাবর পেছনের গল্প বা আদ্যকথা হিসেবে আমরা মেনে নিই ঐতিহ্য বিষয়ে, ঐতিহ্যের পুনঃপ্রবর্তন, প্রচলন এমনকি নবরূপ দান করা বিষয়ক তৎপরতার পরিপ্রেক্ষিত নির্মাণে, তার বাইরের কিছু গল্প থাকে। আমরা জানি গুরুসদয় দত্ত কামরুলের মধ্যে পটশৈলী সম্পর্কে সচেতনতা জাগান, তারও আগের যামিনী রায়ের মধ্যে এ বিষয়ে চেতনা জাগাতে মহাজনের ভূমিকা রাখেন। আমরা যা লক্ষ করি না তা হলো, একই সময়ে – অর্থাৎ বিশের দশকে ইংরেজ লেখক রুডিয়ার্ড কিপলিং ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড এলবার্ট মিউজিয়ামকে ‘এক সিরিজ কালিঘাট পটচিত্র উপহার দেন’ (সত্যশ্রী : ২০১০)। অর্থাৎ ঔপনিবেশিক মাস্টারগণ বা কর্তারা এই সময়কালে লোকশিল্পের, তথা নগরে আশ্রিত ও আদ্রিত লোকশিল্পীর আঁকা চিত্রকে মূল্য দেওয়া শুরু করেন। বলা বাহুল্য, গুরুসদয় দত্তের সাংস্কৃতিক বাঙালিয়ানা থেকে শুরু করে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভারতীয় পরিচয় – এই দুয়েরই পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ইংরেজ কগনোসেন্টি।

তারপরও কথা থাকে – শিকারের সন্ধানে নয় বরং নব্য ফল বা ফসলপ্রাপ্তির সূত্রে আমাদের ঐতিহ্য বিষয়ে ভাবা প্রয়োজন। বিদেশি পৃষ্ঠপোষক থাকুক বা না থাকুক, তিরিশ দশকের কিছু আগে থেকেই শিল্পের নাগরিক চরিত্রের সঙ্গে অতীত ঐতিহ্য বা গ্রামীণ ঐতিহ্যের মেলবন্ধনে নতুন চিত্রশৈলীর সম্ভাবনা বিষয়ে শিল্পীরা সচেতন হয়ে ওঠেন। মূল কথা হলো, আপাত বিপরীত লক্ষণযুক্ত শিল্পশৈলী বা মার্গ যে একটি তৃতীয় প্রপঞ্চ তৈরি করাতে সহযোগী, এই সত্য শিল্পীরা বিংশ শতকের শুরুতে প্যারিসে বসে যেমন বুঝে ফেলেছেন, তেমন কলকাতার নাগরিক পরিসরেও অনুধাবন করতে সমর্থ হন। তাছাড়া, বাড়ির পাশে চোখ না মেলে, শুধু বিদ্যায়তনে শেখা পদ্ধতি দিয়ে যে আর্ট হয় না, এমন বোধ সবার মধ্যে ততদিনে জাগ্রত হয়েছে বলা যায়। কামরুলের পটশৈলীর সঙ্গে সন্ধির শুরু যদি ১৯৪৬-এ, লোকপ্রিয়তার পরিপ্রেক্ষিতে এর মূল্যায়ন জরুরি। তবে যে শরীর তিনি শিল্পী হিসেবে তৈরি করেছেন, যে শরীর শুধু শরীরচর্চা নিয়ে খুশি থাকেনি, নতুনতর কায়ার বা শরীরের প্রতিচ্ছায়া বা প্রতিমা তৈরিতে উৎসাহী, সেই শিল্পী সঞ্চারময় শরীর ও ব্যাষ্টিক কিছু ইতিহাস ও চর্চার মধ্য দিয়ে শিল্পী হয়ে উঠেছেন।

কামরুল যখন কলকাতার শিল্প-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশাধিকার পান, তখন মুকুল দে অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত। তিনিই প্রথম ভারতীয়, যিনি অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ পেলেন। চৌরঙ্গীর বিলাতি অট্টালিকার সিংহদ্বার পেরিয়ে কামরুল শিল্পশিক্ষার পরিসরে পা রাখেন ১৯৩৮ সালে। পরের বছর শিক্ষকতার জীবন শুরু করেন জয়নুল আবেদিন, প্রথম মুসলমান শিক্ষক আবদুল মইনের আকস্মিক মৃত্যুর ঠিক পর। জয়নুলকে কামরুল চিত্রকলার ময়দানে ‘নামজাদা খেলোয়াড়’ সম্বোধন করেছেন সংবাদে ছাপা হওয়া তাঁর বাল্যস্মৃতিতে (সৈয়দ আজিজুল হক : ১৯৯৮)। সে সময়ের আরেক শিক্ষক বসন্ত কুমার গাঙ্গুলী, যাঁকে কামরুল বলেছেন ‘গুরুর গুরু’। জয়নুল, যিনি কামরুলের গুরু, তাঁর স্কেচ, কম্পোজিশন ও জলরঙের হাত পূর্বোক্ত গুরুর ছায়াতলে পূর্ণতা পায়। কামরুলের মতে, তিনি জাদুকর ছিলেন তুলির খেলায়। অচিরেই শিক্ষক জয়নুলের সকল কর্মের একমাত্র সঙ্গী হয়ে উঠলেন কামরুল।

কিশোর কামরুল – যাঁর শিল্পশিক্ষার পর্ব শুরু হয়ে যায় নর্মাল ট্রেনিং স্কুলে। যেখানে কৃষ্ণনগর থেকে গাড়িবোঝাই মাটি নিয়ে আসা হতো। নর্মাল স্কুলের স্যারেরা মডেলিং করতেন মাটি দিয়ে। মডেল স্কুলে ছাত্র হিসেবে কামরুল ড্রইংয়ের পাশাপাশি শিক্ষক সতীশ বাবুর ফর্মুলা অনুযায়ী খড়িমাটি, মৌচাকের মোম, নারকেল তেল, ভ্যাসেলিন ও রং দিয়ে প্লাস্টিসিনের বিকল্প তৈরি করে তা দিয়ে মডেলিং ক্লে তৈরি হতো তার ব্যবহার করা শিখেছেন। অঙ্কনের স্বতঃস্ফূর্ততা এই অভ্যাসের মধ্যেও চিহ্নিত করা যায়। (কামরুল : বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলন ও আমার কথা)। বয়সে তাঁর বড় অপর দুই স্কুলছাত্র ফররুখ ভাই ও হাশেম ভাই ছবি আঁকার সূত্রে খুদে কামরুলকে উৎসাহ দিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে অভিযান সাময়িকীর হাতে লেখা বাংলা সংস্করণের সজ্জার সূত্রে হাশেম ভাই কামরুলকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। এর পাশাপাশি তৎকালীন বঙ্গীয় সংস্কৃতির বাহক হিসেবে প্রবাসী, ভারতবর্ষ, মোহাম্মদী ও সওগাত শিল্পীদের ‘ত্রিবর্ণের ছবি’ ছাপাত। একক প্রদর্শনী দেখার সুযোগ তেমন ছিল না, ফলে কামরুলের মতো উদগ্রীব শিক্ষার্থীর জন্য এইসব মাসিক পত্র-পত্রিকাই ছিল গ্যালারির বিকল্প। কামরুলের লক্ষ্য নির্ধারণে অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, দেবীপ্রসাদ, যামিনী রায় কিংবা চুগতাই বা অতুল বসুর মতো নামজাদা শিল্পীর ছাপা ছবি ভূমিকা রেখেছে। কামরুলের মামা এসব পত্র-পত্রিকার নিয়মিত গ্রাহক হওয়ায়, তাঁর সুযোগ হয়েছে ছাপানো ‘ছবির ওপর কাঁচি চালানোর’।

সাংস্কৃতিক তৎপরতার যে পরিবেশে কামরুল নিজেকে গড়ার সুযোগ পেয়েছেন, তার মধ্যে মুকুল ফৌজ, মুকুলের মহফিল ও মণিমেলার মতো শিশু-কিশোরদের সংগঠনের তৎপরতা তাঁর অ্যাক্টিভিস্ট সত্তার প্রাথমিক চাহিদা মিটিয়েছে বলা যায়। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের ঐকান্তিক যোগের আসা কামরুল নানা সংগঠনের কর্মী হিসেবে কাজ করতে করতে হয়তো গভীরভাবে অনুধাবন করেছেন। মণিমেলা ছিল সে সময়ের কংগ্রেসপন্থী আনন্দবাজার পত্রিকার ছোটদের বিভাগের সংগঠন, ছাত্র ফেডারেশন ছিল সরাসরি কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার সংগঠন, আবার ব্রতচারী আন্দোলন ছিল ধর্ম-নির্বিশেষে শরীর ও সংস্কৃতিচর্চার ভেতর দিয়ে বাঙালির ঐক্যের সংগঠন। কামরুল সবকটি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যদিও রাজনৈতিক মতাদর্শে ওই সংগঠনগুলো ছিল একেবারেই বিপরীতমুখী ও ভিন্নমার্গী (শোভন সোম : ২০০৫)।

শোভন সোমের বরাত দিয়ে কামরুলের রাজনৈতিক দীক্ষার দিকটি আরো স্পষ্ট করে তোলা যায়। নিরন্তরের ষষ্ঠ ইস্যুতে লিখছেন, ‘…কমিউনিস্ট আন্দোলনের জন্য তার করা পোস্টারগুলিও বাংলাদেশে তার সম্পর্কে আলোচনায় অনুল্লিখিত থাকে, যদিও মুম্বাইয়ের নিলাম ঘরে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের স্মারকের মধ্যে কামরুলের ওই পোস্টারগুলিও বিক্রি করা হয়েছে।’

গত শতকে সাম্যবাদ ও প্রগতির যে সমীকরণে শিক্ষিত শ্রেণির সায় ছিল, শুধু এই পরিপ্রেক্ষিতেই কামরুলের অংশগ্রহণ দেখলে চলবে না। ক্ষাত্রশক্তিতে উদ্বুদ্ধ নজরুলের মতো, নজরুলের অনুজপ্রতিম এই তরুণ যোদ্ধাকে নতুন পৃথিবী নির্মাণের বাসনার পরিপ্রেক্ষিতে দেখা জরুরি। ন্যায়-অন্যায় বোধ তিনি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিচার করতে সমর্থ ছিলেন। এ কারণে পাকিস্তান হবার পর জনগণবিরোধী শাসন, বাংলাদেশ জন্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকেও স্বাধীনতা-পরবর্তী বুর্জোয়া বিকাশ ও সামাজিক অবক্ষয় এবং আরো পরে সামরিক শাসনের পীড়ন – সবই তাঁর আবেগী সত্তা সন্ত্রস্ত করে তুলেছে। তিনি কথা বলেছেন, কলম ধরেছেন, এমনকি ছবি এঁকেছেন এসব বিষয়ের ওপর। অনেক লেখকই কামরুল বিষয়ে নানা দিকের উন্মোচনে কালি খরচ করেছেন, কিন্তু কামরুলের রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা চিত্রে ফোটাতে নতুনতর উৎক্ষেপ বিষয়ে কেউ মনোযোগ দেননি। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে গুরুসদয় দত্তের সান্নিধ্য, বাঙালি সত্তার নির্মাণ ও জাতীয়তাবাদী কামরুলের উত্থান বিষয়ে আলোকপাত জরুরি।

ব্রতচারী আন্দোলন শরীর-মন নিয়ন্ত্রণ করে নিজেকে আদর্শ বাঙালি সৈনিক বা ক্ষত্রিয় হিসেবে গড়ে তোলার তালিমনির্ভর এক আন্দোলন। যদিও শিল্পের অব্যক্ত বোধি ও ব্যক্ত বাস্তবতা, এর ভাষা যেমন হাইব্রিড, গুরুসদয় দত্তের বাঙালিপনাও তেমনই। সাধনার সঙ্গে সৈনিকতার যোগাযোগ মূলত তৎকালীন সমাজের ঔপনিবেশিক বাস্তবতার ফসল। বাঙালির জাগরণে আরো নানা প্রকল্পের মধ্যে ব্রতচারী আন্দোলন একটি। ১৯৩৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর কামরুল যুগসন্ধিলগ্নের ‘একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান বাঙালি’র সাক্ষাৎ পেলেন। কামরুলের ভাষায়, ‘বাংলার অতীত ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও মনমানসিকতার এবং শৌর্য-বীর্যের গৌরবময় ইতিহাস যেভাবে তুলে ধরলেন, তাতে আমার স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল’ (কামরুল : বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলন ও আমার কথা)।

স্বপ্নভঙ্গ বলতে হয়তো মোহভঙ্গ বলতে চেয়েছেন। অর্থাৎ আপন দেশ ও জনগোষ্ঠী সম্পর্কে সচেতনতার উত্থানপর্বে কামরুল প্রথম অনুপ্রেরণামূলক ভাষ্য শুনলেন তাঁর নতুন গুরুর কাছ থেকে। ব্রতচারী শিবিরে সৈনিকতার দিকটি কামরুলের দৃঢ়চিত্ত চরিত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। বুক চিতিয়ে হাঁটা তাঁর জন্য অস্বাভাবিক আচরণ ছিল না। কামরুল ছিলেন ব্যায়ামবীর – তাঁর দেহসৌষ্ঠব তাঁর নতুন গুরুজির নজর কাড়তে সাহায্য করে। ‘কামরুলজির ছাতি’ বিষয়ে একদা গুরুসদয় অন্য সদস্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছিলেন ‘এরকম ছাতি বাগাতে হবে’।

ব্রতচারী শিবিরের হাইব্রিড চরিত্র অনিবার্য ছিল। এটি মূলত একটি সাংস্কৃতিক-সামাজিক আন্দোলন, যাতে ঐতিহ্যের সুনির্দিষ্ট কিছু দিকে মনোযোগী হওয়ার পথনির্দেশনা পেয়েছে সেদিনের নতুন প্রজন্ম। রায়বেঁশে নৃত্যের পুনরুত্থান গুরুসদয় দত্তের সূত্রেই সম্ভব হয়েছিল। বাদশাহি আমলসহ অন্য রাজরাজড়ার আমলে সৈন্যবাহিনীর সদস্যরা শরীরচর্চা করত রায়বেঁশে পদ্ধতিতে (কামরুল : বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলন ও আমার কথা)। গুরুসদয় দত্ত যখন বীরভূম জেলার কালেক্টর তখন তিনি প্রথম এই নাচ দেখার আয়োজন করতে বলেন। অনুষ্ঠানে নাচনেওয়ালা পুরুষ নারী সেজে নারীসুলভ ভঙ্গিতে নাচ শুরু করলে গুরুসদয় দত্ত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। শিল্পীদল তখন হারিয়ে যাওয়া রায়বেঁশের পুনঃউপস্থাপনা করে গুরুজির শখ মেটান। কামরুলের প্রস্তুতিপর্বে এই নাচ বিশেষ ভূমিকা রাখে।

যে বিষয়টি কামরুলের শিল্পীজীবনের সবচেয়ে বড় পাওনা ছিল – গ্রামীণ শিল্পী মটরুজির বা মটরজির ছবির সঙ্গে পরিচয়। গুরুসদয় দত্ত মটরুজির ছবি দেখিয়ে চিত্রকলার যে ঐতিহ্য শেখার প্রধান বাহন তা তরুণদের বোঝাতেন। শিল্পী মটরু ব্রতচারী শিবিরে অংশগ্রহণ করায় কামরুল এ অঞ্চলের রেখাপ্রধান কাজের নমুনার সাক্ষাৎ পেলেন। বলা বাহুল্য, মটরু নামের সঙ্গে জি লাগিয়ে ডাকা হতো মটরুজি। এমন বাদশাহি কায়দায় কামরুলও পরিচিত হলেন কামরুলজি নামে, এমনটাই রীতি হিসেবে গ্রহণ করে নেওয়া হয়।

পটুয়া মটরুজি তরুণ শিক্ষানবিশ কামরুলের ‘ভিক্টোরিয়ান পদ্ধতি’র প্রাসাদের দুয়ার ভেঙে দিতে সাহায্য করেছেন। মটরু পটুয়ার চিত্রকর্ম দেখিয়ে গুরুসদয় দত্ত কামরুল হাসানকে বলেছিলেন, ‘হাসান, আর্ট স্কুলে যা শিখছ সেটাও বহু মূল্যবান বস্তু। তবে অতিবস্তুবাদ, তার মধ্যে হীরা জহরত অনেক আছে, বস্তুবাদ বলেই পশ্চিমের শিল্পীরা সরাসরি চোখের দৃষ্টিতে যা দেখে তা-ই আঁকে, কিন্তু আমাদের এই শিল্পীরা অন্তরদৃষ্টি দিয়ে সব দেখে। এ দেখা এরা জন্মকাল থেকেই দেখে আসছে। গ্রামের সহজ সরল গানের মতোই এদের রঙ ও রেখার ভাষা’ (সৈয়দ আজিজুল হক : ১৯৯৯)।

পটুয়া বিষয়ে তাঁর আগ্রহের এই যে সূচনা, এরই পরম্পরা লক্ষ করা যায় কামরুলের সারাজীবনের কাজে। ১৯৪১ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে গুরুসদয় দত্তের হঠাৎ প্রয়াণে ব্রতচারী আন্দোলন স্তিমিত হয়ে আসে, কিন্তু গুরুর শিক্ষা কামরুল সারাজীবন গর্বভরে বহন করেছেন। আত্মগত যে শিক্ষার বুনিয়াদ গুরুসদয় দত্ত সে সময়ের কলকাতার সবার মধ্যে ছড়াতে চেয়েছেন, তার ঐতিহাসিক ও নৈতিক – এ দুই দিক বর্তমান ছিল। সমাজবাদ বা সাম্যবাদের উত্থানপর্বে হয়তো তিনি শ্রম-শ্রমিক-প্রগতির ধারণা শেখান নাই, কিন্তু শ্রমমুখী বাঙালি ও পরম্পরার বৃত্তে কামরুলসহ অনেকের মনন তৈরিতে সহায়তা করেছেন। সর্বোপরি কলকাতার তৎকালীন সাম্প্রদায়িক পরিবেশে অসাম্প্রদায়িকতার পীঠস্থান হিসেবে কাজ করেছে ব্রতচারী শিবির। ঐতিহাসিকতার মধ্যে যে ইটার্নিটি বা চিরায়তের ধারণা আমরা কামরুলের মধ্যে সারাজীবন লক্ষ করি – এটি তাঁর কলকাতায় সাংস্কৃতিক পরিসরসমূহে উদারভাবে সবকিছু গ্রহণ করতে পারার ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত। গুরুসদয় দত্ত হয়তো এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। যদিও কামরুলের ইটার্নিটি বা চিরায়তের ধারণা লালনের মতো আপন-পর কিংবা খোদ-খোদা এমত দার্শনিকতা-আশ্রিত ছিল না, শহুরে এই পটুয়ার শিল্প গ্রামীণ কীর্তিমানদের সঙ্গে একাত্মতার মধ্য দিয়ে পরম্পরানির্ভর বাঙালিত্বকেন্দ্রিক ছিল। তিনি নিজেকে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে গড়ে তোলেন। তাঁর রাজনৈতিকতা, সত্য, শাশ্বতের ধারণা – সবই সাংস্কৃতিক মননের ফসল। এ কারণে পাকিস্তানপ্রেমী কবি হিসেবে পরিচিত ফররুখ আহমদের মৃত্যুর পর, স্বাধীন বাংলাদেশে কামরুল হাসান দৈনিক সংবাদের পাতায় ‘ফররুখ ভাই’ সম্বোধন করে অবিচুয়ারি লিখতে পেরেছেন। লেখায় উল্লেখ করতে ভোলেন নাই যে, আধুনিক তকমার কবিরা যে অনায়াসে পাকিস্তান সরকারের দাওয়াত গ্রহণ করে করাচি-লাহোর যাওয়ার জন্য উদগ্রীব ছিলেন, কেউ কেউ ঘুরেও এসেছেন, তার বিপরীতে ফররুখ আহমদ নির্লিপ্ত জীবনযাপন করেছেন। যে-কোনো সদ্গুণ চিহ্নিত করার সাহস কামরুলের ছিল।

ঢাকায় চারুকলা প্রতিষ্ঠান গড়ার চেষ্টায় জয়নুলের সৈনিক হিসেবে যোগ দেওয়া; পরবর্তী সময়ে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তৎপরতা – এ সবকিছুর ভিত্তি কলকাতার জীবনে খুঁজে পাওয়া যায়। কামরুল হাসান প্রবাসী, ভারতবর্ষ, মৃত্তিকা, মোহাম্মদীর মতো প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। এসব পত্রিকার লেখকদের সঙ্গে তাঁর পরিচিত হওয়ার সুযোগ ঘটে। নানামাত্রার চিন্তকদের সঙ্গে সংস্রবের মধ্য দিয়ে তিনি নিজ হৃদয়ের দৌলত বৃদ্ধি করতে প্রয়াসী ছিলেন। এসব চিন্তাবিদ-সাহিত্যিক তিনি ‘মহাজন ব্যক্তি’ বলে সম্বোধন করেছেন তাঁর ১৯৮৪ সালে লেখা এক স্মৃতিকথামালায়।

পাকিস্তান সৃষ্টির অনিবার্যতার পক্ষে যাঁর একদা বাহাস ছিল, সেই কামরুল রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে শুরু থেকেই ছিলেন সোচ্চার। অন্যায়ের প্রতি অসহিষ্ণুতা এই শিল্পীর মনোকাঠামোর একটি সুস্পষ্ট দিক। ঐতিহাসিকতার যে পাঠ তিনি দুর্ভিক্ষপীড়িত কলকাতার বাস্তবতা থেকে শিখেছেন, অনুমান করা চলে, তা তাঁর সারাজীবনের খোরাক হয়েছে। ঐতিহ্যের ‘শাশ্বত’ বা স্থবির ধারণা তাই কামরুলের আরাধ্য হয়নি। যা ঐতিহাসিক তা থেকে ঐতিহ্যকে আলাদা করে চিনেছেন ঠিক, কিন্তু আচরণীয় বিষয়ের বাইরের কোনো কিছু ঐতিহ্য বলে মেনে নেননি। কামরুল পরম্পরায় বিশ্বাসী নিজস্ব সাংস্কৃতিক ধারা চিহ্নিতকারী শিল্পী। ফলে, অতীতমুখী নন। নব্য বেঙ্গল স্কুল হয়তো এ কারণেই কামরুলের কাজে সামান্য প্রভাব ফেলেছে।

পটচিত্রের সঙ্গে পরিচিত হয়ে, পিকাসোর অভিনবত্ব লক্ষ করে, চিত্র রচনায় আকস্মিকতার স্থান তিনি ধীরে ধীরে অনুধাবন করেন। অথবা, বলা যায় আকস্মিকতার ফল লক্ষ করেই তিনি দুই আপাত বিপরীত ধারা থেকে – অর্থাৎ পট ও ঘনবাদী ছবি থেকে – অনুপ্রাণিত হয়ে চিত্রে ফর্ম বা রূপের সুরাহা করতে পেরেছেন। গ্রামীণ পটের আকস্মিকতা আর প্যারিসবাসী শিল্পী পিকাসোর কাজের আকস্মিকতার সার্থক প্রয়োগ তাঁর নানা চিত্রের রাজনৈতিক ও স্থানিক মাত্রা অর্জনে সহায়ক হয়েছে। তেলরঙে করা চিত্র নাইওর ও ১৯৮৩-র শুরুর দিকে আঁকা রাজনৈতিক চিত্রকল্পে পিকাসোর শিক্ষাটা সবচেয়ে স্পষ্ট। অন্যরা যখন সিনথেটিক কিউবিজম থেকে জ্যামিতিক বিভাজন শিখে আধুনিক হওয়ার প্রয়াস পেয়েছেন, কামরুল পিকাসোর একই মুখ নানা পরিপ্রেক্ষিতে দেখার লজিক গ্রহণ করেছেন, অর্থাৎ কম্পোজিশন তৈরির নিমিত্তে তিনি কোনো কিছু আমদানি করেননি, বরং মানব অবয়বের আকস্মিক ফুটে ওঠা ভিন্নতা নির্মাণ, কোনো মুহূর্তের অর্থবোধক ব্যাখ্যা বা এক্সপ্রেশন বা আকারায়ন তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। এই উপরোক্ত বয়ানের পরিপ্রেক্ষিতে বলা চলে, শিল্পী কোনো প্রকল্পের সুনির্দিষ্ট বেড়াজালে যেমন আবদ্ধ থাকেননি, তেমন তিনি একলেকটিক বা সর্বগ্রাসী কোনো সৃষ্টিশীলতায়ও বিশ্বাসী ছিলেন না।

দেশভাগের পর ‘ওপারে’ আসতে তাঁর ছয় মাসমতো সময় লেগেছে। ১৯৪৭-এ শিল্পী সবেমাত্র কলকাতা আর্ট স্কুল থেকে পাশ করে বেরিয়েছেন। ১৯৪৮-এর মার্চ মাসে স্থায়ী বসবাসের উদ্দেশ্যে ঢাকা চলে আসেন। এই পর্বে তিনি যে নানামুখী তৎপরতা অব্যাহত রাখেন তার প্রমাণ মেলে ১৯৫৮ সালে করা লিথোগ্রাফ ‘স্নান’ শিরোনামের কাজটিতে। ব্লেডে চেঁছে লিথোগ্রাফে যেভাবে ড্রইং ও ফর্ম ফুটিয়ে তুলেছেন, টোন ব্যবহার না করে কালো ছাপে আঁচড় কেটে নারী অবয়ব গড়ে তুলেছেন, তা এই মাধ্যমের প্রচলিত নিয়মের ব্যতিক্রম।

সাদা-কালোর বাঙ্্ময়তা ও স্পষ্টতা আর রেখার শক্তি – এই দুইয়ের মধ্য দিয়ে কামরুলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। যদিও ষাটের দশক, এমনকি পরবর্তীকালেও তাঁর হাতে ওয়াশ টেকনিকের রঙিন শক্তিশালী কাজ লক্ষ করা যায়, তবু কামরুল যে রেখার শিল্পী, মানব-প্রাণী অবয়বের শিল্পী, সেটা অনুধাবন করতে শিল্পীর রেখে যাওয়া অসংখ্য রেখাচিত্রই যথেষ্ট। মেয়ে সুমনা হাসান এবং বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের সংগ্রহে রাখা শত শত ড্রইং তাঁর শিল্পীসত্তার খোদ পরিচয় তুলে ধরে।

সাংস্কৃতিক এই ব্যক্তিত্বের রেখা ও চিত্রকল্পের রাজনৈতিক যে চরিত্র, তার ব্যাখ্যায় নিজস্ব প্রয়োগের বিশেষ কিছু দিকে দৃষ্টি দেওয়া যায়। রেখা কী করে জটিলতাপ্রবণ হয়ে ওঠে – অর্থাৎ যামিনী রায় বা অন্যদের মতো সোজাসাপ্টা কোনো অবয়ব নির্মাণ না করে হাইব্রিড, বাঙ্্ময় কিংবা বুদ্ধি ও আবেগের সমন্বয়ে প্রতীকমুখী চিত্রকল্প গড়ে তোলে। একক মূর্তি থেকে শুরু করে বহুসংখ্যক মূর্তির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা রেখাচিত্রে কামরুলের জটিলতার বিকাশ লক্ষণীয়। ১৯৭০ দশকের সমাজবাস্তবতার আকারায়ন ছাড়াও কেবল নারী, হাতি কিংবা পাখির চিত্রেও কামরুল অনেক সহজে জটিলতার বা বহুমাত্রিকতার জন্ম দিয়েছেন, যা তাঁর চিত্রকল্পকে লোকজ চিত্রের সাধারণ অনুবাদ হওয়া থেকে উদ্ধার করেছে। এমনকি গ্রামীণ ধাঁচ আয়ত্ত করে শহুরে পরিশীলন অর্জনের যে কলকাতা ও ঢাকাকেন্দ্রিক নানা প্রয়াস, তার বিপরীতে ‘বর্তমান’ সময় ও ‘পরম্পরা’র ধারণার সমন্বয়ে ‘আগামী’র চিত্রভাষা নির্মাণে সাহায্য করেছে।

তিনি ছিলেন সার্বক্ষণিক শিল্পী। যে-কোনো প্রকার কাগজে, যে-কোনো ধরনের কলমে তিনি রেখাচিত্র এঁকে দিতেন তাঁর শুভাকাক্সক্ষীদের। বাস্তব-অবাস্তব, শ্লীল-অশ্লীল, পল্লি-নগর কিংবা লক্ষ্য-অলক্ষ্য – এসব ছাড়িয়ে তাঁর ধারণা মূলত রেখা ও চিত্রকল্প গড়ার মধ্যে আবর্তিত। রাজনীতির আবর্তে মানুষের বাস্তব দশা তাই তাঁর কাজে সবচেয়ে ধারালো। ১৯৭৮-এ আঁকা উচ্চবিত্ত রমণী, চশমাওয়ালা প-িত-প্রবণ শেয়াল ও অপরাপর কুশীলব কামরুলের হাতে এক জটপাকানো শরীরী উপস্থিতি। ওপরে পেঁচা ও নিচে ভ্যাট সিক্সটি নাইনের অতিপরিচিত বোতল একত্রে এক প্রকার সিম্ফনির জন্ম দেয়, যা সমাজের নব্য বুর্জোয়ার আবির্ভাব তির্যক দৃষ্টিতে তুলে ধরে।

কামরুলের এমত রাজনৈতিক-সামাজিক ড্রইং হয়তো গুটিকয়েক। কিন্তু সংখ্যা বিচারে এদের মূল্যায়ন না করে, ড্রইংয়ের শক্তির বিচারে, চিত্রকল্পের সার্থক প্রকাশের পরিপ্রেক্ষিতে এদের ইতিহাসে ঠাঁই দিতে হবে। যে শিল্পী বহুপ্রজ, এবং যিনি ঢাকায় এসে বইয়ের প্রচ্ছদ, দৈনিক পত্রিকায় ড্রইং এমনকি সরকারি পাঠ্যবইয়ের মলাটের নকশা করে নাম কুড়িয়েছেন, তাঁর রাজনৈতিক ছবি বিষয়ে শিক্ষিত শ্রেণির মনোযোগ কম হওয়া স্বাভাবিক। কামরুলের রেখাচিত্র তুলির ছন্দনির্ভর। ছন্দের সার্থক প্রয়োগ লক্ষ করা যায় নারী অবয়ব আঁকায় – যা সর্বজনবিদিত। ইমেজের যে জঙ্গমতার কথা বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর লেখেন তাঁর শিল্পীর চোখ শিরোনামের বইয়ে, কামরুলের নান্দনিকতা বিষয়ক প্রবন্ধে সেই জঙ্গমতা তিনি যেমন সমাজের অসামঞ্জস্যতা তুলে ধরতে ব্যবহার করেছেন, তেমন নারী অঙ্কনের সহজতার মধ্যেও প্রকাশ করেছেন। হয়তো অনেক ক্ষেত্রেই যা ‘নৈসর্গিক’ তা নারীতে পর্যবসিত। এখানেও অভিজ্ঞতার চিত্রায়ন কোনো মুখ্য ভূমিকা রাখেনি। সাপ, শেয়াল, পেঁচা কিংবা কচ্ছপের পুনঃপুনঃ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে যে সামাজিক বিচ্যুতি ও অসামঞ্জস্যতা শিল্পী তুলে ধরেন, তার পাশাপাশি যে বিষয়টি বড় হয়ে দেখা দেয় তা হলো ‘উইটনেস’ বা সাক্ষী হিসেবে পেঁচার মতো প্রাণীকে হাজির করা।

যে-কোনো সার্থক শিল্প দৃষ্টির বিবিধতা-নির্ভর। অর্থাৎ শিল্পী নিজের দৃষ্টি দিয়ে যা দেখেন তারও অধিক তিনি হাজির করতে সমর্থ হন। যে চিত্রজ জটিলতার কথা কামরুলের রেখাচিত্রের সূত্রে আগে বলা হয়েছে, তার পরিণতি আসলে এই ‘আপন’ দৃষ্টির পাশাপাশি ‘অপরের’ দৃষ্টিতে দুনিয়া বা কোনো ফর্ম বা ঘটনা দেখতে পারার ক্ষমতার ওপর নির্ভরশীল। বিষয়ের রূপায়ণের চেয়ে তাই বিষয়কে নানা প্রক্রিয়ায় ও পদ্ধতি প্রয়োগে গড়ে তোলাই প্রকৃত শিল্পীর কাজ। এই সূত্র মেনে কামরুলের ছবির দিকে তাকালে বোরহানউদ্দিনের মন্তব্য, ‘কামরুল হাসানের ক্ষেত্রে গ্রাফিক ডিজাইনার ও রাজনৈতিক কর্মীর বহুবিধ ভূমিকা একত্র হয়েছে’, এমন সিদ্ধান্তের সমান্তরালে আরো জুতসই ব্যাখ্যা দাঁড় করানো সম্ভব। কারণ ‘কামরুল হাসান নান্দনিকতার ঐতিহ্যের মধ্যে নিজের অভিজ্ঞতাকে’ শুধু ‘সম্প্রসারিত করেছেন’ শুধু এমনটা নয়। অভিজ্ঞতার বাইরের বিষয় তাঁর ছবির ফর্ম যেমন জটিল ও জুতসই করে তুলেছে, তেমন প্রাণী অবয়ব, স্থানচ্যুতি, বিমানবিকীকরণ – ইত্যাকার স্বতঃস্ফূর্ত রূপ ব্যবহারে যে রূপকতার জন্ম হয় তা ভিশনারির মন দিয়ে গড়ে তোলেন। এখানে জাক দেরিদার ‘অন্ধ অঙ্কনের’ ধারণা প্রয়োগ করা যেতে পারে। ফরাসি এই দার্শনিকের মতে, রেখাচিত্র মূলত চাক্ষুষ বিষয় থেকে সরে গিয়ে অন্ধত্বের মধ্য দিয়ে গড়ে তোলার প্রয়াস। (মার্ক সি টাইলর : দ্য পিকচার ইন কোশ্চেন ১৯৯৯)। কামরুলের রূপান্তরের বিষয়শক্তি আপন থেকে অপরের দৃষ্টিতে পৌঁছানোর প্রয়াস হিসেবে যেমন দেখা সম্ভব, তেমন অন্ধের মতো নব দৃষ্টিপ্রাপ্ত ‘অপর’ হয়ে ওঠা ব্যক্তি যা ভিশনারি হয়ে উঠে নতুন পাওয়া সক্ষমতার ধারণা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। সংস্কৃতিমনা কামরুলের যে বুর্জোয়াবিরোধী সত্তা, সেই রাজনৈতিকতা এ কারণেই সোজাসাপ্টা শ্রেণিচ্যুতির ফর্মুলা অনুসারে গড়ে ওঠেনি। বরং শিল্পীর ভিশনারি শক্তির প্রকাশ বলে ধরে নেওয়া যায়। রূপ তাই সহজে যেমন রূপকথায় গমন করেছে, যেমন গ্রামীণ পরিপ্রেক্ষিতের চিত্রে, কিংবা সাপ, শেয়াল, পেঁচার উপস্থিতিসহ যে সমাজচিত্র, সেসব জটিল চিত্রকল্পের মধ্য দিয়েও প্রকাশ পেয়েছে। অন্যদিকে ১৯৮৩-তে আঁকা বেশ কয়েকটি ক্যানভাসে রেখার খরতা ব্যবহার করে যে অমানবিকতার গাথা বা আখ্যান বর্ণনা করেছেন, তা মানবতার পরাজয়বিষয়ক, গ্লানিবিষয়ক পরাভাষ্য বা অতিবর্ণনা হওয়া সত্ত্বেও বিহ্বলতার বদলে, শূন্যতার বদলে দর্শকমনে প্রশ্নের জন্ম দেয়, ঔৎসুক্যের জন্ম দেয়। এগুলো কামরুলের প্রশ্নবোধক ছবি – যা বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের ভাষায় : ‘নান্দনিকতার প্রথানুগততার বিরুদ্ধে’ শিল্পের সম্ভাবনা তৈরির কারখানা বিশেষ।

কামরুলের শিল্পে রাজনৈতিকতার পর্ব বিভাজন করে চিত্রের লক্ষণসমূহের বিবর্তনে চোখ রাখা জরুরি। চারটি ধাপে এই শিল্পী সমাজের সঙ্গে শিল্পের একাত্মতার ফ্রেমটি নির্মাণ করেছেন। প্রথমত, কলকাতায় কমিউনিস্ট আন্দোলনের সূত্রে তিনি কিছু রাজনৈতিক পোস্টার আঁকেন। শোভন সোমের মতে, এই পোস্টারগুলোর শৈলীবৈশিষ্ট্য এবং পরবর্তীকালে তাঁর ব্যঙ্গচিত্রে ও পোস্টারে এই আদি পোস্টারগুলোর প্রভাব আলোচিত না হলে, কামরুল-অন্বেষা অসম্পূর্ণ থাকবে। এগুলোর চরিত্র আন্তর্জাতিক রাজনীতির অঙ্গনে ছড়িয়ে পড়া তৎকালীন সময়ের রুশ ও চৈনিক পোস্টারের সূত্রে নির্ধারিত। ১৯৪৬ সালের একটি কাঠখোদাইয়ে শ্রমিকের মোকাবেলার যে দৃশ্য পোস্টারের জন্য এঁকেছেন তাতে কিছুটা দেশীয় ধাঁচ আনবার প্রয়াস দেখা যায়।

পঞ্চাশের মন্বন্তরের শিল্পী হিসেবে কামরুলের ভূমিকার কথা অনেকেই আলোচনা করেছেন। কিন্তু যে একটি নমুনা বইপত্রে ছাপা হয়েছে, তা কামরুলের চিত্রভাষায় তেমন কোনো মূল্য সংযোজন করে না। যদিও অলইন্ডিয়া স্টুডেন্ট ফেডারেশনের অষ্টম বার্ষিক সম্মেলন, যা কলকাতায় ১৯৪৪-এর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হয়, তাতে কামরুল শিল্পী হিসেবে যোগ দেন। এ উপলক্ষে ‘বেঙ্গল পেইন্টার্স টেস্টিমনি’ নামে যে অ্যালবাম প্রকাশিত হয় তার সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন কামরুল হাসানসহ অরূপ দাশগুপ্ত, আদিনাথ মুখোপাধ্যায়, সফিউদ্দীন আহমেদ। যদিও এই অ্যালবামে যে চিত্রটি স্থান পায় তা ‘আফটার দ্য সাইক্লোন’। (শোভন সোম : নিরন্তর)। অর্থাৎ এটি মন্বন্তর বিষয়ক ছবি ছিল না।

দ্বিতীয় যে রাজনৈতিক ছবির ধরন কামরুল আবিষ্কার করেন তা ১৯৭৪-এ করা মূলত কাঠখোদাই সিরিজের মধ্য দিয়ে। যদিও কামরুল হাসান শিরোনামের বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের লেখা বইতে এই ছাপাই সিরিজের দুটিকে লিনোকাট হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। দুটি মাধ্যমেই শিল্পী কাজ করেছেন। খান জাহাঙ্গীরের বইতে ছাপানো লিনোকাট দুটি ‘ইমেজ ৭৪’ নামে সাপ, কুমির, কচ্ছপসহ মোটা চশমা পরা নারী-পুরুষ মিলে এক প্রকার টাব্লু বা চালচিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ফল যে একটি উচ্চবিত্ত শ্রেণি ভোগ করে সমাজে এক প্রকার সংকটের জন্ম দিচ্ছিল, এমনকি বৈষম্যমূলক যে আচরণ স্বাধীনতার পথ গড়ে দিয়েছে, নব্য বুর্জোয়া শ্রেণির হাতে তারই পুনরাবৃত্তি কামরুলের এ সময়ের মনোযোগ কাড়ে। এই সামাজিক আঁধার তিনি এক প্রকার এনিমিস্টিক ধাঁচে, পিকাসোর গেরনিকার আলোকে স্পষ্ট চিত্রকল্প গড়ে প্রকাশ করেছেন। কুমির, মুখোশ ও পেঁচা সম্মিলিত একই আঙ্গিকের ছাপাই ছবি জাতীয় জাদুঘরের সংগ্রহে ‘কম্পোজিশন’ নামে ভুক্তি দেওয়া আছে। সাদা-কালোতে করা এই সিরিজে বুর্জোয়া ডেকাড্যান্স বা ক্ষয় বোঝাতে শিল্পী মদের গ্লাস হাতে নারী অবয়ব আলাদা করে চিহ্নিত করেছেনহয়ে ওঠা – নারীর এই ছদ্মবেশ তাঁর চিত্রে আর তেমন ব্যবহার করতে দেখা যায় না।

তৃতীয় ধাপের রাজনৈতিক ছবিগুলো কামরুল আঁকেন ১৯৮৩ সাল থেকে। ক্যানভাসে আঁকা এসব চিত্রকল্পে বিমানবিকীকরণের চূড়ান্ত ফয়সালা লক্ষণীয়। ১৯৮৩-তে আঁকা ‘অনুদানবের মৃত্যু উদ্বোধন’ মোটামুটি বড় ক্যানভাসে তেলরঙে আঁকা। এর ওপর প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক গোষ্ঠীর ছাত্রসংগঠনের কর্মীদের হস্তক্ষেপের ছাপ আছে। শিল্পীর কোনো একটি রাজনৈতিক মন্তব্যে ক্ষিপ্ত হয়ে কিছু কর্মী তাঁর বাড়ির স্টুডিওতে আক্রমণ করে। এই ক্যানভাসটিতে তাদের ছুরির আঁচড়ের চিহ্নে শিল্পী পট্টি ব্যবহার করে সারিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। চিত্রের ভয়াবহতা এই চিহ্নের মধ্য দিয়ে আরো জোরালো হয়েছে। কামরুলের বহুবিধ উপায়ে মানবের পতিত দশা দেখানোর উপায় এ ছবিতে সবচেয়ে সৃষ্টিশীল মাত্রা পেয়েছে বলা যায়। উল্লেখ করা জরুরি যে, সাদা-কালোর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক চিত্রকল্পের যে বহুবিধ ব্যবহার, তা থেকে মুক্ত হয়ে কামরুল প্রথম ভয়াবহতার দৃশ্য আঁকলেন। রং ও রেখা উভয়ের শক্তি একযোগে প্রয়োগের মধ্য দিয়ে তিনি তা সম্পন্ন করলেন। ‘বাংলাদেশ ৭১’ শিরোনামের আরো দুটি ক্যানভাসে সমাজের বিশৃঙ্খলার দৃশ্যের অবতারণা লক্ষ করা যায়। প্রথমটিসহ এ জাতীয় সামাজিক-রাজনৈতিক টাব্লুর ক্যানভাসগুলোতে সকল অবয়ব মাধ্যাকর্ষণনিরোধী – তারা ভাসমান এবং একত্রে জটিল ভিত্তিতে গড়া অর্কেস্ট্রার জন্ম দেওয়া অবুঝ প্রাণীর মতো অসচেতন জীবনযাপন করছে। এখানে যারা অত্যাচারিত তাদের মাজুল দশার সূত্রে কিছুটা আলাদা করে চেনা যায়। এদের হাত অন্যের দিকে প্রসারিত কিংবা কোনো কিছু আঁকড়ে ধরার চেষ্টারত। এমন ফিগারই অধিকসংখ্যক।

ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ফ্রি ফল’, এমন সার্বিক পতনের অনুভূতি এই কাজগুলোকে সময়, সমাজ ও মানব বিপর্যয়ের এক নতুন আয়না হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করেছে। এগুলো যেন সময় ও স্থানচ্যুতির চূড়ান্ত চিহ্ন ধারণ করে আছে।

বলা বাহুল্য, কামরুল হাসান সারাজীবন ধরে একই মাত্রার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তাঁর চিত্রকল্প নির্মাণ অব্যাহত রাখেননি। কারণ তিনি মূলত লীলাপ্রবণ ব্যক্তিত্ব, যিনি নিজ উৎসাহে ও উদ্যোগে নানান সংগঠন ও সংস্থার হয়ে কাজ করে সমাজে সৃষ্টিশীলতার ভূমিকা ও শিল্পের পথ পরিষ্কার করেছেন। লীলাপ্রবণতার মধ্য দিয়ে তিনি গ্রামীণ জীবন ও সংস্কৃতির প্রতি নিষ্ঠ থেকেছেন। হয়তো একই কারণে নগরবাসী হয়েও গ্রামীণ বধূ এঁকেছেন, এমনকি গ্রামীণ চারুকলার চরিত্র ধরে নিজ শিল্পের ছন্দময় চরিত্র নির্ধারণ করেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে কামরুল সমাজ সমালোচনামূলক ব্যক্তিত্ব নন – তিনি  সত্তাসন্ধানী মানুষ। যখন তিনি সন্দিহান হয়ে ওঠেন, অনুধাবন করেন যে, মানব তার ‘খোদ’ অবস্থান থেকে পতিত হয়েছে, তখন তিনি তার রূপায়ণে কঙ্কাল কিংবা দানবের রূপের দ্বারস্থ হয়েছেন। এই দানবই তাঁর কাছে সার্বিক সামাজিক-মানবিক অবনমনের কারণ। কামরুলের চিত্রকল্পের রাজনৈতিক মাত্রার এই একটি বিশেষ লক্ষণের উল্লেখ ছাড়া তাঁর লীলাময়তার ধারণার সমাধান করা যাবে না।

কামরুলের ১৯৭১-এ আঁকা পোস্টারে ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’ সেøাগানের সঙ্গে ইয়াহিয়া খানের যে দানব মূর্তি তার নমুনা তিনি তৈরি করতে শুরু করেন মার্চ মাস থেকেই। কামরুল হাসান ১৯৭০ সালের দিকে ঢাকা জাদুঘরের কোনো এক অনুষ্ঠানে প্রথম ইয়াহিয়া খানকে সামনাসামনি দেখেন। প্রথম দর্শনেই কামরুলের কাছে এই একনায়ক ‘ডেভিলের’ প্রতিরূপ মতন মনে হয় (সৈয়দ আজিজুল হক, ১৯৯৮)। মার্চ মাসেই শিল্পী এই দানবপ্রতিম ব্যক্তিত্বের মুখ আঁকতে থাকেন, এই তথ্যের মধ্যে যা আড়াল হয়ে যায়, তা শিল্পীর ১৯৬৯ সালে আঁকা দানবসমূহ। ওমর শামস, যিনি নিরন্তরের ষষ্ঠ সংখ্যায় (প্রাগুক্ত) কামরুলের ‘কালানুক্রমিক ড্রইং’-এর বর্ণনা ছবিসহ ছাপিয়েছেন তার ভাষ্য মতে শিল্পী ১৯৬৯ সালেই ইয়াহিয়ার দানব রূপ আঁকতে শুরু করেন। কামরুল নিজেও বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলন ও আমার কথায় বলেছেন যে, তিনি শুধু মুজিবনগরে বসেই ইয়াহিয়ার দানবমূর্তি আঁকেননি। ‘১৯৬৯ সাল থেকেই গোপনে ঢাকায় বসেই ঐ প্রতিকৃতি আঁকতে’ থাকেন। শিল্পীর বরাত দিয়ে সুনির্দিষ্টসংখ্যক প্রতিকৃতির প্রদর্শনীর কথাও আমরা জানতে পারি। কামরুল হাসান লিখেছেন : ১৯৭১ সালের ২৩শে মার্চ শহীদ মিনারে কমপক্ষে দশটি ঐ প্রতিকৃতির পোস্টার আঁকা হয়েছিল। সেই পোস্টারে লেখা ছিল ‘এই জানোয়ারটা আক্রমণ করতে পারে’।

ওপরের ভাষ্য যেমন শিল্পীর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার দিকটি তুলে ধরে, তেমন তার তৎপরতার দিকেও নির্দেশ করে। ওমর শামসের সংগ্রহে কামরুলের যে গুটিকতেক ড্রইং রয়েছে তা শুধু ইয়াহিয়ার অবয়ব অনুসরণেই আঁকা নয়। কয়েকটি রেখাচিত্রে মানবের মধ্যকার অমানবিক শক্তিকে চিহ্নিত করতে সিংহ বা কুমিরের মোটিফের বীভৎসকরণের মধ্য দিয়ে শিল্পী যেমন দানবীয় মুখাবয়বের সুরাহা খুঁজেছেন, তেমন ইয়াহিয়ার মুখের বিকৃতকরণের মধ্য দিয়েও একনায়কত্বের জুতসই প্রকাশ খুঁজে পেতে প্রয়াস পেয়েছেন।

সর্বশেষ যে মুখোশমতো মুখটি মুজিবনগর সরকারের প্রচারপত্রে স্থান পায়, তার সঙ্গে পূর্ববর্তী মোটিফগুলোর, বিশেষ করে ’৬৯ সালে আঁকা চিত্রকল্পগুলোর তেমন একটা মিল পাওয়া যায় না। মূল পোস্টার কামরুলের রাজনৈতিক পোস্টার আঁকার ধাঁচে করা – এটি কাঠখোদাইয়ে করা প্রিন্টের মতো আলো-ছায়ার বৈপরীত্য ব্যবহার করে সম্পন্ন করা হয়েছে। অন্যদিকে ড্রইংগুলোর মধ্যে শিল্পীর আঙ্গিক খুঁজে পাওয়া বা জুতসই মোটিফ নির্মাণের বাসনার তাপ এতটাই যে, পিকাসোর আদলে হাত, চোখ বা মুখের স্থানচ্যুতি ঘটিয়ে কোনো কোনো অঙ্কনের সম্ভাবনা চাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা লক্ষ করা হয়েছে।

দানবমূর্তির নানা মাত্রাও পরবর্তী সময়ে আঁকা কয়েকটি ড্রইংয়ে দেখা যায়। যেমন নিরন্তরে ছাপানোর সুবাদে যে ক্রম তৈরি করা হয়েছে, তার সূত্রে ‘ড্রইং ০৭’ ও ‘ড্রইং ০৮’ (১৯৮১)-এর অবয়ব নির্মাণে পৌরাণিক বা কাল্পনিক প্রাণীর আবির্ভাব উল্লেখযোগ্য নতুনত্ব সামনে নিয়ে আসে।

পৌরাণিক মাত্রা অর্জনে চেষ্টা অব্যাহত থাকলেও পুরাণ ব্যবহারের কোনো নিদর্শন কামরুলের জীবনে লক্ষ করা যায় না। মুসলিম শিল্পী হিসেবে হুসেন হিন্দু পুরাণ থেকে অনেক ছবির বিষয় নির্ধারণ করেছেন। কামরুল এমনটা কেন করেননি, তার ব্যাখ্যা দিতে শরীফ আতিক-উজ-জামান (২০০৬) ধর্মীয় অবস্থানের কথা উল্লেখ করেছেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর মুসলিম শিল্পীদের হাতে হিন্দু পুরাণ ব্যবহার ‘একেবারেই সম্ভব ছিল না’ বলে মত দিয়েছেন। এমন সরল ব্যাখ্যা বাস্তবতা তুলে ধরে কিনা সন্দেহ আছে।

কামরুল সারাজীবন তাঁর শিল্পের রসদ হিন্দু রিচুয়াল বা পার্বণের মধ্য থেকে নিয়েছেন, এমনটাও বলা যায় না। ধর্মের পৌরাণিক গাথা তার আরাধ্য ছিল না। এ অঞ্চলের আধুনিক শিল্পের চরিত্র বা সাংস্কৃতিক স্বরাজ নির্মাণে শিল্পী গ্রামীণ রিচুয়াল বা পার্বণের আনুষ্ঠানিকতার যে ঐতিহ্য তা থেকে জন্ম নেওয়া আঙ্গিক ব্যবহার করেছেন। তাঁর লীলার, অর্থাৎ সৃষ্টিলীলার চরিত্র ধর্মীয় কোনো লীলার অনুসারী নয়। বরং প্যারিসের আভা গার্দ আন্দোলনে আয়তন ও ভাষা নির্মাণের যে আয়োজন, তার পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতা ও ঢাকায় নাগরিকের আধুনিক চিত্রকলায় স্থানিক বা আপন বৈশিষ্ট্য সংযোজন করার বাসনা লক্ষনীয়। প্যারিসে পিকাসো-ব্রাক-মাতিস যদিও আফ্রিকার দিকে তাকিয়ে আপন-পরের সমাধা করেছেন, ঢাকায় জয়নুল-কামরুল এবং অন্যরা সেই ফ্রেমওয়ার্কের বাইরে গিয়ে আধুনিকের অপর সন্ধান করেছেন, আধুনিক ও আপনের সার্থক ফর্মুলা তৈরি করেছেন। আরো খোলাসা করে বলা যায়, আধুনিকতায় যাকে অপর হিসেবে দেখানো হয়, সেই পল্লির সাংস্কৃতিক ও শিল্পজ অর্জন যা ‘ঐতিহ্য’ নামে শহরে হাজির হয়, কামরুল সেই জীবিত ধারার মধ্য থেকে শক্তি অর্জনে ব্রতী হয়েছেন। ফলে ধর্মীয় আখ্যান, এমনকি যাকে শহরবাসী লোকজ আখ্যান নামে আলাদা করে পাঠ করে, তার কোনো প্রভাব শিল্পীর কাজে লক্ষ করা যায় না। এক অর্থে কামরুল বৃহৎ বাংলার আধুনিক শিল্পী হিসেবে নিজেকে তৈরি করেছেন। হয়তো এ কারণেই ক্যানভাসে ছবি আঁকার প্রবণতাও তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য রকমের কম লক্ষ করা গেছে। অসংখ্য ড্রইং বা তুলি দিয়ে আঁকা রেখাচিত্রই তাঁর সবচেয়ে সাবলীল মাধ্যম বলে ধরে নেওয়া যায়।

কর্মী মানুষ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব – এই দুইয়ের মেলবন্ধনের মধ্য দিয়ে কামরুল হাসানের জীবন ও শিল্প না দেখলে, তাঁর সার্বিক সত্তাটির খোঁজ মেলা কঠিন হয়ে ওঠে। সাংস্কৃতিক বলতে আসলে ‘হোমে এসথেটিকাস’ বা নন্দনপ্রবণ মানুষ বলা যায় – যার মনোযোগ সত্য ও সুন্দরের প্রতি। এ কারণেই শুধু ঐতিহাসিকতার নিরিখে তাঁর ব্যক্তিগত ও শিল্পজ অর্জনের মূল্যায়ন সম্ভব নয়।

এই পরিপ্রেক্ষিত মাথায় রেখে তাঁর চিত্রজ সফলতার মাত্রাটি নির্ধারণ করা সম্ভব। শিল্পজ ইমেজ যে বাস্তব ইমেজ থেকে পৃথক – দুয়ের মাঝে যোগাযোগ স্পষ্ট হওয়া সত্ত্বেও তারা যে আলাদা – এই সত্যটি কামরুল হাসানের কাজে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। এমনকি আখ্যান বা গল্পের বর্ণনা থেকেও যে ইমেজ আলাদা এক শক্তি সামনে নিয়ে আসে – এ বিষয়ে শিল্পী ছিলেন সচেতন। ইমেজের বিন্যাস যে তলে সম্ভবপর তা এক ভার্চুয়াল তল, যেখানে রেখার গতি, ফর্মের ছন্দনির্ভর এক নির্ভার জগৎ তৈরি করাই ছিল কামরুলের আরাধ্য।

ভাবী প্রজন্মের খোরাক কোনো একটি সমাজে কখনোই অসংখ্য হওয়ার কথা নয়। প্রজন্মের মানস তৈরি করতে সমর্থ এমন বিষয়আশয় তো আরো কমসংখ্যক হওয়াই স্বাভাবিক। জয়নুলের দুর্ভিক্ষ চিত্রমালা, সফিউদ্দীনের সাঁওতাল পরগনার জীবন, কিংবা এস এম সুলতানের কৃষক-বিপ্লবীর উত্থান যেমন বহু প্রজন্মের খোরাক জোগাবে, তেমন কামরুলের সারাজীবনের রেখা ও মোটিফ নির্মাণের কুশলতা ও সৌন্দর্য দেশ-জাতি বা ভাষাগোষ্ঠীর বাইরের দুনিয়াকেও অনুপ্রাণিত করার ক্ষমতা রাখে। কামরুল হাসানের মূল্যায়নের পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করতে রেট্রোসপেক্টিভ প্রদর্শনী হয়তো এখন কামরুলপ্রেমীদের  ভরসা – যার  মধ্যে দিয়ে সাধারণের মধ্যে তাঁর শক্তি তেজ সম্প্রসারিত হবে।

Leave a Reply